প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ১৯
নওরিন কবির তিশা
গাড়ি চলছে মন্থর গতিতে, নীলের দক্ষ হাত স্টিয়ারিংয়ে কার্যত। তিহু মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার দিকে। লোকটার রাগের পরিমাণ নিঃসন্দেহে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতসম। তবে সে রাগের উদগীরণ রেগে থাকা ব্যক্তিটির উপরই নিবদ্ধ।
এমন একটা মানুষই তো প্রতিটি মেয়ের স্বপ্নের পুরুষ! যে পুরুষ সর্বোচ্চ ধাপে রেগে থাকা সত্ত্বেও, নিজের আপন নারীর কাছে কক্ষনো রাগের প্রতিফলন ঘটায় না।তিহু কেমন হেসে ভ্রু কুঁচকালো । পরক্ষণেই তার মাহার কথা মনে পড়তেই, দ্রুত নীলের উদ্দেশ্যে বলল,,,
—>“আপনি তখন আমাকে ওভাবে নিয়ে আসলেন কেন? মাহাকেও তো আনার কথা ছিল, না?”
তার কথার প্রত্যুত্তরে নীল চোখ দুটো সামনের দিকে স্থবির রেখেই স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় বলল,,,
—>“মাহা রাওফিনের সঙ্গে চলে আসবে।”
ফের নীরবতা, তবে এবার তিহু নিশ্চিন্ত হলো। তাই আর বেশি কথা বাড়ালো না সে। নীল এবার গাড়ির গতি বেশ বাড়ালো। মোড় নিলো মহল ভিন্ন অন্যদিকের রাস্তায়।তিহু প্রথমে না বুঝলেও, ব্যাপারটা বোধগম্য হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভ্রু জড়ালো।
—>“এদিকে কোথায় যাচ্ছি?”
তার কথার জবাবে কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করল না নীল। শুধু দক্ষতা প্রাপ্ত হাত দুটো কার্যত রাখল স্টিয়ারিংয়ে। শোঁ শোঁ করে, এগিয়ে চলল পূর্বপরিকল্পিত গন্তব্যটির উদ্দেশ্যে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তিহুরা চলে যাওয়ার পর, স্থানটা থমথমে হয়ে আছে। আফানকে ছেলেগুলো ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছে। বেশ লোকজন জড়ো হয়েছিল, তবে তারাও একে একে প্রস্থান করছে। মাহাও ভাবছে বাসায় যাবে। এখানে অহেতুক দাঁড়িয়ে থাকার কোনো মানে নেই।
ভাবতে ভাবতে দুই কদম এগোতেই তার সামনে এসে থামে একটা বাইক। ইয়ামাহা খচিত দামি বাইকটি দেখে সামান্য ভ্রু জড়ায় মাহা। এত জায়গা থাকতে তার সামনে কেন এসে বাধলো? বেগরানো মেজাজে দাঁতে দাঁত পিষে সে বলল,,,
—>“আপনি কি কানা? আমার সামনে এসে বাধলেন কেন? পথ ভুল করেছেন হাবা লোক?”
তার কথার জবাবে মাথা থেকে হেলমেটটা খুলল রাওফিন। সেটাকে হাতে রেখেই, মাহার থেকে ফিরে দুষ্টু হেসে সে বলল,,,
—>❝অবশেষে গন্তব্য যদি তুমি হও,সে পথ আমি হাজার বার ভুল করতে রাজি!❞
হুট করে রাওফিনকে দেখে আর তার বলা এমন কথায় হচকিত নয়নে তাকালো মাহা।
—>“ত-তুমি?”
—>“ইয়েস, ইওর ক্রেজি লাভার মাই লাভ।”
—>“তুমি এখানে কি করছো?
—>“তোমাকে নিতে এসেছি!
—>“মানে?
—>“মানে আর কি? চলো তোমাকে নিয়ে পুরো শহর ঘুরাই।
মাহা যেন রেগে গেল রাওফিনের কথায়। বিরক্তিতে ‘চ’ সূচক শব্দ করে, সেখান থেকে চলে যেতে নিলেই, রাওফিন হেলমেটটা কোনোমতে বাইকের উপর রাখল। অতঃপর একপ্রকার দৌড়ে গিয়ে, শক্ত করে ধরল মাহার হাত। মাহা অবাক দৃষ্টিতে পিছনে ঘুরতেই, রাওফিন গেয়ে উঠলো,,,
🎶 হাত দুটি ধরেছি তোমার….
