প্রেম ও অসুখ পর্ব ৫

প্রেম ও অসুখ পর্ব ৫
নবনীতা শেখ

“মনে রাখি না। ভুলে যেতে পারি না… দুটো আলাদা।”
বাক্যটা কানে বাজছে সাঁঝের। মনটা আটকে আছে পড়ন্ত বিকেলের সেই নীলক্ষেতের বইয়ের স্তূপের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া লম্বাদেহী লোকটায়। কেমন অদ্ভুত লাগছে! ঝিমঝিম করছে মস্তিষ্ক, চোখ দুটো কোথাও স্থির হয়ে থাকতে পারছে না। বোধহয় অসুস্থ হয়ে পড়েছে। বাসায় ফেরার পথে প্রেসক্রিপশন মোতাবেক ওষুধ কিনে নিয়ে যেতে হবে! লোকটা ডাক্তার! কী শাণিত ও মানানসই ব্যক্তিত্ব!
ছি ছি! নিজের নির্লজ্জ চিন্তাভাবনার জন্য খুবই লজ্জিত বোধ করল সাঁঝ। এতবছর ধরে সামলে রাখা মনটা বেখাপ্পাভাবে টানাটানিতে পড়ে গেছে!
রাঈন ফুচকার প্লেট নিয়ে এসে পাশে বসল। ধ্যানমগ্ন হলো সাঁঝ। টিএসসিতে বসে আছে সে, সাথে তার মনোবিজ্ঞান বিভাগ থেকে প্রাপ্ত দু’জন বন্ধু আয়াত ও রাঈন। তাকে বার বার অন্যমনস্ক হয়ে যেতে দেখে আয়াত কপাট রাগ দেখিয়ে বলল,

-“এ ভাই! তোর সমস্যা কী? খুলে বলবি আমাদের? নয়তো সলভ করব কীভাবে?”
সাঁঝ সমস্যা খুলে বলতে পারে না। মলিন চোখে তাকায় ওদের দিকে। স্বামী নামক লোকটার সাথে সে যোগাযোগ বন্ধ করতে পারছে না না-কি মন চাইছেও না—এই ব্যাপারটা মোটেও পরিষ্কার নয় সাঁঝের কাছে। দ্বিধা-দৃঢ়তার দ্বন্দে পিষ্ট সাঁঝ। এত খারাপ লাগছে, এত অস্থির হয়ে আছে!
রাঈন বলল,
-“সাঁঝ, তোমার যে-কোনো সমস্যা হলে তুমি আমাদের জানাতে পারো।”
সাঁঝ জোরপূর্বক এক হাসির সাথে বলল,
-“আমার কাছে সবচেয়ে বেশি সমস্যা এই মুহূর্তে আমি নিজে। খারাপ লাগছে তাই।”
রাঈন আর আয়াতকে সাঁঝ সবটা বলেছে ইতোমধ্যে। এরপর এ কথা শুনে ওদেরও মন খারাপ হয়ে গেল। মন খারাপ ব্যাপারটা পরিষ্কার পানিতে এক ফোটা রঙের মতো.. পড়তে দেরি, চারপাশে ছড়িয়ে পড়তে তার সময় লাগে না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

হসপিটাল থেকে বাসায় ফিরে হৃদ ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় গিয়ে বসল। সন্ধ্যের পরবর্তী মুহূর্ত। পুরো বাসার লাইট নেভানো। একটা ছাইরঙা বিড়াল লেজ নাড়তে নাড়তে দৌড়ে গিয়ে হৃদের পা ঘেঁষে বসে পড়ল। হৃদ চমৎকার হাসল। বিড়ালছানাটাকে কোলে নিয়ে গায়ে আলতোভাবে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।
আদরে আহ্লাদে নুইয়ে কোলের মধ্যে মিশে গেল ইভ। হৃদের পোষা বিড়াল। ইভ অর্থ সন্ধ্যা। দেড়মাস বয়সে যখন ইভকে হৃদ এনেছিল, মেয়েটা তখন একটু বেশিই রূঢ় ও মুডি ছিল। এমন নাম যেন তার সাথেই যায়।
ইভের গায়ের উষ্ণতায় হৃদের সকল ক্লান্তি মুছে যায়। তার আর নিজেকে নিঃসঙ্গ লাগে না। একটা অদ্ভুত ও বিস্ময়কর লুকোনো সত্য মনে পড়তেই শান্তচোখে তাকায় হৃদ। চোখের কোণায় কুঁচকে থাকে হাসি। সম্মুখে ভেসে ওঠে বিয়ের দিনটা…

