প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ৯

প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ৯
নওরিন কবির তিশা

পূবের আকাশ সিঁদুরের রঙে রাঙা হয়ে উঠেছে, সুস্নিগ্ধ রৌদ্র কিরণ ছড়াচ্ছে ধরণী জুড়ে। তীক্ষ্ম সেই মিষ্টি ‌রোদ্দুরের সঙ্গে রুমের পার্শ্ববর্তী প্রকণ্ড বকুল বৃক্ষের একগুচ্ছ বকুলের ঘ্রাণে রুম ম’ম করছে । দখিনা জালনাটা দিয়ে, এক রাশ সুভাষিত নরম পবন, ছুঁয়ে গেল রুমটাকে ‌‌।
এমনই সুস্নিগ্ধ প্রভাতে, আড়মোড়া ভেঙে ঘুম থেকে উঠলো তিহু। আলসে ভঙ্গিতে বিছানায় উঠে বসলো সে। ঘড়ির কাঁটায় সকাল ছয়টা চলমান। বিছানা থেকে নেমে ওয়াশ রুমে যাওয়ার আগে এক ঝলক তাকালো সোফায়,ঘুমন্ত নীলের দিকে। একটা কুশন মাথার নিচে আরেকটার উপর শরীরের সমগ্র ভর ছেড়ে দিয়ে অন্যদিকে ঘুরে বেশ আরাম করে ঘুমিয়ে আছে সে।
তিহু কোনরুপ শব্দ না করে, চুপিসারে পা বাড়ালো ওয়াশরুমের দিকে।

ফ্রেশ হয়ে,দীর্ঘ একটা শাওয়ার নেওয়া শেষে, তিহু দেখতে পায়, এখনো বিঘোরে ঘুমাচ্ছ সে। তিহু ঘড়ির কাঁটায় তাকিয়ে দেখে ছয়টা বেজে ৪৫ মিনিট। সে ভাবতে লাগলো এখন কি করা উচিত। এমনিতে আজ ভার্সিটি আছে তার উপর বেলাও চড়া হতে শুরু করেছে।তিহু এগিয়ে গিয়ে সামান্য ঝুঁকে ঘুমন্ত নীলের পিঠে আলতো ধাক্কা দিয়ে বলল,,
—-“এই যে,শুনছেন?”
কোনো জবাব না আসায় তিহু আবার ডাকলো,,,—“এই যে, উঠুন না।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নীল এবারও কোনো ‌জবাব না দেওয়ায়,তিহু কিছুটা হতাশ হয়ে সেখান থেকে সরে যাচ্ছিল ঠিক তখনই, নীল পাশ ফিরল। আর তিহু পড়লো মহাবিপত্তিতে। তার একগুচ্ছ কেশরাজ আটকা পড়লো,নীলের শার্টের বোতামে। সামান্য ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠল সে। তৎপর হয়ে পড়ল, সেগুলো ছাড়াতে।তবে কোনমতেই সেগুলোকে, নীলের বোতাম থেকে আলাদা করতে পারছে না সে। বেশ শক্তপোক্ত ভাবেই আটকে গিয়েছে তারা।
এদিকে, নিজের থেকে কয়েক ইঞ্চি উচ্চতায় কারো সঞ্চালন অনুভূত হতেই, তড়িৎ বেগে চোখ খুলল নীল। সঙ্গে সঙ্গে চোখাচোখি হলো তিহুর সাথে। দুজনেই লাজুক ভঙ্গিমায় অনিমেষ চেয়ে রইল একে অপরের দিকে। হঠাৎই নীল সামান্য নড়ে উঠতেই, চুলে টান লাগার দরুণ ভারসাম্য হারিয়ে তিহু তার বুকের উপর পড়লো। লজ্জার এক মহাসমুদ্রে ডুব দিল দুজনেই।

