বাইজি কন্যা পর্ব ৩৭
জান্নাতুল নাঈমা
কিছু কিছু সম্পর্কে মানুষ জড়াতে চায় না। তবুও ভাগ্যচক্রে জড়িয়ে যায়। একদিন,দু’দিন, তিনদিন এভাবে দেড়’টা মাস কেটে গেল। পাঁচফোড়ন গৃহেও সময়কাল বাড়তে লাগল শাহিনুরের। ষোল’তে পা দিয়েছে সে। হিসেব অনুযায়ী পাক্কা ষোল বছর ষোল দিন বয়স তার৷ শান্ত চাহনির দৃঢ়তা, নম্র স্বরের গভীর বাচনভঙ্গি, সময়ভেদে স্বভাবে গম্ভীরতা, জহুরি একজোড়া দৃষ্টি দেখে বোঝার উপায় নেই সে এক ষোড়শী কন্যা! যত সময় বাড়ছে ততই বাড়ছে শাহিনুর শায়লার দৃঢ়তা। যে দৃঢ়তা দেখে বারংবার মুগ্ধ হচ্ছে ডক্টর.প্রণয় চৌধুরী।
শাহিনুরের অতি সুদর্শনীয় ষোড়শী দেহে যতবার দৃষ্টি যায় ততবারই তার পুরুষ দেহের সমস্ত ইন্দ্রিয় জেগে ওঠে। অদ্ভুত এক শক্তি দুমড়ে মুচড়ে দেয় তার দৃঢ় ব্যক্তিত্ব’কে। একই বিছানায় রাতের পর রাত কাটছে তাদের। বাড়ছে অনুভূতি। আজকাল এই অনুভূতি শাহিনুর’কেও বেশ জব্দ করেছে। বিপরীত লি/ঙ্গের প্রতি মানুষের আকর্ষণ থাকাটাই স্বাভাবিক। হয় যদি স্বামী-স্ত্রী তাহলে আকর্ষণ না থাকাই অস্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায়। অনেকগুলো রাত দু’জনেরই তীব্র অস্বস্তি’তে কেটেছে। অজান্তেই একে অপরের খুব কাছেও চলে এসেছে। যতবার কাছে এসেছে ততবারই অদৃশ্য এক বাঁধায় আবার দূরে সরেও গেছে। ইদানীং শাহিনুর নিজেকে বুঝতে পারছে না।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
যা হওয়ার নয় তাই যেন হচ্ছে। ডাক্তারসাহেবের প্রতি যত্নশীল হয়ে ওঠেছে সে৷ যতদিন যাচ্ছে ডাক্তারসাহেব তার অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত এক মায়া শক্তি চুম্বকের ন্যায় তাদের যুক্ত করতে চাইছে।বিছানার দু’প্রান্তে দু’জন থাকলেও তাদের শ্বাসপ্রশ্বাস যেন একই সাথে চলছে। অসহনীয় কিছু অনুভূতি’তে রাতের পর রাত তার বক্ষঃস্থল ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। প্রণয় সবটাই টের পায়। তবুও চুপ থাকে। সে কেবল সঠিক সময়ের অপেক্ষা করে৷ কিন্তু অন্তঃকরণ, সে তো ধরা বাঁধা নিয়মে চলে না। তাই তো নিয়মের ঊর্ধ্বে গিয়ে বেনিয়মেই শাহিনুর’কে লব্ধ(অর্জন) করল প্রণয়।
শুক্রবারের রাত ছিল সেদিন৷ রাত এগারোটা বেজে পয়ত্রিশ মিনিট। প্রণয় কিছু দরকারি ফাইল ঘাটাঘাটি করছিল৷ আর শাহিনুর তার কয়েকটি শার্ট নিজহাতে ইস্ত্রি করছিল। সহসা প্রণয় শাহিনুরের দিকে তাকাল। অতি সন্তর্পণে পাঁচ’টা শার্ট ইস্ত্রি করে ভাজ করে যথাস্থানে রেখে দিল শাহিনুর। প্রণয় অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,
-‘তুমি শার্ট ইস্ত্রি করতে জানো? কীভাবে! ‘
শান্ত চাহনিতে চেয়ে নরম গলায় শাহিনুর জবাব দিল,
-‘বড়ো ভাবির থেকে শিখে নিয়েছি।’
