প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ১৮
নওরিন কবির তিশা
আকাশে সূর্যটা আজ নিজের সর্বোচ্চ তেজে বিরাজমান। ভোরবেলাতেই তার প্রখর খরতাপে কিছুটা অতিষ্ট জনজীবন। সূর্যের দাপুটে রৌদ্ররেখায় চারপাশ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সেই রৌদ্রকিরণের কিছুটা জানলার ফাঁক-ফোকর দিয়ে এসে তিহুর মুখের উপর খেলা করছে। দুষ্টু সেই রোদ্দুরের আলতোস্পর্শে পিটপিট করে চোখ মেলল তিহু।
বর্তমান অবস্থানটা বুঝতে, মুহূর্ত কয়েক সময় নিল মস্তিষ্কটা। তবে বোঝার সঙ্গে সঙ্গে, তড়িৎ বেগে উঠে বসলো সে। পাশেই সটান শুয়ে আছে নীল। তাকে দেখে মুখ বাঁকালো তিহু। মূলত কাল রাতে, এই বজ্জাত লোককে হাজার বলেও রুমের আলো জ্বালাতে পারেনি তিহু। সারারাত ভীত হয়ে বসে থাকতে থাকতে কখন যে এখানেই ঘুমিয়ে পড়েছে, আল্লাহ মালুম।
ঘুমন্ত নীলকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে,তিহু চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,,,
“বজ্জাত বেডা, শুধু একবার সুযোগ পাই। হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দেবো এই তিহু কি জিনিস?”
বলেই সেখান থেকে উঠে গেল তিহু। তার ধাক্কায় নীল কিঞ্চিৎ পরিমাণ সরেছে, তবে পাতলা ঘুমটা ভেঙ্গে গেছে মুহূর্তেই । ঘুম ঘুম চোখে সে চেয়ে আছে তিহুর ধুপধাপ শব্দ ফেলে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে চলা রাগান্বিত দেহবয়বের দিকে। তন্দ্রাচ্ছন্নতার মাঝেই আনমনে মুচকি হাসলো সে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে তিহু দেখতে পায়, নীল বিশাল জানালাটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অত্যাধুনিক জানলাটার পর্দা ভেঁদিয়ে রুমে প্রবেশ করছে উজ্জ্বল রৌদ্র কিরণ। নীল সম্ভবত পাশের ওয়াশরুম থেকেই ফ্রেশ হয়ে এসেছে। তিহু সেদিকে তাকিয়ে ভ্রু ঘোটালো, পরোয়াহীন ভঙ্গিমায়, ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। দীঘল চওড়া সেই আয়নায় এক ঝলক নিজের প্রতিকৃতির পানে চাইল।
পরক্ষণেই গলার ধারে, দৃষ্টি যেতেই চঞ্চল চক্ষু স্থবির হলো তার। কেমন লালচে লালচে দাগ করে আছে জায়গাটা। তিহু বুঝলো না হুট করে জায়গাটায় হলো টা কি। কাল অব্দি তো সব ঠিক ছিল । সে বারংবার জায়গাটায় হাত ঘোষছিল,নীল ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
আয়নার মাঝে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখা তিহুর সামনে স্পষ্ট দৃশ্যমান হলো তা।নীল তার পাশ কাটিয়েই যাচ্ছিল,তাকে এমন গলা ঘোষতে দেখে বলল,,,
“এভাবে ঘোষলে,এবার চামড়াটাও ছিঁড়ে হাতে চলে আসবে।”
তিহু হাত থামালো না।পানি লাগার দরুন বিশ্রীভাবে জ্বলছে স্থানটা। বিরক্ত কন্ঠে বলল,,,
“আপনার কি?”