তিহু দ্রুত নীলের বক্ষদেশ উঠতে যেতেই, ফের চুলে টান লাগায় আবারও মুখ দিয়ে ব্যথাতুর শব্দ করে উঠলো। নীল ব্যাতিব্যস্ত কণ্ঠে বললো,,,—“কি হলো?”
তিহু:“আমার চুলগুলো আপনার শার্টের বোতামে আটকে গিছে।”
নীল সেগুলো ছাড়ানোর জন্য, যখনই উঠতে গেল তৎক্ষণাৎ ব্যথায় ফের চোখমুখ খিঁজে নিল তিহু। তা দেখে নীল নরম কন্ঠে বলল,,,—“ওয়েট, জাস্ট সামান্য একটু। আই প্রমিস বেশি ব্যথা লাগবে না। আরেকটুখানি….”
তিহু চোখ মুখ ওভাবেই রেখে বলল,,,—“আস্তে, ওগুলো যেন ছাড়াতেই যাচ্ছে না!”
নীল ততক্ষণে চুলগুলো প্রায় ছাড়িয়েই ফেলেছে। ধীরে ধীরে সেগুলো হাতের মাঝে এনে,তিহুর অমন অবস্থা দেখে সামান্য হেসে সে বলল,,,—“ছাড়াতে যখন চাচ্ছে না, তবে ছাড়াচ্ছ কেন? হয়তো তারা, সারা জীবন আমার বক্ষেই থেকে যেতে চায়। একটুখানি ভালোবাসা নিয়ে….”

শেষ কথাটা একটু আস্তে বলল নীল। যার দরুন তা তিহুর কর্ণকুহরে পৌঁছালো কিনা বলা দায়। তবে তার প্রথম কথাগুলোতে বোকা বনে গেল তিহু। ভ্রুটা সামান্য কুঁচকে সে বলল,,,—“মানে?”
নীল সোফা থেকে উঠতে উঠতে বলল,,,—মানে কিছু না।
সে মুচকি হেসে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে চলল।তিহু একই ভঙ্গিমায় তখনও তাঁকিয়ে থাকলো তার দিকে।

ডাইনিংয়ে জমা হয়েছে বাড়ির সকলে। বাড়ি সব পুরুষ আর নবীনেরা খেতে ব্যস্ত। প্রত্যেক পুরুষের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে,নিজ নিজ সহধর্মিনী। অন্যান্য দিন বাবা আর বড়চাচ্চুর পাশে,মা,আর বম্মা থাকলেও আজ বড় ভাইয়ের পাশে, তার সহধর্মিনীকে দেখে, হতাশার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লো নিহিত। পাশেই বসে ছিল রাফা।নিহিতের দিকে ফিরে সে বলল,,—“কি হলো তোমার কি বউ মারা গিছে নাকি?”
নিহিত তার দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কিছু বলতে গিয়েও হতাশাগ্রস্থ কন্ঠে বলল,,,
—“দেখ দেখ, আজকের নীল ভাইয়ের পাশেও বউ মনি আছে। কাল রাওফিন ভাইয়ের পাশেও তার সহধর্মিনী আসবে। আর আমার..!”

নিহিতের কথায় হো হো করে হেসে উঠল রাফা। সকলে খাওয়া বন্ধ করে রাফার এমন হাসির পানে তাকালে, থমকালো সে, —স্যরি। বলে আবারও খাওয়ায় মনোনিবেশ করলো। অন্যান্য দিন হলে হয়তো মায়ের মারের হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারতো না তাকে । কিন্তু আজ মা বড় ভাইয়ের যত্নে মশগুল বিধায় এবারের মত বেঁচে গেল সে। কিছুক্ষণ পর নিহিতের দিকে ফিরে সে বলল,,,
—“শোনো ভাই তোমাকে একটা কথা বলি, তোমার কপালে কোনোদিন কোনো মেয়ে জুটবে না আর…”
তাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই, হুট করে নিহিত বলে উঠলো,,,—“তুই কি নিজেকে মেয়ে মনে করিস না?”

নিহিতের এমন কথায় কপাল কুঁচকালো রাফা। ডান চোখটা সামান্য ছোট করে সে বলল,,,—“মানে?”
নিজের কথায় নিজেই লজ্জায় পড়ে গেল নিহিত। দ্রুত পাশের গ্লাস থেকে,এক গ্লাস পানি, এক নিমেষে শেষ করে দিয়ে বলল,,,—“মানে কিছু না এখনো দ্রুত খা। আর একটা কথা বলবি তো এমন থাপ্পড় দিব না।”
রাফা নাক সিটকে বলল,,—“তোমার আসলেও মাথায় সমস্যা আছে নিহিত ভাই।”
নিহিত আর কোনো কথা বলল না। চুপচাপ, দ্রুত ভঙ্গিতে খেতে থাকলো।
———“তুমি এখনও এখানে দাঁড়িয়ে কি করছো? যাও এক্ষুনি আর, দ্রুত রেডি হয়ে নিচে আসো।কুইক।”
নীলের কন্ঠে সবাই অবাক ভঙ্গিমায় তাকালো তার দিকে। রৌশানারা ভ্রু যুগল কুঁচকে বললেন,,,———“রেডি হবে মানে? কোথায় যাবি তোরা?”

