প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ১২
নওরিন কবির তিশা
আট বছর আগে………..
এলাকার বিখ্যাত খানদানি আর প্রভাবশালী পরিবার হক কুঞ্জ আজ জন কলরবে পূর্ণ। যৌথ সে পরিবারে, আজ উপস্থিত সকল আত্মীয়-স্বজনেরা। কারণ একটাই, রাত পোহালেই রোজার ঈদ। আনন্দ উচ্ছ্বাসে পূর্ণ বাড়ির প্রত্যেকটি কোণ। বাড়ির সব বড় ভাই বোনেদের সাথে আনন্দে মেতেছে ১১ বছর বয়সী তিহুও । বয়সে সবার ছোট সে। আতশবাজির রঙিন আলো আর শব্দে মুখরিত আশপাশটা। ছাদে সবাই একযোগে গান আর বাজি ফোটানোর আসর নিয়ে বসেছে।
তিহু ছোটবেলা থেকেই বাজির শব্দ একটু বেশি ভয় পায় বিধায় সে বাজি ফোটানোর পাশটার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। পাশে একটা আসন পেতে গল্পের পসরা নিয়ে বসেছে বাড়ির সকল নবীনেরা। আজ একটা বিশেষ উদ্দেশ্যে, জমায়েত সবাই।তিহুর সৃজা নামক একটা আপু আছে। বয়সে তিহুর থেকেও প্রায় বছর চারেকের বড়।
অসম্ভব সুন্দরী, সৃজা এ বাড়ির সেজ চাচার বড় মেয়ে আদ্রিতা নাহারের ছেলে অর্থাৎ আরহামকে ভীষণ পছন্দ করত। আর আজ,সে সাহস করে আরহামকে প্রপোজ করবে। কিছুটা অজানা শঙ্কায় কম্পিত হচ্ছে কিশোরী দেহ। তবে আজ সে প্রপোজ করেই ছাড়বে, কেননা আজকের দিনটাই, আরহামের কাছে নিজের মনের ভাবটা প্রকাশনার শেষ সুযোগ তার। পরশু সকালেই আরহামের ফ্লাইট, আমেরিকা চলে যাবে সে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মুহূর্ত কয়েকের মাঝেই সেখানে গিটার হাতে উপস্থিত হয় আরহাম। উপস্থিত সবার থেকে একটু ভিন্ন সে, সৌন্দর্যে বা ব্যক্তিত্বে। সবদিক থেকেই পারফেক্ট । ১৯ বছর বয়সী আরহাম, একটা চেয়ারে এসে বসলো। সৃজা আর চোখে বারংবার তার দিকেই চেয়ে আছে। আরহাম চেয়ারটাতে বসেই তিহুর মাথায় হালকা থাপ্পড় দিয়ে বলল,,,,
—-‘ব্যাপার কি? সারাদিন তোতা পাখির মত কথার ফুলঝুরি ঝড়াস? আজ হঠাৎ কি হলো?’
তিহু সামান্য ব্যথায় মুখ কুঁচকে বলল,,,—‘উফ, আরহাম ভাই! একটু আস্তে মারবে না।আর আমি সারাদিন কোথায় বক-বক করি?’
আরহাম ঠোঁট উল্টে বাহবার সুরে বলল,,—‘ভালো মেয়ের উন্নতি হয়েছে দেখছি।’
অতঃপর মুহূর্ত কয়েক জুড়ে চলল বিভিন্ন গান বাজনা, আর গল্পগুজব।
রাত তখন হয়েছে বেশ …..
