প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ৬ (২)

প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ৬ (২)
নওরিন কবির তিশা

অতিবাহিত হয়েছে কয়েক মুহূর্ত,ঘড়ির কাঁটায় সেটা মিনিট তিরিশেক হবে হয়তো। এরই মাঝে নিস্তব্ধ আঁধার আচ্ছন্ন, জঙ্গলাবৃত সেই কুটির পরিণত হয়েছে, এক পরাজিত সৈনিকের র’ক্তে রাঙা রণক্ষেত্রে। কাজী সাহেব এখনো ভয়ার্ত দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন, কম্পন উঠেছে তার সমগ্র শরীর জুড়ে । সামনে পড়ে থাকা রক্ত রঞ্জিত পুরুষ গুলোর দিকে তাকিয়ে কুটিল হাসলো নীল। অতঃপর তাকালো সামনের কৈ মাছের প্রাণধারী পুরুষটির দিকে।যার কাছ থেকে এখনো ক্ষণে ক্ষণে ভেসে আসছে হালকা শ্বাস-প্রশ্বাসের মৃদু গুঞ্জন।
নীল সে দিক থেকে অতি ঘৃণ্য দৃষ্টিতে চোখ ফেরালো। অতঃপর তাকালো সামনের কম্পনরত রমণীটির পানে।রক্তে যে তার ফোবিয়া আছে সেটা বুঝতে বাকি নেই নীলের। নীল রমণীটির দিক থেকে চোখ সরিয়ে কাজী সাহেবের পানে চেয়ে বলল,,,,

———“আপনি বসে আছেন কেন? আপনার কাজ সারুন। হাতে আমার বেশি সময় নেই। যা যা ফরমালিটিস আছে দ্রুত সম্পন্ন করুন।”
কাজী সাহেব: “কিন্তু বাবা, মেয়ে তো নামও বলছে না আমি কি করতে পারি?”
নীল রমণীটির পানে চেয়ে বলল,,,
———“লিখুন পাত্র ওয়াহাজ খান নীল, পিতা ওয়ালিদ খান, মাতা মির্জা সূচনা আর পাত্রী নূরাইন হক তিহু।”
তিহুর হৃদয়টা যেন ধুক করে উঠলো। তার বিয়ে হচ্ছে? আসলে ও তার বিয়ে হচ্ছে? কিন্তু কার সাথে হচ্ছে, এই লোকটার সাথে? যার নাম যার পরিচয় পত্রের সামান্য অংশ ছাড়া বাকি সবটা অজ্ঞাত তার কাছে। লোকটার বাসা কোথায় সেটা অব্দি জ্ঞান সীমানার বাইরে তার। তিহু তীব্র বেগে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,,,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

———“আমি বিয়ে করবো না।”
নীল যেন তার কথা শুনেও না শোনার ভান করলো। কাজী সাহেব ফের বলে উঠলেন,,,
———“কিন্তু বাবা মেয়ের বাবা-মা অর্থাৎ অভিভাবকদের নাম তো লাগবে।”
নীল বিরক্তিমাখা কণ্ঠে বললো,,,
———“কি বললাম শুনতে পাননি? আমার হাতে এত সময় নেই, আর সবচেয়ে বড় কথা কিছুক্ষণ পর ও ওয়াহাজ খান নীলের সহধর্মিনী হবে, তাই আপাতদৃষ্টিতে অন্য কোনো অভিভাবকের দরকার হবে না।”
কাজী সাহেব আমতা আমতা করে বললেন,,,

