প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ২২
নওরিন কবির তিশা
তপ্ত রৌদ্র কিরণে আবৃত গোটা ধরণী। মৃদু-মিঠে সেই রোদ্দুরের উষ্ণ পরশে তন্দ্রাচ্ছন্নতা লোপ পেলো তিহুর। পিটপিট করে বন্ধ আঁখি জোড়া মেলতেই আঁধার দৃশ্যমান হলো। খোলা নেত্রেও অন্ধকার অনুভূত হতেই বিদ্যুৎ গতিতে মস্তিষ্ক সজাগ হলো তার। কোমরে কোনো শক্তপোক্ত পৌরুষিক স্পর্শ টের পাবার সঙ্গে নাঁসাপুটে ভেসে এলো দামি জেন্টস পারফিউমের তীব্র সুবাস।হচকিত চঞ্চল নয়নজোড়ার চঞ্চলতা দ্বিগুন হলো।
নিজের অবস্থান টের পাবা মাত্র নিজেকে ছাড়ানোর প্রয়াসে খাঁচায় বদ্ধ পক্ষীর ন্যায় ছটফটালো। অবশেষে দীর্ঘ এক প্রচেষ্টা শেষে নিজেকে ছাড়াতে সফল হলো সে।তড়িৎ বেগে উঠে বসল বিছানায়। তবে সরে যেতে নিতেই,ওড়ানায় নীলের শক্ত বাঁধনের টানে ফের একই অবস্থানে ফিরে আসলো সে,ঝুঁকে পড়লো নীলের ঘুমন্ত মুখশ্রীর উপর।
তিহুর চঞ্চল নয়নজোড়া হঠাৎ স্থবির হলো ঘুমন্ত নীলের উপর।দৃষ্টি শীতল হলো। ঘুমন্ত মানবটাকে বড্ড মায়াবী লাগছে তার চোখে। নীলের সুতীক্ষ্ণ ললাটে পতিত কেশগুচ্ছ আরও বেশি আকর্ষণীয় করে তুলছে তাকে। এমনিতেই লোকটা একটু বেশিই সুন্দর তার উপর এখন তিহুর দৃষ্টিতে তাকে বর্ণনাতীত সুদর্শন লাগছে, ঠিক যেন ইংরেজি নোভেলে বর্ণনীত কোনো ডমিনেটিং নায়ক।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তিহুর মনে হলো এযাবৎকালের যত উপন্যাস সে পড়েছে আর যত কাল্পনিক পুরুষকে কল্পনা করেছে ঠিকই তেমনি সুদর্শন এই ঘুমন্ত লোকটা,যেন এনাকেই প্রতিটি চরিত্রে কল্পনা করেছে সে। হঠাৎ তিহুর মনে এক দুষ্টু চাওয়া হাতছানি দিলো। নীলের কপালের উপর পড়ন্ত চুলগুলোকে এলোমেলো করার তীব্র বাসনা জন্মালো হৃদগহীনের কোনো স্থানে।
ইচ্ছাটুকু নষ্ট করলো না সে, দুষ্টু হেসে অবিন্যস্ত হাতে চুলগুলোর উল্টাপাল্টাকরনে ব্যাস্ত হলো। হঠাৎ বাইরের সাউন্ড বক্সে বেঁজে উঠল,,
🎶Na na Karte payar hay mein….
(না না ভালোবাসব না বলতে বলতে আমি)
Kar Gaye Kar Gaye Kar Gaye …..🎶
(ভালোবেসে ফেলেছি,ভালোবেসে ফেলেছি, ভালোবেসে ফেলেছি)
হঠাৎ এমন শব্দের ঝংকারে ধ্যান ভাঙল তিহুর। বুঝলো এতক্ষণ কি করছিলো সে। সঙ্গে সঙ্গে চোয়াল ঝুলে আসলো তার। লাজুক হলো দৃষ্টি।ইস!যদি এসময় নীলের ঘুমটা ভেঙে যেতো,কি লজ্জাতেই না পড়তে হতো তিহুকে।সেও যে কি করে না!মানে যা তা;ধুর। লাজুকতা মিশ্রিত সেই মিষ্টি বিরক্তির আভাস ছড়িয়ে পড়ল দেহজুড়ে।
চটজলদি সরে গেল নীলের কাছ থেকে। দ্রুত বিছানা থেকে নামবার প্রয়াসে যখনই পা বাড়াতে তক্ষুনি মনে পড়লো তার ওড়না টা নীলের দৃঢ় হস্তবন্ধনে আবদ্ধ। খানিক লাজুক হেসে সেটা দ্রুত ছাড়িয়ে এক প্রকার পলাতক আসামির ন্যায় পালিয়ে গেল সেখান থেকে।
এদিকে তার প্রস্থান টের পাবা মাত্র চোখ মেলল নীল। নিদ্রা তার ছুটি পেয়েছে বহু পূর্বেই। মূলত এতক্ষণ ঘুমের মিথ্যা অভিনয়ে তিহুর কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করছিলো সে।তার এমন কল্পনাতীত কান্ডে প্রচন্ড রকম বিস্মিত হয়ে স্থির হয়ে যায় নীল।তবে কি তার অনূভুতি শূন্য হৃদয়ে দোলাদানকারীনি নিজেও তার প্রনয় স্রোতে অবগাহন করতে চলছে?নাকি ইতিমধ্যেই স্রোতস্বিনীর তীব্র ঢেউয়ে গন্তব্য হারিয়েছে!
