প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৫৬
ফিজা সিদ্দিকী
ছোটো মাছের প্যাকেট হাতে রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে নাঈম। তনুজা ভ্রু কুঁচকে তাকায় তার দিকে। অনেকক্ষণ ধরেই এভাবে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে, অথচ বলছে না কিছুই। অবশেষে কৌতূহল দমন করতে না পেরে তনুজা নিজেই প্রশ্ন করলো,
“কিছু বলবেন?”
“এগুলো বেছে রান্না করে ডাক দিও আমাকে। দোকানদার বলল ওই কিভাবে যেন সব মশলা ঘষা দিলেই রান্না হয়ে যায়।”
হাতের প্যাকেটটা সিঙ্কে রেখে দিতেই তনুজা উঁকি দিয়ে দেখলো। বেশ অনেকটা ছোটো ছোটো মাছ সেখানে। সে একবার মাছের দিকে তো একবার নাঈমের দিকে তাকায়। অতঃপর চোখ মুখ খিঁচে বলে,
“আমাকে আপনার কাজের বুয়া মনে হয়?”
“একদমই না।”
“তাহলে এগুলো কী?”
“ওগুলো মাছ, সাইজটা একটু ছোট কিন্তু মাছই ওগুলো।”
“মাছ সেটা তো আমিও জানি। কিন্তু এই সন্ধ্যার সময় আপনি এগুলো এনেছেন কেন?”
“কেন আবার? খাবো বলে।”
নাঈমের সোজাসাপ্টা উত্তর শুনে বেজায় চটে যায় তনুজা। বলে,
“গু খেতে মন চায়না আপনার?”
“তুমি তুলে আনতে পারলে খেয়ে খেলবো আমি।”
তনুজা মুখে ওড়না চেপে বমি করার ভঙ্গিতে বেসিনের দিকে এগিয়ে যেতেই নাঈম বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“এই এই! এখনও তো কিছু করিনি। এতো দূরে দূরে থেকেই সুখবর, কিছু করা শুরু করলে কী হবে তবে?”
তনুজা চোখ গরম করে তাকায় নাঈমের দিকে। নাঈম হেলতে দুলতে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যায় নিজের ঘরের দিকে।
খাওয়ার টেবিলে বসে বেশ আয়েশ করে ছোটো মাছের ভুনা দিয়ে ভাত খাচ্ছে নাঈম। মাছ সে খেতে পারে না কাঁটার জন্য। আজ ইচ্ছে করেই কিনে এনেছিল সে, তনুজাকে জ্বালাবে বলে। কিন্তু রান্না করলে এতো টেস্ট হবে জানা ছিল না তার। খেতে খেতে বলল,
“তাজমহল বানানোর জন্য ওয়ার্কারদের হাত কেটে ফেলেছিলো সম্রাট শাহজাহান, যেন দ্বিতীয় কোনো তাজমহল সৃষ্টি না হয় এই দুনিয়াতে। আমার বউয়ের হাতের ছোটো মাছ ভুনা খেয়ে আমারও এমন সাধ জাগছে এখন।”
আমার বউ শব্দটা খেয়াল করলো না তনুজা। নাঈম নিজেও চমকে উঠলো এমন এক শব্দ ব্যবহার করে। আড়চোখে তনুজার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো সে বুঝেছে কিনা ব্যাপারটা। তার কোনরকম হেলদোল না দেখে আবারও বলে উঠলো,
“যাতে অন্য কাউকে আর এভাবে রান্না করে না খাওয়াতে না পারো, তাই হাতদুটো কেটে নেওয়া উচিত না তোমার, বউ?”
তনুজা থতমত খেয়ে চোখ তুলে তাকালো। নাঈম ততক্ষণে চোখ নামিয়ে ভাতের থালা মনোনিবেশ করেছে। তনুজা কন্ঠ চওড়া করে বলল,
“কী বললেন?”
“কী বললাম?”
“আপনি জানেন আপনি কী বলেছেন।”
“তাহলে তো ভালোই। তুমি জানো, আমি জানি দুজনেই জানি।”
“ফাজলামি করছেন আমার সাথে?”
“আরে ধূর, তুমি কি বেয়াই লাগো আমার যে ফাজলামি করবো?”
