বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১১

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১১
রানী আমিনা

ইলহান তাকালো আবার আনাবিয়ার দিকে, দুকদম এগিয়ে এসে আগের মতো করেই বললো,
“তোমার ছোটবেলায় তোমাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারলে আজ তুমি আমার বউ হতে, জানোতো!”
“পারেননি তো, একটা বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে পালানোর মতো মুরদটুকুও তো আপনার নেই, সেই আমার স্বামীর কাছেই ধরা খেয়ে ডার্ক প্যালেসে গিয়ে পঁচতে হলো। আপনি কেমন সাম্রাজ্য চালাবেন সেটাও আমার জানা আছে।
ওই যে একটা প্রবচন আছে না, ‘পারেনা বা* ছিড়তে, উঠে পড়ে বেয়ান রাত্রে’, আপনি আসলে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। যা পারেননা তা করার জন্য এত লাফান কেন বলুনতো?”
ইলহান মিষ্টি করে হাসলো, দরজার ফ্রেমে নিজের দীর্ঘ শরীরটা হেলিয়ে ঠেকিয়ে দিয়ে বলে উঠলো,

“ছিহঃ অশ্লীল! এসব কে শিখিয়েছে তোমাকে? আমার দু মিনিটের ছোট ভাই?”
“আপনার দু মিনিটের ছোট ভাই আমাকে আরও অনেক কিছুই শিখিয়েছে, যখন আমার স্বামী প্রদত্ত শিক্ষার প্রমাণ পাবেন তখন নিজেই এই সিংহাসন ছেড়ে পালাতে চাইবেন। এমনিতেই চেহারার হালত দেখে বোঝা যাচ্ছে এই সাম্রাজ্যের ভার আপনার ওপর খুউউব ভারী পড়ে যাচ্ছে, শেহজাদা জাজিব ইলহান। ফস্‌সা চেহারা কালো হয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে। ইশ…!”
শব্দ করে হাসলো ইলহান, বলল,
“তুমি খুব কিউট করে কথা বলো। তোমার এসব কথা শুনে আমার রেগে যাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু আমি রাগছিনা, আমার মজা লাগছে ভীষণ, মনে চাচ্ছে তোমাকে ধরে একবার কোলে তুলে নিই।”
“আপনি কি সামনে থেকে সরবেন?”
“হুম, অবশ্যই।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বলে দরজা আগলে দাঁড়িয়ে থাকা ইলহান শরীর বেকিয়ে দরজার এক পার্শ্বে চলে এলো।
আনাবিয়া বড় বড় পা ফেলে ঢুকলো কামরার ভেতর। ইলহানের সমস্ত আসবাবপত্রে ঘেঁটে ও খুজতে লেগে গেলো মীরের গাড়ির চাবি। ইলহান দাঁড়িয়ে রইলো দরজায়, আটকালোনা আনাবিয়াকে, দেখতে লাগলো ওর কান্ডকারখানা।
আনবিয়া ভেতরে গিয়ে উলটে পালটে ফেলতে লাগলো ইলহানের সমস্ত আসবাবপত্র, কিছুক্ষণ খোঁজ করার পরেই পেয়ে গেলো মীরের গাড়ির চাবিটা৷ সেটা হাতে নিয়ে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখলো কিছুক্ষণ। সাদা রঙা অর্কিডের আদলে তৈরি এই চাবির রিংটা আনাবিয়া ওদের বিয়ের কবছর পর অ্যানিভার্সারি তে তৈরি করে দিয়েছিলো মীরকে। সেই কবেই দিয়েছিলো, কিন্তু সেদিনের পর থেকে মীর এটাকে কখনোই হাতছাড়া করেনি, নিজের সঙ্গে নিজের শখের গাড়িটার সঙ্গে সর্বক্ষণের জন্য রেখে দিয়েছিলো। আজও সেটা অক্ষত আছে, তার সৌন্দর্য এতটুকু কমেনি পর্যন্ত।
চাবির রিংটা হাতে নিয়ে ও বেরিয়ে এলো কামরার বাইরে। এগোলো প্রাসাদ ছেড়ে যাওয়ার জন্য। ইলহানও জোর কদমে এগোলো ওর পেছন পেছন। আনাবিয়ার সাথে তাল মিলিয়ে হাটতে হাটতে বলে উঠলো,

