প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ১৭
নওরিন কবির তিশা
ভার্সিটির ক্লাস শেষ হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ হলো, সময়টাতে অফ পিরিয়ড বিদ্যমান । মুহূর্ত কয়েকের মাঝেই, ছুটি হবে । অনেকে অবশ্য বেরিয়ে গিয়েছে, তবে অনুষদের সামনের খোলা সবুজাবৃত মাঠটায়, বসে আছে তিহু আর তার গুটি কয়েক সদস্যের বন্ধু মহল । বিভিন্ন গল্প গুজবে লিপ্ত হয়েছে তারা, একপর্যায়ে হঠাৎই আশরা বলল,,,,
——“যে যাই বলুক তিহু, তোর বরটা কিন্তু জোস । যেমন হ্যান্ডসাম,তেমন ড্যাশিং । আল্লাহ , ম্যা লুট গায়া।”
রিতু:“শুধু হ্যান্ডসাম? বল ন্যাশনাল ক্র্যাশ, আল্লাহ আমার নিজেরই তো এত ভালো লাগে । শুধুমাত্র বান্ধবীর বর বলে..!”
তিহু:“নজর দিচ্ছিস? দিলে দে সমস্যা নাই,সমস্যা বরং তোদেরই । কেননা আমি সকালেই, শুকনো লঙ্কা পুড়িয়ে নজর কাটিয়ে এসেছি ।”
মাহা সামান্য ভ্রু উঁচিয়ে বলল,,—–“বাব্বা, এত জেলাস? কে জানি আমাকে বলেছিল, নেতাদের ক্যারেক্টার খারাপ হয় । তাদের পাত্তা দিতে নেই, অন্ততপক্ষে আমি তো কখনোই পাত্তা দিব না ।”
তারা এমন কথায় ঠিক পাশ থেকে রিশাদও বলে উঠল,,,—–“আজ সিঙ্গেল বলে।”
তিহু:“চুপ করবি তোরা!”
আশরা:“আচ্ছা সেসব বাদ দে । দোস্ত তুই একটা কথা বল, শুনলাম আমাদের নেতা সাহেব নাকি অনেক কেয়ারিং ।”
তিহু কিছু একটা বলতে গিয়েও থমকালো । স্মৃতির পাতায় দোলা দিল, মন্ত্রীর মেয়ের বার্থ ডে পার্টির রাতের সেই কথা । আনমনে মুচকি হেসে সে বলল,,,—-“তাই একটু আছে।”
মাহা:“আহাহাহা, বান্ধবী আমার ব্লাশ করে । ইস…!”
তিহু:“ধুর বা*ল!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আদ্রি:“দোস্ত, তাহলে চল আজ তোকে একটা ডেয়ার দি।”
তিহু ভ্রু কুঁচকে বলল ,,—“আমরা কি ট্রুথ-ডেয়ার খেলছি?”
আদ্রি:“ট্রুথ-ডেয়ার খেলা লাগবে কেন? এই ডেয়ার টা শুধুমাত্র বিয়েত্তা গো জন্য! আর এখানে তো বিয়েত্তা একমাত্র তুই ।”
তিহু:“কে বিয়েত্তা? আমি? কোনো প্রমাণ আছে?প্রমাণ ছাড়া একটা সিঙ্গেল মেয়েকে তুই বিয়েত্তা বলে দিলি আল্লাহ !”
মাহা মুখ বাঁকিয়ে বলল,,,—-“কয়দিন পরে শুনব আমরা খালামণি হচ্ছি, এখন নাকি ও সিঙ্গেল । আর কত কি যে দেখব দুনিয়ায়!”
তিহু:“ছিঃ ছিঃ, অশ্লীলের দল । আল্লাহ রহম করো । ওই ব্যাডা কোনদিন আমাকে টাচও করেনি । আর না তো করতে পারবে । তো এতদূর ভাবার কোন দরকার নেই বেবজরা ।”
তার কথায় দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে নিদ্রা গেয়ে উঠলো,,,
🎶ও আঁচল ধরে টান দিও না লাজে মরে যাই…..
