বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১০

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১০
রানী আমিনা

কারো গমগমে ভারী কন্ঠস্বরে চমকে তাকালো থিয়োডর রেসিডেন্সিয়াল এরিয়ার ভেতর দিয়ে রেড জোনের দিকে চলে যাওয়া রাস্তাটার দিকে।
তিনজন দীর্ঘদেহী পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে গোধূলি লগ্নের লালচে আলো মাখা পথের ওপর,
সর্বডানে থাকা ছেলেটি গৌরবর্ণের, অত্যন্ত সুপুরুষ। এক পা সামান্য এগিয়ে দিয়ে ডান হাতটা প্যান্টের পকেটে রেখে দাঁড়িয়ে আছে সে। বা হাতে তার গায়ের খুলে রাখা শার্টটা ধরে আছে অযত্নে। চোখে তার ফুটে আছে বন্য শিকারির তীক্ষ্ণতা।

মাঝখানের জন সবচেয়ে লম্বা। তার তামাটে ত্বকের ওপর ঘাম জমে চিকচিক করছে৷ গাঢ় কালো প্যান্ট আর খোলা বুকের সাদা শার্টে পরণে তার।
দু’হাতই পকেটে, দাঁড়ানোর ভঙ্গিমায় এক অভিজাত গাম্ভীর্য। ভ্রু জোড়া কুঁচকে আছে তার। নীরব কিন্তু প্রবল আত্মবিশ্বাসের ছায়া ছড়িয়ে আছে সমস্ত মুখাবয়বে।
বামে থাকা ছেলেটি সামান্য বেঁকে দাঁড়িয়ে, যেন বেখেয়াল। কিন্তু চোখে তার ফুটে আছে তীক্ষ্ণ হাসি। নির্বিকার চিত্তে পা দিয়ে মাটিতে জমে থাকা ধুলোর স্তুপের ভেতর সমান তালে গুতিয়ে যাচ্ছে সে। কাঁধ থেকে কোমর পর্যন্ত গ্রীক মূর্তির ন্যায় শক্ত গাথুনীর শরীর সবগুলোর।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

লিন্ডা পেছনে তাকিয়ে ওদেরকে দেখা মাত্রই ছুটে গিয়ে ঝাপিয়ে পড়লো ডানে থাকা গৌরবর্ণের সুপুরুষটির বুকে, আহ্লাদে মাথা গুজে দিলো বুকের মাঝখানে। পুরুষটি পরম আদরে আগলে নিলো লিন্ডাকে।
না চাইতেও ভড়কালো থিয়োডর। এ তিনজনকে দেখে মোটেও সুবিধার মনে হচ্ছে না, ক্রিমিনাল ক্রিমিনাল ভাইব দিচ্ছে। কিন্তু এদের সাথে শার্লটদের কি সম্পর্ক সেটা ভেবে পেলোনা থিয়োডর। তবে এদেরকে ও কোথাও দেখেছে, মুখ গুলো চেনা চেনা লাগছে ভীষণ কিন্তু মনে করতে পারছে না৷
নিজের এই অনাকাঙ্ক্ষিত ভীতি কাউকে বুঝতে দিলোনা থিয়োডর, যথাসম্ভব শান্ত থেকে গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

