প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৩১
ফিজা সিদ্দিকী
সকালের নিস্তেজ রোদ চোখে এসে পড়তেই ঘুম পাতলা হয়ে আসে তুর্জয়ের। কিন্তু মাথার ওজনে ঘাড় সহ পুরো শরীর যেন ব্যথাগ্রস্থ। দুই চোখে পাতা মেলে ধরা বড্ডো কষ্টসাধ্য হলেও মাথায় দুই হাত চেপে ধরে চোখ মেলে তুর্জয়। বুকের উপর ভারী কিছু অনুভব করতেই ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুমন্ত নন্দিতাকে দেখে মুচকি হাসে। ঠোঁট বাড়িয়ে চুমু খেতে যায় কপালে। সাথে সাথেই গতরাতের সব ঘটনা একের পর এক ভেসে ওঠে তার স্মৃতিপটে। নন্দিতাকে বুকের উপর থেকে সরিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয় সে তৎক্ষণাৎ। অতঃপর সরাসরি ঢুকে পড়ে ওয়াশরুমে।
দীর্ঘ একটা শাওয়ার শেষে নিজেকে খানিকটা হালকা লাগছে তুর্জয়ের। শিকদারদের কেসটানিয়ে বেশ কিছু এভিডেন্স জোগাড় করতে হবে তাকে। আর মাত্র দুইদিন পর করতে উঠবে কেসটা। এই কেসটা নিয়ে অনেক বেশী প্রস্তুতি নিয়েছিল সে। কিন্তু এখন তার কোনকিছুই হাতে নেই তুর্জয়ের। এই কয়েকদিনে কিছু তথ্য, কাগজ সংগ্রহ করলেও সেই স্ট্রং এভিডেন্সগুলো লাপাতা। আড়চোখে একবার ঘুমন্ত নন্দিতার দিকে তাকিয়ে লম্বা শ্বাস ফেলে। ব্যক্তিগত জীবনকে একপাশে রেখে মনোযোগ দেয় এই কেসের প্রতি।
আলমারি থেকে কোর্ট বের করতে গিয়ে আচমকা তুর্জয়ের চোখে পড়ে সেই আংটিটা। ব্যস্ততায় এতদিন বেমালুম ভুলে গিয়েছিল সে। ঠিক সেই মুহূর্তে নড়েচড়ে ওঠে নন্দিতা। আলতো চোখ খুলে তুর্জয়কে রেডি হতে দেখে তড়িঘড়ি করে নেমে পড়ে বিছানা থেকে। ব্যস্ত কণ্ঠে বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“এখনই বেরিয়ে যাচ্ছেন আপনি? একটু অপেক্ষা করুন, এখনই নাস্তা রেডি করে দিচ্ছি।”
“লাগবে না। বাইরে খেয়ে নেব।”
কথাটুকু শেষ করে নন্দিতার দিকে না তাকিয়েই আলমারিটা বন্ধ করলো তুর্জয়। গায়ে জড়িয়ে নিলো ব্ল্যাক কোর্ট। অতঃপর ড্রেসিংটেবিলের উপর স্বর্ণের সেই আংটিটা রাখতে রাখতে বলে উঠলো,
“আপনার কোনো আশিক দিয়েছে সম্ভবত। যার কিনা আব্বুর বাড়ীর ঠিকানাও মুখস্ত।”
শেষের কথাটুকু বড্ডো তাচ্ছিল্যের সাথে বলে উঠলো তুর্জয়। নন্দিতা আহত চোখে তুর্জয়ের দিকে তাকালো। তবে উল্টোপিঠ করে থাকায় তা চোখে পড়ল না তুর্জয়ের। বরং নন্দিতাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে।
নন্দিতা চটজলদি বসে পড়লো বিছানায়। শরীরটা তার বাহলো যাচ্ছে না। অথচ মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে একরাশ প্রশ্ন। ফোনটা হাতে নিয়ে সরাসরি সে ফোন করলো ধূসরকে। কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর ঘুম বিগলিত কণ্ঠে ধূসর বললো,
“হুম ডার্লিং, এতো সকাল সকাল কল। মিসিং মি রাইট?”