প্রথম রাতে আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাই…..🎶
তার গানে মুখ চেপে হেসে উঠল সবগুলো । রিশাদ দু চোয়ালে আলতো থাপ্পড় দিয়ে বলল,,,-——“তওবা তওবা আস্তাগফিরুল্লাহ!”
নিদ্রা গান থামিয়ে বলল,,,—-“সো গাইজ, আমাদের তিহু সুইটহার্ট এই গান গেয়ে বেঁচে গিয়েছিল ।”
তিহু:“মাফ চাই বইন তোগো কাছে, অহন ক, কি ডেয়ার দিবি আমি, রাজি আছি । অন্তত তোদের এই গানের থেকে বেটার হবে নিশ্চয়ই ।”
আশরা:“এবার আইছে পথে । আচ্ছা তুই এক কাজ কর, আমাদের সামনেই আমাদের নেতা সাহেব কে একবার কল কর । আর বল তোর ভাল লাগছে না, তুই ঘুরতে যেতে চাস । আমরাও দেখি, নেতা সাহেবের কেয়ারিং লেভেল ঠিক কতটা?”
তিহু:“এই না না, এখন এটা করা যাবে না । উনি এখন খুব সম্ভবত পার্টি অফিসে আছেন । বলছিল কি একটা মিটিং আছে ।”
আশরা:“উম… আর ঢং করা লাগবে না । বললেই হয়, নেতা সাহেব এখন আসবেনা ।”
কথাটা যেন তিহুর আত্মসম্মানে লাগলো । মুখ গুটিয়ে দ্রুত ফোনটা বের করে, নীলের নাম্বারে ডায়াল করলো সে। রিং হল মাত্র একবার, সঙ্গে সঙ্গে ফোন রিসিভ করল নীল । গভীর কন্ঠে বলল,,,
——“হ্যালো।”
তিহু বুঝতেই পারে নি নীল এত দ্রুত ফোনটা রিসিভ করবে। অপ্রস্তুত কণ্ঠে সে বলল,,,—-“জ্বী বলুন?”
নীল সামান্য মুচকি হাসলো,,—-“ফোনটা কে করেছে?”
তিহু:“কেন?আমি!”
নীল:“তাহলে কথাগুলো কি বলতে চায়?”
তিহু:“আমিই তো!”
নীল ফের মুচকি হাসলো,,,—-“তো বলো?”
তিহু:“ইয়ে মানে,আপনার একটু সময় হবে?”
নীল:“কেন?”
তিহু:“আসলে আমার ভালো লাগছে না।”
নীল:“তো?”
তিহু:“আমি ঘুরতে যেতে চাই ।”
নীল:“কোথায়?”
তিহু:“কাছে-পিঠে কোথাও!”
নীল:“ওকে।”
তিহু কিছু একটা বলতে গিয়েই টের পায় ফোন কেটে দিয়েছি নীল । লোকটা ফোন কেটে দিলো কেন? সামান্য ভ্রু জড়ালো তিহু ।
১৫ মিনিট বাদে……
ভার্সিটি থেকে একে একে বেরিয়ে যাচ্ছে সবাই। তিহুও ব্যতিক্রম নয়, বন্ধু মহলের সাথে গেট পেরিয়ে বের হচ্ছিল সে। ঠিক তখনই তার সামনে এসে থামে,নামী ব্র্যান্ডের একটা বাইক । তিহু সহ সকলে ভ্রু কুঁচকে তাকায়, তবে পরক্ষণেই কুঁচকানো ভ্রু শিথিল হয় তাদের । কেননা বাইকার ব্যক্তিটিই তাদের নেতা সাহেব ।
লোকটাকে বাইকে দেখে বেশ অবাক হয় তিহু । কিঞ্চিৎ হেসে নীলের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,,,—-“আপনি?”