———“কিন্তু তাও!”
নীল কিছু বলার আগেই তিহু নিজের সর্বশক্তিতে উঠে দাড়িয়ে বলল,,,
———“মামা বাড়ির মোয়া পেয়েছেন? মশকরা হচ্ছে, বিয়েটা কি পুতুল খেলা? যে আসো বন্ধু,বসে আছি,বিয়ে করে যাও! বিয়ে আমি করবো না মানে করবই না! যা ইচ্ছে করে নিন আপনি!”
নীল এক অন্যরকম ভঙ্গিমায় বলল,,
———“বিয়ে তো হবেই । হয়তো এখান থেকে নবদম্পতি বের হবে, নয়তো…… সে কথা না হয় থাক, প্রথমত তোমাকে বিয়ে করার ইচ্ছা আমার নিজেরও নেই,কিন্তু তুমি পুরো ভার্সিটির সামনে বলে বেড়িয়েছো ইউ আর মাই ফিওন্সী, এই পরিচয়ের কারনেই তুমি কিডন্যাপ হয়েছো। তবে তোমার সাথে যদি মিসেস নীল খান নামক সার নেমটা লাগানো থাকতো না আই সয়ার কেউ তোমার দিকে চোখ তুলে দেখাতে পারতো না।তাই বেশি কথা না বলে যা বলছি তাই করো।”

তিহু;“লাগবে না আমার কোন স্পেশাল সার নেম, আমি অ্যাজ নুরাইন হকই ঝাক্কাস আছি। সো আই ডোন্ট নিড ইউর সার নেম।”
নীল:“কনফিডেন্স ভালো তবে ওভার কনফিডেন্স নয়। আর নীল খান যে কথা একবার মুখ থেকে বের করে সেটাকেই সত্যি করে ছাড়ে। তাই আমার জেদের কারণে হলেও আমি শুধু তোমাকেই বউ বানাবো।
তিহু:“আরে আজব লোক তো, কেন রে ভাই? আপনার জন্য কি দুনিয়াতে মেয়ের আকাল পড়ছে?”
নীল আর কোনো কথা না বলে বাঁকা হাসলো। অতঃপর নিজের হাতে থাকা পিস্তলটা দিয়ে পাশে পড়ে থাকা র’ক্তা’ক্ত পুরুষটার দেখে ফের আরেকবার গুলি ছুঁড়লো, সঙ্গে সঙ্গে র’ক্ত ফের আরেকবার ছিটকে বের হলো। ভীত তিহু ভয়ে চোখমুখ খিঁজে এক নিঃশ্বাসে বলল,,,

———“কবুল,কবুল,কবুল।”
আরেকবার বাঁকা হাসলো নীল ,কাজী সাহেবের দিকে ফিরে সে বলল,,,
———“আমার তরফ থেকেও তিন কবুল।”
সম্পন্ন হলো বিবাহ অনুষ্ঠান। এমন অদ্ভুত বিয়ের সাক্ষী হয়ে মুখ চেপে হাসলো জয়,আদনান,আসিফ আর ইফাজ। পাশে এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে আইয়াজ। সেই তো নীলকে তিহুর খোঁজ দিয়েছিল। তবে এটা তার কল্পনাতীত ছিল যে নীল এখানেই এই বদ্ধ কুঠুরিতে বিয়ে সারবে।
আহাদ আইয়াজের কাঁধে হাত রেখে বলল,,,
———“কি ব্যাপার ভায়আ? তুমি এমন গোবেচারার মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন? বাই দ্যা ওয়ে তুমি তো ভাবির খোঁজ দিয়ে ছিলে না,নীল ভাইকে?”
সামান্য মাথা ঝাঁকালো আইয়াজ। আহাদ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,,,

———“তুমি কোথা থেকে জানতে পারলে, যে জাফরের লোকজনই ভাবিকে কিডন্যাপ করেছে?”
আইয়াজ একবার তাকালো আহাদের দিকে। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে সে বলতে শুরু করল,,,
———“আজ ভাইয়ের একটা ইম্পর্টেন্ট ক্লাইন্ট মিটিং ছিল, সেজন্যই কিছু ফাইল এর প্রয়োজন ছিল যেগুলো ভাই গতরাতে আমার তত্ত্বাবধায়নে রেখেছিল। তবে দুর্ঘটনাক্রমে আমি সেগুলো আনতে ভুলে যাই। মাঝরাস্তা থেকে তাই আমাকে ব্যাক করতে হয়েছিল। আবার ওদিকে মিটিংয়ের টাইমও হয়ে আসছে তাই আমি শর্টকাট দিয়ে অতি দ্রুত গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎই আমার দৃষ্টিগত হয় ভাবিকে। যদিও আমি প্রথমে খেয়াল করিনি, তবে আমার চোখ আটকে যায় জাফরের গাড়ি দেখে।

