প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ১৬
নওরিন কবির তিশা
—“দেখুন তো এই ঝুমকাটা পার্ফেক্ট তো, না?”
তিহুর কন্ঠে হাতে ঘড়িটা পড়তে পড়তে এক ঝলক তার দিকে তাকায় নীল। সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি আটকে যায় তার, নিষ্পলক চেয়ে থাকে ডার্ক ব্লু কালার সাটিন শাড়ি পরিহিত, খোলা চুলের অপরুপাটির পানে। এদিকে নীলের দেওয়া শাড়ির সঙ্গে, কোন ঝুমকাটা পরলে ভালো লাগবে, তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিল তিহু ।
অবশেষে বহু কষ্টে একজোড়া পাথুরে ঝুমকা পছন্দ হয় তার, তবে সেটা শাড়ির সাথে ম্যাচ করবে কিনা তাই নিয়ে পড়েছে আরেক চিন্তায় । না পেরে শেষমেষ, নীল এর কাছেই প্রশ্নটা করে ফেলল সে । তবে প্রশ্ন করে পড়েছে আরেক বিপাকে,নীল প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বরং হাঁ করে তাকিয়ে আছে তার থেকে । তিহু মুখ কুঁচকে বলল,,,
———“এই যে মিস্টার, আপনি কি বলবেন নাকি আমি এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবো?”
তার কন্ঠে যেন ধ্যান ছুটল না , বরং দৃষ্টিতে ঠিক আগের মতই মুগ্ধতা রেখে,ঘোর লাগা কণ্ঠে সে বলল,,,—-“Absolutely gorgeous.”
তিহু নীলের এমন কথায় ভ্রু কুঁচকে বলল,,,,—–“মানে?”
ধ্যান ভাঙ্গলো নীলের । বুঝলো এতক্ষণ কিভাবে আহাম্মক এর মতো চেয়েছিল সে । তৎক্ষণাৎ নিজের দৃষ্টি সরিয়ে, হাতের দ্রুত ঘড়িটা পড়ে নিল । অতঃপর কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই বেরিয়ে গেল রুম থেকে । তার এমন কর্মকাণ্ডে, তাজ্জব বনে গেল তিহু । এক হাত কোমরে রেখে বোকা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আনমনে বলে উঠলো,,,———“এই লোক এমন করল ক্যা!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রেডি হয়ে, সেই ঝুমকাটা পড়েই নিজেই এসেছে তিহু । সুদীর্ঘ কেশরাজিকে আবদ্ধ করেছে ফ্রেঞ্চ বিনুনীর বন্ধনে। বিনুনীটা তার হাঁটুর নিচ অব্দি এসে পড়েছে, সামনের কিছু চুল কার্ল করা, বেবি হেয়ার গুলো কপালের ওপর খেলা করছে । নীল সোফায় বসে তার অপেক্ষা করছিল, তিহু কে সিঁড়ি বেয়ে নামতে দেখেই, ভেতরে হৃদযন্ত্রটা ফের দামামা শুরু করলো তার । বুকের বাঁ পাশে হাত রেখে, হৃদযন্ত্র টাকে ধিক্কার জানিয়ে সে মনে মনে বলল,,,
———“Stop jumping like this, stupid!”
তিহু নিচে আসতেই তাকে ঘিরে ধরল মির্জা সায়মা, রাফা আর রুমিন আরা খান । পাশেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে নীরা । রুমিন আরা দুষ্টু হেসে বলল,,—-“কি ব্যাপার? এত সেজেগুজে কি বরের সাথে কোথাও যাওয়া হচ্ছে নাকি?”
রুমিন আরার কথায়, মুগ্ধ হাসলো তিহু। এই মানুষটা অমায়িক, যেমন দারুন ব্যবহার, তেমন আদুরে তার স্বভাব । তিহু ভেবে পায় না, এত দারুন একটা মানুষের গর্ভে কিভাবে ওই মুন্নির মত একটা চু’ন্নি জন্মাতে পারে! সে লাজুক কণ্ঠে বললো,,———“তেমন কিছু না ফুপ্পি, ওই আসলে একটু…!”
