প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৩৬

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৩৬
ফিজা সিদ্দিকী

“বিবাহিত পুরুষের আশেপাশে বেশি ঘুরঘুর করা মেয়েদের কী বলে জানেন তো ম্যাডাম?”
তনুজা চট করে মুখ তুলে তাকায়। মুহূর্তকালের মধ্যেই অগ্নিচোখ নিক্ষেপ করে আনসারের উপর। আনসার মৃদু হাসে। হাসতে হাসতেই বলে,
“চলার পথে এমন অনেক কাঁচা পাকা গর্ত খুঁজে পাবেন, এগুলো নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে নেই। নাহলে দেখা যাবে কোনো এক গর্তে আপনি নিজেই পড়ে গেলেন চট করে। তার চেয়ে বরং পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যান, বেটার অপশন।”

“আপনি কী আমাকে হুমকি দিচ্ছেন?”
“ফাঁকা কলসি আওয়াজ বেশি দেয়। আর আমার লাঠি বা কলসি দুটোই সাউন্ডপ্রুফ, শুধু রেজাল্ট দেখায়।”
শেষের কথাটুকু বলার সময় আনসারের দৃষ্টি ছিল ধারালো। কন্ঠ ছিলো গাঢ়। আনসারের গা জ্বালানো হাসি দেখে মনে মনে বিরক্ত হলো তনুজা। কণ্ঠে খানিকটা জোর দিয়ে বললো,
“রেজাল্ট দেখানোর লোক ওকালতিতে ফলাফল দেখায়, ক্রিমিনালদের পা চেটে তাদের চামচাগিরি করে না। অবশ্য ওসব না করলে আপনার পেটে ভাত জুটবে না তো।”
তনুজার তাচ্ছিল্য ভরা কণ্ঠে শুনে খানিকটা উত্তেজিত হয়ে আনসার বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“দেখুন ম্যাডাম, অযথা সব জায়গায় বাম হাত গলাতে যাবেন না। তাহলে এতদিনে যেটুকু সম্মান কুড়িয়েছেন সব ধুলোয় মিশে যাবে এক লহমায়। আপনি বরং এসব তেজকে দূরে থাকুন, যেটুকু সম্মান আপনার প্রতি আছে সেটুকু থাকুক।”
কথাগুলো না শোনার ভান করে তনুজা চেয়ার ছেড়ে উঠে গেল। বেরিয়ে যেতে যেতে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পড়ল। কন্ঠ খানিকটা খাদে ফেলে বললো,
“আমৃত্যু আমাকে তুর্জয় স্যারের পাশে পাবেন, তার ঢাল হয়ে।”
তনুজার প্রখর দৃষ্টির আড়াল হতেই হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো আনসার। এতক্ষণ যেন নিঃশ্বাসটা কোনমতে ভেতরে চেপে রেখেছিল সে। তার নিঃশ্বাসের শব্দেও বুঝি তনুজা ঠিক টের পেয়ে যাবে সবকিছু। সন্দেহ আরও গাঢ় হবে তার।

তুর্জয়ের সাথে সাথে নন্দিতার চোখটাও যে কখনও লেগে গেছিলো খেয়াল নেই তার। ঘড়ির দিকে তাকাতেই নন্দিতা খেয়াল করলো বেলা নয়টা বাজে। অথচ এখনো বেঘোরে ঘুমিয়ে তুর্জয়। আজ কী কোর্টে যাবে না? ভাবনার মাঝেই তুর্জয়ের সিল্কি চুলগুলোর মাঝে আঙ্গুল চালালো সে। আঙুল চালানোর মাঝে মাঝে হাতের মুঠো ভরে চুল নিয়ে আলতো করে টানও দিলো কয়েকবার। তুর্জয় নড়েচড়ে উঠে আবারও তলিয়ে যাচ্ছে গভীর ঘুমে। যা দেখে খিলখিল করে হেসে ওঠে নন্দিতা। আজ যেন হাসি তার থামছেই না। ডান হাত দিয়ে তুর্জয়ের চুল নিয়ে খেলতে খেলতে তাকায় সে তুর্জয়ের দিকে। নিষ্পাপ চেহারা নিয়ে কী সুন্দর করে ঘুমাচ্ছে সে। ডাকতে মন না চাইলেও আলতো কণ্ঠে তুর্জয়কে ডাকতে শুরু করলো নন্দিতা। ঘুম ঘুম চোখে আলতো চোখ মেলে নন্দিতার দিকে তাকাতেই আবারও তার বুকে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে তুর্জয়। নন্দিতা খানিকটা তাড়া দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে,

“উঠুন, কতো বেলা হয়ে গেছে। কোর্টে যেতে হবে না?”
“যেতে ইচ্ছে করছে না।”
“একজন আইনজীবী হয়ে এমন কথা বললে চাকরী থাকবে না। তখন পেট চালাবেন কিভাবে?”
“না থাকুক চাকরি, বউ থাকুক শুধু। কবি বলেছে, তিনবেলা নিয়ম করে বউয়ের চুমু খেলে শরীর আর মন দুটোই সুস্থ থাকে। খিদেও কম পায়। তাড়াতাড়ি চুমু দাও তো বউ।”
তুর্জয় নন্দিতাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলে নিজেকে ছাড়াতে মোচড়ামুচড়ি করতে করতে নন্দিতা বলে ওঠে,
“ইশ! কিসব কথাবার্তা। কোনো চুমু টুমু নেই। উঠুন জলদি।”