“তোমরা কারা? এখানে কি করছো?”
“আমি কোকো।”
অত্যন্ত ভদ্র স্বরে উত্তর দিলো লিও আর কাঞ্জির মাঝে দাঁড়ানো কোকো, যেন ওর মতো ভদ্রতা জ্ঞান সম্পন্ন ছেলে এই তল্লাটে আর দুটি নেই। ওর দেখা দেখি লিও আর কাঞ্জি পর পর হাত উঁচু করে হাজিরা দেওয়ার মতো করে বলে উঠলো,
“আমি লিও।”
“আমি কাঞ্জি।”
লিওর বুকে লেপ্টে থাকা লিন্ডা থিয়োডরের দিকে তাকিয়ে বাকি সবার মতো করেই হাত উঁচিয়ে বলল,
“আমি লিন্ডা।”
তখনই ওদেরকে খুজতে খুজতে রেড জোনের ভেতর থেকে হেটে কোকো দের পেছনে এসে হাজির হলো ব্রায়ান। কাঞ্জিকে পাশ কাটিয়ে সামান্য এগিয়ে এসে অন্যদের অনুকরণে হাত উঁচিয়ে ইনোসেন্ট হেসে বলল,
“আমি ব্রায়ান।”
শার্লট আর ফাতমা শব্দ করে হেসে উঠলো ব্রায়ানের কথায়৷ শার্লট হাসাহাসির এক ফাঁকে কিছুক্ষণের জন্য থেমে বলে উঠলো,

“আমি হলাম গিয়ে শার্লট।”
বলে ঠোঁট চেপে হাসি আটকানোর চেষ্টা করলো ও, কিন্তু হাসিগুলো থামলো না, ঠোঁট ফসকে শব্দ করে বেরিয়ে এলো।
“আর আমি ফাতমা।”
থিয়োডরের দিকে তাকিয়ে নির্বিকার গলায় বলল ফাতমা।
থিয়োডর চুপ হয়ে রইলো। মুখখানা আগের মতোই কঠিন হয়ে রইলো ওর। এই ছেলে গুলোকে ও চিনতে পেরেছে, শেহজাদী তিন বছর আগে যেদিন সেইফজোনের ভেতর থেকে পালিয়ে লাইফট্রি তে ঢুকে গেছিলেন এদের সেদিনই দেখেছিলো সে। কিন্তু ভুলে গেছিলো এতদিনে।
ব্রায়ান তবে এদের দুজনকে নিয়ে ওই ছেলেগুলোর আন্ডারে বাস করছে! এই জন্যেই তো এখনো রেড জোনে টিকে আছে৷ নইলে তো এতদিনে জংলী জানোয়ারের খাবার হয়ে যেতো!
কোকো এগিয়ে এলো এমন সময়, শার্লট ফাতমাকে পাশ কাটিয়ে থিয়োডরের সামনে গিয়ে দাড়ালো ও৷ কোকোর বিশাল শরীরের সামনে থিয়োডর যেন নাই হয়ে গেলো! পেছনে ফিরে কাঞ্জিকে শার্লট ফাতমার হাতের বাধন খুলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে কোকো ফিরে তাকালো আবার সম্মুখে।
থিয়োডরের নীল চোখের দিকে নিজের লাইট গ্রে চোখের দৃষ্টি রেখে কোকো জিজ্ঞেস করলো,

“পরিচয় পেয়েছিস?”
“জ-জ্বী….”
“খুশি হয়েছিস?”
“জ্বী হয়েছি।”
“ভেরি গুড।”
বলে কোকো ওর বিশাল হাতের চওড়া থাবা খানা রাখলো থিয়োডরের কাধের ওপর। থিয়োডরের মনে হলো যেন কোনো হাতি পা তুলে দিয়েছে ওর ঘাড়ে। কোকো সামান্য এগিয়ে এসে গমগমে গলায় বলল,
“আজ যা বেধেছিস বেধেছিস। ছোট বাচ্চা, ভুল করে ফেলেছিস তাই কিচ্ছু বললাম না।
তবে….. দ্বিতীয় বার আমার বোনেদের গায়ে হাত পড়লে তোর হাত আমি ছিড়ে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবো।
এরা যখন খুশি এখানে আসবে, যা ইচ্ছা করবে, যা ইচ্ছা খাবে, যা ইচ্ছা পরবে। তুই বা তোর ওই পোষা গাধীটা যদি কখনো কোনো কথা বলেছিস তবে সেদিনই হবে তোদের শেষ দিন, কথাটা মাথায় রাখিস।”
তারপর থিয়োডরের দিকে নিজের কুমিরিয়ান দৃষ্টি রেখেই কোকো ডেকে উঠলো,

