প্রেমের সমর সিজন ২ পর্ব ২৭

প্রেমের সমর সিজন ২ পর্ব ২৭
অলকানন্দা ঐন্দ্রি

রাহার শরীর যখন বমিমাখা আর চোখ দুটো নিভু নিভু হয়ে ঢলে পড়ল রোহান শুকনো ঢোক গিলে। নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে। দুয়েকবার ডেকেও যখন সাড়া পেল না তখন পানি ছিটিয়ে দিল রাহার মুখে। পরমুহুর্তে রাহা মিনমিনে চাহনিতে তাকালেও আবার ক্লান্তিতে চোখ বুঝে নিল। রোহান ছোটশ্বাস ফেলে। বুঝে উঠতে পারে জ্বরের কারণেই বোধহয় এমন করছে। মৃদু স্বরে মাকে ডাকল সে। চেঞ্জ করানো দরকার রাহার। এই অবস্থায় থাকলে উল্টো তারই ক্ষতি হবে। যে ভাবা সেই কাজ। মাকে ডেকে সবটা বলল। তারপর রাহাকে চেঞ্জ করিয়ে দেওয়ার জন্য সরে গেল সেখান থেকে। নিজেও ড্রেস চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে আসল কিছুটা সময় পর৷ রোহান ছোটছোট চোখে তাকিয়েই বলে,

“ আম্মু? এই মেয়েকে আর কখনো বৃষ্টিতে ভিজতে দিবে না। এমন ভাবে অসুস্থতা দেখাচ্ছে যে আমার ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে থাপ্পড় দিয়ে বৃষ্টিতে বসিয়ে রাখি টানা চব্বিশ ঘন্টা। ”
রোহানের মা ছেলের অবস্থা দেখে হেসে দিবে যেন। তবুও হাসি চেপে বলল,
” ছোট বাচ্চা। ছেলে মানুষি করে হয়তো বৃষ্টিতে ভিজেছে। রাগ করলে চলবে? ”
রোহান মুখচোখ শক্ত করে বলল,
“ অবশ্যই চলবে। অমন চোখমুখ উল্টে পড়ে থাকলে অস্থির লাগে না বলো? যখন ও বমি করে নেতিয়ে পড়ছিল আমার সত্যিই কেমন অন্যরকম একটা অনুভূতি হচ্ছিল আম্মু। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ”
রোহানের মা বুঝতে পারল ছেলের মন গলেছে। এই চঞ্চল মেয়েটির প্রতি মন না গলার প্রশ্নই আসে না অবশ্য৷ উনি হেসে বললেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ বুঝলাম, তোর কি চিন্তা লাগছে ওর জন্য? ”
রোহান মুহুর্তে আগের রূপে ফিরে শক্তস্বরে বলল,
“মোটেই না! ”
কথাটা বলেই হনহন করে বেরিয়ে যায়। উদ্দেশ্য ডক্টর আনা। মেয়েটার যে অবস্থা তাতে তো মনে হয় না সে হসপিটাল অব্দি যেতে পারবে৷ রোহান ছোটশ্বাস ফেলে৷ অবশেষে বিকালের দিকে ডক্টর নিয়ে ফিরে। ডক্টর রাহাকে দেখে ঔষুধ দেয়। ফের চলেও যায়। তারপর থেকে রোহান বিছানার কোণে বসে আছে। রাহাকে দেখছে।একটু পরপর জ্বর চ্যাক করছে। যখন সন্ধ্যা ফেরিয়ে রাত হলো তখন রাহার শরীর দিয়ে ঘাম দিল। শরীরের তাপমাত্রা কিছুটা কমে এল। রোহানের মা তখন একটা কাজে বাইরে গিয়েছে। রোহান নিজেই তখন রাহার হাত মুখ মুঁছিয়ে দিল। তারপর রান্নাঘরে গেল রাহার জন্য খাওয়ার কিছু আনতে৷ ততক্ষনে অবশ্য রাহা চোখ মেলে উঠে বসেছেে।আশপাশে কাউকে না দেখে এদিক সেদিক ফিরে চাইল। পরমুহুর্তে উঠে রুমের বাইরে এল। পুরো বাসায় তেমন কাউকে না পেয়ে যখন রান্নাঘরে রোহানকে খাবার করতে দেখল তখনই সে বলল,