বেলা হয়েছে বেশ।আজ হলুদ হওয়ায় বাগানে রাখা সাউন্ড সিস্টেমটা সামান্য ঝালিয়ে নিতে একবার গান চালিয়েছিলো নিহিত আর জুনাইদ মিলে ।তবে শব্দ তুমুল হওয়ায় দ্রুত হাতে সে অফ করল সামির।পাশেই ফাহাদ কান চেপে দাঁড়িয়ে।এমন বিকট শব্দে জুনাইয়া রেগে-মেগে এগিয়ে এসে বলল,,,
—’মাথার স্ক্রুগুলো কি একদম ঢিলে হয়ে গেছে?কা’না’র দল!দাদিজান যদি শুনতে পায় না এতো জোর গানের শব্দ তাহলে কি হবে ভেবেছিস?
পাশ থেকে রাফা বলল,,—’বেশি কিছু না।একটার উপর আরেকটাকে তুলে আছাড় মারবে আর বরাবরের মতো গান বাজানোর শখ ঘুচিয়ে দেবে।
রাফার কথায় নিহিত বলল,,—’তুই সর এখন থেকে।নইলে এক গাট্টা খাবি নিজের এমন বেশি কথার জন্য।
তার কথায় রাফা মুখ বাঁকিয়ে বলল,,—’উমম!আইছেরে আমার উনি না তিনি। তুমি মারলে কি আমি চুপ করে থাকব নাকি?এবার একদম নানুর কাছে বিচার দিব।তখন বুঝো ঠেলা!
তার জবাবে নিহিত কিছু বলার আগেই রাফা জুনাইয়াকে বলল,,——’জুনুপু চলো তো আমায় শাড়ি পরিয়ে দিবে।
—’হুম চল।
—’সারাদিন কি যে এতো পড়িস নীর! আমি তো প্রতিদিন সন্ধ্যায় আম্মুর বকা শুনে কোনোমতে একটু বসি,নমনম করে রাত নয়টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ি ।বাকি সব পড়শোনা পরিক্ষার আগের দিন রাতে সারি।আর তুই?পড়তে পড়তে তো চোখদুটো অলরেডি খেয়েছিস, এখন থেকেই ঐ বুড়ি মানুষের মতো চশমা পরা লাগে।
ফারিসার এমন কথায় একঝলক তার দিকে তাকালো নীরা।দুজন সমবয়সী, একই শ্রেণীর শিক্ষার্থী হলেও তাদের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য বিদ্যমান।নীরা সারাদিন পড়াশোনায় ব্যাস্ত অচঞ্চল কিশোরী হলেও ফারিসা অত্যন্ত ডানপিটে স্বভাবের।নীরা চশমাটা ঠিক করতে করতে বলল,,
—’আমার তেমন কোনো গেমস পছন্দ না ফারু।আর তাছাড়া পড়াশোনা ব্যাতিত সারাদিন আমি করবো টা কি?
—’তাই বলে সারাটা দিন?
—’হুম।
—’তুই কি জানিস?ইউ আর টু মাচ অ্যান্টিসোশাল?
