প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ৩
নওরিন কবির তিশা
শীতের রিক্ততার প্রহরের সমাপ্তি অতি সন্নিকটে। পত্রহীন বৃক্ষশাখাগুলিতে বসন্তের প্রথম বার্তা যেন কুঁড়ি হয়ে দেখা দিচ্ছে। গাছের ডালে কোকিলের আনাগোনা,আর অলস মধ্যাহ্নে ভেসে আসা তার চাপা ডাক বসন্তের আগমনের বার্তা বাহক হিসেবে কাজ করছে। বাতাস এখনো উষ্ণ হয়নি,তবু তার মধ্যে এক গোপন ব্যাকুলতা মিশে আছে। আকাশে সোনালি রোদ আর নরম হাওয়ার স্পর্শ, মনে হয় প্রকৃতি যেন রঙিন ওড়না পরে বসন্তের অপেক্ষায় আছে।
সেদিন তিহু আর অফিসারটার কথোপকথন শুনেছিলো তাদেরই অনুষদের কেউ একজন।ব্যাস তারপর থেকেই পুরো আইন অনুষদজুড়ে গুঞ্জন উঠেছে তিহু আর নীলকে নিয়ে। বেশিরভাগ সবাই তো এটা বিশ্বাস করেই বসে আছে যে তিহু সত্যি সত্যিই নীলের বাগদত্তা। তিহু প্রথম দিকে তত একটা গুরুত্ব না দিলেও, এখন বুঝতে পারছে ব্যাপারটা ঠিক কতদূর গড়িয়েছে।
তবে এখন আর সবার ভ্রান্ত ধারণা ভাঙ্গার সুযোগ নেই তার কাছে। ইতিমধ্যেই এমন ভুয়া পরিচয় কাজে লাগিয়ে বেশ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছে সে। সিনিয়রদের রেগিং এর হাত থেকে বাঁচার সঙ্গে সঙ্গে, পাচ্ছে বেশ সম্মানও।আর কি লাগে?তাছাড়া এ কথাতো নীলের জানারও কোনো চান্স নাই । তাই বেশ শান্তিতেই আছে সে।
কাল বাদে পরশু ভার্সিটিতে পহেলা ফাল্গুন উপলক্ষ্যে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছে। আর সেখানকার উদ্বোধনী নৃত্যের দলে রয়েছে তিহু আর মাহা দুজনেই।
ক্লাস শেষে ভার্সিটি ক্যাম্পাসের সবুজ চত্বরে বসে অনুষ্ঠান নিয়েই বিভিন্ন আলোচনা করছে তিহু,মাহা সঙ্গে জনকয়েক তাদের আরো কিছু বান্ধবীরা। ইমা,কায়া, নিদ্রা,রোজাসহ আরো অনেকে। হঠাৎই নিদ্রার ফোন বেজে উঠায় সেখান থেকে উঠে গেল সে। আলোচনার মাঝে হঠাৎ নিদ্রার এমন উঠে যাওয়ায় তিহু বলল,,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
——“আজ কেও নেই বলে!নাইলে আমিও দেখিয়ে দিতাম।”
তার কথা শুনে কায়া বলল,,
——“দেখো আমাদের নেতার বউ বলে কি? সে নাকি সিঙ্গেল!!”
কয়ার এমন কথায় মাহা তিহুর দিকে চেয়ে হেসে মনে মনে বলল,,,“ও যে কি ভন্ড তা তো শুধু আমিই জানি?” ইমা বলল,,
———“তাহলে এটাই সিলেক্টেড তো? যে আমরা লাল পেড়ে বাসন্তী রঙের শাড়ি পরবো।”
তিহু:“না আমি তো ভাবতেছি, সাদা বিধবাদের মতো শাড়ি পড়ে আসবো। পহেলা ফাল্গুনের দিন কেউ রঙিন শাড়ি পরে নাকি?”
