প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৩৫

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৩৫
ফিজা সিদ্দিকী

রাত তখন গভীর। নন্দিতা তুর্জয়ের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে। দুজনের মাঝের মান অভিমানের দেয়াল গলে গিয়ে বোঝাপড়াটা বেশ সহজ হয়েছে। নন্দিতা স্বামীর বুকে মাথা রেখে হৃদস্পন্দনের শব্দ শুনছে। মস্তিষ্কে তার খেলা চলছে নানান পরিকল্পনার। আচমকা তুর্জয়ের বুক থেকে মাথা তোলে নন্দিতা। সিরিয়াস ভঙ্গিতে তাকে কিছু বলতে যাবে, এমন সময় তুর্জয় জোর করে আবারও চেপে ধরে নন্দিতার মাথা তার বুকে। হুঁশিয়ারি কণ্ঠে বলে,
“একদম উঠবে না। শুয়ে থাকো চুপচাপ। কতদিন তোমাকে বুকে পাইনি।”

“কতদিন আর কই? এইতো মাত্র কয়দিন।” নন্দিতা অবাক হওয়ার ভঙ্গিমায় বলে ওঠে।
“তুমি আমার হৃদস্পন্দন। স্পন্দন ছাড়া হৃদয় বেঁচে থাকতে শুনেছ? আর হৃদয় ছাড়া মানুষ? মৃত প্রায় মানুষটা এতোদিন পর তার স্পন্দন খুঁজে পেয়েছে, তাকে বাঁচতে দাও। বেঁচে উঠতে দাও।”
কাঠখোট্টা গম্ভীর স্বভাবের তুর্জয়ের মাঝের এ আমুল পরির্বতন দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলো নন্দিতা। তুর্জয় একনিষ্ঠভাবে তাকিয়ে থাকলো নন্দিতার এই হাসির দিকে। যেন কতকাল পরে এ ঘরে হাসির কলতান উঠেছে। কতকাল পর এ ধরনীতে চাঁদ নেমেছে। কতকাল পর প্রকৃতি মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিচ্ছে, হাসছে, খেলছে, আসল অর্থে বাঁচছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বেঁচে থাকা অর্থ ভালো থাকা নয়। ভালো থাকা r বেঁচে থাকার মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। ঠিক যেমন একজন কোমা পেশেন্ট আর একজন সুস্থ সবল মানুষ। দুজনেই বাঁচছে, অথচ ভালো থাকছে কি?
“আমাদের আলাদা থাকতে হবে তুর্জয়।”
চোখ বুঁজে নন্দিতাকে বুকে জড়িয়ে পূর্ণিমা রাতের জোৎস্নাবিলাসে নেমেছিলো তুর্জয়। একটা কাঠের নৌকা, আর ছেড়ে দেওয়া বৈঠা ভেসে চলেছে নদীর স্রোতের সাথে। ঠিক যেমনটা ভেসে চলেছে তাদের জীবন। এ কল্পনা বড়োই মধুর, বড়ই তৃপ্তিদায়ক। কিন্তু নন্দিতার কথায় আচমকা কল্পনার জগত থেকে বাস্তবে ফিরে হকচকায় তুর্জয়। ভ্রু কুঁচকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে নন্দিতার দিকে। অস্বস্তিতে বুঁদ হয়ে নন্দিতা উঠে বসে। খানিকটা মোচড়ামুচড়ি করতে করতে বলে,

“আমরা সেপারেট থাকতে পারিনা কিছুদিনের জন্য?”
তুর্জয় ঝট করে হাত বাড়িয়ে টেবিল ল্যাম্প নিভিয়ে দেয়। উল্টপাশ ফিরে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিয়ে রুঢ় কণ্ঠে বলে,
“কথা শেষ হয়েছে, এবার ঘুমাও।”
“আমি কিন্তু সিরিয়াস।”
“আমিও ছেলেভোলানো কথা বলছি না। এই কথা এখানেই শেষ।”
নন্দিতা এবার খানিকটা তেজি কণ্ঠে বলে ওঠে,
“শেষ? শেষ মানে কী? আপনি বললেই শেষ, আপনি বললেই শুরু? আমার কথার কোনো গুরুত্ব নেই? ধৈর্য্য ধরে কথাটুকু শোনার পর্যন্ত সময় নেই আপনার।”
“আছে, অবশ্যই গুরুত্ব আছে। তোমার চাওয়া, পাওয়া, ভাবনা সবকিছুর গুরুত্ব আছে আমার কাছে। কিন্তু অহেতুক আবদারের কোনো গুরুত্ব নেই।”