তাকে আমি বেশ ভালো করেই চিনতাম,যে সে নীল ভাইয়ের একমাত্র প্রতিদ্বন্ধী জেকে গ্রুপস অফ কোম্পানির ওনার জাফর করিম।বেশকিছু বার দেখা হয়েছে তার সাথে আমার, ঘনিষ্ঠতা নেই তবে তাকে দেখেই চিনতে পেরেছিলাম আমি। ভাইয়ের সাথে তার শত্রুতার ব্যাপারটাও আমার বেশ ভালোই জানা। তৎক্ষণাৎ গাড়ির ব্রেক কষলাম আমি, আর ঘটলো সেই অদ্ভুত ঘটনাটি ভাবির মুখে রুমাল রেখে একদল ছেলেটাকে গাড়িতে তুলছিল ।
ব্যাস আমার আর বুঝতে বাকি রইল না, আমি সঙ্গে সঙ্গে ভাইকে ফোন লাগালাম, আর তারপরের ঘটনা তো তোমার জানাই।”

আহাদ আইয়াজের মুখে এত বর্ণনা শুনে তার পিঠে চাপড় দিয়ে বললো,,,,
———“যাই হোক আজ থেকে আমাদের ভাই কিন্তু মিঙ্গেল, আর সেটা তোমারই বদৌলতে, আজ রাতে পার্টি হবে মামু, বাহুতদিন বাদ সো চিল ।”

কুটির থেকে বের হওয়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তেই শরীরটা কেন জানি খারাপ হতে শুরু করল তিহুর। মনে হচ্ছে জ্বর আসবে? মাথাটাও ঘুরছে ভীষণ! কল্পনাতীতভাবে কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে চারিপাশ.। তিহু বুঝল আর বেশিক্ষণ সজ্ঞানে থাকা হবে না তার। কিন্তু এখন জ্ঞান হারালে যে মান সম্মান সবটা চলে যাবে । তবে নিজেকে আর সামলাতে পারছে না তিহু।
চারিদিকে এমন র’ক্তে’র বিচ্ছিরি গন্ধ আর রক্তিম পরিবেশে গা গুলিয়ে উঠছে তার। সামান্য র’ক্তে’ই যার ফোবিয়া আছে, সেখানে এতক্ষণ ধরে এমন র’ক্তে রাঙ্গা পরিবেশে মাঝে থাকার সত্ত্বেও যে সে এখনও সজ্ঞানে আছে এটাই তো শুকরিয়া। ব্যাস আর এক মুহূর্ত, চেতনা হারিয়ে তিহু হেলে পড়ল নীলের প্রশস্ত বক্ষ দেশে। অন্যদিকে তিহুকে এমন চেতনাহীন অবস্থায় দেখে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল নীল। তার সুশ্রী মুখশ্রীতে হালকা চাপড় দিয়ে বলল,,,

———“নুরাইন? এই নুরাইন? শুনতে পাচ্ছো আমার কথা? নুর?”
অপর পাশ থেকে কোন আওয়াজ না আসায় নীল তার মুখ থেকে হাত সরিয়ে বলল,,
———“Damn it, she has lost consciousness!”
নীল কোলে তুলে নিলো তিহুকে। অতঃপর পা বাড়ালো কুটিরের বাইরে নিজের গাড়ির দিকে।