নীল নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় বলল,,,—“আজকে নুরের ভার্সিটি আছে। আর আমরা সেখানেই যাব।”
রুমিন আরা স্বামীর প্লেটে ভাত দেওয়া বন্ধ করে বললেন,,,—“ভার্সিটিতে যাবে মানে? আজকে তো, কিছু রিচুয়ালস আছে। আর তুই জানিস না খান বাড়ির বউদের, বিয়ের এক সপ্তাহের আগে কলেজ বা ভার্সিটি যেতে নেই। দায়িত্ব থাকে তাদের । বুঝে নিতে হয় সেগুলো।”
মায়ের কথায় মুন্নি বলল,,,—“কাকে কি বলছো আম্মু? এই মেয়ে সংসারে দায়িত্ব নেবে!”
মুন্নির কথায় তার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকালো নীল। সঙ্গে সঙ্গে চুপসে গেল সে। রৌশানারা বললেন,,,—“সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে। যেখানে বাড়ির বউরা প্রতিদিন ভোরবেলা উঠে রান্না,কাজ সব একা হাতে সামলায় সেখানে, সবকিছু সূচনার করা লাগছে।”

রৌশানারার কথার জবাবে মির্জা সূচনা বললেন,,,—“কাজটা তো আমার করতে হচ্ছে রৌশানা, কই তুইও তো আমাকে হেল্প করিস না। আর নুরাইনের কথা বলার আগে তুই নিজের দিকে তাকা, ও ত না হয় বাচ্চা মেয়ে নতুন এসেছে। কিন্তু তুই? তুই তো এবাড়ির নিয়ম কানুন সব পুঙ্খানুপুঙ্খ জানিস, তবুও কেন তোর প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়? তুই তো আর ওর মতো, বাচ্চা নস। নাকি শিং ভেঙ্গে বাছুরের দলে নাম লেখাতে চাচ্ছিস?”
মির্জা সূচনা এমন কথায় চুপসে গেলেন রৌশানারা খান। মির্জা সূচনা এক ঝলক সেদিকে তাকিয়ে ফের নুরের দিকে ফিরে বললেন,,,—“নুরাইন, যা মা, তুই গিয়ে রেডি হয়েনে। আমি তোর খাবার নিয়ে রুমে আসছি।”
তিহু, এক ঝলক সবার দিকে তাকালো অতঃপর সম্মতিসূচক মাথা নাড়িয়ে উপরে গেল।

ভার্সিটির ক্লাস শেষে, ছুটির প্রায় আগ মুহূর্তে একটা অফ পিরিয়ড চলছিল। তাই বন্ধু মহল, বাইরের খোলা উদ্যানে বসে গল্প করছিল। তিহুকে এতক্ষণ যাবৎ নানা কথা শুনিয়েছে মাহা আর রিশাদ। তিহু চুপচাপ বসে আছে। নিদ্রাও ইফাজের কাছে সবটা শুনেছে, তাই মাহা আর রিশাদ তিহুকে বকলেও, সে কিছুই বলেনি। তিহু, হঠাৎই মাহা আলতো ধাক্কা দিয়ে বলল,,,
—“আরে এমন করছিস কেন, তোর জন্য তো গুড নিউজ আছে। বলেছিলাম না তোকে আমার বড় যা বানাবো, দোস্ত! দিস ইজ টু মাচ আনএক্সপেক্টেড, যে আমার একটা ভাসুর আছে। দ্যাট মিন্স তুই আমার বড় যা কনফার্ম।”