“শুনো আনাবিয়া, যা হওয়ার তা হয়েই গেছে। আমার দু মিনিটের ছোট ভাই মরেছে আজ প্রায় চার বছর হতে চলল, তুম জেনেছো আজ প্রায় বছর খানেক। এত দিনেও কি তোমার শোক কমলোনা? শোক পুষে রেখে লাভ কি বলো?
তার চাইতে ভালো হয় তুমি এখানে চলে এসো, তোমার কামরা, তোমার সবকিছু এখনো তোমারই আছে। দেমিয়ান শেহজাদী হয়ে জঙ্গলের ওসমস্ত জংলী দের সাথে থাকা তোমার মানায় না আনাবিয়া।”
“আমার জন্য আপনাকে ভাবতে হবেনা শেহজাদা জাজিব ইলহান, নিজের চরকায় তেল দিন। একটু বেশি করে দিবেন। আপনার চরকা নাকি আজকাল জ্যাম দিচ্ছে, জ্যাম ছেড়ে দিবে।”
হেটে চলে যেতে যেতে নির্বিকার গলায় বলল আনাবিয়া, আর তারপর বেরিয়ে গেলো প্রাসাদের রয়্যাল ফ্লোর থেকে। ইলহান ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলো ওর যাওয়ার পানে৷

রাতের আঁধারে এক রহস্যময় ঘোমটা টেনে নিয়ে নিশ্চুপে ঘুমিয়ে আছে রেড জোনে, আকাশজুড়ে জ্বলজ্বল করছে অগণিত তারা, রেড উড ট্রির উঁচু উঁচু চূড়াগুলো হাত বাড়িয়ে ছুতে চাইছে যেন রাতের আকাশ। নিঃস্তব্ধতা ভেঙে মাঝে মাঝেই ভেসে আসছে গাছের শুকনো পাতা ঝরার নরম শব্দ।
ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা ঝাঝালো সুর, দূরে কোথাও কোন অজানা প্রাণীর ক্ষীণ ডাক, কিয়ৎক্ষণ বাদে বাদে হুতোম প্যাঁচার হুম হুম শব্দ সব মিলিয়ে এক গা ছমছমে নীরবতা।
মসভেইল প্যালেসের শক্ত কাঠের দেয়ালের ওপর পড়ছে চাঁদের মৃদু আভা। মহলের বিরাট বারান্দার খোলা চত্বরের সিলিং জুড়ে ঝুলে থাকা কাঠের তৈরি লণ্ঠনগুলো বাতাসের দোলায় ঠুন ঠুন শব্দ করে কাঁপছে।
বাচ্চারা কজন কামরাতে ঘুমোচ্ছে, বাকিরা দল বেধে ঘুর ঘুর করে চলেছে রেড জোনের ভেতর। ঝলমলে চাঁদের রাতে তারা জোছনা বিলাসে ব্যাস্ত।

নিজের কামরায় বিছানার ওপর বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে দিয়ে বসে আছে আনাবিয়া। হাতে ওর একটা কালো মলাটের মোটা ডায়েরি, মীরের ডায়েরি।
এতদিন এটা ওর কাছে থাকলেও খোলেনি, কোনো এক অজানা আতঙ্কে ডায়েরিটা খুলতে পারেনি ও, মনে হতো খুললেই হয়তো শেষ হয়ে যাবে, পুরোনো হয়ে যাবে! অজানা গুলো জানা হয়ে যাবে, তখন আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।
অজানা কথা গুলো অজানা থাকা পর্যন্তই যে আলোড়ন সৃষ্টি করে হৃদয়ে, জানা মাত্রই হারিয়ে যায় রহস্যের সমস্ত মাধুর্য।

আজও হয়তো মেলতো না ডায়েরি খানা, কিন্তু মীরকে আজ অসম্ভবরকম মনে পড়ছে ওর। প্রাসাদ থেকে ফেরার সময় মীরের কবরের নিকট কাটিয়ে এসেছে বেশ কিছু সময়, তবুও মনটা শান্ত হতে চায়না! তাই আজ এসেই ডায়েরিটা মেলে দেখার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে ও৷
চোখ বন্ধ করে বুক ভরে দম নিয়ে শ্বাস ছাড়লো আনাবিয়া, অতঃপর চোখ মেলে কাঁপা হাতে ওলটালো ডায়েরিরি প্রথম পাতা।
পাতা উলটাতেই ওর চোখে পড়লো নিজের একেবারেই ছোট্ট বেলার একটা ফটোগ্রাফ! বেবি পিংকের একটা ছোট ফ্রক জড়ানো ওর গায়ে, শুয়ে আছে বিছানায়। ছোট্ট গোলগাল মুখের গাল দুটো ভীষণ ফোলা, ধবধবে হাতপা গুলো এক্কেবারে টসটস করছে!