ঘড়ির কাঁটায় বোধ হয় নয়টা কি দশটা। সবাই ছাদে থেকে নেমে যে যার রুমের উদ্দেশ্যে চলে গিয়েছে বেশ কিছুক্ষণ হলো। আরহামও নিজের ইন্সট্রুমেন্ট গুলো গুছিয়ে, নামবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। হঠাৎই পিছনে কারো উপস্থিতি অনুভূত হতেই, একবার ঘুরলো সে। সৃজাকে দেখে ভ্রু গুলো আপনা আপনি কুঁচকে আসলো তার। এই মেয়েটাকে প্রথম থেকেই সুবিধার মনে হয় না আরহামের নেহাতই ছোট নানার একমাত্র ছেলের মেয়ে বিধায় কিছু বলতে পারেনা সে।
আরহাম:‘কি ব্যাপার তুই এখনো নামিস নি?’
সৃজা:‘তোমার সাথে একটু কথা আছে ।’
আরহাম:‘কিন্তু তোর সাথে আমার কোন কথা নেই । যা এখন আমার সামনে থেকে।’
সৃজা:‘কিন্তু আমি তো বললাম আমার তোমার সাথে কথা আছে।’
আরহাম:‘ভারী অসভ্যতো। আচ্ছা বল কি বলবি দ্রুত দুই মিনিটের ভেতর কথা শেষ কর।’
সৃজা:‘আই লাভ ইউ আরহাম ভাই।’
সৃজার কোথায় রীতিমতো আকাশ থেকে পড়লো আরহাম। এইটুকু মেয়ে বলে কি.? তাও কোন রকম ভনিতা ছাড়া একবারই। অবাক আরহাম তার পানে চেয়ে বলল,,,—-‘থাপ্পড় খেয়েছিস কখনো? এমন একটা মারব না কোনোদিন চোখ তুলে আমার দিকে তাকানোর সাহসও করবি না।’
সৃজা বাবা মায়ের অতি আদরের মেয়ে। ছোটবেলা থেকেই কিছুতে না শোনার অভ্যেস তার নেই। বিশেষত মায়ের আদরে অতিরিক্ত বেয়ারা হয়েছে সে। আরহাম যখন তাকে এভাবে রিজেক্ট করলো, তখন মেজাজ ধরে রাখতে পারল না সৃজা। কিছুটা চটে গিয়ে সে বলল,,,—-‘আমাকে একসেপ্ট করবে নাতো কাকে একসেপ্ট করবা? ওই ছোট্ট পিচ্চি তিহুকে?’
সৃজার কথায় রীতিমতো বোকা মনে গেল আরহাম। সে যে তিহুকে পছন্দ করে, এটা এই মেয়ে জানলো কিভাবে? বোকা দৃষ্টি নিক্ষেপূর্বক সে বলল,,,—‘কি সব উল্টাপাল্টা বলছিস?’
সৃজা:‘সত্য কথা তো বোকা বোকাই লাগে তাই না? তুমি যেভাবে তিহুর দিকে তাকাও তাতে আমার বুঝতে বাকি নেই। কিন্তু শুনে রাখো আরহাম ভাই, আমি তোমাকে প্রপোজ যখন করেছি একসেপ্ট তোমাকে করতেই হবে।’
সৃজার কথা রীতিমত মেজাজ হারালো আরহাম। এইটুকু মেয়ে কিনা তাকে থ্রেট দিচ্ছে? আরহাম রেগে গিয়ে বলল,,,—‘থাপরে, বাপ দাদার নাম ভুলিয়ে দিব । বেয়াদব মেয়ে! তোর কত সাহস তুই আমাকে থ্রেট দিস?’
সৃজা এক শয়তানি হাসি হেসে বলল,,,—-‘ব্যাপারটা থ্রেট হিসেবে নাও কিংবা সতর্ক বাণী, একবার যখন বলেছি তখন আমাকেই তোমার একসেপ্ট করতে হবে। না হলে….’
