বর্ষণের সেই রাতে সিজন ২ পর্ব ৩৩

বর্ষণের সেই রাতে সিজন ২ পর্ব ৩৩
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

‘আদ্রিয়ান আবরার জুহায়েরের সাথে আপনার কী সম্পর্ক?’ ‘আপনারা কী লীভ ইন করছেন?’ ‘মিস অনিমা আপনি কোন সম্পর্কের ভিত্তিতে রকস্টার এডির বাড়িতে থাকছেন? কী পরিচয় আপনার?’ ‘প্লিজ কিছু বলুন?’ সাংবাদিকদের নানারকম প্রশ্নের কোলাহলে চারপাশে বিরক্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। ক্যামেরাথ লাইটের আলোগুলো থেকে থেকে জ্বলে উঠছে।

অনিমা প্রায় কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। সাংবাদিকরা জেকে ধরেছে ওকে, তারওপর ও অসুস্থ। চোখ দিয়ে জল পরছে আর জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে ও। তবুও সাংবাদিকরা থামছেনা। একটান প্রশ্ন করেই চলেছে! অরুমিতা আর স্নেহা মিলে অনিমাকে আড়াল করে রাখার চেষ্টায় আছে। আর তীব্র ওনাদের সরানোর চেষ্টা করছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ওরা ওই সিনিয়রদের সামলে গেটের কাছে এসে দেখে কিছু সাংবাদিক অনিমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে নানারকম প্রশ্ন করে যাচ্ছে আর ছবি তুলছে। অনিমা সরতে চাইছে কিন্তু পারছেনা। ওর দ্রুত এগিয়ে এসে অনিমাকে ওনাদের কাছ থেকে সরানোর চেষ্টা করছে কিন্তু ব্যর্থ হচ্ছে। আদ্রিয়ানকে ফোন করেছিল তীব্র কিন্তু ফোন বন্ধ বলছে। হয়তো রেকর্ডিং এ আছে। ওনারা ওনাদের প্রশ্ন বান চালিয়েই যাচ্ছেন । অনিমা একপ্রকার হিচকি উঠে গেছে, ও ওরকম গলাতেই অস্ফুট স্বরে কিছু বলল কিন্তু কেউ বুঝলোনা। সাংবাদিকদের মধ্যে একজন বলল,

” মিস অনিমা, প্লিজ বলুন কে হয় আদ্রিয়ান আপনার? আপনারা কী কোন অবৈধ সম্পর্কে জড়িত?”
গোটা ভার্সিটি অবাক হয়ে দেখছে। এরা হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হল? যদি এনারা এরকম হঠাৎ হঠাৎই উদয় হয়। কেউ কেউ দেখে ভীষণ মজা পাচ্ছে ব্যাপারটায়। অনিমা ব্যাপারটা আর নিতে পারলনা। ওখানে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। অরুমিতা আর স্নেহা মিলে দ্রুত ধরে ফেলল। তীব্রর চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে, ও এবার ক্ষিপ্ত চোখে সাংবাদিকদের দিকে তাকিয়ে বলল,

” মেয়েটা অসুস্থ! অজ্ঞান হয়ে গেছে। এবার তো ছাড়ুন! মেরে ফেলবেন ওকে?”
কথাটা বলে তীব্র একপ্রকার জোর করেই ওনাদেরকে সরিয়ে দিল। অরুমিতা, স্নেহা, তীব্র ধরে বহু কষ্টে অনিমাকে ওখান থেকে বেড় করে নিয়ে এলো। মেয়েটাকে এই পরিস্থিতি থেকে বেড় করে আনতে একপ্রকার যুদ্ধই করতে হয়েছে ওদেরকে। ওরা বেড়িয়ে যেতেই সাংবাদিকরা হেডলাইন বানাতে শুরু করে দিল ‘ আদ্রিয়ান আবরার জুহায়ের বাড়িতে কে এই অপরিচিত তরুণী’ ‘কার সাথে লীভ ইন করছেন রকস্টার এডি’ ইত্যাদি ইত্যাদি। খবরটাকে রসালো করতে ঠিক যা যা করা লাগে তাই তাই করছে। খবরটার মধ্যকার সত্যি বা মিথ্যেটুকু যাচাই করার দরকার নেই তাদের। আসল কথা হল খবরটা পাবলিক কতটা খাবে সেটাই। সহজ ভাষায় যাকে বলে বিজনেস স্ট্রাটেজি।