“গালের নীচে দুইটা থাপ্পড় দিয়ে সবকয়টা দাঁত ফেলে দেব ফাজিল ছেলে। অন্যের বউকে ডার্লিং বলতে তোর রুচিতে বাঁধে না?”
“সকাল সকাল বরের বুকে থেকে আদর খাওয়া ছেড়ে কেউ যদি আমাকে কল দেয়, তাহলে আমার আর কী দোষ? আসলে মর্নিং আদর যে বেশি রোমান্টিক ফিল দেয়, এডভোকেট তুর্জয় আহসান বোধহয় জানে না।”
“আদর কী আর কখন করতে হয়, সেটা তো মতো লম্পটের কাছ থেকে আমার হাসবেন্ডকে শিখতে হবে না। তোর মতো ছেলেরা শুধু ওই রাস্তার মেয়েদের উত্তেজনার জন্যই পারফেক্ট। ঘরের বউদের যোগ্য না।”
“উফ্! তোমার এই আদাহ, প্রেমে পড়ে গেলে কিন্তু দোষ দিও না আমার।”
নন্দিতা এবার অধৈর্য্য হয়ে পড়ে। দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
“আর একটা ফালতু কথা বললে তুর্জয়কে এখনই সব বলে দেব আমি।”
ধূসর এবার যেন খানিকটা নড়েচড়ে ওঠে। হালকা কেশে সাবলীল কণ্ঠে বলে,
“বলো, কিসের জন্য কল দিয়েছ?”
“আর যাই হোক শিকদাররা শত্রুতাটা অন্তত ঈমানদারীর সাথে করে বলে জানতাম আমি এতদিন। কিন্তু এখন তো দেখছি শিকদাররা আস্ত এক ভীতু, চোর। চুরি করে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি।”
বাপ, চাচার এই অহংয়ের উপর নন্দিতার আক্রমণাত্মক কথাগুলো ধূসরের ইগোতে আঘাত করে। তেতে উঠে খানিকটা হুংকার ছেড়ে বলে ওঠে,
“ভদ্রভাবে কথা বলো, শিকদাররা বেঈমান না। শত্রুতাও তারা সৎভাবেই করে।”
“লোকের ফাইল চুরি করে সব তথ্য লোপাট করার মতো কাজকে বলে চুরি। নাম শুধু বড়ো বড়ো কাজটা ওই ছিঁচকে চোরের মতোই ছোটো মতো।”
কথাটুকু শেষ করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো নন্দিতা। ধূসর ততক্ষণে রাগে ফুঁসে উঠেছে। কমতেহর তেজ বাড়িয়ে চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করলো,
“চুরি? কিসের চুরি? শিকদারের খেয়ে কাজ নেই, তারা করবে চুরি?”
“সামান্য একজন এডভোকেটের ফাইল চুরি করেছে শিকদাররা। ছিঃ বিষয়টা কী লজ্জার! বাপ দাদাদের ঐতিহ্য ডুবিয়ে ছেড়ে দিলো একদম।”
কথাটুকু বলে হাসতে হাসতেই সাথে সাথে কল কেটে দিলো নন্দিতা। অতঃপর লম্বা একটা শ্বাস নিলো। ভীষণ ডেঞ্জারাস একটা খেলা খেলল সে। একদিনের পরিচয়েই ধূসর শিকদারের সব তথ্য বের করে ফেলেছে সে। শিকদার বাড়ির সবচেয়ে আহ্লাদের ছোট ছেলে ধূসর শিকদার। সারাদিন নেশায় ডুবে থাকা, মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করা আর বাপ, চাচার টাকার উপর আয়েশ করে বাঁচা তার মুখ্য কাজ। সাথে কথায় কথায় শিকদার নামের বড়াই করতেও পিছপা হয়না। তার মতে শিকদাররা হলো সিংহের বাচ্চা। সিংহের ঘরে ঢুকে তার চানা চুরি করে আনার মতো দুঃসাহসিক ক্ষমতা আছে শিকদারদের। আর আজ সেই অহংবোধের উপরেই হামলা করেছে নন্দিতা। উগ্র মেজাজের ধূসর শিকদার নামের বদনাম আবার সইতে পারে না সহজে। দেখা যাক, এরপর কী করে সে!
