প্রেম ও অসুখ শেষ পর্ব
নবনীতা শেখ
কাজি অফিসের পার্শ্ববর্তী রেস্টুরেন্টে বসে আছে পূর্বিকা। তার একপাশে সাঁঝ ও অন্যপাশে হৃদ। সামনের চেয়ারটিতে পায়ের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে উদয়। হৃদ গলার স্বর যথাযথ নমনীয় করার প্রচেষ্টায় কেশে উঠল,
-“আমাদের… আমাকে বললে হতো না? আমি মানতাম না? ইচ্ছে করছে কানের ওপর ঠাটিয়ে লাগাই দুটো চড়।”
যতই শান্তিপূর্ণ সংলাপ প্রদানের চেষ্টা করুক না কেন হৃদ, বেরোল তো ধমকের সুরে কিছু ঝাঁঝ! তাতে আবার উদয় কিচ্ছু মনে করল না। আনমনে মাথা নেড়ে বলল,
-“হ্যাঁ, হতো বললে। হতো কী..বলি? বলি বলি?”
হৃদ চোখ রাঙাল। উদয় চোখ-মুখ কুঁচকে হেসে বলল,
-“আ’ম এডাল্ট, ব্রো। যাকে ভালোবাসি, তাকে ধরে রাখবো না-কি আঁটকে রাখবো.. সেটার দায়িত্ব স্রেফ আমার ওপর। এখানে আমি আর পূর্বিকা বাদে পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষ থার্ড পার্সন। ভালোবাসায় তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতি কাজের কিছু না। যা আমার, তা আমারই।”
উদয় একটুখানি থামল। একঝলক পূর্বিকার লাল হয়ে যাওয়া মুখটা দেখে নিয়ে ফের বলল,
-“যদি অন্য কাউকে বিয়েটা করে নিতেন উনি.. খুন করে লাশটা বেডরুমে সাজিয়ে রাখতাম। তবু আমার করে রাখতাম। দ্যাটস ইট ব্রাদার। আর কিছু বলবা? আর কিছু? তাহলে আজ ঘুমাই, কাল বইলো। এই মেয়ের যন্ত্রণায় কতরাত যে ঘুমাতে পারি না!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
হৃদের রাগ এক নিমিষেই গায়েব হয়ে গেল। উদয় একবিন্দু ভুল কিছু বলেনি। কোনো এক মনিষী বলেছিলেন, প্রেম ও যুদ্ধে সব জায়েজ। এক্ষেত্রে উদয়ের কাজটা কোনোদিক থেকেই নাজায়েজ নয়। শুধু বিয়েটাই তো করেছে। ভালো কাজ করেছে। কাজের কাজ করেছে।
হৃদ ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে পূর্বিকার দিকে তাকাল, ঠোঁট চেপে বলল,
-“পূর্বিকা, কিছুক্ষেত্রে বয়স খুব একটা ম্যাটার করে না। হোপ সো তুমি জিতে গেছো। বাকিটা নিজেরা বোঝাপড়া করে নাও। চলো সাঁঝ, আমার ময়মনসিংহে ফিরতে হবে আজ, রেস্ট নেব একটু।”
হৃদ ও সাঁঝ প্রস্থান ঘটাতেই উদয় পূর্বিকার মুখোমুখি থেকে উঠে পাশে গিয়ে বসল। খপ করে ধরল নরম হাতটা। পূর্বিকা নড়েচড়ে বসল, তবে হাত ছাড়ানোর বিন্দুমাত্র প্রচেষ্টা করল না। আশানুরূপ প্রতিক্রিয়া দেখতে না পেরে টেবিলের দিকে ঝুঁকে গেল উদয়, ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি,
-“হাত ছাড়ালেন না? একটা থাপ্পড় লাগান তো আমার গালে। এই যে, এই গালে।”
ডান গালটি এগিয়ে দিলো উদয়। পূর্বিকা অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
-“হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলে, ছাড়তে?”
টেনে-টেনে বলল উদয়,
-“ক-ক্ষ-ন-ও না।”
-“তাহলে?”
হাসি সরছেই না উদয়ের। সে বিশ্বজয় করে ফেলেছে যেন। উঁহু, পূর্বিকাকে জয় করে ফেলেছে। এখন বাকি আছে পূর্বিকার মনটা, সেটাও সে পেয়ে যাবে। কিংবা বলা যায় পেয়ে বসে আছে, কেবলমাত্র বয়সের দোহায় দিয়ে যা মানতে নারাজ পূর্বিকা। উদয় সেটা জানে এবং বোঝে। মুচকি হেসে সে টেবিকে হেলান দেওয়া অবস্থায় পূর্বিকার দিকে তাকাল,
-“একটা মিষ্টি সত্য শুনবেন?”
-“যদি বলি শুনব না…তাহলে কি বলবে না?”
