প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ১৭

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ১৭
ফিজা সিদ্দিকী

পরনারীর বাহুতে আবদ্ধ স্বামীকে টালমাটাল অবস্থায় দেখে বুকের মাঝে তুফানি ঝড় বয়ে গেল নন্দিতার। হৃদয়ের ক্ষুদ্র কুঠুরি রক্ত সঞ্চালন ক্ষমতা গড়িয়ে বিবশ হলো তৎক্ষণাৎ। বন্ধ হলো হৃদস্পন্দন। বাতাসে ভাসমান অজস্র অক্সিজেন, অথচ গোটা দুনিয়ায় তার জন্য বরাদ্দকৃত অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দিলো। নন্দিতা তবে থেমে রইলো না। চিল যেমন দূর আকাশ থেকে তার খাদ্যকে নিশানা বানিয়ে দ্রুত গতিতে ডানা ঝাপটে ছোঁ মেরে তার কাঙ্খিত বস্তুকে ছিনিয়ে নেয়, নন্দিতাও একইভাবে তার নিজস্ব ব্যক্তিগত পুরুষকে ছোঁ মেরে ছিনিয়ে নিলো তনুজার বাহু বন্ধনী থেকে। তার উগ্র চাহনী, স্পষ্ট অধিকারবোধ, তুখোড় ব্যক্তিত্বর সামনে না চাইতেও নুইয়ে পড়লো তনুজা। যতই হোক, স্পষ্ট অধিকারবোধ তার নেই।

“একজন বিবাহিত পুরুষের থেকে ততটুকু দূরত্ব রাখা উচিত যতটুকু দূরত্ব রাখলে কেউ আপনাকে ব্যভিচারিণী উপাধি না দিতে পারে।”
নন্দিতার হাস্যোজ্বল মুখের সাথে তীব্র অপমানজনক কথাটুকু যথেষ্ট ছিল তনুজার ব্যক্তিত্বের মোড়কে চিড় ধরানোর জন্য। মুখে হাসি অথচ কথার তীব্র ধার একসাথে কিভাবে প্রয়োগ করা যায়, এতো বছরের জীবনে আজ তনুজা প্রথমবার বুঝলো। আর তাইতো জ্বালাময়ী এক লেলিহান শিখা বয়ে গেল তার শরীর জুড়ে। দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে যথাসাধ্য সংবরণের তীব্র প্রয়াস চালিয়ে সে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“সবার মুখে সব কথা মানায় না। যে স্ত্রীর তার স্বামীকে খুশি রাখার ক্ষমতা নেই, সেই স্ত্রীর মুখটা জিপারের মতো ক্লোজ করে দিতে আমি জানি। তবে, রাস্তার সব মানুষের সাথে মুখ লাগানোর অভ্যাস অন্তত আমার নেই।”
“ঠিক যেমন আপনাকে এই সাদা শাড়িতে মানাচ্ছে না। ভালো করে দেখুন, আপনার মনের নোংরা প্রবৃত্তির কালিমা এই সাদা শাড়ীকে নোংরা করো ফেলেছে একদম। হয় মন শুদ্ধ করুন নাহয় পোশাকের রং। সব রঙে সবাইকে মানায় না।”

নন্দিতার প্রতিটা কথার মাঝে তার রাগ, ঘৃণার ঝলক স্পষ্ট। অথচ মুখে ধরে রাখা সেই কোমল হাসিটুকু নজর কাড়লো তনুজার। এই প্রথমবার তার মনে হলো মেয়েটা অদ্ভূত। এতখানি অদ্ভূত মেয়ে সে তার গোটা জীবনেও দেখেনি। মুখের মিষ্টি হাসি দিয়ে সে অনায়াসে মানুষ খুন করার মতো ক্ষমতা রাখে। আর এই ভাবনাটুকুই তাকে আরও বেশি চিন্তিত করে তুললো। ভাবতে বাধ্য করলো তুর্যয়কে নিয়ে। লম্বা একটা শ্বাস টেনে ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে তুলল তনুজা। কণ্ঠের স্বর খানিকটা গাঢ় করে বলল,
“আমার ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট দেওয়ার আগে নিজের দিকে তাকান একবার। যার স্বামী অন্য মেয়ের বাহু আঁকড়ে ধরতে চায়, তাকে এতো বড় বড় কথায় ঠিক মানায় না।”
“এক্সাক্টলি, মিস..যাইহোক নাম জানাটা খুব একটা ইম্পর্টেন্ট বিষয় নয়। কারন কিছু মানুষের কাজই তাকে তার নামের চেয়ে বড়ো উপাধিতে পরিচিত করে ফেলে।”

