প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ২১
নওরিন কবির তিশা
সিলেট শহরের অন্যতম সুন্দর নগরী জাফলং । প্রকৃতি যেন তার সৌন্দর্যের সবটুকু ঢেলে দিয়েছে এখানে। আর জাফলং নগরীর এক প্রাচীন জমিদার বাড়ি নামে আখ্যায়িত মির্জা মহল। কথিত আছে এখানকার বর্তমান উত্তরসুরী মির্জা সাঈদ আহমদ, মির্জা জাহিদ আহমদ আর মির্জা ফরিদ আহমেদের পূর্বপুরুষদের একজন সুবেদারী আমলে এ অঞ্চলের অধিপতি ছিলেন।
মির্জামহল টাও তখনকার যুগেরই স্থাপত্য। দুই তলা বিশিষ্ট সে ভবনটা ত্রিশ একর জমির উপর স্থাপিত। দুপাশে স্বচ্ছ পাথুরে লেকের মৃদু কলরব, আর দূর পাহাড় থেকে ভেসে আসা পাখ-পাখালির গুঞ্জন। তিহুরা এসে পৌঁছেছে সন্ধ্যার কিছুটা আগে। যদিও বাড়ির প্রবীণসহ নিহিতরা তার থেকেও ঘন্টা খানেক আগে পৌঁছেছিল।
বর্তমানে ঘড়ির কাঁটায় রাত আটটা চলমান, দুই তলার বিশাল এক রুমে বিশ্রাম নিচ্ছিলো তিহু সহ বাকি নবীনেরা। হুট করে দরজায় এসে কড়া নাড়লো কেউ। সবার হয়ে নাহা বলল,,,
——’কে?
——’আপা আমি ফুলি।
——’ভেতরে আয়।
ভেতরে প্রবেশ করল শাড়ি পরিহিতা এক কিশোরী কন্যা। তাকে দেখে নাহা বলল,,,
——’কিছু বলবি?
——’আপনাদের দাদিজান নিচে ডাকছেন।
——’নানু?
——’হুম!
——’আচ্ছা তুই যেতে লাগ আমরা আসছি।
অনুমতি পেয়েই সম্মতি সূচক মাথা নাড়িয়ে, সেখান থেকে প্রস্থান করল ফুলি। অন্যদিকে এত ছোট একটা মেয়ের পরনে শাড়ি দেখে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে তিহু বলল,,
——’এতোটুকু একটা মেয়ের শাড়ি পরে?
পাশ থেকে রাফা বলল,,,——’এরা এমনই বউমনি। পিচ্চি টু বুড়া সবাই শাড়ি পরে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
——’কি বলো?
——’হুম, এটা একটা ট্র্যাডিশান।
——’ট্র্যাডিশান? এ কেমন ট্র্যাডিশন?
——’ও তুমি বুঝবে না।
——’বেশি বকবক না করে বউমনি আর মাহা স্যরি বড় বউমনিকে নিয়ে আয়। ওরা এখানকার নতুন কিছুই চিনবে না।
বলেই নাহা দ্রুত সেখান থেকে যেতে নিতেই, তার বলা কথাটা খপ করে ধরে বসলো নিহিত,,,——’বড় বউমনি মানে?
নাহা বেরিয়ে যেতে বলল,,——’মানে তোর মাথা আর আমার মুন্ডু। বেশি প্রশ্ন না করে রিশাদকে নিয়ে আয়।
নাহা চলে গেল। নিহিত আর কথা বাড়ালো না। তবে ফন্দি এঁটে রাখল পরবর্তীতে নাহাকে ফাঁকা পেলেই ধরবে। রাফা আর নীরা তিহু আর মাহাকে নিয়ে, নুরজাহান বেগমের কক্ষের দিকে গেল। তারা বেরিয়ে যেতেই রিশাদের উদ্দেশ্যে নিহিত বলল,,
——’হেই ব্রো, চলো আমরাও যাই। দেখি আমার ওয়ান এন্ড ওয়ানলি সুইটহার্ট টা কি বলে?
