প্রেম ও অসুখ পর্ব ৬
নবনীতা শেখ
চতুর্থ রিংয়ে সাঁঝ কল রিসিভ করল। রেলিংয়ে ঝুঁকে দাঁড়াল হৃদ। চারতলা বিল্ডিংয়ের চতুর্থ তলায় সে থাকে, তৃতীয় তলার কোণাকুণি বারান্দায় তার চোখ আটকে রইল। সেকেন্ডের মধ্যে সেখানে কিছু কৌতূহলী কদম এগিয়ে এলো। চঞ্চল নারী শরীরটাও রেলিং ছুঁয়ে দাঁড়াল।
বাতাসে ভেসে আসছে বারান্দার টবে লাগানো বেলি ফুলের ঘ্রাণ। অগ্নিকন্যা বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলে, কাঠকাঠ গলায় বলে উঠল,
-“অসহ্য! কল দিয়েছেন কেন? কী সমস্যা? রাতে খেয়েছেন?”
নৈঃশব্দ্যে হাসতে লাগল হৃদ। মেয়েটা স্থির নেই, ক্রমাগত ফুঁসছে, অশান্ত পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে পুরো বারান্দাজুড়ে। হৃদের চোখ সেখানে আবদ্ধ, কণ্ঠ ধীর ও কর্কশ,
-“খাইনি।”
থমকাল সাঁঝ, পা থেমে গেল একজায়গায়, নিচু স্বরে শুধাল,
-“খাননি? কেন খাননি? কী আশ্চর্য! আপনার বউ কই? খেতে দেয়নি? বউ এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন হলে জামাই আরেকটা বিয়ে কেন করবে না? ঠিকই আছে।”
-“বউ?”
-“আপনার।”
-“তুমি।”
-“কী? ওহ! আমিও তো বউ। কিন্তু আমি দুই নাম্বারটা। এক নাম্বারে যে আছে… এই একটা সত্যি কথা বলুন তো!”
-“কী?”
সাঁঝ বড়ো করে শ্বাস ফেলল। অকস্মাৎ মনটা কেমন হু হু করে কেঁদে উঠল। বিস্মিত হলো সে, চমকে গেল। গলার এখানটায় দলা পাকিয়ে রয়েছে কান্নারা। বার বার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকা অগোছালো শব্দগুলো বড়ো বেঈমানী করে প্রকাশ্যে চলে এলো,
-“আপনি.. আপনি কেন আমাকে বিয়ে করলেন! একটা মেয়ের বিয়ে নিয়ে কত স্বপ্ন থাকে.. আমি একটা নরমাল লাইফ চেয়েছিলাম। সবটা জুড়ে আমার হাজব্যান্ডকে ভালোবাসব বলে আজ অবধি প্রেমের সম্পর্কেও জড়াইনি.. বুঝতে পারছেন?”
সাঁঝের অগোছালো শব্দগুচ্ছ, হৃদের মনটা অশান্ত করে তুলল। বাহ্যিকতার বড়ো শীতল অনুভূতিবিশিষ্ট হৃদের আওয়াজ অব্যাকুল, ধীর,
-“পারছি।”
সাঁঝ ঘুরে দাঁড়াল। রেলিংয়ে ঠেকল কোমর। মাথা একটু পেছনের দিকে ঝুঁকিয়ে নিল। বন্ধরত চোখ তার। হৃদ এই মুখটার দিকে তাকিয়ে রইল। বড়ো অপরাজিত মুখাবয়ব মেয়েটার। সে স্মিত হাসল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-“পারছেন না। পারলে এরকমটা করতেন না।”
-“কী করেছি?”