মাহা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লো। তৎক্ষণাৎ পাশ থেকে রিশাদ বলল,,,—“তোর কোনো ননদ নেই বান্ধবী?”
তিহু:“আছেই তো। দুইটা আমার মনের মতন, একটা সাথে এখনও কথা হয়নি আর একটা তো চুন্নি।”
রিশাদ উৎসুক কন্ঠে জিজ্ঞাসা করল,,,—“নাম কিরে তোর ননদদের?”
রিশাদের কথায় চাপা হাসলো নিদ্রা। তিহু দুষ্টু হেসে বলল,,—“ব্যাপার না দোস্ত তোর সেটিংও আমি করিয়ে দেবো। কিন্তু কথা হচ্ছে তোর জন্য পারফেক্ট কোনটা.. উম,উম…!
ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ এই তিহুর চোখের সামনে ভেসে উঠলো দুই পাশে বিণুণী আবৃত মোটা ফ্রেমের চশমাধারী, মিষ্টি মেয়েটাকে। সঙ্গে সঙ্গে সে বলে্ উঠলো,,—“হুম।নীরু,নীরু পার্ফেক্ট!”
নীরা আর রাফার মধ্যে বড় রাফা তবুও কেন যে, রিশাদের জন্য নীরাকে পছন্দ করল তিহু জানা নেই। তার কথায় রিশাদ ভ্রু কুচঁকে বলল,,,———“নীরু মানে?”
তিহু:“নীরু মানে নীরা। ওয়ারিশা খান নীরা। বিশ্বাস কর তোর জন্য পুরো পারফেক্ট, তুই যেমন সারাক্ষণ শর্ট টেম্পারড ও সেরকম নরম আর মিষ্টি একটা মেয়ে। তোকে শুধু ওই সামলাতে পারবে। তবে রাফা না থাক নীরাই পারফেক্ট।”

তার কথার মাথামুণ্ডু কিচ্ছু বুঝলো না বন্ধু মহল। হঠাৎই ভার্সিটির একজন স্টাফ সালমা বেগম এগিয়ে এসে বললেন,,,——“তিহু মা, নীল স্যার এসেছেন তোমাকে ডাকছে।”
সালমা বেগম চলে যেতে চাপা হাসলো নিদ্রা আর মাহা। মাহা ক্ষনিকের জন্য রেগে থাকলেও, তিহুর উপর রাগ করে থাকা যায় না। অন্ততপক্ষে সে তো কখনোই পারবে না ‌। মুচকি হেসে মাহা বলল,,,
———“চলুন মিস জনাবিকা, আপনি তো এখন আবার নেতার স্ত্রী। কত সম্মান আপনার। চলুন চলুন আপনাকে সম্মান করে আমরাও, সম্মানিত হই। এই রিশাদ চল।”
তিহু:“মাহু?”
রিশাদ উঠে দাঁড়ালো। তিন বন্ধু মিলে এগিয়ে চলল মেইন গেটের দিকে। সামনেই দাঁড়িয়েছিল নীলের গাড়ি। মাহা আর রিশাদ,তিহুকে এগিয়ে দিয়ে সেখান থেকে চলে গেল। তিহুও পা বাড়ালো গাড়ির দিকে।

গাড়ি ড্রাইভিং সিটের পাশেই বসেছিল রাওফিন, বহুদিন পর দেশে ফিরেছে বলে, নীলের কোম্পানিটা ঘুরে দেখতে গিয়েছিল সে। আসার পথে নীল ভার্সিটিতে তিহুকে নিতে আসায়, গাড়ির মাঝেই বসে আছে। তার সুঠামদেহি শরীর আবৃত কালো শার্টে,সানগ্লাসে ঢেকে থাকার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার নিবন্ধ হাতে থাকা মুঠো ফোনে‌। হঠাৎই পরিচিত এক মেয়েলীসুবাসে দ্রুত জালনা দিয়ে বাইরে তাকালো সে।
দেখতে পেল দুজন, বন্ধু গল্প করতে করতে যাচ্ছে। একটা মেয়ে আর একটা ছেলে। বেশ খানিকটা দূরে চলে গিয়েছে তারা, যার দরুন ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছে না তাদের। তবুও রাওফিনের, কেমন যেন লাগলো। মনে হলো বহু পরিচিত বহু প্রতীক্ষিত ব্যক্তিটি তার পাশ দিয়ে হেঁটে গেল। সে দ্রুত গাড়ি থেকে নামতে যাচ্ছিল ঠিক তখনই, হাজির হলো তিহু। এক ঝলক নীলের দিকে তাকিয়ে পরক্ষণেই রাওফিনকে দেখে সে বলল,,,
——“আরে ব্রাদার তুমি এখানে!”
তিহুর কন্ঠে ধ্যান ভাঙল রাওফিনের। তার দিকে ফিরে এসে মুচকি হেসে ফেলল,,,—“এইতো সিস্টার তোমাকে নিতে এলাম.”
তিহু মুচকি হেসে গাড়িতে উঠল।