হীরক খণ্ডের ন্যায় ঝলমলে চোখ জোড়াতে ভিষণ উচ্ছাস! হয়তো ক্যামেরার পেছনের থাকা ব্যাক্তিটার কারণেই উচ্ছাসে ভরপুর ওর ছোট্ট মুখখানি!
হাসলো আনাবিয়া। নিজেকে দেখে নিজেই গলে গেলো যেন! ও কি সত্যিই এমন আদুরে ছিলো? ওর তো নিজেরই নিজেকে কোলে নিতে ইচ্ছে করছে! বয়স কত হবে তখন ওর? চার পাঁচ মাস? সেরকমই তো মনে হচ্ছে দেখে!
পরক্ষণেই ওর চোখ গেলো এক কোণে লেখা একটি ছোট্ট কথাতে, ‘প্রাণ আমার, আমার শিনজো…’
মীরের হ্যান্ডরাইটিং, ওর হাতের লম্বাটে কাটা কাটা অক্ষরে লেখা!
মীরের শিনজো ডাকটা সেই মুহুর্তেই যেন ভেসে এলো আনাবিয়ার কানে, সম্পুর্ন জীবন্ত, সেই প্রচন্ড অথরিটেটিভ পুরুষালি গভীর স্বর!
কেঁপে উঠলো আনাবিয়া, স্মৃতি আলোড়িত হওয়ায় নাকি বাহিরের ঠান্ডা বাতাসের ছোয়ায় সেটা নিয়ে দ্বিধান্বিত রইলো ওর শরীর।

দম নিলো আনাবিয়া, কালো মলাটের ডায়েরির একের পর এক পাতা উলটে গেলো শুধু, প্রতিটি পাতায় ওরই নাম, ওরই হাসি, ওরই চোখ, ওরই মুখের এক একটি পূঙ্খানুপুঙ্খ অভিব্যক্তি— যেন ওর মীর বাধিয়ে রাখতে চেয়েছিলো ওর সমস্ত অনুভূতিকে, চিনতে চেয়েছিলো প্রতিটি মুহূর্তে।
প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি ছকে ছকে লেখার মধ্যে যে তার বুক ভরা ভালোবাসা মেশানো সেটা লেখা দৃষ্টি ফেলা মাত্রই বুঝলো আনাবিয়া!
চোখ ভরে এলো এর, পৃষ্ঠা উল্টালো আবারও। অনেক অনেক পূর্বের ফটোগ্রাফ গুলো একের পর এক সাজানো প্রতিটা পাতায়।

ওদের সেই হাস্যোজ্জ্বল মুহূর্তগুলো, ওদের বিয়ে, ওদের প্রতিদিনের ঘুরতে যাওয়া, রোজ দুপুরে মীরের কোলে বসে খাবার খাওয়া, সময় পেলেই কফির মগ হাতে বেলকনিতে বসে বসে ভীষণ গল্প, রাতেরবেলার অনাকাঙ্ক্ষিত, অপরিকল্পিত ভ্রমণ, উথাল পাথাল আদর; সবকিছু, সমস্ত কিছু যেন এই এক ডায়েরিতে বন্দি করে রেখেছে মীর!
সম্পুর্ন ডায়েরি জুড়ে একের পর এক কালিতে লেখা ওর প্রতি মীরের প্রতিটা অনুভূতি, ওর সকল চাওয়া-পাওয়া, সমস্ত ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ, সমস্ত মান অভিমান, সবকিছু সবকিছু…….
দ্রুত গতিতে পৃষ্ঠা উল্টিয়ে চলল আনাবিয়া, বুকের ভেতরে দামামা বেজে চলেছে ভীষণ রকম! দেখতে চাইছেনা ও এসব, একদম দেখতে চাইছেনা, তবুও ডায়েরির যেখানেই চোখ যাচ্ছে সেখানেই জ্বলজ্বল করছে একটিই নাম, “শিনজো, শিনজো, শিনজো…!”