আকাশে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ। ধীরে ধীরে সরু হবে, শাণিত হবে। এমনই শাণিত এক হাসি সাঁঝের ঠোঁটে এঁটে গেল। সে চোখ খুলল। হৃদ সড়ে গেল দু’কদম পিছিয়ে।
সাঁঝ চাঁদের দিকে স্থির তাকিয়ে, কিছু ফিসফিসানো স্পষ্ট শব্দে বলে উঠল,
-“কী করেননি? আমার এত শখ, এত স্বপ্ন সব তিন কবুলে ভেঙে দিলেন।”
হৃদ সাঁঝের ভুল ভাঙাল না। সময়কে সময় দিলো আর নিজের সাথে নিজে করে নিল এক অদ্ভুত ওয়াদা।
আচমকা হাওয়া বদলের সাথে প্রকৃতি এক ঝুম বৃষ্টি নামাল। ইভের ঘুম ভেঙে গেল, সে হৃদের কোল থেকে নেমে আড়মোড়া ভেঙে রুমের ভেতর চলে গেল। সাঁঝের মনের বিষণ্ণতা ও সকল তৎপরতা কখন যে বর্ষণে ধুয়ে গেল! কখন যে মন খারাপেরা “মন ভালো” হয়ে গেল! সাঁঝ টের পেল না।
বৃষ্টি তার সমগ্র মুখ ছুঁয়ে গেল। সে ঠিক হয়ে দাঁড়াল। রেলিংয়ে একহাত রেখে, অন্যহাত সামনে বাড়িয়ে দিলো। ওপর থেকে হৃদও নিজের হাত এগিয়ে দিলো। বৃষ্টির জল তাদের হাত ছুঁয়ে যাচ্ছে, গায়ে মেখে যাচ্ছে। সদ্য করা ওয়াদাটা হৃদ পুনরায় বিড়বিড় করে উঠল,
-“প্রিয়তমা স্ত্রী আমার, তোমার ছোট-বড়ো সকল স্বপ্ন পূরণের দায়িত্ব নিলাম। তোমার ঠোঁটের স্থায়ী হাসির দায়িত্ব নিলাম।”
হাওলাদার ভিলা আজ ভীষণ থমথমে। বাড়ির কর্তা আরিফ সাহেব সংবাদপত্র হাতে বসার ঘরে বসে রয়েছেন। ছোট হাওলাদার সাহেব বৃষ্টি গায়ে মেখে বাড়িতে প্রবেশ করল এই মাত্র। রান্নাঘর থেকে সুমিতা বেগম সব গতিবিধি লক্ষ করছেন। অর্ণবকে নিজের রুমের দিকে যেতে দেখে তিনি দ্রুত হাতে চুলার আঁচ বন্ধ করে দিলেন। তটস্থ পা তার রুমের দিকে চলমান হলো।
অর্ণব ফ্রেশ হয়ে রুমে এসে নিজের মাকে বসে থাকতে দেখে নিজ থেকেই বলল,
-“ভালো আছে।”
তবু মায়ের মন। এক কথায় নিশ্চয়ই শান্ত হবে না। চোখ দুটো কেমন ছলছল করে উঠল তার। গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল না। শ্রান্ত গলায় শুধালেন,
-“পড়াশোনা কেমন চলছে?”
-“চলছে, আম্মা।”
-“কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?”
-“না, আম্মা। ওরা সবাই খেয়াল রাখছে। হৃদও দেখছে। চিন্তা কোরো না।”
-“চিন্তা করব না?”
সুমিতা বেগম তাকিয়ে রইল অর্ণবের দিকে। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রুতে বিচলিত হলো অর্ণব। এগিয়ে এলো সে। হাঁটু মুড়ে মায়ের সামনে বসল। চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
-“জানোই তো সাঞ্জি কেমন। অল্প একটু সময় দাও, সব ঠিক হয়ে যাবে।”
-“তা ছাড়া আর তো কিছু হাতে নেই।”
চোখের আরেক ফোটা অশ্রু পড়তেই সুমিতা বেগম নিজেই তা আঁচলের সাহায্যে মুছে নিয়ে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে চলে গেলেন। অর্ণব হতাশ চোখে তাকিয়ে রইল। কিছু ভাবল। আর তারপর নিজের ফোন খুঁজতে লাগল। কল লাগাল স্বল্পপরিচিত এক নাম্বারে৷
ও-ধারে যেন ফোন হাতে নিয়েই বসে ছিল অদিতি। সাঁঝ নিজের রুমে ঘুমিয়ে পড়েছে। অদিতি পূর্বিকা আপুর রুমে বসে আছে। অর্ণবের কল আসতেই বুকের ভেতরটা প্রথমে কেমন ধুক করে ওঠে। হাত কাঁপতে লাগে। পূর্বিকা ওর অবস্থা দেখে না হেসে পারে না। আলগোছে উঠে দাঁড়ায়, হাস্যমুখে বলে,
-“চা খাবে? বানিয়ে আনি?”