তিহুর এমন কথায় হেসে উঠলো উপস্থিত সকলে। তারা মাহার দিকে ফিরে বলল,,
———“মাহুরে! আসলেও তোর ধৈর্য আছে। তিহু যে পরিমাণ ঘাড় ত্যাড়া। আল্লাহ!ওকে এতো দিন কেমনে যে তুই সহ্য করছিস আল্লাহ জানে!”
তিহু:“এতে সহ্য করার কি আছে? তোরা যদি আ’বা’লের মত প্রশ্ন করিস, তাহলে সে দোষ কি আমার? একটু আগেই তো সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম যে লাল পেড়ে বাসন্তী রঙা, শাড়ি পরা হবে তারপরেও কেন ইমা আবার একই প্রশ্ন করছে?”
নিদ্রা ফোনটা ধরতে ধরতে দ্রুত গেইটের সামনে এসে দাঁড়ালো। সেখানে আগে থেকে অপেক্ষমান ছিল ইফাজ। তড়িঘড়ি তাকে আসতে দেখে ইফাজ বলল,,,
———“থাকো কোথায় তুমি? ফোন ধরতে কি বেশি কষ্ট হয়ে যায়? সেই কখন থেকে তোমাকে ফোন দিয়ে চলেছি!”
নিদ্রা দ্রুত এগিয়ে এসে বলল,,,
———“এত রাগ করার কি আছে? বললাম তো সরি! তুমি যখন নীল ভাইয়ের সাথে মিটিং এ থাকো তখন কি আমি কখনো তোমাকে বলেছি কেন ফোন ধরোনি?”
ইফাজ:“এখানে নীল ভাইয়ের কথা আসলো কোত্থেকে?”
নিদ্রা:“কোত্থেকে মানে? তুমি যেমন নীল ভাইয়ের সাথে মিটিংয়ে ব্যস্ত থাকো,আমিও তেমনি তার ওয়াইফের সাথে আইমিন তার ফিওন্সির সাথে ভার্সিটির একটা ইম্পর্টেন্ট বিষয়ে আলোচনা করছিলাম। ”
নিদ্রার এমন কথায় ইফাজ অবাক কণ্ঠে বললো,,,
———“নীল ভাইয়ের ফিওন্সি মানে?”
নিদ্রা:“ফিওন্সি মানে ফিওন্সি! এ মা তুমি জানো না? নীল ভাইয়ের ফিওন্সি তো আমার সাথেই পড়ে। একই ডিপার্টমেন্টে।”
ইফাজ ভ্রু কুঁচকে তাকালো নিদ্রার। যেখানে নীলের সঙ্গে সার্বক্ষণিক ওঠা বসা তার,সেখানে নীলের ফিওন্সির কথা সে জানে না অথচ তার গার্লফ্রেন্ড জানে? কেমনে কি?
ইফাজ:“তোমার মাথা ঠিক আছে তো? ভাইয়ের ফিওন্সি কি করে আসবে? ভাইয়ের সঙ্গে সার্বক্ষণিক থাকি আমি। ওয়ান কাইন্ড অফ ভাইয়ের ডান হাত আমি। সেখানে আমি কিছু জানি না, তুমি জানো?”
নিদ্রা: “আহারে নীল ভাইয়ের ডান হাত রে আমার! ডান হাত না,ছাতার মাথা তুমি! সব কিছু জানো আর এইটা জানো না তিহুকে স্বয়ং এমপি সাহেব নিজে তার পরিচয় গোপন রাখতে বলেছেন।”
ইফাজ এবার সত্যি সত্যি কনফিউশনে পড়ে গেল? তাহলে কি নিদ্রার কথায় সত্যি? তাছাড়া সে তো নীল ভাইয়ের মায়ের কাছে ও শুনেছিল, একদিন হুট করেই তাদের সামনে নীল ভাইয়ের বউকে হাজির করবেন তিনি। তাহলে কি? এটাই সেই মেয়েটা? সে দ্রুত নিদ্রার দিকে ফিরে বলল,,,
———“কোথায় সেই মেয়েটা?”
