প্রেম তুমি দ্বিতীয় খণ্ড পর্ব ৩৭

প্রেম তুমি দ্বিতীয় খণ্ড পর্ব ৩৭
ফাবিহা নওশীন

নীরবতায় কাটছে দিন। পাতা ঝড়া শীতের আগমন ঘটেছে। কুয়াশার চাদরে মোড়ানো সকালে অর্ষার ঘুম থেকে উঠতেই ইচ্ছে করে না। শরীর ও মন আরেকটু উষ্ণতা চায়। কম্বল জড়িয়ে আদূরে ঘুম দিতে চায় কিন্তু অফিসের জন্য তা আর হয়ে উঠে না। অতি পছন্দের ঋতুটা হঠাৎ-ই অপছন্দের হয়ে উঠেছে। নয়টায় অফিস। যেতে অন্তত আধঘন্টা সময় লাগে। ফ্রেশ হওয়া, অফিসের জন্য তৈরি হওয়া, নাস্তা করা সব মিলিয়ে চল্লিশ -পয়তাল্লিশ মিনিট লাগে। অর্ষা অগত্যা বিছানা ছাড়ল। আড়মোড়া দিতে দিতে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। পর্দা সরিয়ে সকালটা উপভোগ করতে উদ্বত হলো তখনই সার্ভেন্ট ঘরে কফি দিয়ে গেল। অর্ষা ধোঁয়া উঠা কফির মগ হাতে নিয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে দাঁড়াল। পুরো শহর কুয়াশায় ঢাকা। তবুও জীবন জীবিকার জন্য কতজন ছুটে চলেছে, স্কুলগামী ছাত্র-ছাত্রীরা শীতের পোশাক পরে ঠান্ডায় গুজো হয়ে হাঁটছে। অর্ষা কফিটা শেষ করে ফ্রেশ হয়ে অফিসের জন্য তৈরি হয়ে নিল।

ডাইনিং-এ যেতে যেতে খালা-খালুর কথোপকথন শুনল। তারা ওর বিয়ে নিয়ে কথা বলছে। ওকে দেখে চুপ করে গেল। অর্ষাও পাত্তা দিল না। না শোনার ভান করে নাস্তা করতে বসল। টেবিলে আয়ানকে দেখতে না পেয়ে বলল,
“আয়ান ভাই অফিসে চলে গেছে?”
অর্ষার খালা বলল,
“হ্যা, ওর কি একটা কাজ আছে তাই আগে আগে চলে গেছে।”
অর্ষা আবারও খাওয়ায় মনোযোগ দিল। ফ্রুটস জুশের গ্লাসে চুমুক দিতেই খালু আমতা আমতা করে বলল,
“অর্ষা, এতদিন তুমি তোমার ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তিত ছিলে। ভালো ক্যারিয়ার গড়তে উদ্যমী হয়েছিলে। এখন তো তোমার চাকরি ভালো চলছে। সবকিছু আছে তোমার কাছে। এবার তো বিয়েটা করা যায়। তোমার খালা মনির শরীর কেমন থাকে জানোই তো। তোমাকে নিয়ে অনেক চিন্তা করে। বারবার বলে মরার আগে ওর বিয়েটা দিতে পারলে, ওকে সংসারী দেখে যেতে পারলে মনটা শান্তি পেত।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

অর্ষা পুরো ফ্রুটস জুশ শেষ করে খালার দিকে একবার তাকাল। তারপর খালুর দিকে চেয়ে বলল,
“আমি জানি আপনারা আমাকে নিয়ে বেশ চিন্তিত। আপনারা ছাড়া আমার আর কেউ নেই। আমি জানি কেন এত চিন্তা করেন। তবে একটা প্রশ্ন করি, সত্যিই কী আমার সব আছে? বিয়ে করে সংসার করার মতো সব এবিলিটি আমার আছে? আমি কী পারব অন্য একটা পরিবারে গিয়ে নিজেকে মানিয়ে নিতে? তাদের সব দিক দিয়ে সুখী করতে? আমি এতিম, বাবা-মা নেই। এছাড়া আরও জটিলতা আছে। এমন মেয়েকে কে বিয়ে করবে এটা ভেবেই খালা দিন দিন অসুস্থ হয়ে পড়ছে। খালা কেন এত চিন্তা করো? আমি চাকরি করি। টাকাপয়সা সব আছে আমার। আল্লাহর রহমতে আমাকে না খেয়ে মরতে হবে না। আজীবন নিজের খেয়াল নিজেই রাখতে পারব। আ’ম হ্যাপি উইথ দিস। বিয়ে, একটা পরিবার এসব আমার প্রয়োজন নেই।”