আংটিটা নাড়াচাড়া করে বেশ অনেকক্ষণ সময় নিয়ে দেখছে নন্দিতা। কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে তার আংটিটা। কোথায় যেন দেখেছে। কিন্তু কোথায় দেখেছে মনে করতে পারছে না ঠিক। খানিকটা সময় ধরে ঘরের এদিক সেদিক পায়চারি করতে করতে আচমকা তার মনে পড়ে যায় এই আংটিটা তো মায়ের হাতে থাকতো সবসময়। বিশেষ এক কারণে, এটা কখনোই নিজের কাছছাড়া করতেন না তিনি। কিন্তু মায়ের আংটি এতদিন পর কে বা দিয়ে যাবে তাকে? ভাবনারা অস্থির করে তুলল তাকে। এমন সময় তার মনে পড়ে গেল মায়ের সেই ডায়রির কথা। যেটা ওই বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিল সে।
গেস্ট রুমে ঢুকে ট্রলিব্যাগ দুটো টেনে বের করলো নন্দিতা। এক এক করে দুইটা ব্যাগ খুলে অবশেষে খুঁজে পেল তার কাঙ্খিত জিনিসটা। অতঃপর ডায়রিটা নিয়ে রুমে এসে বসতেই বিছানায় পড়ে থাকা ফোনটা বেজে উঠলো সশব্দে। নন্দিতা ফোনটা কানে ঠেকাতেই ধূসর তার হাতে থাকা ফাইলটা নাড়াচাড়া করতে করতে রসিকতার সুরে বলল,
“এডভোকেট তুর্জয় আহসান দেখছি বেশ অনেক তথ্য জোগাড় করে ফেলেছে। ইমপ্রেসিভ। কিন্তু শিকদারদের ধ্বংস করা এত সহজ নয় বেইব।”
“আপনার অহেতুক প্রলাপ শুনতে আমি একটুও ইন্টারেস্টেড নই। নেক্সট টাইম কল দেবেন না।”
নন্দিতার রাগী কণ্ঠে শুনে ধূসর খানিকটা হতাশ হওয়ার ভঙ্গি করে বলল,
“যাহ! আমি ভাবলাম এই ফাইলটা তোমার হাতে হ্যাণ্ডওভার করবো। কিন্তু তুমি যখন চাইছো না তখন….”
“কোথায় আসতে হবে?”
“আগে বলো, এর বিনিময়ে আমি কী পাব?”
ধূসরের রহস্যময়ী ভঙ্গিমায় কথা শুনে শুকনো ঢোক গিললো নন্দিতা। অতঃপর কাঁপা কণ্ঠে বলল,
“কিসের কথা বলছেন আপনি?”
প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৩০
“এই তুই, এই আপনি, উম রেগে গেলে তুই ডাকটা কিন্তু কিউট লাগে। একদম কাছের কাছের ফিল দেয়। আজ যদিও বেশি কিছু চাইব না। তোমার ঐ সুইট সুইট হাতে একটু সুইট কিছু বানিয়ে খাইয়ো। আমি তোমার বাড়িতেই আসছি।”
নন্দিতা কয়েকটা কড়া কণ্ঠে শুনিয়ে বারণ করতে গিয়েও পারল না। আপাতত এই ফাইলটা অনেক জরুরী তাদের জন্য। তাই ধূসরের কথা মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।