ফের একইভাবে হেসে সেখান থেকে প্রস্থান করলো সৃজা। আরহাম ব্যাপারটা তখনো না বুঝলেও, পরদিন সকালেই সমস্তটা পরিষ্কার হলো তার সম্মুখে।
এটুকু বলেই থমকালো আরহাম।
—-“পরদিন সকালে,পরদিন সকালে কি হয়েছিল আরহাম?বলো,প্লিজ বলো।”
তপ্ত শ্বাস ফেলে আরহাম তাকিয়ে দেখলো সম্মুখে একজোড়া জিজ্ঞাসু দৃষ্টি উদগ্রীব হয়ে চেয়ে আছে তার দিকে। মেয়েটি ফ্লোরা, তার সহকর্মী। ইদানিংকালে সে একটু বেশি কৌতুহল দেখায় আরহামের অতীত প্রণয়নীকে নিয়ে। আজ এক প্রকার বাধ্য হয়েই তাই আরহাম তাকে গল্প শোনাতে বসেছে। আরহাম কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে বলল,,,
———“তোমার এতো কিউরিয়াসিটি কেন ফ্লোরা? আমার সম্পর্কে জেনে তোমার কি হবে?”
ফ্লোরা চুপসে গেল। মুহূর্ত কয়েক পর বলে উঠলো,,,—-“তোমার লাভ স্টোরি শোনার, আর তোমার প্রণয়নিকে দেখার অনেক শখ আমার, যে কে সেই প্রণয়িনী যার জন্য তোমার এত পাগলামি। দ্বিতীয় টা তো আপাতত পূরণ করতে পারছি না তাই ফার্স্ট তাই না হয় শুনি।”
আরহাম একবার হাত ঘড়িটার দিকে তাকালো। অতঃপর বলল,,,—“নাইট শিফটের টাইম অনুযায়ী, এখন তোমার একটা অপারেশন আছে ফ্লোরা। সেদিকে কনসেনট্রেট কর। আমার গল্প না হয় পরে একদিন শুনলে।”
আরহামের কথাই হলো ফ্লোরা একবার, ঘড়ির দিকে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে ভ্রু কুঁচকে এলো তার। শিট! এখনই ১০ টা বাঁজার ছিল? এমনি হাজারো খরকুটো পুঁড়িয়ে এইটুকু শুনতে পেরেছে, না জানি আর কতটা কষ্টের পর বাদ বাকিটুকু শুনতে পারবে। বিরক্তি মুখে, সেখান থেকে উঠে গেল সে। ফ্লোরা চলে যেতেই, আরহাম লুকিয়ে রাখা তিহুর ছবিটা বের করল,তাতে আদুরে স্পর্শ লেপে দিয়ে বলল,,
———“দেখো তোমাকে দেখার কত শখ সবার? তবে এত শীঘ্রই কি তোমাকে আমি সবাইকে দেখাতে পারি। কক্ষনো নয়। তোমাকে যে আমি অত্যন্ত লুকিয়ে রাখি, হৃদ গহীনে।”
আরহাম নিষ্পলক চেয়ে রইল তিহুর ছবিটির পানে, গভীর কন্ঠে সে গেয়ে উঠল,,
🎶 গোপন করে আপন করে….
বুকের পাঁজরে রাখি…..
ঘুমের বড়ি দিয়ে আড়ি…..
হৃদয় বাড়িতে থাকি…..🎶
বাংলাদেশ……
ভার্সিটি শেষ হয়েছে মিনিট পনেরো হবে। ভার্সিটি থেকে অনতি দূরে একটা ক্যাফেতে, গল্পের পসরা নিয়ে বসেছে অন্তরঙ্গ বন্ধুর একটি দল।কোল্ড কফিতে লাস্ট চুমুক দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো তিহু। বহু কষ্ট শেষে, মাকে ভুজুম-ভাজুম দিয়ে কোনো মতে বাড়ি পাঠাতে পেরেছে সে। ঘাড় থেকে একটা বড় বোঝা নেমেছে যেন। এদিকে বন্ধু মহল, নিজেদের মত গল্পে ব্যস্ত।
ক্যাফেটা আজ আলোকসজ্জায় পূর্ণ,চার বান্ধবী মিলে, অনেক আগে থেকেই পরিকল্পনা করে রেখেছিল ক্যাফেতে আসার। তবে চারজন একত্রে একই সময় বের করতে, সক্ষম না থাকায় কিছুদিন বিলম্ব হলো। হঠাৎই নিদ্রা বললো,,,
———“ তোর তো দেখছি সারা শরীরে কলিজা! কি করে আন্টির মত বিচক্ষণ মহিলাকে প্যাঁচে ফেলে বাড়ি পাঠিয়ে দিলি?”
