প্রেমের সমর সিজন ২ পর্ব ২৫
অলকানন্দা ঐন্দ্রি
ভোরের আলো যখন চোখে এসে পৌঁছাল তখন রাহা কপাল কুঁচকায়৷ মাথাটা কেমন যেন ব্যাথা করছে,ভার হয়ে আছে যেন! মুখটা কেমন তেঁতো ঠেকছে। কেমন যেন এক বিস্বাদময় স্বাদ।শরীর ঘেমে উঠে তার । যেন জ্বর সবেই নামছে শরীর থেকে।পরনের জামাটা ঘামে হালকা ভেজা ঠেকছে। রাহা যখন অল্প অল্প করে চোখ মেলে তাকাল তখন নিজে আবিষ্কার করল সে রোহানের সংস্পর্শেই আছে। রোহানের বাহুবন্ধনেই বুকের মাঝে গুঁটিশুঁটি হয়ে শুয়ে ছিল এতক্ষন । রাহা তাকায়। বিশ্বাস হয় না যেন। ফের চোখ পরিষ্কার করে তাকায়। রোহানই!এই আশ্চর্যময় কান্ডটা রাহা যখন বিশ্বাস করতে না পেরে গোলগোল চোখে চেয়ে থাকে ঠিক তখনই কানে এল,
“ জ্বর কমেছে নবনী? ”
এইটুকু বলতে বলতেই রোহান হাত বাড়াল।যে দুই হাতে এতক্ষন রাহাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়ে ঘুমিয়েছিল তার একটা হাতই ছোঁয়াল রাহার কপাল। শরীরের তাপমাত্রা বুঝে বলে উঠল,
” জ্বর তো কমেছে। ”
রাহা তাকায়।কমেছে বোধহয় জ্বর। তার তো সেসব খেয়াল নেই। সে এখনো একটা ঘোরে যেন। এখনে বিশ্বাস হচ্ছে যে রোহান তার আপুকে এতোটা ভালোবাসে সে রোহান তাকে এভাবে জড়িয়ে নিয়ে ঘুমিয়েছে।কি আশ্চর্য! রাহার জ্বরের বিষয়টা খেয়াল না হলেও খেয়াল আছে একটু আগেকার দৃশ্য।বলে উঠল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ আপনি যথেষ্ট দূরত্ব না রেখে ঘুমিয়েছেন মিঃ রোহান ফারাবী। ”
রোহানের এই পর্যায়ে হাসি আসে। যে মেয়েটা জ্বরে কাত হয়ে তাকে আঁকড়ে ধরেছিল সে জাগ্রত অবস্থায় যে এমন করবে তা তার জানা৷ শত হোক এটা নবনী তো!রোহানের হাসি পেলেও গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,
“ আমি নই, তুমি। ”
রাহা ভ্রু কুুচকে নেয়। বলে,
“ মানে? ”
রোহান উঠে বসে। একদম ভদ্র গম্ভীর ছেলের ন্যায় উত্তর করল,
“ তুমিই আমাকে জড়িয়ে ঘুমাচ্ছিলে। তোমার জানা উচিত আমি কোন স্যুয়েটার বা ব্লাঙ্কেট নই যে তোমার শীত করলেই আমার বুকে নিয়ে তোমায় জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে হবে। ”
রাহা মুহুর্তেই বলে,
” তো আপনাকে স্যুয়েটার বা ব্লাঙ্কেটের সাথে তুলনা করল টা কে? ”
“ তুমিই। শীত করছে শীত করছে বলে এমন ভাবে গুঁটিশুঁটি মেরে জড়িয়ে ধরে ঘুমালে যে ঔষুধ খাওয়ানোর সুযোগটা অব্দি দাও নি। পরে অনেক কষ্ট করে উঠে তোমায় ঔষুধ খাইয়েছি। ”
এটা ঠিক রাহা প্রথমে রোহানের বুকে গুঁটিশুঁটি মেরে ঘুমিয়েছিল। তবে পরেরবার উঠে যখন রোহান মেডিসিন দিল এর পরের বার রোহান নিজেই রাহাকে নিজের বুকে টেনেছে। ব্লাঙ্কেট জড়িয়ে আষ্ঠেপৃষ্ঠে এই মেয়েটাকে জড়িয়ে নিয়ে ঘুমিয়েছিল। রোহান পরবর্তী কাহিনী টুকু প্রকাশ করল না। তবে রাহা এসব শুনে কিঞ্চিৎ হলেও থতমত খেল। বলল,