নীল ততক্ষণে হাতে মলম জাতীয় কিছু নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। আয়নায় তার প্রতিচ্ছবি দেখেই ঘুরে তাকালো তিহু। সামান্য ভ্রু কুঁচকালেও তার তোয়াক্কা না করে নীল মলমটা তিহুর গলার সেই লালচে দাগগুলোর উপর আলতো স্পর্শে অতি সন্তর্পণে লাগিয়ে দিতে শুরু করলো।
অপ্রত্যাশিত কাণ্ডে তিহু একদম চমকে উঠলো। তার চঞ্চল চোখ দুটো গোল গোল হয়ে উঠলো, বিস্ময়ে সে স্থির হয়ে রইলো। হঠাৎ নীলের এমন স্পর্শে তিহুর শ্বাস-প্রশ্বাস যেন কেমন আটকে এলো, মেরুদন্ড বেয়ে নামলো শীতল শিহরণের ঝাঁক,সেই শিহরণ ছড়ালো দেহের প্রতিটি লোমকূপে। সামান্য কেঁপে উঠল সে।নীল সামান্য বাঁকা হাসলে তার এমন অবস্থায়।
প্রলেপটা আলতো হাতে লাগানো শেষে নীল একবার তিহুর দিকে তাকালো, বেচারী এখনো চোখ মুখ খিঁচে রেখেছে। নীল তার আরোক্ত মুখশ্রীতে তাকিয়ে, খানিক মুচকি হাসলো। অতঃপর সামান্য ঝুঁকে তার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,,,
——“ইউ আর টু মাচ ইডিয়েট, ইউ নো?”
তার এমন কণ্ঠে চোখ মেলে তাকালো তিহু। কিছু বলতে যাওয়ার আগেই দেখতে পেল, হেলেদুলে তবে দ্রুত পায়ে রুম থেকে প্রস্থান করছে নীল।
ঘড়ির কাঁটায় সকাল আটটা বেজে ত্রিশ মিনিট । ভার্সিটি যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে তিহু। রেডি হওয়া প্রায় সম্পন্ন এখন শুধুমাত্র, চুলগুলো বিনুনি করা বাকি। সুদীর্ঘ সেই কেশরাজের সবে হাতে থাকা চিরুনি দিয়ে আলতো আঁচড় কেটেছে সে, তক্ষুণি খাবার হাতে রুমে প্রবেশ করলেন মির্জা সূচনা।
ব্যাতিব্যস্ত হয়ে পড়লো হয়ে পড়লো তিহু। দ্রুত বিছানা থেকে উঠতে যেতেই মির্জা সূচনা তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,,
——“ উঠো না। চুলগুলো আঁচড়িয়ে নাও। টাইম হয়ে যাচ্ছে তো।”
“আম্মু, আপনি?”
মির্জা সূচনা কোনো কথা বললেন না। প্লেটে থাকা ভাতগুলো, মেখে সযত্নে তিহু দিকে হাত বাড়িয়ে তার গালে তুলে দিতে দিতে বললেন,,
“সকাল থেকে তো কিছুটা পেটে পড়েনি। সারাদিন এভাবেই থাকা হবে, আর কোন বিকালে আসবে? তখন যদি পেটে পড়ে। এভাবে থাকতে তো অসুস্থ হয়ে পড়বে?”
তিহু খাবারগুলো গ্রহণ করে, মুগ্ধ হেসে তাকালো।তার মাতৃত্বসুলভ মৃদু শাসনে, আহ্লাদি কণ্ঠে বললো,,,
“আপনি আছেন না? আমার আম্মু!”
মির্জা সূচনা দ্বিতীয় লোকমা মাখতে মাখতে বললেন,,,
“অত আর আহ্লাদ দেখাতে হবে না। বুঝি আমি, আমাকে কতটা আম্মু হিসেবে মানা হয়!”
তিহু অবাক দৃষ্টি মেলে তাকালে মির্জা সূচনা দ্বিতীয় লোকমাটা তার গালে তুলে দিতে দিতে বললেন,,,
“আম্মুকে কেউ আপনি করে বলে?”
তিহু এবার নিশ্চিন্ত হাসলো। অতঃপর কি ভেবে সে নিজেও প্রশ্ন করে বললো,,,
“মেয়েকে কেউ তুমি করে বলে?”