এদিকে খবরটা রঞ্জিত চৌধুরী আর কবির শেখ অবধি পৌছাতেই সে চমকে উঠলেন। অনিমাকে কোথায় না খুঁজেছে আর এই মেয়ে কি-না ওখানে। রিক সেভাবে নিউস দেখেনা। কিন্তু লোকমুখে তো অবশ্যই শুনবে। কবির শেখ অনেক্ষণ ভেবে বলল,
” কালকে ওর আদ্রিয়ানের বাড়ি যাবার কথা তাইনা?”
” হ্যাঁ! তো?”
কবির শেখ গম্ভীর গলায় বললেন,
” যেভাবেই হোক ওর যাওয়া আটকান আর ওকে ব্যস্ত রাখুন। নিউস বা ফোনের কাছে যাতে সহজে যেতে না পারে। তাড়াতাড়ি করুন।”
রঞ্জিত চৌধুরীও রিককে এখন কী দিয়ে বসিয়ে রাখবে সেটাই ভাবতে লাগল।

বিছানায় দুই পা গুটিয়ে বসে মাথা মুখ কাচুমাচু করে বসে আছে অনিমা। কারণ ওর সামনে এখন বনের সাক্ষাৎ সিংহ দাঁড়িয়ে আছে। এখন শুধু গর্জন করে ওঠা বাকি। সবাই গর্জনের কম্পন সহ্য করার জন্য মোটামুটি প্রস্তুত! তীব্র, অরুমিতা, স্নেহা এককোণে গুটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নাহিদ আর অভ্রও অনেকটা ভেজা বেড়াল স্টাইলে দাঁড়িয়ে আছে। জাবিন দরজার পাশে দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। ও জানে ওর ভাইয়ের রাগ সম্পর্কে। আদ্রিয়ানকে দেখলে এখন ভালো লোকেরও হাওয়া টাইট হয়ে যাবে। একহাতে চুলগুলো উল্টে ধরে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে আবার ছেড়ে দিল। অবাধ্য চুলগুলো আবার কপালে এসে পরল। আদ্রিয়ান অভ্র দিকে তাকাতেই অভ্র সোজা হয়ে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াল। আদ্রিয়ান ওর কাছে গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে ধীর গলায় বলল,

” কোন কোন নিউজ চ্যানেল ছিল খোঁজ লাগাও। ইমিডিয়েটলি!”
অভ্র মাথা নিচু করে বলল,
” আমি খোঁজ নিতে পাঠিয়েছি। কিছুক্ষণের মধ্যে রিপোর্ট চলেও আসবে!”
” আর হঠাৎ ভার্সিটিতে প্রেস কীকরে হাজির হল সেই খবরটাও আমার চাই আজকের মধ্যে।”
” স্যার সেই খবরটা নেওয়ারও ব্যবস্হা হয়ে গেছে।”

আদ্রিয়ান আবারও জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস নিলো। বোঝাই যাচ্ছে যে ওর রাগ মোটেও কমছেনা। তবে কমানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করে চলেছে ও। তীব্রদের দিকে তাকাতেই ওরা তিনজনই থতমত খেয়ে নড়েচড়ে দাঁড়াল। আদ্রিয়ান ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আঙুল দিয়ে নাক স্লাইড করতে করতে বলল,
” ক্যাম্পাসের ভেতরে এক্সাক্টলি কী হয়েছিল? কোনপ্রকারের ভনিতা না করে ফার্স্ট টু লাস্ট বল আমাকে। একটা সেন্টেসও যাতে মিস না হয়।”

