প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৬৩

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৬৩
ফিজা সিদ্দিকী

অনেকটা সময় অপেক্ষা করেও তুর্জয়কে ফিরতে না দেখে গাড়ি থেকে বের হল তনুজা। কয়েক পা এগিয়ে সামনের দিকে যেতেই একটা গাড়ি এসে থামল। ভয় পেয়ে একটা ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে পড়লো সে। মাথা উঁচিয়ে উঁকি দিয়ে দেখতে লাগলো গাড়িটাকে।
কয়েকজন লোক মিলে টেনে হিঁচড়ে নামাচ্ছে দুজনকে। এতো দূর থেকে মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই লোকদুটোকে। তবে আন্দাজ করা যায় বেশ বয়োজ্যেষ্ঠ দুজন নারী পুরুষ। গাড়ি থেকে নেমে এলো জাওয়াদ শিকদার। তার পিছু পিছু নামলো তৈমুর। সবাইকে জঙ্গলের ভিতরে ঢুকতে দেখে সাবধান হল তনুজা। সাথে সাথে ফোন লাগালো তুর্জয়কে। রিং হলেও ফোন তুলছে না সে। এদিকে জাওয়াদ শিকদার তার দলবল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। অস্থিরতায় হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে এলো তার। রক্তশূন্য মুখে অস্থির হয়ে শুধু কল লাগিয়ে গেল তুর্জয়কে। সাথে সাথেই একটা কল ঢুকল তার ফোনে। সামনে তাকিয়ে জাওয়াদ শিকদারের দিকে নজর রেখে ফোনটা রিসিভ করে কানে ঠেকিয়ে ভীতিগ্রস্থ গলায় বলল,

“জাওয়াদ শিকদার এসেছে। নন্দিতাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসো, তুর্জয়। ওদের সাথে লোক আছে অনেক। তুমি …………”
কথা শেষ করতে পারলো না তনুজা। তার আগেই মনে হল কেউ যেন আছে পিছনে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই সাদা পাঞ্জাবী, পাজামা পরে দুই হাত পিছনে বেঁধে রাখা জাওয়াদ শিকদারকে চোখে পড়লো তার। ভয়ে কথা আঁটকে গেল। ঝট করে হাত থেকে পড়ে গেল ফোনটা। ফোনের ওপারে গর্জে উঠলো নাঈম। কিন্তু তার কণ্ঠ পৌঁছালো না কারো অব্দি। নাঈম সাথে সাথে কল করলো ধূসরকে। নিজের ঘরে বসে আরও একটা পরিকল্পনা সাজাচ্ছিল সে। নাঈমের ফোন রিসিভ হতেই গড়গড় করে বলতে লাগলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“কোথায় তুই? নিশ্চয়ই তোর বাপের সাথেই। কান খুলে শুনে রাখ, আমার তনুজার যদি কিছু হয় তোদের কাউকে ছাড়বো না। আই সোয়ার। আমার কলিজায় হাত দিলে তোদের প্রত্যেকের কলিজা টেনে বের করে হাতে ধরিয়ে দেব। তোর বাপকে বলে দিস, নাঈমের শরীরেও শিকদারের তাজা রক্ত বইছে।”
ধূসর থতমত খেয়ে উঠে দাঁড়ায়। খানিকটা রাগান্বিত স্বরে বলে,
“নাঈম ভাই, তোমার আমাকে জাওয়াদ শিকদারের চামচা মনে হয়?”
“কোথায় তুই?”
“আমার ঘরে।”
“তোর বাপ কোথায় জানিস?”
“গেছে কার পিছনে বাঁশ দিতে, জানিনা আমি।”
“অ্যাডভোকেট তুর্জয় আর তার স্ত্রীকে মারতে।”
“হোয়াট? নন্দিতা……”
“মারা যায়নি। ওদের সাথে অ্যাডভোকেট তনুজাও আছে।”
“তার মানে অ্যাডভোকেট তনুজা তোমার…”
“এতো উত্তর দেওয়ার সময় এখন নেই। লোকেশন সেন্ড করেছি, কাম ফাস্ট।”

