প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল পর্ব ৪৯+৫০

প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল পর্ব ৪৯+৫০
Nabila Ishq

‘অত্যন্ত ভালোবাসতে নেই। হৃদয় পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। হয়তো সুখে নয়তো যন্ত্রণায়। আমার হৃদয় কেন পুড়ছে শাবিহা?’
শাবিহা দৃষ্টি সরাল। বুকের চিনচিন ব্যথা অগ্রাহ্য করলো, ‘পরিবারের কথা শোনো। তারা তোমার খারাপ চায়না।’
‘তুমি কী চাও?’
‘যা তোমার জন্য ভালো।’
অয়ন হাসলো নির্বিকার ভঙ্গিতে, ‘আমার জন্য ভালো কী?’
‘এতসব জানি না।’
‘তুমি কিচ্ছু জানো না। বোঝ না। তুমি শুধু আমাকে পোড়াতে জানো।’
শাবিহার চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে আসছে। দুচোখ ভিজে উঠেছে। সে মাথা ঘুরিয়ে সিটে হেলান দিয়ে রইল। চোখজোড়া বুজে রাখল।
অয়ন কপালে আঙুল চেপে ধরেছে। হৃদয় এতটা ব্যাকুল কেন হবে? ভালোবাসার মানুষ সামনে আসতেই রাগ প্রেমের সমুদ্রে ডুব কেন দিবে? রাগ কেন রাগের জায়গায় সটান মেরে থাকে না? অভিমানী মন শক্তপোক্ত হতে পারেনা কেন?

এইযে অয়ন মাস খানেক ধরে জ্বলন্ত আগুনে দাউদাউ করে জ্বলল। পুড়ে ছারখার হয়ে গেল। রেগেমেগে অস্থির হয়ে থাকলো। দিনরাত জেগে কাটাল। একমুহূর্তের জন্য দুচোখের পাতা বুজতে পারেনি, শান্তিপূর্ণ ভাবে ঘুমাতে পারেনি।
খুব করে মনকে শক্ত করেছিল। ভেবে রেখেছিল, শাবিহা সামনে আসলে তাকেও নিজের আগুনে জ্বালাবে। পইপই করে ভেবে রেখেছে। অথচ এখন হচ্ছেটা কী? শাবিহার আঁখিদুটির কোণে জল ঘেঁষতে দেখে মুহুর্তে গলে রসমালাই বনে গেল। রাগ, অভিমান, জেদ সবকিছু উবে গেল। আপাতত বুক ভর্তি ভালোবাসা উতলে উঠছে। হাসফাস করছে বুকের ভেতরটা। শাবিহাকে শক্ত করে ধরে রাখতে ইচ্ছে করছে বক্ষস্থলে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বিরক্ত ভঙ্গিতে কপালের চুলগুলো দু-হাতের সাহায্যে উঠিয়ে নিল। ঘুরে তাকাল পাশে। শাবিহা ঘুমিয়ে পড়েছে। সিটে মাথা এলিয়ে নিশ্চিন্ত চোখবুজে আছে। মায়াবিনী একটা। অয়নকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ঘুমাতে ব্যস্ত।অয়ন ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ঘুমন্ত শাবিহার পানে চেয়ে রইল। চোখমুখ লাল বর্ণে রুপান্তরিত হয়েছে। কালো রেশমি চুলগুলো চারিপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। অয়ন হাত বাড়ালো। মুখশ্রীর সামনে থেকে চুলগুলো সরিয়ে কানের পেছনে গুঁজে দিল। থমথমে চোখ নামিয়ে চট করে একটা চুমু খেল। শাবিহা নড়েচড়ে পাশ ফিরেছে। ঘুমের ঘোরে গোঙাল। অয়ন ঠোঁট এগিয়ে নিঃশব্দে আরেকটি চুমু খেল। কতটাই না আকুতি অনুভব করেছে এই মুখশ্রী দেখার জন্য। কীভাবে ছটফট করেছে দিনরাত! ব্যাকুল হয়ে ঘুরেফিরে বেরিয়েছে একটিবার দেখার জন্য। অয়ন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। অস্পষ্ট স্বরে আওড়াল, ‘বড্ড ছাড় দিচ্ছি৷ একবার নিজের করি। তারপর… খবর আছে তোমার।’

নিস্তব্ধতা ভেঙেছে অয়নের সেলফোনের শব্দে। তন্ময় কল করছে। অয়ন রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে কোলাহলের তীব্র শব্দ। সবরকম শব্দ মিলেমিশে একত্রে এসে কানে বিঁধছে। সেলফোন কান হতে খানিক সরাল। তন্ময় হয়তো কিছুটা দূরে যাচ্ছে শোরগোল থেকে। কিছুক্ষণের মধ্যে শব্দ কমে এল। সে ডেকে উঠলো, ‘ভাইয়া!’
‘হু। কই?’
‘শহরের বাইরে।’
‘শাবিহা?’
‘ঘুমোচ্ছে।’
‘রাত তো অনেক। কোথায় যাবে ভেবেছ?’

অয়ন হাসল। সে মাদারীপুর যেতে চাচ্ছিল শাবিহাকে নিয়ে। ভেবেছিল, সেখানকার একটা হোটেল বুক করে নিবে দুদিনের জন্য। ঘুরেফিরে ফিরে আসবে সময়মত। কিন্তু তা কীভাবে সম্ভব? শাবিহা স্পষ্ট স্বরে নাকচ করে বসেছে। কোনোপ্রকার হোটেল নেওয়া হবে না। কোনোপ্রকার মাদারীপুর যাওয়া হবে না। এভাবে গাড়িতে করে ঘুরবে। নাহলে বাড়িতে দিয়ে আসতে। অয়ন পড়লো বিপাকে। দু-তিনদিন এভাবে গাড়িতে করে থাকা যায় নাকি? পুনরায় দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল, ‘ভেবেছিলাম তবে শাবিহা যাবেনা। এভাবেই গাড়িতে থাকবে বলছে।’
‘ভয়ে আছে।’
‘আমি বুঝতে পারছি ভাইয়া।’
‘আমি খুব ভরসা করি তোমাকে অয়ন।’
‘জানি ভাইয়া। নিরাশ করবো না।’
‘সাবধানে থেকো। প্রয়োজনে কল করো। আর হ্যাঁ, টাকা লাগবে? আমি কী পাঠাব?’
‘না না। আছে আমার কাছে।’
‘এঞ্জয়।’
‘সেইম টু ইউ ভাইয়া।’

সেলফোন রেখে পুনরায় নজর শাবিহার দিক রাখল। অশান্ত লাগছে মেয়েটাকে। ঘুমিয়ে শান্তি পাচ্ছে না। দোনামনা করছে ঘুমের ঘোরে। অয়ন হাত বাড়িয়ে শাবিহার মাথাটা এগিয়ে আনল। ঠিক নিজের পায়ে, রানের উপর রাখল মাথা। পেছন সিটে রাখা কোর্ট এনে শাবিহার শরীরে মেলে দিল। এসির ট্যাম্প্রেচার খানিক কমিয়ে নিল। ধীরেসুস্থে গাড়ি স্টার্ট করলো। টান মেরে চলল মাদারীপুরের উদ্দেশ্যে। এমন সুযোগ বারবার আসবে না। সে সৎ ব্যবহার করবে এই সুযোগের। অবশ্যই!

শান্ত। ভীষণ শান্ত চারিপাশ। কোনোপ্রকার শব্দ নেই কোথাও। শাবিহা চোখ পিটপিট করছে। উঠবে উঠবে ভাব। ঘন্টাখানেক ঘুমিয়েছে। আরাম করে। শরীর মুচড়ে ওঠতেই অয়ন বা’হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলল। শাবিহা মুহুর্তে লাফিয়ে উঠে গেল। হন্তদন্ত ভঙ্গিতে অয়নের দিক তাকাল। কখন ঘুমিয়েছে আর কখনউ বা অয়নের পায়ে পৌছেছে? বিভ্রান্ত হয়ে গুটিশুটি মেরে বসলো। আঁড়চোখে অয়নকে বারবার দেখে নিল। ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে ছেলেটাকে। চোখমুখ ছোট হয়ে আছে ঘুমের অভাবে। নিরামিষ ভঙ্গিতে গাড়ি চালাচ্ছে। শাবিহার মায়া হলো। বুকটা আনচান করতে লাগলো। ধীর গলায় শুধালো, ‘একটু ঘুমিয়ে নিবে?’
‘মাস খানেকের ঘুম জড়ো হয়েছে। একটুখানি ঘুমে কিছু হবেনা। অনেক ঘুমাতে হবে।’
শাবিহা চুপ মেরে গেল। অয়ন আঁড়চোখে তাকিয়ে পুনরায় বলল, ‘তোমাকে দেখেছি, ছুঁয়েছি। এখন ভালো ঘুম হবে। তবে ঘুমের জায়গা নেই। অদ্ভুত!’