মানবো না কোন বাঁধা আর….
শুনবো না কারো কথা যে আর….
মন্দ বলুক সমাজ….🎶
গাড়ি এসে থামলো ঢাকার পান্থপথ এলাকায়, কাওরান বাজারের কাছে অবস্থিত বিখ্যাত বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সের সামনে।আভিজাত্যে মোড়া সেথায় লক্ষ্যপূর্বক তিহু বিষ্ময়জড়িত কণ্ঠে বললো,,,
—>“এখানে কি?
তার কথার জবাব দিল না নীল। সানগ্লাসটা চোখে জড়িয়ে, নিজের হাতের শক্তপোক্ত বন্ধনে তিহুকে আবৃত করে এগিয়ে চলল ভেতরের দিকে।
কমপ্লেক্স এর ভেতরটা বর্ণনাতীত সুন্দর, অবশ্য সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্যদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা বলে কথা। বিশেষত্ব তো থাকবেই! তবে নীল কোনো দিকে না তাকিয়ে তাকে নিয়ে সোজা লেভেল-২ এ অবস্থিত একটা হিজাব এন্ড আবায়া বুটিকের সামনে এসে থামল।
বাহারি রঙা হেজাব আর আবায়ার স্টোনের উপর প্রতিফলিত উজ্জ্বল আলোক ঝলকানিতে চোখ ধাঁধিয়ে আসছে তিহুর। দৃষ্টিতে বিস্ময় স্পষ্ট তার। অবাক কন্ঠে সে বলল,,
—>“এখানে কেন.?
নীল এবারও নিরুত্তর। তিহু দাঁতে দাঁত পিষে, তাকে চারটে কথা শোনাতে যাবে তার আগেই, ভেতর থেকে একটা স্টাফ বেরিয়ে এসে বলে,,,
—>“আরে ভাই? আপনি? ভেতরে আসেন।
লোকটা ব্যস্ত হয়ে পড়ল, দ্রুত ভেতরে থাকা অনেকগুলো স্টাফকে ডেকে জড়ো করে বলল,,,
—>“দ্রুত আয়,কোক আন।
“আরে ভাই আপনি ভেতরে আসেন!——বলতে বলতেই ছেলেটার নজর যায় নীলের পাশে দাঁড়ানো অসম্ভব সুন্দরী রমণীটির দিকে। উচ্চতায় কাঁধসম রণীটি, ভুবনমোহিনী সৌন্দর্যের অধিকারী। অপলক চেয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। তবে বহু কষ্টে নিজের এমন বাজে বাসনাকে পা দিয়ে পিষে ছেলেটি গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,,,
—>“ভাই ইনি?
নীল এক ঝলক তিহুর দিকে তাকালো। তার চঞ্চল মুখশ্রীতে এক গুচ্ছ দুষ্টু কেশরাজি, বিনা বাধায় খেলা করছিল। তাদের হয়তো হিংসা হলো নীলের। সামান্য কুঁচকালো মুখশ্রীতে সে বলল,,,
—>“তোদের ভাবি!
সামান্য একটা কথা, তাতেই ছেলেটি বিষ্ময়ে চূড়ান্ত সীমায়। তারমানে এতক্ষণে এই ভয়াবহ লোকটার বউকে দেখে ক্রাশ খাচ্ছিল সে? হায় আল্লাহ! নীল খান যদি একবার জানতে পারে, তাহলে তো তাকে এখানেই পুঁতে রেখে। শুকনো একটা ঢোঁক গিলে তিহুর উদ্দেশ্যে সালাম করলো সে।
এদিকে নীলের কথায় অবাক এর উপর অবাক হয়েছে তিহু। ছেলেটির সালামের জবাব তেমন আশ্চর্য্যনিত কন্ঠেই দিল সে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বাহারি রকম খাবারের পসরা বসানো হলো সেখানে। সেদিকে লক্ষ্যপাত না করেই নীল বললো,,,
—>“সমস্ত ইউনিক কালেকশন আর লেটেস্ট ভার্সনের হেজাব মডেল দেখাও।
কিছুক্ষণের মাঝেই সাজানো হলো কয়েক শত রকমের হেজাব।তিহু অবাক দৃষ্টিকে উপেক্ষা করেই, নীল বললো,,,
—>“দেখো কোনগুলো পছন্দ হয়?