নীল:“তুমিই তো আসতে বললা!”
তিহু বিষ্ময়ের চূড়ান্ত সীমায়, নীল তার জন্য এসেছে । তার মানে এই জন্য তখন ফোন রেখে দিয়েছিল সে । হাসির রেখাটা প্রসারিত হয় ঠোঁটের কোণে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে বলে,,,—–“আপনি সত্যিই আমার জন্য এসেছেন?”
নীল:“না তো, ভার্সিটিতে এসেছি মেয়ে দেখতে । পছন্দ হলেই বিয়ে করে নেব । কি বলো?”
তিহু ভ্রু কুঁচকে তাকায় । নীল ধমকের স্বরে বলে,,,—-“বোকা বোকা প্রশ্ন না করে দ্রুত ওঠো!”
বলেই একটা লেডিস হেলমেট এগিয়ে দেয় তার দিকে । তিহু আর কোনো প্রশ্ন না করে চোখ কুঁচকে,মুচকি হেসে, বাইকে উঠে বসে। অতঃপর আলতো স্পর্শে নীলের কাঁধে হাত রাখে । নীল লুকিং গ্লাসে একঝলক, তিহুর দিকে তাকিয়ে মুঁচকি হেসে বাইক স্টার্ট দেয় ।
বাইক এসে থামে এক সবুজমন্ডিত নদীর ধারে । চারিধারে মৃদুমন্দ শীতল হাওয়া আর জনকলরবের মৃদুগুঞ্জন । তিহু মৃদু হেসে বাইক থেকে নামে, তার পরপরই নামে নীল । চারিদিকে কপতো-কপতির ভিড়, বিকালের নরম রৌদ্ররেখাটাও যেনো মিইয়ে এসেছে । তিহু মুচকি হেসে শুধালো,,,
——“হঠাৎ,এখানে আনলেন যে?”
নীল:“কাছে-পিঠে এর থেকে সুন্দর জায়গা আর আমার জানামতে নেই ।”
তিহু আর নীল পাশাপাশি হাঁটছিল । পাশাপাশি বলতে নীল তিহুর থেকে সামান্য এগিয়ে । লোকটা মাত্রাতিরিক্ত জোরে হাঁটে । সে এক পা ফেলে যত দূরে যাচ্ছে, ঠিক ততটা দূরত্ব অতিক্রম করতেই তিহুর তিন পা ফেলা লাগছে । সে বিরক্ত হয়ে বলল,,,,
——“এই যে মিস্টার ট্রেন, একটু ধীরে চলুন ।”
সে প্রায় দৌড়ে এসে নীলের পিছনে দাঁড়ালো, সানগ্লাসের আবরণে ঢাকা নীলের নীলচে চক্ষুদ্বয় তীক্ষ্ণ হলো । পিছন ফিরে সামান্য ভ্রু উঁচিয়ে সে বলল,,,
——“আমি ট্রেন?”
তিহু;“তা নয় তো কি? একবারও দেখছেন, আমি তিন পা হেঁটে যত দূরে যাচ্ছি আপনি এক পায়ে তার থেকে ডাবল যাচ্ছেন!”
নীল:“সেটা তোমার ব্যর্থতা । যে,তুমি জোরে হাঁটতে পারো না।”
নীল কি তাকে কথায় কথায় খোটা দিল? ভ্রু জড়ালো তিহু। মুখ বাঁকিয়ে বলল,,,——“এটা একদমই আমার ব্যর্থতা নয় । বরং আপনিই পায়ে ট্রেনের গতি নিয়ে হাঁটেন। এমনিতেই আমি অনেক জোরে হাটি ।”
নীল সামান্য মুচকি হাসলো। এই মেয়ের সাথে কথায় পারা বড় দায়। কন্ঠ খাদে ফেলে বলল,,,——“তার নমুনা দেখতেই পাচ্ছি ।”
তিহু:“কিছু বললেন?”