নন্দিতার কথা শেষ হওয়ার আগেই তুর্জয় তার হাত এলোমেলোভাবে বিচরণ চালালো নন্দিতার কোমরে। কাঁধে রাখা মাথাটা খানিকটা কাত করে উষ্ণ ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো তার ঘাড়ে। ফিসফিস করে বলল,
“এতো টাইম ওয়েস্ট করতে হয়না, আমার জন্য সময় কম পড়ে যাবে।”
নন্দিতা মনে মনে তীব্র রাগে ফেটে পড়লো তুর্জয়ের উপর। অথচ মুখে তার লেশমাত্র না রেখে ঠোঁটের কোণের হাসিটুকু চওড়া করে তনুজাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“দেখুন, আমার হাসবেন্ডের আর তর সইছে না।ডেসপারেটলি অপেক্ষা করছেন আমাদের কোয়ালিটি টাইমের জন্য, আশা করছি এখানে দাঁড়িয়ে নিজের চোখে সেসব দেখতে খুব একটা সাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন না। আপনি এখন আসতে পারেন।”

তীব্র অপমানে গা রি রি করে উঠলো তনুজার। কিছু বলতে গিয়েও থেমে পা বাড়ালো উল্টো পথে। নন্দিতা তৎক্ষণাৎ খট করে দরজা লাগিয়ে গায়ে লেগে থাকা ময়লার মতো করে ঝেড়ে ফেললো তুর্জয়কে। আচমকা ঝটকায় বেসামাল হয়ে ধপ করে মেঝেতে পড়ে গেল তুর্জয়। নন্দিতা দুই হাত বুকে গুঁজে দূরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলো তুর্জয়ের দিকে। কোমরের ব্যথায় ছলছল করে তাকিয়ে আছে সে তার দিকে। তুর্জয়কে নিজের দিকে এভাবে তাকাতে দেখে নন্দিতা হাসতে হাসতে বললো,

“মেয়েটাকে ডেকে দেব? এতটা রাস্তা তার কোলে চড়ে যখন এসেছেন, বেডরুমেও নাহয় সেই নিয়ে যাক।”
“বেডরুমে নিয়ে যাওয়ার জন্য তুমি আছো তো। ওখানে অন্য মেয়ে ঢুকবে কেন?”
তুর্জয়ের আলাভোলা চেহারায় ইনোসেন্ট মার্কা কথা শুনে গরম তেলে পানি ঢালার মতো ছ্যাঁত করে উঠলো নন্দিতা। তেড়ে গিয়ে তুর্জয়ের শার্টের কলার পাকড়াও করে হিশহিশিয়ে বললো,
“ঘরে বউ আছে, এটা আগে মনে ছিল না? বাইরের মেয়েদের সাথে ফষ্টিনষ্টি করতে বেশ মজা লাগে না?”
“বউ তো ঘরে, তাহলে বাইরে কাউকে লাগবে না!”
এতো কাছাকাছি এসে নন্দিতা স্পষ্ট টের পেল তুর্জয়ের শরীরের উষ্ণতা। তাই খানিকটা রাগ গিলে ফেলে অভিমানী কণ্ঠে বললো,

“মেয়েটা কোথায় কোথায় ছুঁয়েছে আপনাকে, বলুন তো!”
“বললে?”
“সেই জায়গার চামড়া উঠিয়ে ফেলবো আমি।”
তুর্জয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে বলে নন্দিতা। তুর্জয় চোখ বড় বড় করে নন্দিতার দিকে তাকালো। জ্বরের ঘোর অনেকটা কমে এসেছে তার। শরীরের উষ্ণতাও আগের তুলনায় বেশ কম। যেটুকু ঘোর চোখে লেপ্টে রয়েছে সেটুকু ছাড়াতে মাথা ঝাড়া দিলো তুর্জয়। অতঃপর নন্দিতার দিকে খানিকটা এগিয়ে ফিসফিস করে বললো,
“যদি না বলি?”
“তাহলে গোটা শরীরের চামড়া উঠিয়ে রোদে শুকাতে দেব। এরপর সেটা আপনার ওই মেয়ে কলীগের কাছে পার্সেল করে দেব।”
“কী সাংঘাতিক মেয়ে রে বাবা! এই এই তোমার বোকা বোকা ভাব কোথায় গেল? এমন সিংহিনী হয়ে উঠলে কবে থেকে?”