“ব্রায়ান!”
“জ্বি ভাইজান।”
“বাকিদের ডেকে নিয়ে সেইফজোনে যত গুলো ফলের গাছ আছে সবগুলো থেকে ফল পেড়ে নিয়ে আয়, অর্ধেক দিবি এখানে যারা কাজ করছে তাদের আর বাকি অর্ধেক মহলে নিয়ে যাবি।”
“ঠিক আছে ভাইজান।”
বলে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে ব্রায়ান ঘুরে চলে গেলো বাকিদের ডাকতে।
থিয়োডর তখনও দাঁড়িয়ে রইলো স্থীর হয়ে, উচ্চবাচ্য করলোনা। কোকো ওর দিকে কিয়ৎক্ষণ শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে অতঃপর ঘুরে দাঁড়িয়ে হাতে দুবার তালি দিয়ে বাচ্চাদের উদ্দ্যেশ্যে উচ্চস্বরে বলে উঠলো,
“দ্যা ড্রামা এন্ডস হেয়ার, চলোরে সবাই!”

বাচ্চারা যখন ক্রিস্টাল পুলে ফিরে এলো ততক্ষণে আনাবিয়া ঘোরাঘুরি শেষ করে ফিরে এসে বর্তমানে ডোবার পানিতে পা ডুবিয়ে বসে আছে।
মন ভালো নেই ওর আজ, মীরকে হঠাৎ করেই ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে। মীর যে নেই সেটা ওর মন মেনে নেয়নি আজও, তাই মনকে বুঝ দিতেই এতক্ষণ এদিক সেদিক ঘুরে মীরকে খুঁজে চলেছিলো ও অবুঝ বাচ্চা মেয়েটির মতো!
আপাতত মনটা একটু শান্ত হয়েছে, কিন্তু পুরোপুরি হয়নি৷ তাকে পুরোপুরি শান্ত করার জন্য কিছু একটা করা প্রয়োজন!

হৈহল্লা করতে থাকা বাচ্চারা এসে ওকে এভাবে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে চুপসে গেলো। একে অপরের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করে, নিজেদের ভেতর চাপা সুরে আলোচনা করে নিলো কিছুক্ষণ।
আনাবিয়ার এমন আচরণের সাথে ওরা পরিচিত। মাঝে মাঝেই হঠাৎ করেই মন খারাপ করে বসে থাকে তাদের শেহজাদী। কারণটাও তাদের অজানা নয়।
কোকো ঝুড়ি থেকে ওদের সংগ্রহ করা ফল থেকে খুব সুস্বাদু আর টসটসে পাকা দেখে কয়েকটা হাতে নিয়ে এগিয়ে গেলো আনাবিয়ার দিকে। বাকিদের পাঠিয়ে দিলো মহলে, ওরা সকলে চুপচাপ প্রস্থান করলো সে স্থান থেকে।
আনাবিয়ার পাশে এসে আনাবিয়ার মতো করেই ডোবার পানিতে পা ঝুলিয়ে বসলো কোকো। ওর আম্মা ফল খেতে চান না৷ হিজ ম্যাজেস্টি থাকাকালীন নিজে হাতে ফলের টুকরো করে ওর আম্মার মুখের ভেতর ঠেসে দিতো জোর করে, মুখ বেজার করে খেতো ওর আম্মা।