নিদ্রা তৎক্ষণাৎ ক্যাম্পাসের মধ্যে থাকা একটা মেয়ের দিকে আঙুল তুলে দেখালো । ইফাজ নিদ্রার আঙ্গুল অনুসরণ করে সেদিকে দৃষ্টি মেলতেই দেখতে পেল, অনেকগুলো মেয়ের মাঝখানে বসে আছে একটা মেয়ে, পরনে অফ হোয়াইট কালার পাকিস্তানি ড্রেস, হালকা লালচে চুলগুলো বাঁধনহারা, হালকা বাতাসে বিক্ষিপ্তভাবে উড়ছে তারা।
চুলগুলো মুখের উপর এসে পড়ায় ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছে না মেয়েটির মুখ। তবে ইফাজ যতদূর বুঝলো মেয়েটির সৌন্দর্য নেহাতই কম নয়, যদিও তাকে বেশ ভালো করে দেখা যাচ্ছে না,তবুও লাবণ্যময়ী মেয়েটাকে একবার নিজেদের প্রিয় ভাইয়ের পাশে কল্পনা করলো সে। মাশাআল্লাহ, ভালোই মানিয়েছে তাদের। তবে ইফাজ এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না যে তাদের প্রিয় ভাই তাদেরকে কিছু না জানিয়েই, পাত্রী ঠিক করে রেখেছে!
ভার্সিটির ক্লাসের রিহার্সাল শেষ করে প্রধান সড়কের পাশের ফুটপাত ধরে গল্প করতে করতে যাচ্ছিল তিহু আর মাহা। হঠাৎই পিছন থেকে কেউ একজন তিহুর মাথায় এক গাট্টা বসিয়ে দিল। হঠাৎ এমন আঘাতে মৃদু শব্দ করে পিছনে তাকালো সে। পিছনে উপস্থিত ব্যক্তিটাকে দেখে দাঁতে দাঁত চেপে সে বলল,,
———“তুই?”
তিহুর দৃষ্টি অনুসরণ করে পেছনে তাকালো মাহাও। উপস্থিত ব্যক্তিটাকে দেখে সে অবাক হয়ে বলল,,
———“তুই? কখন আসলি?”
তাদের পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে দুই নিবিড় সখীর আরেক সঙ্গী। ছিপচিপে গড়নের মাঝারি আকৃতির এক তামাটে পুরুষ—রিশাদ আহমেদ। রিশাদ অবশ্য তাদের দুই জনের বেস্ট ফ্রেন্ডই বলা চলে। তারা তিনজনই একসাথে চান্স পেয়েছিল ঢাবিতে। তবে একটা সমস্যার দরুন ঢাকায় আসতে কিছুদিন বিলম্ব হলো রিশাদের। কিন্তু হুট করেই তাকে দেখে অবাক হলো তিহু,মাহা দুজনেই। মাহার জবাবে রিশাদ কিছু বলার আগেই তিহু বলল,,
——“কবে আসলো! সে কথা না হয় পরে শুনব! তার আগে বলতে আমার মাথায় মারলি কেন?”
রিশাদ আবারও তিহুর মাথায় আরেকটা গাট্টা দিয়ে বলল,,
———“বেশ করেছি। আরেকবার শোন আবারো মারবো।”
তিহু তাকে কিছু বলতে যেতেই মাহা বললো,,
———“রাস্তার মাঝখানে কি করছিস তোরা?”
তিহু:“ও আমার মাথায় মারল কেন?”
মাহা:“সেটা না হয় বাসায় গিয়ে শোনা যাবে! আর রিশাদ তুই থাকার ব্যবস্থা করতে পেরেছিস তো?”
রিশাদ:“থাকার ব্যবস্থা করতে পারব না মানে। আমায় চিনিস?আমি যে জায়গায় যাব সেই জায়গার ফ্ল্যাটের লোকজনই আমার জন্য বাসা ছেড়ে দিবে।”
তিহু:“ও লে লে…. আইছে আমার নবাবজাদা।”
তারা তিনজন মিলে এমনই হাজারো বন্ধুত্বসুলভ দুষ্টমীপূর্ণ কথা বলতে বলতে এগিয়ে চলল বাসার দিকে। হঠাৎই রিশাদ তিহুকে বলল,,
———“বান্ধবী!”