হৃদের মা আফিয়া বেগম ও সুমিতা বেগম স্কুলের সময়কার বান্ধবী। বয়স বাড়লেও, তাদের বন্ধুত্বটা থেকে যায়, গাঢ় হতে লাগে দিনকে দিন। মায়েদের বন্ধুত্বের মাঝ দিয়ে কীভাবে যেন সুমিতা আন্টির ছেলে অর্ণবের সাথেও হৃদের বন্ধুত্ব হয়ে গেল। অর্ণব এরপর নিজের বাড়ির চেয়ে হৃদের বাড়িতে থাকতে আনন্দ পেতে লাগল।
সময় কাটতে লাগল। হৃদের তখন বারো বছর বয়স, সুমিতা আন্টির বাড়িতে একটা ছোট্ট পুতুলের জন্ম হলো। হৃদ ও অর্ণব বিস্ময় নিয়ে বাচ্চাটাকে দেখতে লাগে। তাদের উচ্ছ্বাস আবেগ কোনোটাই প্রকাশ পায় না। কেবল দু’চোখে ঠিকরে বেরোতে লাগে মুগ্ধতা।
বাচ্চাটার নাম রাখা হলো সাঁঝ, অর্থাৎ সন্ধ্যা.. অনিন্দ্য সুন্দর সন্ধ্যা! তিন/চারটে বছর এভাবেই কেটে গেল। কথিত আছে, সময় ও স্রোতকে আটকে রাখা যায় না। সময় বহমান নদীর মতো এগিয়ে যায়। আর স্রোত যেন জীবন।
জীবনের পরবর্তী ধাপ অনুসরণ করে মাধ্যমিকের পরপরই হৃদ আর অর্ণব দু’জনেই ঢাকা শিফট হয়ে গেল। যাওয়ার আগে আফিয়া বেগম ভালোমতো হৃদের মাথায় গেঁথে দিলো,

-“বাবু, তোর জন্য আমি এক লক্ষ্মী মেয়েকে দেখে রেখেছি। ভুলেও অন্য কোনো মেয়ের দিকে তাকাবি না।”
হৃদ মায়ের কথা শুনেছে। পড়তে গিয়েছে, পড়াশোনার মধ্যেই আটকে থেকেছে। ওখানে কলেজের পড়াশোনা, নিজেদের নতুন জীবন.. সব মানিয়ে-গুছিয়ে চলার মধ্যে দিয়ে আর ছোট্ট সাঁঝের কাছে হৃদের ফেরা হলো না।
তারপর মাঝে দিয়ে কেটে গেল এতগুলো বছর। সাঁঝকন্যার তখন সর্বাঙ্গে কৈশোরের ছোঁয়া, যৌবনের ছলনা। মেয়েটাও যেন ঘরকুনো ভীষণ। বাইরের মানুষদের সাথে মিশতে পছন্দ করে না। বাড়িতে মানুষ এলে ঘর থেকে তো বেরই হয় না। যেই বিষয়টাতে সে নেই, সেই বিষয়টাতে আর আগ্রহ পায় না। দিন-দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণ পৃথক মেয়েটা কল্পনায় ভেসে বেড়ায় সারাটা সময়। এই যে, এত ভালোবাসে অর্ণব তার বোনকে! সেই অর্ণবের সাথেও সাঁঝ স্বাভাবিক না, মিশুক না।
বছর দুয়েক আগে ঈদের ছুটিতে যখন হৃদ বাড়িতে এসেছিল, সন্ধ্যায় চা খেতে খেতে আফিয়া বেগম বলে ওঠেন,