কোকো চুপচাপ পকেটে থাকা পকেট নাইফ বের করে ফলগুলো টুকরো করতে লেগে গেলো, তারপর এক টুকরো হাতে নিয়ে আনাবিয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে উঠলো,
“খান আম্মা!”
“ভালো লাগছেনা কোকো, পরে দেখবো।”
“অনেক মিষ্টি, খুব সুস্বাদু! এই দেখুননা, আপনার ঠোঁট শুকিয়ে গেছে, আপনার চোয়ালের হাড় বেরিয়ে যাচ্ছে, ফল খেতে হবে, ফল। তাহলে আপনিও আবার ফলের মতোন টসটসে হয়ে যাবেন৷”
আনাবিয়া চোখ ঘুরিয়ে তীর্যক চোখে দেখলো কোকোকে। এই ডায়লগ টা মীরের। আনাবিয়া ফল না খেতে চাইলে মীর ওর মুখের ওপর অত্যন্ত মনোযোগী দৃষ্টি ফেলে ঠিক এভাবেই বলতো,
“এই দেখো তোমার ঠোঁট শুকিয়ে যাচ্ছে, দেখো চোয়ালের হাড় বেরিয়ে যাচ্ছে, এখানে আমি আদর করবো কোথায়? ফল খাও ফল, তবে তুমি আবার ফলের মতোন টসটসে হয়ে যাবে৷”
বলে মুখের ভেতর ঠেসে দিতো।

কোকো শেষের বাক্যটা শুধু স্কিপ করে গেছে। মীরের থেকে শুনে শুনে এরা এসবও মুখস্ত করে ফেলেছে!
আনাবিয়াকে এভাবে তাকাতে দেখে কোকো ইনোসেন্ট হাসলো, তারপর আবার এগিয়ে দিলো ফলের টুকরোটা। আনাবিয়া মুখ ফিরিয়ে নিলো। মীর ছাড়া ওকে কেউ ফল খাওয়াতে পারেনি, আর পারবেও না।
পুলের ভেতর থেকে পা বের করে উঠে দাঁড়াতে দাড়াতে ও বলে উঠলো,
“মহলে ফিরে যা, আমার কাজ আছে একটু।”
আর তারপর মুহুর্তেই সেখান থেকে হাওয়ার বেগে প্রস্থান করলো আনাবিয়া৷ কোকো ফলের টুকরো টা হাতে নিয়ে সেখানেই বসে রইলো খানিকক্ষণ, তারপর টুকরোটা ডোবার পানিতে কাগজের নৌকার মত করে ভাসিয়ে দিয়ে উঠে চলে গেলো মহলের দিকে। ওর আম্মার মুখের সামনে ধরা ফলের টুকরো ও কিভাবে নিজের পেটে ভরবে?

রাতের এখন দ্বিতীয় প্রহর। ইলহান নিজের কামরায় টেবিলের কাগজ পত্রের ভিড়ে বসে আছে৷ কাগজ পত্র উঠিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া চালু করলেও তার ভয়াবহতা লক্ষ্য করে আবার কাগজ পত্রেই ফিরে এসেছে ইলহান।
ওর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জমা করে রাখা ওয়েবসাইট গুলো এত এত সিকিউরিটি সত্ত্বেও হ্যাক হয়ে গেছে, ভাগ্য ভালো সময় মতো সব তথ্য ও সরিয়ে নিয়েছে, হ্যাকাররা অল্পই নিতে পেরেছে।
এতদিন ওর ধারণা ছিলো ওর সাম্রাজ্যের কোনো শত্রু নেই, কিন্তু না, ওর ধারণা ভুল। পূর্বে মীরকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য অনেক চেষ্টাই করেছে ইলহান, কোনো কিছুই বাদ রাখেনি৷ কিন্তু কোনোভাবেই সফল হতে পারেনি ও, মীর কোনো ফাঁকফোকর রাখতোনা কোথাও৷

ইলহান ভেবেছিলো মীরের শত্রু ইলহান নিজে ছিলো, তাই এখন ওর সাম্রাজ্য নিয়ে চিন্তার কিছুই নেই। কিন্তু ওর এই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে দিলো বিগত কয়েক মাসের ঘটনা গুলো। তবে ওর সাম্রাজ্যের ওপর কার কুনজর পড়েছে? কে ওর সাম্রাজ্যের পেছনে উঠে পড়ে লেগেছে?
ইতোমধ্যেই লোক লাগিয়ে দিয়েছে ইলহান, সবগুলো দ্বীপে খোঁজ চলছে সেসমস্ত ট্রেইটর দের।
চিন্তায় মাথাটা ভার হয়ে আসছে ওর, ক্লান্তিতে শরীর বার বার বিছানা চাইছে। কিন্তু কাজ গুলো শেষ হয়েও হচ্ছে না। নতুন করে ওয়েবসাইটের ডকুমেন্টস গুলোকে আবার কাগজি ডকুমেন্টসে রুপান্তর করতে গিয়ে ভীষণ শ্রম যাচ্ছে ওর।