তাকে কথার মাঝে থামিয়ে দিয়ে রুমিন আরা ফের বললেন,,,———“থাক থাক, বুঝি বুঝি । ওইসব দিন আমরাও পার করে এসেছি, কি বলো ছোট ভাবি?”
মির্জা সায়মা হেসে তিহুর দিকে এগিয়ে এসে বললেন,,,———“থাক না রুমি, দেখচ্ছিস না মেয়েটা কেমন লজ্জায় লাল হয়ে উঠছে।”
অতঃপর তিনি নিজের চোখ থেকে একটুখানি কাজল নিয়ে তিহুর গন্ডদেশের নিচ বরাবর লাগিয়ে দিয়ে বললেন,,,,———“মাশাআল্লাহ, মাশাআল্লাহ, কি দারুন লাগছে আমাদের পরীটাকে । কারো নজর না লাগুক।”
রাফা:“দেখি তোমরা সরো তো, সেই তখন থেকে ঘিরে রেখেছে । আমাকেও একটু দেখতে দাও না ।”
একপ্রকার তাদের দুজনকে ঠেলে তিহুর কাছে আসলো রাফা । তার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,,-———“মাশাআল্লাহ বউমনি, তোমাকে পুরাই ফেইরি লাগছে । কি দারুণ !”
রাফার কথায় বেশ লজ্জা পেল তিহু ।——“ধন্যবাদ!”
তাদের এমন কথোপকথন এর মাঝে নীল অধৈর্য কন্ঠে বলল,,———“তোমাদের গসিপ কি শেষ হয়েছে? লেট হয়ে যাচ্ছা আমার ।”
তার এমন কথায় রুমিন আরা মুখ বাঁকিয়ে বললেন,,,-——“তোর বউকে কি আমরা রেখে দিচ্ছি বাপু?আহ জ্বালা,একটু সুন্দরী বউ বিয়ে করে না জানি কি ভাবছে ! যাওতো নুরাইন মা । তোমার অধৈর্য বরের কাছে যাও ।”
তিহু এবার সত্যি সত্যি লজ্জায় পড়ল । তবে তাতে কোনো হেলদোল নেই নীলের, সে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,,———“দ্রুত আসো নুর ।”
অগত্যা, তিহুও সবাইকে বোকা হেসে বিদায় জানিয়ে এগিয়ে চলল নীলের পিছু পিছু।
তারা বেরিয়ে যেতেই, রাফা সেদিকে তাকিয়ে মন খারাপের সুরে বলল,,,,———“ইশশ,বউমনির কি ভাগ্য! কি সুন্দর ভাইয়ার সাথে সব জায়গায় ঘুরে বেড়াতে পারছে!”
তার কন্ঠে হতাশাস্পষ্ট, তা শুনে রুমিন আরা হেসে বললেন,,,———“আহারে! আচ্ছা এক কাজ করি রাফু, তোকেও বিয়ে দিয়ে দেই, তখন তুইও বরের সাথে সারাদিন ঘুরতে পারবি, পড়াশোনা করা লাগবে না । তাহলে আজকেই আমি আপার সাথে কথা বলি । কি বলিস?”
রাফা আনমনে ছিল, তাই রুমিন আরার কথা ভালোভাবে না শুনেই সে বলে উঠলো,,,———“হু!”
তার কথায় চাপা হাসলো রুমিন আরা আর মির্জা সায়মা । মির্জা সায়মা তার মাথায় আলতো চাপড় দিয়ে সেখান থেকে চলে যেতে যেতে বললেন,,,———“পাগলি একটা!”
তারা চলে গেলেন, এদিকে দুই তলার করিডোর দিয়ে নাম ছিল নিহিত । রাফা,মা আর ছোট ফুপ্পির এমন কথায়, রীতিমতো হোঁচট খেলো সে । রাফার উপর রাগও হলো দারুন, গাধিটা কি শুনেছে? ছোট ফুপ্পি তাকে কি বলেছে? সে দ্রুত পায়ে নিচে এসে, রাফার মাথায় সজোরে থাপ্পড় দিয়ে বলল,,,,———“এই গাধি, ছোট ফুপ্পি তোকে কি বলেছে,শুনেছিস?”
