বর্ষণের সেই রাতে সিজন ২ পর্ব ৬৪

বর্ষণের সেই রাতে সিজন ২ পর্ব ৬৪
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

বিকেল সাড়ে পাঁচটা বাজে। আবরার মেনশানের সবাই বসার ঘরে বসে আড্ডা দিচ্ছে। মানিক আবরার, মিসেস রিমা, মিসেস লিমা, আদ্রিয়ান, অনিমা, রিক, স্নিগ্ধা, নাহিদ, অভ্র, জাবিন এরা সবাই ছিল। অনিমা চা করে এনে দিল সবাইকে। সামনে নাহিদ আর তনয়ার বিয়ে সেটা নিয়েই কথা বলছে ওরা। সেসব আলোচনা শেষ হতেই হঠাৎ করে জাবিন বলল,

” ভাইয়া, আমি চট্টগ্রামে গিয়ে ভর্তি হতে চাই। আসলে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ওখানে যাচ্ছে। তাই আমার এখানে একা একা পড়াশোনা করতে ভালো লাগবে না।”
অভ্র চা মুখে দিতেই নিচ্ছিল। জাবিনের কথা শুনে হাত আটকে গেল। আদ্রিয়ান ভ্রু কুঁচকে তাকাল জাবিনের দিকে। চায়ের কাপটা টি-টেবিলে রেখে দিয়ে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

” হঠাৎ? ওখানে গিয়ে কোথায় থাকবি।”
” ওর সাথেই একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে নেবো। বাবা-মার পার্মিশান নিয়ে নিয়েছি। এখন শুধু তুই বললেই__”
আদ্রিয়ান কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে একটা শ্বাস ফেলে বলল,
” আচ্ছা দেখছি। লাস্ট ডেট কবে?”
” সামনের মাসের পনেরো তারিখ।”

আদ্রিয়ান কিছু না বলে চায়ের কাপে চুমুক দিলো। সবাই অনেকটা অবাক হয়েছে জাবিনের কথায়। হঠাৎ এভাবে চলে যেতে চাইছে কেন? তাও এতোটা দূরে। এ নিয়ে জাবিনকে অনেক প্রশ্নও করা হয়েছে কিন্তু জাবিন শুধু বলেছে বান্ধবী যাচ্ছে তাই যাচ্ছে। পুরোটা সময় অভ্র তাকিয়ে ছিল জাবিনের দিকে। কিন্তু জাবিন একবারও ফিরে তাকায়নি। ব্যাপারটা অনিমার চোখে পরেছে। অনিমা এটা খেয়াল করেছে যে অভ্র তাকিয়ে আছে জাবিনের দিকে। কিছুটা খটকা লাগলেও ঐ মুহূর্তে ব্যাপারটায় তেমন গুরুত্ব দেয়নি ও।

অন্ধকার জেলের এক কোণে চুপচাপ বসে আছে রঞ্জিত চৌধুরী। আজ এতগুলো দিন হয়ে গেছে উনি জেলে। আজ কবির শেখের আসার কথা। কবির শেখকে দেখলেই মেজাজ খারাপ হয় তার আজকাল। উনি জেলে বসে পঁচছে অথচ এসবের পরিকল্পনা, সাজানোর সব তো কবির শেখই করেছেন। তবুও কত নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে বাইরে। তবে এটা ভেবেই নিজেকে শান্ত রাখে যে কবির শেখ বাইরে আছে বলেই বাইরের সব খবর তাঁর কাছে আসে, তাদের ভেঙ্গে গুড়িয়ে পরা ব্যবসাগুলো গোপনে একটু একটু করে দাঁড়াতে শুরু করছে, একটু একটু করে ক্ষমতা আসছে। এটা খুব প্রয়োজন এখন। উনি বের হওয়ার আগেই সবটা হাতে চলে আসুক এটাই উনি চান। এসব কথা চিন্তা করতে করতে কবির শেখ এসে হাজির হলেন। কবির শেখকে দেখে রঞ্জিত চৌধুরী উঠে দাঁড়ালেন। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে লোহার শিকের ওপর দুইহাত রেখে বলল,