-“বলব। তবু বলব। শুনুন পূর্বিকা, পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্টি সত্য হলো…”
থেমে গেল উদয়, ভ্রু সামান্য উঁচিয়ে ঠোঁটে পূর্বের হাসি বজায় রেখে বলল,
-“আপনি আমার।”
রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে সাঁঝ বলল,
-“দেওর উচ্ছন্নে গেছে আমার। কেমন বেয়াদবি করল! আজকের ঘটনাটা সলভ হোক, ওকে তো দেখে নেব।”
সাঁঝের কথাগুলোর মাঝেই হৃদের ফোনে উদয়ের একটা টেক্সট এলো,
-“ভাইয়া সরি, বুঝোই তো নতুন বিয়ে করেছি। একটু পার্ট নিলাম। কিছু মনে কইরো না। বাড়ি গিয়ে ভাবির সাথে চিল করো। আমি ম্যাডামের একটু বকা খেতে থাকি। সত্যি বলতে, বিয়ে ব্যাপারটা ভালোই মজার।”
উদয়ের টেক্সটটা দেখে হেসে ফেলল হৃদ।
-“অর্ণব ভাই? আপনার কী মনে হয়? সুখ ও অসুখ! জীবনে কোন জিনিসটা বেশি ভোগায়?”
টাঙ্গাইল স্টেশনের পাশে বসে অর্ণবকে এই প্রশ্নটা করে অদিতি কেমন চুপ হয়ে গেল। আর একটা কথাও বলল না। উত্তরের আশায় যে আছে—ব্যাপারটা এমনও না। শুধু একটা প্রশ্নের মতো…ঠিক প্রশ্নও না, প্রশ্নের মতো করে কিছু বলার ছিল আর এই যা।
রেললাইন দিয়ে হাতে-হাত রেখে এক প্রেমিকযুগল হাঁটছে, কখনো থামছে, হাসছে, পড়ে যাবে যাবে করেও ঠাঁয় দাঁড়িয়ে হাসছে.. আচমকা ট্রেইনের হুইসেল বাজল। ছেলেটা আলতো করে মেয়েটাকে স্টেশনের ভেতরে নিয়ে এলো। অর্ণব সেদিকে স্থির তাকিয়ে থেকে সেই তথাকথিত প্রশ্নের উত্তরে বলল,
-“সুখ।”
অদিতির তৃষ্ণার্ত মনটা এবার ব্যাখ্যা জানার তাগিদে ছটফট করতে লাগল। চোখ দুটো গিয়ে স্থির হলো অর্ণবের চোখে, এরপর ঠোঁটে! অর্ণব নিজ উদ্যোগেই বলল,
-“যদি সুখটা আরেকটু কম পেতাম, তবে হাজারগুণ বেশি দুঃখও সয়ে নিতাম।”
অর্ণব একটু জিরিয়ে নিল। দোকান থেকে কিছুক্ষণ আগে কিনে আনা পানির বোতলটা অদিতি অর্ণবের দিকে এগিয়ে দিলো। ম্লান হেসে বোতলটা নিয়ে পানিটুকু খেয়ে নিল সে। তারপর বলল,
-“ফর এক্সাম্পল, একজন ফেইল করা স্টুডেন্ট কোনো এক্সামে পাস করে গেলেই খুশি হয়। অন্যদিকে যে বরাবরই টপ করে এসেছে, সে এক্সামে টপ করার পরও একশ’তে নিরানব্বই পেয়েছে বলে কষ্ট পায়।”
স্মিত হাসল অদিতি,
-“চাহিদা কম থাকার সাথে সুখের সমঝোতা?”
-“শতভাগ।”
-“হু, হয়তো।”
ট্রেইন ছাড়বে এখন। অদিতির যেতে হবে। এমন মুহূর্তে অর্ণব হুট করেই জিজ্ঞেস করে বসে,
-“তোমার কাছে এর উত্তর কোনটা?”
-“কীসের উত্তর?”
-“জীবনে কোনটা বেশি ভোগায়? সুখ না-কি অসুখ?”
অদিতি জবাবে হেসে বলে,
-“উত্তরটা পরবর্তী সাক্ষাতের জন্য তোলা রইলো। আমার মনে হচ্ছে, পর্যাপ্ত দুঃখ আপনি পেয়েছেন। যথেষ্ট অপেক্ষা আমি করেছি।”
ট্রেইন ছেড়ে দিয়েছে। পিছে না তাকিয়েই ট্রেইনে উঠে পড়ল অদিতি। ভেতরে গিয়ে সিটে বসল না। দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে রইল। তবে মানুষটার দিকে আর তাকাল না। অদিতির ঠোঁটে হাসি, চোখে অশ্রু, কণ্ঠে ফিসফিসানো বুলি,
-“অর্ণব ভাই, আমার কাছে এর উত্তরটা ভিন্ন। আজন্ম দুঃখীও যদি কোনোদিন সুখের পরশ পেয়ে যায়, পরবর্তী দুঃখ সে সইতে পারে না। অথচ সুখ-অসুখ.. কোনোটাই আমাকে এতটা ভোগায়নি, যতটা..”