“যবে থেকে আপনার আশেপাশে অন্য নারীকে দেখেছি। স্বামীর পাশে অন্য নারীকে সহ্য করার চেয়ে সেই স্বামীকে লবণ মরিচ মিশিয়ে ফ্রাই করে ফেলা অনেক বেটার। অ্যান্ড আই উইল ডু ইট।”
কথাটুকু শেষ করে নন্দিতা উঠে যেতে গেলে হাত ধরে টান দিয়ে ঝট করে তাকে মেঝেতে ফেলে দেয় তুর্জয়। অতঃপর নন্দিতার শরীরের উপর আধশোয়া হয়ে ঠোঁটে বাঁকা হাসি টেনে ধরে মুখ ডোবায় গলায়। নন্দিতা চমকে ওঠে। হুশিয়ারি জাহির করে বলে,
“একদম না। কাল ওই বাড়িতে যেতে হবে আমাদের।”
“তাতে কী?”
নন্দিতা তুর্জয়কে ধাক্কা দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে বেখেয়ালি কণ্ঠে বলে,

“ক্ষতবিক্ষত না করে ছাড়েন না আপনি। এমন দাগ নিয়ে ওখানে যাব কিভাবে?”
“শুধু তো কামড়ের দাগ পড়ে, ইচ্ছে তো করে তোমাকে পুরোটাই খেয়ে ফেলি।”
“ছিঃ! অসভ্য। ছাড়ুন আমাকে।”
তুর্জয় গলা থেকে মুখ তুলে ভ্রু উঁচিয়ে তাকায় নন্দিতার দিকে। মেকি রাগ দেখিয়ে বলে,
“আমাকে অসভ্য বানিয়েছে কে?”
“আপনাকে যে সৃষ্টি করেছে আর আপনাকে যে জন্ম দিয়েছে তাদের মধ্যেই কেউ।”
“উহু! সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টি করেই খালাস, জন্মদাতা জন্ম দিয়ে হাত গুটিয়ে নিয়েছে, কিন্তু আপনি আমাকে অসভ্য, নির্লজ্জ, সবচেয়ে বেহায়া পুরুষ মানুষ বানিয়েছেন। এখন এগুলো সহ্য করার জন্যও রেডি থাকুন।”
নন্দিতা আকাশ থেকে পড়ার মতো চমকে তাকায় তুর্জয়ের দিকে। গলা উঁচিয়ে বলে,
“মিথ্যা। আমি কিছু করিনি। সাইলেন্সার থেকে অসভ্য পুরুষ হওয়ার জার্নি আপনার একার। আমার এতে কোনো হাত নেই।”
“হাত নয়, বৃষ্টিভেজা তোমার ওই লাস্যময়ী দেহটাই দায়ী সবকিছুর জন্য।”

ঘন কালো আঁধারি ঘরের দরজা ঠেলে লুকিয়ে চুরিয়ে প্রবেশ করছে কেউ। চারিদিকে সাবধানী দৃষ্টি মেলে সে এসে দাঁড়ালো একটা চেয়ারের সামনে। চেয়ারে বাঁধা এক ভদ্রমহিলা জীর্ণ চোখে তাকালো আগত মানুষটার দিকে। চোখে মুখে তার শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ। ঠোঁটের কোল ঘেঁষে এখনও তাজা রক্তের দেখা মিলছে। অথচ ভদ্রমহিলা ঠাঁয় বসে আছে। কঠোর তার দৃষ্টি। দৃষ্টির গভীরতা দিয়েই যেন সামনের মানুষটাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে সে। আজগার জলিলের বড্ডো জানতে ইচ্ছে করে এই ভদ্রমহিলা কে? কী বা সম্পর্ক তার তুর্জয়ের সাথে। যাকে বাঁচাতে গিয়ে এতখানি কাঠখড় পোড়াচ্ছে সে। শিকদারের ডেরায় থেকে তার নাকের উপর দিয়েই ঘুটি খেলার মতো সাহস যে সে মানুষের থাকে না। অথচ তাদের হাতে নিপীড়িত হয়েও এখনও তার জেদ, স্পৃহা দমাতে পারেনি কেউ। কোনরকম টর্চার বাদ রাখেনি, অথচ কোনোভাবেই নিজের মুখ খোলেনি এখনও এই ভদ্রমহিলা।

