প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ১৬

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ১৬
ফিজা সিদ্দিকী

“অপরাধবোধে মারতে চান?”
“মরছো?”
“যদি বলি শেষ হয়ে যাচ্ছি।”
“যে অপরাধ মানুষকে অপরাধবোধের দিকে ধাবিত করে, সেই অপরাধ নিমেষে ক্ষমার যোগ্য। শোনো মেয়ে, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি।”
নন্দিতা খানিকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সাদা ঝকঝকে টাইলস বসানো মেঝের দিকে তাকালো। তখনই তুর্জয় আড়চোখে নন্দিতার দিকে তাকিয়ে রাশভারী কণ্ঠে বলল,
“তবে কতটুকু অপরাধ ক্ষমার যোগ্য এই ভাবনা নাহয় তোমার উপরই ছাড়া থাক। হিসেব নিকেশটা নিজেই করো।”
নন্দিতা করুন চোখে তুর্জয়ের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। অতঃপর ঠোঁটের কোণে ফিচেল হাসি টেনে বিড়বিড় করে বলল,

“আমাদের দুজনেরই দুজনকে ঘৃণা করার কথা ছিল, অথচ নিয়মের ফের বদলে ভালোবেসে ফেললাম। এই প্রেমের ধূলিঝড়, হয় অগোছালো সব গুছিয়ে দেবে নাহয় সবকিছু তছনছ করবে।”
কেবিনে মাথা এলিয়ে বসে আছে তুর্জয়। শরীরটা আজ বিশেষ ভালো নেই তার। অজানা কারণেই বেশ উষ্ণতা টের পাচ্ছে শরীর জুড়ে। গা গোলানো ভাবটাও বেশ তীব্র। বেশ কিছু ক্লায়েন্টকে ফিরিয়ে দিয়েছে আনসার। তুর্জয় যে আজ শারীরিকভাবে বেশ একটা ভালো নেই, এ ব্যাপারটা যেন আগেই টের পেয়েছিল সে। তাইতো তুর্জয়ের শিডিউলে বিশেষ কোনো কেসের ডেট রাখেনি। শুধু আজ নয়, বরং আগামী কয়েকটা দিন বেশ ফাঁকা ফাঁকা শিডিউল তার। এ নিয়ে আনসারের উপর বেশ রাগ দেখাতে মন চাইলো তুর্জয়ের। অথচ তার শরীর সায় দিচ্ছে না। কথা বলার শক্তিটুকু জোগাতে গিয়েও বেশ সময় নিতে হচ্ছে তাকে। বেশ খানিকটা শক্তি সঞ্চয় করে তুর্জয় আনসারকে উদ্দেশ্য করে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আজকে শিডিউল খালি রেখেছ মানলাম। কিন্তু আগামী এক সপ্তাহ এমন ফাঁকা ফাঁকা শিডিউল রাখার মানে কী আনসার? এতো বছর আমার সাথে কাজ করে কী এতটাই দূর্বল মনে হয়েছে তোমার আমাকে? এই সামান্য অসুস্থতা এক সপ্তাহ কাবু করার ক্ষমতা রাখে আমাকে?”
“না না স্যার, আপনি ভুল বুঝছেন আমাকে। এখনকার জ্বর মানুষজনকে বেশ ভোগাচ্ছে, কয়েকটা দিন রেস্ট নেওয়া প্রয়োজন আপনার।”
মাথা নীচু করে মলিন সুরে বলল আনসার। এতে যেন তুর্জয়ের রাগ আরও খানিকটা বেড়ে গেল। শরীরের সমস্ত তেজ একত্রিত করে চিৎকার করে বলল,
“আমার প্রয়োজন, অপ্রয়োজন আমার চেয়ে তুমি বেশি বোঝো? ডোন্ট ইউ ডেয়ার টু ক্রস মাই ডিসিশন। আমি বাড়িতে যাচ্ছি, ফাইলগুলো পাঠিয়ে দিও।”