ফুল স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছে ধূসর। লাইভ লোকেশন দেখাচ্ছে মিনিত চল্লিশের পথ। সাথে সাথে গাড়ির ঊর্ধ্বশ্বাসে ছোটালো সে। ট্রাফিক রুলস ভেঙ্গে, ব্যারিকেট ভেঙ্গে, গাড়ি এগিয়ে চলল শুধু।
তনুজার চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে জঙ্গলের রাস্তা ধরে এগিয়ে গেল জাওয়াদ শিকদার। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টায় হুমড়ি খেয়ে কতবার পড়ে গেছে মাটিতে। নিষ্ঠুর জাওয়াদ শিকদার থামেনি। তাকে টানতে টানতে এগিয়ে চলেছে শুধু। পুরনো গাছের ভাঙ্গা ডাল, এবড়ো থেবড়ো রাস্তায় ব্যাথা পেয়ে চিৎকার দিলেও সেই চিৎকার পাষাণ হৃদয়ের জাওয়াদ শিকদার অব্দি পৌছালো না। সে উন্মত্তের মতো টানতে টানতে নিয়ে গেল তাকে।
বাড়ির কাছাকাছি আসতেই চমকে উঠলো তনুজা। তৈমুরের সামনে গান পয়েন্টে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন বয়স্ক মানুষ আর কেউ না, তুহিনা বেগম ও আশরাফ সাহেব। দুজন বলিষ্ঠ দেহের লোক তাদের ধরে আছে দুইপাশ থেকে। তৈমুর এবং আর একজন বলিষ্ঠ লোক বন্দুক তাক করে তাদের দিকে। জাওয়াদ শিকদারের মুখে বিজয়ের হাসি। তনুজাকে টেনে দাঁড় করাল সে। অতঃপর বাড়ির প্রবেশপথের দিকে চাইলো একবার। চোখ মুখ জুড়ে দৃশ্যমান এক নরকিয় হিংস্রতা। সেদিকে তাকাতেই গা শিউরে উঠলো তনুজার।

“শালার অ্যাডভোকেটকে এবার শেষ করার পালা এসেছে। অনেক নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছে আমাদের।”
তৈমুরের কথায় নীরবতায় ছেদ ঘটলো। জাওয়াদ শিকদার হালকা হেসে বলল,
“দাঁড়াও আব্বা, আগে ওর বুক খালি করি তারপর জান।”
জাওয়াদ শিকদার এমন আদুরেভাবে খুব কমই ডাকেন তৈমুরকে। তবে যখনই ডাকেন তৈমুরের বেশ ভালো লাগে। এমন ভালোবাসা, আদরের ডাক পাওয়ার জন্যই তো বাপের কথার অবাধ্য হয়নি কোনোদিন সে।
কয়েকজোড়া পায়ের ক্ষীণশব্দের বিচরণে সতর্ক হল তুর্জয়। ভয়ে নন্দিতা লেপ্টে গেল তার শরীরের সাথে। তুর্জয় তাকে অভয় দিতে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। কপালে দীর্ঘ একটা চুমু খেয়ে বলল,
“আমার প্রান থাকতে তোমার কিচ্ছু হবে না কিছু হতে দেব না আমি তোমার।”
“আপনাকেও লাগবে আমার।’’

