প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৬১

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৬১
ফিজা সিদ্দিকী

তুর্জয়ের বুকের উপর সামনের দুই পা উঠিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে পিট বুল টিয়ারার প্রজাতির একটা কুকুর। উপর থেকে দেখে তাকে যতখানি শান্ত লাগছে, ভেতরে ভেতরে সে ততখানি ক্ষিপ্ত। ঠিক যেন তার আবাসস্থলে ভুল করে ঢুকে পড়েছে কেউ।
তুর্জয় নড়লো না। বড্ডো ধীর গতিতে কাঁধ থেকে ব্যাগপ্যাকটা সরিয়ে রাখল সাইডে। এরপর একহাত বাম পকেটে ঢুকিয়ে কিছু একটা বের করার চেষ্টা করছিল। সাথে সাথে মুখের একদম কাছে জোরে শব্দ করে ডেকে উঠলো কুকুরটা। অতিরিক্ত ভয় পায় তুর্জয়। সাইডে থাকা ব্যাগপ্যাকটা ডানহাতে উঠিয়ে টেনে নেয় বুকের কাছে। কুকুরটা তেড়ে দাপিয়ে ওঠে তার বুকে। সাথে সাথে পকেটে তার কাঙ্খিত জিনিসটা পেয়ে গিয়ে চোখ বন্ধ করে সাথে সাথে সেটা স্প্রে করে কুকুরের চোখে মুখে।

আলতো চোখ খুলে কুকুরটাকে মাটিতে সাইট ছটফট করতে দেখে তুর্জয় উঠে দাঁড়ায় আস্তে করে। বামহাতে ধরে রাখা জিনিসটার দিকে একপলক তাকিয়ে অসহায় চোখে টাকায় সামনে ছটফট করতে থাকা কুকুরটার দিকে। অনুশোচনায় দগ্ধ হয় তার মন। অবলা এই প্রাণীটাকে আঘাত দেওয়ার উদ্দেশ্য তো তার ছিল না। মানুষরূপী কুকুরগুলোর থেকে আত্মরক্ষার জন্য পকেটে পেপার স্প্রে নিয়েছিল সে। কিন্তু কে জানতো, অবলা এই কুকুরটা তার শিকার হয়ে যাবে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বেশিক্ষণ এখানে দাঁড়ানো সেফ না। নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে আলতো পায়ে সেখান থেকে বিদায় নিলো সে। পাছে কুকুরটা টের পায় তার গতিবিধি। কারন কুকুরদের ঘ্রাণশক্তি যেমন প্রখর তেমনই সজাগ তাদের নার্ভ। একটু শব্দ পেলেই উদভ্রান্তের মত ছুটে আসে সেদিকে।
রক্তিম আকাশের লালিমায় একটা ছন্নছাড়া, পতিত বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তুর্জয়। কান্না পাচ্ছে তার ভীষণ। বুক ধড়ফড় করছে। ভেতরে গিয়ে আশাহত হবে না তো? নোডনতাকে সুস্থ অবস্থায় পাবে তো? অযাচিত চিন্তাগুলোকে মাতা থেকে ঝেড়ে ফেলে সাবধানে ভেতরে ঢুকলো সে।
একের পর এক ফাঁকা ঘর পেরিয়ে তুর্জয় যখন সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে যাবে, এমন সময় শূন্য বুকে ঝড় তোলার মতো করে জঞ্জিরের শব্দ ভেসে আসে সিঁড়ির পিছনের দিকের ঘর থেকে। ঘরটা খেয়াল করেনি এতক্ষণ সে। সাথে সাথে নেমে এলো সে সিঁড়ি দিয়ে। পকেট থেকে পেপার স্প্রের বোতলটা বের করে রাখলো ডানহাতে। অতঃপর পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল সেই ঘরের দিকে।