প্রতিটি পাতায় আনাবিয়া যেন হারিয়ে ফেলতে লাগলো নিজেকে, হারিয়ে যেতে লাগলো প্রতিটি মুহূর্তের মাঝে। ওর মীর ওকে একা হতে দেয়নি কখনো, কখনোই না! নিজের হস্তলিখিত প্রতিটি শব্দে শুধু ওকেই আবদ্ধ করে গেছে— বারবার, তারই কাছে, তারই পাশে!
ডায়েরির দুই তৃতীয়াংশে আসা মাত্রই শেষ হয়ে গেলো লেখা, আর নেই, আর নেই! আর লেখেনি এতে কেউ……..
সেখানের তারিখ দেখলো আনাবিয়া, ফেব্রুয়ারী টেন, টুয়েন্টি-টুয়েন্টি ট্যু। ও লাইফট্রির ভেতর ঢুকে যাওয়ার ঠিক দুদিন আগে!

পৃষ্ঠাটিতে চোখ বুলালো আনাবিয়া, এখানে শুধুই এক টুকরো লেখা। অন্য পৃষ্ঠা গুলোর হস্তাক্ষরের ন্যায় সুন্দর, গোছালো নয়; আঁকাবাঁকা, ভীষণ উদ্ভ্রান্ত লেখা!
মীর কি তবে সত্যিই উদভ্রান্ত হয়েছিলো? সত্যিই কি ওকে হারিয়ে বুক কেঁপেছিলো মীরের?
এলোমেলো হস্তাক্ষরের ওপর হাত বুলিয়ে আনলো আনাবিয়া, অবাধ্য চোখজোড়া পড়ে নিতে লাগলো মীরের সর্বশেষ লেখাটা….

“শিনজো, আমার প্রাণ, আমার ভালোবাসা…….
তোমার দুর্দমনীয় ক্রোধের গভীরে সর্বদাই ছিল এক অমীমাংসিত শূণ্যতা, সে শূণ্যতার গহীন অন্ধকারে হারিয়ে গিয়েছিল আমার প্রতিটি শব্দ! তোমার নীরবতা ছিল ভালোবাসার অমোচনীয় চিহ্ন, তোমার অভিমান ছিল অন্ধকারের মাঝে ছড়িয়ে পড়া এক রূপকথার অনন্ত আলোচ্ছটা— কিন্তু আমার অন্ধ চোখে বাধেনি তা!
তোমায় যতটা জানতে চেয়েছি তার চেয়ে বেশি আমি তোমায় চেয়েছি, সীমাহীন চেয়েছি।
হাজার অভিমান সত্ত্বেও, তোমার কাছে আমি ছিলাম তোমার পৃথিবী, কিন্তু বড় নিষ্ঠুর ছিলাম আমি!
তুমি যে ছিলে আমার সব, আমার সমস্তু কিছু… তুমি যে ছিলে আমার অস্তিত্বের একমাত্র সঙ্গী, আমার শিনজো, আমার প্রাণ!
আমার প্রতিটি নিকৃষ্ট কর্মে তোমার চোখের জল হাহাকার হয়ে উঠতো, আমার ভুলে তোমার চোখে অশ্রু ঝরতো, তোমার কষ্ট ছিল আমাদের এই অসঙ্গায়িত গল্পের এক অপ্রকাশিত অধ্যায়, তোমার অভিমান ছিল এক দীর্ঘ বেদনাময় চুপ……

তবুও তোমার কন্ঠে ছিল সেই স্নেহের ধ্বনি
যে ধ্বনিতে আমি এই পৃথিবীর সমস্ত কিছু পেছনে ফেলে হারিয়ে যেতাম কেবল তোমার মাঝে।
তোমার অভিমানে গুম হওয়া রাতগুলো আমার নিকট ছিলো একেকটি বিভীষিকা, ভয়ানক রাত, শেষই হতে চাইতোনা, দিনের আলো যেন ফুটতেই চাইতোনা!
আমি ভালোবাসি তোমাকে শিনজো, ওই সমস্ত তুমিটাকে আমি ভালোবাসি, অনেক অনেক ভালোবাসি, ভীষণ রকম ভালোবাসি…