ততক্ষণে হুশে এসেছে রাফা, বুঝেওছে কিছুক্ষণ আগে রুমিন আরার বলা কথাটা । নিজে লজ্জা পেলেও,নিহিতের এমন গাট্টা সহ্য হলো না তার । রেগে গিয়ে বলল,,,
——“হ্যাঁ শুনেছি আর বুঝেওছি, আমার বিয়ের কথা বলেছে । তো এতে মন্দ কি? এমনিতেও কোথাও ঘুরতে পারি না, একটা সুন্দর দেখে হ্যান্ডসাম ছেলেকে বিয়ে করবো আর সারাদিন ঘুরে বেড়াবো ।”
রাফার কথায় হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আসলো নিহিতের, দাঁতে দাঁত চেপে সে বলল ,,,—–“কি বললি? আরেকবার বল।”
রাফা:“বলেছি আমি বিয়ে করতে চা…!”
তার কথা শেষ করতে দিল না নিহিত, দুই হাতে রাফার গোলুমোলু নরম দুই বাহু চেপে ধরে বলল,,,-——“চুউউপ! আর একবার ঐ কথা বললে জানে মেরে দেবো তোকে । ট্রাস্ট মি, একেবারে জানে মেরে দেবো।”
বলেই একপ্রকার ঝাড়ি মেরে তাকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে, ধুপ ধাপ পায়ে মহল থেকে বেরিয়ে গেল নিহিত । রাফা বোকা দৃষ্টি মেলে চেয়ে থাকল সেদিকে, বুঝলো না এই ছেলের হঠাৎ হলো টা কি !
দীর্ঘ এক জার্নি শেষে, গাড়ি এসে থামলো আলোক সজ্জিত এক বিলাস বহুল ভবনের সামনে । সন্ধ্যা গাঢ় হয়ে রাত ঘনীভূত, ঘড়ির কাঁটায় হয়তোবা সাতটা কি আটটা । সাধারণত জন্মদিনে অনুষ্ঠানগুলো, রাত বারোটায় সংঘটিত হলেও, অরুর ক্ষেত্রে সেটা ভিন্ন । কেননা তার জন্মদিন ছিল গতকাল, আর আজকে সেটারই পোস্ট-বার্থডে সেলিব্রেশন ।
তিহু গাড়ি থেকে নামলো, ভবনের বাইরে স্ট্রিং লাইটের বিবিধ আলোক রশ্মির ঝলকানি । অদূরের মিষ্টি হাওয়া ক্ষণে ক্ষণে ছুঁয়ে যাচ্ছে শাড়ির আঁচল । অদ্ভুত অনুভূতিতে চড়মড়িয়ে উঠছে, ভেতরটা । সে নামার মুহূর্ত কয়েকের মাঝে গাড়ি থেকে নামলো নীল । তার পরনে তিহুর সাথে, ম্যাচ করেই ডার্ক ব্লু কালার, ফরমাল ড্রেস । লোকটাকে মাশাআল্লাহ, মারাত্মক সুদর্শন লাগছে । বিশেষ করে তার নীল চক্ষুদ্বয় অত্যাধিক আকর্ষণীয় ।
তিহু আড়চোখে তার দিকে তাকালো, পরক্ষণেই সে অনুভব করল লোকটা তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে । সে কিছু বলার আগেই, নীল নিজের বাহু দ্বারা তার ক্ষীন বাহু আঁকড়ে ধরল । নীলের সঙ্গে নিজের ঘনিষ্ঠতা অনুভূত হতেই, হৃদযন্ত্রটার নৃত্য বেগতিক হলো তিহুর । শুকনো একটা গিলে, এক ঝলক মাথা তুলে নীলের পানে তাকালো সে ।
উচ্চতায় তিহু নীলের কাঁধ বরাবর, তাই লোকটাকে দেখতে সামান্য মাথা উঁচু করা লাগে তার । তবে অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এমন ঘনিষ্ঠতায় তিহু লজ্জায় আরক্ত হয়ে উঠলেও, অপর প্রান্তে মানুষটার কোনো হেলদোল নেই । অনুভূতি শুন্য মুখশ্রীতে সম্মুখে তাকিয়ে আছে সে, তিহু সামান্য মুখ বাঁকালো । নীল সেদিকে না তাকিয়েই বললো,,,
——“লজ্জায়, লাল টমেটো হওয়ার দরকার নেই । অভ্যাস করে ফেলো ।”
“মানে?”———তীব্র কৌতুহলে প্রশ্নটা করল তিহু ।
তবে নীল কোনো জবাব না দিয়ে, হাঁটা শুরু করল ভবনটির উদ্দেশ্যে ।
অরু সেই তখন থেকে, বন্ধুদের সাথে গল্প করছে আর বারংবার প্রধান দরজা দিকে তাকাচ্ছে । অপেক্ষা একজনেরই, সে সহ এখানকার সব মেয়েদের স্বপ্নের পুরুষ ওয়াহাজ খান নীল। অরুর এমন অবস্থা দেখে, তার বান্ধবী রুহি বলল,,,
—“ট্রাস্ট মি, অরু । নীল স্যার আমার ইভেন ওহী, ঋদ্ধিমা শ্রেয়সী ওদেরও ক্রাশ । আর এমনিতেই উনিতো ন্যাশনাল ক্রাশ ভাই, এমন কোনো মেয়ে আছে? যে প্রথমবারই তাকে দেখে ক্রাশ খায়নি । বাট তোর মত এত আঁকুপাঁকু?”