নীল জবাবে কিছু বলার আগেই,তিহুর দৃষ্টিগত হয় সামনে থাকা ফুচকার গাড়িটি । সঙ্গে সঙ্গে চোখ চিকচিক করে ওঠে তার । ফুচকা নামক জিনিসটাই একমাত্র, না না একমাত্র নয় । সঙ্গে আইসক্রিমও আছে। এই দুইটা জিনিস দেখলে তিহুর মাথা কক্ষনো ঠিক থাকে না, আর না তো ঠিক তাকে জিহ্বা । ভারী বর্ষণ শুরু হয় তাতে । এই যেমন এখন হচ্ছে ।
নীল কিছু বলতে গিয়েও থামল, তিহুর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো ফুচকার গাড়িটির দিকে। শুধালো,,,
——“ফুচকা খাবে?”
তিহু সেদিকে দৃষ্টি রেখেই আনমনে মাথা নাড়লো। নীল মুচকি হেসে, এগিয়ে চলল । পিছু নিল তিহু নিজেও ।
ফুচকা খেতে গিয়েই,তিহুর মনে পড়ল আগের দিনকার মেলায় সেই ফুচকা দুর্ঘটনার কথা । লাজুক দৃষ্টিতে এক ঝলক নীলের দিকে তাকালো সে । মানুষটা গম্ভীর দৃষ্টিতে মোবাইল ঘাটতে ব্যস্ত । তিহু এবার নিশ্চিন্ত মনে খেতে শুরু করল । খাওয়ার এক পর্যায়ে, নীলকে ফুচকা দিতে গিয়েও থামলো সে । না বাবা, একদম দরকার নেই । এই লোককে বিশ্বাস নেই । কখন কি করে বসে?
অন্যদিকে নীল আড়চোখে তিহুকে দেখছিল । তাকে এমন দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে দেখে, ঠোঁট চেপে মুচকি হাসলো সে । মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েই বলল,,,
——“আজকে আর ফুচকা অফার করবে না.?”
তার কণ্ঠে সামান্য অপ্রস্তুত হয়ে উঠলো তিহু । বোকা হেসে বলল,,,——“আপনি তো ঝাল খেতে পারেন না এই জন্য ।”
নীল:“সেটা আগের দিন বোঝা উচিত ছিল । বাই দ্যা ওয়ে, আজ আমি খেতে চাই । দাও ।”
তিহু শুকনা ঢোক গিলল,,—-“সত্যি খাবেন?”
নীল:“তো কি মিথ্যা বলছি?”
তিহু:“এটা কিন্তু অনেক ঝাল!”
নীল গভীর দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে, বাঁকা হেসে বলল,,,——“ডোন্ট ওয়ারি, ঝাল ঠান্ডা করার ঔষধ আছে আমার কাছে ।”
তার এমন কণ্ঠে চমকে তাকালো তিহু । বিস্ময়কর কণ্ঠে বললো,,,—-“ম-মানে?”
নীল সামান্য শব্দ করে হেসে উঠলো । পাশে থাকা আইসক্রিমের ভ্যানটি আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে বলল,,,——“ঐযে। আইসক্রিমের কথা বলছিলাম।”
নিশ্চিন্ত হল তিহু । তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে, ছোট্ট করে বলল,,,——“ওহ!”
