প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ২৫
নওরিন কবির তিশা
মুক্ত ডানায় ভর করে উড়ে চলা পাখির ন্যায় উড়ে চলেছে দিনগুলো, আর তার সঙ্গে অলক্ষ্যে কখন যেন অতিবাহিত হয়ে গেছে কতগুলো অমূল্য ক্ষণ। অতিবাহিত হয়েছে সপ্তাহখানেক। কুহেলিকা-সৌভিক বিবাহের তৃতীয় দিন রীতি অনুযায়ী কুহেলিকার বাড়িতে গিয়েছিল। দুদিন হলো ফিরেছে তারা।
কাল রাতে সবাই মিলে, সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাফলং শহরটাকে ঘুরে দেখবে। বিশেষত সেখানকার পাহাড় আর হ্রদ সামনাসামনি দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাদের। শেষমেষ সৌভিক বলল, সপ্তাহখানেকের একটা ট্যুর নিবে তারা,সিলেটের মধ্যেই। আর যেহেতু তাদের রিসোর্ট এর বিজনেস। আর জাফলং এর গারো পাহাড়ের কাছে, শৈলবাস নামক তাদের একটা বিখ্যাত রিসোর্ট আছে।তাই কাল সেখানেই যাবে তারা।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সকাল থেকেই চলছে সেই তোড়জোড়, নবীন প্রাণ গুলো উঠেছে রাওফিনের ছাদ খোলা জিপটায়। নিহিত,রাফা নীরা আর রিশাদ। বাড়ির গাড়িতে সৌভিক,কুহেলিকা, মুন্নি, ফারিসা,নাহা আর ফাহাদ। নীলের জিপে শুধুমাত্র সে আর তিহু। এদিকে সামির জায়গা না পেয়ে রুদ্রর বাইকে উঠেছে। আইরাত ছোট হওয়ায় জুনাইয়া আর আদিত্য আলাদা বাইকে যাবে।সবার অবস্থান কাঙ্ক্ষিত জিপে হলেও মাহা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। তা দেখে তিহু তার দিকে ফিরে তড়িঘড়ি কণ্ঠে বললো,,
—’কিরে তুই উঠিস না কেন? দ্রুত ওঠ বেলা হয়ে যাচ্ছে তো।
মাহা প্রত্যেকটা গাড়িতে তাকিয়ে বলল,,—’উঠবো কোনটাতে? সবগুলোই তো বুক।
তিহু এক ঝলক প্রত্যেকটা গাড়ির দিকে তাকালো, অতঃপর ড্রাইভিং সিটে বসা রাওফিনের পাশের সিট খালি দেখে মৃদু হেসে বলল,,—’ঐতো ব্রাদারের পাশে একটা সিট খালি। ওখানে গিয়ে বস।
মাহা সামান্য অপ্রস্তুত হলো তিহুর কথায়,,—‘না থাক আমি বরং যাব না।
তার কথার তীব্র বিরোধিতা জানালো প্রত্যেকে। রাফা বলল,,—’কেন মাহাপু? বউমনি তো বলছে আর এমনিতেও বড় ভাইয়ার পাশে তো সিট খালিই আছে তুমি এটাতেই বসো না। প্লিজ।।
তার সঙ্গে সায় মিলালো প্রত্যেকে। রাগের দরুন মাহা ভেতর আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত হলেও, বাহিরে প্রকাশ করল না তা। শুধু শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল ঠোঁট চেপে মুচকি মুচকি হাসতে থাকা রাওফিনের পানে। অন্যদিকে তাকে এভাবে তাকিয়ে ভাবে থাকতে দেখেই স্থবির হয়ে পড়ল রাওফিন। সামান্য ঢোক গিললো যার অর্থ ‘আমার কোনো দোষ নেই।’
তবে পরক্ষণে মাহা বাঁকা হেসে বলল,,—’আচ্ছা উঠছি আমি।
সম্পূর্ণ কথাটা রাওফিন এর চোখের দিকে তাকিয়েই বললো মাহা। তাতে ভয় আরো প্রগাঢ় হলো রাওফিনের। মাহা ধীর পায়ে হেলেদুলে জিপে উঠে বসলো।রাওফিনের দিকে তেমনি বাঁকা হেসে বললো,,
—’কি ব্যাপার গাড়ি স্টার্ট দিচ্ছেন না কেন মিস্টার? আ’ম রিয়েলি টু মাচ এক্সাইটেড ফর দিস জার্নি!
