প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৩৭
ফিজা সিদ্দিকী
“রাতে ঘুম আসার জন্য লাগে মানসিক শান্তি। এটুকু আমি বেশ পাই। কারন আমি জানি আমি কতটুকু সৎ আর সত্য, তাই যে যাই ভাবুক এতে আমার রাতের ঘুমের খুব একটা সমস্যা হয়না।”
“ইউ বাস্টার্ড। তোর এই ভালোমানুষির মুখোশ আমি একদিন খুলে ফেলব। মিথ্যা দায়ে আমার বউকে না ফাঁসালে আজ আমারও সুখের সংসার হতো। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম আমরা।”
তুর্জয় মৃদু হাসে। দুই পা পিছনে টেনে ক্লান্ত ভঙ্গিতে ফোঁস ছেড়ে বিনয়ী কণ্ঠে বলে,
“আমার যেটুকু প্রমাণ করার ছিল কোর্টেই করেছিলাম। সকল সাক্ষ্য, প্রমাণ দেখেই আইন তার রায় জানিয়েছিলো। হাজতবাসের চেয়ে আত্মহত্যা তার কাছে সহজ মনে হয়েছিল বলেই সে আত্মঘাতি হয়েছিল। নয়তো পরকীয়ার শাস্তি তো মৃত্যুদণ্ড নয়।”
আলোক চোখ তুলে তাকায় তুর্জয়ের দিকে। চোখ দিয়ে তার আগুন ঝরছে যেন। অন্ধকারেও স্পষ্ট টের পাওয়া যাচ্ছে তার আক্রোশ। তার মনের ভেতরে চলতে থাকা প্রতিশোধের দাবানলে বালি চাপা দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা চালাতে তুর্জয় হাত রাখে ইন্সপেক্টর আলোকের কাঁধে। নরম কণ্ঠে বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“চার বছর হয়ে গেছে, এবার সত্যিটা মেনে নিন অফিসার। আপনার স্ত্রী আপনার অগোচরে বিভিন্ন পরপুরুষের সাথে অবাধে সম্পর্ক রেখে গিয়েছিল। অভিযুক্ত ব্যক্তিটি ছিলেন তাদের মধ্যে একজন, যার সাথে তিনি প্রতারণা করেছেন। এমনকি মিথ্যা বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে তার সবকিছু দখল করেছিলেন।”
“আমি সেদিনও বিশ্বাস করিনি, আজও করবো না। আমাদের দুজনের প্রেম ছিল স্টুডেন্ট লাইফ থেকে, প্রিয়া আমার সাথে প্রতরণা করতেই পারে না। সবটা আপনার আইনি গাফিলতির জন্য। আমার স্ত্রীর মৃত্যুর জন্য একমাত্র আপনি দায়ী। মিথ্যা দায় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল বলেই সহ্য করতে পারেনি সে। তাইতো শেষ অবদি আত্মহত্যা করে বসলো।”
“সত্য আর বিশ্বাস সবসময় এক হয়না। আপনি সত্য দেখবেন নাকি বিশ্বাস, এটা পুরোটাই আপনার উপর অফিসার। আমি আমার ডিউটি পালন করেছি মাত্র।”
নিজের বক্তব্য শেষ করে আর মুহূর্তকাল অপেক্ষা না তুর্জয়। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে গেল নিজ গন্তব্যে।
খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ডান হাতে কফির কাপ আর বাম হাতে দামী ব্র্যান্ডের একটা জ্বলন্ত সিগারেট। সিগারেটটা পুড়তে পুড়তে একেবারে শেষপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। আচমকা আঙ্গুলের চামড়ায় জ্বালাপোড়া করতেই ব্যাথাতুর শব্দ করে হাত থেকে সিগারেটটা ছেড়ে দেয় ধূসর। সাদা ঢিলেঢালা ডেনিম জিন্সের প্যান্টে জ্বলন্ত সিগারেটের ছাই পড়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ডান হাতে থাকা কফির কাপটা থেকে বেশ খানিকটা কফিও পড়েছে তার পরনের সাদা টি শার্টে। এতক্ষণে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে সেটা। তাই জ্বালাপোড়া না করলেও পছন্দের টি শার্টে লেগে যাওয়া দাগটার দিকে তাকিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে কেমন যেন এক কণ্ঠে বলে উঠলো,
“ঠিক এমন করে পছন্দের আবরণে তুমি নামক দাগটা লেগেই গেল অবশেষে। কিন্তু ওঠানোর উপায় কই? লেপ্টে যাওয়ারই বা পন্থা কী?”