——’হুম চলো। তোমার সুইটহার্টের সাথে আমিও একটু সখ্যতা করে আসি।
নিহিত হালকা হেসে রিশাদের কাঁধে হাত রাখল, রিশাদও নিজের অপর হাতটা রাখল নিহিতের বাঁকাধে।
নুরজাহান বেগমের রুমের সামনে এসে থামলো তিহু। ভেতর থেকে শোনা যাচ্ছে অনেক মানুষের কথোপকথনের গুঞ্জন। পাশ থেকে ফুলি ডেকে বলল,,,
——’ভাবিজান কিছু মনে করিয়েন না, তবে মাথায় ঘোমটাটা টেনে দিন। দাদিজান আবার বাড়ির বউদের মাথা খোলা রাখা পছন্দ করেননা।
তিহু তার জবাবে মুচকি হেসে, ওড়নার পাড়টা মাথার উপর সামান্য টেনে দিলো। অতঃপর প্রবেশ করল কক্ষটিতে।কক্ষটা বেশ বড়সড়,ভেতরে ঢুকেই সে দেখতে পেলো সেখানে উপস্থিত খান বাড়ির সকলে। সাথে আরো অজানা অনেক সদস্য। সবাই তার দিকে তাকালে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে উঠল সে। জোরপূর্বক হাসির চেষ্টা করে সামান্য গলা খাঁকারি দিলো। অতঃপর একে একে সবার উদ্দেশ্যে সালাম দিতে শুরু করল।
সালাম পর্ব শেষে, নুরজাহান বেগম তাকে হাতের ইশারা করে নিজের দিকে ডাকলেন। তিহু মুচকি হেসে এগিয়ে গেল সেদিকে। কাছাকাছি আসতেই নুরজাহান বেগম হাত বাড়িয়ে তাকে নিজের বেশ কাছাকাছি এনে বললেন,,
——’কি ব্যাপার হুরপরী? শুনলাম তুই নাকি আমার বরটাকে নিজের রূপে পাগল বানিয়ে ফেলেছিস? আমার সাথে তো কথাই বলছে না ঠিকমতো। শুধুই তোর কথা।
তার এমন কথায় তিহু অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো, কুঁচকানো চামড়ার মুখশ্রী মোটা ফ্রেমের চশমায় আবৃত নুরজাহান বেগমের। বৃদ্ধ হয়ে গেলেও তাকে দেখে অনুমান করা যায় বয়সকালে বেশ সুন্দরী ছিলেন তিনি। তিহুতো ভেবেছিলো তিনি হয়তো বেশ গুরু গম্ভীর হবেন , খানিকটা স্টার-সিরিয়ালে দেখা নানী-শাশুড়িদের মতো। তবে তার আনুমানিক চরিত্রের ভিন্নতা দৃষ্টিগত হতেই মুচকি হাসলো সে।
——’তুমি আমাকে হুরপরী বলছো,হুম? নিজেকে দেখেছো কখনো তুমি ? তুমি আমার থেকেও দ্বিগুন সুন্দরী সুইটহার্ট।
——’হয়েছে,হয়েছে আর তেল দিতে হবে না। তা এবার নিজের সুন্দর নামখানা বলো দেখি।
——’আমি কই তেল দিলাম? যেটা সত্যি সেটাই তো বললাম শুধু।
পাশ থেকে জুনাইয়া বলল,,——’দাদিজান কিন্তু আমার সুপারহিট। কিছুক্ষণ থাকলেই বুঝতে পারবা। যাইহোক এবার নিজের নামটা বলো তো শুনি। আর হ্যাঁ আমাকে নিয়ে কনফিউজ হইও না, আমি তোমার বরের মেজো মামার একমাত্র মেয়ে। মির্জা জুনাইয়া। তোমাদের জুনুপু।
জুনাইয়ার এমন কথায় মুচকি হাসলো তিহু।
——’আমি নুরাইন,নুরাইন হক তিহু।
নুরজাহান বেগম:’মাশাআল্লাহ। নামের মতোই সুন্দরী তুমি।
তিনি আলগোছে একটা উষ্ণ চুমু খেলেন তিহুর প্রশস্ত ললাটে।তার এমন কান্ডে নাহা নাক ফুঁলিয়ে নীরাকে ধাক্কিয়ে জোরে জোরে বলল,,,