” ওদিকে সব ঠিক আছেতো?”
কবির শেখ নিজের চিবুক চুলকে একটা শ্বাস ফেলে বললেন,
” একটুতো সময় লাগবেই। আমার গুণধর দুই ভাগ্নে যেভাবে আমাদেরকে ভেঙেছে। উঠে দাঁড়ানো এতো সহজ নাকি। তবে চিন্তা করবেন না। আপনি বের হওয়ার আগেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”
কবির শেখ লোহার শিকে জোরে আঘাত করে বললেন,

” সব দোষ ঐ হাসান কোতয়াল আর আদ্রিয়ানের। ওদের জন্যেই সব হয়েছে। ছয় বছর আগে হাসান বেঁচে গেছে তো কী হয়েছে পরেরবার বাঁচবেনা। আর আমার নিজের ছেলে আমার সাথে এমন করবে সেটা কল্পনাও করিনি। আজ ওর জন্যে জেলে পঁচে মরছি। আমার রক্ত তো কী হয়েছে। বেইমানির শাস্তি ওকেও পেতে হবে। ”

কবির শেখ হালকা হেসে বলল,
” চিন্তা করবেন না। সব ব্যবস্থাই হবে। আগে বের হন। আর হ্যাঁ ওদের তিনজনেরই সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হল ঐ মেয়েটা। তাইতো চব্বিশ ঘন্টা আমার নজরে রাখছি ওকে। সঠিক সময় এলে ওদের তিনজনের করা ভুলের শাস্তি পেতে হবে। আমি আমার জাল সাজাচ্ছি। শুধু আপনি একবার বের হন।”

রঞ্জিত চৌধুরী হিংস্র চাহনী দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরলেন লোহার শিকটি রাগে গা জ্বলছে ওনার। যতদিন না এদের শেষ দেখছে যেন শান্তি নেই ওনার। তার এই ক্রোধ থেকে তার নিজের ছেলেও পার পাবেনা। আর কবির শেখ নিজের মনেই হাসছেন। তবে এই হাসির সাথে প্রচন্ড রাগ মিশে আছে। ওনাদের প্রধান উদ্দেশ্য এখন একটাই আদ্রিয়ান, রিক, হাসান কোতয়াল এদের শেষ করা। আর ওরা জানে ঠিক কীভাবে আঘাত করলে তিনজনই শক্তিহীন হয়ে পরবে।

অনিমা নিজের পড়া শেষ করে ফোনটা হাতে নিয়ে বিছানায় বসেছে। আজ আদ্রিয়ানের আসতে দেরী হবে। আদ্রিয়ান বলেছে ওকে খেয়ে শুয়ে পরতে। কিন্তু অনিমা এখনো খায়নি। আদ্রিয়ানকে ছাড়া খেতে ওর ভালো লাগেনা। জানে আদ্রিয়ান এসে রাগ করবে। কিন্তু আদ্রিয়ানের বকা শুনতে যে ওর খুব খারাপ লাগে তাও ঠিক না। বিছানায় হেলান দিয়ে ফোন স্ক্রোল করতে করতে অনিমার চোখ লেগে এলো।

বেশ অনেক্ষণ পর আদ্রিয়ান রুমে এলো। এসে দেখে অনিমা বিছানায় হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে। টি-টেবিলে রাখা খাবার দেখে আদ্রিয়ান ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলল। এতো করে মেয়েটাকে বলে যে ওর জন্যে অপেক্ষা না করতে কিন্তু শোনেই না। আদ্রিয়ান ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় বসে অনিকে আলতো কন্ঠে ডাকল। কয়েকবার ডাকার পর অনিমা চোখ খুলে তাকাল। আদ্রিয়ানকে দেখে একটা হাই তুলে মুচকি একটা হাসি দিল। আদ্রিয়ান রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