—>“আপনার কি মাথা খারাপ?
—>“মানে?
—>“মানে আবার কি, আমাকে কখনো দেখেছেন হেজাব পড়তে? আমি হেজাব পড়তে পারি না। আর না তো পড়তে চাই। আমার এতো সুন্দর চুলগুলো কেন আমি ঢেকে রাখব?
—>“কারণ আমি চাই।
—>“কিন্তু আমি চাইনা।
—>“কিন্তু আমি চাই।
—>“আপনি চান তো নিজে পড়ে বসে থাকুন না!
—>“নুর?
—>“হুম।
—>“এবার কিন্তু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে।
—>“আপনি জোরাজোরি না করলে কম কমই হবে।
—>“আমি চেয়েছি মানে এটাই ফাইনাল।
—>“দেখুন জনাব, আমি হেজাব পরতে পারি না। আর আমার এত সুন্দর চুল,এগুলো তো সবাই দেখবে তাই না?
“সবাই দেখবে মানে?——এবার বেশ রাগী শোনালো নীলের কন্ঠ।
তিহু বোকা হেসে বলল,,,
—>“আরে রাগ করছেন কেন? সবাই দেখবে মানে, আমি কি ওটা বুঝিয়েছি নাকি? আমি বলতে চাইছি, আমি কখনও হেজাব বাঁধিনি । তাহলে এখন কেন?
নীল এবার তিহুর দিকে এগিয়ে এলো।তার এমন কান্ডে এক কদম পিছালো তিহু। তবে তাকে তোয়াক্কা করলো না নীল। সেও এগিয়ে এসে, তিহুর কপালের উপর পড়া একগুচ্ছ চুলগুলো, তার কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,,
—>❝ তখন তুমি অন্যকেউ ছিলে,তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু এখন তুমি আবদ্ধ, আমার দৃঢ় বন্ধনে। তখন তোমাকে দেখার অধিকার সবার থাকলেও, এখন সেটা শুধুই আমার। তোমার দেহের প্রতিটা লোমকূপ দেখার অধিকার আমি রাখি আর আমি ব্যাতিক্রম অন্যকেউ তোমার দিকে তাকালেও তার জান কবজের অধিকারও আমি রাখি! মাইন্ড ইট মিসেস,জান কবজের অধিকারও আমি রাখি! ❞
তিহুর বিষ্ময়েরা যেন দিক হারালো নীলের এমন কথায়। চুড়ান্ত আশ্চর্যান্বিত হয়ে সে তাকালো নীলের দিকে। তার এমন দৃষ্টিতে মুচকি হাসলো নীল। তাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে, স্টাফ ছেলেগুলোর উদ্দেশ্যে বলল,,,
—>“লেটেস্ট মডেলের সবগুলো প্যাক করে, খান মহলে পৌঁছে দিও।
আর এক মুহূর্ত না, তিহুকে নিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করল নীল।
বাইক চলছে শহরের প্রশস্থ সড়কের বুকে। একই বাইকে বসে থাকলেও মাহা আর রাওফিনের মাঝে বেশ কয়েক ইঞ্চির দূরত্ব বিদ্যমান। রাওফিন এক প্রকার তুলে নিয়ে এসেছে তাকে সেখান থেকে। তাইতো ‘থ’ মেরে বসে আছে মাহা। হুট করে রাওফিন একটা দুষ্টু চাল চালল। দুষ্টুমির ছলে বাইকটা একটু জোরে টান দিতেই মাহা হুমড়ি খেয়ে তার পিঠের উপর পড়ল।
রাওফিন সামান্য বাঁকা হাসলেও, ক্ষেপে গেল মাহা। কেননা সে ভালো করেই জানে এটা রাওফিনের দুষ্টুমি বৈ অন্য কিছু নয়। রেগে মেগে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,,
—>“বাইক থামাও।
—>“কেন? তোমার কি পার্সোনালি আমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করছে লাভলাইন? কিন্তু আশেপাশে তো আমি কোনো রেস্টুরেন্ট বা ক্যাফে দেখছি না। আচ্ছা বাদ দাও আমরা বরং বাড়ি গিয়েই, সারারাত গল্প করবো ঠিক আছে? লাভলাইন!