সন্ধ্যার পর থেকেই মাহা একের পর এক কল দিয়েই চলেছে,তিহুর প্রত্যেকটা নাম্বারে। লোকাল নাম্বার থেকে শুরু করে হোয়াটসঅ্যাপ,ইমো,মেসেঞ্জার এমন কোথাও বাদ নেই যেখানে সে ট্রাই করেনি। কিন্তু কোনো রকম সাড়া নেই অপর পাশ থেকে। সবকিছুই সুইচ অফ বলছে। চোখে মুখে দুশ্চিন্তার রেখা স্পষ্ট মাহার। এই মেয়েটা কি তাকে একদন্ডও শান্তি দেবে না ?
আবারও নিশ্চয়ই ফোনে চার্জ দিতে ভুলে গেছে। ফোন অফ হয়ে পড়ে আছে আর তার খেয়াল নেই। মানে এই মেয়েটাকে নিয়ে হয়েছে যত জ্বালা মাহা।শেষমেষ না পেরে রিশাদের ফোনে কল লাগালো সে। দুইবার রিং হওয়ার পর থেকে ওই পাশ থেকে ফিরে আসলো এক গভীর পৌরুষ কন্ঠস্বর,,,

———“হ্যালো।”
মাহা রাগান্বিত তবে চিন্তিত কন্ঠে বলল,,,
———“হ্যালো মাই ফুট, তিহু কই রে? কোন চুলায় গিয়ে মরছে ? ক’ব’র কি দিয়েছিস নাকি আমার আসা লাগবে?”
সারাদিনের ক্লান্তি শেষে সবে বিছানায় শরীরটা এগিয়ে দিয়েছিল রিশাদ মাহার এমন কথায়,, এক ঝটকায় শোয়া থেকে উঠে বলল,,
———“কি হয়েছে বান্ধবী? এতো ক্ষেপলি ক্যা?”
মাহা:“ক্ষেপপো না তো কি মধু ঝরাবো?আর সেই শা-ক-চু-ন্নী-টা কই রে? কোন মা-ম-দো-র সাথে ভাগছে?”
রিশাদ:“মানে?”

মাহা:“কারন দুনিয়ার কারো সঙ্গে তো ও ভাগতে পারবে না। সে ক্ষমতা আল্লাহ ওরে দেয় নাই, তাহলে কোনো ভূতের সঙ্গেই নিশ্চয়ই ভেগেছে, দেখ কোন শেওড়া গাছে ঝুলছে। আল্লাহর ওয়াস্তে ভাই ওর কাছে একটু যা গিয়ে বল আমার ফোনটা একটু তুলতে,টেনশনে টেনশনে আমার অবস্থা খারাপ।”
রিশাদ:“কেন?তিহু তোর ফোনও ধরছে না?”
মাহা:“আমার ফোনও মানে? তোর কথা হয়নি ওর সাথে?”
রিশাদ:“না!! আমি তো ভাবলাম ও মেইবি তোর সাথে গিয়েছে । না মানে আমি আজকে ভার্সিটিতে যেতে পারিনি সবুজের বার্থডে ছিলতো এজন্যই । তাই ফিরে ভাবলাম,, ওর কাছ থেকে নোট নিব কিন্তু ও তো এমনিতেই কখনো মেসেজ সিন করে না, তাই শুধুমাত্র ওর জন্য আজকে ফ্ল্যাক্সিলোড দিয়েছিলাম।শা’লি’র মাইয়া ফোনটাও অফ কইরা রাখছে । ৩০টা টাকারই জলাঞ্জলি। এই ৩০ টাকা যদি আমি ওর কাছ থেকে না নিছি না!!! আমার নাম ও রিশাদ আহমেদ না!!”
মাহা মহা বিরক্তিতে ফেটে পড়ে বলল,,,