দড়জায় কোনো লক নেই। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বড় করে একটা শ্বাস টেনে নিলো তুর্জয়। ভেতরে ভেতরে নিজেকে প্রস্তুত করলো অনাকাঙ্খিত কিছুর জন্য। অতঃপর বাম হাত বাড়িয়ে ঝট করে খুলে দিল দরজা। চোখ ঘুরিয়ে সামনে তাকাতে হতবাক সে।
পুরনো, ধুলোবালির খসখসে মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসে আছে তুর্জয়। দুই হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে চলেছে সে। নন্দিতা এক হাত পেটে দিয়ে অন্য হাতে দেওয়ালে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরেছে। কান্না নিবারনের বৃথা চেষ্টা চালাতে চালাতে ক্ষীণ কন্ঠে ডাকে,
“তুর্জয়”
তুর্জয় চোখ তুলে তাকায়। নন্দিতা আবারও একই সুরে বলে,
“কাছে এসো।”

“নাহ। কাছে আসার দরকার নেই। এইযে তোমাকে দেখতে পাচ্ছি, এটাই অনেক। কাছে গেলেই হারিয়ে যাবে তুমি। তুমি ভ্রম। তুমি আমার বেঘোরে দেখা ভ্রম। আমি বাস্তবে তোমাকে ছুঁতে পারবো না। আমি তাই শুধু দেখব, দূর থেকেই দেখব।”
তুর্জয়ের পাগলামি দেখে হাসলো নন্দিতা। একই সুরে বলল,
” আমি তোমার সত্তা, আমিই তোমার সত্য। ঠিক যেমন সত্য এ ধরণী, যেমন সত্য এ সাঁঝ, আমি তোমার অস্তিত্বের তেমন এক সত্য।”
বিশ্বাস করলো না তুর্জয়। পাগলের মতো বিড়বিড় করে বললো,
“মিথ্যা মিথ্যা মিথ্যা। তুমি রোজ আসো কল্পনায়, আমাকে ঘুম পাড়ানোর জন্য আমার পাশে বসো। যাবে না বলে কথা দিয়েও ঠিক চলে যাও। আবারও চলে যাবে তুমি। আমি কাছে আসবো না, পলকও ফেলবো না চোখের। দেখি এবার কিভাবে ফাঁকি দিয়ে পালাও তুমি আমাকে।”

নন্দিতা এবার শব্দ করে হাসলো। বিড়বিড় করে বললো,
“বউয়ের শোকে এডভোকেট তুর্জয় আহসান পাগল টাগল হয়ে গেল নাকি?”
কিন্তু মুখে বলল, “এই কাছে এসো। দূরত্ব কমাও। আর দূরত্ব সহ্য হচ্ছে না আমার।”
তুর্জয় তড়িৎ গতিতে চোখ তুলল এবার। তার কল্পনার নন্দিতা তো এসব বলে না। সে তো কথাই বলে না। শুধু মাথার পাশে বসে মাথা নাড়িয়ে তার জবাব দেয়। এ তো তার নন্দিতা। তবে কি এ সত্য! এটা বাস্তব!
হাঁটুতে ভর দিয়েই এক পা এক পা করে এগিয়ে এলো তুর্জয়। বুক তার মোচড় দিচ্ছে। শরীর কাঁপছে থরথর করে। ঠোঁট দুটো চোখা করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। নন্দিতা দুই পা এগিয়ে এলো। তুর্জয়ের মুখটা আলতো করে ধরে কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো নিগূঢ়ভাবে। এরপর ওভাবেই রয়ে গেল কিছুটা সময়। মুখ যখন তুললো, তুর্জয় কাঁপছে রীতিমতো। ধীর কণ্ঠে শুধু বলল,