——’দেখ,দেখ নীর আমরা কতদিন পর আসলাম সেদিকে ওনার হুঁশ নাই। অথচ নাতবৌকে কি যত্নটাই না করছে।
পাশ থেকে রাফা অভিমানী কন্ঠে বলল,,,——’আর আমাকে তো কেউ চেনেই না।
তাদের সাথে যোগ দিল জুনাইয়াও,, ——’হ্যাঁ, হ্যাঁ। একদম। আমিও তো কতদিন পর পরশু শাশুড়ি বাড়ি থেকে ফিরলাম।কই আমাকে তো একটিবার ডেকেও শুনলো না যে,জুনু কেমন আছিস?আর দেখ নাতবৌকে কি যত্নটাই না করছে!
জুনাইয়ার কথায় পাশ থেকে তার ভাই জুনাইদ বলল,,——’তোরা মেয়েরা এতো হিংসুটে কেন রে?
তাকে ধমকে নাহা বলল,,——’তুই চুপ থাক।
——’ওই?আমি তোর বড়ো।
——’তাই?তা কতদিনের?
——’গুনে গুনে চার ঘন্টার।
তার কথায় তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে নাহা বলল,,,
——’চার জনমের বড় হলেও তোরে সম্মান দিতাম না।আর কই চার ঘন্টা!
তাদের এমন বাকবিতন্ডার মধ্যে নুরজাহান বেগম তাদের থামিয়ে বললেন,,——’আরে,আরে।থাম,থাম।আয় দেখি সবকটা আমার বুকে আয়।
তার কথা বলতে দেরি;সবাই একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়লো তার বক্ষদেশে। নুরজাহান বেগম হাত প্রসারিত করে জায়গা দিলেন সব কটাকে। শুধু দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলো মাহাকে। তা দেখে নুরজাহান বেগম বললেন,,
——’এই মেয়ে, তুমি দূরে কেন? এদিকে এসো।
মাহা অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে বোঝালো,,তাকে? নুরজাহান বেগম ইশারায় সম্মতি জানিয়ে বললেন,,—’হুম। ব্যাস মাহা এগিয়ে গিয়ে শামিল হলো স্নেহ পূর্ণ সেই মূহূর্তের।
পাশ থেকে জুনাইদ মুখ বাঁকিয়ে বলল,,——’শা*লা হিংসুকুটির দল।
দীর্ঘ এক স্নেহ পূর্ণ আলিঙ্গন শেষে মির্জা সূচনা তিহুর উদ্দেশ্যে বলল,——’এদিকে এসো নুরাইন।
তিহু বাধ্য মেয়ের মতো এগিয়ে আসলো। মির্জা সূচনা তাকে একে একে সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন।সোফার বাঁ দিকে ওয়ালিদ খানের দুজন পরে বসা মধ্যবয়সী লোকটাকে দেখিয়ে বললেন,,
——’ঐযে দেখছো সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত লোকটা উনি হচ্ছেন আমার বড় ভাই,তোমার বড় মামা মির্জা সাঈদ আহমদ।তার পাশে তোমার মেজো মামা মির্জা জাহিদ আহমেদ,আর তোমার আব্বুর ডান পাশে হলুদ পাঞ্জাবী ওটা আমার ছোট ভাই মির্জা ফরিদ আহমেদ।
তিহু একে একে ফের সালাম দিলো তাদের। অতঃপর মির্জা সূচনা বাড়ির রমনীদের সাথে তার পরিচয় করিয়ে দিলেন।তিনি কাতান শাড়ি পরিহিত আজমিরা আনমের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন,,
——’উনি তোমার বড় মামিমা,আজমিরা আনম। তার বাঁ পাশে তোমার মেজো মামিমা শামিমা সুলতানা আর ডান পাশে….