তিহু কিছু বলার আগেই, পাশ থেকে রিতু বলল,,—“সাহস না থাকলে কি আর, নীল খানের মতো মানুষকে থ্রেট দিতে পারে?”
নিদ্রা:“সেটা সত্য!”
তিহু:“ইটস মাই ট্যালেন্ট বেবি।”
মাহা: “এসব ফাও ট্যালেন্ট শুধু তোর মধ্যেই আছে।”
মুহূর্ত কয়েক গল্প করতে করতে, হঠাৎই আশরা বলল,,,—-“তিহু?”
তিহু তখনও আনমনে গল্পে ব্যস্ত। হঠাৎই আশরা ডাকে, তার দিকে ফিরে তিহু বলল,,,—-“কিছু বলবি?”
আশরা কিছু একটা ভাবলো। অতঃপর বিচক্ষণতার সুরে বলল,,,—-“আমার না কেমন একটা লাগছে!”
তিহু:“কেমন লাগছে?”
আশরা:“না মানে ব্যাপারটা কেমন না? নীল খানের মতো অত বড় একটা নেতা, তার পরিচয় ভাঙ্গিয়ে তুই সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করেছিলেন জানা সত্ত্বেও তোকে কিছু বলল না। আর তোকে বিয়েও করে নিল? এটা কেমন না!”
রিতু:“আমারও না ব্যাপারটা সুবিধার ঠেকছে না। এমনিতেই নেতাদের ক্যারেক্টারে প্রবলেম থাকে!”
আশরা আর রিতুর কথায় এবার তিহুর নিজের মনেও সন্দেহের জন্ম নিল। সত্যি তো, সে তো জানেই যে নেতাদের ক্যারেক্টারে প্রবলেম থাকে।তাহলে যদি নীলেরও অমন…! না না তিহু কি সব ভাবছে? মাথা থেকে উল্টাপাল্টা চিন্তা বিদায় করে,সে আশরা আর রিতুর দিকে ফিরে বলল,,,
———“আরে না,না তেমন কিছুই না। ইভেন উনি তো আমার সাথে তত একটা কথাও বলে না।”
আশরা:“তাও একবার যাচাই করতে ক্ষতি কি?”
তিহু ভ্রু কুঁচকে বলল,,,—-“যাচাই মানে?”
আশরা:“যাচাই মানে যাচাই।একটা টেস্ট করি চল,তুই বরং আমার ফোনটা দিয়ে তোর নেতা সাহেবকে একটা কল কর। দেখ ধরে কিনা!যদি ধরে আর তোর পরিচয় না জানা সত্ত্বেও কথা বলে তাহলে বুঝে নিস ডাল মে কুচ কালা হে।”
তিহুর দৃঢ় বিশ্বাস নীল ফোনটা ধরবেনা। তাই সে কোনো রকম চিন্তাভাবনা ছাড়াই, আশরার ফোন থেকে নীলের নাম্বারে ডায়াল করলো। তবে অবাক করা বিষয় হচ্ছে, প্রথমবার রিং হতেই ফোন ধরলেও নীল। তিহু বিষ্ময়ে বড় বড় দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকালো। আশরা ইশারায় বলল, ফোনটাতে স্পিকার অন করে কথা বলতে। তিহুও স্পিকার অন করল অতঃপর, কণ্ঠস্বর সর্বোচ্চ নমনীয় করে বলল,,
———“হ্যালো সুইটহার্ট!”