তার কথায় তিতিয়ে উঠল মাহা।
—>“তুমি গাড়ি থামাবে কিনা?
—>“না।
—>“আমি কিন্তু লাফ দিব!
—>“লাফালাফি স্বভাবটা এখনো যায়নি? চলন্ত গাড়ি থেকে কিভাবে লাফ দেবেন ম্যাডাম?
—>“রাওফিন!
অদ্ভুতভাবে এবার বাইকটা থেমে গেল। বুকের মাঝে চলা, তুমুল ঝড় তুফান, হাত থামিয়ে দিল রাওফিনের। অপ্রস্তুত এমন ব্রেকে, কিছুটা হেললো মাহা। পরক্ষণেই, চটজলদি বাইক থেকে নেমে পড়ল। রাওফিন যেন একটা ঘোরের মাঝে আছে, পাঁচ বছর পর প্রিয়তমার মুখে নিজের নাম শুনেছে যে! এর থেকে শ্রেষ্ঠ অনুভূতি আর কি হতে পারে?
তবে যতক্ষণে সে হুঁশে এসেছে ততক্ষণে মাহা বেশ অনেকটা দূরত্ব অতিক্রম করে ফেলেছে। সজ্ঞানে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে রাওফিন দ্রুত বাইক থেকে নামলো। মাহার পিছে পিছে দৌড়ে গিয়ে তার ওড়নার আঁচল শক্ত করে ধরল। শক্তপোক্ত বাঁধনে আবদ্ধপূর্বক নিজের দিকে টান দিলো মাহাকে। ভারসাম্য হারিয়ে রাওফিনের বুকে পড়ার আগেই হাত দিয়ে বাধা প্রদান করল সে
মাহা । খানিক চেঁচিয়ে বলল,
—>“হোয়াট দ্যা হেল, রাওফিন? রাস্তার মধ্যে সিন ক্রিয়েট করবানা। নয়তো, নয়তো আমি তোমার এমন অবস্থা করবো না! ভাবতেও পারছ না।
—>“বাব্বা! মিস, আপনার মধ্যে এখনো তো দেখি সেই গুন্ডি ভাবটা আছে। বাই দ্যা ওয়ে, তোমার মারামারিটাও কিন্তু আমার বেশ লাগতো। অনেক মিস করেছি জানো?
—>“বাজে বকা বন্ধ করো। আর ওড়না ছাড়ো না হলে কিন্তু আমি!
—>“না হলে কিন্তু তুমি?
তাদের এমন কথোপকথনের মাঝেই বেশ কয়েকজন মানুষ তাদের লক্ষ্য করে এগিয়ে আসে। মাঝ বয়সী একটা লোক কিছুটা তেড়ে এসে বলে,,,
—>“কি হচ্ছেটা কি এখানে? তুমি ওর ওড়না ধরে আছো কেন? (অতঃপর সে আশে পাশে থাকা লোকগুলোর দিকে ফিরে বলে) মেয়েরা এখন কোথাও নিরাপদ নয় বুঝলেন?
লোকগুলো ও তার কথায় সায় জানিয়ে এগিয়ে আসে। তাদের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল রাওফিন কে এখন পারলে সবাই মিলে গনধোলাই দেয়। অবস্থা বেগতিক দেখে, মাহা ভড়কে গেলেও রাওফিন খানিক হেসে বলল,,,
—>“আরে আঙ্কেল বাসায় কি আন্টি নেই নাকি?
—>“মানে?
—>“মানে এত বড় হয়েছেন আর এটুকুও বোঝেন না?
পাশ থেকে আরেকটা লোক এগিয়ে এসে বলল,,,
—>“এই ছেলে এই? ভারী অসভ্য তো তুমি। একে তো রাস্তার মাঝখানে মেয়েদের হ্যারাস করছো, তার ওপর আবার এত বড় একটা লোকের সাথে এভাবে কথা বলছ?
—>“আরে,আঙ্কেল আমার কথাটা তো শুনুন!