“আপনি আমার পুরো কথাটা তো শুনুন!”
“যে কথার শুরু হয় তোমার আমার দূরত্বে, সেই কথা সেই মুহূর্ত, সেখানেই শেষ।”
“এতো একরোখা কেন আপনি?”
“আমি এমনই, ঘুমাতে যাও।”
“আমিও কিন্তু কম জেদি না।”
তুর্জয় এবার নন্দিতার দিকে মুখ ঘুরিয়ে অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বলে ওঠে,
“আমার সাথে জেদ দেখাতে এসো না, সব শেষ হয়ে যাবে।”
“ভয় দেখাচ্ছেন?”
“সতর্ক করছি।”
“তবে তাই হোক। জেদ আমি ধরেই রাখবো এবার। দেখা যাক কতটুকু শেষ হয় আমাদের সম্পর্ক।”
আচমকা তুর্জয় নন্দিতার বাহু ধরে টান দিয়ে তাকে চেপে ধরলো বিছানায়। শরীরের সমস্ত ভর তার উপর ছেড়ে দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,

“কী শেষ হবে?”
নন্দিতা রাগে, জেদে তুর্জয়ের চোখে চোখ রেখে বলে, “আমাদের সম্পর্ক”
তুর্জয় সাথে সাথেই নন্দিতার গলায় মুখ ডোবালো। শিহরণে তুর্জয়ের পিঠের জামা আঁকড়ে ধরতেই, জোরে একটা কামড় বসালো তুর্জয়। ব্যথায় চিৎকার দিয়ে তুর্জয়কে নিজের উপর থেকে সরিয়ে দিতে উদ্যত হলে একচুল পরিমাণ নড়লো না তুর্জয়। বরং গলায় মুখ ডুবিয়ে গভীর কণ্ঠে বললো,
“আমার মৃত্যু এসে গেলেও তোর হাত ধরে মরবো। পারলে এরপর ছাড়িয়ে নিস নিজেকে আমার থেকে, এর আগে না।”

খুব ভোরে উঠে নন্দিতা লাগেজ গুছিয়ে রাখলো। এরপর কিচেনে গিয়ে বেশ কয়েক রকম পদের রান্না চড়ালো। তরকারি নাড়তে নাড়তে হাতে হাতে সবজিও কেটে নিলো। গ্যাসের দুইদিকে কড়াই চড়িয়ে ব্যস্ত হাতে লেগে পড়লো সে। কিচেনের গরমে, ঘামে, তেলে শরীর হয়ে উঠলো চিপচিপে। যেহেতু তুর্জয় এখনও ঘুমে, তাই রাতের পরা তুর্জয়ের ওই ঢিলেঢালা শার্টটাই এখনও তার পরনে। গরমে বেশ শান্তি দিচ্ছে এটা।

সকাল সকাল রান্নাঘরের কড়া খুন্তির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল তুর্জয়ের। পাশ ফিরে নন্দিতাকে না পেয়ে ঘুম ঘুম চোখে বেরিয়ে এলো সে ঘর থেকে। বিরক্তি তখন তার চরমে। নন্দিতার জ্বর কমতে কমতে বেশ রাত হয়েছিল। রাত করে ঘুমিয়েছিলো বিধায় একটু বেলা পর্যন্ত ঘুমানোর কথা ভাবছিলো। কিন্তু এত সকালে তেল মশলার ঝাঁঝ আর খুন্তি নাড়ার শব্দে ভেঙ্গে যায় তার কাঁচা ঘুম। ফলে বিরক্তিমাখা চোখ মুখ নিয়ে এসে এগিয়ে যায় রান্নাঘরের দিকে।
রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে তার চোখ মুখের বিরক্তি উবে গিয়ে সেখানে ভর করে মুগ্ধতা। গরমের তাপে, মশলার তেলে নন্দিতার কোমল মুখটা চকচক করছে। পরনের হাঁটু অব্দি টি শার্টে কী যে মোহনীয় লাগছে তাকে! তুর্জয় এগিয়ে যায়। নন্দিতার পিছনে দাঁড়িয়ে চিমনি অন করে দিতে দিতে বলে,