রাওফিন ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো।সে খুব ভালো করেই জানে এই মেয়ের মতিগতি, কখন না গাড়ি চলাকালেই লাথি মেরে গাড়ি থেকে ফেলে দেয় তাকে। সিট বেল্টটা শক্ত পোক্ত করে বাঁধল সে। সকলের উদ্দেশ্যে বোকা হেসে বলল,,
—’তাহলে যাওয়া যাক।
সকলে সম্মতি জানালো। সৌভিক কুহেলিকাদের গাড়ি ইতিমধ্যেই রওনা দিয়েছে। পিছন থেকে রাফা বলল,,-—’বোকার মত দাঁত কেলিয়ে না হেসে দ্রুত চলো ভাইয়া। সৌভিক ভাইয়ারা তো আগে চলে গেল।
—’হ্যাঁ হ্যাঁ যাচ্ছি তো।
রাওফিনকে এমন ভয় পেতে দেখে, সকলে অবাক হলেও মুখে চেপে হাসছে তিহু আর রিশাদ। কাল রাতে ই তিহু সবটা বলেছে তাকে। তারপর থেকেই তারা দুজন আঁটঘাট বেঁধে নেমেছে,মাহা আর রাওফিনের মিলের জন্য।
কিছুক্ষণ পর হঠাৎ ছাড়া হলো জিপটি, শব্দ তুলেই সেটি এগিয়ে চলল সম্মুখ পানে। তাদের যাত্রার মুহূর্তের মধ্যেই নীলের জিপটিও শব্দের ঝংকার তুলে এগিয়ে চলল। নীল দক্ষ হাতে ড্রাইভিংয়ে ব্যস্ত থাকলেও, তিহুর সম্পূর্ণ মনোযোগ মোবাইলে। ব্যস্ত হস্তে টাইপিংয়ে নিযুক্ত সে। নীল কেবল লুকিং গ্লাসে তিহুর ব্যস্ততার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে।তিহু চটটজলদি রিশাদকে মেসেজ লিখল,,,
“Son jeep er update kichu khon por por dibi.Ar amar boro ja kichu korle ba bolle brother er Sath dibi,bujli?
শোন জিপের আপডেট কিছুক্ষণ পরপর আমাকে দিবি, আর আমার বড় যা কিছু করলে বা বললে ব্রাদারের সাথ দিবি। বুঝলি?
সঙ্গে সঙ্গে অপরপাশ থেকে রিপ্লাই,,“Don’t worry.I will handle.but maha ar raufin bro er chemistry to jome khir.bedi ekhaneo bro k voy dekhasse ar bro er obissthata na.. !dekhar moto.
“চিন্তা করিস না আমি সামলে নেব। কিন্তু মাহা আর রাওফিন ব্রোর কেমিস্ট্রি তো জমে ক্ষীর। বেডি এখানেও ব্রো ভয় দেখাচ্ছে আর ব্রো এর অবস্থাটা না!দেখার মতো।
“Assa kheyal rakhis ar update janas bye.
“আচ্ছা খেয়াল রাখিস আর আপডেট জানাস বাই।
“ok.
রিশাদের রিপ্লাই দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিহু কি একটা ভেবে জলদি হাতে আবারও টাইপ করলো,,
“o ar ha,Tor to character problem ekdom amar nonod er dike nojor dibi na sala.(ও, আর হ্যাঁ তোর তো আবার ক্যারেক্টারে প্রবলেম। একদম আমার ননদের দিকে নজর দিবি না,শালা)
“first of all I’m not your sala Mrs mohila akter biti.kichudin por Tor nonod er bor hobo tai somman kor. ar amar character er problem.?Tor jijer ki sali j drama dekhis sei nayok er preme poris.ar ha Ami moteo emon na jodio o amar ekdom samne bosese tai oi ektu ar ki…!(প্রথমত আমি তোর শালা নই মিসেস মহিলা আক্তার বেটি। কিছুদিন পর তোর ননদের বর হবো তাই সম্মান কর। আর আমার ক্যারেক্টারে প্রবলেম?তোর নিজের কি শালি? যেই ড্রামা দেখিস ওই ড্রামার নায়কের প্রেমে পড়িস। আর হ্যাঁ আমি মোটেও এমন না। যদিও ও আমার একদম সামনে তাই ওই একটু আর কি…!)