শবনম এবং জেবার সঙ্গে ইদানীং বেশ ভাব হয়েছে শাহিনুরের। শবনমের থেকে খুটিনাটি অনেক বিষয়ই শিখে নিচ্ছে নিয়ম করে৷ এতসব প্রণয়ের প্রয়োজন ছিল না। তার শার্ট ধৌত করা,ইস্ত্রি করা, এসবের জন্য আলাদা লোক রয়েছে। কিন্তু শাহিনুর তাদের দিয়ে করায় না। সবটা নিজ হাতেই করে৷ এসবের মাঝে প্রণয় আনমনে খুঁজে নেয় এক গভীর শুদ্ধতম ভালোবাসা’কে। সে ভালোবাসা যখন হৃদয়ে সুক্ষ্ম ব্যথা দেয়। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা বড্ড কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। প্রণয়ও পারেনি, বাঁধাও দেয়নি শাহিনুর। প্রণয় যখন কক্ষের সমস্ত জানালা বন্ধ করে শাহিনুরের দিকে তাকিয়েছিল, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর এক দৃশ্য দেখতে পেয়েছিল।
শাহিনুর শায়লার লজ্জা পাওয়ার দৃশ্য। যে দৃশ্যে তার হৃদয়ের তোলপাড়কেও সুক্ষ্ম ভাবে অনুভব করতে পেরেছিল। এক ষোড়শী কন্যার হৃদয়ে চলা তুমুল আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল সে। যার সমাপ্তি’তে মেয়েটা ক্লান্ত হয়ে অসহনীয় যন্ত্রণায়, চূড়ান্ত সুখে ছটফট করতে করতে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছিল তার বক্ষঃতলে। প্রণয় প্রথম বারের মতো অনুভব করেছিল সেই নারী’কে। যে নারী মিশে আছে তার মানসিক শান্তি’তে,দৈহিক সুখেতে। কোথায় সেই দৃঢ়তা? কোথায়ই বা গম্ভীরতা? প্রকৃতির সকল নমনীয়তা, সংসারের সকল বাধ্যতা স্বীকার করে তার হৃদয়কারিনী ঠিক তার হৃদয়ে ফিরেছে।
প্রথম পূর্ণতার রাত্রিটায় প্রণয় এতটাই উন্মত্ত ছিল যে কোন দিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল করেনি সে। কিন্তু দ্বিতীয় রাতে ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে আচমকাই তার দৃষ্টি এক জায়গায় স্থির হয়ে যায়! তৎক্ষনাৎ ত্বরিত বেগে একহাতে শাহিনুরের গায়ে কাঁথা টেনে সরে যায় সে। নিমিষেই তার চোখ দু’টো রক্তিম বর্ণ ধারণ করে। বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ত্যাগ করে পুরো শরীরে কাঁথা মুড়িয়ে শাহিনুর’কে কোলে তুলে নেয়। প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হয়ে স্নানাগারে ঢুকে পড়ে সে। লম্বা একটি সময় পর বেরিয়ে আসে প্রণয়। এসেই সর্বপ্রথম কক্ষের বাতি জ্বালায়। ক্রোধে তার মুখটা ভয়ানক রূপ ধারণ করেছে। কোনরকম গুরুগম্ভীর পা ফেলে শাহিনুরের জন্য প্রয়োজনীয় বস্ত্র নিয়ে স্নানাগারে দিয়ে পুনরায় বেরিয়ে আসে৷ পালঙ্কে বসে বারকয়েক জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে।
মিনিট কয়েকের ব্যবধানে শাহিনুরও বেরিয়ে আসে। এসেই প্রণয়’কে অস্থিরচিত্তে বসে থাকতে দেখে। রুদ্ধশ্বাস ত্যাগ করে ধীরপায়ে এগিয়ে এসে স্বামী’র পাশে বসে সে। এক হাত বাড়িয়ে প্রণয়ের বুকের বা’পাশটায় চেপে ধরে। মাথা নিচু করে সেখানটায় কান পেতে নিশ্চুপ হয়ে রয় অনেকটা সময়৷ প্রণয় স্থির হয়ে বসেই থাকে। তবে তার বক্ষঃস্থলের অস্থিরতা কিঞ্চিৎ হলেও কমেছে। তা টের পেয়ে মৃদু হাসে শাহিনুর মাথা তুলে এক পলক প্রণয়ের দিকে তাকায়। উঁচু হয়ে ধীরে ধীরে কানের কাছে মুখ ঠেকায়। ফিসফিসে কন্ঠে বলে,
-‘যে বুকে আমার শান্তি মেলে সে বুক’কে এত অস্থির করবেন না ডাক্তারসাহেব। আমার কষ্ট হয়!’