“তবুও মা, ভালো ভাবে বেঁচে থাকার জন্য শুধু টাকাপয়সা নয়, একটা পরিবারও প্রয়োজন।”
“খালা মনি তুমি সব জেনেও…..
” আমরা এমন ছেলের সাথেই তোর বিয়ে দেব যে কি-না তোকে সুখে রাখবে। তোর জীবনের জটিলতা নিয়ে মাথা ঘামাবে না। তুই শুধু একবার হ্যা বল।”
অর্ষা মাথা নিচু করে আছে। চোখে পানি জমেছে। কেউ যদি দেখে ফেলে তাই মাথা তুলছে না। দ্রুত বেরিয়ে গেল অফিসের জন্য।
ও যেতেই খালা মনি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
“কথা কিছুতেই আগানো যাচ্ছে না। ও ওর অতীতের মধ্যে এতটা ডুবে আছে যে বের হতে পারছে না। এখনো আতংকে থাকে। ভয় পায় কথা বলতে।”

“আয়ানের সাথে ওর বিয়েটা দেব কিভাবে? আমাদের আয়ানের সাথে কথা বলা উচিত। আয়ান যদি পারে….”
“অর্ষা যদি না রাজি হয় তাই ওকে বলিনি। আয়ানের সাথে বিয়ে দিলে ওর জীবনে আর কোন জটিলতা থাকবে না। কার সাথে বিয়ে দেব, কোন পরিবারে দেব তারপর যদি বাবা-মাহীন ভেবে সুযোগ নেয়, যদি অবহেলা করে। বোনকে অকালে হারিয়েছে। ওকে সুখী দেখতে চাই।”
“এইজন্যই তো ছেলের বউ করতে চাইছি। যাতে ওর ফিউচার সিকিউর থাকে।”
“কিন্তু কিছুই আগাতে পারছি না। ঘুরে-ফিরে এক জায়গায় গিয়ে থেমে যায়।”

পুরোটা দিন গাঢ় বিষন্নতায় কেটেছে অর্ষার। ভার মুখেই অফিস থেকে বের হয়েছে। কিছুই ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে জীবন থেকে সব রঙ হারিয়ে গেছে। বেসুরে, বেরঙ জীবন। ড্রাইভ করতে করতে হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে দিল। জানালার কাচ খুলে বাইরে তাকাল। এই ঠান্ডার মধ্যেও কেমন যেন দম বন্ধ লাগছে। জানালা খুলতেই ফুরফুরে বাতাস ভেতরে এল। অর্ষাকে ছুয়ে দিল গভীর ভাবে। শরীরে হঠাৎ কাঁপুনি দিয়ে উঠল। ফুটপাতে একটা মেয়ে একটা বাচ্চা কোলে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরে একজন ভদ্রলোক এল। মেয়েটির কোল থেকে বাচ্চাটি নিয়ে আদর করতে লাগল। দুজনে মিলেই আদর করতে করতে কীসব বলছে আর হাসছে। কি সুন্দর দৃশ্য!

একটা বাচ্চার কাছে তার নিরাপদ আশ্রয়স্থল তার বাবা-মা। বাবা-মা থাকলে আর কিছু লাগে না। কারো কাছে আকুলতা নিয়ে পড়ে থাকতে হয় না। আর বাবা-মায়ের কাছে সন্তানই সব। একটা সন্তান তাদের জীবনে রঙ এনে দেয়। খুশিতে ভরিয়ে দেয়। সন্তানহীন জীবন প্রত্যেক দম্পত্তির রঙিন জীবন বিবর্ণ করে দেয়।
অর্ষা চোখ ফিরিয়ে নিল। কান্না পাচ্ছে খুব। নিজেকে অসহায় লাগছে। বুকটা হু হু করছে।চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। ভেতরের চাপা কান্নাটা চিৎকার করে বলে উঠছে,
“হে সৃষ্টিকর্তা কেন আমাকে অপূর্ণ করে দিলে? আর পাঁচটা মেয়ের মতো আমি পূর্ণ নই কেন?”