ব্যাস কথাটুকু অসমাপ্ত রেখেই অফলাইন হয়ে গেল রিশাদ। মনে মনে কপাল চাপড়ালো তিহু ।“কুকুরের লেজ ঘি দিয়ে টানলেও সোজা হয় না।
গাড়ির গতি মন্থর। ধীরে ধীরে তা এগিয়ে চলেছে গন্তব্যের দিকে। ভিতরে বসে থাকা কপত-কপতি জোড়া নির্জীব ভঙ্গিমায় বসে আছে। নীল অবশ্য বেশ কয়েকবার সানগ্লাসের আবরণে বদ্ধ চক্ষুদ্বয় দ্বারা লুকিং গ্লাসে আড়ালে-অগোচরে তিহুকে পর্যবেক্ষণ করছে। তবে তিহুর দৃষ্টি রাস্তার দু’ধারের সবুজ পথটারর দিকে স্থির। মাঝে মাঝে মনটা আঁকুপাঁকু করে উঠছে কিছু বলার জন্য। তবে মুহূর্তেই কোনো এক অলীক কল্পনার দরুন স্থির হচ্ছে তা।নতুবা সদা চঞ্চল, তোতাপাখির ন্যায় বকবক করতে থাকা মেয়েটির এমন শান্তরুপ বিরল।
তবে ব্যাপারটা যেন পছন্দ হচ্ছে না নীলের। দক্ষ হাতজোড়া স্টিয়ারিংয়ে রেখেই সে বললো,,,
—’হঠাৎ এমন শান্ত হয়ে যাওয়ার কারণ?
তিহু ভ্রু কুঞ্জন পূর্বক প্রশ্নাত্মক কন্ঠে বলল,,—’তারমানে কি আপনি বলতে চাচ্ছেন যে আমি সবসময় বকবক করি?
—’সাম হাউ লাইক দ্যাট!
—’মানে…! আপনি কি আমাকে বাচাল বলতে চাচ্ছেন?
—’সেটা আবার কখন বললাম?
—’মাত্রই!
নীল নিজের কপাল নিজেই চাপড়ালো যেন। কোথায়এসে চেষ্টা করছে যাতে মেয়েটা একটু কথা বলে, তা না ঝগড়া শুরু করে দিয়েছে! আল্লাহই জানে, ভবিষ্যতে আরো কি কি সহ্য করতে হবে তাকে।
—’কি হলো কথা বলছেন না কেন?
—’বলার জন্য তো তুমি আছোই, আমি শুনছি। তোমার একমাত্র নীরব শ্রোতা হিসাবে।
তিহু কিছুক্ষণ চুপ করল, পরমুহূর্তে কি একটা ভেবে বললো,—’কখনো কারো প্রেমে পড়েছেন?
ব্যাস! সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেলো গাড়িটা। বিস্ফোরিত নয়নে তার দিকে তাকালো নীল। তিহু তারা এমন কান্ডে অপ্রস্তুত কন্ঠে বলল,,
—’গাড়ি থামালেন কেন? আমি তো শুধু এমনি….
তাকে কথা না শেষ করতে না দিয়ে,ফের গাড়ি স্টার্ট করল নীল। বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা বিরাজমান, হঠাৎ তা ঘুচিয়ে তিহু পুনরায় বলল,,
—’না মানে ও যে হয় না, একটু একটু ভালো লাগে। দেখলে বুক ধড়ফড় করে,সাম হাউ ক্রাশ বলা চলে…!
—’শুনেছি মানুষের কুকুর দেখলেও বুক ধড়ফড় করে, তাহলে কি কুকুর তার ক্রাশ?
তিহু নাক সিঁটকায়, সে কি প্রশ্ন করলো আর লোকটা কি উত্তর দিলো।
—’বুঝেছি, আপনি কখনো ক্রাশ-ঠ্রাশ খান নি!(কিছুক্ষণ নীরব থেকে আবার বলল) কিন্তু শুনলাম আপনি নাকি অনেক মেয়ের ক্রাশ,আবার আপনার কোনো ক্রাশ নেই ব্যাপারটা কেমন না?
—’শাট আপ স্টুপিড। সর্বক্ষণ এমন উল্টাপাল্টা কথা বলো কেন?