এতক্ষণে ধূসরের খেয়াল হলো সদ্য গোসল শেষে ধোঁয়া ওঠা কফি নিয়ে বারান্দায় এসেছিলো সে। সাথে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে সুখটান দিতে গিয়ে আচমকা তার মনে পড়ে গেল সেই মেয়েটার কথা, যাকে পাওয়ার কোনো উপায় নেই, ছেড়ে দেওয়ার পথ খুঁজে পাচ্ছে না। যাকে পেতে গেলে জোরদখল বড্ডো সহজ, অথচ দখলদারি করে পেতে চায়না। কিজানি কেন, কিভাবে চাইলো তাকে, যাকে না পারছে রাখতে, না পারছে ফেলতে। না পারছে সইতে, না পারছে ভুলতে। শুধু এটুকু বুঝছে সে বড্ডো অন্যায় এক জিনিসে আসক্ত হয়েছে। একটা নেশা তাকে এমনভাবে টেনেছে, সে সব অন্যায় আবদারের ঊর্ধ্বে গিয়েও তাকে পাওয়ার উপায় খুঁজছে। তাকে চাই বলে তাই চাইছে না, বরং তাকে ছাড়া ভালো থাকা যাচ্ছে না বলে চাইছে। একদিন, একরাত, কয়েকটা মুহূর্তের জন্য নয়, বরং কয়েকটা জনমের জন্য অধিকার চাইছে। বন্ধন চাইছে। বন্ধন থেকে পালিয়ে বেড়ানো উড়নচণ্ডী ছেলেটা বন্ধনে আবদ্ধ হতে উদগ্রীব অবশেষে।
নিজের মাঝের এই আমুল পরিবর্তনে নিজেই অবাক ধূসর। বিগত কয়েকদিন ধরেই লেট নাইট ক্লাবে মন টিকছে না তার। পিপাসার্তের মতো একের পর এক ড্রিংক পান করে অবশেষে বাড়িতে ফিরে লম্বা একটা ঘুম দিচ্ছে। বিগত দিনে হওয়া গোলটেবিল মিটিংয়ের সবটাই কানে এসেছে তার। জাওয়াদ তালুকদার তাকে টানতে চায় এই ব্যবসায়, কিন্তু ব্যবসার এসব জটিল আর কঠিন সমীকরণ বোঝার চেয়ে ফুর্তি করে বেড়ানোটাকে বেশি প্রাধান্য দেয় সে। তাইতো বাবার ডাক পেয়েও ফার্ম হাউসে দিয়ে উপস্থিত হয়নি সে। মূলত মনে মনে একটা ভয়ও কাজ করছিল তার। বাবার তুখোড় দৃষ্টির কাছে যদি ধরা পড়ে যায়, এই ভয়েই সেই পথে পা বাড়ায়নি আর। নাঈমের বেয়াদবি আচরণের খবর পেয়ে এই প্রথম তার বেশ ভালো লাগছে।
তৈমুর যে মুহূর্তে এগুলো তাকে বলছিল, তার মুখ ছিলো বেজায় ভারী। বাবা তাকে অবিশ্বাস করছে। ঠিক অবিশ্বাস নয়, তার কাজে সন্তুষ্ট নন বরং তিনি। এটুকু যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না তৈমুর। বাবার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে এসেছে সে ছোটো থেকে। বাবা যদি বলে দিনে চাঁদ ওঠে, তৈমুর সেটাই মুখস্ত করে নিয়েছে। পড়াশোনায় সে মন্দ ছিল না, ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে পুলিশের পোশাক গায়ে জড়ানো পুরোটাই তার বাবা জাওয়াদ শিকদারের ইচ্ছেতে। ঘরে একজন পুলিশ থাকলে নাকি তার আড়ালে অনেক বেআইনি কাজ সারা যাবে। তৈমুর পুলিশে জয়েন দেওয়ার পর অবশ্য তাদের ব্যবসা বেড়েছে তরতর করে। বিদেশী ড্রাগ লাইসেন্স ছাড়াই সাপ্লাই দিতে গিয়ে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছে।