তিহু:“বইলা ফেল,কান খোলাই আছে।”
রিশাদ:“শুনলাম তোরা নাকি ঢাকা শহরে এসে গুন্ডামি শুরু করেছিস?”
তিহু:“ওয়ান কাইন্ড অফ!”
রিশাদ:“মাহা নাকি একটার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে?”
তিহু:“আমাদের জায়গায় তুই যদি থাকতিস না, তাইলে ওই জায়গায় বেডা বাঁচতো কি না সন্দেহ!”
রিশাদ:“সেটা ঠিক। কিন্তু তুই আমাকে এটা বল তোর নাকি এলাকার এমপি ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে।”
কথাটা বলেই হেসে দিল রিশাদ। তা দেখে তিহু বললো,,
———“ঐদিন যদি ওই ব্যাডার কথা না বলতাম না, তাহলে এতক্ষণ আর বাইরে থাকতে পারতাম না।সোজা লাল দালানে।”
রিশাদ:“তাই বলে সরাসরি নেতার বউ?”
তিহু:“তোকে এত কথা কে বলল রে?”
রিশাদ মাহার দিকে ফিরে বলল,,
———“আমার বান্ধবী আছে না?”
তিহু:“ও আইসি তাই বল! তা তুই কি তোর বান্ধবীকে ভালো বললি। আমি মারলেও ওই লোকের লেগেছে কি লাগে নি জানিনা, কিন্তু ওই বেডি তো সরাসরি মাথাই ফাটিয়ে দিয়েছে।”
মাহা:“ওই বেডার কপাল ভালো যে ওখানে পুলিশ চলে এসেছিল না হলে ওর যে আরো কি কি ফাঁটাতাম। গড নোজ!”
তিহু:“এই না হলে আমার বেস্টি। চালিয়ে যাও বেবি, আমি তোমার সাথে আছি।”
———“আইয়াজ ভাই!”
ঘড়ির কাঁটায় রাত বারোটা চলমান। শীতের নিস্তব্ধ এক গভীর রজনী।আইয়াজ এহসান এসেছে নীলের কাছে। প্রায়শই রাতে দলীয় সদস্যদের সাথে ছোটখাটো একটা আলোচনা সভা করার অভ্যাস আছে নীলের। আজকেও ঠিক তেমনি, একটা ছোটখাটো মিলনায়তন থাকায় সেখানেই যাচ্ছিল সে। হঠাৎ এই নিস্তব্ধতার মাঝে এক মেয়েলী রিনরিনে কন্ঠে থমকালো তার পদচারনা।
কন্ঠটা তার অতি পরিচিত ঠেকল। চমকে পিছন ফিরল সে। তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে নীল স্কার্ট আর অফ হোয়াইট টপসে আবৃত এক অষ্টাদশী কন্যা। ঝাড়বাতির স্বচ্ছ আলোয় তার সুশ্রী মুখাবয়ব স্পষ্ট। মুহূর্তেই তাকে চিনে ফেলল আইয়াজ-মেয়েটি আর কেউ নয়,তাদের প্রিয় নেতা ওয়াহাজ খান নীলের একমাত্র ছোট বোন। ওয়াসফিয়া খান নাহা। তাকে দেখে আইয়াজ অপ্রস্তুত হেসে বলল,,,
———“কিছু বলবে নাহা?”
নাহা:“হুমমম…”
আইয়াজ:“বলো।”
শব্দগুলো যেন কণ্ঠ দিয়ে বেরই হতে চাচ্ছেনা নাহার, অথচ তার আছে অনেক কিছু বলার। নিজেকে ধাতস্থ করে,শুকনা একটা ঢোক গিলে সে শুধু বলল,,,
———“এত রাতে?”