—>“বলো।
—>“এটা আমার ওয়াইফ, ঝগড়া করে বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছে। বলুন তো কি করি?
লোকগুলোর সঙ্গে হতভম্ব হয়ে গেল মাহা নিজেও। কত্ত বড় মিথ্যা! এই বেডার উপর গজব পড়ুক,আল্লাহ! তবে তৎক্ষণাৎ সে কিছু বলল না। অন্যদিকে লোকজন গুলো নিজেদের মধ্যে কথোপকথন শুরু করল। ভুল বোঝা লোকটা অনুশোচনার ভঙ্গিমায় বলল,,,
—>“ দুঃখিত বাবা, আসলে আমি বুঝতে পারিনি।
পাশ থেকেই একটা মহিলা মাহাকে টিটকারি করে বলল,
—>“ এখনকার যুগের মেয়েগুলোও হয়েছে বাপু! একটু কিছু হয়ে পারেনা স্বামীর সাথে ঝগড়াঝাটি শুরু করে। অথচ আমাদের সময়, আমরা কত কিছু সহ্য করেছি!
মহিলার কথায় গা পিত্তি জ্বলে উঠলো মাহার। এসব গাঁ জ্বালানো মহিলাদের কথা শুনলে মনে হয় ঠাঁটিয়ে একটা থাপ্পর দিতে। মনে মনে ফিসফিসিয়ে, তবে মুখে রাগী হাসির রেখা ফুটিয়ে বলল,,
—>“ হ্যাঁ হ্যাঁ আন্টি, আপনারা তো সব কথা মেনে চলতেন। তা এখন এখানে কি করছেন? আপনার হাসবেন্ড বুঝি বাড়ির কাজ ফেলে এখানে এসে, অন্যের সমালোচনা করার পারমিশন দিয়েছে আপনাকে? না হলে তো আপনি আবার, এখানেও আসতেন না। তাই না?
মহিলাটি রাগে হিসিয়ে বলল,,,—>“ কি অসভ্য মেয়ে।
—>“ আপনাদের মত অতি সভ্য মহিলাদের জন্য, আমি একটু বেশিই অসভ্য আন্টি। তাই আমাকে জ্ঞান না দিয়ে এখান থেকে সরে গেলে ভালো করবেন। না হলে এই অসভ্যের অসভ্যতার কিছুই আপনি দেখেননি।
মহিলাটি একপ্রকার রেগে চলে গেল সেখান থেকে। সে চলে যেতেই আরেকজন মহিলা স্নেহ পূর্ণ কণ্ঠে বললো,,
—>“ এতো রাগ ভালো নয় মা। স্বামীর উপর রাগ করলে আল্লাহ নারাজ হন।
মাহা কিছু বলতে গিয়েও থমকালো। একঝলক রাওফিনের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল,সে ঠোঁট চেপে হাসছে। তা দেখে রাগ সপ্তমে চড়লেও তৎক্ষণাৎ কিছু বলল না সে। বাধ্য মেয়ের মত বাইকে উঠে বসল।রাওফিনও খোশমেজাজে বাইক স্টার্ট দিল। কিন্তু বোকা সে অনুমানই করতে পারলো না তুমুল সাইক্লোনের আগাম পূর্বাভাস।
গাড়ি চলছে, তো চলছেই। ভেতরে বাসা দুটি জীব নির্বিকার। নীল ভাবলেশহীন ভঙ্গিমায় গাড়ি চালাতে ব্যস্ত। হঠাৎই থেমে গেল গাড়িটা।তিহু বাইরে তাকানোর প্রয়োজন বোধ অব্দি করল না। কেননা তার বোঝা হয়ে গিয়েছে, এই লোককে কোনো কিছু নিষেধ করলেও শুনবে না। হুট করে তার পাশে থাকা দরজা টা খুলতে লাগলেই, অবাক ভঙ্গিমায় পাশে তাকালে তিহু।
দৃষ্টিগত হলো সুদর্শন পুরুষটিকে, যিনি এখন চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে সটান দাঁড়িয়ে আছে তার পাশে। দেখতে অনেকটা ঋত্বিক রোশানের মত লাগছে। আহ,কি স্টাইল! কি অ্যাটিটিউড!কি ফিটনেস! সাধে কি আর, মেয়েরা তার উপর ক্রাশ খায়? ওয়েট আ মিনিট,তিহু কি ক্রাশ খেলো!