অরু দৃষ্টি জোড়া প্রধান দরজায় নিবন্ধ রেখেই বলল,,-—“আমার ক্ষেত্রটা ভিন্ন, তোরা বুঝবি না।”
তার কথা শেষ হতে না হতেই, ভবনে প্রবেশ করল নীল, তবে তাকে দেখে মুগ্ধ হওয়ার পরিবর্তে চোখ কুঁচকে আসলো অরুর । কারণ একটাই, তার বাহুতে আবদ্ধ থাকার সুশ্রী রমনীটি, নিঃসন্দেহে সে ভুবনমোহিনী সৌন্দর্যের অধিকারী । তবে আপাতত অরুর দৃষ্টিতে তাকে একদমই সুন্দর লাগছে না । অরুর সযত্নে হাস্যোজ্জ্বল মুখাবয়ব অন্ধকারাচ্ছন্ন হলো ।
ঠিক তখনই তার সামনে উপস্থিত হলো নীল । সামান্য হেসে, তাকে উইশ করলো । অরু ওভাবেই থ্যাংকস বলে ভাবল জিজ্ঞাসা করবে এই মেয়েটা কে? তার আগেই নীল নিজ থেকে বলল,,,
——“মিট মাই ওয়াইফ, মিসেস নুরাইন ওয়াহাজ খান।”
সঙ্গে সঙ্গে যেন অরুর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল, বজ্রপাত হলো ঠিক কাছেপিঠে কোথাও, আশেপাশের হাজারটা কথোপকথন থেমে গেল । তিহুও তাকে উইশ করেছে, তবে সেটা হয়তো কর্নকুহরে পৌঁছায়নি তার । ঠিক তখনই সেখানে হাজির হলো পানি মন্ত্রী ইশতিয়াক চৌধুরী । নীলকে দেখে সামান্য হাসলেও তিহুকে দেখে যেন সে খুশি হতে পারল না।
নীল একইভাবে তার সাথে তিহুর পরিচয় করিয়ে দিতেই তিনি একঝলক মেয়ের দিকে তাকালেন তিনি । অরুও এখনো সেই স্তব্ধ-স্থবির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে । একমাত্র আদরের মেয়েকে এমন অবস্থায় দেখে যেন সহ্য হলো না ইশতিয়াক চৌধুরীর । তিনি নীলের ব্যাপারে অরুর মনোভাব সম্পর্কে অবগত । সেজন্যই তো তিনি চেয়েছিলেন আজ, এই পার্টিতে নীলের কাছে,অরু আর তার বিয়ের প্রস্তাব রাখবেন । তবে নীল যে সেই পরিকল্পনায় পানি ঢেলে নিজের বউ নিয়ে উপস্থিত হবে এটা কে জানতো.?
🎶 জানি তুমি আছো একা…..
তবে কেন বলো দূরে থাকা…..