—’জানি।
ফারিসা মুখ বাঁকালো,,—’ধুর, তোর সাথে কথা বলে মনে হচ্ছে কোনো বুড়ি দাদির সাথে কথা বলছি।সো বোরিং।
প্রত্যুত্তরে নীরা কিছু বলল না। দুটি মিলে যাচ্ছে বাগানের দিকে। প্রথমে নীরা আর তার পিছু পিছু ফারিসা।প্রধান দরজায় পৌঁছাতেই কোত্থেকে তুফানের ন্যায় আগমন ঘটলো রিশাদের। ঝড়ো হাওয়ার গতিতে পাশ কাটিয়ে যেতে গেলেই বাঁধলো নীরার সঙ্গে।তার বেগের তোপে নীরা পরে যেতে নিতেই তার হাতটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরল রিশাদ।নীরা চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে রেখেছে তখনও।
এখনো ভূপতিত না হয়ে বরং হাতে কারো শক্ত বাঁধন অনুভূত হতেই নিজের অবস্থান দেখবার উদ্দেশ্যে পিটপিট করে চোখ মেলল নীরা।সে চোখ মেলতেই রিশাদ কিছু বলতে যাবে তার আগেই নীরা নিজেকে ছাড়িয়ে বলল,,
—’স্যরি।
স্যরি? কিন্তু সে কেন স্যরি বলছে।স্যরি তো বলবে রিশাদ।যদিও স্যরি বলাটা তার ধাঁচে নেই, তবুও দোষটা তো তার।সে বিস্মিত-হতবাক দৃষ্টিতে তাকালো।তবে নীরা কিছু না বললেও পেছন থেকে ফারিসা একপ্রকার তেড়ে এসে বলল,,
—’ঐ কানা,তুই স্যরি বলছিস কেন?স্যরি তো বলবে ওই লোক।
অন্যসময় হলে ফারিসার এমন কথার জবাবে হয়তো তার চোয়ালে রিশাদের জোর হাতের ঠাঁটানো একটা থাপ্পর জুটতো।মেয়ে মানুষ এমন লাফাবে কেন?যতই রিশাদ দোষ করুক না কেন।তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে স্থির রিশাদ। কিছুটা বিস্মিত দৃষ্টি জোড়া নীরাতে নিবদ্ধ। জড়তা কাটিয়ে সে বলল,,
—’হুম,স্যরি তো আমার বলার কথা।
তার কথায় সামান্য অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল নীরা।
—’না,মানে আমার চোখে একটু প্রবলেম আছে তো এজন্য হয়তো আমি আপনাকে দেখতে পাই নি।নয়তো আপনি কেন আমাকে ধাক্কা দিবেন বলুন?
তার এমন অতিরিক্ত ভালোমানুষীতে মেজাজ খারাপ হলো ফারিসার। মনে মনে তাকে হাজারটা গালাগাল দিয়ে ধুপধাপ পায়ে সেখান থেকে প্রস্থান করল সে। ফারিসা চলে যেতেই রিশাদ বলল„
—’নরম হওয়া ভালো তবে অতিরিক্ত নয়।সময়ানুসারে গরমও হতে হয়।নয়তো মানুষ লাই পেয়ে যায়।তাই আমি স্যরি,এখানে দোষটা আমার ছিলো।আমিই দ্রুত যেতে গিয়ে তোমাকে নোটিশ করিনি।
বলেই সেখান থেকে চলে যেতে নেয় রিশাদ।নীরা তখনও অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার দিকে।তবে পরক্ষণেই ফিরে এসে রিশাদ ফের বলল,,
—’চশমা পড়ো বলে এই নয় যে সর্বদা দোষটা তোমার।সেটা অপরপক্ষের গুরুত্বের অভাবেও হতে পারে। যেমনটা আমার ক্ষেত্রে হয়েছে।তাই সবসময় অন্যের কাছে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করতে নেই। আন্ডারস্ট্যান্ড?