আইয়াজ সামান্য হেসে বলল,,
———“আসলে, স্যার আসতে বলেছিলেন এজন্য!”
নাহা:“ওহ।”
নাহা কথাটা বলেই চুপ হয়ে গেল।আইয়াজ মুহূর্ত খানেক দাঁড়ালো নাহার আর কিছু বলার অপেক্ষায়, তবে সে নিশ্চুপ। তাই আইয়াজও আর দাঁড়ালো না, সে চলে যেতেই, নাহার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে পা দুটি দিয়ে ফ্লোরে সামান্য আঘাত করে বলল,,
———“তুই কোনদিনই কি,আইয়াজ ভাইয়ের সামনে ঠিকমত কথাটাও বলতে পারবি না? একটু আগেই না কত প্র্যাকটিস করলি আর এখানে এসে সব গুলিয়ে খেয়ে ফেলছিস!শুধু শুধু কি আর, নিহিত ভাই তোকে হাবলি বলে? ঠিকই বলে!”
নিজেকে হাজারটা ভৎসনা দেওয়া শেষে, মুখটা বাংলার পাঁচের মতো করে, রুমের দিকে পা বাড়ালো নাহা।
———“তাহলে কালকেই ফাইনাল? শিওর বল কিন্তু, যদি তোরা শিওর হোস তাহলে আমি কোনো না কোনোভাবে,বম্মাকে রাজি করাতে পারলেই কেল্লা ফতে। বাবাকে নিয়ে আর কোনো সমস্যা হবে না।”
বন্ধুদের সাথে নাইট আউটে ঢাকার বাইরে যাওয়ার জন্য, শীতের এমন রুক্ষ হওয়ার মাঝেও ছাদে দাঁড়িয়ে প্ল্যান করছিলো নিহিত। কেননা রুমে কথা বলাটা অত্যন্ত রিক্সের, যদি কেউ শুনে ফেলে? এমনিতেই এই বাড়ির কারোই নাইট আউট এ যাওয়ার অনুমতি নেই। তার উপর আবার ঢাকার বাইরে। ওরে বাপরে! বাড়ির কর্তা যদি জানতে পারে তাহলে খবর আছে নিহিতের।
হঠাৎই পেছনে কারো উপস্থিতি অনুভূত হয় তার। তৎক্ষণাৎ পিছনে তাকাতেই সে দেখতে পায়, কোমরে দুই হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে,তার জীবনের একমাত্র সমস্যা সৃষ্টিকারী। তার বড় ফুফুর ছোট মেয়ে রাওফিয়া হক ওরফে রাফা।রাফাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে নিহিত। গেল রে গেল,সবটা গেল! যার থেকে বাঁচার জন্য এই শীতের তীব্রতার মাঝেও ছাদে এসে দাঁড়িয়েছে সে, সেই ভুতনিটাই পিছনে তার।
নিহিত দ্রুত কল কেটে, ফোনটা রেলিং এর ওপর রেখেই এগিয়ে যায় তার দিকে। এদিকে রাফা কোমরে হাত বেঁধেই বলে,,
———“আরেব্বাস, নাইট আউট, ওএমজি। এটাতো এক্ষুনি বড় মামুকে না জানাতে পারলে আমার পেটের ভাত হজম হচ্ছে না। ওকে নিহিত ভাই, বেস্ট অফ লাক। আমি এক্ষুনি যাচ্ছি মামুর কাছে।”
কথাটা বলেই সে পা বাড়াতে যেতেই পিছন থেকে তার হাতটা খপ করে ধরে বসে নিহিত।
নিহিত:“ভূতনির বাচ্চা ভূতনি! আজকে তোকে এই ছাদের থেকেই ফেলে দেবো আমি। তখন ওপরে গিয়ে বড় মামুর কাছে নালিশ করিস।”
নিহিতের এমন কথায় কিছুটা ভয় পায় রাফা। ঠোঁট নাড়িয়ে বড় মামুকে ডাকতে যাওয়ার আগেই, নিহিত এক হাতে চেপে ধরে তার কোমল ওষ্টদ্বয়। ভয়ে চোখ বড় বড় হয়ে যায় রাফার। মৃদু গোঙানি দিতে থাকে সে। তা দেখে নিহিত বাঁকা হেসে বলে,,,
———“কি হলো মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না কেন? এমনি সময় তো বকবক করে আমার কানের পোকা গুলো নাড়িয়েই দিস। এখন কথা বেরোচ্ছে না কেন হ্যাঁ?”