তিহু মুখ বাঁকিয়ে ফিসফিস করে বলল,,,—’আমার কথা তো সর্বদাই আপনারা স্টুপিড স্টুপিড লাগে! সত্য কথার ভাত নাই!
তিহু কথাগুলো ফিসফিস করে বললেও সেটা যেন শুনতে পেল নীল। তবে কিছু না বলে শুধু নিশ্চুপ ভঙ্গিমায় গাড়ি চালিয়ে চলল সম্মুখ পানে।
এতক্ষণ চারিদিক শান্ত থাকলেও হঠাৎ বায়ুর প্রবল তোপে এলোমেলো হয়ে গেলো নীলের সেট করে রাখা চুলগুলো।তিহু বেশ কয়েকবার সেদিকে তাকিয়ে একটা শুকনো ঢোক গিললো। লোকটিকে মারাত্মক সুদর্শন লাগছে। ঠিক ওই গ্রিক গড নামে খ্যাত হৃতিক রোশনের মতো।তিহুর ইচ্ছা করছে, চুলগুলোকে স্বহস্তে আরো উলটপালট করে দিতে।মনে বাজছে ডলি সায়ন্তনীর বহু পুরাতন গানের কয়েকটা কলি।
🎶 রুক্ষ এলোমেলো চুলগুলোয়…
মনটা চায় যেন হাত বুলোয়…..
দুহাতে আদর করি মুখটাকে…..
হৃদয়ে বেঁধে রাখি সুখটাকে……🎶
শব্দগুলো কখন যে হৃদয়ের মনিকোঠা থেকে মুখে বেরিয়ে এসেছে টেরই পায়নি তিহু। এদিকে তার এমন গানে অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো নীল । তিহু বুঝলো কি বোকামিইটা না করে ফেলেছে সে। চটজলদি নিজের দৃষ্টি দূর পাহাড়ের পানে নিক্ষেপ করল,তার এমন লাজুকতায় তার দিকে ফিরেই মুচকি হাসলো নীল।
গাড়ি চলছে উঁচু-নিচু পথটা দিয়ে,মাঝে মাঝে ঝাঁকুনি দিচ্ছে সেটা। যার দরুন কেঁপে উঠছে ভেতরে বসে থাকা যাত্রীগণ। রাওফিন বারংবার মাহার দিকে তাকালেও , মাহা নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে সম্মুখ পানে তাকিয়ে। রিশাদ ব্যাপারটা খেয়াল করছে আর মজা নিচ্ছে। কথাগুলো জমিয়ে রাখছে, পরবর্তীতে মাহাকে ক্ষেপানো আর তিহুকে বলার জন্য। হঠাৎ করে রাফা বলল,,,
—’ও ভাইয়া তোমার জিপে কি কোনো সাউন্ড সিস্টেম নাই?
—’হ্যাঁ আছেই তো!
—’তাহলে এমন মরার মতো বসে আছো কেন? একটু বাজাও না বোরিং লাগছে। তাই নারে নীর?
সে সামান্য ধাক্কা দিল নীরাকে, তাতেই ধ্যান ভাঙল নীরার। এতক্ষণ লুকোচুরি দৃষ্টিতে রিশাদকে পর্যবেক্ষণ করছিল সে। তবে রিশাদ তার সামনাসামনি বসলেও একটি বারের জন্যেও তাকায়নি তার দিকে, রাফার কথায় অপ্রস্তুত কণ্ঠে সে বলল,,,
—’হ-হ-হ্যাঁ।
তার এমন কথায় সকলে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো তার পানে। সাধারণত এমন প্রশ্ন সে এড়িয়ে চলে অথবা না বলে। কেননা গান-বাজনা তত একটা পছন্দ করে না সে। সারাদিন পড়াশোনাতেই বিভোর থাকে। তবে আজ এমন বিপরীত উত্তরে রাওফিনও পিছন ঘুরলো। সকলের এমন দৃষ্টির মুখে স্থবির হয়ে পড়ল নীরা। সেতো কিছু শুনতে পায়নি, সে প্রশ্ন করার আগেই রাফা বলল,,
—’দেখেছো তো? নীর পর্যন্ত আজকে বোর হয়ে যাচ্ছে।
তার সামনে রিশাদের পাশে বসে থাকা নিহিত বলল,,-—’সঙ্গদোষে লোহা ভাসে, প্রবাদটা আসলেও সত্য। নইলে নীরের মতো কেউ আবার গান পছন্দ করতে পারে?