শাবিহা কথা ঘুরিয়ে বলল,’কোথায় যাচ্ছি?’
অয়ন জবাব দিল না। তবে এবার গাড়ি টেনে চলেছে বিচলিত হয়ে। চারপাশে তাকাচ্ছে বারংবার। যেমন ভালো জায়গা খুঁজছে। একটি শুনশান কোলাহল বিহীন বাড়ির সামনে থামাল গাড়ি। বাড়িটি পাঁচতলা। বেশ দূরে। আশেপাশে আর বাড়ি নেই। তাদের চারপাশে গাছপালা আর ঘাস। অয়ন বেরোলো। অপরপাশে এসে শাবিহাকে বের করল টেনে। পেছনের দরজা খুলে শাবিহাকে বসিয়ে, উল্টো ঘুরে সেও গিয়ে বসলো। ভেতর দিয়ে সম্পুর্ন গাড়ি লক করে ফেললো। হাতপা মেলে মাথাটা শাবিহার কোলে রেখে শুয়ে পড়লো। মুহুর্তে চোখবুঁজে ঘুমিয়ে গেল। শাবিহা স্তব্ধ, কিংকর্তব্যবিমুঢ়! চমকে বসে রইল। চোখজোড়া এখনো পলক ফেলতে সক্ষম হয়নি।

লঞ্চ থেকে সকলে নামতে ব্যস্ত। কেউবা নিজেদের ল্যাগেজ হাতে দাঁড়িয়ে কথাবার্তায় মশগুল। মধ্য দিয়ে মাহিন অরুর সেলফোন হাতে দাঁড়িয়ে। সেলফোন খানা লাগাতার বেজে উঠছে। সেকেন্ডের জন্য ওফ হয়ে আবারো বেজে উঠছে। এমন ভোর সকালে কার এতো তাড়া? পৃথিবী এখনো অন্ধকার। সূর্য উঠেনি। অথচ কলকারী ব্যক্তি বড্ড তাড়াহুড়ায় যেমন। অরুকে ডেকে ফোন দিবে তারও উপায় নেই। সে এখনো ছাঁদে। রুস্তমের সাথে কাজ করছে। একটুপর নামবে। অন্যদিকে তন্ময় অরুকে নিয়ে নেমে গিয়েছে। সেলফোন ভুল বসত ফেলে গিয়েছে। যেটা আপাতত তার হাতে। স্ক্রিনে বড়বড় অক্ষরে লেখা ভেসে উঠেছে ‘ফার্মের মুরগী’। নামের কারণে মাহিনের অ্যাটেনশন বৃদ্ধি পেল। কল রিসিভ করতে ইচ্ছে হলো। তবে পারমিশন বিহীন অন্যের কল রিসিভ করা মোটেও সভ্যতার কাতারে পড়ে না। তাই ধরছে না। সেলফোন পকেটে ঢোকাবে সেমূহুর্তে আবারো কল।

উপায় না পেয়ে, পাশ কেটে একটু দূরে গেল। কলটা রিসিভ করলো। ধমকের সুরে কিছু বলবে পূর্বেই ওপাশ হতে একটি পুচকে মেয়েলী কন্ঠের স্বরে পকপক করে উঠলো, ‘এতো কীসের ব্যস্ততা। সকাল হবে প্রায়। রাতের এক্টিভিটিস তো শেষ, মনে হয়। শোন এখন তাড়াতাড়ি সবকিছু ডিটেইলসে খুলে বল। কি কি করলি! কিচ্ছু মিস দিবিনা। আমি সারারাত ঘুমাতে পারিনি। তোদের কাহিনি শুনব বলে। তাড়াতাড়ি বল! তন্ময় ভাই তো মনে হয়…
মাহিন হকচকিয়ে গেল। আনমনে খু খু শব্দে কেশে উঠলো। তালুতে পানি উঠে গেছে যেমন। চোখ বড়বড়। এমন অসভ্য কথাবার্তা মেয়েদের মুখ থেকে শুনতে সে অভ্যস্ত নয় মোটেও। মোটামুটি তার মুখটাও হা হয়ে গিয়েছে। ওদিকে মারজির বকবকানি থেমে গেল। গলার স্বর চওড়া হলো, ‘কে?’

‘মাহিন।’
‘ওই মিয়া! কল ধরে কথা বলেন না কেন! অসভ্যের মতো শুনে যাচ্ছিলেন। ভদ্রতা বলতে কিচ্ছু নাই নাকি!’
চমকিত মাহিন কিছু বলবার ভাষা খুঁজে পেল না। কথা বলার সময় দিল কই? অসভ্য মেয়েটা তো বকবক করেই গেল। তাকে আরও চমকে মারজি বলল, ‘এইযে মিয়া। অরুকে ফোন দেন। তাড়াতাড়ি। খুব দরকার। কই ও? আপনি কী হোন? ফোন আপনার কাছে কেন!’
মাহিন মেয়েমানুষ দেখেছে অনেক। তবে এমন ঝাঁজালো মেয়েমানুষ দেখেনি। তাও এতটা নির্লজ্জ। কন্ঠ শুনে তো পুচকে মনে হলো। এমন চটাং চটাং কথাবার্তা শিখেছে কোথার থেকে এই মেয়ে? মাহিন ভাষা হারিয়ে বিনাবাক্যে ফোন কানে ধরে রাখল। ওপাশে মারজি চেঁচিয়ে চলেছে, ‘বোবা নাকি! মাহিন এর পর কী আর কোনো কথা নেই আপনার ডিকশিনারি’তে! পড়েন কীসে! কোন কলেজ! নাকি ভার্সিটি। ভদ্রতা জানেন না৷ প্রশ্ন করলে উত্তর দিতে হয়। এভাবে অন্যের ফোন ধরে চুপ থাকতে নেই। শুনুন……’

‘নাম কী?’
মাহিন আনমনে প্রশ্ন করল।তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো মারজি, ‘নাম কী মানে! দেখেন না স্ক্রিনে? অশিক্ষিত নাকি?’
‘ফার্মের মুরগী।’
মারজি চুপসে গেল যেমন। সে ফট করে কল কেটে দিল। এপাশে মাহিন সবে ঘোর হতে বেরিয়েছে, নরম কন্ঠের তেতো কথাগুলোর সমাপ্তি ঘটায়। স্ক্রিনে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। বিড়বিড় করলো, ‘মেয়ে নাকি আগুন এটা!’

নারায়ণগঞ্জ বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল ঢাকা বিভাগের একটি জেলা। রাজধানী ঢাকার নিকটবর্তী একটি শহর এবং সদরদপ্তর। অত্যন্ত প্রাচীন এবং প্রসিদ্ধ সোনারগাঁও এ জেলার অন্তর্গত।
এই শহর জনসংখ্যার ভিত্তিতে বাংলাদেশের ৪৩টি বৃহত্তম শহরের মধ্যে এটি ১৩তম। শহরটি শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবস্থিত। এভাবেও নারায়ণগঞ্জ বন্দর দেশের বৃহত্তম নদীবন্দর ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবেও পরিচিত। এছাড়াও এটি পাট বাণিজ্য ও প্রক্রিয়াকরণ কারখানা এবং দেশের টেক্সটাইল সেক্টরের ব্যবসা ও শিল্পের একটি কেন্দ্র। অনেক পাটকলের উপস্থিতির কারণে এটিকে প্রাচ্যের ড্যান্ডি নামে ডাকা হয়।

৬৮৩.১৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ জেলাটি ঢাকা বিভাগের সবচেয়ে ছোট জেলা। রাজধানী ঢাকার সাথে এ জেলার সীমানাও রয়েছে। নামার সময়টায় ভালোভাবে নজর বোলালে বোঝার উপায় আছে। সঙ্গে আশপাশে দেখা মিলে নতুন প্রকৃতির।

ভ্রমণের উদ্দেশ্যে অনেকে মিলেমিশে এসেছে ঠিক, তবে এখন বিদায়ের পালা। দল নিয়ে একেকজন একেক হোটেলে উঠবে। নিজেদের মতো বেরিয়ে পড়বে। কেউ হোটেল, কেউবা রিসোর্টে। নিজেদের মতো ঘুরেফিরে ঠিক সময় ফিরে আসবে। এমনটাই বলা আছে। অন্যদিকে তন্ময়দের হোটেল বা রিসোর্ট নিতে হবে না। মাহিনের নানার বাংলো আছে ইস্টে। সেটা ফাঁকা করা হয়েছে। বন্ধুবান্ধব মিলে তারা সেখানেই থাকবে বলে আলোচনা করা আছে। গাড়ি এসেছে পাঁচটা। মিলেমিশে এগুলোর মধ্যে চড়বে। কেউবা এখনই নারায়ণগঞ্জ ঘুরতে বাইক ভাড়া করে ফেলেছে। ঘুরেঘুরে যাবে।