নীরা ধীরে ধীরে সম্মতি সূচক মাথা নাড়ালো।তা দেখে রিশাদ মুচকি হেসে বলল„—’গুড গার্ল।
বলেই সেখান থেকে প্রস্থান করল রিশাদ।নীরা তখনও মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার যাওয়ার ফলে উন্মোচিত দরজাটার দিকে।
সৌভিকের হলুদের আয়োজন করা হয়েছে বাগানের সবচেয়ে বড় বকুল গাছটার নিচে,এক বিশাল আসন তৈরি করে। সেখানেই উপস্থিত বাড়ির সকল নবীন-প্রবীণ প্রাণ। তবে প্রবীনেরা একে একে প্রস্থান শুরু করেছে। তাদের হলুদ পর্ব প্রায় শেষ, এখন শুধুমাত্র নবীনদের আনন্দ উল্লাস পর্বের সূচনা হতে চলেছে। উপস্থিত সকলের পরনে আজ হলুদ শাড়ি।
তিহু সবে একটা বাসন্তী পেড়ে হলুদ শাড়ি পড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। শাড়িটা তাকে পরিয়েছে জুনাইয়া, এক প্রকার জোর জবরদস্তি করে। শুধু শাড়ি পরিয়েই ক্ষান্ত হয়নি সে। তার দীর্ঘ লম্বা কেশরাজিতে করেছে বিভিন্ন কারসাজি। ফ্রেন্স বিনুনীর শক্ত বন্ধনে আবদ্ধ করেছে সেগুলোকে। সামনের বেবি হেয়ারগুলো সামান্য কার্ল। নাকের নোলক আর কানে দুল দিয়ে পরিপূর্ণ বাঙালি বধু সাজানো হয়েছে তাকে।
তিহুকে দেখে মুগ্ধ নয়নে তাকালো সকলে। এমনিতেই মেয়েটা বর্ণনাতীত সুন্দরী আবার এখন এমন সাজুগুজু করেছে। সকলের দৃষ্টি যেন তিহুতেই নিবদ্ধ। নুরজাহান বেগম তার তর্জনীতে আলতো কামড় দিয়ে বললেন,,,
—’মাশাআল্লাহ নজর না লাগুক আমার পরীটার।
তার এমন কথায় পাশ থেকে জুনাইয়া বলল,,—’ক্রেডিট কিন্তু সব আমার! ওকে আমি সাজিয়েছি। অহন টাকা দাও বুড়ি, তোমার নাতবউ রে সাজাইছি।
—’অনুষ্ঠান শেষে রুমে আসিস, তখন দিয়ে দিব।
—’উহু, আজ নগদ কাল ধার।
—’আচ্ছা চল তাহলে,এখনই দিচ্ছি।
—’হুম চলো।
জুনাইয়া নুরজাহান বেগমের পিছু পিছু যেতে গিয়ে ফিরে এসে আবার তিহুকে বলে গেল,,—’তুমি ওই বকুল তলার দিকে যেতে লাগ, ওখানে নাহারা আছে। আমি দুই মিনিটে আসছি।
বলেই চলে গেল সে, তিহু গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেল বকুলতলার দিকে।
সৌভিকের মঞ্চের পাশে উপস্থিত তার সব কাজিনেরা। সকলে একে অপরকে হলুদ লাগাতে ব্যস্ত। আর সৌভিক ব্যস্ত ভিডিও কলে নিজের প্রণয়নীর সাথে কথা বলতে। ব্যাপারটা বেশ লাগলো তিহুর। সৌভিক কিভাবে এত হইহুল্লোড়ের মাঝেও শুধুমাত্র নিজের প্রণয়নীর জন্য সময়কে বরাদ্দ রেখেছে।
তিহুর কাজল কালো আঁখিদ্বয়ের চঞ্চল দৃষ্টি কাঙ্খিত পুরুষটি কে দেখতে তৎপর। চারিদিকে খুঁজে ফিরছে তাকে। কিন্তু কোথায় সে? বেশ কিছুক্ষণের খোঁজাখুঁজি শেষে তিহু দেখতে পায়, লোকটা গার্ডেন এরিয়া থেকে বেশ কিছুটা দূরে, ফোনে কথা বলছে। পরনে হলুদ রঙা পাঞ্জাবি,ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে ইচ্ছামতো ঝাড়ছে কাউকে।তিহু মুখ বাঁকিয়ে মনে মনে বলল,,
—’এই লোক নিজেকে মনে করে টা কি? যখনই দেখি তখনই কাউকে না কাউকে ঝাড়তে থাকে!
মুখ বিকৃত করে নীলের দিকে তাকালো সে। তবে এবার কেন যেন দৃষ্টি সরাতে ইচ্ছা করলো না, লোকটাকে পাঞ্জাবীতে বেশ লাগছে। যদিও নীল প্রায়শই পাঞ্জাবি পড়ে তবে আজকে, একটু অন্যরকম লাগছে তাকে। কারনটা তিহুর অজানা। হুট করে মানবটাকে অদ্ভুত রকম ভালো লাগছে। তার দিকে তাকিয়ে থাকলেও ভালো লাগা কাজ করছে।
তিহু তো এমন নয়, কোনো পুরুষের দিকে তাকিয়ে থাকা তার স্বভাবের বাইরে। তবে ইদানিং কিছু একটা হয়েছে তার, যখন তখন এই নির্লজ্জ দৃষ্টি নীলের দিকে আটকে যায়। সে যখন আনমনে নিজের প্রশ্নের উত্তর গুলো খুঁজতে ব্যস্ত, তখনই টের পায় কাঁধে কারো আলতো স্পর্শ। পাশ ফিরে মানবীটির অবস্থান জানার প্রয়াসে। তখনই ভেসে আসে মাহার কণ্ঠস্বর,,
—’কিরে, বিয়েত্তা মহিলা।অমনি কি দেখিস?