———“বা-ল, এখন তোর ৩০ টাকা মেইন হইছে? আ-বা-লের আ-বা-ল যা গিয়ে দেখ, ও কোন মা-ম-দো-র সাথে পালাইছে! এক্ষুনি যা আর হ্যাঁ আজকে ওর নীমার সাথে থাকার কথা। তাই নীমাদের ফ্ল্যাটে যা । আর এক্ষুনি ওর কান ধরে নিচে এনে ঝটপট কল লাগাবি আমার কাছে। জলদি যা।”
রিশাদ গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলল,,,
———“প্রথমত আজকে সারাদিন পার্টি করছি। সো আই এম ভেরি টায়ার্ড নাউ, দ্বিতীয়ত আমার বউ নেই যে আমার সেবা করবে, তার ওপর তুই আবার আমাকে কতবার কথার ভিতরে আ-বা-ল বলেছিস, আমি একদমই যেতে পারবো না রে।”
মাহা:“জুতার বাড়িটা কি মোবাইলের এপাশ থেকে দিবো? নাকি এসে দেবো?”

রিশাদ:“মানে?”
মাহা:“মানে এখন তুই টায়ার্ডনেস দেখাচ্ছিস,কানা যা, এক্ষুনি যা। নইলে….”
রিশাদ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,,,
———“চুপ কর শা’লী বহুত কথা বলছিস, আমি যাচ্ছি। আর তুই খালি আমার সামনে আয়, থাপড়াইয়া থাপড়াইয়া ‌তোর মাথায় একদম আলু গঁজিয়ে দেব।”
মাহা:“জলদি যা।”
কথাটা বলেই ফোন কেটে দিল মাহা। রিশাদ ইতিমধ্যেই বেরিয়ে পড়েছে নীমাদের ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে। সত্যি বলতে দুশ্চিন্তা তারও কিছু কম হচ্ছে না। কারন তাদের তিন মানিকের মধ্যে তিহুই একমাত্র ইম’ম্যাচিউর। তাই তাকে নিয়ে চিন্তার পরিমাণ দুজনের কারোরই কম নয়।

সন্ধ্যার কিছুটা পর, নিকষকালো আঁধারে ঘনীভূত চারিধার, শুধু কৃত্রিম আলোকসজ্জা ছাড়া, আজ অন্তরীক্ষে দেখা নেই চাঁদ মামারও । খান মহলের প্রধান গেইটের লৌহ কপাট খোলার শব্দ হলো। ধীরে ধীরে চারিপাশে বাগানাবৃত সাদা কংক্রিটের রাস্তাটা পেরিয়ে মহলের সামনে এসে থামল ‌ নীলের গাড়িটি । সেখান থেকে নেমে আসলেন নেতা সাহেব, আর আদুরে ভঙ্গিমায় ‌তার বক্ষদেশে লেপ্টে থাকা এক রমনী।
জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে তার, সর্বদা কম্পমান গোলাপি ‌অধরজোড়া,জ্বরের তোপে শ্বেত বর্ণ ধারণ করেছে। নাকের ডগা রক্তিম বর্ণাবৃত। তবুও চেতনাহীন সেই রমনীটি ভুবনমোহিনী সৌন্দর্যের অধিকারিনী। নীল এক ঝলক তাকালো উত্তপ্ত দেহের অধিকারিনী রমণীটির পানে। অতঃপর পা বাড়ালো অন্দরমহলের উদ্দেশ্যে।
এদিকে…………..

খান মহলে আজ আনন্দের জোয়ার। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর রৌশানারা খানের একমাত্র ছেলে মাহমুদুল হক রাওফিন, আজ ফোন করে জানিয়েছে সে বাংলাদেশ ফিরতে চায়। হয়তো দুই দিনের মাঝেই ফিরবে সে। এমন খবরে আনন্দ অশ্রু গড়াচ্ছে বাড়ির সকলের নয়নে। তার ওপর আজ আবার রুবিন আরা খানের মেয়ে সানজিদা আফরা মুন্নির ২০ তম জন্মদিন। সেই উদ্দেশ্যেও লেগেছে উৎসবের আমেজ।
হঠাৎই কলিংবেলের শব্দে বিশাল কাঠের দরজাটি খুললো একজন মেড। সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যমান হলো নীল আর তার বক্ষদেশে থাকা রমনীটি । নীলের বক্ষদেশে অচেনা কোনো এক যুবতীকে দেখে, হতবিহ্বব্বলতাবশত রুমিন আরার হাতের পায়েসের বাটিটি, শ্বেত পাথরের মেঝেতে পড়ে শব্দের ঝংকার তুলল।

