বর্ষণ মুখর দিন পর্ব ১১

বর্ষণ মুখর দিন পর্ব ১১
লেখিকাঃ জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

অফিসে ঢুকতেই সবাই নিয়াজ আর জারাকে বিবাহিত জীবনের শুভেচ্ছা জানাতে লাগলো।সবার সাথে কথা বলে নিয়াজ নিজের কেবিনে চলে গেলো।জারা নিজের কেবিনে বসতেই রিহা পাশে এসে দাঁড়ালো।জারা একবার রিহার দিকে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে বলল,তোমার সাথে কোনো কথা নেই তুমি বিয়েতে গেলেনা কেনো?
রিহা মুখটা ছোট করে বলল,সরি!আসলে আমার জার্নি করার অভ্যেস নেই।বমি করে ক্লান্ত হয়ে যাই চোখ ও মেলতে পারিনা।তাইতো যাইনি।

জারা শান্ত কন্ঠে বলল,বাহানা বাদ দেও।তাহলে রিসিপশনে গেলেনা কেনো?সেটাতো আর গ্রামে হয়নি।
রিহা বলল,কাল মাকে নিয়ে একটু ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম।
জারা আচ্ছা বলে কাজে মন দিলো।রিহা জারাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।ঘাড় একবার একদিকে ফিরিয়ে জারাকে পর্যবেক্ষণ করছে।জারা মাথা তুলে রিহার দিকে তাকিয়ে বলল,কাজ নেই তোমার?
রিহা যা খুঁজছিলো সেটা না পেয়ে ভ্রু কুচকে বিরক্তি নিয়ে বলল,পাচ্ছিনা কেনো?
জারা বোকার মতো চেয়ে থেকে বলল,কি পাচ্ছো না?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রিহা কোনো সংকোচ ছাড়াই বলে দিলো,নতুন বিয়ে হয়েছে তোমার ঘাড়ে গলায় দাগ নেই কেনো?না মানে এই দাগ সরানোর জন্য কি রিমুভার আছে?
জারা আজ শাড়ির সাথে হিজাব পড়েনি।এখানে ওর কাছে কোনো হিজাব ছিলোনা। নিয়াজ বলেছিলো যাওয়ার সময় জারাকে কয়েকটা হিজাব কিনে দেবে।হিজাব না পড়ার দরুন গলা ঘাড় দেখা যাচ্ছে।জারা লজ্জা পেয়ে বলল,ক-কি উল্টাপাল্টা কথা বলছো?রিহা অবাক হওয়ার ভান করে বলল,কি উল্টাপাল্টা বললাম?যা সত্যি তাই তো বললাম।স্যার আর তোমার রোমাঞ্চকর মুহূর্ত গুলো মনে পড়ায় লজ্জা পেলে বুঝি?

জারা চোখমুখ এদিক ওদিক করে বলল,এরকম কিচ্ছুনা।তুমি কাজ করো যাও।
রিহা হাসতে হাসতে বলল,যাচ্ছি যাচ্ছি।হায় আল্লাহ কবে আমার এরকম দিন আসবে?
জারা আজ আর ভার্সিটিতে যায়নি।কাল থেকে যাবে তাই আজ নিয়াজের সাথেই অফিসে চলে এসেছে।গতকাল রিসিপশনের অনুষ্ঠান খুব জাঁকজমকপূর্ণ ভাবেই করা হয়েছে।রাতে ক্লান্ত হয়ে জারা নিয়াজের আগেই ঘুমিয়ে গেছে।নিয়াজ আর জারাকে না জাগিয়ে নিজেও জারাকে জড়িয়ে ধরে পাশে শুয়ে পড়লো।

নিয়াজকে কম্পানির একটা কাজে বিদেশে যেতে হবে।দশদিন পরই যাওয়ার ডেট ফিক্সড হয়েছে।জারাকে নিয়ে যেতে পারতো।কিন্তু ওখানে নাকি দুমাস থাকা লাগবে।এই দুমাসে জারার পড়ালেখার ব্যঘাত ঘটবে।তাছাড়া জারার কোনো পাসপোর্ট নেই।এখন অল্প কয়দিনে সব করতে গেলে প্রচুর ঝামেলা পোহাতে হবে।নিয়াজ জারাকে নিতে চাইলেও জারা যেতে চায় কিনা সেটাও তো জানতে হবে।

জারা তার ভার্সিটি তারপর অফিস এসব নিয়েই আছে।ওদের সম্পর্কের তেমন কোনো উন্নতি হয়নি।নিয়াজ যদিও জারার কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করে জারা কেমন যেন নিজেকে গুটিয়ে নেয়।তাই নিয়াজ নিজের ইচ্ছাকে দমিয়ে রেখে জারাকে সময় দিতে চাইছে।জারা হয়তো এখনো নিয়াজের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেনি।নিয়াজের যাওয়ার দিন ঘনিয়ে এলো।নিয়াজের বাবা অবশ্য বলেছেন নিয়াজ না গিয়ে ওর বদলে তিনিই গিয়ে কোম্পানির জামেলাটা সামলে নিবেন।কিন্তু নিয়াজ নাকোচ করে দিয়ে বলল,তোমাকে আর এই বয়সে এসব নিয়ে দৌঁড়াদৌঁড়ি করতে হবেনা।