পরপর তার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো মাহা। নীলকে দেখে ঠোঁট উঁচিয়ে বলল,,—’তাইতো বলি। মধু থাকলে তো মৌমাছি ভোঁ ভোঁ করবেই আশেপাশে। বইন অমনে দেখিস না আমি আবার সিঙ্গেল মানুষ তো কষ্ট হয়।
তার কথায় রেগে গিয়ে তিহু বললো,,—’ক্লাস নাইনের তে প্রেম মারাও আর অহন কও সিংগেল?
—’ছ্যাঃ মুখের ভাষার এ কি অবস্থা!
—’এটা আমার স্পেশালিটি। বাদ দে চল, হলুদের ওখানে যাই।
একে অপরকে হলুদ মাখাতে ব্যস্ত সবাই, তিহু কেও হলুদ মাখিয়ে ভূত বানিয়েছে তার ননদিনীরা। সেও মাখিয়েছে সবাইকে। তবে এতকিছুর মাঝে ও তার চঞ্চল চোখ দুটো বারবার নীলের দিকে চলে যাচ্ছে। নীল বর্তমানে সৌভিকের পাশে দাঁড়িয়ে, বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করছে ভাইয়েরা মিলে। রাওফিন ও সেখানেই। তিহুকে এমন বারংবার তাকাতে দেখে মাহা বলল,,
—’এমনি দেখার কিছু নেই রে বইন। তোর বরকে কেউ তুলে নিয়ে যাচ্ছে না। অন্তত আমাদের দিকে মনোযোগ টা দে এখন, বরকে তো অনেক দেখলি।
পাশ থেকে জুনাইয়া বলল,,—’সদ্য সদ্য বিয়ে হয়েছে, বোঝো না? দ্যাট ইজ কল্ড লাভ ডিয়ার। দেখনি, নীলও কেমন অগোচরে তাকাচ্ছে ওর দিকে।
—’তাকাচ্ছে নাকি আপু?
মাহার কথায় তার দিকে তাকালো তিহু। জুনাইয়া বলল,,—’হুম। যতবার আমাদের তিহু মহারানী তাকাচ্ছে, তার থেকেও বেশি। কিন্তু তিহুর দৃষ্টি ফেরালে আড়ালে-অগোচরে।
—’আহাহাহা ভালুপাশা। সয়না সয়না, আমার মত সিঙ্গেলদের এ যন্ত্রণা আর সয়না।
মাহা কথাটা বলতে বলতে খেয়ালই করেনি কখন রাওফিন এসে তার পাশে দাঁড়িয়েছে।তিহু রাওফিনকে দেখে সামান্য চাপা হাসলো। জুনাইয়া বাচ্চার ফিডিং করাতে দ্রুত প্রস্থান করলো সেখান থেকে। তিহুও সরে গেলো আলগোছে। তারা চলে যেতেই রাওফিন পিছন থেকে মাহার কানে একগুচ্ছ চুল গুঁজে দিয়ে, সামান্য ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলল,,,
—’তুমি চাইলে আমরা দুজন এখনই সিঙ্গেল থেকে মিঙ্গেল হতে পারি লাভলাইন। আর ইউ ওয়ান্ট দ্যাট?
