প্রেম ও অসুখ পর্ব ২
নবনীতা শেখ
“প্রিয়তমা স্ত্রী আমার, মাথার ঘিলুটা কোন হাঁটে গিয়ে কয় টাকা দরে বিক্রি করে এসেছেন, কাইন্ডলি বলবেন? ফেরত নিয়ে আসা লাগবে। আফটার অল, বিয়ে করেছি, সংসারটাও করাই লাগবে। স্টুপিড মুরগী কোথাকার!”
ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকাল অদিতি। হতবিহ্বল আওয়াজ তার,
-“এ কে?”
-“আমার একুশ বছরের বড়ো বর মহাশয়!”
দুইজনে খপ করে বসে পড়ল বিছানায়। চোখ দুটোয় বিস্ময় ভাব কাটছে না। কিছু সময় নিঃস্তব্ধতার নামে কেটে গেলে প্রথম প্রশ্নটা অদিতিই করল,
-“নাম্বার পেল কীভাবে?”
-“যাকে বিয়ে করেছে, তার নাম্বারটা কীভাবে পেল? এটা একটু বেশিই বলদ টাইপের প্রশ্ন হয়ে গেল না?”
অদিতি ঠোঁট ওলটালো, মাথা নাড়ল,
-“হ্যাঁ। এখন কী করবি?”
-“জানি না।”
দু’জনেই ভীষণ হতাশ। ভীষণ মানে মারাত্মক হতাশ। তাদের হতাশা কাটছে না। কী করবে ভেবেই পাচ্ছে না। এরমধ্যে নির্দিষ্ট ভদ্রলোকের নাম্বার থেকে দ্বিতীয় টেক্সটটা এলো। ফোনের ভাইব্রেশনে অদিতি চমকে উঠল, হাত থেকে ফোনটা ছিটকে পড়ে গেল ফ্লোরের ওপর।
চিৎকার করে উঠল সাঁঝ, “শালি, কী করলি?”
সাঁঝ নিজের ফোনটা ওঠাল। কার্পেটের ওপর পড়ার দরুন আহামরি কোনো ক্ষয়ক্ষতি ফোনের হয়নি। তবে ডিসপ্লেতে জ্বলজ্বল করতে থাকা টেক্সটটা পড়ে সাঁঝ ফ্লোরের ওপরই বসে পড়ল৷ এটা দেখার আগে ফোনের গ্লাসটা ভেঙে গেলেই ভালো হতো না? ডিসপ্লে চৌচির হয়ে যেত। আর না-হয় তার কাজলকালো হরিণী চোখ দুটো কোনো এক বাঘ এসে গিলে খেয়ে ফেলত। দুটোর যে-কোনো একটা হলেই তো পারত। তবে এখন এটা দেখা লাগত না।
কী দেখা লাগত না? এই টেক্সটটা ছাড়া আর কী? সাহেবের দ্বিতীয় টেক্সটটা ঠিক এরকম ছিল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ফ্রিডম চাই? দিলাম। আগামী একবছর নিজের লাইফটাকে যেভাবে উপভোগ করার, করে নাও। কেউ আটকাবে না। কোনো সমস্যায় পড়বে না। আর তারপর তোমার লাইফের ওপর থেকে তোমার সম্পূর্ণ অধিকার কেড়ে নেওয়া হবে। তোমার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ আমার হবে।”
প্রথমবার পড়ে চরম পর্যায়ের হতাশ হলেও, দ্বিতীয়বার সে আবারও পড়ল। আর তারপর কোঁচকানো কপাল শিথিল হলো। ঠোঁটের কোনে এসে আঁটল এক স্মিত হাসি।
শেষোক্ত কথাগুলো খুব একটা আমলে আর নিল না সাঁঝ। একটা বছর তো পেয়েছে। এই একবছরে ঠিকই কোনো না কোনো কিছু ম্যানেজ করে নেবে। যেই বাড়ি থেকে একবার সে বেড়িয়ে এসেছে, সেই বাড়িতে সে দ্বিতীয়বার পা রাখবে না। রাখবে না, রাখবে না, রাখবে না। কখনো না।
দুইদিন আগের সাঁঝের থেকে বর্তমানের সাঁঝ সম্পূর্ণ পৃথক দুই মানবী এখন। বাবা-মা, ভাইয়া ছাড়া যেই মেয়েটা দু’কদমও ফেলতে পারতো না, দু’দিন ধরে তার সাথে তাদের কোনো যোগাযোগই নেই। দুইদিনের আগে অকারণেই সাঁঝ মাকে “আম্মা, ভাল্লাগে না” বলে ডাকত, ভাইয়ার পিছে পিছে ঘুরত। অথচ এখন সময় কতটা পালটেছে… আচ্ছা, তার ভাইয়া কি একটাবারও পারত না তাকে কল করতে? মা-বাবা? তাকে কি একটুও মনে পড়ছে না কারো?