হাতের মুঠোয় তুর্জয়ের কলার আঁকড়ে তার চোখে চোখ রেখে নন্দিতা বলল। তার ভাবভঙ্গিমা এমন, যেন একটু হাত আলগা করলেই হারিয়ে যাবে তুর্জয়। নন্দিতার কোথা শুনে আলতো হাসল তুর্জয়। বলল,
“জীবনে যা কিছু ঘটে নির্দিষ্ট কোন কারনে ঘটে। আমাদের এতদিনের দূরত্ব, অভ্যাসের পরিবর্তনের পিছনেও নিশ্চয়ই কোনো কারন ছিল। মেনে নাও, মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়াই জীবন।”
পদচারণের শব্দ জোরালো হতেই তুর্জয়কে আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরল নন্দিতা। তার হৃদস্পন্দনের শব্দ ছাপিয়ে যাচ্ছে ঘরের নিস্তব্ধতাকে। সাপের মতো পেঁচিয়ে ধরেছে সে তুর্জয়কে। যেন এভাবে আঁকড়ে ধরলে কেউ আলাদা করতে পারবে না তাদের। তুর্জয় নন্দিতার চোখে চোখ রেখে নরম কণ্ঠে বলল,
“ব্রিথ, টেক ডিপ ব্রিথ, ইউ আর মাই ব্রেভ কুইন। ডোন্ট প্যানিক।”

পকেটে হাত চালিয়ে ফোন বের করার চেষ্টা করলো তুর্জয়। এই পকেট, ওই পকেট সব জায়গায় খুঁজে হতাশ হতেই তার খেয়াল হল ফোনটা গাড়িতে ফেলে এসেছে। নিজের উপর চরমভাবে বিরক্ত হলেও মুখভঙ্গিতে প্রকাশ করলো না। এ কোথা কোনোভাবেই জানানো যাবে না নন্দিতাকে। এই অবস্থায় নন্দিতা উত্তেজিত হলে তার ক্ষতি হতে পারে।
আচমকা জোরালো শব্দে ঘরের দরজাটা ভেঙ্গে পড়লো মেঝেতে। সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে আঁতকে উঠলো নন্দিতা। তবে চমকালো না তুর্জয়। নন্দিতাকে বুকে জড়িয়েই উঠে দাঁড়ালো সে। জাওয়াদ শিকদারের চোখে চোখ রেখে বলল,

“যেতে দে আমাদের। আমার বউয়ের সাথে করা সব অন্যায়ের জন্য ক্ষমা করলাম তোকে।”
সাথে সাথে একজন লোক কোথা থেকে যেন একটা চেয়ার নিয়ে এসে রাখল জাওয়াদ শিকদারের সামনে। জাওয়াদ শিকদার চেয়ারে বসলেন পায়ের উপর পা তুলে। সাদা পাঞ্জাবীটা টান টান করে বিছিয়ে নিলেন কোলের উপর। একটু ভাঁজ পড়েছিল পাঞ্জাবিতে, সেটাও মসৃণ করলেন হাতের সাহায্যে। অতঃপর বললেন,
“সামান্য পাঞ্জাবীর কুঁকড়ে যাওয়া দাগটাও সহ্য করেনা জাওয়াদ শিকদার। তুই তো সেখানে তার চরিত্রে, অহংকারে, জীবনে দাগ লাগিয়েছিস। দফারফা করেছিস সবকিছু। দুনিয়ার হাওয়া, বাতাস এতক্ষণও যে পাচ্ছিস পায়ে পড়ে শুকরিয়া জানানো উচিৎ আমাকে।”

“এক সৃষ্টিকর্তা আর দুই জন্মদাতা ছাড়া কারোর কাছে মাথা নত করেনা তুর্জয় আহসান।”
তুর্জয়ের অহংবোধ দেখে মনে মনে রাগ হলেও মুখে তা প্রকাশ করলো না জাওয়াদ শিকদার। শীতল কণ্ঠে বলল,
“তুই এখন কোথায় দাঁড়িয়ে আছিস জানিস তো? জাওয়াদ শিকদারের ডেরা এটা। এখানে আমার অনুমতি ছাড়া নিঃশ্বাস নেওয়ার সাধ্যও তোর নেই।”
তুর্জয় নিঃশব্দ হাসল। তৎক্ষণাৎ বলল,
“তুই এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছিস সেটা আমার রবের ঘর, তার সৃষ্টি দুনিয়া। যার অনুমতি ছাড়া তোর নিঃশ্বাস নেওয়ার সাধ্য নেই বৈকি। তোর মতো পাপীকে ছাড় দিয়েছে ঠিক যেভাবে লাটাই ঢিল দেয় সুতোকে আকাশে ওড়ার জন্য। এরপর ঝট করে পাতাং কেটে মুখ থুবড়ে পড়ে মাটিতে।”
জাওয়াদ শিকদার সাথে সাথেই আঙ্গুল উঁচিয়ে ইশারা করলো কাউকে ভেতরে আসতে। মুখে বলল,
“তবে তোর মাথা নোয়ানোর জায়গাগুলো আগে শেষ করি। তারপর নাক ঘষতে ঘষতে এই জাওয়াদ শিকদারের পায়ে মাথা নোয়াবি তুই, প্রানভিক্ষা চাইবি।”