সময় তো থেমে থাকে না……
দ্বিধা ভেঙে কাছে এসো না……🎶
গভীর এক পৌরুষকন্ঠে ধ্যান ছুটে গেল মাহার । কন্ঠটা ভেসে আসছে পাশের বিল্ডিংয়ের ব্যালকনি থেকে, মাহা দ্রুত পাশে পড়ে থাকা ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে, কি এক অদৃশ্য টানে হুরমুরিয়ে ব্যালকানিতে এসে দাঁড়ায় । তার ব্যালকনির সম্মুখেই ঠিক বিপরীত পাশের ব্যালকনি টা তে বসে গিটার হাতে এক মনে এদিকে তাকিয়ে গানটা গাইছে রাওফিন।
রাওফিন কে দেখে, অবাকের চূড়ান্ত সীমায় আরোহন করে মাহা । সে এখানে কি করছে? প্রশ্নতা মস্তিষ্কে নাড়া দিতেই, দৃষ্টিজোড়া বড় হয় তার। তাকে দেখে মুচকি হাসে রাওফিন, গিটারটা পাশে রেখে রেলিং এ হাত শক্তপোক্তভাবে ধরে, গা ছাড়া ভাবে বলে,,,
——“কি ভেবেছিলে? তুমি অ্যাডড্রেস না দিলে আমি কখনো তোমায় খুজে পাবো না? You’re totally clueless about me,my sweetest darling!”
মাহা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। রাওফিন ফের বলতে শুরু করে,,,——“Don’t worry, তোমাকে বউ বানিয়ে তবেই আমরা একসঙ্গে বাসায় উঠবো । ততদিন না হয় আমিও এই ফ্ল্যাটটায় থাকি । কি বলো?”
মাহা এবার তেঁতে উঠল যেন,——“লিসেন রাওফিন, তুমি যে পাগলামি গুলো করছ না, এগুলোতে কোনো লাভ হবে না। আর কি বললে তুমি? তুমি এই ফ্ল্যাটে থাকবে । ট্রাস্ট মি, তুমি এখানে থাকলে আমি কালকেই এখান থেকে চলে যাব । ভার্সিটি গিয়ে হলে থাকার ব্যবস্থা করব, তবুও তোমার বিপরীত বিল্ডিংয়ে কক্ষনো থাকবো না ।”
বলেই সেখান থেকে চলে যায় মাহা, সশব্দে আটকে দেয় ব্যালকনির সঙ্গে লাগোয়া রুমের দরজাটা । রাওফিন ব্যথাতুর দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে সেদিকে । সে জানে হয়তো, পুরাতন রূপে তার প্রেয়সিকে ফিরে পেতে, অনেক অপেক্ষার প্রহর গুনতে হবে তাকে। তবে সে রাজি, জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অব্দি, অপেক্ষা করতে রাজি সে ।
পার্টির পরিবেশ থমথমে, আনন্দ উল্লাস মাটি করে দিয়েছে নীল খান একা হাতে । তবুও উপস্থিত সকলকে তো আর নিজের মনোভাব বুঝতে দেওয়া চলে না, তার ওপর এখানে উপস্থিত সবাই তাদের অতি পরিচিত, বাবার ফ্রেন্ডের ও তাদের ছেলে মেয়ে । তার ওপর নিজের বন্ধু মহল তো আছেই । তাদের সামনে নিজের নাক-কান কোনোমতেই কাটতে পারবে না অরু ।