গাড়ি চলছে ব্যস্ততম সড়ক দিয়ে, ড্রাইভিং সিটে দক্ষ খাতে গাড়ি চালাচ্ছে নীল । পাশে রাওফিন,তিহুর বিক্ষিপ্ত নয়ন জোড়া বারংবার লুকিং গ্লাসে চলে যাচ্ছে। যেখানে দৃশ্যমান নীলের তীক্ষ্ণ নীলচে আখিঁজোড়া। ফের দৃষ্টি নামাচ্ছে সে। বার কয়েকটা এমন কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করল রাওফিন, আরো একটা জিনিস তার নজর কাড়লো, যখনই তিহু দৃষ্টি নামাচ্ছে ঠিক তৎক্ষণাৎ নীল লুকিং গ্লাসে তার দিকে তাকাচ্ছে। ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং লাগলো তার কাছে। ঠোঁট চেপে হেসে সে বলল,,,

———“নীল গাড়িটা থামাতো।”
রাওফিনের কথায় তৎক্ষণাৎ ব্রেক কষলো নীল। দ্রুত কণ্ঠে বললো,,,—“কি হয়েছে? এনি প্রবলেম?”
রাওফিন দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে বলল,,,—“কাবাব মে হাড্ডি হতে কার ভালো লাগে বল? সিস্টার, তুমি বরং সামনে যাও আমি পিছনে বসি!”
তিহু আর নীল দুজনেই লজ্জায় পড়ে গেল রাওফিনের এমন কথায়। দুজনের মনে একই ভয়, রাওফিন কি দেখে ফেলল নাকি?তিহু লাজুক কণ্ঠে বললো,,,—“না,না ব্রাদার তেমন কিছু না!”
রাওফিন:“তাহলে আর কি, এই মাঝে রাস্তাতেই এখন আমাকে ক্যাব বুক করে তাই যেতে হবে। আফটার অল কাবাব মে হাড্ডি তো, আমি হতে পারব না।।”
তিহু উপায়ান্তর না পেয়ে, নীলের পাশে সিটটায় গিয়ে বসলো. রাওফিন মুচকি হাসলো। নীল এক ঝলক তাকালো তিহুর দিকে।তিহুও লাজুক ভঙ্গিমায় এক পলক তাকালো।

সন্ধ্যার কিছুটা পরে, নীল ল্যাপটপে কাজ করছিল। রাফা সেই তখন থেকে এসে বসে আছে তিহুর কাছে। আবদার একটাই, একটা হরর ফিল্ম দেখবে সে। তবে একা একা দেখতে ভয় করে আর নীরা এসব পছন্দ করে না বিধায়, তিহুকে সঙ্গী করতে চাইছে সে। এদিকে তিহু একদমই রাজি নয় কোনো হরর ফিল্ম দেখতে। রাফা আরেকবার বলাতে সে ঘোর আপত্তি করে বলল,,,
—-“রাফু, আমি হরর ফিল্ম দেখতে পারিনা । ইভেন আমি তো রাতের বেলায় জ্বীন-ভূতের কথাও শুনতে করতে পারিনা। মনে হয় আমার পাশেই বসে আছে। ওরে বাবারে একদমই না!”
রাফা বুঝলো তিহুকে, জোর করেও আর কোনো লাভ হবে না। হতাশ হয়ে সে চলে গেল। তবে রাফার সাথে কথোপকথন চলাকালীন নীল এক অদ্ভুত ভঙ্গিমায়, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল তার দিকে।