এদিকে কাউকে বিশ্বাসও করতে পারছেনা, তাই এ কাজ গুলো খুব অল্পসংখ্যক লোকজন দিয়েই করাতে হচ্ছে ওকে, আর নিজে যতটা সম্ভব করছে। নিজের বোকামির জন্য নিজের ওপরেই বিরক্ত হয়ে উঠছে ও৷ মীরের সিস্টেম গুলোকে খাটো করে দেখার আর সুযোগ নেই, সেগুলোই বেস্ট ছিলো। এখন ওর টেকনিক গুলোই ইলহানকে ফলো করতে হবে। এর জন্য ওর মীরের কাছের কাউকে চাই।
জায়ান সাদি আর নওয়াস জাবিন, এরাই ওর সর্বশেষ সম্বল!
এমন সময়ে ওর টেবিলের ওপরে থাকা স্বচ্ছ স্ক্রিনে ভেসে উঠলো ইযানের নাম, পরমুহূর্তেই স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রটি থেকে ধ্বনিত হলো ইযানের কণ্ঠস্বর,

“ইয়োর ম্যাজেস্টি, ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিন।”
ইলহান খুলে দিলো দরজার সিকিউরিটি লক। ‘এসো’ বলতেই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো ইযান, ইলহানের টেবিলের সম্মুখে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো,
“ইয়োর ম্যাজেস্টি, শেহজাদী এসেছেন।”
ইলহান চমকালো কিছুটা। এতগুলো দিন পর আনাবিয়া এসেছে, সেটাও প্রাসাদে! অবিশ্বাস্য ব্যাপার স্যাপার।
হাতের কাজ রেখে সোজা হয়ে বসলো সে, তারপর বলে উঠলো,
“কোথায় সে? ভেতরে আসতে বলো।”

“উনি নিজের কামরাতে ঢুকেছেন। কারো সাথে কোনো কথা বলেননি। আমি ইয়াসমিন আর মহসিনকে ইনফর্ম করেছি শেহজাদীর নিকট উপস্থিত হওয়ার জন্য। যদি তাঁর কিছু প্রয়োজন হয়, সেকারণে।”
ইযানের কাজে খুশি হয়েছে বলে মনে হলো ইলহানকে। সন্তুষ্ট চিত্তে টেবিলের ওপর ছড়ানো ছিটানো কাগজ পত্র গুলো গুছিয়ে রাখতে শুরু করলো সে।
আনাবিয়া ঘুরেফিরে দেখছে নিজের কামরাটা। আগের মতোই আছে, একটা জিনিসও এদিক থেকে ওদিক হয়নি, বিছানাটাও বরাবরের মতোই ফিটফাট। সম্পুর্ন কামরা চকচকা ফকফকা, ধুলো জমেনি কোথাও।
তার কামরাটা যে নিয়মিত ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করা হয় সেটা স্পষ্ট বুঝলো আনাবিয়া৷ কিন্তু পরিষ্কার করা হয় ঠিক কার আদেশে সেটা অস্পষ্ট রয়ে গেলো।
ঝিনুকের খোলসের আকৃতির ন্যায় বিশাল বিছানার দিকে দৃষ্টি যাওয়া মাত্রই পুরোনো স্মৃতি গুলো মানস্পটে হুটোপুটি করে এসে লাফিয়ে পড়লো তৎক্ষনাৎ!