সঙ্গে সঙ্গে অপর পাশ থেকে ভেসে আসলো গভীর পৌরুষ কন্ঠস্বর,,,,—-“বলো লাভক্যান্ডি!”
তিহুর চোখ যেন এবার কোটর থেকে বের হয়ে আসবে। শুকনা ঢোক গিলে, বান্ধবীদের দিকে এক ঝলক তাকালো সে। অন্যদিকে সে কোনো কথা না বলায় অপর পাশ থেকে নীল ফের বলে উঠলো,,,,—-“কি হলো কথা বলো না কেন জানেমান?”
তিহু:“উম, হ্যাঁ বলছি তো।”
নীল:“তো বলো!”
তিহু:“আই লাভ ইউ জান!”
নীল:“লাভ ইউ টু জানেমান।”
তিহু:“আমার জানটা কি করে?”
নীল:“তোমার জানটা এখন তোমার সাথে কথা বলে।”
তিহু:“মিস ইউ জান।”
নীল:“মিস ইউ টু জান।”
তিহুর এবার নিজের উপরে নিজের রাগ হতে শুরু করলো। তারমানে আশরা আর রিতু ঠিক কথাই বলেছিলো, নেতাদের ক্যারেক্টার সত্যি সত্যিই ঢিলা থাকে। সে মনে মনে বললো,,,—-“মিস তোরে করাচ্ছি,খালি সামনে আয়।”
নীল:“কি ব্যাপার লাভ ক্যান্ডি? কথা বের হচ্ছে না আর?”
তিহু:“আপনি কি আমাকে চেনেন?”
নীল:“ চিনিই তুমি আমার জানেমান।”
তিহু:“অসভ্য ফাজিল বেডা, বাড়ি বউ রাইখা তুই, অন্য মেয়েগো লেইগা ইটিশ-পিটিশ করিস।”
নীল:“নিজের বউয়ের সাথেই তো ইটিশ-পিটিশ করি।”
তিহু অবাক কন্ঠে বলল,,,—“মানে?”
নীল খানিক হেসে বলল,,—“তোমার ডান দিকে তাকাও, দেখো দুটো ছেলে বসে আছে!”
তিহু এক ঝলক ডানের দিকে তাকালো, সত্যি সত্যিই দুইটা যুবক বসে আছে, সে মৃদু কণ্ঠে বললো,,,—“হুম, আছে।”
নীল:“এবার বাঁ দিকে তাকাও।”
তিহু তাকিয়ে দেখলো, বাঁদিকেও সেরকম দুইটা যুবক একই ভঙ্গিমায় বসে আছে। তিহু ভ্রু কুঁচকে বলল,,,—-“হুম,, আছেই তো! কিন্তু তাতে কি হয়েছে?”
নীল:“ওরা দুজনেই আমার লোক. যারা সার্বক্ষণিক তোমার দিকে নজরদারি করছে। ইনফ্যাক্ট, ওদের হাতে দেখো একটা ফোন আছে, যাতে ভিডিও অন করা। সো আশা করি সবটা বুঝতে পেরেছ।
তিহু এবার বুঝলো, এতক্ষণ নীল তাকে চিনেই কথা বলছিল। এদিকে ফোনে স্পিকার অন করা থাকায়, রিতু,নিদ্রা আশরা আর মাহাও সে কথাগুলো শুনলো। সবাই তাজ্জব বনে গেলো নীলের এমন কাণ্ডে। হতভম্ব তিহু নিশ্চুপ রইল, নীল ফের বলল,,,
———“ খান সাহেবা একদমই ভেবোনা আমি আশেপাশে না থাকলে তুমি আমার দৃষ্টিসীমার আড়ালে চলে যাচ্ছ, মাইন্ড ইট নুরাইন হক নাউ ইউ আর মাই ওয়াইফ মিসেস নুরাইন ওয়াহাজ। তাই তোমার প্রত্যেকটা নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মৃদুগুঞ্জনও, আমার অজ্ঞাত নয়।”