“তুমি কিন্তু আমার খরচ বাড়াচ্ছ বউ। চুমু না খেলে খিদে বেশি পাবে, খিদে বেশি পেলে বাজার বেশি করতে হবে, বাজার বেশি করতে গেলে টাকা বেশি লাগবে, টাকা বেশি লাগলে টাকা কামাই করতে হবে বেশি, টাকা বেশি কামাই করতে গেলে আমাকে বেশি কষ্ট করতে হবে, বেশি কষ্ট করলে শরীর খারাপ করবে, শরীর খারাপ করলে বউকে ঠিকমতো আদর করতে পারবো না, বউকে ঠিকমতো আদর না করতে পারলে বউ শুকিয়ে যাবে, বউ শুকিয়ে গেলে তাকেও ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে, ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে সেই টাকা লাগবে। এই এতসবকিছু ঠিক হয়ে পারে একমাত্র তোমার ঊষ্ণ চুমুতে।”
নন্দিতা কপাল চাপড়ে বিরক্তি প্রকাশ করে বললো,

“হয়েছে হয়েছে। মুখে যেন খই ফুটেছে ওনার। আগেই ভালো ছিলেন আপনি, কথা কম বলতেন, কী সুন্দর করে আমি সাইলেন্সার ডাকতাম। আর এখন কথা শুরু হলে তো শেষ হয়না। বাপরে!”
তুর্জয় মুচকি হেসে নন্দিতার দিকে খানিকটা ঝুঁকে বলে,
“এসব বউয়ের আদরের ফল। চুমু খাওয়ার বাহানায় তার ঠোঁট থেকে মধু ঢেলে দেয় মনে হয়, তাইতো এতো সুন্দর সুন্দর কথা বলি আজকাল।”
“ইশ! সখ কতো। আমি নাকি ওনাকে চুমু খাই। আপনাকে চুমু খাওয়ার থেকে ওই টিউবলাইটে চুমু খাওয়া ভালো।”
“ইউ মিনস হট হট চুমু? রাতে ফিরে তাহলে হট হট চুমু খাব, রেডি থেকো বউ।”

বাড়ি থেকে বেশ অনেকটা দূরে অবস্থিত একটা ফার্ম হাউসে বসে হুক্কায় টান দিচ্ছেন জাওয়াদ শিকদার। মাথা ভর্তি টেনশনে কপালে তার গভীর ভাঁজ। হুক্কাতে টান দিয়ে মুখ গোল করে ধোঁয়া ছেড়ে নিজেকে খানিকটা রিল্যাক্স করলেন তিনি। অতঃপর সরাসরি তাকালেন সামনের দিকে। সামনে অপরাধী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে তার বড়ো ছেলে তৈমুর শিকদার। গায়ে জড়ানো পুলিশের পোশাক। সম্ভবত ডিউটি থেকেই বেশ তোড়জোড় করে আনানো হয়েছে তাকে।
“তুমি থাকতে বাড়িতে এমন একটা কাজ কিভাবে হলো? গোটা একটা ফাইল রাতারাতি গায়েব হয় কিভাবে?”
“আমি সত্যিই জানিনা বাবা। বাইরের টাইট সিকিওরিটি ভেদ করে বাড়ির ভেতরে আসার সাহস হবে না কারোর। আমার মনে হচ্ছে বাড়ির মধ্যে থাকা কেউ করেছে এই কাজটা।”

তৈমুরের নরম কণ্ঠ শুনে যেন আরও খানিকটা হুংকার দিয়ে উঠলেন জাওয়াদ শিকদার। বললেন,
“তোমার গাফিলতির দায় এখন বাড়ির মধ্যে থাকা লোকদের উপর চাপাতে চাইছো? বাড়ীর সদস্য কেউ এই কাজ করবে না। আর স্টাফ মেম্বাররা আমাদের কতখানি বিশ্বস্ত তোমার অজানা নয়।”
“বিশ্বস্ত লোকও যে কখন বেইমানি করে বসে কে বলতে পারে?”
ফার্ম হাউসে ঢুকতে ঢুকতে বলে উঠলো নাঈম। সম্পর্কে তৈমুরের চাচাতো ভাই হলেও শিকদার পরিবারের কাউকেই বিশেষ পছন্দ করে না সে। তাই পরিবারের থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে নিজের মতো করে ক্যারিয়ার গড়েছে সে। নিজের কঠোর পরিশ্রমে ডাক্তারিতে চান্স পেয়ে একজন সফল কার্ডিওসার্জন সে। জাওয়াদ বাঁকা চোখে তার দিকে তাকাতেই খানিকটা গা ঝাড়া ভাব করে সে বললো,
“আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়ার্ল্ডে কম বেইমানী তো শিকদারা করেনি। বেইমানি যেখানে তাদের রক্তে মিশে, এ আর এমন কী?”