ফিটফাট বিছানা পছন্দ করতো ও সবসময়, কোথাও এতটুকু ভাজ পড়লেও আর সেখানে ঘুমোতে চাইতোনা। কিন্তু ওর বিছানার বারোটা বাজানোর দায়িত্ব মীর নিজের কাধে নিয়ে নিত রোজ।
নাকে মুখে রাজ্যের কাজ শেষ করে এসে হামলে পড়তো ওর বিছানায়, ওর ফিটফাট বিছানার দফারফা করে দিয়ে, ওকে সমস্তই উল্টেপাল্টে দিয়ে ভোর বেলা বীরদর্পে বেরিয়ে যেতো; যাওয়ার পূর্বে আনাবিয়ার এলোমেলো বিছানার দিকে তাকিয়ে এমন এক বিশ্বজয়ের হাসি দিতো যেন খুব উত্তম কোনো কাজ করেছে সে এবং এই কাজের জন্য তাকে দিন রাত দুটো করে নোবেল দেওয়া উচিত!

ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো আনাবিয়ার, ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ও এগোলো ওর ক্লজেটের উদ্দ্যেশ্যে।
মীরের অনুপস্থিতি কোনো এক অজানা কারণে নাড়া দিতে পারছেনা ওকে, আনাবিয়া নিজেও ওর মনের এমন অদ্ভুত কর্মে দ্বিধান্বিত। মীরের মৃত্যুটা এখনো বিশ্বাস করেনি ওর মন, মস্তিষ্ক। তাদের ধারণা মীর আছে, আনাবিয়ার খুব কাছে; হয়তো ধরা দিচ্ছেনা, লুকিয়ে আছে কোথাও! কিন্তু সে আছে!
ক্লজেটের ভেতর ঢুকতে ঢুকতে আনাবিয়ার মনে হলো এই বুঝি ওর পোশাকের আড়াল থেকে অর্ধ উন্মুক্ত শরীরে দুম করে বেরিয়ে এসে ওকে চমকে দেবে মীর, তারপর এক ঝটকায় ওকে কোলে তুলে নিয়ে গিয়ে ধপাস করে ছেড়ে দিবে বাথ টাবে জমিয়ে রাখা পানির ভেতর!

আনাবিয়া এসব ভাবনাগুলোকে বাতিল করার প্রচেষ্টায় মাথাটা কিঞ্চিৎ ঝাকালো, যেন ভাবনাগুলোকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিতো চাইলো মেঝেতে, এখুনি হয়তো সেগুলো দুম দাম করে মেঝেতে পড়ে ছোট ছোট হাত পা গজিয়ে ছুটে পালাবে দেয়ালের কোনো এক অন্ধকার কোণে৷
এগিয়ে গিয়ে ক্লজেটের ভেতরে থাকা শেল্ফ গুলোর একটির স্লাইডিং ডোর সরিয়ে বের করলো একটা ট্রলি। অন্য শেল্ফগুলো থেকে বেছে বেছে নিয়ে নিলো বেশ কিছু পোশাক। কয়েক জোড়া জুতা, বেশ কয়েকটি প্রয়োজনীয় প্রসাধনী নিয়ে ব্যাগের একাংশ ভর্তি করে ফেললো আনাবিয়া।

ট্রলিটা এক হাতে মেঝেতে টানতে টানতে বেরিয়ে এলো ক্লজেট থেকে। বিছানা ঘেঁষে কামরার ডান পাশে থাকা ওয়াল আলমিরার ভেতরের লক করা একটি কম্পার্টমেন্ট খুলে ও বের করলো ওর দেনমোহরের ব্লু কয়েন্স গুলো।
এখনো পর্যন্ত একটি ব্লু কয়েন্সও খরচ হয়নি এগুলো থেকে। ঠিক যেভাবে মীর দিয়েছিলো সেভাবেই আছে, আছোঁয়া। শেহজাদী হওয়ার সুবাদে মাসিক একটা বড় অ্যামাউন্টের ইনকাম হয় তার, সেগুলো গিয়ে জমা হয় রাজ কোষাগারে তার জন্য নির্ধারিত কম্পার্টমেন্টে। আনাবিয়া এখনো জানেনা সে ঠিক কত অ্যামাউন্টের স্যালারি পায়। আর এখন পর্যন্ত ঠিক কত অ্যামাউন্ট সেখানে জমা হয়েছে সেটারও কোনো ধারণা নেই ওর।