রাওফিনের ফিসফিস কন্ঠে, দেহে অজ্ঞাত শিহরণ জাগলো মাহার। রন্ধে রন্ধে দিয়ে শুরু হলো এক নামহীন দাঙ্গা। পরক্ষণেই সেগুলোকে বিদায় করতে সামান্য মাথা ঝাঁকুনি দিল মাহা। কণ্ঠ শক্ত করে বলল,,,
—’এই মাহা সারা জীবন সিঙ্গেল থাকুক, তবুও তোমার মত জীবনসঙ্গিনী তার জীবনে না আসুক। কক্ষনো না আসুক।
বলেই ধুপধাপ পায়ে সে সেখান থেকে প্রস্থান করতে যেতেই পিছন থেকে তার হাত আঁকড়ে ধরল রাওফিন, টেনে আনলো কাছাকাছি ।যার দরুন মাহার পিঠ ঠেকল তার প্রশস্ত বুকে, গভীর কন্ঠে রাওফিন বলল,,
—’ভালো যখন বেসেছি, তখন এই নির্লজ্জ-বেহায়া পুরুষের সঙ্গেই সারা জীবন পার করতে হবে তোমাকে। শুধুই ইহকালে নয়, পরপারেও তোমার শান্তি নেই। কেননা যে যাকে ভালবাসে তার সাথেই তার হাশর। অ্যান্ড আই ইন্সেনলি লাভ ইউ মাই লাভ।
রাফা হলুদ হাতে নাহা’র পিছু পিছু ছুটছে। উদ্দেশ্য তাকে হলুদ মাখানো।নাহা হলুদ মাখিয়ে সম্পূর্ণ ভূত বানিয়ে দিয়েছে তাকে,শোধ নিতে তাই রাফাও ছুটছে নাহা’র পিছু পিছু। দিগ্বিদিক হারিয়ে নাহা চটজলদি দুই তলার কর্নারের একটা রুমে গিয়ে ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দিল। ঘটনার আকস্মিকতায় ভেতরে কেউ উপস্থিত কিনা দেখতেও ভুলে গেল সে।
এদিকে হঠাৎ রুমে কারো উপস্থিতিতে ভ্রু কুঁচকে তাকালো আইয়াজ। মানবীটিকে দেখার প্রয়াসে পিছন ঘুরে তাকালো। নাহা তখন দরজা লাগাতে তৎপর।দু-পায়ের বৃদ্ধ আঙুলে ভর করে ছিটকেনি লাগিয়ে তবে পিছন ঘুরলো সে। আইয়াজকে দেখে ভুত দেখার মত চমকে উঠলো নাহা। আইয়াজেরও একই অবস্থা। দুজনে একত্রে ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো,,
—’আ-আপনি?
—’ত-তুমি?
নাহা খেয়াল করল আইয়াজের দেহ সম্পূর্ণ উন্মুক্ত। সম্ভবত পাঞ্জাবি পড়ার জন্য রেডি হচ্ছিল সে, তাকে এমন অবস্থা দেখে চোখ কোটর থেকে বের হয়ে আসার উপক্রম নাহা’র। নিজের শরীরের অবস্থা টের পাবা মাত্র লজ্জায় পিছন ঘুরলো আইয়াজ। নাহা লজ্জায় সিটিয়ে বলল,,
—’আ-আ’ম স্যরি। আসলে, আসলে এখন আম-আমি খেয়াল করিনি।
বলেই দ্রুত হাতে ছিটকেনি খুলতে গেল সে। তবে পড়লো আরেক ফ্যাসাদে। ছিটকেনি টা বেশ পুরাতন ছিল, কিছুটা মরিচা ধরানো। লাগানো সহজসাধ্য হলেও খোলাটা বেশ কষ্টের। নাহা পরপর কয়েকবারের প্রচেষ্টাতেও ব্যর্থ হলো। আইয়াজ জলদি হাতে পাঞ্জাবিটা পড়ে, এগিয়ে গেল তাকে সাহায্য করতে।
আইয়াজের একবারের প্রচেষ্টাতেই খুলল বদ্ধ দরজা। নাহা তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে যেই না বেরোতে যাবে, তৎক্ষণাৎ পিছন থেকে তার হাতে টেনে ধরল আইয়াজ। মিশালো নিজের বুকের সাথে। তার এমন কান্ডে বিষ্ময় সীমা চূর্ণ করে তাজ্জব বনে গেছে নাহা। দৃষ্টি যেন ফেটে বেরিয়ে আসবে। আইয়াজ তাকে নিয়ে ফের রুমের ভেতর প্রবেশ করল। মুহূর্ত কয়েক পর, ধীরে ধীরে ছেড়ে দিল তাকে।
নাহা কোনো প্রশ্ন করার আগেই আইয়াজ বলল,—’আ’ম স্যরি। আসলে এখান থেকে কয়েকজন বৃদ্ধা যাচ্ছিল। আমাদের একসাথে দেখে নিলে হয়তো কোনো সমস্যা হতে পারতো তাই আর কি।