কিন্তু তোমার প্রতি আমার এ অনন্ত ভালোবাসা তুমি জানোনি! তুমি জানোনি, তোমার রাগের ভেতরও ছিল আমার হৃদয়ের আকুলতা, তোমার অভিমানের আড়ালে লুকানো ছিল আমার অশেষ ভালোবাসা,
যতবার তুমি দূরে চলে গেছো, ততবারই আমি আরও গভীরভাবে অনুভব করেছি তোমায়।
এখন, এই শেষ মুহুর্তে শুধু এতটুকুই বলতে পারি,
তোমার অভিমান নিয়ে আমি শেষ হতে চাইনা শিনজো, আমি তোমার ভালোবাসায় বেঁচে থাকতে চাই, সারাজীবন… ফিরে এসো শিনজো, আর একটিবার এসে শ্রাবণের ঝুম বৃষ্টির মতো আছড়ে পড়ো আমার বুকে… আমি ভিজতে চাই তোমার ভালোবাসায়, প্রচন্ডরকম ভিজতে চাই… বাঁচতে চাই আমি……”
ডায়েরিটি ধাম করে বন্ধ করে ফেললো আনাবিয়া, হাঁসফাঁস লাগছে ওর ভীষণ, দম আটকে আসতে চাইছে!
আজ এই মুহুর্তে, এত্ত গুলো দিন পর ও হঠাৎই অনুভব করলো ওর মীরি আর নেই, চলে গেছে সে, আর ফিরবে না, কখনোই ফিরবে না, কোনোদিনই ফিরবে না…..

মুহুর্তেই ওর বুকের ভেতর তৈরি হলো এক তীব্র শূন্যতা! প্রচন্ড যন্ত্রণা, একাকিত্ব আর হতাশা হুড়মুড়িয়ে এসে যেন আষ্ঠেপৃষ্ঠে মুড়িয়ে নিলো ওকে। শেষ হয়ে গেছে ও, একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছে!
অবিলম্বে চোখে জমে উঠলো অশ্রু, বুক ভেতর ভূমিকম্পের ন্যায় কেঁপে উঠলো সাথে সাথে! সমস্ত বক্ষ জুড়ে জন্ম নিল এক ভীষণ বেদনা। নিঃশব্দ হাহাকারে কালো মলাটের মোটা ডায়েরিটি শক্ত করে দুহাতে বুকে জড়িয়ে নিলো ও ধরলো, যেন এই ডায়েরিতে লেগে থাকা মীরের সমস্ত স্পর্শ গুলোকে ও নিজের ভেতরে নিয়ে নিতে চাইলো!
রেড জোনে শুরু হলো ফিসফিসে বৃষ্টি, এরপর ক্রমে ক্রমে সেটা রূপ নিলো ঝুম বৃষ্টিতে!
ডুকরে কেঁদে উঠে ডায়েরিটা বুকের মাঝে চেপে বিছানায় আছড়ে পড়লো আনাবিয়া। আর ঠিক সেই মুহুর্তেই ওর মস্তিষ্ক ওকে প্রথমবারের মতোন জানান দিলো আর কখনো ওর মীর ওকে সেই প্রেমমাখা কণ্ঠে ডাকবে না…..
আর কখনো আঁকড়ে ধরবে না ওকে, জড়িয়ে নিবে না নিজের সাথে, আর কখনো দেখতে পাবেনা ওই কালো রঙা ঠোঁটের ওপর খেলে চলা মিষ্টি, তৃপ্ত হাসি!

আর কখনোই ও ধরতে পারবে না মীরের ইস্পাত-দৃঢ় হাতখানা, ওই হাতও আর কখনো স্পর্শ করবে না ওর সফেদ চুল, আর কখনো জড়িয়ে নিবেনা ওর কোমর, বারে বারে বর্গির মতো করে এসে ওকে ছিনিয়ে নিয়ে নিজের বুকের ভাজে পুরবে না আর! ফিরবেনা আর সে…… ফিরবেনা!
ক্রমে ক্রমে এই ভয়ঙ্কর সত্যটা আনাবিয়ার ভেতরে জোয়ারের স্রোতের মতো ঢুকে চলল, খসিয়ে দিলো ওর শরীরের সমস্ত শক্তি!