“আমাকে একটু ধরবে?”
কী ভীষণ রকম আবদার। শরীর কেঁপে উঠলো নন্দিতার। আলতো করে ডানহাত রাখলো তুর্জয়ের বুকে। বড্ডো ধীর কণ্ঠে ফিসফিস করে বললো,
“আছি। আমি আছি।”
নন্দিতার কোমর জড়িয়ে পায়ের কাছে বসে তুর্জয়। সারা পেট চুমুতে ভরিয়ে দিয়েছে সে। এখনও তার পাগলামির শেষ নেই। তুর্জয়ের এই রূপ নন্দিতার একেবারেই অজানা ছিল। হতবাক হয়ে সবটুকু দেখতে দেখতে তুর্জয়ের চুলের মাঝে আঙ্গুল চালাতে চালাতে বলল,
“হয়েছে তো। কান্না থামাও। বাচ্চার বাপ বাচ্চাদের মতো কান্নাকাটি করলে আমার বাচ্চাটা কী শিখবে?”
তুর্জয় হেসে দিল ফিক করে। সাথে সাথে নন্দিতার হাত ধরে করুণ সুরে বলল,
“আমাকে মাফ করে দিও।”
নন্দিতা ভ্রু কুঁচকে তাকালো তার দিকে। সাথে সাথে তুর্জয় আবারও বললো,
“দুনিয়ার সবচেয়ে খারাপ পিতা আমি। যে সময় তোমার সবচেয়ে আদরের প্রয়োজন ছিল, অনাদরে কাটিয়েছ দিনের পর দিন। আমাদের সন্তানের জন্য কিছু করতে পারিনি আমি। সব সংগ্রাম তোমার একার, সব যন্ত্রণা তোমার একার।”

নন্দিতা বেশ কষ্ট করে দেয়ালে ভর দিয়ে মেঝেতে বসলো। তুর্জয়ের মুখোমুখি হতেই দুই আজলায় তার মুখটা ধরে তাকিয়ে রইলো বেশ অনেকটা সময়। সাথে সাথে ঠোঁট উল্টে বিড়বিড় করে বললো,
“ইশ! কেমন বাজে দেখতে হয়ে গেছে তোমাকে। দাঁড়িগুলো বড়, মুখ তো আর দেখাই যায়না। সব দাড়ি গোঁফ। আর এইযে এই চোখ, কতরাত ঘুমাও না? বউ মরে গেছে তোমার?”
তুর্জয় ক্ষিপ্র চোখে তাকালো তার দিকে। সাথে সাথে নিজেকে সংযত করতে করতে বলল,
“আমাকে দেখতে দেখতে তরকারিতে লবণ বেশি দিয়ে ফেলার কেউ ছিলো না, তাই জংলী হয়ে গেছি।”
নন্দিতা হেসে উঠলো শব্দ করে। মনে পড়ে গেল তার কোনো এক দুপুরের কথা। তুর্জয় সদ্য শাওয়ার নিয়ে ভেজা শরীরে তোয়ালে প্যাঁচিয়ে ডাইনিংয়ে এসেছিল কিছু একটা কাজে। নন্দিতা রান্নাঘর থেকে উঁকি দিয়ে তুর্জয়কে দেখছিল বারবার আড়চোখে। তুর্জয় তাকালে সাথে সাথে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। আর সেই লুকোচুরির খেলায় কখন যে তরকারিতে দুইবার লবণ দিয়ে ফেলেছিল খেয়াল নেই। এ কথা নিয়ে সেদিনও অবশ্য একচোট হেসেছিল তুর্জয়। আর আজও তার অন্যথায় নয়।

তনুজাকে গাড়িতে অপেক্ষারত অবস্থায় রেখে তুর্জয় বেরিয়েছিল জঙ্গলের উদ্দেশ্যে। কথা ছিলো রাতের মধ্যে সে ফিরে না এলে পুলিশ নিয়ে যেন উপস্থিত হয় সে। তনুজা তাই অপেক্ষা করছে। অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ হবে জানে সে। তাই ফোন হাতে নিয়ে কল লাগালো নাঈমকে। আলতো কণ্ঠে বললো,
” আজ রাতে আমি আর ফিরব না।”

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৬০

ম্যাসেজটা সিন হতেই সাথে সাথে ভিডিও কল এলো নাঈমের। ঘাবড়ে গেল তনুজা। আমতা আমতা করে কেটে দিলো সে কলটা। সাথে সাথে আবারও বেজে উঠলো ফোনটা। একবার , দুইবার করতে করতে এই নিয়ে ঊনত্রিশ বার একইভাবে ধৈর্যের সাথে কল দিয়ে যাচ্ছে নাঈম। শেষবেলায় কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা রিসিভ করলো তনুজা। সাথে সাথে রাগান্বিত কণ্ঠে নাঈম বলল,
“আল্লাহর কসম লাগে, যেখানে আছো এই মুহুর্তে তুলে নিয়ে আসবো। আমি আসছি।”

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৬২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here