মির্জা সূচনা অবাক হলেন, তিনি এমন উত্তর কখনোই আশা করেননি। অতঃপর খানিক হাসলেন, তিহু মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো তার হাসির পানে। মানুষটা এই বয়সে এসেও কতটা সুন্দরী! এনাকে দেখলেই তিহুর ইচ্ছা করে নিজের শশুরকে বাহবা দিয়ে বলতে,,
“আপনার চয়েজ আছে আব্বু।জিতছেন!”
“আচ্ছা এখন থেকে আমি তোকে তুই করেই বলবো। এবার হয়েছে?”
মির্জা সূচনার কথায় ধ্যান ভাঙল তিহুর। মাথা নাড়িয়ে এক গাল হেসে বলল,,,
“হুম!”
“এবার দ্রুত খেয়ে নে দেখি। এক্ষুনি সময় হয়ে যাবে।”
তিহু মুচকি হেসে হাত চুলে কার্যত রেখে,এক এক করে গ্রহণ করল, মির্জা সূচনার তুলে দেওয়া প্রতিটি লোকমা। হঠাৎই খেতে খেতে কিছু একটা মনে পড়লো তার, দ্রুত কন্ঠে বলল,,
“আম্মু!”
“জ্বী?”
“আমার একটা রিকুয়েস্ট ছিল!”
“কেমন রিকুয়েস্ট?”
তিহু কাচুমাচু করতে লাগল, মির্জা সূচনা অভয় দিয়ে বললেন,,
“বল!”
“আমি জাফলংয়ে আমার বান্ধবীকে সাথে করে নিয়ে যেতে চাই।”
“এতে এত ভয়ের কি আছে? অবশ্যই যাবে সে। তুই এক কাজ কর, আজই তাকে আমাদের বাসায় নিয়ে আয়। আমরা চাচ্ছি কাল সকাল সকাল রওনা দিব।”
“কিন্তু আম্মু আমি তো মাহাকে কিছু বলিনি এখনো। আর তুমি না বলেছিলে?পরশু যাবে।”
“হুম, সেটাই জানতাম। তবে বিয়ের ডেট দুইদিন এগিয়ে এনেছো তো, সৌভিক আবার আমেরিকা ব্যাক করবে। এজন্য আমরা ভাবছি কাল সকাল সকাল রওনা দিব।”
“ওহ!”
ভার্সিটির প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে, নীলের গাড়ি। এতক্ষণ ধরে তাকে কিছু বলার জন্য, বেশ অস্থির হয়েছিলো তিহু। নীল সেটা দেখলেও না দেখার ভান করে, দক্ষ হতে ড্রাইভিং এ ব্যস্ত। না পেরে, তিহু এবার বলেই দিলো,,
“আমার একটা কথা ছিল!”
“হুম,বলো!”
“ওদিকে কি? আমি এদিকে কথা বলছি, আমার দিকে ফিরুন!”
তিহুর কন্ঠে বিরক্তি স্পষ্ট। তার কথায় নীল গাড়ি থামিয়ে, চোখের থাকা রোদ চশমাটা খুলে,তার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“বলুন!”
তার এমন কাণ্ডে, রীতিমত তাজ্জব বনে গেল তিহু।
“এ-এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”
“তো কিভাবে তাকাবো?”
“যেভাবে ইচ্ছা! কিন্তু এভাবে নয়!”
“আমার তো এভাবে তাকাতেই ইচ্ছে করছে।”
“আপনি বাজে বকা বন্ধ করবেন?”
“তুমি শুরু করলেই, বন্ধ করব!”
তিহু থামল। কিছুটা ইতস্তবোধ করে, শেষমেষে সাহস করে বলেই দিলো,,,
“আমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ডদের সাথে করে নিয়ে যেতে চাই।”
“কোথায়?”
“জাফলংয়ে।”
“তো, যাবে।”
“আমার বেস্ট ফ্রেন্ড এর ভিতর কিন্তু একটা ছেলে আছে!”