———“কি হলো রুমি?” প্রশ্ন করতে করতে এগিয়ে আসলেন রৌশনারা. রুমিন আরার দৃষ্টি অনুসরণ করে দরজায় তাকাতেই হতভম্ব তিনি । চুপ থাকলেন মুহূর্ত কয়েক, নীল ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করতেই তাকে থামিয়ে রৌশনারা বলল,,
———“এই মেয়েটা কে নীল? কোত্থেকে ধরে এনেছো তাকে?”
নীল:“ ও নুরাইন, নুরাইন হক। সবচেয়ে বড় কথা নাও সি ইজ মাই ওয়াইফ,সো ডোন্ট অ্যাড্রেস হার অ্যাজ এই মেয়ে!”

নীলের এমন কথায় যেন ড্রয়িং রুমে বো’মা বিস্ফোরণ হলো। বিস্ফোরিত নয়নে সবাই চেয়ে আছে তার দিকে। মির্জা সায়মা রান্না ঘরেই ছিলেন, নীলের কণ্ঠে বেরিয়ে আসতেই এমন দৃশ্যে হতবাক তিনি।রৌশানারা গাম্ভীর্য বজায় রেখে কিছুটা রাগী কন্ঠে বললেন,,
———“তোমার বউ মানে? এটা কোন ধরনের কথাবার্তা নীল? তুমি জানো না এই বাড়িতে বড়দের অনুমতি ছাড়া বিয়ে নিষিদ্ধ!”
নীল জবাব দিল না ‌। মির্জা সায়মা এগিয়ে এসে নীলের বক্ষদেশে থাকা অচেনা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললেন,,,

———“এসব কথা না হয় পরে হবে আপা, নীল, বাবা আমার তো মনে হচ্ছে ও অসুস্থ। এক্ষুনি ওকে নিয়ে রুমে যা তুই। বাদবাকি কথা না হয় পরে হবে।”
বলেই মেয়েটির কপালে একবার হাত ছোঁয়ালো সে। জ্বরের তীব্রতায় পুড়ে যাচ্ছে তার কপাল খানা, সঙ্গে সঙ্গে হাত ছড়িয়ে মির্জা সায়মা কিছু বলার আগেই রৌশানারা খান ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললেন,,,
———“তুই চুপ থাক সায়মা,চেনা নেই জানা নেই একটা মেয়েকে ও বউ বলল,আর মেয়েটিও ওর বউ হয়ে গেলো?”
মির্জা সায়মা কিছু বলার আগেই সেখানে উপস্থিত হলেন মির্জা সূচনা।

মির্জা সূচনা:“কি হচ্ছে এখানে?”
পরক্ষণই নীলের কোলে এক সুশ্রী যুবতীকে দেখে চমকে তাকালেন তিনি। নীলের দিকে ফিরে শুধালেন,,,
———“এটা কে নীল?”
তার জবাবে নীল কিছু বলতে যাবে ঠিক তৎক্ষণাৎ রৌশানারা খান বাগড়া দিয়ে বললেন,,,
———“কে আর হবে, শোন তোর ছেলের কাছে, বলে কিনা এটা তার বউ? এই শিক্ষা দিয়েছিস তুই নিজের ছেলেকে!”
তাকে কথার মাঝখানে থামিয়ে মির্জা সূচনা বললেন,,,
———“তুই একটু চুপ করলে ভালো হয় রৌশানা, প্রশ্নটা আমি যাকে করেছি উত্তরটাও না হয় সেই দিক। আর আমার ছেলে যদি বলে এটা তার বউ, তাহলে রাস্তার কোনো পরিচয়হীন মেয়েকেও আমি এক শর্তে মেনে নেব আমার বৌমা হিসেবে।”
তিনি নীলের দিকে তাকাতেই নীল বলল,,