“ ওসব জ্বরের কারণে। কিন্তু আপনাকে ঔষুধ খাওয়াতে তো আমি বলিনি। আপনি চাইলে আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে পারতেন। কি প্রয়োজন ছিল এভাবে জড়িয়ে রেখে ঘুমানোর? ”
রোহান ছোটশ্বাস টানে। এই মেয়েটা সত্যিই জটিল! এত প্রশ্ন মাথায় কেন ঘুরে? রোহান নিশ্চয় আসল উত্তরটা দিবে না? রোহান গম্ভীর স্বরে উত্তর করে,
“ মানবতা। ”
রাহার কেন জানি উত্তরটা পছন্দ হলো না। একদমই পছন্দ হলো না। সকাল সকাল এই পুরুষটির বুকে নিজেকে আবিষ্কার করে যতটা চকচকে হয়েছিল তার চোখমুখ এই উত্তরটা পেয়ে তার ততটুকুই রাগ লাগল। কে বলেছে মানবতা দেখাতে? রাহা বলেছে? রাহা মুহুর্তেই উত্তর করল,
” লাগবে না আপনার মানবতা। আমাকে আমার আপুর বাসায় দিয়ে আসবেন আজই। ”
রোহান ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় এবারে। ফের এই কথা উঠাবে কেন রাহা? কি পেয়েছে কি? রোহান যে তাকে মিস করে এটা বুঝে এই মেয়েটা? একটা অস্থিরতা যে কাজ করে এটা জানে? এই মেয়েটার প্রতি যে তার একটু হলেও দুর্বলতা কাজ করছে এটা বুঝে উঠে না মেয়েটা?রোহান ঘাড় ঘুরিয়েই সরাসরি উত্তর করল,
“ বললেই হলো? ”
“ অবশ্যই হলো। আমার অধিকার আছে যাওয়ার। আমার বাচ্চাটাও ও বাসায় পরে আছে। নিশ্চয় আমায় মিস করছে।আমাকে দিয়ে আসুন। ও বাসায় আমার আপু আছে, বাচ্চা আছে।এই বাসায় কেউ নেই যে আমাকে এখানে থাকতেই হবে। আমি মাঝেমধ্যে অবশ্যই আসব মিঃ রোহান ফারাবী। কয়েক সপ্তাহ কয়েক সপ্তাহ থেকে আবার চলে যাব। তাছাড়া আমাদের বিয়েটা তো হয়েছিলই এমন শর্তে যে আমরা নিজেরা নিজেদের মতোই বাঁচবে।আপনি আপনার মতো, আমি আমার মতো। ”
এত স্পষ্ট স্বরে এতগুলো কথা রোহান হজম করতে পারল না। সকাল সকালই মেজাজ খারাপ লাগল তার। রাগে মুখ কিঞ্চিৎ লাল দেখায়। বলে উঠে,
“ আগামী ছয়মাসে যদি কোথাও যাওয়ার নাম করেছো নবনী? সত্যি সত্যিই তুমি যা চেয়ে আসছো এতদিন তাই হবে। এবং তুমি এখানে থাকতে বাধ্য হবে। ”
রাহা বুঝে উঠে না। দ্রুত বলে,
“ কি হবে? ”
” বাচ্চা! তবে মেডিক্যালি দৌড়াদৌড়ি করে নয় বা ডক্টরের সাথে আলোচনা করে নয়। ”
রাহা ফের প্রশ্ন ছুড়ে,
“ তাহলে? ”
রোহান আর দাঁড়ায় না। যেতে যেতে বলে,
“ বুঝে নাও।এইটুকু বোঝার বয়স তোমার হয়েছে। ”
রাত গভীর! সিয়ার হাতে ঘুমের ঔষুধ। আজকাল খুব সহজে ঘুম ধরে না তার। কেন যে ঘুম আসে না তাও জানে না। আর এইজন্যই রোজ রোজ ঘুমের ঔষুধ গিলে নেয় সে। কোন ডক্টরের পরামর্শে নয়। বরং নিজে নিজেই। যদিও এই বিষয়টা কাউাে জানায়ও নি সে। সিয়া ছোটশ্বাস ফেলে। ফেইসবুক হুট করেই একটা পোস্ট করে,