” একদম হাসবেনা। তোমাকে কতবার বলেছি আমার জন্যে ওয়েট না করে টাইমলি খেয়ে নেবে। তোমাকে মেডিসিন নিতে হয় সেটা ভুলে গেছো?”
অনিমা মুখ ছোট্ট করে বলল,
” আমিতো এখন ঠিকই আছি। মাথা ব্যাথাও করেনা। তবুও এতো ঔষধ কেনো।”
আদ্রিয়ান চোখ ছোট ছোট করে হালকা ধমকে বলল,
” নিজেকে ডক্টর মনে হয়? এতো বেশি বোঝ কেন?”
অনিমা কাঁদোকাঁদো চোখে তাকিয়ে বলল,
” আপনি আসলেই একটা খারাপ লোক। লোকে বাড়ি ফিরে বউকে ভালোবাসে। আর আপনি শুধু বকেন।”

আদ্রিয়ানের রাগ মুহুর্তেই পরে গেলো। কারণ এভাবে অনিমাকে প্রচন্ড কিউট লাগে। ঠোঁট হালকা ফুলিয়ে কীভাবে ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকে। আদ্রিয়ান একটু এগিয়ে অনিমার কপালের চুলগুলো সরিয়ে একটা চুমু দিয়ে বলল,
” মাথা ব্যথা কমেছে রিক্স কমেনি এখনো। কিছুদিন আরও চালাতে হবে ঔষধ। এরকম অনিয়ম করলে তোমার এই খারাপ বরটা তোমাকে বকবেই। কারণ এই খারাপ বরটা নিজের পাগলী বউটাকে খুব ভালোবাসি।”
অনিমা লাজুক হেসে চোখ নামিয়ে নিলো। এরপর চোখ তুলে কিছুক্ষণ আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,

” ঐ ইনজেকশনগুলোতে আমার ব্রেইনের অনেকটা ড্যামেজ হয়ে গেছে না? যদি কোন ভুল হয়ে যায়। বা ভবিষ্যতে আমার মাথায় আঘাত লাগে বা প্রচন্ড মানসিক কোন আঘাত লাগে তাহলে আমি সব ভুলে যেতে পারি। আবার তারসাথে পাগলও হয়ে যেতে পারি। তাইনা?”
আদ্রিয়ান চমকে উঠল। এটাতো অনিমার জানার কথা না। অনিমা কীকরে জানলো। আদ্রিয়ান জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে অনিমার দিকে। অনিমা নিজের ঠোঁটের হাসি প্রশস্ত করে বলল,
” গতকাল আব্বুর সাথে আপনার ফোনালাপ শুনে ফেলেছি আমি। যদিও ইচ্ছে করে শুনিনি। এগুলো জেনেও আমায় বিয়ে করেছেন? কেনো?”

আদ্রিয়ান অনিমার ডান হাতে বাহু ধরে টেনে ওকে নিজের বুকে নিয়ে এলো। এরপর বলল,
” ভালোবাসি তাই। ভালোবাসলে সব পারা যায়, জানপাখি।”
অনিমা কেঁদে ফেলল। আদ্রিয়ানের টিশার্টে আঙ্গুল নাড়াতে নাড়াতে বলল,
” আমি সবসময়ই আপনাকে কষ্ট দেই, রকস্টার সাহেব। আর কত কষ্ট পাবেন আমার জন্যে? যদি এমন কিছু হয়ও আমিতো সব ভুলে শান্তিতে থাকব। কিন্তু প্রতিনিয়ত কষ্ট পাবেন আপনি। ছটফট করবেন আমার জন্যে। অসুস্থ আমি হব, কিন্তু যন্ত্রণা তো আপনাকে ভোগ করতে হবে।”
আদ্রিয়ান অনিমার মাথায় আরেকটা চুমু দিয়ে বলল,

” এমন কিছুই হবেনা। তুমি এখন প্রায় সুস্থ আছো। মাথা ব্যাথও নেই। জাস্ট আর কয়েকটি দিন ঔষধ কন্টিনিউ রাখলেই তুমি একদম ঠিক হয়ে যাবে। আমিতো আছি তোমার সাথে।”
অনিমা চুপ করে রইল। আদ্রিয়ান অনিমার মাথায় হাত বুলাচ্ছে আর ভাবছে যে, এটা ঠিক অনিমা প্রায় সুস্থ। কদিনের মধ্যে পুরোপুরি ঠিক হয়েও যাবে। কিন্তু ওর মস্তিষ্কের যে ড্যামেজটা হয়েছিল এর প্রভাব ভবিষ্যতে পরবেনা তাঁর কী সত্যি কোন গ্যারান্টি আছে? অনির স্মৃতির পাতা থেকে মুছে যাবেনাতো আদ্রিয়ান নামটা?