আনাবিয়া আর ধরে রাখতে পারলো না নিজেকে। এক হাহাকার, এক অসম্ভব দুঃখের চাপা গোঙানির আওয়াজ বেরিয়ে এলো ওর গলা চিরে!
হয়তো প্রাণপণে চিৎকার করতে চেয়েছিল, কিন্তু শব্দটা এগোলোনা, একদম এগোলোনা! ওর মন মস্তিষ্ক শুধু এটুকুই বারে বারে জানান দিতে রইলো, এখন ওর পৃথিবী নিঃসঙ্গ, শূন্য। এই পৃথিবীতে ওর মীরি নেই, ওর কেউ নেই! ও একা, একেবারেই একা!
এই প্রচন্ড নিঃসঙ্গতার গগনচুম্বী যন্ত্রণার তোপে ওর বুক ফেটে বেরিয়ে এলো এক চাপা আর্তনাদ,
“কেন চলে গেলে তুমি? আমার সমস্ত পৃথিবী সঙ্গে নিয়ে তুমি কেন চলে গেলে? আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি তুমি কি জানতে না? তবে কেন…কেন গেলে…..?”

রেড জোনের বৃষ্টি থেমে গেছে বেশ অনেক খানি আগেই। বৃষ্টির শীতল ছোঁয়া এখনও ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। গাছের পাতাগুলো থেকে কিয়ৎক্ষণ পর পর টুপ টুপ করে ঝরে পড়ছে বৃষ্টির জমে থাকা ফোটা।
আকাশে এখনো জমাট বেঁধে আছে কিছু কালো মেঘ, লুকিয়ে রেখেছে চাঁদের আলো। তবুও চাঁদের ম্লান আভা সঞ্চারিত হচ্ছে কালো মেঘের ফাঁকফোকড় দিয়ে।
আনাবিয়া ডায়েরিটা বুকে চেপে বিছানায় পড়ে ছিলো ওভাবেই৷ চোখের কোণে ওর পানির রেশ এখনো বিদ্যমান! চাপা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নড়েচড়ে উঠলো ও, সাইড টেবিলের ওপর থাকা নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে সময় দেখলো, বারোটা বেজে পয়তাল্লিশ।

ডায়েরিটা বুক থেকে নামিয়ে উঠে পড়লো। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে বিছানা ছেড়ে উঠে গেলো কামরার ডান দিকের দেয়ালে থাকা ওয়াল আলমিরার নিকট। ডায়েরিটা সযত্নে রেখে দিলো সেখানে৷
পাশের ওয়ারড্রব থেকে নিজের পোশাক ও গোসলের কিছু সরঞ্জাম হাতে নিয়ে দরজা খুলে বের হয়ে এলো কামরা থেকে।
বের হতেই আনাবিয়ার চোখে পড়লো লিন্ডাকে, ঘুম ঘুম চোখে সে বারান্দা চত্বর দিয়ে হেটে কামরায় যাচ্ছে। এই অসময়ে আনাবিয়াকে জামা কাপড় হাতে নিয়ে বাইরে যেতে দেখে ঘুম পালালো ওর, চোখ বড় বড় করে শুধালো,

“আপনি কোথায় যাচ্ছেন শেহজাদী?”
“গোসল দিতে যাচ্ছি।”
“এত রাতে? শরীর ঠিক আছে আপনার? আর গোসল দিতে কোথায় যাচ্ছেন? গিজার চালিয়ে দিই? আপনি ভেতরেই শাওয়ার নিন!”
“প্রয়োজন নেই লিন্ডা, আমি ক্রিস্টাল পুলে যাচ্ছি। অস্থির লাগছে সামান্য, ঠান্ডা পানিতে গোসল দিলে ঠিক হয়ে যাবে হয়তো।”
লিন্ডা হঠাৎ করেই খুব খুশি হয়ে গেলো, লাফিয়ে কোমর দুলিয়ে এগিয়ে এসে নেচে উঠে বলল,
“তাহলে আমিও যাবো!”
“ঘুম লাগেনি তোর?”
“লেগেছিলো, এখন আর নেই৷”