তন্ময় ল্যাগেজ হাতে দাঁড়িয়ে। গরমে অতিষ্ঠ হয়ে আছে সে। ঘেমে-নেয়ে একাকার। শার্ট পেছন দিয়ে ভিজে উঠেছে।পাশে অরু দাঁড়িয়ে। সেও হাসফাস করছে গরমে। এখানে উপস্থিত সকলেই ক্লান্ত এবং গরমে অতিষ্ঠ। আজ ভাপসা গরম খুব বেশি। তাদের সামনে গাড়ি। বড়ো গাড়ি। সাত আটজন নির্দ্বিধায় এটে যাবে। মাহিন এবং রুস্তম আসলেই উঠে পড়বে গাড়িতে। রিহান কপালের ঘাম মুছে বলল, ‘অরু ভেতরে বসো শুহানির সাথে। যেই গরম!’
তন্ময় মাথা দোলাল। ল্যাগেজ পেছনে রেখে ফিরে আসল। অরুকে ভেতরে বসিয়ে দিল। শুহানি ততক্ষণে অন্যপাশ হয়ে উঠে বসেছে। বাইরে তন্ময়, ইব্রাহিম, রিহান এবং সৈয়দ দাঁড়িয়ে রইলো। মাহিন এবং রুস্তম এলেই গাড়ি স্টার্ট করা হবে। দুটো গাড়ি অলরেডি বেরিয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল দুজনকে। কাছাকাছি আসতেই গাড়িতে উঠে বসল সকলে। ড্রাইভিংয়ে রুস্তম বসেছে। পাশে সৈয়দ। পেছনের সাড়িতে অরু আর শুহানি। মিডেল
সাড়িতে তন্ময়, মাহিন, ইব্রাহিম এবং রিহান। গাড়ির এসি বন্ধ করে দেওয়া হলো। চারপাশের কাঁচ খুলে দিল। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। মুহুর্তে ঠান্ডা বাতাস ছুঁয়ে ঝিম লাগিয়ে দিল একেকজনের শরীর।

অরু পিপাসিত দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে। অন্ধকার কাটিয়ে পৃথিবীর বুকে সূর্য উঠবে যেকোনো সময়। সুর্যস্তর দেখার বড্ড সখ অরুর। আজ দেখতে পাবে স্পষ্ট ভাবে। কোনো এক নদীর সামনে গাড়ি থামালে মন্দ হয়না। এদিকে প্রকৃতিতে বাতাসের তীব্র হুংকার তুলছে। চোখ বন্ধ করে ফেললো অরু। প্রাণবন্ত প্রকৃতির ঘ্রাণ নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। পুনরায় চোখ মেলে তাকাতেই দেখল গাছপালা আর নদী।
মাহিন হুট করে ডাকল। অরু ঘুরে তাকাল, ‘জি ভাইয়া!’
মাহিন সেলফোন এগিয়ে দিল। উদ্ধিগ্ন তার দৃষ্টি। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে আছে। কিছু একটা বলতে চাইছে। ভেবেচিন্তে শুধালো, ‘ফার্মের মুরগী কে? কল এসেছিল।’
অরু হাসল, ‘মারজি। আমার ফ্রেন্ড।’

‘ওহ। কোথায় থাকে?’
‘পাশাপাশি৷ আমাদের লাইনের মাথার বাড়িটা ওদের।’
‘খুব কথা বলে তাই না? মানে পকপক করে সারাদিন?’
অরু মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল, ‘হ্যাঁ! ওই একটু আরকি।’
‘একই নৌকার মাঝি!’
অরু ভাষাহীন দৃষ্টিতে তন্ময়ের দিক তাকাল। তন্ময় ও তাকিয়ে। হাসি হাসি মুখশ্রী। নরম দৃষ্টি। একদম আদুরে। অরুর বক্ষস্থলে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। ইচ্ছে করলো দৌড়ে গিয়ে তন্ময়ের কোলে চড়তে। শব্দ করে দু’গালে গালে চুমু বসাতে। গালে গাল ঘষতে। কিন্তু তা অসম্ভব। লাজুক অরুর জন্য অসম্ভব। উদ্বিগ্ন মন নিয়ে সে প্রকৃতিতে ধ্যানমগ্ন হলো পুনরায়।

সাদা রঙের ডিজাইনিং বাংলো৷ ছয় একর জমিতে গড়া৷ চারপাশ হতে লম্বা দেয়াল টানা। দারোয়ান দাঁড়িয়ে। দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে। গাড়ি গুলো একেক করে ঢুকছে৷ দুপাশে বাগান গিয়েছে। মাঝে চওড়া রাস্তা। বাড়ির সামনে গাড়ি পার্ক করার ব্যবস্থা রয়েছে। সেখানেই পার্ক করেছে গাড়িগুলো। ভেতর হতে বেরিয়ে এসেছে করীম চাচা। কেয়ার টেকার তিনি। সঙ্গে দুটো কাজের লোক এনেছেন। ল্যাগেজ ভেতরে নিবেন বলে। মাহিন একটি ল্যাগেজ স্পেসিফিকলি দেখিয়ে স্পষ্ট স্বরে বলল, ‘চাচা! এই ল্যাগেজ দোতলার কর্নার রুমে নিতে বলবেন।’
তন্ময় কপাল কুঁচকে বসলো। ল্যাগেজটা তার। এটা স্পেসিফিকলি দেখানোর মানে কী? অন্যদিকে রিহান হো হো শব্দে হেসে উঠলো। যেমন সে অনেক কিছুই জানে। তবে বলবে না। ব্যস্ত পায়ে ভেতরে যেতে নিয়ে বলল,’আমি একটু ঘুমিয়ে নেই। বিকেলে বেরোতে হবে তো। জান তুমি আসো তাড়াতাড়ি।’

শুহানিও মিটিমিটি হাসছে। আলগোছে সেও রিহানের পিছুপিছু চলে গেল। রুস্তম ও আর দাঁড়িয়ে নেই।মুহুর্তে সবাই একেক করে কেটে পড়েছে। শুধু মাহিন দাঁড়িয়ে। ভুবনমোহিনী চেহারা নিয়ে। তন্ময় সন্দেহজনক গলায় প্রশ্ন করল, ‘কী ঝামেলা পাকিয়েছিস?’
‘এই চিনলি বন্ধুরে? দেখলে অরু! এভাবে বন্ধুত্ব টেকসই হয়না৷ প্যাপার্স রেডি করি গিয়ে। এখানেই বন্ধুত্বের ইতি টানব। মানে আমাদের ডিভোর্স!’
অশ্রুসিক্ত নয়ন দেখিয়ে সামনে অগ্রসর হলো মাহিন। পেছনে রেখে গেল বোকা অরু এবং অতিষ্ঠ তন্ময়কে। দুপাশে অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে তন্ময় অরুকে নিয়ে এগোল। দেখানো রুমের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। পাশের কক্ষটি রিহান আর শুহানির। তারা দুজন ইতোমধ্যে ভেতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। সেদিকে ধ্যান নেই অরুর। সে অবাক দৃষ্টিতে তাদের রুমের দরজার পানে তাকিয়ে। সাইনবোর্ড লাগানো সেখানে। বড়বড় অক্ষরে লেখা, ‘নিউলি ম্যারিড কাপল, ডু নট ডিস্টার্ব!’

অরুর বুক অজানা আশঙ্কায় ধুক করে উঠলো। মুচড়ে উঠলো ভেতরটা। তন্ময় ভেতরে ঢুকেছে খানিক্ষন হয়েছে। ছোট পা ফেলে অরুও পেছন পেছন ঢুকলো। ঢুকে তৎক্ষণাৎ মুখে দুহাত চেপে ধরল। সম্পুর্ন রুম ফুলের বাগানে রুপান্তরিত হয়েছে। বাসর রাতের ঘর সাজানো যাকে বলে। অরুর হাত-পা রীতিমতো কাঁপছে। ক্ষনে ক্ষনে কেঁপে উঠছে হৃদয়। তন্ময়ও বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে যেন। অগোছালো পায়ে বেরিয়ে পড়ল। শব্দ করে, ‘মাহিন!’ বলে চেঁচাল।
মাহিন ততক্ষণে নিজের রুম লক করে ওয়াশরুম ঢুকেছে। শুধু সে নয়। সবগুলো রুম লকড। কাউকে ধরতে না পেরে তন্ময় ফিরে আসল। অরু তখনো দাঁড়িয়ে। দাঁড়িয়ে থাকবে না তো কী করবে? বসবার যায়গা কই? যেখানে তাকাচ্ছে সেখানেই ফুল। হরেকরকম ফুল। বাগানের সব ফুল এই কক্ষে নিশ্চিত। চোখমুখ জ্বলছে। নিশ্চয়ই লালচে হয়ে গিয়েছে। তন্ময় গলার স্বর শক্ত করার সামান্য চেষ্টার উদ্দেশ্যে বলল, ‘পড়ে কাউকে দিয়ে পরিষ্কার করিয়ে দিব। আপাতত ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নে।’