এসব কখনো দেখার প্রয়োজন পড়েনি ওর, নিজের অংশ থেকে কখনো এতটুকুও খরচের প্রয়োজন পড়েনি।
মীর ওকে এমনিতেই একটা বিশাল অ্যামাউন্টের হাত খরচ দিতো, সেটাও মাস শেষে উপেক্ষিতই থাকতো। প্রাসাদের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন পড়তো না ওর কখনো, যেটুকু সময়ের জন্য যেতো সেটুকু সময়ের কোনো এক্সপেন্স হলেও সেটা মীরই বহন করতো।

ব্লু কয়েন্স গুলো নিয়ে ও হাত বাড়ালো জরুরি দলিলপত্রের দিকে। শিরো মিদোরির রেড জোন সম্পুর্নটাই ওর নামে। বাকি চার দ্বিপের কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশের মালিকানাও মীর ওর নামেই করে দিয়েছে৷ এছাড়া বাবা সালিমের কারণে এক বিরাট পরিমাণ সম্পত্তির মালিক হয়েছে সে।
এগুলোর দেখভাল আনাবিয়াকে কখনোই করতে হয়নি, মীর নিজে থেকেই সমস্ত কিছু দেখাশোনা করতো। সবকিছু নিজের নখদর্পনে রাখতো।

আনাবিয়া এখনো ভেবে পায়না ওই মানুষটা এত্ত কিছু কিভাবে সামলাতো? ওর তো ভাবলেও মাথা ঘুরায়!
এসবের কাগজপত্রগুলো সংগ্রহ করে, আরও কিছু প্রয়োজনীয় কাগজ ও দলিলপত্র নিয়ে ব্যাগে ঢোকালো আনাবিয়া। গোছগাছ করে তাকালো একবার ওর আর মীরের কামরার সংযোগ স্থলের দরজাটার দিকে, ওপাশের চিরপরিচিত কামরাটা এখন অন্য কারো দখলে।
বুকের ভেতর হঠাৎই মোচড় দিয়ে উঠলো আনাবিয়ার। সেটাকে কোনোরকমে সহ্য করে নিয়ে ট্রলির হাতলটা ধরে এগোলো বাইরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু কামরার দরজা খুলে বারান্দায় পা রাখতেই নিজের সামনে ইলহানকে দাঁড়ানো দেখলো ও।

দুহাত পেছনে বেধে, ঠোঁটের কোণে অমায়িক হাসি ফুটিয়ে তাকিয়ে আছে সে আনাবিয়ার দিকে।
হাসি হাসি মুখেই ইলহান বলে উঠলো,
“হাই, মিসেস দেমিয়ান! কেমন আছেন?”
আনাবিয়া নির্বিকার চোখে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে কিছুক্ষণ, তারপর ইলহানকে সম্পুর্ন উপেক্ষা করে ঘুরে যেতে নিলো মীরের কামরার দিকে।
ওকে নিজের কামরার দিকে অগ্রসর হতে দেখে ইলহান ছুটলো ওর পেছনে, এগিয়ে আনাবিয়ার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আনাবিয়ার পাশে পাশে হাটতে হাটতে সম্পুর্ন স্বাভাবিক স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“কোথায় যাচ্ছো পতিব্রতা রমনী?”