তার কথা কেড়ে নিয়ে তিহু বলল,——’ছোটো মামিমা।
——’হুম,মনোয়ারা।
তাদের কথোপকথনের মাঝেই সেখানে হাজির হলো অনেকগুলো নবীন প্রাণ। তাদের দেখে মির্জা সূচনার হয়ে পাশ থেকে মির্জা সায়মা খানিক হেসে বললেন,,,
——’আর এই যে দেখছিস,এরা হচ্ছে একেকটা দুষ্টুমির উপর নোবেল প্রাপ্ত সদস্য।এই যে ডান দিকে হলুদ শার্ট ওটা তোর বড় মামার ছোট ছেলে মির্জা সামির,পাশে মেজ মামার ছোট ছেলে মির্জা জুনাইদ,তার পাশে ছোট মামার দুই বাঁদর আর বাঁদরনী মির্জা ফাহাদ আর মির্জা ফারিসা।আর ঐযে আমার মায়ের বাঁ পাশে বসা মিষ্টি করে দুষ্টু মেয়েটা ওটা তোর মেজো মামার বড় মেয়ে মির্জা জুনাইয়া।
ফারিসা:’এটা কি পরিচয় করালে নাকি অপমান ফুপ্পি?
মির্জা সায়মা:’যা মনে করিস।
ফাহাদ:’তোমার সাথে কথা পরে বলছি,আগে বউমনির সঙ্গে আলাপ সেরে নেই।
ফাহাদ,ফারিসা বাড়ির সবার ছোট। বাদবাকি ভাই-বোনরা সবাই কলেজ শেষে ভার্সিটি পড়ুয়া হলেও তারা সবে কলেজে পদার্পণ করেছে। ফাহাদ ইন্টার ফার্স্ট ইয়ার আর ফারিসা ক্লাস নাইনের শিক্ষার্থী। একে একে সবার সাথে আলাপ সারলো তিহু। সবাই একটু দুষ্টু হলেও অত্যন্ত মিশুকে স্বভাবের।
ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দ রাত দশটার জানান দিচ্ছে। বরাদ্দকৃত রুমটির ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে তিহু। এতক্ষণ বাড়ির সবার সাথে আড্ডা দিচ্ছিলো বেশ। তবে রাত গাঢ় আর সকলে ক্লান্ত হওয়ার দরুন, বিশ্রামে মগ্ন হয়েছে সবাই। তবে আড্ডা থেকে সে যতদূর জানতে পেরেছে বিয়েটা, এবারের বড় ছেলে মির্জা সৌভিকের।
বিজনেসের কারণে কানাডায় থাকে সে। যার দরুন মাসের শেষে থাকা বিয়েটা এগিয়ে আর মাত্র তিন দিন বাদেই আনা হয়েছে। কাল হলুদ পরশু মেহেদী পর দিন বিয়ে। যদিও তাদের আরো কিছুদিন আগে আসার কথা ছিল তবে ওয়ালিদ খানের ব্যবসা আর পার্টি অফিসের কিছু ঝামেলার দরুন বিলম্ব হলো।
ভাবতে ভাবতে তিহু একবার বাঁ পাশে ফিরে চায়,পাথুরে লেকের স্বচ্ছ পানিতে চাঁদের রুপালী কিরণ প্রতিফলিত হচ্ছে। এক অপার্থিব সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। মৃদুমন্দ বাতাসে তিহুর বেবি হেয়ারগুলো অবাধ্য প্রেমিকের ন্যায় তার মুখে আঁচড়ে পড়ছে। এক হাতে সেগুলো সরিয়ে সে ফের মনোনিবেশ করল বাইরের সৌন্দর্যে।
স্ট্রিং লাইটের মৃদু আলোক রশ্মির ঝলকানিতে উজ্জ্বল সমগ্র মহলটা। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে এক পর্যায়ে সে গুনগুনিয়ে গান ধরল,,
🎶Tu hi yeh mujhko bata de…..