নীল এবার কঠোর দৃষ্টিতে তাকালো। তিহু কিছুটা ভরকে গেলেও, মুখের সেটা প্রকাশ করলে না। সে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই তাকে অবাক করে দিয়ে নীল বলল,,
“রিশাদ নামের ছেলেটা তো?”
“হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কিভাবে জানালেন?”
“সেটা তোমার না জানলেও চলবে। বাই দ্যা ওয়ে, ছেলেটাকে আমারও ভালো লাগে। তুমি ওকে নিয়ে যেতে পারো।”
তিহু খুশিতে আত্মহারা হয়ে সিট থেকে উঠে নীলকে একপ্রকার জাপ্টে ধরতে গেল। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে বলল,,,
“থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ।”
তার এত খুশি হওয়ার কারণ নীল বুঝতে না পারলেও তিহু খুব ভালো করেই জানে, রিশাদকে না নিয়ে গেলে কতটা সমস্যা হতে পারে। প্রথমত মাহা আর তাকে ছাড়া তিহু কক্ষনো ঢাকার বাইরে যেতে পারবেনা। গেলেই বাবা-মাকে হাজারটা জবাব দেখে করতে হবে, তাদের দুজনকে নিয়ে গেলে হয়তোবা প্রশ্নের বর্ষণ কিছুটা কম হতে পারে।আর এই সুযোগে না হয় বন্ধু মহল মিলে একটু জাফলং এর সৌন্দর্যও উপভোগ করা হয়ে যাবে।
ভার্সিটির সামনে তাকে নামিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ হলো চলে গিয়েছে নীল।তিহু অপেক্ষা করছে রিশাদ আর মাহার। দুটো একটারও কোনো খোঁজ নেই। বেশ কিছুক্ষণ পর অবশেষে দেখা মিলল জোড়া-মানিকের। বিরক্ত তিহু এগিয়ে গিয়ে বলল,,
“কত সময় লাগে তোদের? লাস্ট মোমেন্টে আসবি নাকি?”
তার কথায় মাহা হাই তুলে বললো,,,
“আমরা তো বিয়েত্তা না,যে বর বা বউ গুছিয়ে দেবে আর আমরাও চলে আসব। আমাদের নিজেদের কাজ নিজেরই করতে হয়। তাইনা দোস্ত? (সে রিশাদের দিকে তাকালো)
তার কথায় রিশাদ সম্মতিসূচক মাথা নাড়াতেই তিহু মুখ কুঁচকে বলল,,
“আজেবাজে কথা ছাড়া আর কোনো কথা আছে তোদের?”
তার কথা এক লহমায় লুফে নিয়ে রিশাদ বলল,
“বান্ধবী?”
“হু?”
“আমার সাদা মনে একটা কাঁদা কাঁদা প্রশ্ন,করি?
“হুম,কর।
“তুই এত তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠলি কিভাবে?
“মানে?
“না মানে…..!
তার কথার মর্ম তিহু না বুঝলেও, মাহা ঠিকই বুঝতে পেরেছে। তাইতো সজোরে এক চিমটি দিয়ে থামিয়ে দিয়েছে তাকে। রিশাদ মৃদু শব্দ করে মাহার দিকে তাকিয়ে আছে।তিহু বোকা দৃষ্টি মেলে তাকানো মাত্রই মাহা রিশাদের দিকে তাকিয়ে কটমাটিয়ে বলল,,,
“ক্লাসে চল, সময় হয়েছে।
রিশাদ ব্যাথা প্রাপ্ত হাত স্থানে হাত ঘষতে ঘষতে এগিয়ে চললো তাদের সাথে।
“দোস্ত তোদের না আমার কিছু কথা বলার আছে!