জারা কেমন চুপচাপ থাকে।ওকে দেখলে বোঝা যায়না ও আসলে কি চায়?কি চলছে ওর মনে।নিয়াজ জারার কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে গিয়েও মাঝেমাঝে নিয়ন্ত্রন হারিয়ে জারার কাছাকাছি চলে যায়।ছুঁয়ে দিতে গেলেই লজ্জাবতী গাছের মতো নুইয়ে যায় জারা।নিয়াজ সরে এসে ভাবে তবে কি জারা আমাকে পছন্দ করেনা?এসব ভেবেই মনটা বিষিয়ে যায়।
কালকেই নিয়াজের ফ্লাইট।যেতে মন চাইছেনা।ইচ্ছে করছে জারার কাছে থেকে যেতে।ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও একরাশ মন খারাপ নিয়ে জামা কাপড় ঘুছিয়ে সব ট্রলিতে ভরছে।

জারা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।সবকিছু গুছিয়ে নিয়াজ বারান্দায় জারার পাশে গিয়ে দাঁড়িলো।পকেটে একহাত গুঁজে বাইরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,কালকেই আমার ফ্লাইট।সাবধানে থাকবে নিজের খেয়াল রাখবে।কিছু প্রয়োজন হলে বাবা মাকে জানাবে।ফোন কাছে রেখো আমি সময় পেলে কল দেবো।জারা কোনো উত্তর না দিয়ে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।বারান্দার লাইট নিভানো।রুমের লাইটের হালকা আলো এসে আছড়ে পড়ছে বারান্দায়।জারার মুখ ভঙ্গি নিয়াজ ঠিক ঠাওর করতে পারলোনা।জারাকে নিশ্চুপ দেখে নিয়াজ একটু কষ্ট পেলো।বুকের ভেতর একটা মোচড় দিয়ে উঠলো।এতদিনেও কি নিয়াজের প্রতি জারার সামান্য মায়া জন্মায় নি?পেছন ঘুরে রুমে ফিরে আসতে নিলেই দু’জোড়া হাত পেছন থেকে নিয়াজকে ঝাঁপটে ধরে।

নিয়াজ থেমে যায়।কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ কানে আসতেই নিয়াজ বিচলিত হয়ে পড়ে জারার হাত দুটো ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল,কি হয়েছে জারা তুমি কাঁদছো কেনো?কোথাও ব্যথা পেয়েছো।
জারা নিয়াজকে আরো ভালোভাবে আঁকড়ে ধরে কাঁদতে থাকে।ধীরে ধীরে কান্নার গতি তীব্র হতে লাগলো।নিয়াজের শার্ট পেছনের দিকে ভিজে গেছে জারার চোখের পানিতে।নিয়াজ বুঝতে পারছেনা জারার এরকম কান্নার কারণ কি।ও কি কোনোভাবে কোনো কথা দ্বারা জারাকে হার্ট করেছে?
জারাকে সামনে টেনে দুহাতে আঁজলা ভরে জারার মুখটাকে তুলে বলল,কি হয়েছে তোমার বলো আমায়।আমি কি কোনো ভুল করেছি?

জারা হেঁচকি তুলে বলছে,আপনি আমাকে এখানে রেখেই বিদেশে চলে যাবেন।আপনি আমাকে একটুও ভালোবাসেন না।নাহলে আমার কথা কি করে ভুলে গেলেন?আমি একা একা কি করে থাকবো?
নিয়াজ অবাক হয়ে তাকিয়ে জারাকে দেখছে।সত্যিই কি জারা ওর জন্য কাঁদছে?নিয়াজের যেনো বিশ্বাস হচ্ছেনা।তাই জারাকে বলল,আমি গেলে তোমার সমস্যা কি?আমি কাছে গেলেই তুমি নিজেকে গুটিয়ে নাও।আমাকে ভালোও বাসোনা তাহলে আমার থাকা না থাকায় তোমার কি আসে যায়?

জারা ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দিয়ে বলল,আমি জানিনা এতকিছু।আপনি আমাকে রেখেই চলে যাবেন আমি আপনাকে যেতে দেবোনা।নিয়াজ আল্লাদি কন্ঠ বলে উঠলো,আচ্ছা যেতে দেবেনা তো কি করবে?
জারা নিয়াজের কাছ থেকে সরে আঙ্গুল উঁচিয়ে বলল,একদম দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখবো।নিয়াজ শব্দ করে হেসে বলল,বরকে দড়ি দিয়ে নয় আঁচল দিয়ে বেঁধে রাখতে হয় গো বউ।

নিয়াজের মুখে বউ ডাক শুনে জারা থমকালো।মনে এক অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছে।জারা জানেনা ওর মনের অনুভূতির নাম কি তবে সামনের এই মানুষটাকে ওর বড্ড প্রয়োজন।মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই মানুষকে তার পাশে চাই।
জারাকে এক দৃষ্টে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিয়াজ তুড়ি বাজিয়ে বলল,হারিয়ে গেলে নাকি বউ।আচ্ছা তুমি হারিয়ে যাও আমি কালকের যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।নিয়াজ ঘুরে আসতে নিলেই জারা নিয়াজের ঘাড়ের দিকের কলার চেপে ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলল,বিদেশে যাওয়ার জন্য দেখছি পাগল হয়ে আছেন।বিদেশ মেয়েদের সাথে নেচে বেড়াতে পারবেন সেই জন্য ভালো লাগছে?