প্রণয়ের দু-চোখে যেন অগ্নিবর্ষণ হচ্ছে। ক্রোধে শরীরের রক্ত টগবগ করছে। অথচ শাহিনুর শান্ত রয়েছে। এর পেছনের কারণ হচ্ছে প্রণয়ের অশান্ত রূপ৷ তাকে তো শান্ত থাকতেই হবে। শাহিনুর আবারও প্রণয়’কে শান্ত করতে উদ্যত হলো৷ কিন্তু পারল না। তার পূর্বেই হিংসাত্মক চাহনি’তে তাকাল প্রণয়। শাহিনুর শান্ত দৃষ্টি’তে তাকিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলল,
-‘আপনি শান্ত হন ডাক্তারসাহেব।’
আঙুল দ্বারা তার ওষ্ঠ চেপে ধরল প্রণয়। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-‘একদম চুপ।’
শাহিনুর সত্যি চুপ করল। আর কথা বড়াল না। যাইহোক না কেন স্বামীর সঙ্গে বেয়াদবি করার ইচ্ছে তার নেই। তাছাড়া যে নিকৃষ্ট ঘটনা ঘটেছে এতে প্রণয়’কে শান্ত থাকতে দেখাও কাম্য নয়। প্রণয় আর দেরি করল না। শাহিনুর’কে চুপচাপ বসে থাকার আদেশ দিয়ে পুরো কক্ষের বাতি নিভিয়ে দিল। মধ্যরাত থাকায় অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে গেল কক্ষটি৷ ঘুটঘুটে অন্ধকারে অতি অল্প আলোও খুব সুক্ষ্ম ভাবে নজরে পড়ে৷ প্রণয়ের নজরের পড়ল৷ শাহিনুর খেয়াল করল প্রণয় ধীরপায়ে হাঁটাহাটি করছে। সহসা তার নজরেও সুক্ষ্ম এক আলোকরশ্মি বাড়ি খেল। নিখুঁত ভাবে খেয়াল করলে বোঝা যাবে প্রণয় যেদিকে যাচ্ছে আলোটাও সেদিকে যাচ্ছে।
এক পর্যায়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে চলে গেল প্রণয়। কপাট পদ্ধতির ড্রেসিংটেবিলের হাতলে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সে। সঙ্গে সঙ্গে একটানে খুলে আনল গোপন ক্যামেরাটি। শাহিনুর ত্বরান্বিত হয়ে কক্ষের বাতি জ্বালাল। প্রণয় তর্জনী আঙুল উঁচিয়ে চুপ করতে ইশারা করল তাকে৷ শাহিনুর চুপ হয়ে গেল। প্রণয় অতি ক্ষুদ্র ক্যামেরাটি দ্রুত তার ডাক্তারি ব্যাগে ঢুকিয়ে ব্যাগটি আলমারিতে ঢুকিয়ে তালা বন্ধ করে দিল। শাহিনুর চুপচাপ দাঁড়িয়ে সবটাই দেখল। প্রণয় ধীরপায়ে এগিয়ে এসে আলতো হাতে তার কপোলদ্বয় চেপে ধরল৷ ললাটে গাঢ় একটি চুম্বন এঁকে দিল। শাহিনুর স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। তার শুভ্র মুখশ্রী রক্তিম আভায় ছেয়ে গেল। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে প্রণয় বলল,
-‘প্রযুক্তি আশীর্বাদ, প্রযুক্তিই অভিশাপ!’