ভার্সিটি ক্লাস প্রায় শেষ, লাস্ট ক্লাসটা আর করবে না তারা। ক্যাম্পাসের খোলা মাঠটায় বসে আছে তিনজন, হঠাৎ তিহুর কথায়, মাহা আর রিশাদ উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,,
“হুম,বল।
“একটা নিউজ আছে ।তবে সেটা গুড না ব্যাড জানিনা।
“আগে বল তো।
রিশাদের কন্ঠে তার দিকে তাকালো তিহু। অতঃপর বলল,,
“নেতা সাহেবের বড় মামার বড় ছেলের বিয়ে। এই মাসেরই শেষে।তো সবাই চায় আমি সেখানে যাই।
তার এমন কথায় মাহা বলল,,
“হ্যাঁ,তো যাবি।
তার কথা একপ্রকার কেড়ে নিয়ে রিশাদ বলল,,
“শা*লি গুবলেট।ও কি করে যাবে, আঙ্কেল-আন্টি বিশেষত ওর ছোট চাচা যদি জানতে পারে তাহলে তো…!
আর কথায় মাহা গাছাড়া ভাবে হাই তোলা স্বরে বলল,,
“সেটা আমাদের না জানিয়ে সিনেমাটিক স্টাইলে বিয়ে করার আগে মনে করা উচিত ছিল, ড্রামা কুইনের।
তার এমন কথায় তিহু রেগে গিয়ে বলল,,,
“বা*লে*র কথা বলিস না তো। তুই খুব ভালো করেই জানিস, ওটা একটা এক্সিডেন্ট ছিল।
“মুখের ভাষা ঠিক কর । আর হোক সে এক্সিডেন্ট। তো এখন আমরা কি করতে পারি?
“তোরাও আমার সাথে যাবি!
তার অকপটে বলা কথাটায় চমকে তাকালো মাহা রিশাদ দুজনেই।
“তোর মাথা ঠিক আছে? অবশ্য তুই মাহাকে সাথে করে নিয়ে যেতে পারিস।
“মাথা আমার ঠিকই আছে। আর শুধু মাহা না তুইও যাচ্ছিস।
“পাগল তুই? এটা তোর ফ্যামিলির অকেশন না, যে আমি যাব ।
“ফ্যামিলির অকেশন না বলেই তো তুই যাবি। কেননা আমি আম্মু-আব্বুকে বলবো, তোর খালাতো বোনের চাচাতো ভাইয়ের বিয়ে।
“কানার কানা, আমার কোনো আত্মীয়ের বাড়িই জাফলং এ নাই।
তিহু এবার বেশ চিন্তায় পড়ল। সে তো ভেবেই রেখেছিল রিশাদের কোনো একটা আত্মীয়ের কথা বলে দেবে। এবার কি হবে? তৎক্ষণাৎ মাহা শব্দ করে হেসে বলল,,,
“আহারে আমাদের নেতা সাহেবের বউয়ের কি বুদ্ধি! এবার কি হবে বিয়েত্তা মহিলা?
“ফাও কথা না বলে; বুদ্ধি ভাব কোনো!
“আপাতত আমার মাথা ব্ল্যাংক!
“আ-বা-ল রিশাদ। তুই কথা বলিস না কেন?
“চিন্তা করার জন্য তো তোরা আছিসই।
তিহু তার মাথায় সজোরে একটা গাট্টা মারলো। রিশাদ সেখানে হাত বোলাতে বোলাতে তিহুর দিকে এগিয়ে গিয়ে মারতে গিয়েও থমকালো। একগাল হেসে বলল,,,
“না না তোরে তো এখন আর মারা যাবে না। বিয়েত্তা মহিলা বলে কথা!
“একদম উল্টাপাল্টা কথা বলবি না। আমি মহিলা না।
রিশাদ শোধরানোর ভঙ্গিমায় বলল,,
“না না আমারই ভুল হয়েছে। তুই কেন মহিলা হতে যাবি? তুই তো আরো এক গ্রেট উপরে, মহিলা আক্তার বেটি। এবার ঠিক আছে না?
“রিশাদের বাচ্চাআআআ!!!
বলেই তিহু তার দিকে তেড়ে যেতেই সে দৌড়ে পালিয়ে বলল,,,
“ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন, আমার এখনো বিয়েই হয়নি! তো বাচ্চা আসবে কোন হানতে?