চোখ মুছে অর্ষা বাইরে বের হলো। সামনের দিকে হাঁটতে লাগল। হঠাৎ চোখ গেল এটিএম বুথের দিকে। দর্শন বুথ থেকে টাকা তুলছে। অর্ষা ওকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। দর্শন টাকা তুলে ঘাড় ঘুরিয়ে অর্ষাকে দেখেও না দেখার ভান করে গাড়ির কাছে গেল। গাড়ির সামনে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দর্শনকে দেখে হাসি মুখে কি যেন বলল। দর্শন নিজেও আলতো হাসল। তারপর দরজা খুলে দিল মেয়েটার জন্য। মেয়েটা ভেতরে বসতেই দর্শন অপর পাশের দরজা খুলে গাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। মুহুর্তেই গাড়ি হাঁকিয়ে চলে গেল। অর্ষা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু দেখল।

অর্পার জন্মদিনের দাওয়াত করার জন্য কল করেছে প্রিয়াকে। প্রিয়া দাওয়াত কবুল করে ইতস্তত করে বলল,
“আপু অর্ষাকে বলেছো?”
প্রিয়ার প্রশ্নে অর্পা বিব্রত হলো। এতকিছুর পরে অর্ষাকে বলতে চায় না। চায়না ও আর দর্শন আর মুখোমুখি হোক। দর্শন আবারও কষ্ট পাক। এই কথাটা প্রিয়াকে বলা জরুরি। তাই স্পষ্ট উত্তর দিল,
“না, আমি চাই না দর্শন ওর জন্য আর কষ্ট পাক।”
প্রিয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কষ্ট তো অর্ষা কোন অংশে কম পাচ্ছে না।

“কিছু মনে করো না। আসলে আমি চাইছি ওদের আবারও মুখোমুখি করতে। এদিকে অর্ষা কষ্ট পায়, কাঁদে সব কিছু বন্ধু হিসেবে আমাকে দেখতে হচ্ছে। আর অপর প্রান্ত দর্শন ভাইয়া কষ্ট পাচ্ছে তারজন্য বন্ধু হিসেবে তোমাদের দেখতে হচ্ছে। আপসেট হতে হচ্ছে। অনেক কিছুর মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে কিন্তু এভাবে কতদিন? যতক্ষণ পর্যন্ত একে অপরের সাথে খোলাখুলি কথা না বলছে, যতদিন পর্যন্ত সবকিছু ক্লিয়ার না হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত এভাবেই চলবে। কেউ সত্যির মুখোমুখি হবে না।”

“কোন সত্যি?”
“যা শুনলে হয়তো তুমি শিউরে উঠবে। তোমার আমার দেখার মধ্যেও হয়তো অনেক ফাঁক রয়ে গেছে। অনেক কিছু দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না সেজন্য জানা জরুরী, বলা জরুরী। আর তাই চাচ্ছি দুজন বারবার মুখোমুখি হোক যতদিন পর্যন্ত সব ধোয়াশা না কাটে।”
“যদি হিতে বিপরীত হয়?”
“বিপরীত হতে হতে একদিন বাস্তব সত্যতা সামনে আসবে।”

“আমার ভয় করছে দর্শন কী রিয়েক্ট করবে আর তাছাড়া অর্ষা আসার জন্য রাজি হবে বলে মনে হচ্ছে না।”
“অর্ষার সাথে ইমোশনাললি কথা বলবে রাজি হবে। আর দর্শনের ব্যাপারটা তুমি বুঝে নিও।”
“কিন্তু কিছু কি মিরাকল হওয়ার সম্ভাবনা আছে? আমিও অপেক্ষা করছি আড়ালে কি আছে দেখার জন্য।”

প্রেম তুমি দ্বিতীয় খণ্ড পর্ব ৩৬

“ইনশাআল্লাহ। আশা করা যায়। আর আমি তো আছি। ওদের মুখোমুখি করব। শুধু দোয়া করো ওরা যেন খোলাখুলি কথা বলে। ওদের মনের ভেতর অনেক কথা জমা হয়ে আছে কিন্তু বলে না। কোন কারণে বলার ইচ্ছে হারিয়ে ফেলেছে। ”
অর্পা কল কেটে বড় করে শ্বাস নিল। প্রিয়া ম্যাসেজ করে অর্ষার নাম্বার দিয়েছে। অর্পা ওর নাম্বার বের করল। বের করে কল দিল।

প্রেম তুমি দ্বিতীয় খণ্ড পর্ব ৩৮