“ শুনুন৷ ”
রোহান গম্ভীরভাবেই বলে উঠল,
“ উঠেছো কেন? ”
রাহা হেসে বলে
“ আমি একদম ফিট এখন। দেখুন! ”
রোহান বিড়বিড় করে বলে,
“ হু, কতটুকু ফিট তা তো দেখতোই পাচ্ছিলাম৷ ”
কিন্তু রাহার উদ্দেশ্যে মুখে বলল,
“ এখানে কেন এসেছো?”
রাহা মুহুর্তেই প্রশ্ন ছুড়ে,
“ আম্মু কোথায়?”
“বাইরে গিয়েছে। কেন? কোন প্রয়োজন? ”
রাহা উত্তর দেয় না৷ তবে রোহানের গম্ভীর স্বরে কথা শুনে বলে,
“আপনি কি রেগে আছেন? ”
“ না। তোমার উপর রাগ করাটা বোকামো। ”

রাহা ছোটশ্বাস ফেলে৷ তারপর যখন রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়াবে তখনই তার দৃষ্টি পড়ল তার জামার দিকে। এটা অন্য ড্রেস। মানে যে ড্রেসটা সে আজ পড়ে ছিল সেটা নয়। রাহা ভ্রু কুঁচকায়। কে পোশাক পাল্টাবে তার? রোহান? নাহ! ছিঃ ছিঃ! কিসব ভাবছে সে? হয়তো আম্মুই পাল্টে দিয়েছে জ্বরের কারণে৷ কিন্তু আম্মুও বাসায় নেই। রাহা শিওর হতে আবার ঘাড় ফিরিয়ে শুধায়,
“ আম্মু নেই না বাসায়? ”
“ না নেই। ”
রাহা তবুও স্থির দাঁড়িয়ে থাকে ওখানে। আবার মুখেও প্রশ্নটা করতে পারছেেনা যে তার পোশাক কে পাল্টিয়েছে? কিভাবে বা করবে? এমন প্রশ্ন করা যায়? রাহা হাঁসফাঁস করে। জিজ্ঞেস করবে করবে করেও করতে পারছে না। রোহান তা খেয়াল করে শুধাল,

” কিছু বলবে? ”
রাহা এবারে সাহস নিয়ে চাইল। দ্রুত গলায় তীব্র অস্বস্তি নিয়ে শুধাল,
“ আমার ড্রেস চেঞ্জ দেখাচ্ছে যে? ড্রেস চেঞ্জ করেছেন? ”
রোহান ছোটশ্বাস ফেলে। মেয়েটা ঘুম থেকে উঠে যে সর্বপ্রথম এই বিষয়টা খেয়াল করবে তা বোধহয় সে জানত। গম্ভীর স্বরে উত্তর দিল,
“বমি করেছিলে। নিশ্চয় বমে সমেত তোমাকে ফেলে রাখাটা উত্তম কাজ নয়? ”
রাহার এবার বুক ডিপডিপ করে। চেঞ্জ কে করিয়েছে? রোহান? সন্দেহী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
“ড্রেস চেঞ্জ করেছেন তা নিয়ে তো কিছু বলছি না। কিন্তু কে করেছে? আপনি? ”
রোহান তাকায়। রাহার বাঁকা দৃষ্টি দেখে শুধায়,

“ ওভাবে তাকাচ্ছো কেন? ”
“ উত্তর দিন আগে, আপনি চেঞ্জ করিয়েছেন? ”
রোহান মনে মনে হাসে যেন। ভাবে রাহাকে এক ধাপ জ্বালানে যেতেই পারে। শক্ত স্বরে বলে,
“ উত্তর হ্যাঁ হলে কি করবে? ”
রাহা মুহুর্তেই আওয়াজটা একটু জোরে করে বলে উঠল,
” ছিঃ! আপনি আমার অনুমতি না নিয়েই পোশাক চেঞ্জ করিয়েছেন কেন? বলেছি আমি? ”
রোহান গলায় জোর দিয়ে বলল,
” তুমি না বললেও আমার মনে হয়েছিল তখন পোশাক চেঞ্জ করাটা উচিত। তাই করিয়েছি। এই অধিকারটা আমার আছে। ”

