প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৫৮
ফিজা সিদ্দিকী
এতোগুলো দিনের পরিশ্রম সফল হলো। নন্দিতার পায়ের জঞ্জির খুলে গেল অবশেষে। যে তালা এতবার প্রচেষ্টার পরও খোলেনি, আজ রাগের বশে আছাড় দিতেই খুলে গেল তা। খুশিতে নন্দিতা দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো। হাসতে হাসতে পেটে হাত রেখে সাবধানী কণ্ঠে বলল,
“এই দেখ জয়, আমরা পেরেছি। আমরা পেরেছি মুক্ত হতে। এখন শুধু মুক্তি পাওয়ার পালা।”
বদ্ধ ঘরে নন্দিতার একাকিত্তের সঙ্গী ছিল একমাত্র তার গর্ভস্থ সন্তান। দিনরাত তাই তার সাথেই কথা বলতো সে। একটা সময় পর থেকে তার মন বলল তার গর্ভস্থ সন্তান পুত্রসন্তান। আর সাথেই তার নাম রেখে দিলো সে জয়, জয় আহসান। তুর্জয় আহসানের ছেলে।
উঁচু পেট, ফুলে ওঠা পা, কোমরে অসহনীয় ব্যাথা নিয়ে এই মৃত্যুপুরী থেকে নন্দিতা কীভাবে বের হবে জানেনা। তবে এই বন্দিত্ব জীবনে থেকে শিকদারদের হাতে মরতে সে চায়না। কপালে মৃত্যু লেখা থাকলে রাস্তায় মরবে সে, তবুও সে মৃত্যু সম্মানের হবে। আত্মসম্মানের সাথে আপোষ করে না।
জঞ্জিরের অপরপ্রান্ত খুব সহজেই খুলে ফেললো নন্দিতা। কিন্তু বের হল না সে সেই মুহূর্তে। বরং আগের মতো জঞ্জিরটা আলতোভাবে বেঁধে রাখল পায়ে।
কেয়ারটেকার লোকটা এসে তাকে রাতের খাবার দিয়ে গেল। নন্দিতা অনুরোধের সুরে তাকে বলল,
“আর একটু খাবার হবে চাচা?”
লোকটা অবাক হল বেশ। এতদিন যে খাবারের অর্ধেকটা ফিরিয়ে দিতো মেয়েটা, আজ দ্বিতীয়বার নিজে চেয়ে খাচ্ছে। বিষয়টা অবাক করার হলেও খুব একটা আশ্চর্য হলো না সে। তেমন কোনো সন্দেহ পোষণও করলো না। অনেকদিন পর নন্দিতা পেট ভরে খেলো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
পড়ে রইলো ছন্নছাড়া খাবারের টেবিল। ধূসর ব্যাতিত কেউ আর উপস্থিত নেই ডাইনিং টেবিলে। সকলে একসাথে ছুটেছে ফুলতলার বাগানবাড়িতে। বাগানবাড়ি! উহু, আগুনের ধ্বংসস্তূপে। দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনে জাওয়াদ শিকদার নিজের ধ্বসে পড়া ক্ষমতার প্রতিচ্ছবি দেখবে শুধু। ওটা তার কাছে শুধু বাগানবাড়ি নয় বরং তার জীবনের একটা বিশেষ অঙ্গের মতো ছিল। রাজনীতির কারচুপি থেকে শুরু করে সারা জীবনের যতো ফাইল, ডকুমেন্ট সে রেখেছিলো ওই বাগানবাড়ির দক্ষিণের দিকে অবস্থিত ঘরদুটোতে। বিশাল সে ঘরের একটার পুরোটা জুড়ে কাগজ আর ফাইলের ঢের। আর অন্যটা ছিল তার নিজস্ব রুম। যে রুমের বিশেষ এক লকারে রাখা তার অবৈধ জিনিষপত্র ও মোটা অঙ্কের ক্যাশ। মাংসের হাড্ডি চিবাতে চিবাতে ধীর কণ্ঠে ধূসর বলে ওঠে,
“জাওয়াদ শিকদার, তুমি এবার অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু, মানসিকভাবে বিধ্বস্ত, ক্ষমতার আসনে বিপর্যস্ত। একটা একটা করে আমার বুক থেকে দুইজন প্রিয় মানুষকে কেড়ে নিয়েছ তুমি, তোমার বুক খালি না করে কীভাবে থাকি আমি?”