তাই একপ্রকার হাসি খুশি থাকার অভিনয়ে ব্যস্ত সে । তাদের পার্টির মূল আকর্ষণ ছিল উপস্থিত কাপলদের স্লো ডান্স। এটার আয়োজন অরু নিজেই করেছিল । ভেবেছিল, নীল যেহেতু একা, তাই হয়তো পার্টনার হিসেবে সে জয়েন করতে পারবে । তবে তখন কি আর জানা ছিল,যে নীল নিজের সহধর্মিনীকে নিয়ে হাজির হবে ।
যাইহোক, অবশেষে ডান্সের জন্য সেই নিয়ন আলোক পরিবেশের তৈরি করা হয়েছে। কাপলরা সবাই, নিজ নিজ পার্টনার নিয়ে উপস্থিত সেথায় । শুধুমাত্র নীল আর তিহু দূরে বসে আছে । তিহু কোন মতেই, ডান্স করতে চায় না । কেননা তার ভালো করেই জানা, ডান্সের বাহানায় নীলের বেশ কাছাকাছি চলে যাবে সে । আর এই মানুষটা মা*দ*কের থেকেও ভয়ংকর, কখন যে তিহুর ঘোর লেগে যাবে , আর ঘটবে ভয়াল কান্ড । আল্লাহ মালুম।
না বাবা, কোনমতেই কোন রিক্স নিতে চায় না সে । তবে কথায় আছে না, অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকিয়ে যায়। তার অবস্থাও হয়েছে তেমন, এই যে সে ডান্স করতে চায় না এই সুযোগে কতগুলো ছ্যাঁচড়া মেয়ে এসে, নীলকে নিজের পার্টনার হিসেবে অফার করছে । দেখেই মেজাজ বিগড়ে গেল তিহুর, মেয়েগুলোকে নীলের পাশ থেকে একপ্রকারের ঝটকা মেরে সরিয়ে দিয়ে, নীলকে টেনে ডান্স প্ল্যাটফর্ম এর কাছে নিয়ে যেতে যেতে বলল,,,,
——“বাড়ি চলুন, আপনার নজর কাটানোর ব্যবস্থা করতে হবে । আশেপাশে শাকচুন্নির উৎপাত বেড়েছে ইদানিং । পুরো ঝাঁঝালো শুকনো লঙ্কা পুড়িয়ে নজর কাটাবো।”
নীল:“তো এদিকে কোথায় যাচ্ছ?”
তিহু:“ডান্স করতে!”
নীল:“সিরিয়াসলি? তুমি না বললে তোমার প্রবলেম হবে।”
তিহু:“প্রবলেম আপাতত চান্দের দেশে ।”
নীল বাঁকা হেসে তাকালো তিহুর দিকে, মেয়েটা কে এমন হিংসায় জ্বলতে দেখলে বেশ লাগে তার। সেভাবেই ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি বিদ্যমান রেখে নীল বললো,,,
——“পোড়া পোড়া গন্ধ পাচ্ছি!”
তিহু:“হ্যাঁ, কিছুক্ষণ পর আপনার ক*লি*জা পোড়াবো সেই গন্ধই আগে থেকে পাচ্ছেন আপনি ।”
নীল আর কোনো কথা বলল না।স্রেফ মুচকি হাসলো।
স্ট্রিং লাইটের মৃদু আলোয়,আলো-আঁধারির সন্ধিক্ষণে মাঝে কয়েক জোড়া কপত-কপতি নিজের সঙ্গীকে আঁকড়ে দাঁড়িয়ে । সাউন্ড সিস্টেমে হঠাৎই বেজে উঠলো animal মুভির জনপ্রিয় গান,,,
“Pehle bhi main tumse mila hoon,
Pehli dafa hi milke laga.
Tune chhua zakhamo ko mere,
Marham-marham dil pe laga.”