ফের বাঁকা হাসলো নীল ।
তিহু প্লেট থেকে একটা ফুচকা নিয়ে তাতে সামান্য টক মিশিয়ে নীলের দিকে ধরল । নীল সেটা হাত দিয়ে না নিয়ে, বরং সরাসরি মুখে নিল । তিহু সামন্য ভ্রু জড়ালো। তবে পরক্ষণেই চোখ খিঁচে ফেলল, নীলের এক অপ্রত্যাশিত কাণ্ডে ।
নীল ফুচকাটা মুখে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, তিহু যখনই হাত সরিয়ে নিতে যায়, ঠিক তক্ষুণি নীল দুষ্টুমি করে তার ডান হাতের তর্জনীতে আলতো কামড় বসায় । লজ্জায় তিহুর সমগ্র শরীরে সৃষ্টি হয় মৃদু কম্পন । দ্রুত হাত সরিয়ে, ফুচকার প্লেটটা কোনোমতে যথাস্থানে রেখেই সেখান থেকে সরে যায় সে ।
তিহুর এমন আচরণে তার দিকে ফিরে মুচকি হাসে নীল । টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে, ফুচকার দাম মিটিয়ে সেও চলে যায় টতিহুর পিছু পিছু ।
—–“কি ? আইসক্রিম বিক্রি করতে পারবেন না মানে? তাহলে ভ্যান নিয়ে দাঁড়িয়েছেন কেন হ্যাঁ? আইসক্রিম আপনার বিক্রি করাই লাগবে!”
রীতিমতো আইসক্রিমের ভ্যানে থাকা লোকটার সঙ্গে ঝগড়া শুরু করে দিয়েছে তিহু । ভ্যান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অথচ নাকি বিক্রি করবে না । কারণ কি? কারণ একটাই, এখন সে বাসায় যাবে । তিহু বুঝলো না একটা আইসক্রিম বের করতে কতই বা টাইম লাগবে তার ! এদিকে তিহুর এমন কথায় ভ্রু কুঁচকে তাকালো লোকটা। খসখসে কন্ঠে বলল,,,,
——“আরে আপা আপনি যান গা, মুই বেচতাম না ।”
তিহু:“বিক্রি করবেন না তাহলে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আজিব লোক!”
আইসক্রিম ওয়ালা:“মুই অহনি চৈলা যাইতাছি। বেচতাম না ।”
———“আর যদি তোমার ভ্যানে থাকা সবগুলো আইসক্রিম কিনে নেই তো?”
গভীর পৌরুষ কণ্ঠে পিছনে ঘুরে তাকায় তিহু, নীলকে দেখে তার মুখাবয়বে কোনো পরিবর্তন না হলেও, চমকে উঠে আইসক্রিম ওয়ালা লোকটি । দীর্ঘ এক সালাম দিয়ে বলে,,,,——“আরে নীল ভাই, আপনে?”
নীল:“তোমাকে কি বললাম শুনতে পাওনি?
আইসক্রিম ওয়ালা:“হ হ ভাই হুনছি তো । আপনে শুধু কন, কোনডা লাগবো? মুই অহনি দিতাছি।”
নীল:“তোমার ভ্যানে কত রকম আইসক্রিম আছে?”
আইসক্রিম ওয়ালা:“বিক্রি-বার্টা প্রায় শ্যাষ। আর বড়জোর বিশ রহম হবে ।”
নীল:“দাম কত?”
আইসক্রিম ওয়ালা:“হাজার পাঁচেক।”
নীল তৎক্ষণাৎ নিজের পকেট থেকে হাজার টাকার দশটা নোট বের করে দিয়ে বলল,,,——“আইসক্রিমগুলো,এখানে দাঁড়িয়েই খাবে আমার বউ। যতক্ষণ তার ইচ্ছা হবে,ততক্ষণ খাবে । আর ততক্ষণ তুমি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে। আন্ডারস্ট্যান্ড?”
লোকটা ভয়ে শুকনো ঢোক গিলে বলল,,,——“দুঃখিত ভাই, মুই আসলে বুঝি নাই এডা আমাগো ভাবি জান! মাফ কইরেন ভাবিজান।”
লোকটার কথা কর্নকুহরে পৌঁছায়নি তিহুর । সে তো নীলের এমন কাণ্ডে রীতিমত তাজ্জব বনে গেছে । সামান্য একটা আইসক্রিমের জন্য পুরো এক ভ্যান! লোকটার কি মাথা খারাপ? তার উপর আবার দামের দ্বিগুণ পরিশোধ করেছে । মুখ কুঁচকে তাকালো সে । নীল একটা কোণ আইসক্রিম এনে তার সামনে ধরতেই বিষ্ময়ে আপ্লুত কণ্ঠে সে বলল,,,
——“আপনার কি মাথা খারাপ? এতগুলো আইসক্রিম দিয়ে আমি কি করবো?”