‘আ..আচ্ছা।’
তন্ময় ঠাঁই দাঁড়িয়ে। নজর বিছানায় সীমাবদ্ধ। সে সময় নিয়ে পুনরায় বলল,’এসব… এসব কী তোর খারাপ লাগছে? ছিঁড়ে ফেলব?’
অরু চোখ তুলে তাকাল। তার লাজুক দৃষ্টি থমকে গিয়েছে। তন্ময়ের দৃষ্টি দৃঢ়। যেমন সে ‘হ্যাঁ’ বললেই সবকিছু ছিঁড়ে ফেলবে। দুজনের দৃষ্টিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো। অরু থরথর করে কাঁপতে থাকা, ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রেখেছে। লজ্জা, দ্বিধা উজাড় করে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে তাকে। খুব কষ্টে, আটকে যাওয়া গলায় জবাব দিলো, ‘না। আমার খারাপ লাগছেনা। ছিঁড়বেন না।’
পরপর অরু কম্পিত পায়ের ধাপ ফেলে ল্যাগেজ খুলল৷ কাপড়চোপড় নিয়ে ওয়াশরুম ছুটল। এই বিছানায় সে কীভাবে ঘুমাবে? অরুর যে লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে এখনই। তা কী উপলব্ধি করতে পারছে লোকটা?

নিস্তব্ধতা! আবদ্ধতায় ঘেরা চারপাশে। কক্ষ জুড়ে শুধু অরুর ঘন শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ। তন্ময় হতে লজ্জিত মুখশ্রী আড়াল করতে বেশ সময় নিয়ে বেরিয়েছে ওয়াশরুম থেকে অরু। বিচলিত চোখে চারিপাশে নজর বুলিয়েছে। যাকে দেখার প্রত্যাশা নিয়ে বেরিয়েছে সে নেই! তন্ময় নেই! আনাচে কানাচে কোথাও নেই। অরু স্বস্তির শ্বাস ফেলবে নাকি দীর্ঘনিশ্বাস? তন্ময়কে ভীষণ ক্লান্ত দেখিয়েছে। এতটা জার্নি করে এসেছে। এখন একটু রেস্ট নিবে না? ইতস্তত মনে বিছানার সামনে এসে দাঁড়াল অরু। তখন লজ্জায় পঞ্চমুখ হয়ে, বিছানা’খানা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারেনি। এখন যখন দেখছে, বুঝতে পারছে তখন তন্ময়ের ধ্যান মেরে তাকিয়ে থাকার কারণ!

তুলতুলে লাল বিছানায় হরেকরকম ফুল। ফুলের পাপড়ি’র সাহায্যে বিছানার মধ্যস্থানে ‘লাভ’ বানানো হয়েছে। লাভের ভেতরে তাদের দুজনের নাম লেখা। ‘তন্ময় এন্ড অরু’। প্রশান্তিতে অরুর ভেতরটা জুড়িয়ে গেল। এতো সুন্দর বিছানায় কীভাবে শুবে? তার তো বসতেও দ্বিধাবোধ হচ্ছে। নষ্ট হয়ে যাবেনা? কতটাই না পরিশ্রম করেছে। কিছুক্ষণ ভেবে অরু ব্যাগ থেকে সেলফোন বের করলো। ক্যামেরা ওন করে বিছানার একটি ছবি তুলল। আরেকটু জুম করে, তাদের নামের অংশটুকুর ছবি তুলে নিল। তোলা ছবি খানা দেখতেই ঠোঁটের হাসি দীর্ঘ হলো। আধঘন্টা তো হয়েছে প্রায়। তন্ময় এখনো ফিরছে না। সে কী ফিরবে না? এই কক্ষে ঘুমোবে না? অরু চিন্তায় মশগুল থাকতে পারছে না। চোখ স্বেচ্ছায় বুঁজে আসছে। প্রচন্ড ঘুম ধরছে। এমন সময় হাতের সেলফোন বেজে উঠলো। মারজির কল। অরু কল রিসিভ করলো। মারজি কল না দিলে, ঘুম থেকে উঠে সে’ই কল ব্যাক করত। মারজির গলা থমথমে শোনালো, ‘অসভ্য পুরুষ মানুষ দিয়ে আমাকে কথা শোনানো হচ্ছে! সব বুঝি। কে ছিল ওই হতবুদ্ধি লোকটা! আমাকে বলে কি-না ফার্মের মুরগী! ওহ্, তোর সাথে বুঝাপড়া আগে করে নেই অরুর বাচ্চা। আমার নাম কী লিখে সেভ করছস? ভালোয় ভালোয় বলে দে।’

অরু খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। প্রাণোচ্ছল দীর্ঘ শব্দের হাসি৷ সুগন্ধি ভর্তি কক্ষ জুড়ে হাসির বিচরণ বয়ে বলল, ‘মারজি তুই আমার নাম কী দিয়ে সেভ করছিস হ্যাঁ? ভেবেছিস আমি জানি না? আমি সব জানি। ‘মধু ওয়ালা তন্ময় ভাইয়ের মধু লোভী মৌমাছি’ দিয়ে সেভ করছিস। আমি দেখেছি। আবার আমার তন্ময় ভাইয়ের নাম্বার সেভ করছিস কীভাবে? ‘মধু লোভী মৌমাছির মধু ওয়ালা তন্ময় ভাই!’ সে মোটেও মধু লোভী মৌমাছির মধু ওয়ালা তন্ময় ভাই না। সে অরুর তন্ময় ভাই। আমাদের নাম ভালোভাবে লিখ, আমিও তোর’টা ভালোভাবে লিখব।’

তন্ময়ের থমথমে চেহারার পরিবর্তন দেখাল। মাত্রই দরজার সামনে এসে দাঁড়ানো সে বেকুব বনে গেল। মুখশ্রীর রঙ বদলাতে দেখা যাচ্ছে। থমকে গিয়েছে পা’জোড়াও। দৃষ্টি অরুর পিঠের উপর নিবদ্ধ। মুলত তারা অরুর প্রাণোচ্ছল দীর্ঘ হাসির শব্দ শুনতে শুনতে এসেছে। তন্ময়ের পেছনে দাঁড়ানো মাহিন মুখ টিপে হাসছে। ব্যাঙ্গ করে ফিসফিস করে তন্ময়ের কানের সামনে বলল, ‘মধু ওয়ালা তন্ময় ভাইয়া! লোভী মৌমাছির মধু ফিরিয়ে দিন। সেগুলো নিয়ে আর কতো ঘুরবেন বলুন!’

তন্ময়ের গাম্ভীর্যের মুখশ্রী দেখে, মাহিনের শব্দ করে হাসতে ইচ্ছে করছে। তবে সে একটি টু শব্দ পর্যন্ত করলো না। আগ্রহী চোখে কান পেতে রাখল। সে কথপোকথন আরও শুনতে চায়। মাহিনকে অসহায়ত্ব করে অরু হুট করে ঘুরে তাকাল। বড়বড় চোখ করে ফেললো। কল আলগোছে কেটে দিল। হতভম্ব অরুর পানে তাকিয়ে, মাহিন এবার উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। ঘর কাঁপানো হাসি। হাসতে হাসতে ফ্লোরে বসে পড়লো। গম্ভীর তন্ময়ের মুখশ্রীর সাথে মধু ওয়ালা তন্ময়কে মেলাতে গিয়ে, আরেকদফা
হাসলো। হাসতে হাসতে সে দিশেহারা একপ্রকার! চোখের কোণের জল মুছে উঠে দাঁড়ালো। নিজেকে যথাসম্ভব ঠিক করে বলল, ‘টাকা দে মধু ওয়ালা। তাড়াতাড়ি। যাই। অনেক কিছু কিনতে হবে।’