(তুমিই শুধু আমায় বলে দাও)
Chahun main ya na……
(আমি তোমায় ভালোবাসবো কি না)
Apne tu dil ka pata de…..
( তোমার মনের খবরটা আমায় জানাও)
Chahun main ya na …..🎶
(আমি তোমায় ভালোবাসবো কি না )
নীল সবে একটা ভিডিও কনফারেন্স শেষে রুমে এসেছে, কোথাও তিহুর কোনো হদিস না পেয়ে একপ্রকার বিচলিত হয়ে পড়েছিল সে। তবে ব্যালকানি থেকে ভেসে আসা এমন সুমধুর কন্ঠে,হৃদয়ের উচাটন শুরু হলো তার। হৃদপিন্ডের ধুকধুকানি বেড়ে চলল তড়িৎ বেগে,যা সামাল দেওয়া বড্ড কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ল তার পক্ষে। হৃদয়ের কথাগুলো হঠাৎ বেরিয়ে আসলো মুখে,,,,
🎶Itna bata doon tujhko…….
(এইটুকু শুধু বলতে পারি তোমায়)
Chaahat pe apni mujhko…..
(আমার ভালোবাসার ওপর আমার)
Yun toh nahin ikhtiyaar…….
(সেভাবে কোনো অধিকার নেই)
Phir bhi yeh socha dil na….
(তবুও মন এটা ভেবেছে যে)
Ab joh laga hoon milne…….
(এখন যখন দেখা হওয়া শুরু হয়েছে)
Poochhun tujhe ek baar…….🎶
(একবার তোমায় জিজ্ঞেস করি)
ভেসে আসা গভীর পৌরুষ কণ্ঠে থমকাল তিহু। বিষ্ময় ভাবাপন্ন মুখশ্রীতে জলদি পায়ে প্রবেশ করলো কক্ষে। ভেতরে এসেই নীলকে এমন এলোমেলো অবস্থায় দেখে আরও বেশি অবাক হল সে। লোকটা কক্ষনো অগোছালো থাকা পছন্দ করে না, সর্বক্ষণ গুছিয়ে থাকা তার একটা অভ্যাসের মধ্যে পড়ে। তবে এখন কেমন অদ্ভুত লাগছে মানুষটাকে।
চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপালের উপর পড়ে আছে, দৃষ্টি চঞ্চল, নিঃশ্বাস এলোমেলো। তাকে এমন অবস্থায় দেখে তিহু বোকা বনে গেল। মুহূর্তে ভুলে গেল রুমে আসার কারণ। কিছুটা অস্থির কন্ঠে শুধালো,,
——’আর ইউ ওকে নেতা সাহেব?
তিহুর কন্ঠে ধ্যান ভাঙল নীলের। মুহূর্তেই নিজের চিরাচরিত গাম্ভীর্য বজায় রেখে শক্ত করল চোয়াল। গলা সামান্য খাঁকারি দিয়ে বলল,,,
——’আ’ম ওকে।
পরক্ষণে প্রসঙ্গ বদলাতে চারিদিকে এক ঝলক তাকিয়ে বলল,,,——’এখানে সোফা নেই না?
——’না।
“ওহ”——ছোট্ট করে কথাটা বলেই,সে বিছানা থেকে একটা বালিশ নিতে যেতেই তিহু তাকে আটকিয়ে বলল,,,
——’কই যাচ্ছেন?