তনুজা তপ্ত শ্বাস ফেলে থামলো। এই লোকের সাথে তর্ক করতে যাওয়া আর মূর্খের মুখ লাগা সমান। তাই নিজের মতো খাবারে মনোনিবেশ করল সে।
“তুমি কী আমার উপর রেগে আছো? এখানে থাকতে সমস্যা হচ্ছে তোমার?”
আচমকা নাঈমের সিরিয়াস ভঙ্গিতে কথা শুনে তনুজা বলল,
“জেলখানায় ভালো থাকতে শুনেছেন কাউকে? জেলখানা সোনা দিয়ে মোড়ানো হলেও সেটা জেলখানাই।”
“আমার বাড়ি তোমার কাছে জেলখানা?”
“তার চেয়ে কম কী?”
“আমার ভালোবাসা তবে তোমার পায়ের শিকল?”
“সন্দেহ আছে?”
নাঈম আর কোনো উত্তর খুঁজে পেল না। খাবার আর গলা দিয়ে নামবে না তার। আধখাওয়া ভাতের প্লেটটা নিয়ে উঠে পড়ল সে। মুখে আলতো হাসি রেখে বলল,
“আপনাকে মুক্তি দেওয়া হলো তবে। পায়ের শিকল আর বন্দীত্ব জীবন থেকে আপনি মুক্ত এখন।”
তনুজা চট করে চোখ তুলে তাকালো। সাথে সাথে নাঈম আবারো বলে উঠলো,
“একটা অনুরোধ করবো?”
“করুন”
“আপনি যেখানে ইচ্ছে যেতে পারেন, যা ইচ্ছে করতে পারেন, শুধু দিনশেষে এখানে ফিরবেন। প্লীজ! এই বাড়ি, ইট পাথর, চারদেয়ালের নিষ্প্রাণ ভূমিতে আমি সুখের পায়রা দেখতে পাই আপনার উপস্থিতিতে। আপনার অনুপস্থিতি সবকিছুকে মেরে দেবে, আমাকেও।”
শেষের কথাটা বড্ডো আলতো করে বললেও কানে পৌঁছালো তনুজার। তবুও নিশ্চুপ রইলো সে। একটাবার সহানুভূতির দৃষ্টি পর্যন্ত ফেলল না ফিরে যাওয়া বিধ্বস্ত মানুষটার দিকে। ঠিক যেমন করে রণক্ষেত্রে বুকে তীর ছুঁড়ে ঘায়েল করা শত্রুকে পিছু ফিরে দেখে না বিজয়ী যোদ্ধা।
ফ্যাক্টরিতে পুলিশের রেড পড়েছে। পুরো এরিয়া সিল করে ফেলা হয়েছে। এই খবর পাওয়া মাত্রই গুহা থেকে বের হয়ে এসেছেন জাওয়াদ শিকদার। তৈমুরকে কোনোভাবেই নক গলাতে দেওয়া হয়নি এই কেসে। একজন বড় অফিসার নিজে দেখছেন এই কেসটা। এমনিতেই কোর্টের হেয়ারিংয়ের পর থেকে বেশ নজরে নজরে রাখা হচ্ছিল শিকদারদের। তার উপর নন্দিতার সাথে হওয়া এক্সিডেন্ট, বেআইনি ওষুধের ঢেরে ভরা ফ্যাক্টরির গুদামঘর। পুলিশের সরাসরি তীক্ষ্ণ নজর এখন শিকদারদের উপর। আর এই বিষয়টা হ্যান্ডেল করতেই নন্দিতাকে একা ছেড়ে ছুটে আসা তাদের এখানে। তবে সবচেয়ে অবাক হচ্ছেন তিনি এই খবর লিক হওয়া নিয়ে। এই ফ্যাক্টরী পরিত্যক্ত, যাওয়া আসা নেই কারোর। রাতের অন্ধকারে পিছন দিকের নীচু জমি দিয়ে পাচার হয় সবকিছু। ফ্যাক্টরির আন্ডারগ্রাউন্ড ঘরে কাজ করছিলো কুড়িজন লোক। তাদের কাজ নতুন তৈরি হওয়া ওষুধগুলোকে প্যাকিং করে সিল করা। আর এসব কাজ রাতের অন্ধকারেই হয়। কিন্তু আচমকা মাঝরাতে রেড পড়ে সেখানে। গ্রেপ্তার করা হয় দশজনকে। দুইজন পালাতে গিয়ে গুলির আঘাতে স্পট ডেড। বাকি আটজন পলাতক।
আজকের নিউজের চাঞ্চল্যকর খবর, শিকদারদের ফ্যাক্টরিতে পড়েছে পুলিশের রেড। বের করে আনা হয়েছে কয়েক টন বিদেশী ড্রাগ, যেগুলো সরাসরি নিষিদ্ধ আমাদের দেশে। ডাক্তারের মতে এই ড্রাগে রোগী সুস্থ হয় দ্রুত। কিন্তু বয়সের আগে বার্ধক্য এসে যায়, হৃদরোগ আর চোখের দৃষ্টিশক্তি কমে যায় অল্প বয়সে। কিন্তু শিকদার মেডিকেয়ারের মতো নামিদামি ব্র্যান্ড কেন করলো এমন কাজ? দেশের অন্যতম ওষুধ কোম্পানির মধ্যে একটা তারা, তবে কী এভাবেই এতো বছর ধরে ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা চালিয়ে যাচ্ছিল তারা? মানুষের প্রাণের বিনিময়ে তাদের সুস্থতা দিয়ে?