অরুমিতা আর স্নেহা কথা বলার মত অবস্থায় নেই। আদ্রিয়ানের রাগ দেখে ওদের গলার স্বর গলাতেই আটকে আছে। আদ্রিয়ান তাকাতেই তীব্র অনেকটা সাহস জুগিয়ে সবটা বলে দিল। কিচ্ছু বাদ রাখেনি। সব শুনে আদ্রিয়ানের রাগের মাত্রা প্রচন্ড বেড়ে গেছে সেটি ওর লালচে মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তবুও খুব শান্ত দেখাচ্ছে ওকে। ও শান্তভাবেই বলল,
” সবাই বেড় হও রুম থেকে।”

কিন্তু আদ্রিয়ানের স্বাভাবিক কন্ঠটাও ওদের কাছে রীতিমতো হুমকি মনে হলো। তাই কেউ সাহস পেলোনা রুমে থাকার। সবাই বেড়িয়ে গেল। অনিমা উঠে দাঁড়াতেই আদ্রিয়ান বলল,
” তোমাকে যেতে বলিনি আমি।”
অনিমা অসহায় মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল। আদ্রিয়া গিয়ে শব্দ করেই দরজাটা বন্ধ করে দিল। আদ্রিয়ান এবার অনিমার দিকে তাকাতেই অনিমা আরো একটু গুটিয়ে দাঁড়িল। বুক কাঁপছে ওর। গলা শুকিয়ে আসছে। আদ্রিয়ান ওর সামনে এসে একদম শান্ত গলায় বলল,

” কতদিন ধরে হচ্ছে এসব?”
অনিমা কোন উত্তর দিচ্ছেনা। মাথা নিচু করে হাত কচলে যাচ্ছে। কান্না পাচ্ছে এখন খুব ওর। আদ্রিয়ান এবার ঘর কাঁপিয়ে ধমক দিয়ে বলল,
” আন্সার মি ড্যাম ইট!”
অনিমা কেঁপে উঠল। অনিমা ভয় পেয়ে এক নিশ্বাসে বলল,
” কয়েকদিন যাবত।”
” আর তুমি আমাকে সেটা আজ বলছ?”

আদ্রিয়ানের ধমকিতে অনিমা আবারও কেঁপে উঠল। এমনিতেই মন খারাপ। তারওপর এই লোকটা আবার ওকে বকাবকি করছে। অনিমা কান্নামিশ্রিত চোখে তাকিয়ে আছে আদ্রিয়ানের দিকে। আদ্রিয়ান ওর হাত ধরে নিজের দিকে টেনে বলল,
” এই মেয়ে, তুমি জানো তুমি আমার কাছে কী? কতোটা? তোমার সম্পর্কে কেউ এমন কিছু ভাববে সেটাও আমি ভাবতে পারিনা। আর ওরা এরকম কিছু বলেছে আর তুমি এতোদিন যাবত সেসব শুনেছো? এতো সাহস কে দিয়েছে তোমাকে?”

অনিমা মাথা নিচু করে আছে। যেকোন সময় কেঁদে দেবে। আদ্রিয়ান ওকে ঝাকিয়ে বলল,
” চুপ করে আছো কেন? তুমি আগে আমাকে সবটা বললে আজ এরকভ কিছু হতোনা। তুমি জানো এখন কী কী হতে পারে? সেসব না হয় আমি সামলে নেব। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা তোমার চরিত্র না সম্মান নিয়ে কেউ কথা বলবে কেন? হোয়াই? এতো সাহস! এতো সাহস কে দিয়েছে এদের!”
আদ্রিয়ানকে এভাবে দেখে অনিমা বেশ ভয় পাচ্ছে। ও ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে ফেলতে গেলেই আদ্রিয়ান শক্ত কন্ঠে বলল,