রাত প্রায় এগারোটার কাঁটায়,তিহু মাহাকে দিয়ে কিছু বই আনিয়েছিল, সেগুলোতে চোখ বোলাচ্ছে সে। হঠাৎ এ নীল এক ঝলক তার দিকে তাকালো। অতঃপর, কন্ট্রাক্ট লিস্টের একটা নম্বরে ডায়াল করল ‌। মুহূর্ত কয়েকপর, দেশে আসলো একটা গুরুগম্ভীর পৌরুষ কন্ঠ ‌। নীল সালাম দিয়ে বলল,,,
—-“ আসসালামুয়ালাইকুম,কেমন আছেন হুজুর?”
অপর পাশের ব্যক্তিটি বলল,,—-“আলহামদুলিল্লাহ,বাবা। তোমার অবস্থা কি? আর কোনো সমস্যা?”
নীল:“হ্যাঁ হ্যাঁ হুজুর সমস্যা তো অনেক, আমাদের মানে আমার রুমের সুইমিং পুলের পাশের যে জ্বীনটা ছিল না? ওটা ইদানিং একটু বেশি জ্বালাচ্ছে. ঘুমের ঘোরে কখনো, পাশে হাত দিয়ে মনে হয় কেউ বসে আছেন।”
নীলের কথায় তিহু বিস্ফোরিত নয়নে তাকালো তার দিকে। নীল কথোপকথনের মাঝে দু একবার বার অতি সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে, পরখ করছিল তিহুকে। তার ভীত চোখ মুখ দেখে, লুক্কায়িত হাসলো নীল। অতঃপর নিজের আলাপচারিতা চালিয়ে গেল হুজুরের সাথে । হুজুর তাকে জানালো, তিনি কালকে আসবেন আর আজকে রাতটুকু নীলকে আয়তুল কুরসি পড়ে ঘুমাতে। নীল জ্বী হুজুর বলে,ফোন রেখে দিল।

কথা বলা শেষ করে নীল একবার তিহুর দিকে তাকালো।তিহু তখনও ভীত দৃষ্টিতে,অবাক লোচনে তাকিয়ে আছে তার দিকে।নীলকে ফোন রেখে দিতে দেখে সে ভীত কন্ঠে বলল,,—“আপনার রুমে জ্বীন আছে?”
নীল নির্বিকার ভঙ্গিতে সোফাতে বসতে বসতে বলল,,,—“হুম, আছে তো।”তারপর তিহুর বাঁ পাশের দিকটাতে যেখানে সুইমিংপুলের এরিয়াটা সেদিকে ইশারা করে বলল,,,—“ওই সুইমিংপুলের এরিয়াটা তার খুব পছন্দের‌। সর্বক্ষণ ওখানে থাকে সে।”

নীলের ইশারায় এক ঝলক সেদিকে তাকালো তিহু।গাঁ ছমছম করে উঠলো তার, শরীর জুড়ে বয়ে গেল এক মৃদু ভীত কম্পন।নীল সেদিকে তাকিয়ে চাপা হাসলো। অতঃপর সোফাটাতে আরাম করে শুতে শুতে বলল,,
————“লাইট অফ করে দাও।আমি ঘুমিয়ে পড়।”
তিহু:“আ-আ-আপনি-আপনি ঘুমান না,আমি বরং পড়ে, একটু পরে লাইট নিভিয়ে দিব।”
নীল বুঝলো তার বুদ্ধিতে কাজ হয়েছে।এক ঝলক হাসলো সে,অতঃপর স্বাভাবিক হয়ে তিহুর দিকে ফিরে বলল,,,—“কেন?ভয় পাচ্ছ?”
তিহুর সত্যি সত্যিই ভয় করছে। তবে সেটা তো কোনো মতেই নীলকে বুঝতে দিলে চলবে না। তাহলে যে তার মানসম্মান কিচ্ছু বাকি থাকবে না।সে ঘোর বিরোধীতা করে বলল,,,—“না, না।ভয় পেতে যাব কেন? এইটুকু ব্যপারে কি কেউ ভয় পায় নাকি?আমি কি বাচ্চা যে সামান্য ‌এইটুকুতেই ভয় পাব?”

নীল ডান ভ্রুটা সামান্য নাচিয়ে বলল,,—“ওহ আচ্ছা,তাহলে লাইটার নিভিয়ে দিন মিসেস খান সাহেবা।”
নীলের বলা ‌মিসেস খান সাহেবা কথাটা কর্নকুহরে পৌঁছাতেই লজ্জায় লাল বর্ণ ধারণ করল তিহুর ফর্সা মুখশ্রী।ভয় আর লজ্জার অদ্ভুত মিশ্রণে আবৃত তিহু চুম্বকের মত আকর্ষণ করছে নীলকে।নীল দৃষ্টি নামালো।তিহু ভীত হাতে লাইট নিভিয়ে দিলো। রুম জুড়ে এখন শুধুই ডিম লাইটের টিমটিম আলো। মাঝে মাঝে ভেসে আসছে পাখপাখালির মৃদু গুঞ্জন। তবে তাও আজ ভয়ের কারণ হচ্ছে তিহুর কাছে।কম্পিত হাতে পাশ থেকে একটা বালিশ দিয়ে তাতে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ল সে।