বহুদিন পর বাড়ি থেকে বের হয়েছে ধূসর। রাতের আঁধারে নিস্তব্দ রাস্তায় হাঁটার শখ জাগছে আজ তার খুব। বুকটা পুড়ছে ভীষণ। এ জ্বালাপোড়া আজকের নয়। এ ক্ষত বহু পুরনো। মাঝে মাঝে মাঝরাতে জেঁকে বসে তারা বুকের উপর। জোঁকের মতো আঁকড়ে ধরে হৃদপিণ্ডকে। এই সময়টা বড্ড হাঁসফাঁস লাগে তার। বিছানায় ছটফট করতে করতে দুই হাত দাপিয়ে খুঁজতে থাকে পাশে কাউকে। অথচ একাকী জীবনে কেউ হাত বাড়ায় না তখন। পরম মমতায় ছুঁয়ে দেয়না তার বুক। একটু ছুঁয়ে দিলেই বোধহয় তার এই ব্যাথা কমে যেত। কিন্তু আসে না কেউ। যন্ত্রণা বুকে জড়িয়ে সেভাবেই নির্ঘুম কাটে তার সে রাত।
অদূরে কোথাও থেকে গোঙানির শব্দ ভেসে আসছে। ধূসর সতর্ক হল। কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো শব্দের উৎস। রাস্তার ধারে পার্কের গেট খোলা। একপাশের ল্যাম্পপোস্টের আলো নেভানো। কৌতূহলে সেদিকে পা বাড়াল ধূসর। কিছুটা যেতেই শব্দ গাঢ় হল আরও। দ্রুত কদমে সেখানে পৌঁছাতেই অন্ধকারে ধস্তাধস্তির শব্দ পেয়ে চিৎকার করল ধূসর।
“কে ওখানে? কি হচ্ছে কী?”
চমকে উঠলো লোকগুলো। অনাঙ্খিত মানুষের আগমনে চমকে উঠে হাতের বাঁধন আলগা হলো তাদের। মেয়েটাকে ছেড়ে এগিয়ে এলো একজন ধূসরের দিকে। ধূসর আঁচ করতে পারলো ব্যাপারটা। একপাশে পড়ে থাকা গাছের শুকনো ডাল তুলে নিলো হাতে। সাথে সাথেই একজন মধ্যবয়সী লোক ছুটে এলো তার দিকে। পরনে নীল রঙের শার্ট, মস্ত বড় একটা ভুঁড়ি উঁচিয়ে সামনে এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
“মালটা এক্কেরে খাসা, ভাগ চাইলে শেষে আইসো। এখন যাও তো।”
পার্কের গার্ডও যে এসবের সাথে জড়িত বুঝতে পেরে মেজাজ চরম রকমের খারাপ হল ধূসরের। ঠিক সে সময়ই অন্ধকার থেকে ছুটে এলো একটা মেয়ে। সোজা এসে লেপ্টে গেল ধূসরের বুকে। ধূসর তাকে একহাতে আগলে নিলো।
“আমাদের মাল ছেড়ে এখান থেকে ফুটে যা, কেচাল করলে ভালো হবে না কিন্তু।”
অল্পবয়সী ছেলের মুখে এমন কথা শুনে তার নাক বরাবর ঘুষি মারল ধূসর। বলল,
“আমার বুকে থাকা জিনিস ছিনিয়ে দেখা, কেটে ভাগা দেব এখানে টুকরোগুলোকে।”
ধূসরের কণ্ঠের তেজ, তার ঔদ্ধত্য দেখে ভয় পেল ছেলেগুলো। এক এক করে বেরিয়ে গেল তিনজন ছেলে পার্ক থেকে। যাওয়ার আগে একপলক তাকালো ধূসরের দিকে। তার চোখের তেজের সামনে অবশ্য তাকাতে পারলো না বেশীক্ষন। চলে গেল সেখান থেকে।
ফুঁপিয়ে কাঁদছে মেয়েটা। কাঁপছে ধূসরের বুকে মুখ গুঁজে। নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলো ধূসর, কিন্তু পারলো না। মেয়েটা তার বুকের কাছের শার্ট খামচে ধরে রয়েছে শক্ত করে।
“প্লিজ ছাড়বেন না আমাকে। প্লিজ, প্লিজ! আমাকে এভাবে থাকতে দিন।”
ভ্রু কুঁচকে ফেললো ধূসর মেয়েটার আবদারে। এ কেমন আবদার? অচেনা এক পুরুষের বুকে লেপ্টে থাকা এ কেমন স্বভাব?