দরজার দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠলো তুর্জয়। তুহিনা বেগম আর আশরাফ সাহেবকে ধরে বেঁধে নিয়ে আসা হল ঘরের মধ্যে। বিপন্ন, বিধ্বস্ত নন্দিতাকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন তুহিনা বেগম। নন্দিতাও আর দূরে থাকতে পারলো না, ছুটে যেতে চাইলো তার কাছে। কিন্তু তার হাত ধরে ফেললো তুর্জয়। রুখে দিলো তাকে। একজন সন্তানের কাছে তার বাবা মাকে এমন অবস্থায় দেখার চেয়ে করুণ কিছু আর হতে পারে না। জাওয়াদ শিকদার সেটাই চেয়েছিল। তুর্জয়ের মনোবল ভেঙ্গে দিতেই তো তার এতো আয়োজন। এমন শক্ত্রপক্ত পুরুষের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিলে কেমন লাগে, এ দেখার তার সাধ বড়।

তুর্জয়ের আসার খবর কেয়ারটেকারের কাছ থেকে পাওয়ামাত্রই ছক কষে ফেলে সে। তুর্জয় যেন খুব তাড়াতাড়ি সেখান থেকে পালাতে না পারে তাই লোকটাকে আড়ালেই থাকতে নির্দেশ দেয়। তুর্জয়ও আসেপাশে কাউকে না পেয়ে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে আসার তাড়া দেখায় না। তার ধারনা ছিল জাওয়াদ শিকদার এখন নিজের ধ্বংস কুড়াতে ব্যস্ত। অথচ এই সুযোগটা কাজে লাগিয়েই লোক দিয়ে উঠিয়ে নিয়ে আসে তুর্জয়ের বাবা মাকে। একজন পুরুষের শক্তি তার বাবা, মা, স্ত্রী, সন্তান। তুর্জয়ের সবগুলো শক্তি এখন জাওয়াদ শিকদারের হাতের মুঠোয়। কথাগুলো ভেবেই পৈশাচিক আনন্দে মেতে ওঠে সে।
পরপর দাঁড় করানো দুটো গাড়ি দেখে গাড়ি থামায় ধূসর। গাড়ি থেকে নেমে কোনদিকে এগোনো উচিৎ তার মাথা কাজ করছে না। কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো পিছনে ঠেলে আশেপাশে তাকাতেই লক্ষ্য করে মাটিতে কী যেন একটা ঘষে যাওয়ার দাগ। যেটা প্রবেশ করেছে জঙ্গলের অভ্যন্তরে। ধূসরের বুঝতে আর বাকি রইলো না কিছু। সেই দাগ ধরে এগিয়ে গেল সে সামনে।

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৬২

জাওয়াদ শিকদার ঠোঁটে আঙ্গুল চালিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল,
“আমি পাপ, আমি পাপী। পাপেরও বাপ আমি। কোনো বাপের ক্ষমতা নেই তোর মরন আমার হাত থেকে আটকানোর।”
“বন্ধ ঘরে বন্দি করে মানুষ মারে কুকুররা, শিকদাররা তো বাঘের বাচ্চা। খোলা আকাশের নীচে ফেলে মারবে এক এক করে।”
শব্দের উৎসের দিকে তাকাতেই চমকে ওঠে সকলে। ঠোঁটের হাসি বিস্তৃত হল জাওয়াদ শিকদারের আরও।

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৬৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here