নিউজচ্যানেলে চলতে থাকা কথাগুলো চোখ বন্ধ করে নিজের ঘরে বসে শুনছে ধূসর। ঠোঁটের কোণে তার ক্ষীণ হাসি। দরজা জানালা বন্ধ অন্ধকার কুকাপ ঘরে আচমকা সুর টেনে ধূসর গেয়ে উঠলো,
তুমি আরেকবার আসিয়া
যাও মোরে কান্দাইয়া
আমি মনের সুখে একবার কাঁদতে চাই
পোড়া বুকে দারুণ খরা
চোখের পানি চোখে নাই
আরেকবার আসিয়া
যাও মোরে কান্দাইয়া
আমি মনের সুখে……
একবার কাঁদতে চাই
না পারিলাম বাচঁতে আমি
না পারিলাম মরতে……
না পারিলাম পীরিতের ওই
সোনার পাখি ধরতে
কোর্টে পা রাখতেই তুর্জয় মুখোমুখি হলো জাওয়াদ শিকদারের। বেশ ছোটাছুটির মধ্যে আছেন তিনি, তুর্জয়কে তাই সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে গেলে পথ আটকায় সে। বুকে দুইহাত গুঁজে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রহস্যময় হেসে বলে ওঠে,
“ফাঁসির দড়ি গলার পড়ার জন্য প্র্যাকটিস করুন এখন থেকে। রোজ ঠিক এভাবেই একটু একটু করে দড়িটা শক্ত করে আকড়ে ধরবে আপনার গলা।”
“জাওয়াদ শিকদারকে তুমি এখনো চেনো না। এসব তার কাছে চুনোপুঁটি খেলা। এর চেয়ে বড়ো বড়ো রহস্য মাটির তলায় কবরে চাপা দিয়েছি আমি, বুঝলে?”