দুটো মিলে ক্যাম্পাসের মাঝে একপ্রকার ছোটাছুটি লাগিয়ে দিয়েছে। তা দেখে কপাল চাপড়ালো মাহা, ইচ্ছা করছে দুইটাকেই শূন্যের উপর তুলে পরক্ষণেই মাটিতে ফেলে আছাড় মারতে!
ভার্সিটির শেষ হতে এখনো মিনিট দশেকের মত বাকি। রিশাদ কিছুক্ষণ হলো বাসার উদ্দেশ্যে গিয়েছে। বহু কষ্টে তাকে আর মাহাকে যাওয়ার জন্য রাজি করাতে পেরেছে তিহু । রিশাদ কাল সকালে তাদের সাথে জয়েন করবে, আর মাহা আজ তার সাথেই যাবে।
বর্তমানে ভার্সিটি থেকে কিছুটা দূরে একটা ফুচকার স্টলে দাঁড়িয়ে আছে তারা দুজন। তিহু তখন থেকে বকবক করে চললেও, নিশ্চুপ মাহা। হৃদযন্ত্রটা দামামা বাজাচ্ছে তার, যতবার মনে পড়ছে প্রায় অর্ধমাসের বেশি সময় ধরে রাওফিনের সামনে থাকা লাগবে।
তিহু হাজারো কথোপকথনের মাঝে হঠাৎই স্টলের লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল,,,
“আর কতক্ষণ লাগবে আঙ্কেল?
“এই তো মা হইয়া গ্যাছে । আর পাঁচটা মিনিট অপেক্ষা হরো।
“একটু দ্রুত করেন। ভার্সিটি শেষ হওয়ার আগেই যেতে হবে।
“আইচ্ছা।
তিহু আবার মাহার দিকে ফিরে বলল,,
“দোস্ত শোন হইছে কি….
তার কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই অপর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটা ছেলের দল যারা এতক্ষন যাবৎ তাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরখ করছিল, হঠাৎই তাদের মধ্য থেকে লিডার টাইপ ছেলেটা তিহুর দিকে ফিরে গেয়ে উঠলো,,
“তোর কাজল কালো চোখ….
তোর ঝুমকা কানের দুল…..
ঢাকাই শাড়ি পড়ে তোকে লাগছে বিউটিফুল…..”
একই কলি বেশ কয়েকবার আওড়ালো সে। দৃষ্টিটা এখনো তিহুর দিকে নিবদ্ধ। পরক্ষণেই সিটি মেরে তিহুর দিকে ফিরে বলল,,,
“ওই সুন্দরী?
তিহু এতক্ষন এইটারই অপেক্ষা করছিল যেন। এতক্ষণ তো সরাসরি তাদের কিছু বলেনি, তবে যেই না তাকে ডাক দিল ওমনি তাদের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে, বাঁকা হেসে সে বলল,,
“কিছু বলছিলেন? ভা-ই-য়া-য়া!
ভাইয়া কথাটা বেশ টেনে টেনে বলল তিহু। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটা বুকের বাঁ পাশে হাত দিয়ে, ঘষে বলল,,
“আমনে বইলো না গো। বুকে বড্ড জ্বালা করে।
“স্যরি টু সে ভাইয়া, কিন্তু আপনার মনে হয় গ্যাস্ট্রিকের প্রবলেম হইছে। এক্ষুনি ডাক্তারের কাছে যান না হলে আশেপাশের বায়ু দূষিত হবে!
তার এমন কথায় বোকা দৃষ্টি মেলে তাকালো ছেলেটা। সে কি বুঝালো আর এই মেয়েটা কি বলল! এদিকে দলের ছেলেগুলো হাঁ হয়ে তাকিয়ে আছে, কখনো তারা মেয়েটার দিকে তাকাচ্ছে তো কখনো তারা নিজেদের লিডারের দিকে। তাদের এমন অবস্থায় সশব্দে হেসে চলেছে মাহা। তিহু ফের বলল,,
“এছাড়াও মনে হয় আপনার চোখের ন্যাবা হয়েছে, নইলে পাকিস্তানি থ্রি পিসকে কেউ গুলিস্তানি স্যরি ঢাকাইয়া শাড়ি বলে, আমার জানা ছিল না!