‘ইটস ওকে’——কোন মতে কথাটা বলে সেখান থেকে এক প্রকার ছুটে পালালো নাহা। লজ্জা-ভালো লাগার মিশেলে এক অদ্ভুত শিহরণ জাগছে দেহ জুড়ে তার। প্যারালাইজড হয়ে যাওয়া পা গুলোকে নিয়ে কোনোমতে পালালো সেখান থেকে। আইয়াজ শুধু অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল তার প্রস্থান পথের দিকে।
এমনিতেই শাড়ি জিনিসটাই বড্ড এলার্জি তিহুর, তার ওপর আজ আবার ভীষণ ভ্যাপসা গরম। সঙ্গে হলুদের চিটপিটানি তো আছেই। সারা শরীর বিড়বিড় করছে এলার্জি নামক অসহ্য যন্ত্রণায়।সবার থেকে বিদায় নিয়ে হাতে থাকা টিস্যুতি দিয়ে হাত মুখ পরিষ্কার করতে করতে বরাদ্দকৃত কক্ষটির দিকে এগিয়ে চলেছে তিহু। উদ্দেশ্য একটা দীর্ঘ শাওয়ার নিয়ে শাড়ীটা বদলে অন্য কিছু পরা।
কক্ষের সামনে এসে কেমন একটা অদ্ভুত অনুভবের মৃদু পবন ছুঁয়ে গেল তিহুকে। দরজাটা সামান্য ভ্যাজানো, যেন আলতোস্পর্শেই খুলে যাবে তা। হলোও সেটা,তিহু জলদি পায়ে এগিয়ে দরজায় হাত রাখতেই খুলে গেল সেটা। তবে রুমের মধ্যেকার দৃশ্যে মেজাজ সপ্তমে চড়লো তিহুর। সেখানে নীলের সাথে উপস্থিত মুন্নিও। মুন্নির হাতে একটা ট্রে আর নীলের এক হাতে ফোন অন্য হাতে পানির গ্লাস। দেখলেই বোঝা যাচ্ছে মুন্নি পানি দিতে এসেছিল তাকে।
তবে সেটা পানি দেওয়া পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকলে কোনো ব্যাপার ছিল না, মুন্নি এটা হাতে রেখেই নির্লজ্জের মত নীলের দিকে তাকিয়ে লাজুক-লাজুক হাসছে। মনে হচ্ছে কোন স্ত্রী তার স্বামীকে তৃপ্তি করে ঠান্ডা পানি খাওয়াচ্ছে। তার ওপর রুমের দরজাটাও প্রায় বদ্ধ অবস্থায় ছিলো।মেজাজ ধরে রাখতে পারল না তিহু। ধুপধাপ পায়ে এগিয়ে গিয়ে তড়িৎ বেগে নীলের হাতে থাকা গ্লাসটা ছো মেরে নিজ হাতে নিলো সে। সর্বশক্তিতে সেটা ছুঁড়ে ফেলল ফ্লোরে।
শ্বেত পাথরের মেঝেতে,শব্দের ঝংকার তুলল কাঁচের গ্লাসটা। ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল একেবারে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল মুন্নি। নীল প্রথমে হচকিত হলেও পরক্ষণেই রেগে গিয়ে বলল,,
—’হটস রাবিশ নুর? আর ইউ ক্রেজি? কি করলে এটা?
তিহু তখনও রাগে ফুঁসছে।
—’কি হলো কোনো কথা বলছো না কেন? আন্সা’মি!
তিহু তখনো জবাব দিল না। এদিকে তার এমন নির্লিপ্ততা দফায় দফায় বাড়িয়ে দিচ্ছে নীলের ক্রোধর মাত্রা। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো সে,তিহু তাকে কিছু না বলে মুন্নির দিকে তাকিয়ে সরাসরি প্রশ্ন ছুঁড়লো,,
—’তুই? তুই এ রুমে কি করছিস?
তার এমন উগ্রতায় খেই হারালো নীল।তিহুর কাঁধ বরাবর নিজের হাত দুটো রেখে শক্ত বন্ধনে আবদ্ধ করলে তাকে। নিজের দিকে ফিরিয়ে,ক্রোধে রঞ্জিত রক্তিম দৃষ্টিতে চেয়ে বললো,,
—’আমার কথা কানে যাচ্ছে না? আন্সা’মি!
তিহুকে সামান্য ঝাঁকুনি দিল সে। তিহুও চেঁচিয়ে বলল,,
—’আপনি রাগ দেখাচ্ছেন কাকে হ্যাঁ? গলা নামিয়ে কথা বলুন আমার সাথে। দোষটা আপনার আমার না। আপনি কি করে পারলেন একটা মেয়ের সাথে রুমের দরজা বন্ধ করে থাকতে?যখন আপনি জানেনই মেয়েটা আপনাকে পছন্দ…..
—’শাট আপপপপপপ!