এরপর আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে গাড়ির চাবি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল তুর্জয়। টলমলে পা, ভারী ওজনের মাথা, টালমাটাল শরীর নিয় গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাতেই যেন শরীর এলিয়ে পড়ল। গাড়ির দরজা খুলতে গিয়ে ঘোলা চোখে একপলক তাকালো আশেপাশে, অতঃপর বেঘোরে পড়ে গেল যেন কোথাও।
এডভোকেট অতন্দ্রি তনুজা একটা কেসের ব্যাপারে ডিসকাস করছিলেন জুনিয়র একজনের সাথে। আচমকা তার চোখ পড়ে খানিকটা দূরে দাঁড়ানো তুর্জয়ের দিকে। বয়সে আর পেশায় দুই দিক থেকেই তুর্জয় যথেষ্ট সিনিয়র তনুজার থেকে। এডভোকেট হওয়ার এই জার্নিতে তার একমাত্র আইডল ছিলো এডভোকেট তুর্জয় আহসান। ল কলেজে পড়াশোনা চলাকালীন কালেভদ্রে দেখা মিলতো তুর্জয়ের। তার ব্যস্ত শিডিউল ফেলে ল কলেজে স্টুডেন্টদের ক্লাস নেওয়ার খুব একটা সুযোগ তিনি পেতেন না। তবে মাঝে মধ্যেই প্রিন্সিপাল স্যারের আবদার একেবারে ফেলতে না পেরে ছুটে আসতেন। ঘণ্টা দেড়েকের ব্যস্ত একটা ক্লাস নিয়ে বেরিয়ে যেতেন নিজের মতো।

তনুজা এই ক্লাসটা কখনোই মিস করতো না। এডভোকেট তুর্জয়ের ক্লাস মানেই আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো ছিল তার কাছে। অবশ্য ক্লাসে পড়ার চেয়ে বেশি যে এই মানুষটার ব্যক্তিত্ব তাকে মুগ্ধ করত, এ বিষয়টা অস্বীকার করার নয়। এ নিয়ে বন্ধু বান্ধবদের মধ্যে বেশ খিল্লি ওড়ানোর পাত্রীও হতো সে। ওইযে মজা করে স্যারদের সাথে কোনো ফ্রেন্ডের নাম জুড়ে দেওয়া, তারপর গোটা সেশন জুড়ে কেমন এক অস্বস্তি নিয়ে তাকালো স্যারের দিকে। এসবের মাঝে কখন যে তনুজা সত্যিকারের প্রেমে পড়ে গেল নিজেও টের পেল না। তার স্বপ্ন ছিলো তুর্জয়ের সমসাময়িক যোগ্যতায় এসে কোনো একদিন নিজের অনুভূতিকে খোলাসা করবে। হয়তো সেদিন প্রত্যাখান করতে পারবে না তুর্জয়। ক্লিল্লি ওড়াতে পারবে না তার অনুভূতিকে নিয়ে। অথচ তার নামের আগে এডভোকেট যোগ হওয়ার সাথে সাথেই তুর্জয়ের নামের আগে ম্যারেড যোগ হয়ে গেল। নিয়তির পরিকল্পনা নিয়ে বড্ডো অভিযোগ তার। কী এমন হতো যদি আর কয়েকটা দিন দেরী করতো? শুনেছে অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ তাদের।

ভাবনার সুতো ছিঁড়ে মনোযোগী দৃষ্টি সামনে ফেলতেই তুর্জয়কে কেমন যেন এলোমেলো ঠেকলো তনুজার কাছে। কেসের ফাইলটা জুনিয়ারের হাতে ধরিয়ে প্রাণপণে দৌড় দিল তনুজা। তুর্জয় ততক্ষণে গাড়ি ধরে নিজেকে সামলে নেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। ঘোলা দৃষ্টিতে গাড়ির দরজা খুলতেও আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। এমন সময় ব্যালেন্স হারিয়ে পড়ে যেতে গেলে তাকে আষ্টেপৃষ্টে আঁকড়ে ধরে তনুজা। ডানহাতে গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে তনুজা উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,
“আপনাকে তো বেশ অসুস্থ লাগছে স্যার। এভাবে ড্রাইভ করে বাড়ি ফিরবেন কীভাবে? আপনি কিছু মনে না করলে আমি আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি?”
তুর্জয় প্রত্যুত্তর করলো না। ততক্ষনে জ্বরের ঘোরে প্রায় সেন্সলেস হওয়ার জোগাড় তার। তনুজা আর উত্তরের অপেক্ষা না করে তুর্জয়কে ধরে নিয়ে এলো গাড়ির অপর পাশে। গাড়ির দরজা খুলে তুর্জয়কে ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে বসিয়ে দিয়ে দরজা লক করে দিলো সে। অতঃপর নিজেও দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেল উল্টো পাশের ড্রাইভিং সিটের দিকে।