অনিমা আদ্রিয়ানের বুকে মাথা রেখে নিরবে কেঁদে যাচ্ছে। এতক্ষণ আদ্রিয়ান বেশ গভীর ভাবনায় মগ্ন ছিল কিন্তু এখন অনিমার মন ঠিক করতে হবে। না হলে সারারাত কেঁদে পার করবে। আদ্রিয়ান অনিমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,

” এইযে ম্যাডাম। এভাবে কাঁদলে হবে? আপনার কান্নায়তো আমার পেট ভরবেনা তাইনা? এতক্ষণ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে করে গান করে এসছি। ক্ষিধে পেয়েছে তো। ”
আদ্রিয়ানের ক্ষিধে পেয়েছে শুনে অনিমা তাড়াতাড়ি উঠে বসে চোখ মুছে বলল,
” সরি আসলে আমারই খেয়াল ছিলোনা। দাঁড়ান আমি এক্ষুনি নিয়ে আনছি।”
অনিমা দ্রুত উঠে খাবারের ট্রে টা নিয়ে বিছানায় এসে বসলো। আদ্রিয়ান তাকিয়ে আছে অনিমার দিকে। অনিমা আদ্রিয়ানের প্লেটটা এগিয়ে দিতেই আদ্রিয়ান ওর সেই মুচকি হাসিটা দিয়ে বলল,

” আজ নিজের হাতে খাইয়ে দেওনা, প্লিজ।”
অনিমা অবাক হলোনা। ক্লান্ত থাকলে আদ্রিয়ান মাঝেমাঝেই এমন আবদার করে। তাই উঠে গিয়ে হাতটা ধুয়ে এলো। এরপর ভাত মেখে এক লোকমা নিজে খেয়ে পরের লোকমা আদ্রিয়ানের দিকে এগিয়ে দিল নয়তো আদ্রিয়ান খাবেনা এটা অনিমা ভালো ভাবেই জানে। তাই আদ্রিয়ানকে খাওয়ানোর সাথে সাথে নিজেও খেয়ে নিচ্ছে। খাওয়ার মাঝে অনিমা বলল,

” জাবিনের ব্যাপারে কিছু ভাবলেন?”
আদ্রিয়ান কয়েকসেকেন্ড চুপ থেকে খাবার চিবুতে চিবুতে একটু চিন্তা করল। এরপর বলল,
” এখন ও বড় হয়েছে। ভার্সিটিতে যাবে। এখন কিছু কিছু সিদ্ধান্ত ওর ওপর ছেড়ে দেওয়াই ভালো। ও যখন চাইছে যেতে, তখন যাক। কিন্তু একটা জিনিসই বুঝতে পারছিনা। হঠাৎ এভাবে দূরে যেতে চাইছে কেনো? ও যেই কারণটা যেখাচ্ছে সেটা মোটেই স্ট্রং নয়। কিছু হয়েছে হয়তো। যেটা ও শেয়ার করতে চাইছেনা।”
অনিমা একটু ভাবুক হয়ে বলল,

” আমারও সেরকমই মনে হয়েছে।”
” হ্যাঁ কিন্তু ও যখন যেতে চাইছে তখন যাক। চট্টগ্রামই তো। আমার অনেক চেনাজানা আছে ওখানে, সমস্যা হবেনা।”
অনিমা আর কিছু বলল না। তবে অভ্রর ওভাবে তাকিয়ে থাকাটা একবার মনে পড়ল ওর। পরক্ষণেই মনে হলো ওই হয়তো একটু বেশি ভাবছে, সেটাকে ততটা গুরুত্ব না দিয়ে নিজের আদ্রিয়ানকে খাওয়ানোতে মনোযোগ দিলো।