কথা শেষ হলো না তিহুর, চিৎকার করে উঠল নীল। অবস্থা বেগতিক দেখে দ্রুত রুম থেকে প্রস্থান করল মুন্নি। তবে যাওয়ার আগে এক কুৎসিত শ’য়’তা’নি হাসি হাসলো। যেন নিজের কু’প্রবঞ্চনাকে বাস্তবিক রূপ দিয়ে সার্থক হয়েছে সে। এদিকে নীলের এমন চিৎকারে রাগে-দুঃখে তিহুর চোখ ফেটে গড়িয়ে পড়লো দু ফোঁটা নোনা জল। তবে সেটা দৃষ্টিগত হলো না নীলের। বর্তমানে রাগে সমগ্র শরীর কাঁপছে তার।
—’কি হলো কথা নেই মুখে? জবান বন্ধ হয়ে গেছে? উত্তর দিস না কেন?
রাগে কক্ষনো মাথার ঠিক থাকে না নীলের। বর্তমান অবস্থাটা ও খানিকটা সেরকমই, তার সামনে উপস্থিত রমণী যে তার সহধর্মিনী। সেটা বেমালুম ভুলে গেছে সে। এদিকে তার মুখে তুই-তুকারি শুনে স্তব্ধ হয়ে রইলো তিহু। শক্ত ধাঁচের মেয়ে হলেও, কাছের মানুষের সামান্য আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় সে। তর্কের বদলে দীঘল নেত্রে নামে আষাঢ়ে ভারী বর্ষণ।
এদিকে তাকে এমন স্তব্ধ-স্থবির আর তার কাজল কালো আঁখিতে প্রথমবারের মতো নোনা জল দেখে সামান্য স্থবির হলো নীল। জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে ধাতস্থ করল নিজেকে। ভাবার চেষ্টা করল কিছুক্ষণ আগে ঘটা প্রত্যেকটা ঘটনা। মূলত এই ভ্যাপসা গরমের মাঝে শুষ্ক মরুভূমির ন্যায় শুকিয়ে গিয়েছিল তার ভেতরটা। তৃষ্ণার্ত সে ফুলিকে বলেছিল একটু ঠান্ডা পানির ব্যবস্থা করতে।
অতঃপর রুমে এসে বসার কিছুক্ষণ পর, একটা ট্রেতে ঠান্ডা পানির গ্লাস নিয়ে সেখানে আসে মুন্নি। পিপাসিত নীল তখনও খেয়ালই করেনি আসলে পানি এনেছেটা কে? এতকিছুর মাঝে সে যখন পানিটা খেতে যাবে ঠিক তখনই তার হাত থেকে গ্লাসটা কেড়ে নেয় তিহু। স্বভাবতই মেজাজ বিগড়ে যায় নীলের। যার দরুন….! পরবর্তী কথাগুলো মাথায় আসতেই চোখ মেললো নীল। তিহু তখনো ফুঁপিয়ে চলেছে। তার কাঁধে রাখা শক্ত বন্ধনটা সামান্য শিথিল করল নীল। আলতোস্পর্শে তাকে সান্ত্বনা দিতে অনুশোচনার সুরে বলল,,
—’আ’ম স্যরি নুর আসলে….
ব্যাস!তাকে কথা শেষ করতে দিল না তিহু। ঝটকা মেরে তার হাত দুটো সরিয়ে, নাক টেনে ক্রোধান্বিত কন্ঠে বলল,,
—’আপনি একটা বাজে লোক নেতা সাহেব। খুব,খুব,খুব বাজে লোক! আমি-আমি আর কক্ষনো, কোনোদিন আপনার সাথে কথা বলবো না। না তো আপনার কোনো ব্যাপারে অধিকার ফলাবো। আই প্রমিস, আমি আর কক্ষনো আপনার কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করব না!
শেষ কথাগুলো বলার সময় গলা ভেঙে আসলো তিহুর। যেন আরেকটু হলেই কেঁদে দেবে। তবে তার কথার জবাবের নীল কিছু বলতে যাবে তার আগেই অপর হাতের পৃষ্ঠে চোখ মুছতে মুছতে রুম ছেড়ে ছুটে পালালো তিহু। নীল তার প্রস্থান পথের দিকে অসহায় দৃষ্টি মেলে চেয়ে রইল। পরক্ষণই সামনে থাকা আয়নায় সজোরে ঘুষি দিয়ে চিৎকার করে উঠল।
প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ২১
—’ড্যাম ইটটটটটটট!
কাঁচের ঝন ঝন শব্দে মুখরিত হলো রুমটা। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল আয়নার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাঁচ কণা। নীলের ফর্সা হাত র’ক্তে রঞ্জিত! ফোঁটা ফোঁটা র’ক্ত প্রবাহ তুমুল রূপ নিল। শ্রাবণের অমোঘ বর্ষণের ন্যায় গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে।