“আমার বাড়ির ঠিকানা জানেন?”
“জি স্যার জানি। আপনাকে চিন্তা করতে হবে না।”
“কীভাবে জানলেন?”
জ্বরের ঘোরে যে তুর্জয়ের হুঁশ নেই, এই ব্যাপারটা বেশ আগেই লক্ষ্য করেছে তনুজা। তাইতো খোলা জানালা দিয়ে ভেসে আসা ফিনফিনে বাতাসে উড়তে থাকা চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে আলতো কণ্ঠে বললো,
“প্রিতের খবর যে রাখে, সেই তো প্রিয়জন।”
“প্রিয়জন! হাঃ সবই প্রয়োজন। প্রিয়জন বানাই আমরা প্রয়োজনের তাগিদে। প্রয়োজন ফুরালেই ওইযে রাস্তার পাশে ডাস্টবিন দেখছেন, ওখানে ফেলে দিয়ে চলে আসি আমরা প্রিয়জনদের। তাই প্রিয়জন বলে কিছু হয়না, সবই প্রয়োজন।”

“আপনি এভাবে বলছেন কেন স্যার? বিবাহিত জীবনে ভালো নেই আপনি?”
তুর্জয় গাল বাঁকিয়ে হাসে। এরপর গাড়ির গতির সাথে নিজের মাথা দোলাতে দোলাতে বলে,
“আমাকে ধ্বংস করতে সে এসেছে।”
কথাটুকু বড্ডো নীচু কন্ঠে বিড়বিড় করে বললেও কর্ণগোচর হলো তনুজার। বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠল তার। এতগুলো দিন বাদে পুরোনো অনুভূতিরা রং ভর্তি বেলুনের মতো ভুরভুর করে বের হতে লাগলো। এরপর মিশে গেল রক্তে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
নির্দিষ্ট ফ্ল্যাটের সামনে এসে গাড়ি দাঁড় করালো তনুজা। একহাতে তুর্জয়ের কোমর আঁকড়ে ধরে বেশ কষ্ট করে তাকে টেনে নিয়ে গেল লিফটের কাছে। অতঃপর নির্দিষ্ট ফ্লোরে এসে থামলো সেই লিফট। দরজায় কলিং বেল চাপার আগে তুর্জয় বিড়বিড় করে তনুজাকে বলল,

“ক্যান আই হোল্ড ইউ?”
তনুজা তার বাম হাত এগিয়ে দিলো তুর্জয়ের দিকে। তুর্জয় হালকা হেসে সেই হাতের ভাঁজে নিজের হাত রাখলো। মাথা রাখলো তনুজার কাঁধে। অতঃপর নিভে যাওয়া কণ্ঠে বললো,
“এবার ভেতরে যাব।”

তনুজার রঙিন মন কোকুন থেকে বের হয়ে প্রজাপতির মতো ডানা ঝাপটে উড়তে লাগলো। নতুন করে এ জাগতিক সবকিছু ভালো লেগে লাগ তার। মনে হলো এইতো, এই সময়টায় তো সে চেয়েছিল। এতটুকু কাছে, এতটুকু পাশে, হয়তো এরচেয়ে বেশি কাছে চেয়েছিল সে তুর্জয়কে। অপত্যাশিতভাবে এটুকু যখন পেয়েছে, বাকিটুকু পাওয়ার রাস্তা সে নিজেই বানিয়ে নেবে। কিংবা হয়তো তুর্জয় নিজেই এভাবে আরও কাছে টেনে নেবে তাকে। ঠোঁটের কোল গলে গদগদ হওয়া হাসির রেশ নিয়েই সে চাপ দিলো দরজার পাশের কলিং বেলে। তুর্জয়ের ঠোঁটে ততক্ষণে বাঁকা হাসি। মনে চলছে বিশেষ কিছু পরিকল্পনা। সেটুকু বহাল রেখেই মনে মনে আওড়ালো,

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ১৫

“মিসেস আহসান, এই ঝড় সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। আমাকে ভাসাতে এসেছিলেন, অথচ আমি আপনার সবকিছু ভাসিয়ে দেব, ভালোবেসে। কারন এ যে প্রেমের ধূলিঝড়।”

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ১৭