-‘ওটা কি ছিল?’
-‘ওটা এমন এক প্রযুক্তি যার নাম হেডেন ক্যামেরা। এর মাধ্যমে দূরে থেকেও এ কক্ষে কি হচ্ছে না হচ্ছে সবটাই দেখা যাবে।’
স্নানাগারে প্রণয় শুধু তাকে বলেছিল তাদের কেউ দেখছে। কিন্তু এভাবে এমন একটি কৌশল খাটিয়ে ভাবতেও পারেনি! প্রণয় ভেবেছিল সে অবাক হবে। কিন্তু শাহিনুর অবাক হলো না। শুধু তার চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠল। বলল,
-‘দুনিয়া’টা এমন কেন ডাক্তারসাহেব? বন্ধ ঘরে স্বামী-স্ত্রী’র পবিত্র সম্পর্ক’কেও ওরা ছাড়ল না!’
প্রণয়ের চোখ দু’টো কঠিন হয়ে এল। শাহিনুরের মাথায় হাত রেখে আশ্বস্ত করে বলল,
-‘কিচ্ছু হবে না। আমার স্ত্রী’র সম্মান রক্ষা করার দায়িত্ব আমারই। তার আগে তোমায় একটি কথা দিতে হবে নুর৷’
শাহিনুর আলগোছে প্রণয়ের বুকে মাথা রাখল। বলল,
-‘বলুন।’
-‘আমার সঙ্গে এ বাড়ি ছাড়তে হবে তোমায়।’
-‘ছাড়ব ডাক্তারসাহেব। কিন্তু আমারও কিছু শর্ত রয়েছে।’
-‘কী?’
-‘বাইজি গৃহের ধ্বংস।’
প্রণয় নিশ্চুপ হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। কোন উত্তর না পেয়ে শাহিনুর মাথা তুলল। দৃঢ় দৃষ্টি’তে তাকিয়ে বলল,
-‘কিছু বলছেন না যে?’
-‘এখানে আমার কোন হাত নেই।’
রাগ হলো শাহিনুরের। আক্রোশে ফেটে পড়ে বলল,
-‘আজ যদি আপনার ভাই হঠাৎ উধাও হয়ে যেত। আপনি কি খোঁজ করতেন না?’
-‘কি বলতে চাও।’
-‘আমার মান্নাত বুবু নিখোঁজ হয়ে গেল৷ অথচ এটা নিয়ে আপনার বিন্দু চিন্তাও দেখলাম না।’
-‘তুমি ভাল করেই জানো বাইজি গৃহ নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। আমি বাইজি’দের ঘৃণা করি!’
আঁতকে ওঠল শাহিনুর৷ শুষ্ক দৃষ্টি’তে পলক হীন তাকিয়ে রইল ক্ষণকাল। প্রণয় তার হাত ধরে বলল,
-‘অনেক রাত হয়েছে ঘুমাবে চলো।’
এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে শাহিনুর বলল,
-‘ছুঁবেন না আমাকে।’
-‘হোয়াট! পাগল হয়ে গেছ তুমি। চলো।’
বলেই শাহিনুর’কে টেনে পালঙ্কে বসাল। শাহিনুর সটান হয়ে দাঁড়িয়ে কঠিন গলায় বলল,
-‘আমি বলেছি আপনি আমাকে ছুঁবেন না।’
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল প্রণয়৷ সহসা শাহিনুরের কাঁধ চেপে ধরে ধমকে ওঠল,
-‘সমস্যা কী?’