” ছিঃ! আপনার মনে তাহলে এসব ছিল? আমাকে ঘুমের মধ্যে….”
রোহান ভ্রু নাচায়। দ্রুত ভ্রু বাঁকিয়ে বলে উঠে,
”তোমাকে ঘুমের মধ্যে কি করেছি? অন্য কিছু তো নিশ্চয় করিনি ? অন্য কিছু করলেও সেটা অন্যায় বা অনুচিত বলে আমার মনে হচ্ছে না। কারণ তুমি আমার স্ত্রী। ”
” অন্য কিছুও করেছেন? ছিঃ ছিঃ! আপনি আমার মান ইজ্জ্বত সব শেষ করে দিয়েছেন। ”
রোহান দ্রুত প্রতিবাদ জানিয়ে হুমকি স্বরূপ বলল,
”এখন ও কিছুই শেষ করিনি নবনী। শেষ করার আগেই যদি মিথ্যে মিথ্যে আমার নামে বদনাম দাও তাহলে কিন্তু সত্যিই তোমার সবকিছু শেষ করতে আমি দুবার ভাবব না মেয়ে। সে অধিকার আমার আছে! ”
রাহা সরু চাহনিতে তাকিয়ে থাকে। বিড়বিড় স্বরে বলতে লাগল,
“ শেষ করতে আর বাকি রেখেছেন কিছু? বেয়াদব পুরুষমানুষ! ”
রোহান আড়ালে হাসে। তবে মুখ গম্ভীর রেখে রাহার দিকে কিছুটা ঝুঁকে বলে উঠে
“ তেমন হলে বিয়ের এতদিন পরেও ভার্জিন থাকতে না নবনী৷ ”

স্নিগ্ধ সবেই ঘুমিয়েছে। অল্প থেকে অল্প কিছুর আওয়াজেই ঘুম ভেঙ্গে যায় বাচ্চা ছেলেটার। বড্ড ঘুম পাতলা বাচ্চা। সুহা স্নিগ্ধর ঘুমন্ত মুখটা এক পলকেই তাকিয়ে দেখে। অতঃপর ঘুমন্ত মুখটাতে দুটো চুমু আঁকল। ঠোঁটে হাসি রেখে বলল,
”আব্বুজান? তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাও তো। তোমায় নিয়ে শহর দেখা বাকি তো আব্বুজান। ”
স্বচ্ছ তখন দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। এতক্ষন যাবৎ খেয়াল করে যাচ্ছিল সুহার স্নিগ্ধাে ঘুম পাড়ানোর দৃশ্য। স্বচ্ছ হাসে। ছেলের যাতে ঘুম না ভাঙ্গে এইজন্য অতি সাবধানে পা ফেলে বিছানার কাছে এল।শান্ত গলায় শুধাল,
” ছেলের আব্বুও তো বেঁচে আছে। মাঝে মাঝে তার দিকেও তো একটু কৃপাদৃষ্টি রাখতে পারো সুহাসিনী। দুয়েকটা চুমুও তো দিতে পারো। কেন ছেলের আব্বুর বেলায় তোমার এত কিপ্টামো অভ্যেস? ”

সুহা তাকায়। হাসবে কি কাঁদবে বুঝে না। তবে স্বচ্ছর কথা আর মুখচাহনি দেখে তার সত্যিই পেট ফেটে হাসি পায়৷ বেচারা! বউ এর ভালোবাসা বিহীন থাকতে থাকতে মুখচোখ শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে যেন। সুহা হেসে শুধায়,
” কারণ ছেলের আব্বুকে যে ভালোবাসা দেওয়া হয়েছে তা এনাফ৷ তাকে আর ভালোবাসা দেওয়ার দরকার আছে বলে আমার মনে হয় না। এখন ছেলেকে ভালোবাসাটা গুরুত্বপূর্ণ! ”
কথাগুলো কেন জানি স্বচ্ছর পছন্দ হলো না। ভালোবাসার দরকার নেই মানে? সব ভালোবাসার সমাপ্তি ঘটেছে তাহলে? শুধাল,

“ আমায় তুমি কতদিন ভালোবাসার নজরে দেখোনি সুহাসিনী! অথচ বলছো যা দিয়েছো তা এনাফ? তবে কি আমার প্রতি ভালোবাসা সব শেষ? আর কখনো তোমার সে প্রেমময় রূপ আমি পাব না? নিষ্ঠুর তুমি! আমায় কষ্ট দিতে দুবার ভাবো না।”
কথাগুলো একটু জোরেই বলছিল স্বচ্ছ৷ সুহা বুঝে এই ছেলেটা বাচ্চাদের মতোই কষ্ট পায়, বাচ্চাদের মতোই তার ভালোবাসা চায় সর্বক্ষন। কিন্তু সে আসলে কষ্ট দিতে চায়নি। মজা করেই তো বলেছে। মৃদু স্বরে জানাল,
” ঘুম ভাঙ্গবে ওর। ”
স্বচ্ছর বড্ড রাগ হলো। তার কথার উত্তরে এই কথাটা নিশ্চয় প্রাপ্য নয়? বলল,