ষোড়শী কন্যাটার এবার সত্যি সত্যিই ভয় হতে লাগলো। তার থেকে বয়সে প্রায় পাঁচ বছরের বড় এক ছিপছিপে গড়ণের সুঠাম দেহি পুরুষের সামনে,নিজের ক্ষীণ শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগেও লাভ হলো না যেন।এক চুলও নড়লো না নিহিত। এদিকে রাবার এমন বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টায় তাকে ধাক্কা দেওয়ার ব্যাপারটা বেশ উপভোগ্য ঠেকছে নিহিতের কাছে। ভীত রাফা এবার চোখ দিয়ে অনুনয় করতে লাগলো। এবার বেশ মায়া হল নিহিতের।সে তার মুখটা ছেড়ে দিয়ে বলল,,
———“এইটুকু বয়সে চোখে এত মায়া কোত্থেকে আসে তোর? পিচ্চি কোথাকার! যা আমার সামনে থেকে, আর আমার নাইট আউটের কথা যদি কেউ জানতে পারে না,তাহলে মনে রাখিস ঐ শ্যাওড়া গাছের পেত্নী দিয়ে তোর ঘাড় মটকাবো।।”
নিহিতের থেকে ছাড়া পেয়ে রাফা জোরে একটা নিঃশ্বাস নিল। অতঃপর ফের দুষ্টু হেসে বলল,,
———“কেন,কেন?শ্যাওড়া গাছের পেত্নী দিয়ে কেন? পেত্নী কি তোমার বউ নাকি?”
নিহিত:“দাঁড়া দেখাচ্ছি পেত্নী আমার বউ কিনা!”
কথাটা বলেই সে রাফার পিছু নিতেই রাফা এক ছুটে চিলেকোঠার সিঁড়ি বেঁয়ে নিচের দিকে যেতে যেতে বলল,,
———“নাইট আউটের কথা কাউকে বলি বা না বলি! শ্যাওড়া গাছের পেত্নী যে তোমার বউ এটা সব্বাইকে বলবো।”
রাফা নিচে চলে যেতেই, তার দিকে ফিরে নিহিত মুচকি হেসে বলল,,
———“পাকনি কোথাকার!”
বহুদিন পর সবার অনুরোধে, আজ ঘরের কোনে পড়ে থাকা গিটারটা হাতে নিয়েছে নীল। গিটারের স্ট্রিংয়ে তার সূক্ষ্ম হাতের আঁচড়ে টুংটাং শব্দ হচ্ছে। কি গান গাইবে বুঝতে পারছে না সে। হঠাৎই স্মৃতির পাতায় একটা সুর হানা দিতেই গলা খাঁকারি দিয়ে সে গেয়ে উঠলো,,,
🎶সারারাত ভোর চোখের ভেতর….স্বপ্নে তোমার আনাগোনা…..নেমে আসে ভোর থাকি তবু ঘোর….হাওয়ায় হাওয়ায় জানাশোনা……সারারাত ভোর চোখের ভেতর….স্বপ্নে তোমার আনাগোনা…..নেমে আসে ভোর থাকি তবু ঘোর….হাওয়ায় হাওয়ায় জানাশোনা……🎶
দলের সকলে প্রিয় নেতার কন্ঠে এমন গানে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে আছে। নীল এবার বেশি জোরে গিটার বাজিয়ে গিয়ে উঠলো,,,
🎶 তুমি দেখা দিলে তাই…..মনে জাগে প্রেম প্রেম কল্পনা….আমি তোমার হতে চাই…..এটা মিথ্যে কোন গল্প না….. আমি তোমার হতে চাই…..এটা মিথ্যে কোন গল্প না…..🎶
নীলের কণ্ঠস্বর যেন মিলিয়ে গেল নিস্তব্ধ সেই নিশিথের, হিমেল হাওয়ার মাঝে। আহাদ,ইনান,ফরহাদসহ উপস্থিত সকলে একসাথে বলে উঠলো,,,
———“ওহ ভাই! আপনার যে কন্ঠ না!”