মাথা নাড়ে অদিতি। পূর্বিকা যেতেই কল রিসিভ করে। কাঁপা-কাঁপা গলায় সালাম দেয়,
-“আসসালামু আলাইকুম, অর্ণব ভাইয়া।”
অর্ণবের গম্ভীর কণ্ঠ,
-“ওয়ালাইকুমুস সালাম। কী অবস্থা?”
অদিতির শ্বাস আটকে যায় গলাতেই। হাত উঠে আসে বুকে। চাহনি এলোমেলো। চিন্তা-ভাবনা অগোছালো। সে অশান্ত আওয়াজে বলে,
-“জ..জি! ভালো!”
-“সাঞ্জি কই?”
-“ঘুমাচ্ছে, ভাইয়া।”
-“খেয়েছে রাতে?”
-“হ্যাঁ।”
-“কান্নাকাটি করে?”
-“না.. ভাইয়া।”
-“আচ্ছা।”
আর তারপর সব চুপ, সব শান্ত। কেউ কোনো কথা বলছে না। কোথায় যেন একটা মাছি উড়ে বেড়াচ্ছে, তার শব্দে বিরক্তবোধ করল অদিতি। কিন্তু সামনের মানুষটার উপস্থিতিতে বিরক্তিভাবটা বেশিক্ষণ টিকতে পারল না। বুক ভরে শ্বাস টানল সে। বড়ো সাহস সঞ্চয় করে ডাকল,
-“অর্ণব ভাইয়া!”
-“হু? তুমি ভালো আছো?”
শেষ! শেষ! শেষ! অদিতি মারা পড়ল। এই কঠিন পুরুষটার নরম স্বরে যে তার হৃৎপিণ্ডটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। সে শ্বাস নিতে পারল না। ফোন হাত থেকে পড়ে গেল বিছানার একপাশে। সে বালিশে মুখ গুঁজল। হাসি-কান্না মিশেলের এক অদ্ভুত চাপা অনুভূতি। দম যায় যায়!
ওধারে অর্ণব দু’তিনবার হ্যালো বলেও অদিতির আর কোনো সাড়া পেল না। এরকম হুটহাট গায়েব হয়ে যাওয়ার পুরোনো স্বভাব মেয়েটার আছেই।
হৃদ চেম্বারে বসে রোগী দেখছিল। মহিলা রোগী, নাম আতিকা, বয়স একুশ, সর্দি-জ্বরের সমস্যা। সে কিছু টেস্ট লিখে দিলো।
ভদ্রমহিলার সাথে তার সাড়ে তিন বছর বয়সী কন্যা আদিবা দাঁতফাঁকা হাসিতে টেবিলের ওপর এটা-ওটা ছুঁইছে। আতিকা বিশাল এক হাসি নিয়ে বলা শুরু করল,
-“ডাক্তার সাহেব, এটা আমার মেয়ে। আদিবা মেহরিমা আয়শা বিনতে রাকিব। সামনের বছর স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিব। এই আদি বুড়ি, ডাক্তার সাহেবকে সালাম দাও।”
আদিবা সালাম দিলো,
-“আসসামু আইকুম। বাবা, কোলে!”