———“মা, সি ইজ মাই ওয়াইফ নুরাইন, নুরাইন হক আই থিঙ্ক আর কোনো পরিচয় লাগবেনা তার।”
মির্জা সূচনা একবার ভালো করে ছেলেকে পরখ করলেন।রৌশানারা খান কিছু বলতে গেলেই মির্জা সূচনা একপ্রকার তার মুখে ঝাঁমা ঘষে দিয়ে বললেন,,,
———“ছেলে আমার যখন বলেছে এটা তার বউ তার মানে এটাই আমার সংসারের উত্তরাধিকারীণী। কেউ আর কোনো প্রশ্ন করবে না। নীল তুই ওকে নিয়ে রুমে যা। বাদবাকি আমি সামলে নিচ্ছি।”
নীল আর কোনো দিকে না তাকিয়ে তিহুকে নিয়ে পা বাড়ালো তার রুমের উদ্দেশ্যে। নেহাতই সে গুরুজনের মুখে মুখে তর্ক করে না।, নতুবা রৌশানারা খানের এতক্ষণ বলা কথাগুলোর প্রত্যুত্তর সে যে কিভাবে দিত, তা হয়তো কল্পনাতীত ছিল এ মহলের প্রত্যেকটা লোকের। তবে সিঁড়ি বেয়ে যেতে যেতে সে একবার বাড়ির একজন মেডের উদ্দেশ্যে বলল উদ্দেশ্যে বলল,,,

———“আসমা খালা।”
আসমা বেগম চমকে তাকালেন। নীল তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলল,,,
———“নুরের জন্য মেডিসিন আর জলপটি নিয়ে, ৫ মিনিটের মাঝে আমি তোমাকে আমার রুমে দেখতে চাই।”

———“মনি আপু, তুমি এখনও সাজতেছো, শিগগিরই নিচেই চলো নীল ভাইয়া বউ নিয়ে এসেছে।”
মুন্নি নিজের ঢেউ খেলানো চুলগুলোতে চিরুনির শেষ আঁচড় চালাতে ব্যস্ত, প্রাণোচ্ছল চঞ্চল চোখ দুইটি বৃহৎ আতশীতে নিবদ্ধ তার। হঠাৎই রাফার এমন কথায় চমকে তাকালো সে। ধরে রাখা কাঠের চিরুনি টা ধপ করে মেঝেতে পড়ল। উদ্বিগ্ন কন্ঠে সে বলল,,,,
———“ইয়ার্কি করছিস? এক গাট্টা দিব! ফাজলামি করার জায়গা পাস না, নীল ভাই বউ নিয়ে এসেছ মানে? উনি যদি জানতে পারে না তার নামে এত উল্টাপাল্টা কথা বলছিস তুই, আস্ত রাখবে না কিন্তু তোকে।”
রাফা:“আমি কেন মিথ্যা বলতে যাব? বিশ্বাস না হয় তুমি নিজেই বাইরে চলো।”