“ কল্প? তোমার মুখে আমি হাসি দেখি না বহুদিন। তুমি কি জানো? আমার মুখেও হাসি থাকে না আজকাল। আমি নির্জীব পদার্থের ন্যায় ঘুরে বেড়াচ্ছি! আমি শূণ্যতা নিয়ে দিক-বিদিক ঘুরে এইটুকু বুঝেছি তুমি আসলে আমার নও। কোনকালেই নও। কিন্তু তবুও তুমি আমার। বিশ্বাস করো, তুমি সত্যিই আমার। আমার কল্পনায়! ”
এই অল্প লেখাটুকু লিখতে লিখতেই সিয়ার চোখে পানি আসে। চোখ টলমল করে। এইটুকু পোস্ট করেই সিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ঘুমের ঔষুধটুকু খেয়ে যখন ঘুমে ডুলুডুলু অবস্থা তার তখন আলো নিভাল সে। বিছানার এককোণায় যখন গুঁটিয়ে পড়বে ঠিক সেই মুহুর্ত টাতেই তার ফোনে কল এল। সিয়ার ঘুম ফেল। তবুও কেন জানি না সতর্ক হয়ে মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ বুলায় সে। নাম্বারটা চেনা। সচারচর এই নাম্বার থেকে কল আসে না। তবে আজ কিভাবে আসল তাও বুঝে উঠে না সে৷ সিয়ার ঘুমে চোখ নিভু নিভু।ঘুম পেল খুব। তবুও সে নতুন উচ্ছাসর কল তুলল সে। বলল,
“ এত রাতে কল দিলেন সাদ ভাই? আমি তো কিছু করিনি। আপনার কথা মতো রিক্সায় করে চলে এসেছিলাম তো তখন। ”
সাদ কিছুটা সময় চুপ থাকে। অতঃপর নিরব মুহুর্ত টুকু কাঁটিয়ে অনেকটা সময় পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“ সিয়া? আমি তোমায় হাসতে দেখতে চাই। ”
সিয়া হাসে এবারে। ঘুমু ঘুমু স্বরে বলে উঠে,
” এইজন্য কল দিলেন?”
ওপাশ থেকে সাদ মুহুর্তেই বলল,
“ আমায় অপরাধী করো না সিয়া। আমি তোমার হাসি কেড়ে নিতে চাই নি। কখনো চাইনি।আমাকে এভাবে অপরাধীদের দিকে ঠেলে দিও না। ”
সিয়া তখন ঘুমে চোখ বুঝে নিয়েছে। বলল,
“ আমি তো বলিনি আপনি আমার হাসি কেড়ে নিয়েছেন।”
সাদ আবারও চুপ থাকে। সিয়ার ঘুম চরম মাত্রায় তবুও প্রিয় পুরুষটির পাল্টা উত্তর শোনার জন্য সে অপেক্ষায় থাকল৷ চোখ বুঝে নিয়েও চোখ খুলে ফেলল সে। বহুক্ষন অপেক্ষা করল ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে৷ অতঃপর সাদ বলল,
“ তোমার চেহারায় পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি সিয়া। চোখের নিচে কালো দাগ বসিয়েছো। রাত জাগো তুমি। আমি প্রায়সময়ই দেখি তুমি রাতে অনলাইনে। ”
সিয়া মুহুর্তেই প্রশ্ন ছুড়ে,
” তো? ”
সাদ এবারে বলল,
“ কেন নিজের সুন্দর জীবনটা নষ্ট করছো? ”
সিয়া হেসে উত্তর করল,
“ এমনিই। ”
” আমি চাই তুমি সুন্দরভাবে বেঁচে থাকো। এসব আবেগ ভুলে বাঁচতে শিখো সিয়া। ”
সিয়ার ঘুম যেন কোথায় পালিয়ে গেল। মুহুর্তেই শক্তপোক্ত স্বরে উত্তর করল,
” আবেগ নয়।”
সাদ প্রশ্ন ছুড়ল,
“ অনুভূতি?”