নীল:“যতগুলো ইচ্ছা খাবে বাদবাকি নষ্ট করবে!”
তার ভাবলেশহীন কথায়, ভ্রু গোটালো তিহু ।
সন্ধ্যা গাঢ় হতে শুরু করেছে । নীলের বাইক এসে থামে, প্রধান ফটকের সামনে । শব্দের ঝংকার তুলে খোলা হয় সেটা । ভেতরে প্রবেশ করে তারা । গাড়ি পার্কিং এরিয়ায় থামিয়ে, মহলে প্রবেশ করে দুজনে । তবে ভেতরে ঢুকে বেশ অবাক হলো তিহু । কেননা সেখানে আজ পরিচিত মুখের পাশাপাশি উপস্থিত কিছু অপরিচিত জন । তিহু তাদের দেখে অবাক হলেও নীল এগিয়ে গিয়ে মধ্যবয়সী দম্পতিকে সালাম দিয়ে বলল,,,
——“আসসালামুয়ালাইকুম;মামা,মামিমা কেমন আছো?”
তারা দুজনেই হেসে সালামের জবাব দিয়ে,কুশল বিনিময় করেন । তিহু বুঝলো এরা নীলের মামা-মামি। তাই সে এগিয়ে যাচ্ছিল তাদের সালাম দিতে ঠিক তখনই, নীলের মামি বলল,,
——“কি ব্যাপার নীল বাবা? শুনলাম, তুই নাকি বিয়ে করেছিস? তা আমাদের মা কোথায়?”
নীল এক ঝলক তিহুর দিকে তাকালো, তার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালেন নীলের মামি মনোয়ারা বিবি। তিহুকে দেখে মুগ্ধ কন্ঠে তিনি বললেন,,——‘আরে এতো সাক্ষাৎ পরি!’
তিহু মুচকি হেসে এগিয়ে আসলো,——‘আসসালামু আলাইকুম!’
তার সালামের জবাবের চমৎকার হাসলেন মনোয়ারা বিবি । কাছে টেনে মুখে আদুরে স্পর্শ লেপে দিয়ে বললেন,,——‘ওয়ালাইকুম আসসালাম । মাশাআল্লাহ মাশাআল্লাহ, কি সুন্দরী আমাদের মা টা! আমাদের ছেলের পছন্দ আছে দেখছি ।’
তিহু লাজুক হাসলো । মনোয়ারা বিবি শুধালেন,,,——‘তা নাম কি তোমার মা?’
তিহু:‘নুরাইন হক তিহু।’
মনোয়ারা বিবি:‘মাশাআল্লাহ, তুমি তোমার নামের মতোই সুন্দর।’
অর্ধঘন্টার বিশাল এক আলাপচারিতা চলল তাদের । পরবর্তীতে কথার ইতি টানা হলো মির্জা সূচনার ডাকে । তিনি ডেকে বললেন,,,
——‘দ্রুত ফ্রেশ হয়ে,রান্নাঘরে আসো নুরাইন,কাজ আছে।’
তার ডাকে মনোয়ারা বিবিকে বিদায় জানিয়ে, দ্রুত রুমে ছুটলো তিহু ।
ফ্রেশ হয়ে নিচে আসতে একটু দেরি হয়েছে, কিছুটা কুণ্ঠিত হয়ে কিচেনের সামনে এসে দাঁড়ালো তিহু । সেখানে উপস্থিত মির্জা সূচনা, মির্জা সায়মা আর রুমিন আরা সহ বাড়ির বেশ কয়েকজন মেড । তাকে দেখে মির্জা সায়মা হেসে বললেন,,,
——“কি ব্যাপার, অমন দাঁড়িয়ে আছো কেন?ভেতরে আসো ।”
মির্জা সায়মার কন্ঠে সকলে এক পলক তিহুর দিকে তাকালো সকলে । ফের মনোনিবেশ করল কাজে । তিহুকে কিচেনে গুটিসুটি মেরে দাঁড়াতে দেখে মির্জা সূচনা বললেন ,,,——“খাওয়া হয়েছে দুপুরে কিছু?”