হিম শীতল তিহু এতক্ষণে ছোট্ট একটা নিশ্বাস ছাড়লো। অপর পাশ থেকে নীল বলল,,,—“তো সাহেবা এবার আর বাদরামি না করে দয়া করে বাহিরে আসুন। আ’ম ওয়েটিং।”
তিহু একজন বাইরে তাকিয়ে নীলের গাড়ি দেখে, আনমনে মুচকি হাসলো। অতঃপর বন্ধু মহল কে বিদায় জানিয়ে এগিয়ে চলল কাঙ্খিত গন্তব্যের উদ্দেশ্য।
নীলের গাড়ির সামনে এসে থামলো তিহু। কিছুক্ষণ আগের নিজের দুষ্টুমির কথা চিন্তা করে হঠাৎ লাজুক হাসলো সে। গাড়ির দরজা খুলে, নীলের পাশের সিটটাই বসে এক ঝলকে নীলের দিকে তাকালো সে। সম্পূর্ণ ফর্মাল গেট আপে বসে আছে নীল । দেখেই বোঝা যাচ্ছে অফিস থেকে বের হয়েই এখানে এসেছে সে। কালো রোদচশমার আড়ালে আবৃত তার নীল আঁখি জোড়া। তিহু কিছুটা বোকা হেসে বলল,,,,
———“আপনি বুঝে গিয়েছিলেন না আমি ওটা?”
নীল সে কথার জবাব না দিয়ে, বরং বলল,,,———“সিট বেল্ট লাগাও!”
নীলের কথাটা বুঝতে তিহুর কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো। অতঃপর পাশ থেকে সিটবেলটি খুঁজতে গিয়েও সেটা না পেয়ে, বিরক্তি মুখে পাশ ঘুরতেই নীল কিছুটা গম্ভীর কণ্ঠে বললো,,———“সামান্য সিট বেলটাও খুঁজে পাওনা?”
তিহু:“সামান্য মানে? আমি ড্যাম শিওর আপনি নিজে খুঁজলেও পাবেন না। কেননা এখানে সিট বেল্টটাই নাই।”
নীল তিহুর সম্মুখে চেয়ে বলল,,,——-“আমি যদি পাই তো?”
তিহু:“পাবেন না?”
নীল:“চ্যালেঞ্জ করছো?”
তিহু:“যা মনে করেন!”
নীল এবার বাঁকা হেসে তিহুর দিকে এগিয়ে এলো, বেল্টটা খোঁজার প্রয়াসে সামান্য ঝুঁকে তীক্ষ্ণ নয়ন জোড়া স্থবির করলো, এদিকে নীল বেল্ট খোঁজার দরুন বেশ কাছাকাছি চলে এসেছে তিহুর। তার শরীর থেকে ভেসে আসা কড়া পারফিউমের সুবাস তিহুর নাকে এসে বাড়ি দিচ্ছে, এক অজানা শিহরণে কম্পিত হচ্ছে তার তরু কায়া, ভয় লজ্জা আর মিশেলে তিহুর ফর্সা মুখশ্রী রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে।
নীল সিট বেল্টটা খুঁজে পেয়েই মুখ তুলে একবার তিহুর পানে চাইল। মূল উদ্দেশ্য ছিল তাকে কিছু বলা, কয়েকটা কথা শোনানো, অথবা তার জেদের বিরুদ্ধে কাজে সক্ষম হওয়া দরুন কিছু বলে তার জেদে ভাঙ্গন ঘটানো। তবে মুখ তুলেই তিহুর এমন লজ্জা মাখা রক্তিম মুখশ্রী দেখে নীল নিজেই থ’বনে গেল। হুট করে মেয়েটাকে অন্যরকম লাগলো তার দৃষ্টিতে।