এদিকে তাকে এমন অপলক চেয়ে থাকতে দেখে, ভ্রু গুটিয়ে সামান্য বাঁকা হাসলো নীল। তার ধ্যান ছুটানোর জন্য, সামান্য খাঁকারি দিলো। সঙ্গে সঙ্গে ধ্যান ভাঙল তিহুর, বুঝলো এতক্ষণ কেমন কেবলার মত চেয়ে ছিলো! নিজের বোকামির কথা মনে পড়তেই, নিজের মাথায় নিজের গাট্টা দিতে ইচ্ছা করলো তার। অপ্রস্তুত ভঙ্গিমায় দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে, গন্তব্যহীন রাস্তায় পাড়ি জমালো।
নীল জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে, ফের দুষ্টু হাসলো। অতঃপর কিছুটা দ্রুত হেঁটে এগিয়ে গিয়ে, তিহুর পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো। তাকে দেখে তিহু বললো,,
—>“আমরা কোথায় যাচ্ছি বলুন তো?
নীলের মুখে বিদ্যমান, দুষ্টু হাসিটা তিহুর পাশাপাশি দাঁড়ানোর পর পরই গায়েব হয়ে গিয়েছে। সেখানে ফুটে উঠেছে, চিরচরিত গাম্ভীর্য।
—>“তুমি যেখানে যেতে চাচ্ছ!
থেমে গেল তিহুর পা, নীলের দিকে ফিরে অবাক হয়ে বলল,,,
—>“আমি আবার কোথায় যেতে চাইলাম?
—>“সেটা আমি,কি জানি? তুমিই তো গাড়ি থেকে বের হয়ে এদিকে আসলে।
—>“আমি? ও হ্যাঁ, কিন্তু সেটা আপনি গাড়ির দরজা খুলেছিলেন বলেই তো।
নীল আর কথা বাড়ালো না, এগিয়ে চলল সামনের দিকে। তিহুও পিছু নিল তার। দুটি মিলে এসে দাঁড়ালো, সবুজ মন্ডিত এক পার্কের মাঝে। গোধূলি আলোয় রঙা সেথায় কপতো-কপতির ভিড় জমেছে। হঠাৎ নীলের এখানে আসার কারণ বুঝলো না তিহু। তাকে প্রশ্ন করতে যাবে তার আগেই সামনে থাকা একজোড়া কাপল, দৃষ্টি কাড়ল তাদের। শুধু তাদের নয় এখানে উপস্থিত সকলের।
ছেলেটি হাঁটু গেড়ে বসে শাড়ি পরিহিত একটি মেয়ের সামনে একগুচ্ছ লাল গোলাপের স্তবক ধরে, চিৎকার করে বলছে,,,,
—>“আই লাভ ইউ তনু। আই লাভ ইউ ভেরি মাচ সুইটহার্ট। হবি আমার? হবি আমার জীবনসঙ্গিনী?
উপস্থিতি সকলের স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। তিহু তো পলক ফেলতেই ভুলে গেছে যেন! বিড়বিড়িয়ে সে বললো,,
—>“হাউ সুইট! আল্লাহ!
অতঃপর সে এক ঝলক নীলের দিকে তাকালো।বেডা এখনো মোবাইল ঘাটছে। খেই হারিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,,
—>“কি ব্যাটা দিলে কপালে খোদা!
অতঃপর নীলের উদ্দেশ্যে সে, কিছুটা জোরে বললো,
—>“এই যে শুনছেন? দেখুন কি সুন্দর একটা মোমেন্ট! দারুন না?
—>“আমায় কিছু বলছো?
—>“না, ভুতকে বলছি।
—>“যাকে ইচ্ছা বলো কিন্তু আমাকে এসব ফালতু জিনিস দেখাবা না। এসব জিনিস দেখে টাইম ওয়েস্ট করার মত সময় আমার কাছে নেই।
—>“এ সমস্ত ফালতু জিনিস?
—>“তা নয় তো কি?
—>“আপনি কি মানুষ? না মানে এসব জিনিস কারো কাছে ফালতু লাগে?