তাদের থামিয়ে রাওফিন বলল,,—’আচ্ছা আচ্ছা থাম তোরা। ঝগড়া করিস না আমি গান দিচ্ছি। কি বলো মা….
মাহার দিকে ফিরে সম্বিৎ ফেরার ন্যায় সে বলল,,—’ইয়ে মানে,আচ্ছা দিচ্ছি!
বহু কষ্টে সাউন্ড সিস্টেমটায় একটা গান চালালো সে। মৃদুমন্দ শব্দ তুলে বেজে চলেছে গানটা,,,
🎶 চাইনা মেয়ে তুমি অন্য কারো হও….
পাবেনা কেউ তোমাকে তুমি কার নও……
চাইনা মেয়ে তুমি অন্য কারো হও….
পাবেনা কেউ তোমাকে তুমি কার নও……
তুমি তো আমারই…..
জানোনা ওওওওও…
এ হৃদয় তোমারি…..
ওওওওও…….
তোমাকে ছাড়া আমি বুঝিনা কোন কিছু যে আর….
পৃথিবী জেনে যাক…..
তুমি শু-ধু আ-মার…..🎶
গানের তালে তালে দৃষ্টি বিনিময় হচ্ছে প্রত্যেক জোড়া কপত-কপতির। এ যেন শুধু একটা গান নয়, এখানে উপস্থিত প্রত্যেকটা মানবের মনের কথা। কি জানি কি ভেবে, রিশাদ প্রথমবারের মতো নীরার দিকে তাকালো। নীরা আগে থেকেই তাকিয়ে থাকায় সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হলো তাদের। তৎক্ষণাৎ তড়িৎ বেগে দৃষ্টি সরালো নীরা। কারণহীন মুচকি হাসলো রিশাদ। এদিকে নিহিত তো সেই শুরু থেকেই রাফার দিকে তাকিয়ে আছে, আর রাফা গানটার সঙ্গে সঙ্গে লিপসিং করছে।
একে একে গাড়িগুলো এসে থেমেছে পাহাড় আর হ্রদের মাঝে অবস্থিত বিখ্যাত রিসোর্ট শৈলবাসের সম্মুখে। গেট পেরিয়ে একে একে ঢুকছে সেগুলো। বাইকে আসার দরুন রুদ্র আর সামির বহুৎ আগেই এসে পৌঁছেছে, একপ্রকার সকলকে স্বাগতম জানিয়ে ভেতরে প্রবেশে সহায়তা করছে তারা। সকলের প্রবেশের মিনিট দশের পর নীলের জিপটা প্রবেশ করল। তা দেখে রাওফিন সৌভিকের কাঁধে হাত রেখে বলল,,,
—’দেখেছিস ভাই সৌভিক? কি জামানায় এসে পড়লাম রে !আমাদের গুরু গম্ভীর নেতা সাহেবও দেখে বউয়ের পাল্লায় পড়ে বউ পাগল হয়ে গেছে। বউকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবে বলে জিপটাতে আর কাউকে উঠতেও দিলো না। আর তার ভাই হয়েও কিনা আমি এখনো সিঙ্গেল!এ কষ্ট কই রাখবো আমি?
সৌভিক সামিরদের উদ্দেশ্যে বলল,,—’ওই কেউ একটা বদনি দে তো। রাওফিনের কষ্টগুলো একটু সঞ্চয় করি।
রাওফিন নাক সিঁটকে দূরে সরে আসলো।—’শেষ পর্যন্ত কিনা বদনি?
—’তোর জন্য ওটাই বেস্ট তাই ডোন্ট আন্ডারএস্টিমেট শা’লা। উহা একটা পবিত্র পদার্থ।
—’ওয়াক থু। চুপ কর শালা বদের হাড্ডি!