অদিতি থামল। মাথাটা আলতো করে ধাতব কাঠামোয় এলিয়ে দাঁড়াল সে। চোখ গড়িয়ে পড়ল একবিন্দু অশ্রু,
-“প্রেমাসুখ! সুখের চেয়েও তীব্র, অসুখের চেয়েও ভয়াবহ, সহ্য-অসহ্যের সীমা অতিক্রান্ত এক প্রকট যন্ত্রণা… অর্ণব ভাই, তুমি তাকে পেয়ে গেছো বলে যখন বিশ্বাস করে নিলে, তখনই টের পেলে—সে অন্য কারো। আমি তো পাওয়ার আগেই হারিয়েছিলাম, অন্যের বলে মেনে নিতে না পারার যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে শুনলাম…”
অদিতি থামল, চোখের পানি মুছে নিয়ে বলল,
-“শুনলাম, তুমি এখনো আমারই আছো। ভাগ্য আমায় যেই দ্বিতীয় সুযোগটা দিলো, এটা আমি অপচয় করব না। অসুখের গল্পের সমাপ্তি ঘটাই, পরবর্তী সাক্ষাতে তোমায় আমি প্রেম দেবো।”
পরের স্টেশনে ট্রেইন থামতেই অদিতির ফোনে কল এলো একটা, আননোওন নাম্বার থেকে। কল রিসিভ করতেই ভীষণ ভীড়ের মধ্যে থেকে ভেসে এলো কাঙ্ক্ষিত আওয়াজটা,
-“আমিও ট্রেইনে চড়ে গেছিলাম। তুমি কোন বগিতে আছো, খেয়ালে নেই। প্লিজ স্টেশনে নামো একটু। প্লিজ।”
অর্ণবের কণ্ঠে প্রবল ব্যাকুলতা, যেন না হলেই নয়, না পেলে চলবেই না। অদিতি সচরাচর বিস্মিত হয় না, তবে এখন থমকে আছে। এই থমকানো পরিস্থিতিটা পেরিয়ে আসতে সে একটা অহেতুক প্রশ্ন করল,
-“নাম্বারটা? এটা তো আপনার না।”
এই অহেতুক প্রশ্নটারও এক চমৎকার উত্তর দিলো অর্ণব,
-“আমারই। নতুন সূচনা…”
পরিশিষ্ট:
কল্পকন্যা সাঞ্জিনা আফরিন সাঁঝ বাস্তবার্থেই এক কল্পপুরুষকে পেয়ে গেল। সবসময় প্রকৃতিবিলাসে মত্ত থাকা সাঁঝবালিকা এবার প্রেমবিলাসে ডুবে থাকতে লাগল। সবকিছু আগের চেয়েও সুন্দর। পার্থক্য কোনটুকুতে?
আগে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে হারিয়ে যেত, এখন সে প্রিয়তমের চোখের গভীরে কোথাও এক জায়গায় তলিয়ে যায়। আগে সে বৃষ্টিতে দু’হাত ছড়িয়ে ভিজত, এখন সে বৃষ্টিকালে কারো বুকে মাথা গুঁজে ঘুমোয়। আগে মন খারাপ হলে সে নিজেকে ভালো রাখার জন্য বিভিন্ন আয়োজনে ব্যস্ত থাকত। এখন আহ্লাদী হয়ে গেছে অনেকটা। নির্দিষ্ট পুরুষটির কাছে গিয়ে মূর্ছা যায়।
ছাদে বিছানো শীতলপাটিতে এই সন্ধ্যালগ্নে শুয়ে আছে হৃদ, তার পেটের ওপর মাথা রেখে শুয়ে সাঁঝ। নিস্তব্ধতায় অনেক অনেক সময় কেটে গেলে সাঁঝ বলল,
-“আমার একটা সংসারের খুব স্বপ্ন ছিল হৃদ.. তোমার আমি আর আমার তুমিকে নিয়ে। একটা অগোছালো সংসার। তুমি সন্ধ্যে করে বাড়ি ফিরবে, আমি দরজা খুলেই তোমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ব.. এমন সংসার। আমি অভিমান করে গাল ফুলিয়ে বসে থাকব, তুমি আমার মান ভাঙাতে কী না কী করবে… ফুল দেবে, মধ্যরাতে ঘুরতে নিয়ে বেরোবে, এত এত এত বেশি ভালোবাসবে! মজার ব্যাপার কী জানো?”
প্রেম ও অসুখ পর্ব ২৬
-“কী?”
-“একটি বাদে সবগুলোই পূরণ হয়েছে।”
-“কোনটি বাদ পড়ে গেছে ম্যাডাম?”
সাঁঝ মাথা তুলল, পেটে ভর দিয়ে শুয়ে কনুই শীতলপাটিতে ঠেকিয়ে গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে রইল হৃদের দিকে। ঠোঁটের কোণ ঠেসানো হাসির সাথে বলল,
-“তোমার সাথে বৃদ্ধ হবার শখ।”
সাঁঝ একটু একটু করে হৃদের কাছ ঘেঁষে শুয়ে পড়ল। প্রশান্তিতে দু’জনেরই চোখ দুটো বন্ধ। বড়ো বিস্ময়কর এক সত্য হলো—প্রেমাসুখে প্রেম ও অসুখের সন্ধি হলেও, অসুখের ‘অ’ কিছু ক্ষেত্রে উহ্য হয়ে যায়। এটা মূলত তেমনই এক সময়।