রুঢ় কণ্ঠে ধূসর বলল,
“আপনাকে ভালো মেয়ে ভেবে বাঁচাতে এসেছিলাম। কিন্তু আপনি তো পুরুষের শরীরে মাখামাখি করে মজা পাওা মেয়ে। ছাড়ুন বলছি আমাকে।”
মেয়েটা হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকালো একপলক ধূসরের দিকে। এরপর সাথে সাথেই দূরে সরে গেল তার থেকে। সেদিকে তাকাতেই সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিলো ধূসর। মেয়েটা গর্জে উঠে বলল,
“চোখ নামালেন কেন? তাকান এবার আমার দিকে। আপনার তাকানো উচিৎ। এজন্যই তো এতোগুলো কথা শোনালেন।”
অপরাধী ভঙ্গিতে মাথা নামিয়ে নিলো ধূসর। তামাটে হলদে আলোয় মেয়েটার জামার সামনের অংশ অনেকটা ছিঁড়ে গিয়ে অন্তর্বাস স্পষ্ট। বুকে অজস্র আঁচড়ের দাগ থেকে রক্তপাত হচ্ছে ইতিমধ্যে। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে ধূসর বলল,
“সরি”
আউট হাউজের দরজায় চাবি ঘুরিয়ে ভিতরে ঢুকল ধূসর। শার্টলেস, ক্লান্ত, শান্ত মানুষটা। পাশে দাঁড়িয়ে মেয়েটা। শরীরে যার জড়ানো ধূসরের টি শার্ট। নওরিন এগিয়ে এলো তাদের দিকে। অবাক চোখে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটে উঠলো তার মুখে। সাথে সাথে ধূসর বলল,
“মেয়েটার ফাস্ট এইড দরকার আম্মা, একটু হেল্প করে দাও।”
কথাটা শেষ করে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না সে। সাথে সাথে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে।
মনের ভাঙ্গন ধরলেও উপরে উপরে নিজেকে কঠোরভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টায় তনুজা দুই কদম পিছিয়ে এলো। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“আপনার খাবারটা রেখে গেলাম, খেয়ে নেবেন।”
“খাবার কি চেয়েছি আমি?”
“আমি এনেছি”
“খাবো না”
“কেন খাবেন না?”
“কেন খাবো?”
কথার ফাঁকে এক পা এক পা করে তার দিকে এগিয়ে আসছে নাঈম। তনুজা একইভাবে এক পা এক পা করে পিছিয়ে যেতে যেতে বলল,
“আমি রান্না করেছি তাই খাবেন।”
নাঈম চমকে উঠে একপলক তাকাল প্লেটের দিকে। সাথে সাথে তনুজার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,
“আমার জন্য রান্না করেছ?”
“না নিজের জন্য করেছিলাম। ভাবলাম আপনাকেও একটু দিই।”
প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৫৭
নাঈম হাসল ঠোঁট কামড়ে। হাত বাড়িয়ে দরজাটা আটকে দিতেই তনুজার পিঠ গিয়ে ঠেকল দরজায়। পাশ থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলে দরজায় একটা হাত রাখল নাঈম। তনুজা অন্যপাশ দিয়ে বেরোনোর চেষ্টা করলে একইভাবে তাকে আটকে দিলো নাঈম। সাথে সাথে কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলল,
“এভাবে মিথ্যা বলতে হয়না। তুমি ধরা পড়ে গেছ। যা করেছ, যা হয়েছে, যা চলছে, সব আমার জন্য। শুধু আমার জন্যই।”
“আ…আপনি কে? কেন করতে যাব আমি আপনার জন্য এসব?”
“প্রেমে পড়েছেন আপনি, মিস তনুজা।”