তিহু:“হুম? জ্বী খেয়েছি!”
মির্জা সূচনা অভিজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকালেন,,,——“নিশ্চয় রাস্তা ধারের হাবিজাবি কিছু?”
তিহু বোকা হেসে বলল,,,——“ওই আর কি!”
মির্জা সূচনা:“এদিকে এসো।”
তিহু:“জ্বী?”
মির্জা সূচনা:“এদিকে আসতে বলেছি। ”
তিহু এগিয়ে আসতেই তিনি পাশ থেকে একটা বাটি থেকে চামচে কিছু খাবার তুলে তিহুর মুখের কাছে ধরে বললেন,,,——“সুজির হালুয়া বানিয়েছিলাম । সারাদিন তো কিছুই খাওয়া হয়নি । এটুকু খেয়ে নাও ভালো লাগবে, না হলে এত ছোটাছুটি করার এনার্জি পাবে কি করে?”
তিহু অবাক হেসে গ্রহণ করল সেটা । মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো সম্মুখের মানুষটির পানে । এই মানুষটা এতো মমতাময়ী তা এনার বাহ্যিক গাম্ভীর্য দেখে কেউ আন্দাজই করতে পারবে না। একবারে নারকেলের মতো তিনি, বাইরেটা কঠিন তবে ভেতরটা কুসুম কোমল।
হাতে খাবারের ট্রে নিয়ে নাহা’র রুমের দিকে যাচ্ছে তিহু । যদিও খাবার টেবিলে সবাই উপস্থিত,খেয়েও নিয়েছে অনেকে । তবে নাহা’র টেস্ট চলাকালে রুম থেকে বের হয়নি সে, সারাদিন পড়াশোনার জন্য নিজেকে ঘর বন্দী করে নিয়েছে । কালকে তার লাস্ট টেস্ট হওয়ায় আজও রুমেই খাবে সে । তিহু অতি যত্নে ভাত,মাংস,সবজি ট্রেটাতে সাজিয়ে নিয়েছে ।
মির্জা সূচনা বহুবার তাকে নিষেধ করেছে, কিন্তু তার তোয়াক্কা না করেই তিহু একপ্রকার জোর করে নাহা’র রুমে খাবার নিয়ে যাচ্ছে। উদ্দেশ্য একটাই,, এই মেয়েটার সাথে কখনো কথা হয়নি তার । আলাপচারিতার সুযোগ হয়নি কক্ষনো,আর তিহুর জানামতে নাহা’র কালকের টেস্টটা একটা সহজ সাবজেক্টের । হয়তো এতক্ষণে সকল রকম প্রস্তুতি নেওয়া সম্পন্ন হয়েছে তার ।
দুই তলার করিডোর দিয়ে উত্তর দিকে যাচ্ছিল তিহু । নাহাসহ বাড়ির সকল নবীনদের রুম এদিকে। হঠাৎই একটা রুমের সামনে এসে থামায় সে, দরজায় আলতো ধাক্কা দিয়ে বলে,,——“আসতে পারি?”