দীর্ঘশ্বাসেরা বুকটাকে ভারি করে তুলছে। নিঃশ্বাস থেমে থেমে পড়ছে। আনমনা হয়ে বারান্দার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল সে। পরনে অদিতির একটা থ্রিপিস।
অদিতির বাড়ি আজ আনন্দ-উল্লাসে পরিপূর্ণ। ঢাবির রেজাল্ট দিয়েছে আজ। ভালো একটা পজিশন নিয়ে সাঁঝ আর অদিতি, দু’জনেই পাশ করেছে। আচ্ছা, সবকিছু ঠিক থাকলে সাঁঝও নিশ্চয়ই অনেক খুশি থাকত! পুরো এলাকায় তার বাবা আর ভাই মিলে মিষ্টি বিলাতো… অথচ কিছুই যেন হচ্ছে না! মনে শান্তি নেই।
অদিতি পেছন থেকে এসে সাঁঝের গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়াল। কাঁধে মাথা রেখে বলল,
-“খুব মন খারাপ?”
-“নাহ।”
-“তবে অল্প?”
-“হ্যাঁ। একটু।”
সেই একটুখানি বিষণ্ণতা অদিতির মনেও ছেয়ে গেল। তারপর আর তার কিচ্ছু ভালো লাগল না। নিশ্চুপ রইল কিছুক্ষণ। লক্ষ করা গেল, অদিতিরও শ্বাসগুলোও এখন দীর্ঘায়িত হয়েছে। সাঁঝের দুঃখের পরিমাণ একটু কমেছে, তাতে ভাগ বসেছে অদিতির।
দুঃখবিলাসের প্রথম শর্ত হলো একাকিত্ব। যখনই একাকী মুহূর্তগুলোয় আরেকটা মানুষের আগমন ঘটে, পরিপূর্ণভাবে দুঃখকে বিলাস করা যায় না। সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো সুখ সঙ্গসুখ, সবচেয়ে বড়ো লোভ সঙ্গলোভ, সবচেয়ে বড়ো দোষ সঙ্গদোষ।
সাঁঝ চোখ বন্ধ করে মনে মনে কিছু বিড়বিড় করল। আর তারপর অদিতিকে বলল, “জীবন উপভোগ করার জন্য সবচেয়ে বড়ো সুযোগ আল্লাহ আমাকে দিয়ে দিয়েছেন। আমার তো খুশি হওয়া উচিত।”
উৎফুল্ল হলো অদিতি, “হ্যাঁএএ! এটাই বোঝাতে চাইছিলাম।”
সরু চোখে তাকাল সাঁঝ, “বোঝাতে চেয়েছিলি? তুই তো একটা শব্দও করিসনি।”
-“তোর শোকে একটু নিরবতা পালন করতেছিলাম তো। তাই মনে মনে বলছি। তুই না শুনতে পেলে এটা তোর দোষ। তোর মন অপরিষ্কার।”
সাঁঝের মনের আকাশটা আচমকা পরিষ্কার হতে লাগল। একাকীত্বে গুমরে থাকা সাঞ্জিনা আফরিন অদ্ভুতভাবে টের পেল, সে মোটেও একা নয়।
মাসখানেকের মধ্যেই তারা কাঁটাবনের এক ছোট্ট দুইরুমের ফ্ল্যাটে উঠল। একরুমে মাস্টার্সের একজন আপু আছে, আর অন্যরুমটায় অদিতি আর সাঁঝ। সাশ্রয় তো হলো বটে! কিন্তু থাকা-খাওয়া ও অন্যান্য খরচের জন্য টিউশনি খোঁজা লাগবে।
এসব ভাবনার মাঝেই তার ফোনের ম্যাসেজ টিউন বেজে উঠল। অদিতির বেডশিট গোছানো হাত থেমে গেল। টেবিলের সাইডে বেজে ওঠা সাঁঝের ফোনের দিকে একবার তাকাল, তারপর পিছে ফিরে তাকাল সাঁঝের দিকে। মেয়েটা ফ্লোরে চিত হয়ে শুয়ে আছে, তাকিয়ে আছে সিলিংয়ের দিকে।
অদিতির তাকিয়ে থাকাটা সাঁঝের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় টের পাওয়ার সাথে সাথে সে চোখ ঘুরিয়ে তাকাল। দুইজনের চোখাচোখি হলো। চোখের ইশারায় অদিতি জিজ্ঞেস করল,
-“সে?”