তন্ময় থমথমে চেহারায় ল্যাগেজ খুলল। মানিব্যাগ বের করে পাঁচটা হাজার টাকার নোট এগিয়ে দিল মাহিনকে রফাদফা করতে। এভাবে তাদের কারো কাছে ক্যাশ নেই। তন্ময়ও ক্যাশ রাখেনা সচরাচর। আজ অরুর জন্য রাখা মুলত। রাস্তাঘাটে এটাসেটা দেখে চেয়ে বসলে! এই ভেবে আগেই বের করে রেখেছে কিছু খুচরো। মাহিন টাকা পেয়ে আরেক চট হেসে তবেই বিদায় হয়েছে। এদিকে অরু আতঙ্কের শেষ প্রান্তে। তন্ময় কখন এসেছে জানে না। কতটুকু শুনেছে বুঝতে পারছে না। লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়ে বড্ড নাজেহাল অবস্থা তার। গম্ভীর থমথমে চেহারার তন্ময় অরুকে দেখছে। অরুকে অবাকের চুড়ান্তে পৌঁছে দিয়ে সে হুট করেই হেসে ফেললো। ডান হাতে কপাল চোখ ঢেকে হাসছে। অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে হাসা যাকে বলে। আবার ফকফকে সাদা দাঁতের প্রানবন্ত হাসিও বলা যায়।
অরু ভ্রম করছে নাতো? এতো সুন্দর হাসির মালিক তার তন্ময় ভাই? অরু অনিমেষ ভঙ্গিতে দেখছে। ভুলবশত পলক ফেলছে না। তন্ময় দীর্ঘ হাসি ছোট করল। ঠোঁটে মুচকি হাসি লেপ্টে। সে অরুর দিক অগ্রসর হচ্ছে। ধীর স্বরে শুধালো,

‘মারজি ছিলো?’
অরু পিটপিট চোখে তাকিয়ে। ঠোঁট ভিজিয়ে ছোট্ট গলায় জবাব দিল, ‘হু।’
‘কি বলছিল!’
‘কই.. কিছুনা।’
তন্ময় কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। গলার স্বরে ফাজলামোর ইঙ্গিত, ‘আমাকে মধু ওয়ালা বলেছে! কেন? মধু তো চুরি করিনি এখনো। তাহলে?’
অরু বাক্যের মানে বুঝল না। নিজের মতো বলে দিল, ‘অ্যাহ? মারজি মজা করছিল। আমিও একটু..’
‘তুইও একটু মজা করছিলি?’
‘হু।’
‘মজা করা শেষ?’
‘না..হ্যাঁ।’
‘খিদে পেয়েছে?’

অরুর পেট মুচড়ে উঠলো। তার টুকরো খিদে পেয়েছে। পেটে কিছু দিয়ে ঘুমালে ঘুম আরামময় হতো। তাই ভেবেচিন্তে মাথা দুলিয়ে বলল, ‘একটু।’
‘নিয়ে আসি। বোস।’
অরুর সঙ্গে যেতে ইচ্ছে করলো। কিন্তু লজ্জায় সঙ্গে যাবার আবদার ধরলো না। একটু আগে মাহিন কীসব শুনে গেল। তারউপর এমন বাসরঘর সাজাওনোর উদ্ভট বিষয়টি। সব মিলিয়ে সে বেশ লজ্জিত। খাবার আসতে সময় নেয়নি। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে এসেছে। তবে তন্ময় আনেনি। খাবার এনেছে করীম চাচা। প্লেট সাজানো খাবার টি-টেবিলে রাখল। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বৃদ্ধ বলল, ‘মামনী তোমাকে খেয়ে শুয়ে পড়তে বলেছে তন্ময় বাবা। আজকের জন্য কোথাও বেরোনো হবে না। বারবিকিউ পার্টি হবে বাগানে রাতের দিক।’
‘ওহ্! আচ্ছা। সে খেয়েছে?’
‘তা তো বলতে পারছি না মামনী। আমি গিয়ে খেতে বলবো কেমন?’
‘ধন্যবাদ।’

গাড়ির জানালায় ছোট ছোট টোকার খটখটে শব্দ। শাবিহা ঘাবড়ে গেল। অয়নের ছোট চুলে ঘন্টার পর ঘন্টা যাবত চলতে থাকা হাতটি থমকে গেল। চোখজোড়া বড়ো আকার ধারণ করলো। পাশে তাকাল। একজন মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা। মুখ নাড়িয়ে কিছু বলছে। শুনতে পেলো না শাবিহা। বাহির থেকে নিশ্চয়ই কিছু দেখতে পাওয়া যায় না। এখন সে কী করবে? বোধগম্য হচ্ছে না শাবিহার। অয়ন তখনো নিশ্চিন্তে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। শাবিহা দিশেহারা হয়ে একপ্রকার ডাকতে বাধ্য হলো, ‘অয়ন!’
অয়নের চোখজোড়া নড়েচড়ে উঠছে। গুঙিয়ে পাশ ফিরে মুখটা শাবিহার পেটের ভেতর গুঁজে দিল। আচমকা আক্রমণে হতভম্ব, বাকরুদ্ধ শাবিহা। দৃশ্যমান রূপে কেঁপে উঠল। শক্তপোক্ত হয়ে এলো শরীর। ঢোক গিলে ডাকার তাগিদা বাড়াল, ‘এই অয়ন! অয়ন!’

ক্রমশ অয়নের মুখ খানা পেটের গহ্বরে হারিয়ে যেতে ধরেছে। শিরা-উপশিরায় রক্ত চলাচলের তীব্র বেগ। হাত বাড়িয়ে অয়নের মুখে ধরে রাখল। অন্যদিকে কাঁচের খটখট শব্দ এবার জোরে শোনা যাচ্ছে। অয়ন চোখজোড়া খুলল। নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। উঠে বসলো। ঘুম পর্যাপ্ত হয়নি। চোখমুখ ফুলে। চোখজোড়া লালচে। কপাল হতে চুলগুলো তুলে বলল, ‘বসো। বেরিয় না। কথা বলে আসি।’
শাবিহা চিন্তিত মুখে মাথা দোলাল। অয়ন বেরিয়েছে। গাম্ভীর্যের চুড়ান্তে তার হাবভাব। কাঁচা ঘুম ভাঙলে মাথাটাই গরম থাকে। বেরোতেই সামনাসামনি হলো মধ্যবয়সী মহিলার। এখন তার পাশে স্বল্প বয়সের কুমারী মেয়ে। ফটফট চোখে তাকিয়ে। অয়নকে সমানতালে দেখে চলেছে। অন্যদিকে ভদ্রমহিলা অয়নকে ভালোভাবে দেখে নিল। ঘুমাচ্ছিলো মনে হয়। দেখতেও সভ্য-টব্য। মহিলার মুখশ্রী নরম হলো। চওড়া গলায় শুধালেন, ‘কে তুমি বাবা? এখানে কী করতাছ?’

অয়ন ভদ্রতাসূচক হাসার চেষ্টা করতে পারলো না। প্রচন্ড মেজাজ গরম তার। ঘুমে মাথাটা জ্বলছে। গম্ভীরমুখে জবাব দিল, ‘ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। তাই বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। এখনই বেরোবো।’
‘সাথে কেডা?’
মাথাটা বাড়িয়ে গাড়িতে নজর দিল ভদ্রমহিলা। চোরাচাহনিতে দেখছে বারংবার। অয়ন বিরক্ত হলো, ‘ওয়াইফ।’
‘অ্যাহ?’
পাশের যুবতী মেয়েটি বুঝিয়ে বলল, ‘মা স্ত্রী বলেছে। সাথে স্ত্রী আছে।’
ভদ্রমহিলার মুখশ্রী এবার খুব নরম হয়ে গেল। ম্লান হাসলেন, ‘আমি হেলেনা। বাড়ির সামনে গাড়ি দেইখা একটু চিন্তায় পড়লাম। বাবা মাতাল কতগুলা নিরিবিলি জায়গা পাইয়া চলে আসে। উদ্ভট সব কান্ডকারখানা করে যায়। সেইবার তো গেং রেপ ক্যাস হইয়া গেল। তাই বাবা এতো সতর্কতা। থাকো কই? শহরের থেকে আইলা মনে হচ্ছে!’
‘জি। হানিমুনে যাচ্ছি।’
খুব স্বাভাবিক ভাবে একের পর এক মিথ্যে নির্দ্বিধায় বলে যাচ্ছে অয়ন। না নড়ছে ঠোঁট আর না নড়ছে চোখ। খুব সাবলীল ভঙ্গিমা। হেলেনা বেগম উদ্বিগ্ন হলেন, ‘এতো সুন্দর পোলা। বউ তাইলে কতটাই না সুন্দর হইবো। বেরোতে বলো না বাবা। একটু দেখি।’

এতো কৌতূহল কেন! ভদ্রসভ্য অয়ন ভদ্রমহিলার মুখের উপর দ্বিমত করতে পারছে না। আর না পারছে গাড়িতে ঢুকে টান মেরে চলে যেতে। মনে অতিষ্ঠ হয়ে দরজা খুলল। মাথাটা ঢুকিয়ে বলল, ‘বেরোবে?’
শাবিহা মাথা দোলাল। সে দরজা খুলে বেরোলো অপরপাশ হতে। কামিজ পরিহিত ফর্সা, স্লিম ফিগারের সুন্দরী মেয়ে। দেখতেই সুশীল, ভদ্র উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়ে মনে হচ্ছে। শাবিহা সালাম জানাল। সামান্য হাসার চেষ্টা। হেলেনা এমন সাংস্কৃতিক ভদ্র মেয়েমানুষ দেখে গলে রসমালাই বনে গেলেন। চাতক পাখির মতো ছুটে গেলেন, ‘মাশাআল্লাহ! কী সুন্দর মাইয়া। দুজনকে পইপই মিলিয়ে বানিয়েছেন আল্লাহতালা।’