বেআইনি ওষুধ থেকে শুরু করে নিষিদ্ধ ড্রিংক, সবই সাপ্লাই করেছে দিনের আলোতে। তাদের ব্যবসার একটা বড়ো অংশ কাজ করে ওষুধ নিয়ে। যেখানে যেখানে ওষুধের সাথে অল্প পরিমাণে কেমিক্যাল মিশিয়ে সিল প্যাক ওষুধের মতো করে সাপ্লাই করা হয় বাজারে। যে ওষুধগুলো দেখতে একদম সাধারণ ওষুধের মতো। চড়া লাভ করে আসল ওষুধের পরিবর্তে সেই ওষুধগুলোই কেমিস্ট্র থেকে সংগ্রহ করে মানুষজন।
দুপুরের পর থেকে বেশ কয়েকবার শরীর ঝাঁকিয়ে বমি হয়েছে নন্দিতার। খাবার দেখলে এই বমি বমি বান্ত তার বেড়ে যাচ্ছে যেন আরও। নন্দিতা চেয়েছিল আজই আলাদা শিফট হতে তুর্জয়ের থেকে। তবে শরীর এর পরিস্থিতি দেখে সেটা আর হলো না। বরং সারাটা দিন বেঘোরে বিছানায় পড়ে রইলো সে।
প্রায় পনেরো মিনিট ধরে একাধারে কলিং বেল বাজিয়ে চলেছে তুর্জয়। অথচ ভেতর থেকে কারোর কোনো সাড়াশব্দ নেই। ভয়ে রীতিমত হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসার উপক্রম তার। তাড়াহুড়ো করে ব্যাগ থেকে দরজার এক্সট্রা চাবি খুঁজতে শুরু করলো সে। চাবিটা খুব একটা প্রয়োজন পড়ে না বলে কোথায় যে রেখেছে, খুঁজে পেতে বেশ বেগ পোহাতে হলো তাকে।
নিঃশ্বাসটুকু আটকে দরজার চাবি খুলে দৌড়ে নিজের ঘরের দিকে গেল তুর্জয়। নন্দিতাকে এলোমেলোভাবে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখে ভয়টা তার বেড়ে গেল আরও। কাছে এসে কপালে, গলায় হাত ঠেকিয়ে জর পরিমাপ করলো। শরীর ঠাণ্ডা নন্দিতার। অথচ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে সে। অজ্ঞান হলো কিনা বুঝতে না পেরে আলতো করে নন্দিতার মাথাটা নিজের কোলে তুলে গালে ছোটো ছোটো করে কয়েকটা চড় মারলো নন্দিতার। বেশ খানিকটা সময় পর মৃদু চোখ খুলে তাকালো নন্দিতা। কয়েক ঘন্টায়ই চোখের নীচে কেমন কালশিটে দাগ পড়ে গেছে। দূর্বল শরীর নিয়ে ক্লান্ত কন্ঠে শুধু সে বললো,
প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৩৬
“বড্ডো ক্লান্ত লাগছে, ঘুমাতে দিন।”
তুর্জয় থামলো না। নন্দিতা চোখ বুঁজে ফেলতেই তাকে আবারো জাগিয়ে তুলে প্রশ্ন করলো,
“এতো অসুস্থ হলে কিভাবে? খেয়েছ কিছু?”
“খাবার দেখলেই বমি পাচ্ছে। আমি বোধহয় বাঁচবো না আর বেশিদিন। তখন কী আপনি এভাবে অন্যকারো যত্ন নেবেন? এতো ব্যস্ত কী তাকে নিয়েও হবেন?”
তুর্জয় নীচু হয়। নন্দিতার কপালের সাথে নিজের কপাল ঠেকিয়ে মৃদু কন্ঠে বলে ওঠে,
“আমাকে ধ্বংস করার এই একটাই মূলমন্ত্র, তুই।”