-“আব্বা, তোর বউ তো ঘরে আনার মতো বয়স হয়ে গেছে প্রায়। অপেক্ষা আর ভালো লাগে না।”
মায়ের ছেলেমানুষীতে হৃদ না হেসে পারে না,
-“তাই নাকি? আমিও দেখতে চাই আমার বউ কত বড়ো হয়েছে!”
আফিয়া বেগম এতগুলো বছরে এই প্রথম হৃদকে সাঁঝের ছবি দেখায়। ষোড়শী শ্যামকন্যা! গায়ে লাল শাড়ি, নীল ব্লাউজের সাথে আটপৌরে করে পরা। ছাদের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে, তাকিয়ে আছে মাথা বাঁকিয়ে ক্যামেরার দিকে। মুখে হাসি নেই, তবে চোখ দুটোতে কী যেন আছে। সর্বাঙ্গে উপচে পড়ছে স্বঅভিমান, সদ্য প্রস্ফুটিত ফুলের সুঘ্রাণ।
হৃদ তার গোটা পৌরুষ যেই মেয়েটার হেফাজতে রেখেছে, সেই মেয়েটাকে প্রথমবারের মতো দেখতে পেয়ে বুকের ভেতরটায় অদ্ভুত কিছু অনুভব করল। বুকেতে অসুখ, অনুভবে সুখ। এ কী জ্বালা!
সেই জ্বালা আরও বাড়িয়ে দিতেই মা বলে উঠল,

-“সাঁঝ!”
ছোটবেলার সেই প্রিয় পুতুলটার নাম অর্ণবের মুখে প্রায়শই নামটা শুনতে পায় হৃদ। তবে দেখতে আগ্রহ করেনি কখনো। অর্ণবও বাইরের কোনো পুরুষকে নিজের বোন দেখিয়ে বেড়ায়নি, সে যতই প্রাণের চেয়েও প্রিয় বন্ধু হোক না কেন! আর তাই হয়তো হৃদ বিস্ময়ের চূড়ান্তে,
-“আমাদের সাঁঝ?”
হৃদ বরাবরই কথাবার্তা মেপে-বুঝে বলে থাকে। তবে এখন চেনা-পরিচয়ের বেশ বাইরের এক মেয়েকে কীভাবে যে “আমাদের” বলে বিশেষায়িত করল—সে বুঝতে পারল না। ঠোঁট চেপে হাসল আফিয়া,
-“হ্যাঁ।”
হৃদ ছবিটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
-“ও তো অনেক বাচ্চা! আমার চেয়ে বারো বছরের ছোট না? এখন মাত্র ষোলো…”
-“তো? তাতে কী হয়েছে? তোমার বাবা আমার চেয়ে সতেরো বছরের বড়ো। তাই কি বিয়ে করিনি? সংসার হয়নি? সুখে নেই?”

-“আমি তা বলছি না।”
আফিয়া বেগম চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলল,
-“বললেই বা কী? তোমার কথা যেন আমি খুব শুনব?”
-“আচ্ছা.. আন্টি-আঙ্কেল জানেন?”
-“কে? সুমিতা আর ভাইয়া?”
-“হুঁ।”
-“হ্যাঁ, সেই একযুগ আগেই তাদের কাছে সাঁঝকে চেয়ে রেখেছি।”
-“তারা রাজি?”
-“হ্যাঁ। রাজি না-হওয়ার প্রসঙ্গই ওঠে না। আমার অমন সোনার টুকরো ছেলে…”
এ কথা বলে আফিয়া বেগম হৃদের থুতনিতে নিজের হাতের আঙ্গুল ছুঁইয়ে এনে চুমু খেল। হৃদ মাথা নেড়ে বলল,
-“আমার কলজে পানি করা বন্ধুটা জানে?”
-“নাহ। আমরা বড়োদের মধ্যেই রেখেছি এসব কথা।”
-“আর তোমার বৌমা?”

-“এখনো না। আমার তো ওকে দেখলেই সব বলে দিতে ইচ্ছে করে। মাঝেমধ্যে তো মুখ ফসকে বলেও ফেলি, তোকে আমি আমার বাবুর বউ বানাব। শুনে হাসে খালি। পাত্তাই দেয় না মেয়েটা!”
হৃদ হেসে ফেলে,
-“সদ্য মেট্রিক পাশ করা মেয়েটা কলেজ পাড় করে নিক। আগেই বিয়ের ভূত চাপিয়ো না।”
আফিয়া বেগম বহু কষ্টে এরপরের দু’বছর সাঁঝের সামনে নিজেকে সংযত করেছে। নয়তো সাঁঝকে নিজের বৌমা হিসেবে লিখে নিতে তার সংযম চন্দ্রভ্রমণে গিয়ে আটকা পড়ে থাকে…
ধীরে ধীরে কলেজ পেরোল, ষোড়শী সাঁঝ অষ্টাদশী হয়ে উঠল। এরমধ্যে পরিবর্তন কেবল এটুকুই যে, ব্যাপারটা অর্ণব আর হৃদ জেনে গিয়েছে। হৃদ এখন মেয়েটার ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়, খোঁজ নেয়, কখন কী করছে এসব জানার চেষ্টা করে। তার ব্যস্ত জীবনের বেশ বড়ো একটা সময় গোছাতে শুরু করেছে তার বউকে দেওয়ার জন্য।
বিয়ের একমাস আগে সাঁঝকে সব জানানোর পরিকল্পনা করা হলো। অথচ আটপৌরে সাঁঝকে নিয়ে হৃদের আলাদাই পরিকল্পনা। একদম অল্প মানুষদের নিয়ে ঘরোয়া বিয়ে, বিয়ের কনে নিজেও চমকে যাবে এমন কিছু, একটা অকস্মাৎ গল্পের প্রারম্ভ…