নাঈমকে এখানে দেখে চোখ বাঁকা করে ছোটো ভাই লাবিবের দিকে তাকান জাওয়াদ। লাবিব শিকদার খানিকটা গম্ভীর কণ্ঠে নাঈমকে বললেন,
“আমাদের বিজনেসের সাথে জড়াতে চাওনি তুমি স্বেচ্ছায়। আজ তাহলে এসবে জড়াচ্ছ কেন?”
“জড়াইনি তো! শুধু আয়না দেখালাম তোমাদের। আজ পর্যন্ত কেউ বোধহয় তোমাদের সামনে আয়না ধরেনি। নাহলে নিজেদের কুৎসিত চেহারা দেখে নিজেদেরই ঘৃণা হতো।”
“নাঈম!”

লাবিবের ধমকে ভয় পেয়ে খানিকটা থেমে যায় নাঈম। অতঃপর খানিকটা ধীর কণ্ঠে বলে ওঠে,
“আমাকে তো চুপ করিয়ে দেবে, কিন্তু বাস্তবতার আয়নায় নিজেদের দেখার জন্য প্রস্তুত হও। পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না। তাই তোমার কিছু হলে আমার মা বিধবা হবে।”
এটুকু বলে আর ক্ষণমুহূর্ত অপেক্ষা না করে টেবিলের উপর রাখা গাড়ির চাবিটা হাতে উঠিয়ে নিয়ে লাবিবের দিকে দৃষ্টি মেলে বলে,
“এটা শিকদারদের টাকায় কেনা নয়, ভুলে যেও না।”
“ছেলের জিনিসে বাপের পূর্ণ হক থাকে। আর তুমি ভুলে যেও না ছোটো থেকে খেয়ে পরে এই তাগড়া যুবকে পরিণয় হয়েছ এই শিকদারের পয়সায়।”
“সেজন্যই নিজের শরীরকে ঘৃণা হয় আমার, এমনকি নিজের রক্ত আর রক্তের মানুষদেরও।”
শেষের কথাটুকু লাবিবের চোখে চোখ রেখে বলে ফার্ম হাউস ছেড়ে বেরিয়ে গেল নাঈম।

নতুন একটা কেস নিয়ে সারাদিন বেশ ব্যস্ততায় দিন কাটলো তুর্জয়ের। কোর্টে কয়েক দফায় শুনানির পর অবশেষে এই কেসটাও জিতলো সে। যদিও এমন খুব কমই কেস আছে যেগুলো জিততে পারেনি এডভোকেট তুর্জয় আহসান। আর সেগুলোও সে নিজে থেকে হেরেছিল। অন্যায়ের সাথে আপোষ করা তার ঠিক পোষায় না। ক্লায়েন্ট মিথ্যা বলে অপরাধী হয়েও যদি ভিক্টিম সেজে তার কাছে কেস দেয়, তবে আসল তথ্য সামনে আসার পর সে নিজেই হেরে যায় সেই কেস। একজন আইনজীবির কাছে কোর্ট তার কাছে ভীষণ পবিত্র একটা জায়গা, যেখানে সে সত্যর জন্য লড়াই করার শপথ করেছে। শপথ করেছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর, অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার। ন্যায়বিচার পাওয়ার আশায় মানুষ যে জায়গায় আসে, সে ন্যায়ের জায়গায় অন্যায় কাজ করা তার দ্বারা হয়না।

তাইতো অনেক সময় হুমকির মুখেও পড়তে হয়েছে তাকে। শিকদারের কেস যখন কোর্টে ওঠে, দেশের বেশ নামকরা একজন লয়ারের সন্ধান করতে করতে তারা খোঁজ পেয়েছিল এডভোকেট তুর্জয় আহসানের। বেশ মোটা অঙ্কের টাকার অফার দিয়েও তুর্জয়কে যখন কেসটা নিতে বাধ্য করতে পারেনি, সেই মুহূর্ত থেকে তুর্জয় শিকদারদের চক্ষুশূলে পরিণত হলো। এরপর তাদের বিপরীতে তুর্জয়কে দাঁড়াতে দেখে একেবারে চরম দুশমনির মোড় নিলো তা।
গাড়ীর কাছে আসতেই আচমকা তুর্জয়ের পথ আটকে ধরে অফিসার আলোক। এতদিন পর আলোককে চোখের সামনে দেখে খানিকটা ইতস্তত বোধ করে তুর্জয়। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠে,

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৩৫

“আমার পথ আটকানো কী আপনার একমাত্র ফেভারিট ডিউটি অফিসার?”
অলোক হাসলো। বড্ডো ক্ষীণ সেই হাসি। যেন এই হাসির সাথে মিশে রয়েছে অনেকটা বেদনা। মুখে সেই হাসি ধরে রেখেই বললো,
“আপনার রাতে ঘুম কিভাবে আসে এডভোকেট তুর্জয় আহসান? নিজের ওয়াইফকে দেখলে আমার ওয়াইফের কথা মনে পড়ে না? মনে পড়েনা শুধুমাত্র আপনার কারণে মারা গিয়েছে সে?”

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৩৭