শাহিনুর বারকয়েক ঘনঘন নিঃশ্বাস ত্যাগ করে কাঁধ থেকে প্রণয়ের হাতজোড়া ছাড়িয়ে নিল। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল,
-‘আমি বাইজি কন্যা ডাক্তারসাহেব। আপনি যাদের ঘৃণা করেন তাদেরই একজনের কন্যা আমি!’
এমনিতেই মেজাজ ক্ষিপ্ত হয়ে আছে। তারওপর শাহিনুরের জেদে অসহ্য হয়ে ওঠল প্রণয়৷ না পেরে জোরপূর্বক পালঙ্কে শুইয়ে দিল। গায়ের জোরে বাঁধ্য করল চুপ থাকতে৷ আদর করল অভিমান ভাঙাতে৷ কিন্তু শাহিনুর ঐ ধাঁচের মেয়েই না৷ সে তার জেদে অটল। প্রণয় যখন সোহাগে সোহাগে নিজ ওষ্ঠ দ্বারা তার অধর স্পর্শ করতে যাবে শাহিনুর তখন রাগান্বিত হয়ে হস্ত দ্বারা বাঁধা দিল, অধৈর্য হয়ে প্রণয় বলল,
-‘আরে বাবা আমি আমার শাশুড়ি মা’কে ঘৃণা করি না। তাকে আমি ভীষণ শ্রদ্ধা করি। সে না থাকলে এমন সুন্দর জিনিস আমি কোথায় পেতাম বলো। তার প্রতি আমি চিরকৃতজ্ঞ।’
তবুও নিভল না শাহিনুর৷ বরং দ্বিগুণ ফুঁসে ওঠল৷ তার কলার ধরে শক্ত কন্ঠে প্রশ্ন করল,
-‘বাইজিদের কেন ঘৃণা করবেন আপনি? ওরা খারাপ ওরা অহরহ পুরুষ’কে শরীর ছুঁতে দেয় তাই।’
-‘নুর!’
চমকে ওঠল শাহিনুর৷ সহসা কলার ছেড়ে দিল। অনুতপ্তের সুরে বলল,
-‘ক্ষমা করবেন।’
প্রণয় মৃদু হাসলো একহাতে মাথায় আলতো করে হাত বুলালো। বলল,
-‘খুব রেগে গেছো। শান্ত হও।’
ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে শাহিনুর বলল,
-‘আমি এখন অনেক কিছু বুঝি ডাক্তারসাহেব। আপনি বাইজিদের ঘৃণা করেন সেটাও বুঝি৷ কিন্তু কেন বলুন তো? ওদের দোষ’টা কোথায়? আমার আম্মার অতিত সবার জানা তাই সেদিকে যাব না। কিন্তু আপনি কি জানেন বেশির ভাগ বাইজিদেরই এমন অতিত আছে। আর একটা কথা বলুন তো? বাইজিদের জমিদার বাড়িতে কেন রাখা হয়?’
-‘চুপ করো।’
-‘না আমি চুপ করব না৷ কথা যখন ওঠেছে আজ আমি বলবই।’
শাহিনুরের দিকে ঝুঁকে থাকা প্রণয় ক্লান্ত হয়ে বালিশে মাথা রাখল৷ দৃঢ় দৃষ্টিজোড়া স্থির রাখল শাহিনুরের মুখপানে। শাহিনুর শান্ত কন্ঠে বলতে শুরু করল,
-‘আম্মার কাছে শুনেছি,পূর্বে জমিদার’রা বিনোদনের জন্য,তাদের তুষ্ট সাধনের জন্য বাইজিদের নিয়ে আসতো। তাদের কাজ ছিল নাচ করে জমিদার’দের মন জয় করা৷ দরিদ্র পরিবারের মেয়েরা টাকার অভাবে নৃত্য পেশা’কে বেছে নিতো। খুব সহজেই এভাবে তারা উপার্জন করতো৷ বাইজি মানে পেশাদার নর্তকী। নাচ দিয়ে জমিদারদের মনোরঞ্জন করাই তাদের কাজ। কিন্তু ধীরে ধীরে অধঃপতন ঘটল জমিদারদের৷ তারা বাইজিদের জন্য আলাদা বাড়ি তৈরি করল৷ সেখানে স্থায়ী করল তাদের। নাচ ভোগের পাশাপাশি শরীর ভোগ করার প্রস্তাব দিল, যেসব বাইজি এ প্রস্তাব সহজে মেনে নিতো তাদের টাকা,পয়সা,সোনা,দানায় ভরিয়ে দেওয়া হতো। যারা মানতো না তাদের জোরপূর্বক নিজের শয্যাসঙ্গিনী করা হতো। অনেক বাইজিদের জমিদারের হাতে খুন হওয়ার গল্প ইতিহাসে লেখা আছে।