নীল এক ঝলক নিজের হাতের দিকে তাকালো, যেখানটায় তিহু ধরে আছে।সে তাকাতেই দ্রুত হাত সরিয়ে নিল তিহু।
——’না মানে, আমি একা একা ঘুমাতে অভ্যস্ত নই।
নীল বেশ অবাক হলো, সে তো কোথাও যাচ্ছিলই না। যাওয়ার প্রশ্নই বা উঠছে কোথা থেকে? সে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই তিহু ফের বলল,,,
——’আপনি না হয় আজ বিছানাতেই ঘুমান।
——’আর তুমি?
তিহু কিছুটা কাচুমাচু করে অপ্রস্তুত কণ্ঠে বললো,,,——’আমিও বিছানাতেই ঘুমাবো।
তিহুর এমন কথায় গভীর দৃষ্টিতে তার পানে তাকালো নীল। কিঞ্চিৎ বিস্মিত চোখগুলো সরু করে,অদ্ভুত কন্ঠে বলল,,,
——’আ ইউ শিওর?
নীল সামান্য বাঁকা হাসলো। তা দেখে তিহু চোখ সরু করে বলল,,,——’এরেই কয় ব্যাডা মানুষ, শিওর না হয়ে কি আমি কোনো কিছু বলছি? আচ্ছা যান আপনার ঘুমানো লাগবে না বিছানায়।
“ওকে,অ্যাজ ইউর উইশ”——বলেই সে বালিশটা হাতে তুলে মিছিমিছি অন্য রুমের দিকে পা বাড়াতে যেতেই তিহু ফের বাঁধা দিয়ে বলল,,,
——’যেতে বললেই চলে যাবেন? এমন একটা ভাব দেখাচ্ছেন যেন আমার সব কথা শোনেন? এই যে মিস্টার শুনেন, আপনি যদি এখন রুম থেকে বের হন না, তাহলে আমি সবাইকে বলে দেবো যে আপনি আমাকে জোর করে বিয়ে করেছেন।
নীল বালিশটা বিছানার উপর রাখল,মুখ কুঁচকে বলল,,,——’তুমি আসলে চাওটা কি বলোতো?
——‘কিছুই না।
——’তাহলে পথ আটকালে কেন?
——’এমনি।
——’লিসেন, আমার তোমার সাথে বকবক করার টাইম একদম নেই। ঘুম আসছে ঘুমাবো আমি। পথ ছাড়ো।
——’আপনাকে কি বললাম শুনতে পাননি? এক পাও বের হওয়া যাবে না রুম থেকে। যান বিছানায় গিয়ে ঘুমান। আর কোনো কথা নয়।
বলেই সে ড্রেস চেঞ্জ করতে ওয়াশরুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। তার এমন কান্ডে খানিক মুচকি হাসলো নীল।
ওয়াশরুম থেকে বের হয়েই তিহু দেখতে পায় নীল একটা সাইডে সরে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে আছে। সে চট জলদি ওড়নাটা নিজের সঙ্গে ভালো করে পেঁচিয়ে, ধীরে ধীরে বিছানায় উঠে বসে। ঘুমাতে গিয়েও কিছুটা সংকোচ বোধ করে সে। উঠে এক ঝলক নীলের দিকে উঁকি মারে। সে এখনো পাশ ফিরে ঠিক আগের ভঙ্গিমাতেই ঘুমিয়ে আছে। তবুও কাটেনা তিহুর সংকোচ, সে এবার দুই হাতে ভর করে সামান্য উঁচু হয়ে নীলের মুখোমুখি হয়।