বিয়েটা হলো। অথচ গল্পটা মোড় নিল অন্যদিকে। রুমের এককোণায় লাগানো সিসিটিভি ক্যামেরার দরুণ, হৃদ বাগানের একসাইডে বসে সাঁঝের মতিগতি দেখছিল আর হাসছিল। ঘুমের ওষুধ মেশালো? শেষে কি-না ছুরিও নিয়ে হাতের কাছে রাখল? কী ঝাঁজ! বাপরেহ!
হৃদ গিয়ে তাই সরাসরি কথা না বলে একপাশে শুয়ে পড়ল। গতরাতে ডিউটি করে সেদিন সকালেই সে টাঙ্গাইল এসেছিল, আর বিয়ের ধকল.. সব মিলিয়ে ক্লান্ত হৃদ মুহূর্তের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল।
আর তারপর যা হলো, তা কি কেউ কল্পনা করেছে? নির্বোধ মেয়ে! তাকে দেখে কি সত্যিই বাপ-বাপ টাইপের কোনো ব্যাপার পাওয়া যায়? কী দেখে চিরকুটে বলল, বিবাহিত কাকু? আর তারপর তার ঘুমেত সুযোগ নিয়ে পালিয়ে গেল? মানে সিরিয়াসলি! কী আশ্চর্য!

বহু ধকল গেল হৃদের। বাড়িতে, শ্বশুরবাড়িতে না চাইতেও সব জানানো লাগল। মেয়েটা স্বাধীনতা চাইছে। সেটা নিশ্চিত করতে যা যা করা লাগে, সম্ভাব্য সবকিছুই হৃদ করল। আর তারপর নিজেই সাজিয়ে ফেলল সাঁঝের পরবর্তী পদক্ষেপগুলো। মেয়েটা না চাইতেও এখন তার কথাতেই চলছে, চলবে…
ইভ ঘুমিয়ে গেছে কোলে। হৃদ তাকে আলতো হাতে জড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। রুম থেকে ফোন নিয়ে ফের বারান্দায় পা বাড়াল, হাতের আঙ্গুল চলে এলো রিসেন্ট ডায়ালে। সবচেয়ে ওপরে সেভ করা আছে “সন্ধ্যা” নামটি। হৃদ কল লাগাল। রিং হতে লাগল। একটা, দুটো, তিনটে..
চতুর্থ রিংয়ে সাঁঝ কল রিসিভ করল। রেলিংয়ে ঝুঁকে দাঁড়াল হৃদ। চারতলা বিল্ডিংয়ের চতুর্থ তলায় সে থাকে, তৃতীয় তলার কোণাকুণি বারান্দায় তার চোখ আটকে রইল। সেকেন্ডের মধ্যে সেখানে কিছু কৌতূহলী কদম এগিয়ে এলো। চঞ্চল নারী শরীরটাও রেলিং ছুঁয়ে দাঁড়াল।
বাতাসে ভেসে আসছে বারান্দার টবে লাগানো বেলি ফুলের ঘ্রাণ। অগ্নিকন্যা বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলে, কাঠকাঠ গলায় বলে উঠল,

প্রেম ও অসুখ পর্ব ৪

-“অসহ্য! কল দিয়েছেন কেন? কী সমস্যা? রাতে খেয়েছেন?”
নৈঃশব্দ্যে হাসতে লাগল হৃদ।

প্রেম ও অসুখ পর্ব ৬