জিদ্দি আর তেজি মেয়েটাকে কেন যেন অন্যরকম লাগতে শুরু করল। তার মুখশ্রীতে বিদ্যমান সমগ্র লাজুকতা নীলের হৃদয়ে দোলা দিলো। সে যতটা না সুন্দরী, তার দশগুণ হয়ে আজ ধরা দিচ্ছে নীলের দৃষ্টিতে। কি অদ্ভুত লাগছে মেয়েটাকে, চোখ ফেরানো বড় দায় হয়ে পড়েছে। শুকনো একটা ঢোক গিলে নিজেকে ধাতস্থ করল নীল, বহু কষ্টে দৃষ্টি ফেরালো আপন রমণীর লাজুক মুখশ্রী থেকে।
ধীর হাতে সিট বেলটা পরিয়ে দিয়ে, ফের দক্ষ হতে ড্রাইভিং এ মনোযোগ দিল সে। এদিকে এতক্ষণ চোখ মুখ খিঁজে বন্ধ করার দরুন তিহু বুঝতেই পারেনি এক জোড়া নীল চক্ষু কিভাবে তার আরক্তিম মুখশ্রী কে নিবিষ্ট দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছিল।
গাড়ি ছুটছে বেশ অনেকক্ষণ হলো, পথটা তিহুর অচেনা। এতক্ষণ তো লাগার কথা নয়! ভার্সিটি থেকে গাড়িতে খান মহল অব্দি পৌঁছাতে বড়জোর ২০ থেকে ২৫ মিনিট সময় লাগতে পারে, তবে আজকের সময়টা অর্ধ ঘন্টার কাঁটায় এসে থেমেছে। তিহু বিরক্ত হয়ে এবার বলেই উঠলো,,,
———“আপনি কি এই পথ যদি না শেষ হয় গানের ভক্ত না কি?”
নীল এক অন্যরকম ভঙ্গিমায় তাকালে, তিহু অন্যদিকে ফিরে মিন মিন করে বললো,,,—-“গাড়ি চলছে তো চলছে, একটা গানও চালায় না, কি বোরিং রে বাবা!”
তিহু কতটা যেন শুনতে পেল নীল। ড্রাইভিংয়ে মনোনিবেশ করে সে বলল,,,—-“সাউন্ড সিস্টেমটা তোমার সাইডেই, পছন্দ অনুযায়ী মিউজিক সিলেক্ট করতে পারো।”
বিরক্ত তিহুর মুখ হঠাৎই উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। সামনের দিকে তাকাতেই সে দেখতে পেল ক্যাশবোর্ডের ধারে থাকা মিউজিক সিস্টেমটাকে। অতঃপর বহু খুঁজেও পছন্দ অনুযায়ী গান সিলেক্ট করল। মিউজিক সিস্টেমে মৃদুমন্দ শব্দ তুলে বাজছে গানটি।
🎶 Hai Yeh nasha yeh zeher’
‘Iss pyaar ko hum kya naam dein’
‘Kaise adhure hain ek dastaan’
‘Aa jao usey anjaam dein’🎶
সঙ্গে সঙ্গে তীব্র বেগে ব্রেক কষলো, নীল। বিস্ফোরিত নয়নে তিহুর দিকে চেয়ে বলল,,,
———“এই গান!”
প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ১১
তিহু কোনোরূপ ভাবান্তর না দেখিয়ে বলল,,,—–“হ্যাঁ, এটা আমার ফেভারিট গান, অতঃপর নীলের পানে চেয়ে চোখ সরু করে ফের বলল,,,—-“এ মা ছিঃ ছিঃ আপনি কি আবার ঐসব? আস্তাগফিরুল্লাহ! এজন্যই বলে নেতাদের ক্যারেক্টার খারাপ। নাহলে সিম্পল একটা গানকে কেউ ওই মাইন্ডে নিয়ে যায়! ছিঃ ছিঃ!”
নীল এবার নিজের কপাল নিজে চাপড়ালো যেন। মনে মনে বললো,,,,—–“মেয়ে তো নয় যেন ধানি লঙ্কা। ইয়া আল্লাহ রহম করো!”