থতমত খেয়ে গেল হৃদ। বাবা! কী বলে মেয়েটা! মেয়ের মা বোধহয় লজ্জা পেল একটু,
-“আসলে ওর বাবা সাদা শার্ট পরে তো তাই মেয়ে আমার সাদা শার্ট পরা মানুষ দেখলেই নিজের বাবা ভেবে নেয়। কিছু মনে করবেন না।”
হৃদ ওপর-নীচ মাথা নাড়ল,
-“ইটস ওকে।”
আতিকা মেয়েকে বোঝাল,
-“বাবা এখন ব্যস্ত। বাবা কোলে নিতে পারবে না। তুমি এই কলম দিয়ে খেলো।”
এমন সময় হৃদের ফোনে কল এলো। সন্ধ্যা! সন্ধ্যাবতী! মেয়েটা দিনদিন সময়জ্ঞান ভুলে বসেছে। বলা নেই, কওয়া নেই, কল দিয়ে বসে। এরপর ভুলভাল বকতে থাকে। ওর কলের পেছনের কোনো শক্ত কারণ থাকে না। যখনই মুড খারাপ থাকে, ভংচং বলতে কল দিয়ে বসে। সম্ভবত সাঁঝের কাছে হৃদ নিজের ব্যক্তিগত ডায়ারি। যাকে যা খুশি বলা যায়, কষ্ট পাবে কি না ভাবা লাগে না, অনুশোচনা আসে না। হৃদ এটুকু উপভোগ করে, আনন্দ পায়।
হৃদ কল রিসিভ করল। ওপাশ থেকে ক্ষেপে আগুন সাঁঝ, ঝাঁজালো গলায় বলে উঠল,
-“আপনি.. আপনি একটা যা-তা! আপনার যা-তা মার্কামারা দেশের গুষ্টিকিলাই! আজকে আপনার মতো দেখতে কিছু লোক এসে আমার পার্স চুরি করে নিয়ে গেছে। মোট সাঁইত্রিশ টাকা ছিল। কুড়ি টাকা, দশ টাকা, পাঁচ টাকা ও দুই টাকার একটা করে নোট ছিল। পার্স কিনেছিলাম নিউমার্কেট থেকে, একশ টাকা দিয়ে। মেজাজটা যে কী খারাপ হয়ে গেছে! শালা চোরের চোর, তোর বউ যেন তোর আরেক চোরাই বন্ধুর সাথে পালিয়ে যায়! উফ! অসহ্য!”
সব শুনল হৃদ। ধীর আওয়াজে বলল,
-“ম্যাডাম, শান্ত হন। আপনি ঠিক আছেন? কোথাও লেগেছে?”
-“লেগেছে? কোথায় লাগেনি বলেন। মস্তিষ্কে যেন বোম ফেটেছে। টগবগিয়ে ফুটছে। মনটা ব্যাগ আর টাকার শোকে কাঁদছে। হাত-পা মারাত্মক বিষ। চোরের পিছে দৌড়াতে দৌড়াতে কারওয়ান বাজার অবধি চলে গেছিলাম। শালারে পাইলামই না।”
আতিকার বাচ্চা আদিবা তখন লাফিয়ে হৃদের কোলে আসার জন্য হাত বাড়িয়ে বলল,
-“বাবা, বাবা! কোলে কোলে!”
সাড়ে সর্বনাশ! ও-ধারে চমকে উঠল সাঁঝ,
-“এ বেটা, তুমি বাচ্চা কোলে নিয়ে আমার সাথে গল্প করতেছো? তোমার বাচ্চার সাথে আইসক্রিম নিয়ে কাড়াকাড়ি লাগানোর বয়স আমার? বিয়ের পর জামাই নিয়ে আইসক্রিম শেয়ার করার বয়সে তার বাচ্চার সাথে ভাগাভাগি করা লাগবে? এমনই কপাল আমার?”
হৃদ বলল,
প্রেম ও অসুখ পর্ব ৫
-“সেরকম না আসলে..”
-“তো কী রকম কী? নিজের কানকে অবিশ্বাস করব যে আঠারোটা বছর ধরে আমাকে সঙ্গ দিয়ে গেছে?”
এমন সময় আতিকা বলে উঠল,
-“একটু কোলে নিন না! কতক্ষণ ধরে বাচ্চাটা যেতে চাইছে!”
সাঁঝ দ্বিগুণ ক্ষেপে উঠল,
-“ওশশশালা! তুমি বউকেও কোলে বসিয়ে রাখছো?”
হৃদ এখন কী করবে? পড়ল না মাইনকার চিপায়?