—>“আমার কাছে লাগে। বিকজ আই বিলিভ ইন হালাল, নট হারাম। আর ছেলেটা যদি মেয়েটিকে সত্যিই ভালোবাসতো, তাহলে এমন উদ্ভট জায়গায় অদ্ভুত কর্মকাণ্ড করত না।
—>“ আইছেরে আমার হালাল পুরুষ!তাহলে আমাকে এখানে আনলেন কেন?
—>“আমি এনেছি?
—>“তা নয় তো কি?
তাদের এমন খুনসুটি পূর্ণ সময় সেখানে উপস্থিত হল, নিদ্রা আর ইফাজ।
—>“আসসালামু আলাইকুম ভাই!
—>“ ওয়ালাইকুমুস সালাম। ইফাজ,তুই?
—>“হ্যাঁ আপনাদের দেখে আসলাম।
তাদের কথোপকথন চলাকালে নিদ্রা এসে তিহুর পাশে দাঁড়ালো।
—>“তিহু?
—>“হু?
—>“ঘুরতে এসেছিস?
—>“না,না।ঐ আরকি !
—>“আচ্ছা চল।
সে তিহুর হাত টান দিতেই,তিহু অবাক হয়ে বলল,,—>“কোথায়?
—>“ওই তো ঐখানে।
নিদ্রার আঙ্গুল অনুসরণ করে সেদিকে তাকালো তিহু। অনেকগুলো মেয়ে একত্র হয়ে বসে আছে সেখানে। আর ছেলেগুলো এদিকে আসছে,খুব সম্ভবত নীলের কাছে। কয়েক মুহূর্ত, তার মাঝেই ছেলেগুলো নীলের সামনে এসে গণযোগে সালাম দিয়ে বলল,,,
—>“ভাই আপনি এখানে?
—>“তোরা এখানে কি করছিস?
—>“ওই আর কি,গার্লফ্রেন্ড নিয়ে এসেছিলাম ভাই!
—>“সবাই একসাথে?
—>“ওই আর কি!
—>“ওহ।
তারা নীলের পাশে থাকা তিহুর দিকে তাকিয়ে বলল,,
—>“ভাই,ভাবি নাকি?
নীল সামান্য ইশারা করতেই, সকলে হইহই করে উঠলো। একে একে সালাম ঠুকলো তিহুকে।
আদনান:“আসসালামু আলাইকুম ভাবি!
রোহান: “আসসালামু আলাইকুম ভাবি!
সাদমান: “আসসালামু আলাইকুম ভাবি!
মাহিন: “আসসালামু আলাইকুম ভাবি!
আজিজ:“ আসসালামু আলাইকুম ভাবি!
এত এত সালামের ভিড়ে কারটা রেখে কারটার জবাব দিবে সেই খেই হারিয়ে ফেলল তিহু। তার ওপর এখানে উপস্থিত সকলে বয়সে বেশ বড় তার থেকে। এমন অবস্থায় নীল তাদের সকলকে থামিয়ে বলল,,
—>“এই, চুপ!
নীলের ধমকানিতে থামলো সব কয়টা। তাদের মধ্যে থেকে ইফাজ বলল,,,
—>“ভাই চলুন একটু সামনে গিয়ে বসি।আমরা কিছু খাবারের আয়োজন করেছিলাম।ভাবিকে নিয়ে আসলেন। চলুন একটু!
“হ্যাঁ, হ্যাঁ।ভাই প্লিজ ”——সায় মেলালো সবগুলো।
—>“আজ না,অন্য একদিন। সন্ধ্যা হয়ে গেছে আজ।
—>“চলুন না ভাই। পাঁচ মিনিটের ব্যাপার।
সবগুলো একেবারে ঘিরে ধরল তাকে। শেষমেষ তাদের অনুরোধের কাছে হার মানল নীল। অবশ্য নিজ থেকে না,তিহুর জন্যই।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা ঘনীভূত। রক্তিম আলোয় রাঙা চারিপাশ। সবুজ ঘাসের উপর পাতা শীতল পাটিতে বসে আছে সকলে। অবশ্য নীলের জন্য মোড়া আনা হলেও, তাতে বসেনি সে। গোল হয়ে বসে আছে সকলে। মাঝখানে খাবারের পসরা, বিভিন্ন রকম ফাস্টফুড, স্ট্রিট ফুড এর পাশাপাশি কোকের বোতলগুলো । হঠাৎই তিহুর নজর কাড়ল মাঝখানে রাখা গিটারটা। গিটার জিনিসটা তার বড্ড পছন্দের। তবে কখনো ছুঁয়ে দেখা হয়নি। আবেগ আপ্লুত হয়ে সে বলেই ফেলল,,,
—>“গিটার!