প্রশংসা শুনে অয়নের গম্ভীরমুখের পরিবর্তন ঘটলো। গাম্ভীর্য অনেকাংশে কমে এলো। ঘুম কিছুটা ছুটে গেল। নরম চোখে নিজের শাবিহার দিক তাকাল। হু! প্রশংসা করবেনা আবার! তার শাবিহা পরীদের থেকেও সুন্দর। হেলেনা শাবিহার দুহাত ধরে প্রশ্ন করলেন, ‘নতুন বিয়া না? চোখমুখে সব পরিষ্কার লেখা তুমি নতুন বউ। এমন লজ্জায় লালনীল আমিও হইছি বুঝলা। তোমার আংকেলের দিক চোখ তুলে তাকাতেই পারতাম না। কি যে লজ্জা লাগতো। আর এখন দেখ! মাজায় কাপড় বেঁধে ঝগড়া করি।’

শাবিহা সন্দেহ দৃষ্টিতে তাকাল অয়নের পানে। নতুন বউ কবে হয়ে গেল সে! ঠোঁট কাঁপছে ভদ্রমহিলাকে ভুল সাবিত করার জন্য। পড়ে ভাবলো এভাবে গাড়িতে দুজন একসাথে ছিলো। স্বামীস্ত্রী না বললে ভালো দেখাবে না। বরং এই মানুষগুলোও কুৎসিত কিছু ভেবে বসবে। তাই আর মুখ খুলল না। সয়ে গেল। হেলেনা হেসে বলতেই থাকলেন, ‘হানিমুনে কই যাইতেছ? আমাদের আশেপাশে ঘোরার সুন্দর জায়গা আছে। শহর থেইকা অনেকেই ঘুইরা যায়।’
শাবিহা থমথমে চোখে তাকাল। গলাটা শুকিয়ে কাঠকাঠ। হানিমুন? আর কীসব বলেছে এই পুচকে ছেলেটা?

সূর্য ডুবেছে। আঁধার নেমেছে। বাতাস ছেড়েছে। প্রকৃতি ঠান্ডা এবং উচ্ছ্বাসিত। আকাশে চাঁদ নেই। মেঘেদের দলে ঘেরা সম্পুর্ন আকাশ। বাগানে বিশাল বড়ো তাবু টানানো হয়েছে। সঙ্গে তাবু সাইজের আমব্রেলা। বেশকিছু চেয়ার পাতা সেখানে। মধ্যে গোল টেবিল। বাতি লাগানো চারিপাশে। ইটের সাহায্যে আগুন ধরানো হয়েছে। আগুনের উপরে বারবিকিউ রড রাখা। গ্রিল হবে মুরগী। গোস্তো ভাজা হবে। শিকাবট হবে। আরও কিছু গোস্তোর ভাজা আইটেম। সঙ্গে ভেতরে বাবর্চির হাতের স্পেশাল আইটেমস তো আছেই। মাহিন ব্যস্ত পায়ের এসে তন্ময়ের পাশে বসলো, ‘কই অরু? ঘুমিয়ে এখনো? তুই ঘুমোতে গেলি না যে! এতো সুন্দর বাসরঘর পেতে দিলাম। ভেবেছিলাম প্রেয়সী নিয়ে দিব্বি ঘুমোবি।’

ইব্রাহিম হতাশ সুরে তাল মেলাল, ‘ওর ভেতরে গন্ডগোল আছে বুঝলি। চলে না নাহলে নষ্ট। বউ রেখে শালায় যে কেম্নে ঘুরেফিরে আমার বুঝে আসেনা।’
তন্ময় দাউদাউ করে জ্বলজ্বল করতে আগুনের পানে তাকিয়ে। দৃষ্টি নিথর। মাহিন হেসে বলল, ‘কাজ করে দেখেই এখানে বসে। দেখছিস না ঘরে যেতে চাচ্ছে না। বাসরঘর দেখে ওর মধ্যে কিছু-মিছু হচ্ছে দোস্ত!’
তন্ময়ের থমথমে গলা, ‘মোটেও ঠিক করিস নি।’
মাহিন চওড়া গলায় হাসলো, ‘অনেক কিছু এখনো বাকি। আগে আগে দেখ হোতা হে ক্যায়া!’
তন্ময় চোখ রাঙাল। কাজে দিল না। মনের ভেতরটা সংকোচে মুচড়ে উঠলো। কীসব উল্টাপাল্টা সিচুয়েশনে দাঁড়া করাবে, ভাবতেই মাথাটা ধক করে জ্বলছে! নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা নেহাতি অসম্ভব হয়ে পড়ছে। তিলেতিলে জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। মরন যন্ত্রণা বুঝি একেই বলে!

শুহানি এসেছে। শাড়ি পরেছে। শুধু সে নয়! সব মেয়েরাই শাড়ি পরেছে। সেজেগুজে হাজির। বাগানে পার্টি হবে বলে কথা। মিউজিক সিস্টেমও বাজানো হচ্ছে! মাহিন উঠে দাঁড়ালো। শুহানিকে ইশারা করে একটু দূরে আনলো। ধীর স্বরে বলল, ‘দোস্ত অরু মনে হয় ঘুমোচ্ছে। ওরে উঠিয়ে তৈরি করে আন। এমন ভাবে তৈরি করাবি যেনো তন্ময় চেয়ার থেকে পড়ে যায়! বুঝলি? শালা আজ ওর বাসর তো হওয়াই ছাড়মু!’
শুহানি মুখ টিপে হাসলো। উপর নিচ করে মাথা দোলাল ক্রমাগত, ‘আমার সাদা শাড়ি আছে। তন্ময়ের সাদা রঙ পছন্দ না? ওইটা নিয়ে যাই। তারপর দেখ ওর কী অবস্থা হয়!’
‘যা ফুট!’

উদ্বিগ্ন মনে ছুটে গেল শুহানি। তার সাথে বান্ধবী মেহরুনও ছুটলো। যেতে নিয়ে শুনে নিল পুরো কাহিনি। উত্তেজনায় টানটান অবস্থা তারও। সে পুরোদমে লেগে পড়লো শুহানির সাথে অকাজে।
শব্দ শুনে অরু ছটফটিয়ে উঠে বসেছে। সে সোফায় ঘুমিয়েছিল। এতো সুন্দর বিছানা সে নষ্ট করতে পারলো না। হুড়মুড়িয়ে ঢুকেছে দু’তিনজন শাড়ি পরিহিত মেয়ে। সেজেগুজে চমৎকার রূপে আবদ্ধ। সেখানকার একজনকে চিনেছে। শুহানিকে! বাকি দুজন অচেনা। তারা ঢুকে নিজেদের মতো ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। হাতের শাড়ি, কসমেটিকস একত্রে ড্রেসিং টেবিলে রাখছে। শুহানি এগিয়ে আসল৷ অরুকে উঠিয়ে ওয়াশরুম পাঠাল জোরপূর্বক। অরু সময় নিয়ে ফ্রেশ হতে চাইল। এসব কি হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করল! সুযোগ দেওয়া হলো না তাকে। শুহানি করাঘাত করছে শব্দ করে। বাধ্য হয়ে বেরোলো অরু। শুহানি মজার সুরে বলল, ‘ভয় নেই প্রিটি গার্ল। উই আর ইওর এলডার সিস্টার্স! তোমাকে তৈরি করব। নিচে তো পার্টি হবে। সেখানে তো একটু সেজেগুজে যেতে হয় তাই না?’
অরু পুতুলের ন্যায় মাথা দোলাল। শুহানি নরম চোখে তাকিয়ে। আদুরে স্বভাবে অরুর গাল টেনে দিল, ‘লক্ষি মেয়ে। চুপচাপ বসো দেখি।’

অরুকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পুতুলের ন্যায় সাজানো হচ্ছে। শাড়ি পরাবে মেহরুন। সে খুব ভালো শাড়ি পরাতে জানে।সমস্যা বেঁধেছে ব্লাউজ নিয়ে।শুহানিরটা অরুর হবেনা। ঢোলা হবে বেশ। হুট করে মনে পড়লো তার আকাশী রঙের ক্রপ টপ আছে। এগুলো দিয়ে শাড়ি পরলে আরও সুন্দর দেখায়। সে ছুটে সেটা নিয়ে আসলো। গেঞ্জির কাপড়। বেশ ছোট। অরুর পারফেক্ট হবে। ফিটিংসে কোনো কমতি থাকবে না।
ঘড়ির কাঁটা সাতটা একুশে। একঘন্টা নিয়ে তাকে সাজানো হয়েছে। শাড়ি পরতেই সময় গেল বেশি। আপাতত শাড়ি পরিহিত অরু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। চমৎকার চোখ ধাধানো নিজেকে দেখে ঝটকা খেল। খুটিয়ে খুটিয়ে সময় নিয়ে দেখল। পিঠে সোজা পড়ে থাকা চুলগুলো দুলিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজেকে দেখছে। শুহানি পেছনে দাঁড়িয়ে, ‘মাশআল্লাহ! খুব সুন্দর লাগছে। তোমার কেমন লাগছে অরু?’
অরু ফিরে তাকাল। লাজুক হাসি চোখমুখে,’খুব সুন্দর।’

‘সাজগোজে আমি এক্সপার্ট বুঝলে। রিহান আমাকে এরজন্য প্রচন্ড কথা শোনায়। এতো সাজুগুজু করে অন্যকারো সাথে পালানোর মতলব এঁকেছি নাকি! ছেলেটা হিংসুটে!’
অরু আগ্রহী স্বরে শুধালো, ‘বিয়ের কত বছর আপনাদের আপু?’
‘উম, প্রেমের সাত বছর। বিয়ের তিন বছর। আমাদের পরিচয় স্কুল জীবন থেকে। পাশাপাশি বাড়ি ছিলো।’
‘স্কুল জীবন থেকে প্রেম?’
‘উহু না। ইন্টার থেকে। এর আগে দুজন সাপ বেঁজীর মতো লেগে থাকতাম।’
‘তাহলে প্রেম কীভাবে হয় আপু? প্রপোজ কে করে?’
‘চলো যেতে যেতে বলি।’
‘আচ্ছা।’

অরু কুঁচি ধরে হাঁটছে। ব্যাকুল নয়নে তাকিয়ে শুহানির পানে। প্রেমের গল্প শুনবে। শুহানি সময় নিয়ে বলতে লাগলো, ‘ক্লাস সিক্স পর্যন্ত মারামারি করে কাটিয়েছি। সেভেন থেকে বন্ধু হলাম। ক্লোজ ফ্রেন্ডস। আমি ভাই ওকে সর্বদাই বন্ধু ভেবে এসেছি। কখনো কিছু ফিল করিনি। ও নিজেই পরিবর্তন হয়ে গেল ক্লাস টেন থেকে বুঝলে? আমি জানতাম না। ইন্টারে দুজন একই কলেজ। ব্যাচের একটা ছেলে আমাকে প্রপোজ করে। হ্যান্ডসাম ছেলে। আমিও ভাবলাম ট্রায় করে দেখি। ওমা, আমি প্রেম করবো শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। রেগেমেগে অস্থির। পারেনা আমাকে মেরে তক্তা বানাতে। আমিও রাগলাম। ও কিন্তু নিজে মেয়েদের সঙ্গে দুনিয়ায় ঘেঁষাঘেঁষি করেছে। আমার স্ব-চোক্ষে দেখা। ও কতো তুলসীপাতা আমিতো জানি। তাই ইগ্নোর করতে লাগলাম। মাস খানেক করেছিও বুঝলে। কিন্তু খারাপ লাগছিল। মনের বন্ধু। সে এমন ভেঙে পড়লো চোখের সামনে মানতে পারিনি। বন্ধুত্ব বজায় রাখতে যাই। সাহেব প্রপোজ করেন। কোনো মেয়ের সাথে কখনো জড়াবে না, গ্যারান্টি দিল। আমিও কিছুদিন পিছু ঘোরালাম। তখন কিন্তু ওর প্রতি প্রেম আমি উপলব্ধি করে ফেলেছিলাম। তবু্ও স্বীকার করিনি। আমাকে প্রেমিক হিসেবে পেতে ওকে বেশ কাঠখড় পোহাতে হয়েছে।’

হুট করে শুহানি শব্দ করে হাসতে লাগলো। অরু হঠাৎ হাসির কারণ বুঝে পেল না। বোকার মতো চারপাশে তাকাল। তারা বাগানে এসে পড়েছে ইতোমধ্যে। গান বাজছে। আশেপাশে অনেকেউ হাঁটাচলা করছে। হাসাহাসি করছে। গান গাইছে। দুলছে। অরু সকলের মধ্যে তন্ময়কে খুঁজে পেল। আমব্রেলার নিচে দাঁড়িয়ে। একটা চেয়ার তার পায়ের নিচে পড়ে। হাতের সেলফোনটাও জমিনে।
স্তব্ধ শরীর আর মুগ্ধ নয়ন অনিমেষ ভঙ্গিতে অরুকে দেখছে। অরু কিছুটা বুঝতে পেরে লজ্জা পেলো বটে। শুহানির সঙ্গে বাকিদের তুমুল হাসির শব্দ ভেসে এলো। মাহিন কড় তালি দিচ্ছে, ‘সাব্বাশ দোস্ত! তোর থেকে এটাই আশা করেছি। ছক্কা মেরে দিছোস! তন্ময় পড়েনি। তবে চেয়ার আর সেলফোন তো পড়েছে। এটাই এনাফ!’
ইব্রাহিম শিষ বাজালো জোরসে। রিহান ইব্রাহিমের উদ্দেশ্যে বলল, ‘অরু মারাত্মক সুন্দর তাই না? মেয়েটা এতো মায়াবী। তন্ময়ের সেল্ফকন্ট্রোলের দাঁত দিতে হবে।’
‘শাড়ি আর সাদা রঙ মিলে এক অনাকাঙ্ক্ষিত মায়াবতী। আজ তন্ময় কই যাবে!’
হেসে ফেললো রিহান। থতমত খাওয়া তন্ময়কে আরেকবার দেখে নিল। ইশ, দুজনকে একসাথে এতটা মানায় যে রিহানের বুক জ্বলছে।

অরু তন্ময়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। শাড়ির কুঁচি ধরছে একটু পরপর। চুলগুলো সামলে নিচ্ছে। বাতাস ছেড়েছে। আবহাওয়া ঠান্ডা। বৃষ্টি নামবে মনে হয়। তার পাশে তন্ময় কাঠকাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে। অরু লাজুক চোখে তাকাল। তবে তন্ময় ভুলেও পাশে ফিরছে না। তাকাচ্ছে না৷ অরু খানিক মন খারাপ করলো। এতো সুন্দর তৈরি হয়ে আসলো। অথচ তন্ময় তাকাচ্ছেও না ভালোভাবে! কেন!
‘ছাম ছাম’ গানে নাচার প্ল্যান করা হলো। শুহানি, মেহরুন আর ঝর্না নাচবে। সকলে গোল হয়ে বসেছে চেয়ার পেতে। মিউজিকের লাউড বাড়ানো হয়েছে। অরু তন্ময়ের পাশে বসে। হাতে হাত রেখে আগ্রহী চোখে তাকিয়ে। নাচ শুরু হতেই করতালি। অরু হাসছে। নাচগান সে বড্ড উপভোগ করে কিনা।

হাততালি, শিষ বাজানো, চেঁচামেচি সবকিছু একত্রে কানে ভাসছে। উত্তেজিত মানুষদের সঙ্গে অরুও একটু উত্তেজিত। ছোট্ট গলায় সেও গানের সঙ্গে ঠোঁট মেলাচ্ছে। হাততালি দিচ্ছে। পাশে কাঠকাঠ হয়ে বসে থাকা তন্ময়কে ভুলে গেল প্রায়। হঠাৎ অরু হাততালি দেওয়া বন্ধ করে দিল। মুখের হাসি উধাও হয়ে গেল। শ্বাস আটকে এলো। ধীরে উপলব্ধি করছে ঠান্ডা হাতের ছোঁয়া। যা শাড়ি ভেদ করে পেট ছুঁয়েছে। চমকে আঁড়চোখে পাশে তাকাল। তন্ময় তাকিয়ে। অরুর বুকের ভেতর তুফান শুরু হলো। তোলপাড়, বেসামাল পরিস্থিতি। থরথর করে কেঁপে উঠা হাত তন্ময় আলগোছে লুকিয়ে মুষ্টিবদ্ধ করেছে নিজের হাতে। শক্ত করে ধরে আছে। মুখটা কাছাকাছি নিয়েছে। ঠিক অরুর কান বরাবর। কানে ঠোঁট ছুইছুই অবস্থা। অরু ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকাল। কেউ এদিকে তাকিয়ে নেই। সবাই নাচগানে ব্যস্ত। কানে ঘনঘন শ্বাসপ্রশ্বাস উপলব্ধি করা যাচ্ছে। তন্ময়ের অসম্ভব গভীর স্বর শোন গেল, ‘খুব খুশি না? আমাকে আগুনে জ্বলতে দিয়ে তুই দিব্বি আছিস!’