“কাজ হয়েছে?”
জরাজীর্ণ কণ্ঠের আওয়াজে ধ্যানভঙ্গ হয় আজগার জলিলের। এই ডেরার দারোয়ান তিনি অনেক বছর ধরে, শিকদারদের বিশ্বস্ত সঙ্গী। অথচ তার মতো মানুষকে কিনা এই ভদ্রমহিলা শিকদারদের বিপক্ষে ব্যবহার করছে। তেরচা দৃষ্টি ফেলে আজগার সাহেব বলেন,
“আপনি যেভাবে বলেছিলেন সেভাবেই সব হয়েছে। এখন আমার পাওনাটা দিন।”
ভদ্রমহিলা তাকে হাতের ইশারায় কাছে আসতে বললো। আজগার জলিল তার দিকে এগিয়ে যেতেই ভদ্রমহিলা নীচু কন্ঠে হুশিয়ারি দেওয়ার ভঙ্গিমায় বললেন,
“আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে পারি তাইনা?”
“জি ম্যাডাম। আমার এতো বড় বিপদে আপনি যেভাবে সাহায্য করছেন, নাহলে শিকদারদের বিপক্ষে যাওয়ার মতো ক্ষমতা আমার ছিলো নাকি? আমি জানি আমি বাঁচব না। শিকদাররা ধরা পড়লে পুলিশের হাতে মরবো। আর ধরা না পড়লে তাদের হাতে মরবো। মৃত্যু যখন আমার কপালের লিখন, তখন নাহয় পরিবারটাকে বাঁচিয়ে নিজে একাই মরি।”

ভদ্রমহিলা হালকা হেসে বলেন,
“হাতের বালাজোড়া আর আংটিটা খুলে নাও।”
চেয়ারে বেঁধে রাখা হাত থেকে আজগার জলিল একজোড়া মোটা স্বর্ণের বালা আর একটা বিশেষ ধরনের পাথরের আংটি খুলে নিতেই ভদ্রমহিলা কন্ঠ খাদে ফেলে নীচু কণ্ঠে বললেন,
“বালা জোড়া বিক্রি করে তোমার স্ত্রী আর ছেলেকে অনেক দূরে পাঠিয়ে দাও। বাকি টাকা তাদের হাতেই দিয়ে দিও। আর এইযে আংটি, এটা তোমাকে পৌঁছে দিতে হবে এডভোকেট তুর্জয় আহসানের কাছে। কাজটা কিন্তু অনেক সাবধানে করতে হবে তোমাকে। কাজটা ঠিকমতো করতে না পারলে শিকদারদের পিঠ পিছে কী করেছ, জানিয়ে দেব আমি তাদের। এরপর না বাঁচবে তুমি, না তোমার পরিবার। মনে রেখো।”
আজগার জলিল মাথা নত করে সম্মতি জানায় তাকে। অতঃপর আগের মতোই নিশ্চুপে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।

নন্দিতা তুর্জয়কে ধাক্কা দিয়ে নিজের উপর থেকে ফেলে দেয়। অতঃপর শার্টের কলার ধরে টানতে টানতে তাকে নিয়ে যায় বেডরুমের দিকে। তুর্জয় অসহায় ভঙ্গিতে নন্দিতাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“আরে আরে কী করছো? আমি কিছুই করিনি বিশ্বাস করো। যা করার তনুজা করেছে। আমি একদম পবিত্র আছি বউ। টেস্ট করে দেখো একদম শুধু তোমার গন্ধ পাবে আমার শরীর থেকে।”

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ১৬

“একদম বাজে বকবেন না আপনি। কতো বড়ো সাহস, অন্য মেয়ের কোলে চড়ে ঘরে আসেন।”
তুর্জয় অসহায় ভঙ্গিতে বলে,
“তুমি চাইলে তোমার কোলে আমি সারাদিন উঠে বসে থাকতে পারি। চাইলে কোল ছেড়ে বুকে আসতেও রাজি আমি।”

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ১৮