রাফার কথায় বুক ধক করে উঠলো মুন্নির।আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না সে। পরনের নীলের পছন্দের ডার্ক ব্লু কালার শাড়ির রমণীটি ছুটে চলল বারান্দার দিকে। মুহূর্ত কয়েকের মাঝে থমকালো তার পদচারণা। তার ঠিক বিপরীত দিকের সিঁড়ি টি বেয়ে নীল বক্ষদেশে এক রমণীকে আগলে এগিয়ে চলছে নিজের রুমের দিকে। প্রথম পলকে বিশ্বাস হলো না মুন্নির ‌‌।
তবে সময় অতিবাহিত হতে লাগলো, কিছুক্ষণের মাঝে মিলিয়ে গেল নীল আর তার বক্ষদেশে আগলানো রমণীটি। রাফা এসে হাত রাখল মুন্নি ক্ষীন কাঁধটায়। মন্ত্রমুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলতে লাগলো,,,
———“হাউ রোমান্টিক না আপু? ভাইয়া পুরাই সিনেমার স্টাইলে বউমনিকে নিয়ে এন্ট্রি নিয়েছে। আই জাস্ট শকড।”
অপর পাশ থেকে কোনো মন্তব্য না আসায় রাফা এবার মুন্নির পানে তাকালো। মুন্নির অচঞ্চল চোখ দুইটা স্থির-স্থবির, যেগুলোতে কিছু মুহূর্ত পূর্বেও বিদ্যমান ছিল এক নাম না জানা চঞ্চলতা। রাফা মুন্নির কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,,,

———“ওই মনিপু, বলো, সেই না সিনটা?”
মুন্নির চোখ বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু কণা টু‌প করে গড়িয়ে ‌পড়ল তবে সেটা রাফার দৃষ্টির অগোচরে রেখেই দ্রুত দৌড়ে রুমে গিয়েই দরজা বন্ধ করে দিল মুন্নি। রাফা শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ হলো টা কি মনি আপুর। যাইহোক এখন তার অনেক দায়িত্ব নীরা নিহিত নাহা, সবাইকে তো নতুন বউমনির ব্যাপারটা জানাতে হবে। মুন্নির রুম আগে বাঁধে বিধায় তাকে জানানো হয়েছে ‌। এখনো বাকি বাড়ির বাকি সব নবীনের। সে দ্রুত নীরার রুমের দিকে পা বাড়ালো।

রুমে এসেই শব্দ করে সবেগে দরজা লাগিয়েই তার সাথে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসে পড়লো মুন্নি। চোখের কোনে জমে থাকা জল কণারা যেন বাঁধন‌ ভেঙেছে। কান্নার তোপে কাজল লেপ্টে যাচ্ছে, নষ্ট হচ্ছে পুরো মেকআপ, মুন্নির এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না কিছু। মনে হচ্ছে এ যেন কোনো দুঃস্বপ্ন। কিছুক্ষণ পরেই তার ঘুম ভেঙ্গে যাবে আর শেষ হবে এই দুঃস্বপ্নের প্রহরের।
মুন্নি দুহাতে নিজের সেট করে রাখা চুলগুলো সর্বশক্তি দিয়ে টেনে ধরল। দুহাত দিয়ে লেপ্টে দিলো কাজল কালো সেই নয়ন দুটি যা কিছুক্ষণ আগেও অতি যত্নে সাজাচ্ছিল সে। চিৎকার করে কেঁদে উঠল সে, তবে সেই চাপা কান্নার সাক্ষী হলো কেবলমাত্র একটা নিস্তব্ধ রুম, আর তার কিছু প্রাণহীন আসবাবপত্র।

প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ৬

নীল নিজের কিং সাইজ ‌নরম বেডটাতে অতিযত্নে শুইয়ে দিলো তিহুকে। ধীরে ধীরে তার মাথার নিচে রাখা নিজের হাতটা, চুপিসারে সরালো। তার ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করা মুখশ্রীর ওপর পতিত বেবি হেয়ারগুলোকে সর্বোচ্চ যত্ন দিয়ে, আলতো হাতে সরালো। তিহুকে আজ অন্যরকম সুন্দর লাগছে ‌।
জ্বরের তোপে চেতনাহীন রমনীও যে এতটা আকর্ষণীয় আর মোহনীয় হতে পারে;সেটা হয়তো তিহুকে না দেখলে কখনোই বুঝতেই পারত না নীল। সে এক ঘোর লাগা মন্ত্রমুগ্ধ দৃষ্টিতে অপলক চেয়ে রইল সেই অগ্নিকন্যাটির পানে।

প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ৭

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here