ঘুমটা ঠিক কতটা গভীরতা দেখার প্রয়াসে যেই না সে মুখটা বাড়াবে তৎক্ষণাৎ পাশ থেকে একটা উড়ন্ত তেলাপোকা দেখে ভয়ে ভারসাম্য হারিয়ে নীলের মুখের উপর পড়ে সে, তার সূক্ষ্ম নাকটা গিয়ে ঠেকে নীলের তীক্ষ্ণ চোয়ালে। কোনো কিছুর হঠাৎ উপস্থিতিতে তড়িৎ বেগে ঘুম ভেঙ্গে যায় নীলের। দ্রুত পাশ ঘুরতেই, ঘটে অদ্ভুত ঘটনা, তিহুর চিকন অধরে মিলিত হয় নীলের গোলাপি ওষ্ঠ।
দ্বিতীয়বার এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে চোখ বড় বড় হয়ে যায় তিহুর, নীল প্রথমে অবাক হলেও পরবর্তীতে স্বাভাবিক হয়। তবে তখনো একই ভঙ্গিমায় একে অপরের উপর তারা। হুট করে নীলের হাত লেগে নিভে যায় পাশে থাকা টেবিল ল্যাম্পটা। আর অপর হাতের বিচরণ হয় তিহুর পাতলা কোমরে।
মুহূর্ত খানিকের মাঝে তড়িৎ বেগে সেখান থেকে উঠে বসে তিহু, লাজুক ভঙ্গিমায় দ্রুত অপর পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে। নীল শুধু বাঁকা হেসে চেয়ে থাকে তার অমন লাজুকলতা বউটির পানে।
রাতের শেষ ভাগ চলমান, গ্রীষ্ম আগত হলেও নিশির এ শেষ প্রহরে সামান্য শীতলতার আভাস এখনো বিদ্যমান। তার ওপর আবার রুমে চলছে এসি, যার দরুন শীতলতা পূর্ণোদ্যমে বিরাজমান। শীতের তীব্রতায় সামান্য কুঁকড়ে আসলো তিহু। শরীরে জড়ানো ওড়না খানার দৃঢ় বন্ধনে নিজেকে আবদ্ধ করলো। তবুও শীত যেন কমার নামই নিচ্ছে না। ঘুমঘোরে পাশে থাকা ব্যক্তিটিকে জড়িয়ে তার উষ্ণতায় নিজের শীতলতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টায় নিমগ্ন হয় সে।
অপরদিকে সবে এপাশে ঘুরেছিল নীল। তিহুর এমন কাণ্ডে ফের ঘুম ভাঙলো তার। সারারাত এমনিতেই সে ঘুমাতে পারেনি এই নারীর জ্বালাতনে, আর এখন! তিহু ধীরে ধীরে নীলের বোতাম খোলার শার্ট খানার মধ্যে ঢুকে পড়ে, সেভাবে থেকেই শক্ত করে জাপ্টে ধরে নীলকে। নীল বুঝলো না তার এখন করণীয় কি?
মন চাইছে তিহুর যেভাবে তাকে জাপ্টে আছে তার থেকেও দ্বিগুণ শক্ত করে তিহুকে জাপ্টে ধরতে , অপরদিকে মস্তিষ্ক বলছে,,,
প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ২০
‘সে এখন ঘুমে বিভোর, তাই তোমাতে এতটা লিপ্ত হয়েছে, তার না জানার সুযোগে তার বিনা অনুমতিতে তুমি এটা করতে পারো না নীল। তুমি কখনোই সুযোগ সন্ধানী হতে পারো না।
মস্তিষ্কের কথাটা যেন ডাস্টবিনের ছুঁড়ে ফেলল নীল, চুলায় যাক সুযোগ সন্ধানী হওয়া। এটা তার নিজের নারী, একান্ত ব্যক্তিগত। যার সাথে অচিরেই হয়ে গেছে মনের লেনাদেনা। ধর্মীয় দৃষ্টিতেও তারা এখন হালাল, তাহলে সুযোগ সন্ধানী কথাটা কোথা থেকে আসছে? সে নিজের সর্বশক্তিকে জাপ্টে ধরল তিহুকে। নিজের ওষ্টাধর ঠেকালো তিহুর প্রশস্ত ললাটে।