গান বাজতেই নীল নিজের এক হাত তিহুর শাড়ি ঢাকা আবরন ভেদ করে,তার পাতলা কোমরে রাখলো । উন্মুক্ত কোমরে নীলের এমন শীতল স্পর্শে তীব্র গতিতে কেঁপে তিহু। নীল মুচকি হেসে কাছে টেনে নিলো তাকে । তার একহাত নিয়ে নিজের প্রশস্ত কাঁধটাতে রাখল । শুরু হলো কপত-কপতির এক মনমুগ্ধকর স্লো ডান্স।
সকলে ব্যস্ত নিজেদের সঙ্গিনী কে নিয়ে । এদিকে নীল নিবিড় দৃষ্টিতে চেয়ে আছে,তিহুর পানে । আর তার ঘায়েল করা দৃষ্টিতে, লজ্জায় লাজুক লতার ন্যায় নুইয়ে আসছে তিহু । নীলের গলার ধারে থাকা হাতটা দিয়ে সর্বশক্তিতে খামচে ধরলো তার কলারটা । যার দরুন নখের সামান্য আঁচড়ে লালচে হলো নীলের ফর্সা কাঁধটা । তবে তাতে কোনরুপ হেলদোল দেখালো না নীল । সে ডুবে আছে মুগ্ধতার এক মহাসমুদ্র, অতলস্পর্শী সেই সমুদ্রের গভীরতম স্থানে বিচরণ করছে সে ।
ডান্সটা এতক্ষন বেশ চলছিল । স্লো পারফরম্যান্সের অনুভবে ডুবে আছে সবাই । হঠাৎই গানের লাইন অনুসারে “Pehle bhi main tumse mila hoon” লাইনটির পুনরাবৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে জোরে ইন্সট্রুমেন্টের সাউন্ড বেজে উঠলো । ডান্স অনুযায়ী নীল তিহুকে স্ববেগে নিজের কাছে টেনে দূরত্ব ঘুচিয়ে ফেলল । সঙ্গে সঙ্গে ঘটলো এক অপ্রীতিকর ঘটনা, তিহুর ব্লাউজের পিছনের দুইটা হুক পরপর খুলে গেলো । উন্মুক্ত হলো ফর্সা পিঠটা । তিহুর শ্বাস যেন আটকে আসছে । ভয়ে,লজ্জায় চোখ কোটর থেকে বের হয়ে আসার উপক্রম ।
উপায়ান্তর না পেয়ে সে দ্রুত নিজেকে নীলের প্রশস্ত বক্ষদেশে লুকিয়ে,গুমড়ে উঠলো, শক্ত হাতে চেপে ধরল তার পোশাক। তার চাপা আর্তনাদ,কর্নকুহরে পৌঁছাতেই অপ্রস্তুত হয়ে উঠল নীল। এর আগে কখনো তিহুকে এমন আরক্ত হতে দেখে নি সে । তাহলে আজ হঠাৎ কি হলো? ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে নীল বলল,,,
——“নুর!এই নুর? কি হয়েছে?”
নীলের কন্ঠে কম্পমাত্রা তীব্র হলো তিহুর,ফুপাঁনো কণ্ঠে সে বলল,,,
——“আ-আ-আমার, ব্লাউজের হুক…!”
কম্পনের তোপে আর লজ্জায় কথাটা শেষ করতে পারল না সে । নীল দ্রুত তার পিঠে হাত রাখল, সঙ্গে সঙ্গে সবটা বুঝতে পারলো সে। দ্রুত কন্ঠে বলল,,,
——“ডোন্ট ওয়ারি, আমি এক্ষুনি সব ঠিক করে দিচ্ছি। ”
বলেই তিহুকে এক প্রকার কাঁধে তুলে নিয়ে, সেখান থেকে চলে গেল নীল । স্থানটা অন্ধকারাচ্ছন্ন, আর সকলের স্লো ডান্সে ডুবে থাকায়, ব্যাপারটা ততএকটা লক্ষ্যগত হলো না কারো ।
ওয়াশরুমের সামনে এসে, তিহুকে নামালো নীল । আশপাশটা জনমানবশূন্য । দ্রুততার সহিত ভেতরে ঢুকেই নীল তার কম্পনরত রক্তিম মুখশ্রীতে আদুরে হাত রেখে নরম কন্ঠে বলল,,,
——“এমন করো না, প্লিজ । ওয়েট,ওয়েট আ মিনিট। আমাকে একটা মিনিট টাইম দাও আমি সব ঠিক করে দিচ্ছি।”
তিহু এখন কিছুটা নিশ্চিন্ত। নাক টেনে সে বলল,,,
——“আমার পিঠ !”
প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ১৫
নীল আর কিছু বলার সুযোগ দিল না, দ্রুত তাকে পিছন ঘুরালো । অতঃপর ব্লাউজের হুক দুটো লাগাতে গিয়েই তার, দৃষ্টিগত হলো তিহুর পিঠের মাঝ বরাবর থাকা লালচে তিলটা । শুকনো একটা ঢোক গিললো নীল । যার দরুন তার অ্যাডামস অ্যাপেলের মৃদু সঞ্চালন লক্ষ্যগত হলো আয়নার মাঝে । দ্রুত হাতে হুক দুইটা লাগিয়ে চটজলদি সেখান থেকে প্রস্থান করল নীল । হৃদযন্ত্রের দামামা শান্ত করাটা এখন বেশি প্রয়োজন।