আনাবিয়া এবারও উত্তর দিলোনা কোনো।
সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলো মুহসিন আর ইয়াসমিন, দুজনেই আনাবিয়াকে দেখে মাথা নুইয়ে আনুগত্য প্রকাশ করলো। আঙুলের ইশারায় মুহসিনকে নিজের কাছে ডাকলো আনাবিয়া। মুহসিন ছুটে এলো দ্রুত পায়ে, এসে নত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো আনাবিয়ার আদেশের অপেক্ষায়।
“মীরের জিনিসপত্র গুলো কোথায়?”
জিজ্ঞেস করলো আনাবিয়া, মুহসিন আনুগত্যের সাথে উত্তর দিলো,
“প্রাসাদের বেজমেন্টে রেখে আসা হয়েছে শেহজাদী।”
“ওগুলো এখনি গুছিয়ে গাড়িতে উঠিয়ে দাও। আর আমার বাচ্চা গুলোর সমস্ত জিনিসপত্র আমার চাই। একটাও মিসিং থাকা চলবে না।”

মুহসিন মাথা হেলিয়ে চলে যেতে নিচ্ছিলো, তার আগেই আনাবিয়া ওকে ডেকে আবার জিজ্ঞেস করলো,
“মীরের কার ক্যিজ কোথায়?”
“হিজ ম্যাজ.……”
বলতে গিয়েও থেমে গেলো মুহসিন, শুকনো একটা ঢোক গিলে আবার বলা শুরু করলো,
“শেহজাদা নামীর আসওয়াদ দেমিয়ানের গাড়িটি হিজ ম্যাজেস্টি নিজের করে নিয়েছেন৷ গাড়ির চাবি বর্তমানে তাঁর কাছেই আছে।”
ইলহান দাঁড়িয়ে ছিলো মীরের কামরার দরজার নিকট, মুখে তার হাসি খেলা করছে।
আনাবিয়া মুহসিনের দিক থেকে ফিরে গেলো মীরের কামরার দিকে, ইলহান দরজায় দাঁড়িয়ে আছে তখনো। আনাবিয়া কামরার ঢোকার জন্য ওর সম্মুখে এসে দাঁড়ালেও একচুল নড়লো না সে।
আনাবিয়া মাথা উঁচিয়ে ওর চোখের দিকে সরাসরি তাকালো এবার, শক্ত গলায় বলে উঠলো,
“সামনে থেকে সরুন।”

“ইয়োও, শেহজাদী এতক্ষণে মুখ খুলেছেন দেখি! আপনার মিষ্টি কন্ঠস্বর শুনে আমি ধন্য।
কিন্তু আমি খুবই দুঃখিত, এখানে দাঁড়াতে এই মুহুর্তে বেশ ভালোই লাগছে আমার, আপাতত সরছিনা।”
“সরে দাড়ান!”
“যদি না সরি?”
“তাহলে দেমিয়ান সাম্রাজ্যের আরও এক শেহজাদার মৃত্যু হবে এবং সিংহাসনে বসবে আনাবিয়া ফারহা দেমিয়ান।”
বলে তর্জনী দিয়ে নিজের নাকের মাথা ঘষলো আনাবিয়া। আনাবিয়ার বলার ভঙ্গি দেখে হো হো করে প্রাসাদ কাঁপিয়ে হেসে উঠলো ইলহান, বলল,
“আরে, আমার দু মিনিটের ছোটভাইটা দেখি তোমাকে দারুণ জোক্স মারা শিখিয়েছে!”
বলেই ইলহান তাকালো একবার বারান্দা জুড়ে, দাস দাসী গুলো হা করে ওদের কথা শুনছে। হয়তো ভাবছে, এরাও তবে নিজেদের ভেতর এমন ইনফর্মালি কথা বলে!

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৯

ইলহান ওদের দিকে একবার দৃষ্টি দিয়ে কৌতুকপূর্ণ স্বরে উচ্চস্বরে বলে উঠলো,
“ফ্যামিলি ফ্যামিলি কথা হচ্ছে এখানে, বারান্দা ফাঁকা চাই।
ইলহানের কথা শোনা মাত্রই সকলে সুড়সুড় করে বেরিয়ে গেলো বারান্দা থেকে, বারান্দা খালি হয়ে গেলো মুহুর্তেই….

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here