পেটে চাপ পেয়ে ভয়ার্ত হতভম্ব অরু মুচড়ে উঠলো। খামচে ধরেছে কী? অরু ব্যথিত সুরে বলল, ‘কি করেছি?’
‘নির্বোধ!’
থরথর করে কেঁপে উঠল অরু। তন্ময় হাওয়ার বেগে ধরেছে তেমনি হাওয়ার বেগে ছেড়ে দিয়েছে। কারণ শুহানিদের নাচ শেষ। সকলেই আগের মতো বসেছে নিজেদের চেয়ারে। এতক্ষণের হাস্যজ্বল অরু মুহুর্তে অনুভূতির সাগরে ভেসে চুপসে গেল। থমকে গেল। অতি চেষ্টা করেও হাসতে ব্যর্থ হলো।
কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি নামছে। ফোটা ফোটা। অরুর হাতের তালুতে একফোঁটা বৃষ্টি এসে পড়লো। মুগ্ধ নয়নে অরু সেখানে তাকিয়ে। বৃষ্টি আসার খুশিতে সে পুনরায় তন্ময়কে ভুলে গেল। ভুলে গেল তার করা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। শুহানি শব্দ করে চেঁচাল,
‘উফ! বৃষ্টি’টা আরেকটু আগে আসত। তাহলে ‘ছাম ছাম’ গানে বৃষ্টিতে ভিজে নাচা যেতো। তাই না?’
‘আরেকবার হয়ে যাক তাহলে?’
‘অবশ্যই!’

হৈ-হুল্লোড় পড়ে গেল পুনরায়। ঝুম বৃষ্টি নামতে দেখে সকলে আঁটসাঁট হয়ে আমব্রেলা এবং তাবুতে ঢুকে গেল। মুলত এগুলো আজকের ওয়েদার জেনেই গাড়া হয়েছে। বৃষ্টি উপভোগ করে আড্ডা দেওয়া হবে। রাত দশটা পঁয়তাল্লিশ। সময় কীভাবে পেরিয়ে গেল বলা দায়। মুশলধারা বৃষ্টি হচ্ছে। শুহানি’রা পুনরায় নেমেছে বৃষ্টির মধ্যে। নাচের একফাঁকে একেক করে অনেকে, যোগদান করলো। আমব্রেলার মধ্যে রয়ে গেল তিন চারজন মানুষ। তাদের মধ্যে তন্ময় অরু উপস্থিত। একসময় শুহানি ছুটে এলো অরুকে সঙ্গে নিবে বলে। তন্ময় দ্বিমত করলো। অরুর পাতলা শাড়ি। এভাবে বৃষ্টিতে ভেজার প্রশ্নই আসে না। তার উপর এই মেয়ের অল্পতেই ঠান্ডা জ্বর বেধে যায়।
খাওয়াদাওয়ার পর্ব চুকিয়ে মেয়েদের ভেতরে যাবার নির্দেশ দেওয়া হলো। এবার পুরুষদের পার্টি। তাদের পার্টি বলতে মদ্যপান সহ হাবিজাবি। অরু শুহানির সাথে ভেতরে এসেছে। তার রুমেই বসে। আর সকলের সঙ্গে গল্প মশগুল করতে ব্যস্ত হতে চাইল।কিন্তু পারলো না। তন্ময়ের অসভ্য দৃষ্টি বেপরোয়া ছোঁয়া এখনো মস্তিষ্কে গেঁথে আছে। পিঁড়া দিচ্ছে। বুকের ধুকপুক বাড়িয়ে দিচ্ছে। এই কী যন্ত্রণা!

ঘড়ির কাঁটা বারোটায় ছুইছুই। অরু কক্ষের দিক যাচ্ছে মাত্রই। ওই ফুলের বাগান নামক কক্ষে যেতেই বুকের উঠানামার গতি বেড়ে যায়। সুগন্ধে মাতোয়ারা হতে বাধ্য হতে হয়। তন্ময় নেই ভেবে সে ব্যস্ত পায়ে ঢুকে পড়লো। ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঢুকে সুইচড খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। হুট করে পেছন থেকে দরজা লাগানোর শব্দ শোনা গেল। নিস্তব্ধ কক্ষে অতটুকু শব্দ বজ্রপাতের মতো। ভয়ে লাফিয়ে উঠলো অরু। অন্ধকারে কিছুই দেখতে পেল না। প্রশ্ন করবে পূর্বেই বাতি জ্বলে উঠলো। সামনে তন্ময় দাঁড়িয়ে। উষ্কখুষ্ক চুলগুলো কপাল থেকে উঠিয়ে দিল। গভীর নেশাতুর চোখে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টি কম্পন সৃষ্টি করছে যেন৷ অরুর সর্বাঙ্গ শক্ত হয়ে গেল। হাসফাস লাগছে। দমবন্ধ হয়ে আসছে। চোখ তুলে তাকানোর চেষ্টা করল। তন্ময় একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে চোখ বুজে। মিনিট খানেক চোখ বুঁজে দাঁড়িয়ে থাকলো। যেমন কঠিন কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।

অরু কী কিছু বলবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য? সেমূহুর্তে তন্ময় চোখ মেলে তাকাল। ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে এলো ভাবুক অরুর দিক। বড়বড় পায়ের ধাপ। সেকেন্ডেই সামনে চলে এসেছে। অরুও আনমনে পিছিয়ে বিছানার কাঠের সঙ্গে লেগে গিয়েছে। কোমরে শক্ত ঠান্ডা হাতের স্পর্শ। মুর্তির ন্যায় দাঁড়ানো অরু আতঙ্কিত হয়ে শক্ত করে চোখ বুঁজে ফেলেছে। তন্ময় ততক্ষণে তার ঠোঁট নিজ ঠোঁট দ্বারা আঁকড়ে নিয়েছে। উন্মাদ হয়ে গিয়েছে। নিজের সঙ্গে শক্ত করে চেপে ধরেছে। তার উত্তেজিত শ্বাসপ্রশ্বাস অশান্ত আজ। বিচলিত হাতের স্পর্শ অরুর সম্পুর্ন শরীরে বিচরণ চালাচ্ছে। থরথর কাঁপতে থাকা অরুকে আজ কোনো সুযোগ দেওয়া হলো না। শ্বাস নেবার সময় দেওয়া হলো না।
ঠোঁট ছেড়ে ঠোঁট অরুর ঘাড়ে নামিয়েছে তন্ময়। তার গলার স্বর আটকে আসছে, ‘একটু মদ খেয়েছি। মাতাল নই। অরু আমার… শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। দাউদাউ করে জ্বলছে সবকিছু। ভস্ম করে দিচ্ছে।তুই…তুই কী রাজি? যদি না হয়, তাহলে তুই..না। অরু…. ‘

এতো ব্যাকুল কন্ঠ, অসম্ভব লালচে চেহারা, এই বিচলিত তন্ময়কে দেখে থমকে গেছে অরু। অসম্ভব লজ্জা, দ্বিধা কাটিয়ে চোখ মেলে তাকাল। বুক ভরে শ্বাস নিল। কম্পিত হাত বাড়িয়ে তন্ময়ের পিঠে রাখল। তন্ময় যেমন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। মুহুর্তে অরুকে পাজাকোলে তুলে নিল। ঠোঁটে পুনরায় ডুবে গেল। সাজানো নরম তুলতুলে বিছানায় পিঠ ঠেকল অরুর। সর্বাঙ্গ জুড়ে লাজ। কোথায় হাত রাখবে আর কোথায় দৃষ্টি বুঝে পাচ্ছে না। এদিকে হালকা নেশায় তন্ময় বুদ হয়নি। তবে সেল্ফকন্ট্রোল হারিয়ে বসেছে।

প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল পর্ব ৪৭+৪৮

বৃষ্টি থেমেছে। মেঘ সরেছে। আকাশ পরিষ্কার। চাঁদ ভেসেছ। কক্ষের বাতি নেভানো। জানালা দ্বারা দমকা ঠান্ডা বাতাস। উড়িয়ে তুলছে পাতলা সাদা পর্দা। চাঁদের আলো উঁকি মারছে। অরু ছটফট করছে অস্পষ্ট স্বরে। চোখ ভিজে আছে। তার ছোট্ট দেহ তন্ময়ের পেশীবহুল দেহের নিচে চাপা পড়ে আছে। তন্ময় তার মুখের দিকে তাকিয়ে। সর্ব মুখশ্রী জুড়ে চুমু বসাচ্ছে। কাতর গলায় বলে উঠলো আঁধার কক্ষে, ‘অনেক ধৈর্যের ফল তুই আমার। খুব আদরের। অনেক ভালোবাসার। খুব ভালোবাসি তোকে…. আমার জান।’

প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল পর্ব ৫১+৫২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here