” একদম না। ইউ নো এটাই আমার দুর্বলতা। তাই কান্নাকাটি করে আমার রাগ কমানোর চেষ্টা ভুলেও করবেনা।”
কিন্তু কান্না থামাতে পারেনি। অনিমা মাথা নিচু করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছে। আদ্রিয়ান সযত্নে চোখ মুছে দিতে দিতে বলল,
” একদম কাঁদবেনা।”
অনিমা বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছে। আদ্রিয়ান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
” এদের ছাড়বোনা আমি। আদ্রিয়ান আবরার জুহায়েরকে চেনেনা এরা। রক্ষিতা বলেছে তাইনা? আজতো…”

কথাটা বলে বাইরে যেতে নিলে অনিমা এবার শক্ত কন্ঠে বলল,
” আপনি শারীরিক কোন ক্ষতি করবেন না ওদের। অাপনাকে আমার কসম।”
অাদ্রিয়ান অনেকটা হিংস্র বাঘের মত তাকালো অনিমার দিকে। এগিয়ে এসে ওর হাত মুচড়ে ধরে বলল,
” আবার বল?”
অনিমা খুব ব্যাথা পাচ্ছে। তবুও আদ্রিয়ানের চোখে চোখ রেখে বলল,

” ওনাদের এসব বলা কী খুব যুক্তিহীন আদ্রিয়ান? আমাকে আপনার রক্ষিতা বলাতে আপনার রাগ হল। কিন্তু আমায় পরিচয় কী? কেন আছি আমি এখানে? কে হই আমি আপনার? আমাদের সম্পর্ক কী? কী নাম আমাদের সম্পর্কের? উত্তর আছে আপনার কাছে?”
আদ্রিয়ান হাত আলগা করে দিল। অনিমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
” নাম ছাড়া কোন সম্পর্কের কোন মূল্য নেই?”

বর্ষণের সেই রাতে সিজন ২ পর্ব ৩২

” মূল্য থাকলেও সেই মূল্য সমাজ দেয়না আদ্রিয়ান। সমাজ সব সম্পর্কের নাম খোঁজে। এরকম সম্পর্ক সমাজ মানেনা। তাই আমাকে এসব শুনতে হবে। কজনের মুখ বন্ধ করবেন আপনি? প্রেসের, ভার্সিটির ছেলেমেয়েদের, সমাজের সবার মুখ বন্ধ করতে পারবেন?”
আদ্রিয়ান কোন কথা বলল না। কিছুক্ষণ অনিমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
” আমি কসম টসম কোনদিনও মানিন। কিন্তু কসমটা এমন একজনকে নিয়ে দিয়েছ যাকে নিয়ে কোনরকমের রিস্ক আমি নিতে পারবোনা। সেটা কুসংস্কারই হোক। ওদের কিছু বলব না ঠিকই। কিন্তু এখন অন্যকিছু করব।”

কথাটা বলে অনিমার হাত শক্ত করে ধরে। রুম থেকে বেড়িয়ে এলো। অনিমা আদ্রিয়ানের কথার মানে বুঝল না। তাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দেখে অভ্র ওরা সবাই দাঁড়িয়ে আছে। আদ্রিয়ান অভ্রকে উদ্দেশ্য করে বলল,
” একঘন্টার মধ্যে ঐ সবগুলো চ্যানেলকে কাজী অফিসের সামনে এসে হাজির হতে বলো। তোমরাও এসো সাথে।”

কাজী অফিস শুনে অনিমা চমকে উঠল। আদ্রিয়ান অনিমার হাত ধরে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে গেল বাকিরাও বোকার মত কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ওদের পেছনে ছুট লাগাল।
ঘন্টা খানেকের মধ্যে সবকিছুই বদলে গেল। অনিমা আদ্রিয়ানের বিয়ে হয়ে গেছে। অনিমা পুরোটা সময় একটা শকের মধ্যে ছিল। কীভাবে কী হয়ে গেল কিছুই বুঝতে পারেনি। সবটাই কেমন স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে। এখন ও বিবাহিত। আদ্রিয়ানের বউ ও? মানে আদ্রিয়ান ওর হাজবেন্ড এখন? এগুলো সব সত্যি?

বর্ষণের সেই রাতে সিজন ২ পর্ব ৩৪