তার কথার প্রত্যুত্তরে ছেলেটি অর্থাৎ আফান বলল,,
“তুমি কিন্তু জোস! এক্কেরে মনের মতো। ঘরে সাজিয়ে রাখার মত।
তার জবাবের তিহু কিছু বলতে যাওয়ার আগেই সে দেখতে পেল আফানের ঠিক পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে নীল। তাকে দেখে চাপা হাসল তিহু কোনো কথা না বলে এই লোকের মাইর খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। নীল হাতা ফোল্ড করতে করতে এগিয়ে এসে আফানের পিছনে এসে দাঁড়ালো, তার কাঁধে হাত রেখে বলল,,
“আসলেই মেয়েটা জোস!
তার কাঁধে কে হাত রেখেছে তা না দেখেই আফান বলল,,,
“জোস বলে জোস! আমার তো ইচ্ছা করছে আমার রুমে নিয়ে গিয়ে পুতুল হিসেবে সাজিয়ে রাখতে। এমন একটা কথা বলা পুতুল আমিও ডিজার্ভ করি।
নীল সামান্য বাঁকা হাসলো,,
“তবে ভুল জায়গায় হাত দেওয়া হয়ে গিয়েছে যে। এটা ইতিমধ্যেই আমার রুমকে সজ্জিত রাখা সবচেয়ে দামি পুতুলটি।
আফান চমকে তাকালো এমন কথায়। নীলকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠে সে বলল,,
“ভ-ভাই,আ-আপনি?
তার কথাগুলো যেন মুখের মধ্যেই আটকে আসলো।আর সেগুলো বের হওয়ার কোনো সুযোগও দিল না নীল। এক ঘুষিতে মাটিতে ফেলে দিলো তাকে। প্রথম ঘুষিতেই রক্তাক্ত হলো আফানের ফর্সা মুখশ্রী। তুতলিয়ে সে কিছু বলার আগেই নীল সর্বশক্তিতে তার পেটে লাথি মেরে বলল,,,
“শু****র বাচ্চা। তুই জানিস তুই কাকে কি বলেছিস?ওটা ওয়াহাজ খান নীলের সহধর্মিনী। নীল খানের বউ ওটা।
বলেই একের পর এক ঘুষি দিতে শুরু করলো সে। আশেপাশের ছেলেগুলো ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে তাকে থামাতে এসেও পারল না। শেষমেষ না পেরে তিহু ছুটে গেল নীলের কাছে। তবে তার ক্ষীণ কায়ার সর্বশক্তি নীল খানের শৈল্পিক সে দেহের কড়ি আঙুলের সমান। নীল প্রায় ঝটকা মেরে সরিয়ে দিল তাকে।
অথচ পরক্ষণেই সম্বিৎ ফিরে পাওয়ার ন্যায় ছেড়ে দিল আফানকে, দ্রুত এগিয়ে গেল তিহুর কাছে। তাকে তুলেই অনুশোচনায় দগ্ধ কন্ঠে বলল,,,
প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ১৭ (২)
“আ’ম স্যরি। আ’ম রিয়েলি স্যরি। আসলে, আসলে আমার মাথা ঠিক ছিল না। শুনছো নুর? আ’ম রিয়েলি স্যরি।
তিহুকে সযত্নে টেনে তুলল সে, নিজের সঙ্গে মিশিয়ে গাড়ির দিকে যেতে যেতে আরেকবার ফিরলো আফানের রক্তাক্ত দেহের দিকে। বলল,,
“আজকের মত বেঁচে গেলি বাস্টার্ড! তবে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে নে। যতক্ষণ না পৃথিবীর এই মিষ্টি হাওয়া তোর জন্য বৈরী হচ্ছে!