“ ভাঙ্গলে ভাঙ্গুক! ও ও দেখুক আমার প্রতি এই অবিচার। সবকিছু মেনে এসেছি। তোমার দূরে সরে যাওয়া, আমাকে দোষী মনে করে বারবার কষ্ট দেওয়া সব! আমি আশায় ছিলাম তুমি কোন একদিন আগের মতো হয়ে যাবে। আবার আমার আগের সুহাসিনী হবে। আমার দিকে প্রেমময় হাত বাড়িয়ে দিবে। কিন্তু আমি ভুল! রাইট? তোমার কথা দ্বারা তো এটাই বুঝায় বলো? ”
এটুকু বলেই হন হন করে সে বেলকনিতে গেল। নিশ্চুপ দঁাড়িয়ে থাকল। সুহা ততক্ষনে নিভু নিভু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।তারপর কি বুঝে ছেলেকে অতি সাবধানে দোলনায় রাখল। গুঁটিগুঁটি পায়ে বিড়াল ছানার মতো বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়াল স্বচ্ছর পিছনে৷ অতঃপর দুইহাত দিয়ে পেছন জড়িয়ে ধরল পুরুষটাকে। বলল,

“ স্বচ্ছ? ”
স্বচ্ছ উত্তর করে না৷ সুহা ফের বলে,
“ ছেলের আব্বুটাও ছেলের মতো বাচ্চা। এত বেশি বাচ্চামো চিন্তাধারা যে কোন কথার কি অর্থ কিছুই বুঝে না। ”
স্বচ্ছ এবারে গম্ভীর গলায় উত্তর করে,
“ছাড়ো সুহাসিনী। আমার কেমন জানি এক বিশ্রী অনুভূতি হচ্ছে। ছেড়ে দাও। ”
সুহা হতাশ স্বরে বলে,
“ আমি জড়িয়ে ধরাতে বিশ্রী অনুভূতি হচ্ছে? ”
“ জড়িয়ে ধরার আগ থেকেই।”
সুহা এবারে বলে,
” তাহলে যেভাবে আছি ওভাবেই থাকি।ছেড়ে দিলে যে বিশ্রী অনুভূতিটা কমে যাবে এমন তো নয়। ”
এটুকু বলেই ফের আবার বলে,
“ স্বচ্ছ? স্নিগ্ধকে দোলনায় দিয়েছি আজ। ”
” কেন? ”
সুহা হাসে। বলে,

“ তার মা ভেবেছে তার বাবার থেকে ভালোবাসা নিবে। দেওয়া যাবে ভালোবাসা? ”
স্বচ্ছ হুট করেই ফিরে চাইল। বরাবরের মতো না গলে শক্ত স্বরে জানাল,
”তুমি কি ভাবছো? ফিজিক্যাল রিলেশনের জন্য আমি অস্থির হয়ে আছি যে বাচ্চাকে দোলনায় ঘুম পাড়িয়ে আমি তোমায় কাছে টানব? ”
সুহা মিনমিনে দৃষ্টিতে তাকায়। বলে,
” তা কখন বলেছি? আমি নিজেই চাইছি আপনার কাছে আসতে। কাছে টানবেন না?”
শক্ত স্বরে উত্তর আসল,
“ না! ”

সুহার চোখমুখ টলমল করল প্রত্যাখানে। বলল,
“ কেন? ”
স্বচ্ছ উত্তর দিল,
“ সময় হোক, যেদিন তুমি সত্যিই আমার দিকে আবার আগের মতো প্রেম নজরে তাকাবে সেদিন কাছে টানব। ”
সুহা মুখ তুলে তাকায়। প্রশ্ন ছুড়ে,
“ প্রেম নজরে তাকাইনি বলছেন? ”

প্রেমের সমর সিজন ২ পর্ব ২৬

” এটা হয়তো বা একটু আগে আমার বলা কথাগুলোর প্রভাবেও হতে পারে। আমি প্রভাব খাটিয়ে কিছু করতে চাইছি না। ”
সুহা ফের দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল। মাথা গুঁজল স্বচ্ছর বুকে। হৃদস্পন্দন শুনতে শুনতে বলল,
“ আপনি আসলেই বাচ্চা স্বচ্ছ।প্রেমাস্পর্শ না দিন, কিছুটা সময় এভাবে জড়িয়ে ধরে থাকতে দিন। ”

প্রেমের সমর সিজন ২ পর্ব ২৮