রাত হয়েছে অনেকটা। চারপাশটা বেশ নিস্তব্ধ। আকাশটা মেঘলা হওয়াতে অন্ধকার একটু বেশিই। একটু পরপর হালকা হালকা বাতাস আসছে। জাবিন রেলিং এর ওপর হাত রেখে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। মনের ভেতরেও মন খারাপের মেঘ জমে আছে। ওর মন চাইছেনা ওর এই পরিবার, কাছের মানুষগুলোকে ছেড়ে দূরে যেতে। কিন্তু কী করবে? না চাইতেও অভ্র নামক এই ছেলেটাকে প্রচণ্ড ভালোবেসে ফেলেছে। যখন ও জানেই সেই মানুষটা ওর না, সে অন্যকারো কাছে কমিটেড। তখন দিনরাত তাঁকে চোখের সামনে দেখা ওর পক্ষে সম্ভব না। কোনভাবেই না। তাইতো দূরে সরে গিয়ে ভুলে যাবে অভ্রকে, চিরকালের মতো ভুলে যাবে। তখন পেছন থেকে কেউ বলে উঠল,

” ঘুমাও নি?”
জাবিন হালকা চমকে পেছন ঘুরে তাকিয়ে দেখল অভ্র দাঁড়িয়ে আছে। জাবিন কোন উত্তর না দিয়ে আবার ঘুরে সামনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অভ্র আস্তে আস্তে এসে জাবিনের পাশে রেলিং ধরে দাঁড়ালো। কয়েকমিনিট দুজনেই চুপ ছিলো। অভ্র নিজেই বলল,
” চট্টগ্রাম যাওয়ার সিদ্ধান্তটা কী শুধুই আমার জন্যে?”
জাবিন সাথেসাথেই নিজেকে একটু শক্ত করে নিয়ে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
” নিজেকে এতো গুরুত্ব কেনো দিচ্ছেন?”
অভ্র সোজাসাপ্টা ভাবে বলল,

” আমার মনে হল তাই বললাম। কারণটা যদি শুধুমাত্র আমি হই তাহলে বলব যেওনা। আমার জন্যে নিজের কাছের লোকগুলোকে ছেড়ে থাকার কোন প্রয়োজন নেই। প্রয়োজনে আমি নিজেই চলে যাবো এই বাড়ি ছেড়ে। তবুও তুমি থেকে যাও। ”
জাবিনের এবার একটু রাগ লাগল। সিমপ্যাথি দেখাতে এসছে ওকে। যাক না নিজের গার্লফ্রেন্ডের কাছে। সব দরদ, সিমপ্যাথি তাঁকে দেখাক। ওর কাছে কেন এসছে? জাবিন একটু রেগে গিয়েই বলল,
” কী ভাবেন কী আপনি নিজেকে? আপনার মত একজনের জন্যে আমি আমার শহর ছেড়ে চলে যাবো? সিরিয়াসলি? ইউ মিন টু সে, আমার ভাইয়ের বেতনভুক্ত সামান্য একজন পি.এ. এর জন্যে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো? দিবাস্বপ্ন দেখছেন নাকি? আমার ব্যাক্তিগত সিদ্ধান্তে নাক গলানোর আপনি কেউ নন। আর সেই চেষ্টাও করবেন না। জাস্ট গেট লস্ট!”

অভ্র হালকা হাসল। তারপর নিজের নাকটা হালকা টেনে বলল,
” সেটাই। ফ্যাক্টটা বুঝতে একটু দেরী করে ফেলেছেন ম্যাম। আমার মতো সামান্য পি.এ এর জন্যে আপনি কেন এমন সিদ্ধান্ত নেবেন। ভুলটা আমারই। আ’ম সরি।”
বলে অভ্র চলে গেল ওখান থেকে। অভ্র চলে যেতেই জাবিন নিজের চোখের জল ছেড়ে দিল। কী হতো একটু ভালোবাসলে? ও কী অভ্রর এতোটাই অযোগ্য ছিল? কেন অন্যকারো প্রতি কমিটেড হতে হলো অভ্রকে? যদিও এতে অভ্রকে দোষী বলাটাও একপ্রকার বোকামি। অভ্র কারো প্রতি কমিটেড হতেই পারে। এতে তো অভ্রর দোষ নেই। কিন্তু জাবিনের তো প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। ও কীকরে সহ্য করবে এই কষ্ট? কীকরে?