“ভেবেছিলাম এসেই কয়েকটা ঝাড়ি দেব, চিমনি অন না করার জন্য। এখন দেখছি সকাল সকাল ঘুমটা ভেঙে খুব একটা মন্দ হয়নি।”
কানের পাশে আচমকা তুর্জয়ের কন্ঠস্বর শুনে খানিকটা চমকে ওঠে নন্দিতা। হাতে ধরা গরম খুন্তি আলগা হয়ে পড়ে যেতে গেলে বামহাতে নন্দিতার কোমর আঁকড়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয় তুর্জয়। গরম মশলা মাখানো খুন্তিটা নীচে পড়ে যেতেই নন্দিতা দুইহাত কোমরে গুঁজে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায় তুর্জয়ের। রাগী কণ্ঠে বলে,
“এখানে কী করছেন আপনি? দিলেন তো আমার কাজের বারোটা বাজিয়ে।”
তুর্জয় মুচকি হেসে নন্দিতার দিকে তাকায়। অতঃপর হাত বাড়িয়ে গ্যাসের চুলা দুটো বন্ধ করে সাথে সাথেই নন্দিতাকে পাঁজাকোলে তুলে নিয়ে বেশ উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে,

“এতক্ষণ তো বাজাইনি, তবে এখন বারোটা, চোদ্দটা যা খুশি বাজাবো। আমার ঘুম ভাঙ্গানোর শাস্তি তো পেতেই হবে তোমাকে।”
নন্দিতা ছটফট করতে করতে তুর্জয়ের পিঠে লাগাতার কিল ঘুষি দিলেও বিশেষ পাত্তা দিল না সে। উপরন্তু নন্দিতাকে বিছানার উপর ফেলে নিজের শরীরের ভরও ছেড়ে দিলো তার উপর। এরপর ব্যাথাতুর, শুকনো ঠোঁটদুটোতে আলতো চুমু খেয়ে মলিন কণ্ঠে বললো,
“একটু থাকো তো, তুমি ছাড়া আমার ঘুম তো আসে কিন্তু শান্তি আসে না।”

তুর্জয়ের কেবিনে ঢুকে রুমের মধ্যে পায়চারি করতে করতে একটা কেসের ফাইল স্টাডি করছিল আনসার। এমন সময় দরজায় নক পড়ে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই তনুজাকে দেখে বেশ খানিকটা অবাক হয়ে সে। তবে চোখে মুখে সেই ভাব প্রকাশ না করে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে,
“আরে তনুজা ম্যাডাম যে, আসুন ভেতরে।”
অনুমতি পেয়ে ভেতরে ঢুকলো তনুজা। শুধু যে ভেতরে ঢুকলো তা নয়, একটা চেয়ার টেনে বসেও পড়লো। পরনে তার সাদা রঙের শাড়ি, হাতে ব্ল্যাক অ্যাপ্রন।
“ম্যাডামের পায়ের ধূলো আজ আমাদের এখানে, আমাদের সৌভাগ্য বলতে হয়।”
তনুজা হাসে। ঠোঁট বাঁকানো সেই হাসির অর্থ আনসার জানে না। তনুজা তার প্রশংসা শুনে বেশ উৎফুল্ল হচ্ছে ভেবে তাকে আরও খানিকটা তাড়িয়ে ধরতে সে আবারও বলে,

“অল্প কিছুদিনের মধ্যেই হাইকোর্টের লয়ার হয়ে আপনি যে নাম খ্যাতি অর্জন করেছেন, আজ পর্যন্ত কোনো মেয়ে পারেনি। শুধু মেয়ে কেন, তেমন কোনো ছেলেও পারেনি বোধহয়।”
“চাইলে আপনিও পারতেন। তবে অন্যের পিছনে কলকাঠি নাড়া থেকে ফুরসৎ পেলে তো?”
তনুজার কথায় হকচকায় আনসার। আমতা আমতা করে বলে,
“আপনি কী বলছেন ম্যাডাম? আমার মতো সামান্য মানুষ আবার কার পিছনে কলকাঠি নাড়বে।”
তনুজা আবারও হাসে আগের ভঙ্গিতে। হাসতে হাসতেই বলে,
“দেখে তো মিষ্টি লাগে, কিন্তু বিষে ভরা। অনেকটা চিনির বোতলে কীটনাশকের মতো।”
আনসার এখনও নিশ্চিত হতে পারছে না তনুজা কোন বিষয়ে কথা বলছে। তাই তাকে আরও ঘাটাতে মুচকি হেসে বলে,

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৩৪

“ম্যাডাম আমাকে নিয়ে রিসার্চ করছেন নাকি আজকাল!”
“যে থালায় খায় সেই থালায়ই ছিদ্র করা মানুষদের কথা শুনেছিলাম, কিন্তু এখন তো চোখের সামনে দেখছি। তারপর বলুন, এডভোকেট তুর্জয় আহসানের এতো বড়ো শত্রুকে স্যার কী চেনে?”

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৩৬