হালকা হাসলো নীল। ঠিক তখনই ইফাজ বলল,,
———“ভাই গানটা কি আমাদের ভাবিকে ডেডিকেট করে গাইলেন?”
তৎক্ষণাৎ কুঁচকে গেল প্রিয় নেতার নীল মনিযুক্ত চোখের ওপরে থাকা কৃষ্ণকালো ভ্রুদ্বয়। তবে সে কিছু বলার আগেই উপস্থিত সকালে অবাক হয়ে বলল,,,
———“ভাবি মানে?”
ইফাজ:“সেটা না হয় ভাইয়ের কাছেই শোন।”
নীল:“আমার কাছে শুনবে মানে? কি উল্টোপাল্টা কথা বলছিস?”
ইফাজ:“ভাই, এখন অন্তত আর মিথ্যে বলিয়েন না। আমি সবটা জানি,এমনিতেই তো আমাদের অজান্তে ভাবিকে পছন্দ করে রাখছেন, তার উপরে কিনা আমার গার্লফ্রেন্ডেরই ডিপার্টমেন্টের। যাই হোক, ভাই আপনার চয়েজ আছে বলতে হবে,ভাবি কিন্তু মাশাল্লাহ!”
নীল:“হোয়াটস রাবিশ! আর ইউ ক্রেজি, এইসব উল্টাপাল্টা কথা কে ঢুকায় তোদের মাথায়?”
ইফাজ:“ভাই, এখনো? আপনি হয়তো জানেন না নিদ্রাও কিন্তু ঢাবিতেই চান্স পেয়েছে আর আইন অনুষদেই। আর এটা শুধু ও নয়, পুরো আইন অনুষদ জুড়ে সবাই জানে। শুধু আমাদেরই আপনি বললেন না?”
নীলের এবার সত্যিই মেজাজ গরম হতে লাগলো। কি সব বলে যাচ্ছে ইফাজ তখন থেকে? তবে নীল কখনোই তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নেয় না। সে খুবই স্থিরধী সম্পন্ন পুরুষ। তবে সে বুঝতে পারছে না, কেন কোনো মেয়ে তাকে নিয়ে এমন অদ্ভুত পরিচয় রটাবে? কিন্তু এখন সবার আগে জানার বিষয় মেয়েটিকে? তাই নীল ইফাজের দিকে ফিরে বলল,,
———“মেয়েটির নাম কি রে?”
ইফাজ সহ উপস্থিত সকলের এবার, সত্যিই দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেল। কেননা সবারই নীলকে খুব ভালো করে চেনা। এমন অসময়ে হাসিঠাট্টা করার মতো পুরুষ একদমই নয় সে। তবে মেয়েটি কি মিথ্যা বলছে?ইফাজ বহু কষ্টে মনে করার চেষ্টা করল নিদ্রা তাকে কি নাম বলেছিল। অবশেষে মনে পড়তেই সে নীলের দিকে চেয়ে বলল,,,
———“ভাই,তিহু বা এই টাইপ কিছু!”
নীল:“কোথায় পড়ে বললি?”
প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ২
ইফাজ:“ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আইন অনুষদের প্রথম বর্ষে।”
নীল বাজ পাখির ন্যায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে বলল,,,
———“ওহ আইসি! তাহলে তো এবার দেখতেই হচ্ছে, কে সেই মহীয়সীনি, যে আমার পরিচয় নিয়ে সবাইকে বোকা বানাচ্ছে!”