কলেজ শেষ করে অনিমা, অরুমিতা, তীব্র, স্নেহা চারজনই একসঙ্গে বেরিয়েছে। আজ একসাথে লাঞ্চ করবে ওরা চারজন। সেরকমই প্রস্তুতি নিয়ে বেরিয়েছে। অনিমা যে গাড়ি করে আসে সে গাড়িতে করেই চারজন রেস্টুরেন্টে পৌঁছেছে। খেতে খেতে অনিমা অরুমিতার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,
” আজ আবার মুখটা এমন ফ্যাকাসে কেন? আশিস ভাই আবার কিছু বলেছে?”
অনিমার কথা শুনে তীব্র আর স্নেহাও তাকালো অরুমিতার দিকে। অরুমিতা লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,

” না, তবে কাল অয়ন স্যার আলাদাভাবে কথা বলতে ডেকেছিলেন আমায়।”
তীব্র বলল,
” কী বলল?
” উদ্ভট সব কথাবার্তা। তবে মনে হলো উনি খুব শীঘ্রই আমার বাড়িতে আসবেন প্রস্তাব নিয়ে।”
তখনই পেছন থেকে কেউ বলে উঠল,
” আর তুমিও নিশ্চয়ই রাজি হয়ে যাবে?”

ওরা চারজনেই সেই কন্ঠস্বর অনুসরণ করে তাকালো। তাকিয়ে দেখে আশিস দাঁড়িয়ে আছে। ওরা চারজনই অবাক হল খানিকটা আশিসকে এভাবে এখানে দেখে। অরুমিতা উঠে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,
” আপনি এখানে?”
অনিমা, তীব্র, স্নেহাও দাঁড়িয়ে গেল। আশিস আরেকটু এগিয়ে এসে বলল,
” হুম আমি। তোমার সাথে কিছু কথা আছে।”
অরুমিতা শক্ত কন্ঠে বলল,

” আপনার সাথে আমার কোন কথা নেই। যা কথা ছিল সবতো শেষ হয়েই গেছে । তবুও এতোগুলো মাস যাবত কেনো জ্বালিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?”
আশিস এবার নিজেও একটু রেগে বলল,
” তাই নাকি? জ্বালাচ্ছি আমি? ওও এখন তো আমায় জ্বালাতনই মনে হবে। অয়ন স্যারকে পেয়ে গেছোতো। এখন আর আমাকে কী দরকার? তবে এটা ভুলে যেওনা। একসময় আমায় ফিরে আসার অনুরোধ করে তুমি একপ্রকার আমার পা__”
এইটুকু বলে থেমে গেল আশিস। রাগের মাথায় কী সব বলছে ও। অরুমিতা একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,

” কী হলো থামলেন কেন? বলুন? এটাই বলবেন তো আপনি যখন ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন তখন একপ্রকার পায়ে পড়ে গেছিলাম আপনার। বলেছিলাম আমাকে ছেড়ে দেবেন না, পারবোনা আপনাকে ছেড়ে থাকতে। পাগলের মতো কেঁদেছিলাম। বারবার ফোন করে আপনার কাছে একপ্রকার ভিক্ষা চেয়েছিলাম। কিন্তু আপনি কী করেছিলেন? বারবার অপমান করেছিলেন। যা-তা বলেছিলেন। কত খারাপ ভাষা ব্যবহার করেছিলেন। শুধু এইটুকুতেই থেমে থাকেননি আপনি। আপনার গার্লফ্রেন্ড। ও সরি, এক্স গার্লফ্রেন্ডকে দিয়েও আমায় অপমানও করিয়েছেন। যা নয় তাই শুনিয়েছেন। মনে নেই সেসব?
অনিমা অবাক হয়ে গেল। ও এগুলো জানতোনা। যদিও তীব্র আর স্নেহা জানে সবই। আশিস অরুমিতা হাত ধরে বলল,