রাওফিনের মলিন মুখশ্রীতে চেয়ে, সকলে শব্দ করে হেসে উঠলো। তবে পূর্ববর্তী কথার প্রেক্ষিতে তক্ষনও গুরু গম্ভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল নীল, মাহা নিশ্চুপ ভঙ্গিমায় পাশ ফিরে দাঁড়িয়ে আছে।তিহু তার কাছে আসার আগে দেখতে পেল মুন্নির ভ্রু কুঞ্জনরত গম্ভীরতায় কালো মুখশ্রী।তিহু ঠোঁট চেপে হাসলো, অতঃপর তাকে পেরিয়ে যেতে যেতে ফিসফিস করে তার কানের ধারে বলল,,,
—’ট্রাস্ট মি, ইউ আর লুকিং লাইক আ মুখ পোড়া হনুমান।
মুন্নি কটমটিয়ে তাকালো তার দিকে।তিহু সেভাবেই উচ্ছ্বাসিত দৃষ্টি আর ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসির রেখা নিয়ে এগিয়ে চলল মাহার দিকে।
মাহার মুখ গোমড়া দেখে, তিহু চাপা হেসে বলল,,—’হোয়াটস আপ বড় জা? আমার ভাসুরের সাথে সময় কেমন কাটলো.?
তার এমন হাসি হাসি মুখখানা যেন সহ্য হলো না মাহার, ভেতরের সমস্ত রাগ-ক্ষোভ উগড়ে দিলো এক লহমায়,-—’বা’ল হইছে। আর একবার শুনবি তো…..!
তার এমন রাগী মুখশ্রীতে কিছুটা ভরকে গেল তিহু। বোকা হেসে বলল,,—’আরে আরে এমন করছিস কেন?
মাহা ফের কটমট করে তাকাতেই দ্রুত দূরে সরে গেল সে।
ঘড়ির কাঁটায় রাত নয়টা চলমান। ক্লান্ততায় খেয়ে দেয়ে নিজদের জন্য বরাদ্দকৃত শয়নকক্ষে অবস্থান করছে সবাই। কাল থেকে শুরু হবে ঘোরাঘুরি। রিসোর্টটা চারতলা বিশিষ্ট। দুতলার মাঝখানের সিঁড়ির বাঁ পাশে,দুদিকে পাঁচটা-পাঁচটা করে মোট দশটা কক্ষ। প্রত্যেকটাই বৃহৎ আকৃতির। কুহেলিকা-সৌভিক, নীল-তিহু আর জুনাইয়া-আদিত্য ব্যতীত বাকি সবার জন্য সিঙ্গেল রুমগুলো রাখা হয়েছিলো ।
তবে তাতে আপত্তি জানিয়ে, বাকিরাও কাপল রুম নিয়েছে। কারণ একটাই সকলে একসঙ্গে থাকা। মেয়েরা সবাই একটা রুমে আর ছেলের অন্য রুমে থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। তবে বিপত্তি বেঁধেছে মুন্নিকে নিয়ে, সে কিছুতেই তাদের সাথে থাকতে রাজি নয়। কারণটা সবার অজ্ঞাত হলেও নাহা ভালো করেই জানে মূলত মাহার কারণেই সে এমনটি করছে। তবুও তাকে না আটকে অন্য রুমে থাকতে দেওয়ার জন্য মেজ মামার কাছে আবেদন করা মাত্র সেটা গ্রহণ করেছে সে।
রাত মোটামুটি ভালোই হয়েছে, সকলে ঘুমিয়ে পড়লেও পুবের দিকে রুমটাতে জাগ্রত এক জোড়া কপোত-কপতি। বিপত্তি যেন আজ ঘটা করে এসেছে তাদের মধ্যে। এমনিতে একই বিছানায় কখনো থাকা হয়নি তাদের, যদিও জাফলংয়ে এসে সেই নিয়মটা কিছুটা ঘুচেছে তবে সম্পূর্ণ নয়। এখনো তাদের মাঝে চীন-ভারত বর্ডারের ন্যায় বিশাল পাশ বালিশের অবস্থান হয়।
তবে আজ সেটাও অনুপস্থিত, ঘুম যেন কিছুতেই আসছে না তাদের। রুমের সমস্ত আলো নেভানো শুধু ডিম লাইটের মৃদু আলোয় দৃশ্যমান চারিপাশ। তিহু বিড়ালছানার ন্যায় ঘাপটি মেরে পড়ে আছে বিছানার এক কোণে, অপরদিকে নীল চুপচাপ শুয়ে থাকলেও নিদ্রারা আজ বিদায় নিয়েছে তার চক্ষু থেকে।
ঘুমানোর পরও হঠাৎ পানির তৃষ্ণায় ঘুম ভেঙেছে মুন্নির। পানি পান করতে পাশ থেকে জগ হাতরে দেখল সেটা সম্পূর্ণ খালি,খানিক বিরক্ত হয়ে দ্রুত উঠে দাঁড়ালো সে। বেরিয়ে পড়ল নাহাদের রুমের উদ্দেশ্যে।
পথিমধ্যেই হঠাৎ কারো সাথে ধাক্কা লাগায় ছিটকে কিছুটা দূরে সরে গেল মুন্নি। বিরক্তি এবার দ্বিগুণ হলো। রেগে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,,—’কানা নাকি? চোখে দেখেন না?