নাহা পড়া শেষে একবার নিচে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, দ্রুত হাতে গোছাচ্ছিল পড়ার টেবিলটা । পরিচিত তবুও অজ্ঞাত ঠেকল কন্ঠটা, অনুমতি সূচক কন্ঠে নাহা বলল,,,
——“ জ্বী,আসো।”
অনুমতি পেয়ে রুমে প্রবেশ করল তিহু। তাকে দেখে বেশ অবাক হলো নাহা, মুখশ্রীতে সামান্য পরিবর্তন হলো । যেন তাকে একদমই আশা করেনি সে । তিহু খাবারের ট্রে টা সেন্টার টেবিলের ওপর রেখে বলল,,,
——“খেয়ে নাও । রাত তো অনেক হলো।”
নাহা ধীরে ধীরে প্র্যাকটিক্যাল খাতাটা যথাস্থানে রাখল।তিহু বুঝলো সে কথা বলতে চাইছে না । তবে আজ তার সাথে কথা না বলে সে কোথাও যাবে না । রুমে চারিধারে দেখতে দেখতে সে বলল,,,
——“তোমার রুমটা তো বেশি গোছালো। তুমি গুছিয়েছ?”
নাহা ধীর কন্ঠে বেশ সময় নিয়ে বলল,,,——“না ।”
তিহু:“ওহ!”
কিছু সময় নীরবতা, তিহু ফের বলল,,,——“খেয়ে নাও ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তো ।”
নাহা:“হুম, ইচ্ছা নেই খাবারটা আপনি নিয়ে যান ।”
তিহু:“এমা, আপনি-আপনি আবার কি? তুমি আর আমি একই ইয়ারে সিস, সো ডোন্ট কল মি আপনি। আমি তোমার বয়সী ।”
নাহা:“ওহ, স্যরি আমি জানতাম না।”
তিহু:“ইটস ওকে । আচ্ছা, ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?”
নাহা:“হু!”
তিহু:“তুমি আমার সাথে কথা বলো না কেন?”
তিহুর এমন প্রশ্নে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে উঠল নাহা,,,-——“দেখা হয় না তো এইজন্য!”
তিহু:“উহু, মিথ্যা কথা বলোনা । তুমি মেইবি মুন্নির কারণে আমার সাথে কথা বলো না, তাই না?”
নাহা বিষ্ময়ে তাকালো তিহুর দিকে।তিহু সামান্য ভ্রু নাচিয়ে বললো,,,——“কি? ঠিক বললাম না?”
নাহা:“তেমন কিছু না আসলে….”
তিহু:“এতে, এত কুণ্ঠিত হওয়ার কি আছে? একটা মানুষ কাউকে পছন্দ করতেই পারে। তাই বলে তুমি আমার সাথে কথা বলবে না?”
নাহা:“ আ’ম স্যরি নুরাইন। আসলে আমার ব্যাপারটা বোঝা উচিত ছিল, মুন্নি আপু শুধু নীল ভাইয়াকে পছন্দ করতো । কিন্তু তার ওয়াইফ তো এখন তুমি, ভাইয়ার উপর অধিকারও এখন তোমার বেশি । প্রথম প্রথম ব্যাপারটা আমার একটু খারাপ লাগতো । কিন্তু আমি পরবর্তীতে বুঝেছি । তবে তখন তোমার সাথে কথা বলতে গিয়ে আমার কেমন জানি লাগতো, আসলে প্রথম প্রথম তোমার সাথে অমন ব্যবহার করেছি তো তাই ।”
তিহু:“কেমন ব্যবহার বলোতো? তুমি তো আমার সাথে কথাই বলোনি । বাই দ্যা ওয়ে আমি ওসব মনে রাখি না।”
নাহা:“থ্যাঙ্ক ইউ।”
প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ১৬
তিহু:“উহু, শুকনো থ্যাঙ্ক ইউ তে তো চিঁড়ে ভিজবে না।”
নাহা:“তাহলে?”
তিহু হেসে বলল,,——“এতদিন যেহেতু তুমি আমার সাথে কখনো কোনো গল্প করনি, তাই আমার অনেক প্রশ্ন জমা হয়ে আছে। টেস্ট শেষে সেগুলোর আন্সার দিতে হবে কিন্তু!”
নাহা মুচকি হেসে বলল,,,——“অবশ্যই!”
তিহুও হাসলো তার সাথে।