অনেক বাইজিদের আত্মহত্যার কথাও উল্লেখ আছে। বাইজি’রা ঘৃণিত ছিল না। তাদের ঘৃণিত করা হয়েছে। আপনি বাইজিদের ঘৃণা করেন। অথচ তাদের যারা জন্ম দিল, যাদের জন্য জন্ম হলো এই বাইজিদের তাদের সঙ্গেই একই ছাদের নিচে কাটাচ্ছেন। বাইজিদের খারাপ চোখে দেখেন কারণ তারা পতিতাবৃত্তি করছে। অথচ তাদের দিয়ে যারা এসব করাচ্ছে তারা ভদ্র সমাজেরই লোক। ভদ্র সমাজে জমিদার’দের মাথায় করে রাখা হয় আর বাইজিদের বলা হয় নিকৃষ্ট, ঘৃণ্যতম মানুষ। আপনার বড়ো ভাই’কে দু’দিন বলতে শুনলাম আমি বেশ্যার মেয়ে! বাইজি’রা নাকি বেশ্যাই হয়৷ তাহলে আমি বলতে পারি এই বেশ্যাদের জন্মদাতা জমিদার’রা। আমার আম্মা যদি বেশ্যা হয় আপনার আব্বা সেই বেশ্যারই জন্মদাতা!’
সহসা শাহিনুরের মুখে হাত চেপে ধরল প্রণয়। ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে বলল,
-‘ব্যস।’
ঠাশ করে হাত সরিয়ে দিল শাহিনুর৷ ক্ষণকাল চুপ থেকে সহসা শক্ত জড়িয়ে ধরল প্রণয়’কে। বুকে মাথা রেখে শান্ত গলায় বলল,
-‘শুনতে খারাপ লাগছে ডাক্তারসাহেব? সত্যিটা সবসময় তিক্তই লাগে। এই বাইজিদের ঘৃণা করার আগে,এই বাইজিদের দিকে আঙুল তোলার আগে আঙুলটা আপনার আব্বার দিকে তুলবেন। আপনার পূর্ববংশীয় জমিদার’দের দিকে তুলবেন। তাহলে আর ঘৃণা আসবে না বরং করুণা আসবে ওদের জন্য৷ ঘৃণা আসবে নিজেদের জন্য!’
-‘আমি সবাই’কে ঘৃণা করি। আমি নিজের বাবা,মা’কে যেমন ভালোবাসি তেমন ওদের কৃতকর্মের জন্য ঘৃণাও করি। আর এ ঘৃণার জন্য ছোটো থেকেই এ বাড়ি’তে দীর্ঘ সময় কাটাতে পারিনি।’
শক্ত গলায় জবাব দিল প্রণয়৷ শাহিনুর বলল,
বাইজি কন্যা পর্ব ৩৬
-‘আমি আপনাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য কথাগুলো বলিনি৷ শুধু বোঝানোর জন্য বলেছি।’
প্রণয় নিশ্চুপ হয়ে রইল। শাহিনুর আরো গভীরভাবে তাকে জড়িয়ে ধরল। নরম গলায় বলল,
-‘আমার স্বামী’র মনে কোন ভুল ধারণা থাকুক তা আমি চাইনা।’
শেষ বাক্য শুনতেই বড়ো করে একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে শাহিনুর’কে কঠিন ভাবে জব্দ করল প্রণয়। শাহিনুর নিঃশব্দে ভালোবেসে বাকি রাতটুকু পার করল।