মুহূর্ত কয়েকপর,,
আজ তন্দ্রা যেন বিদায় জানিয়েছে তিহুকে। চোখে একফোঁটা ঘুমের লেশ নেই তার।ভয় লাগছে খুব,ভিষন।বালিশ থেকে মাথাটা তোলার সাহস পর্যন্ত হচ্ছে না তার। হঠাৎই পায়ের কাছে কিছুর আলতো স্পর্শ অনুভূত হতেই তড়িৎ বেগে চোখ মেলে ভীত স্বরে চিৎকার করে উঠলো সে,,,
———“ভূত,ভূত। আম্মু, আম্মু কই তুমি? আম্মু ভুত।”
ঠোঁট ভেঙ্গে কাঁদ কাঁদ কন্ঠে, কথাগুলো একনাগাড়ে বলে উঠলো তিহু। তার চিৎকারে ধড়ফড়িয়ে উঠলো নীল, যদিও সে এতক্ষণ জাগ্রতই ছিলো।তবে তিহুর থিয়েটারের আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেলো সে। দ্রুত এগিয়ে এসে রুমের লাইট অন করে সে বলল,,,

———“নুর,এই নুর কি হয়েছে তোমার?দেখো দেখো এইতো আমি,ভয় পেয়ো না।এই তো এইতো আমি।”
তিহু কোনো কথা না বলে সবেগে এগিয়ে এসে শক্ত করে জাপটে ধরল নীলকে।তার এমন কান্ডে থ বনে গেল নীল। নিজের উপর নিজেরই রাগ হতে লাগলো তার।কেন করল এমন মিথ্যা নাটক?সে দ্বিধান্বিত হাতে তিহুর পিঠে আলতো হাতে বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,,
———“এইতো আমি।ভয় পেয়ো না। কিচ্ছু নেই এখানে।”
তিহু ঠোঁট ভেঙ্গে বাচ্চাদের মত কেঁদে দিয়ে বলল,,—“না আছে,ভূত,ভূত আমার পায়ের কাছে হা….”
কান্নার তোপে আর কিছু বলতে পারল না সে।নীল একপলক তার পায়ের দিকে তাকালো।এবার সবটা স্পষ্ট হলো তার কাছে।উপুর হয়ে শোবার দরুন,তার ওড়নাটা পায়ের কাছে এসে পড়েছিলো,আর সেটাই হালকা বাতাসে দোল খেয়ে তার পা স্পর্শ করায় সে ভেবেছে এটা ভূত!নীল তিহুর এমন বোকামিতে মাথা নিচু করে মুচকি হাসলো। অতঃপর বলল,,,

———“আচ্ছা বুঝেছি,থাক আর লাইট অফ করা লাগবে না। তুমি লাইটা জ্বালিয়েই ঘুমিয়ে পড়।”
সে সরে যেতে গেলেই তিহু তাকে আরো শক্ত করে জাপটে ধরে বলল,,,—“না না আপনি প্লিজ যাবেনা।আপনি,আপনি বিছানাতেই ঘুমান।আমার কোনো আপত্তি নেই।”

প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ৮

নীল এবার যেনো অবাকের চূড়ান্ত সীমায় আরোহন করলো। সামান্য একটু মিথ্যা জ্বীনের ভয়েই,তিহু কাবু।যাই হোক সে হাজার বার ধন্যবাদ জানালো সেই অজ্ঞাত জ্বীনকে।যার দরুন আজ শান্তিতে নিজের বিছানায় ঘুমাতে পারবে সে।। কাল সারারাত ওই সোফাতে নির্ঘুম কেটেছে তার। ‌ঘুমানো জন্য বিশাল বিছানা যার নিত্যদিনের সঙ্গী,সেখানে একরাত ওই ছোট্ট সোফা বেশ পিঁড়া দিয়েছে তাকে।সে দুষ্টু হেসে ‌ফের সাধুবাদ জানালো নিজের ওমন বুদ্ধিকে।।।।

প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ১০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here