” হ্যাঁ। ”
সাদ প্রতিবারের মতো জানাল,
“ মুঁছে ফেলো।”
সিয়া এবারে শক্ত গলায় বলল,
“ সম্ভব নয়।”
” সম্ভব। ”
“ আপনার থেকে তো অনুভূতি চাইনি আমি সাদ ভাই। কাজেই আমার অনুভূতি মুঁছতে বলার আপনার কোন অধিকার নেই৷ ”
এই কথাগুলো সিয়া শক্ত গলাতেই বলল। অতঃপর কল রেখে দিল। সিয়া এইভাবে সাদের দেওয়া কলকে প্রত্যাখান ও করতে পারে এটা বোধহয় আজই হলো। যে সিয়া সাদের একটা কথার অপেক্ষায় থাকে, কন্ঠ শোনার অপেক্ষায় থাকে সে সিয়া ফোন রেখে দিল?
ভীনদেশে এসে বহুদিন পর নিজের প্রিয় নারীকে কাছে পাওয়ার সুখে আবির নিরব চেয়ে থাকে। পরখ করে ঘুমন্ত ছুটিকে। মুহুর্তেই বাঁকা হাসে একটু আগের ঘটনা মনে করে। ছুটি ঘুমিয়েছে অল্প সময়ই হয়েছে। আর তখন থেকেই সে তাকিয়ে আছে এই মেয়েটার দিকে। মেয়েটা তার বক্ষেই গুঁটিশুঁটি হয়ে ঘুমোচ্ছে। চোখ বুঝে রেখেছে। ফুলো গাল দুটো বাচ্চাদের মতো লাগছে যেন। আবির বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে গাল ছোঁয়ে। মুখ নামিয়ে একটা চুমু এঁকে ফিসফিস স্বরে বলে,
“ তুই এতো বেশি আদুরে না হলেও তো হতো ছুটি। তোর মুখটা দেখলেই আমার এত আদুরে অনুভূতি আসে কেন? ”
এইটুকু বলেই আবির ফের ঠোঁট ছোঁয়াল ছুটির ঠোঁটে, নাকে,কপালে সমগ্র মুখে। বেচারা ছুটি ঘুমিয়েছেই অল্প কিছুক্ষন সময় হলো। এর মধ্যে ফের ঘুমের মধ্যে আবারও কিছুর বিচরন টের পেয়ে কোনভাবে চোখ মেলে তাকায় সে। শরীর জুড়ে অল্প রিনরিনে ব্যাথা টের পায়।যা স্পষ্ট মনে করায় তার সংস্পর্শে থাকা পুরুষটির একটু আগের পাগলামো। ছুটি ঝাপসা চাহনিতেই তাকায়।সাথে সাথে এই পুরুষটির এমন কান্ড দেখে ঘুম ঘুম কন্ঠে বলে উঠে,
“ ঘুমোন নি কেন এখনো? ”
আবির হাসে। দুই হাতে ছুটিকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়ে বড্ড সন্তুষ্ট স্বরে বলে উঠে,
“ আমি বহুদিন তোকে দেখি নি এভাবে ছুটি। তোর ঘুমন্ত মুখটা দেখাও আমার নেশা নেশা লাগত, এখনও লাগে।”
“ আপনার নতুন জব এখানে। ঘুমানো উচিত আপনার এবার। ”
আবির হেসে শুধায়,
প্রেমের সমর সিজন ২ পর্ব ২৪
“ একদিন নির্ঘুম কাঁটুক না। তুই আছিস তো পাশে।”
ছুটি ওভাবেই নিরব থাকে। তারপর হুট করেই আবিরকে প্রশ্ন ছুড়ে বসে,
“ আরো একজন আসলে কেমন হবে? আমাদের একটা ছোট্ট প্রাণ থাকলে কেমন হবে আবির ভা…”
আবির মুহুর্তেই ছুটির মুখ চেপে ধরল। সতর্কতা স্বরূপ বলে উঠল,
” এ্যাঁ! খবদ্দার! ভাই বলবি না । ভাই ডেকে তুই আমার সাথে বাচ্চার প্ল্যানিং করতে আসিস? ফাজিল মহিলা! ”