সকলে বেশ অবাক হয়ে তাকালো। সাদমান বলল,,,—>“হ্যাঁ ভাবি।
—>“এটা কি আপনার?
—>“হুম।
—>“ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড আমি কি একটু নিতে পারি।
—>“আল্লাহ ভাবি কি বলেন? অবশ্যই।
সে গিটারটা এগিয়ে দিল তিহুর দিকে। তিহু সেটা নিল ঠিকই,তবে বিপত্তি বাঁধলো অন্য জায়গায়। সে তো এটা বাজাতে পারে না। সে ফেরত দিতে যেয়ে বলল,,,
—>“স্যরি, অ্যাকচুয়ালি আমি বাজাতে পারি না।
—>“ভাই তো পারে।
সবাই একযোগে তাকালো নীলের দিকে। তাদের সঙ্গে সঙ্গে তিহু নিজেও। তার দৃষ্টিতে বিস্ময়ের ছাপ স্পষ্ট।
—>“আপনি গিটার বাজাতে পারেন?
তার কথার জবাবে নীল কি বলবে? তার আগেই, সকলে অবাক হয়ে বলল,,,
—>“সে কি ভাই? আপনি ভাবিকে কখনো গান গেয়ে শোনান নি?
নীলকে বলবে না বলবে বুঝতে পারল না। এই মেয়েটাও না এত বোকা! তবে তৎক্ষণাৎ ইফাজ তাকে বাঁচিয়ে দিল যেন, দ্রুত গিটারটা নীলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,,,
—>“আরে ভাই ব্যস্ত মানুষ। সারাদিন পার্টি অফিস আর নিজের অফিস নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এজন্যই হয়তো। আচ্ছা ভাই আপনি নেন নেন, এখন না হয় একটু গান শোনান ভাবিকে।
নীল কোনো উপায়ান্ত না পেয়ে গিটারটা হাতে নিল। এক ঝলক তাকালো তিহুর দিকে।কি গাইবে বুঝলো না । গিটারটা হাতে নিয়ে তারে টুংটাং শব্দ করতে লাগলো। হঠাৎই তিহুর দিকে ফিরে গিয়ে উঠলো,,,
🎶 জানতে যদি চাও কতটা তোমার…..
একটু থেকে যাও এই মনে আমার ……
জানতে যদি চাও কতটা তোমার…..
একটু থেকে যাও এই মনে আমার ……
কেন ঘুম ভাঙিয়ে দূরে থাকো হারিয়ে….
কেন ঘুম ভাঙিয়ে দূরে থাকো হারিয়ে….
তাই ক্ষণে ক্ষণে আনমনে তোমায় শুধু খুঁজি বারবার…..
জানতে যদি চাও কতটা তোমার…..
একটু থেকে যাও এই মনে আমার ……🎶
নীল গিটারে টুংটাং আওয়াজ করতে লাগলো, তার সাথে এবার পাশ থেকে আরো একটি গিটার বাজালো, আদনান। ইফাজ সুর তুলে বাজালো, ঠোঁটে চেপে রাখা মাউথ অর্গানটা। তিহু অবাক-হতভম্ভ , চূড়ান্ত আশ্চর্যান্বিত। তবে তাকে আরও বেশি অবাক করে দিয়ে নীল ফের গাইলো,,,
প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ১৮
🎶 তোমার জন্য সাজানো স্বপ্নে একা দিনযাপন….
বলোনা কবে শুরু যে হবে প্রেমের আলাপন….
তোমার জন্য সাজানো স্বপ্নে একা দিনযাপন….
বলোনা কবে শুরু যে হবে প্রেমের আলাপন….
জুড়ে আছো নিশিদিন রাখবো বেঁধে চিরদিন….
জুড়ে আছো নিশিদিন রাখবো বেঁধে চিরদিন….
তাই ক্ষণে ক্ষণে আনমনে তোমায় শুধু খুঁজি বার বার….🎶