শুয়ে শুয়েই ছোট্ট করে উপর-নীচ মাথা নাড়ল সাঁঝ। হ্যাঁ। সে-ই! বর মহাশয়! শুরুর দুইটা টেক্সট পেয়ে যখন ব্লক করে ফেলেছিল, পরদিনই আরেকটা নাম্বার থেকে কল আসে, সেই কলে থাকে বিরাট মাপের হুমকি। সেই হুমকিতে থাকে ছয়টা শব্দ। শব্দ ছয়টা হলো—ব্লক, করলে, বাড়িতে, এনে, বেঁধে, রাখব।
তারপর আর সাঁঝ সাহস পায়নি ব্লক করার। স্বভাবতই ভীতু ও পরনির্ভরশীল ধরনের মেয়ে সাঁঝ। তার সাথে কী যে হচ্ছে, এটাই তো বোঝা যাচ্ছে না। তার নাকি বিয়ে হয়ে গেছে! কী অদ্ভুত কথা! কী সত্য কথা! কী অনস্বীকার্য সত্য কথা!
সত্য যতই অস্বীকার করা হোক না কেন, তা তো আর মিথ্যে হয়ে যায় না। সাঁঝের অন্তরাত্মাও বোধ করি সে কথা মেনে নিয়েছে। আর তাই লোকটার বিশেষ পরোয়া করছে না, সেই সাথে বেপরোয়া ভঙ্গিমায় ব্লকও করতে পারছে না। এভাবেই চালিয়ে নিল তার বিবাহিত ব্যাচেলর লাইফের প্রথম দেড়টা মাস।
অদিতি ফোনটা তুলে সাঁঝকে দিয়ে নিজের কাজে মনোযোগী হয়ে উঠল। অতিষ্ঠ ভঙ্গিমায় সাঁঝ বলল,
-“এইটা ফ্রিডম? এটাকে কোন এঙ্গেল থেকে ফ্রিডম বলে বোঝা আমাকে!”
অদিতি কাঁধ উঁচিয়ে বলল,
-“যারটা তারেই জিগা।”
-“ধুর!”
সাঁঝ ফোন হাতে নিল। লোকটা তাকে রেগুলার টেক্সট দেয় না। মাঝেমধ্যে দেয়। সপ্তাহে একটা অথবা দুইটা। আর সেই দুয়েকটাতেও কিছু গোণা শব্দ থাকে মাত্র। আচ্ছা… লোকটার কি কথা বলতে কষ্ট হয়? নাকি ট্যাক্স বসানো আছে প্রতিটা শব্দে?
হাঁপ ছাড়ল। হাপিত্যেশ ছাড়ল না। নোটিফিকেশন থেকে দেখে নিল টেক্সটটা,
“আমার লিগ্যাল ওয়াইফ শুনুন, আপনার ছোট-বড়ো সকল দায়িত্ব আমার ওপর বর্তায়। নিজের হক বুঝে নিতে শিখুন।”
আর তারপরই দেখতে পেল বিকাশ থেকে আসা টেক্সট। রিসিভড মানি! ত্রিশ হাজার টাকা! সাঁঝ ত্বরিতে উঠে বসল। প্রচণ্ড চমকে গেলে মনটা তার বেখাপ্পা হয়ে যায়। মুখটা শত্রুতা ও শব্দগুলো বেঈমানী করে বসে। সে রিপ্লাই করল,
-“আমাকে টাকার গরম দেখাচ্ছেন, অমুক-তমুক.. হোয়াটেভার সাহেব? আপনি টাকা না দিলে না খেয়ে মরে যাব আমি? এ বেটা! আমাকে সুগার বেবি পেয়েছেন? আমার মোটেও ড্যাডি ইস্যু নেই। আপনি এই টাকাগুলো আপনার বউ-বাচ্চার পিছে ঢালেন গিয়ে। যান তো!”
সাঁঝ বুক ভরে শ্বাস ছাড়ল। তারপর আবার নিজের পাঠানো টেক্সটটা পড়ল। বেশি বেশি বলে ফেলেছে নাকি? নাহ! ঠিকই আছে। এমন লোককে এসবই বলা উচিত। এরা এরকম কথারই জাত।
ওপাশ থেকে কিছুক্ষণ পর রিপ্লাই এলো,
-“নির্বোধ!”
আর কিছু না। কেবল এটুকুই। এরপর আরও পাঁচ মিনিট সাঁঝ গোল গোল চোখে ফোনের দিকে তাকিয়ে রইল। নাম্বারটা সেভ করেছে “মিস্টার ড্যাডি” দিয়ে। কিছুটা মজার ছলেই করেছে অবশ্য। সে যাক! জনাবের মাপা কথায় অভ্যস্ত সাঁঝ এটুকু বুঝতে পারল, ওপাশ থেকে আর কোনো টেক্সট এখন আসবে না।
এরপর সাঁঝ নিজেই লিখল,
প্রেম ও অসুখ পর্ব ১
-“আপনার মনে হয় আমি এখান থেকে এক পয়সাও খরচ করব?”
-“অলরেডি ১০ টাকা করে ফেলেছো। দুই দফায় সেন্ড মানি করতে আমার ৫ টাকা করে চার্জ কেটেছে।”