‘আমি কানা নাকি আপ….’——কথাটা শেষ হলো না রুদ্রর। শব্দগুলো যেন মিলিয়ে গেল গলার মধ্যেই, সম্মুখে থাকা সুশ্রী রমণীটিকে দেখে। অপরদিকে তাকে এমন চুপ করে থাকলে দেখে রাগ তরতরিয়ে বেড়ে গেল মুন্নির,,
—’কি হলো আপনি কি বোবা নাকি?
—’তোমাকে দেখার আগে ঠিকই ছিলাম।
ফিসফিস করে কথাটা বললো রুদ্র, যার দরুন মুন্নির কর্ণগত হলো না কথাটা। সে ভ্রু কুঞ্জন করে তাকাতেই, রুদ্র ফের বলল,,
—’স্যরি মিস, অ্যাকচুয়ালি আমি আপনাকে নোটিশ করিনি।
—’কানা হলে দেখবেন কি করে?
‘কইরে রুদ্র দ্রুত আয়। এক কোক আনতে গিয়েই কি মায়ের ভোগে গেলি নাকি?’——রুম থেকে ভেসে আসা সামিরের কন্ঠে সম্বিৎ ফিরল রুদ্রর। চটজলদি রুমের দিকে পা বাড়ানো পূর্বক সে ফের মুন্নি কে বলল,,,
—’আপনার কথার জবাবটা না হয় পরবর্তীতে দিব মিস। আপাতত গুডবাই, এন্ড গুড নাইট।
রুদ্র চলে গেল, মুন্নি এখনো রাগী দৃষ্টি মেলে চেয়ে আছে তার দিকে। ইচ্ছা করছে ছেলেটাকে চিবিয়ে খেতে। মেজাজ বিগড়ে যাওয়ায় নাহাদের রুমের দিকে আর গেল না সে, সোজা এগিয়ে গিয়ে ঠাস করে লাগিয়ে দিল রুমের দরজাটা।
কথায় বলে না ক্লান্তি মানে না হাজার বাঁধা। হলোও তাই, সারাদিনের ক্লান্তি শেষে রাজ্যের ঘুমেরা এসে হানা দিল তিহুর চঞ্চল চোখে। ঘুমাবেনা বলতে বলতে কখন যে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমিয়েছে জানা নেই। তবে নীল জাগ্রতই ছিল।তিহুর বহু বদভ্যাসের মধ্যে সবচেয়ে অন্যতম হচ্ছে ঘুমের ঘোরে উল্টাপাল্টা হয়ে যাওয়া।
প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ২৪ (২)
আজও ব্যতিক্রম হলো না তার। আরো আজ মাঝে নেই চীন-ভারত বর্ডার। ঘুমঘোরের আনমনা তন্দ্রাচ্ছন্নতা থেকে সে হঠাৎই এগিয়ে আসলো নীলের দিকে। নীল তখনো অপর পাশ ফিরে শয়নরত।তিহুর হঠাৎ স্পর্শে পাশ ঘুরলো সে। মুহূর্তেই তার ওষ্টাধর ঠেকলো তিহুর প্রশস্ত ললাটে।উষ্ণ সেই স্পর্শের ঘুমের মধ্যেই সামান্য ঝাকুনি দিলো তিহুর সর্বাঙ্গ।
পরমুহূর্তেই হাত দুটো তুলে দিলো নীলের ওপর। সামান্য অবাক নীল, নিচু হয়ে বক্ষদেশে আগলানো তিহুর পানে চাইলো। হঠাৎ কি ভেবে সে নিজেও শক্তপোক্ত বন্ধনে আবদ্ধ করল তাকে।