” অরু আমি জানি যে আমি ভুল করেছি কিন্তু। ভুল না অন্যায় করেছি। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি এখন আমার ভুলটা বুঝতে পারছি প্লিজ একটা সুযোগ দাও আমাকে। আমি__”
অরুমিতা ঝাড়া দিয়ে হাত ছাড়িয়ে ঠাটিয়ে একটা চড় মেরে দিলো। তারপর রাগী কন্ঠে বলল,
” আমাকে ছোঁয়ার দুঃসাহস করবেন না। এর চেয়েও অনেক বেশি আকুতি আর অনুরোধ করেছিলাম আমি। কিন্তু আপনি শোনেন নি। গুরুত্বও দেননি। আর আজ আমার প্রয়োজন নেই। যদি সত্যি মিনিমাম অনুতাপবোধ আপনার মধ্যে এসে থাকে তাহলে আমাকে আর ডিসটার্ব করতে আসবেন না। চলে যান।”

আশিস কিছুক্ষণ অরুমিতার দিকে তাকিয়ে থেকে হতাশ এক শ্বাস ফেলে চলে গেল। আর তার সাথে এটাও ঠিক করে নিল অরুমিতাকে আর বিরক্ত করবেনা। ওকে সময় দেওয়াটা প্রয়োজন। থাকুক নিজের মত করে কিছুদিন। যে মেয়েটাকে এতো বাজেভাবে ঠকিয়ে এতোদিন যাবত কাঁদিয়েছে। মাত্র কয়েকমাসেই তার কাছ থেকে ক্ষমা পেয়ে যাবে এটা ভাবাও বোকামি।

বর্ষণের সেই রাতে সিজন ২ পর্ব ৬৩

প্রবাহমান সময় তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে চলেছে। দেখতে দেখতে কেটে গেছে আরও ছয়টা মাস। সবাই নিজের জীবনে ব্যস্ত। আদ্রিয়ান অনিমার ভালোবাসা, খুনশুটি, রাগ, অভিমান সব মিলিয়ে কেটে গেছে দিনগুলো। জাবিন ছ’মাস আগেই চলে গেছে চট্টগ্রাম। মাঝে শুধু একবারই এসছিল বাড়িতে। অভ্রও স্বাভাবিক জীবন যাপনই করছে। তবে ওর সেই পাগলাটে ভাবটা যেনো হারিয়ে গেছে। আদিব আর রাইমার মেয়ে হয়েছে। নাম রেখেছে আদিবা। আশিস আর বিরক্ত করেনি অরুমিতাকে। আর না অরুমিতা আশিসকে গুরুত্ব দিয়েছে। নাহিদ আর তনয়ার বিয়ে হয়ে গেছে চারমাস হল। তীব্র আর স্নেহার ব্রেকআপ আর প্যাচআপেই দিন যাচ্ছে। রিক দু’মাস আগেই হসপিটাল জয়েন করেছে। এখন ও নিজের কাজে সম্পূর্ণ মনোযোগী।

বিকেল চারটা বাজে। আবরার ম্যানশনে সবাই বসার ঘরে বসে আছে। হালকা গল্পগুজব চলছে। রিক-স্নিগ্ধা এখনো বাড়ি ফেরেনি। ওরা বাড়ি ফিরলে স্ন্যাকস বানানো হবে। হঠাৎ করেই কলিং বেল বেজে উঠল। অনিমা চট করে দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল,
” রিক আর স্নিগ্ধা এসে গেছে হয়তো।”
আদ্রিয়ান রাগী চোখে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বলল,

” এতো লাফাও কেন? চুপচাপ ফলগুলো শেষ কর।”
অনিমা মুখ ফুলিয়ে বসে চোখ-মুখ কুঁচকে খেতে শুরু করল। সার্ভেন্ট দরজা খুলে দিতেই রিক স্নিগ্ধার হাত ধরে টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে এলো। সবাই বেশ অবাক হল এভাবে টেনে আনতে দেখে। কেউ কিছু বলার আগেই রিক মানিক আবরারের দিকে তাকিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল,
” খালু আমি স্নিগ্ধাকে বিয়ে করতে চাই। সেটাও এক সপ্তাহের মধ্যে।”

বর্ষণের সেই রাতে সিজন ২ পর্ব ৬৫