জারার রিয়েকশন দেখে নিয়াজ মিটিমিটি হাসছে।জারাকে আরেকটু জ্বালানোর জন্য বলল,বিদেশি মেয়েরা কি কিউট হয়।একটু ইশারা করলেই কাছে আসার জন্য তারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে।
রাগে জারার কান গরম হয়ে আসছে।শরীরের চামড়া গুলো জ্বলে যাচ্ছে।নিয়াজের দুপায়ে ভর দিয়ে দুহাতে ওকে আঁকড়ে ধরে নিয়াজের ঠোঁটে কুটুস করে একটা কামড় দিয়ে সরে আসতেই নিয়াজ জারাকে আঁকড়ে ধরে।জারাকে ছেড়ে দিয়ে নিয়াজ দূরে সরে যেতেই জারা আবারো ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠে বলে,দূরে সরে যাচ্ছেন কেনো?
নিয়াজ অন্যদিকে ফিরে বলল,নিজের নিয়ন্ত্রণ হারাতে চাইনা।যাওয়ার একদিন আগে তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনা।আমি চাইনা আমার আচরণে তুমি কষ্ট পাও।জারা ছলছল চোখে বলল,আপনি দূরে সরে গেলেই আমার কষ্ট হয়।
নিয়াজ জারার দিকে ফিরে বলল,কাছে আসলেই খুব করে ভালোবাসতে ইচ্ছে করবে।

বর্ষণ মুখর দিন পর্ব ১০

জারা এগিয়ে এসে নিয়াজের ঠোঁট জোড়া স্পর্শ করে।সম্মতি পেয়ে নিয়াজ জারাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়।
জারা ঘুমিয়ে আছে।নিয়াজ জারাকে বুকে নিয়ে হাসছে।প্রথম যেদিন প্রেয়সীকে দেখেছিলো সেদিন ও ভারী বর্ষণ ছিলো।আজ প্রেয়সীকে সম্পূর্ণ নিজের করে নিয়েছে আজও ভারী বর্ষণ হচ্ছে।বৃষ্টি হওয়ার কারণে একটু শীত অনুভব হচ্ছে।জারা নিয়াজের বুকে আরেকটু গুটিয়ে গেলো।নিয়াজ জারার গায়ে ভালো করে কাঁথা জড়িয়ে দিয়ে বারান্দায় গিয়ে গ্রিলে হাত রেখে দাঁড়ালো।মেয়েটা এতদিন দূরে সরে থাকতো এটাই ভালো ছিলো।আজ এতটা কাছে এসে সামনের দুই মাসের কষ্ট বাড়িয়ে দিলো।এখন কি করে দুই মাস জারাকে ছাড়া থাকবে?এখন জারাকে নিয়ে যেতেও পারবেনা আবার ছেড়ে যেতেও কষ্ট হবে।হাজারো ভাবনা চিন্তায় ভেতর থেকে এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।

রুমে ফেরত এসে জারাকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
কি হলো জানু আমার কল কেটে দিচ্ছো কেনো?
মিমির কথায় বিরক্ত হয়ে তুহিন বলল,তুমি কি আমাকে শান্তি দিবানা?
মিমি একহাতে নিজের চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে বলল,এই মিমির পাল্লায় পা দিয়েছো তোমার শান্তি আর খুঁজে পাবেনা।
তুহিন দাঁতে দাঁত চেপে বলল,মনে করো একটা ভূতুড়ে বাড়ি।চারদিকে গা কাঁটা দেওয়া পরিবেশ।বাড়িটার ভেতরে পুরো অন্ধকার।এক রুমে শুধু হালকা টিমটিমে আলো জ্বলছে কিন্তু কোনো কিছুই স্পষ্ট না।তোমাকে সেখানে রেখে আসলে কি করবা?

মিমি একটু ও ঘাবড়ে না গিয়ে মুচকি হেসে বলল,তোমাকে বিয়ে করে সেখানে নিয়ে গিয়ে রোমান্স করবো।ওয়াও কি সুন্দর রোমান্টিক পরিবেশ।ডিস্টার্ব করার জন্য কেউ থাকবেনা।নাইস না?
তুহিন নিজেই নিজের কপাল চাপড়ে বলল,দেখাতে গেলাম ভয় আর এই মেয়ে উল্টো আমাকে পেঁচিয়ে ধরছে।

বর্ষণ মুখর দিন শেষ পর্ব