জাওয়াদ শিকদারের চামড়ার উপর দাম্ভিকতার আড়ালে লুকানো ভীতগ্রস্থ মনটা খুব সহজেই পড়ে ফেললো তুর্জয়। হাসি তার চওড়া হলো আরও। জাওয়াদ শিকদারের দিকে খানিকটা ঝুঁকে ফিসফিস করা সুরে বলল,
“বুকটা খামচি দিয়ে ধরছে না একটু? আমার পাঁচ আঙ্গুল দাবিয়ে তোর কলিজা টেনে যদি না বের করেছি, আমার নাম তুর্জয় আহসান না। আমার কলিজা দুইটাকে কেড়ে নিয়েছিস তুই আমার থেকে, তোর কলিজা ভুনা করে কুত্তাকে না খাওয়ানো অবদি আমার শান্তি নেই।”
জাওয়াদ শিকদার এবার ভয় পেয়েছেন একথা সত্যি। ভয় তার জনগণকে নিয়ে। দেশের জনগণ একবার ক্ষেপে গেলে তাকে হারানো সহজ হয়ে যাবে মানুষের কাছে। তার মুখ আর মুখোশ আলাদা হতে দেওয়া যাবে না কিছুতেই জনগণের সামনে। এজন্য যা করা লাগে তাই করবে সে।
দেয়ালের গায়ে আঁকিবুকি করতে করতে ঘরের ছোটো জানালাটা ভয়ে ভয়ে আলতো করে খুললো নন্দিতা। বাইরে এখন দিন। জানালার ফাঁক থেকে অল্প বিস্তর আলো এসে ঠিকরে পড়ছে ঘরের মেঝেতে। নন্দিতা মুখ বার করার চেষ্টা করলো জানালা থেকে। জানালার বাইরে দিকে লোহার নেট জাল দেওয়া। বহুদিন না খোলাফেলা করার জন্য জানালার কব্জায় জং ধরেছে বেশ। বেশ জোর লাগিয়েও খোলা যাচ্ছে না পুরোটা। তবুও বহু কষ্টে জালানার পল্লা অর্ধেক খুললো সে।
বাইরে ঘন জঙ্গল। দূর থেকে ভেসে আসছে কুকুরের ডাক। পুরো জায়গাটা কেমন যেন গা ছমছমে ভাব। তবুও এতগুলো দিন পর সূর্যের আলো দেখে মনে মনে বেশ খুশি হলো সে। হাতে পায়ে বেঁধে রাখা জঞ্জির টেনে এসে বসলো জানালার কাছটায়, যেখানে আলোর সাথে মিঠা রোদ এসে বাড়ি খাচ্ছে মেঝেতে। সেখানে বসেই ভাবতে লাগলো সে।
জাওয়াদ শিকদার ফিরে আসবেন খুব শীঘ্রই। তার ফেরার আগেই নন্দিতাকে পালাতে হবে এখান থেকে। কিন্তু জায়গাটা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা তার নেই। যতদূর চোখ যায় শুধু ঘন জঙ্গল আর জঙ্গল। এই জঙ্গলে প্রবেশ করলে সে বেঁচে ফিরবে বলে মনে হয়না। তার উপর কুকুর দুটোকে জাওয়াদ শিকদার যখন খেতে দেয়, জান হাতে চলে আসে নন্দিতার তাদের ডাক শুনে। মাঝে মাঝে তার মনে হয় চারপাশের পরিবেশ কোনো মৃত্যুপুরীর চেয়ে কম নয়। এরচেয়ে বরং এই ঘরের মধ্যে থাকলে সে বেঁচে থাকবে, বাঁচিয়ে রাখতে পারবে তার সন্তানকে।
উঁচু পেট নিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসলো নন্দিতা। ডানহাত পেটের উপর রেখে বিড়বিড় করে বললো,
“আমাদের কতো স্বপ্ন ছিল, কতো সুন্দর সুন্দর মুহূর্ত বাঁচার ছিলো। বাবুকে নিয়ে তোমার কত উচ্ছাস ছিল। অথচ কিছুই দেখা হলো না আর। কতোমাস দেখিনা তোমাকে তুর্জয়, কেমন আছো তুমি? আমাকে কি মনে পড়ে এখনও? আচ্ছা তুমি সুস্থ হয়েছ তো? আমাদের সব স্বপ্ন কি এভাবেই অপূর্ন থেকে যাবে? আর কখনও দেখা হবে না আমাদের?”
চোখের কোল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো নন্দিতার। আজ অনেকদিন পর বুক ভেঙে কান্না আসছে তার। কান্নাও ভুলে গেছে সে। এখানে যে কান্না দেখার কেউ নেই, আহ্লাদ করার কেউ নেই। এই বিভীষিকাময় জীবনের শেষ কোথায়? চারদেয়ালের উঁচু ছাদের সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে অভিযোগের সুরে বলে ওঠে,
“আমার আর কত পরীক্ষা নেবে তুমি আল্লাহ? আমি ক্লান্ত। আমারও কাগজ ফুরায়, কলমের কালি শেষ হয়। শুধু তোমার মায়া দয়া হয়না আমার উপর।”
অতঃপর গুনগুন করে গেয়ে উঠলো,
প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৫৫
না জানি কোন অপরাধে দিলা এমন জীবন
আমারে পোড়াইতে তোমার এতো আয়োজন
আমারে ডুবাইতে তোমার এতো আয়োজন
ও ও আমারে ডুবাইতে তোমার এতো আয়োজন