দাঁতের পাটি সবগুলো মেলে হেসে বলল লিন্ডা৷ আনাবিয়া মৃদু হেসে ওর সোনালি চুলগুলো এক হাতে এলোমেলো করে দিয়ে সিড়ি বেয়ে নেমে এলো বারান্দাচত্বর থেকে। লিন্ডা চত্বরের এক কোণে রাখা লিওর ওভারসাইজ টি শার্টটা হাতিয়ে নিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে এগোলো ওর পেছন পেছন।
ফাতমা আর শার্লট তখনি কামরা থেকে বাইরে আসছিলো লিন্ডা কোথায় হারিয়ে গেছে দেখতে, বাইরে এসেই আনাবিয়াকে পোশাক হাতে কোথাও যেতে দেখে, সাথে লিন্ডাকে নেচে নেচে এগোতে দেখে ওরা দুজন কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“শেহজাদী, এত রাতে কোথায় যাচ্ছেন আপনি?”
“গোসলে, আমরা গোসলে যাচ্ছি। লেট নাইট গোসল, ক্রিস্টাল পুলে!”
আনাবিয়ার পেছন থেকে উচ্ছসিত কন্ঠে বলে উঠলো লিন্ডা। লিন্ডার বাচ্চামো দেখে মৃদু হাসলো আনাবিয়া। ফাতমা আর শার্লট একে অপরের দিকে একবার তাকিয়ে চাপা উত্তেজনার স্বরে বলে উঠলো,
“আমরাও যাবো!”

তারপর আনাবিয়ার অনুমতির অপেক্ষা না করে দুজনেই হুটোপুটি করে ছুটলো নিজেদের কামরায়, কিয়ৎক্ষণ বাদেই আবার হুটোপুটি করে বাইরে এলো দুজন। কাঁধের ওপর ওদের নিজেদের পোশাক। মুখের ওপর উচ্ছাস ফুটিয়ে দুজনে লাফালাফি করতে করতে এসে বারান্দা থেকে নেমে এসে দাড়ালো আনাবিয়ার পাশে, লিন্ডা পেছন থেকে উচ্চস্বরে বলে উঠলো,
“চলোওওওওও, মিশন গোসলে……!”
ওর বলার ভঙ্গি দেখে শব্দ করে হেসে উঠলো শার্লট আর ফাতমা৷ এদিকে বাইরে লিন্ডার চিৎকার শুনে তৎক্ষনাৎ দরজা খুলে হুড়মুড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো লিও, বেরিয়েই এদের চারজনকে এভাবে কাধের ওপর পোশাক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তব্দা খেয়ে তাকিয়ে রইলো ও। পরক্ষণেই নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে আনাবিয়ার দিকে চেয়ে শুধালো,

“শেহজাদী, আপনারা এত রাতে এভাবে কোথায় যাচ্ছেন?”
“মিশন গোসলে…!”
আগের মতো করেই চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো লিন্ডা। আনাবিয়া গা কাঁপিয়ে হেসে উঠলো এবার।
লিও সঙ্গে সঙ্গে চোখ গরম দিলো লিন্ডাকে, বুঝিয়ে দিলো শেহজাদীর সামনে এধরণের আচরণ না করতে। লিন্ডা চুপসে গেলো সাথে সাথেই, মুহুর্তেই ফুলে উঠলো ওর নিচের ঠোঁট। লিওর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলো সাথে সাথে৷

লিও হতাশার সাথে কপাল চাপড়ালো, এই মেয়েকে নিয়ে ও কোথায় যাবে? আগে শেহজাদীকে যেমন করতে দেখতো হিজ ম্যাজেস্টির সাথে এখন লিন্ডাও ওর সাথে সেইম কাহিনী করছে।
এই মেয়ে জাতটাই এমন, ইমোশনাল ব্লাকমেইল করে সারাজীবন টাইট দিয়ে রাখবে, কিছু বললেই ঠোঁট ফুলোবে! আর এখন তো কিছু বলাও লাগলোনা, এমনিতেই ঠোঁট ফুলে গেলো!
“না খেয়ে দেয়ে কোথায় টো টো করছিলি তোরা? কিচেনে বিরিয়ানি রাখা আছে, আমরা গোসল দিয়ে আসতে আসতে খেয়ে নিবি।”
বলল আনাবিয়া, লিও মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে বলল,
“জ্বি শেহজাদী।”
এমন সময় হলরুমের ভেতর থেকে দুমদাম পা ফেলে বেরিয়ে এলো কোকো, উদভ্রান্তের ন্যায় আনাবিয়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“আপনারা কোথায় যাচ্ছেন আম্মা?”
“ক্রিস্টাল পুলে, গোসল দিয়েই ফিরে আসবো। তোরা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়িস।
উত্তর করলো আনাবিয়া, কোকো তড়িতে মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানিয়ে বলে উঠলো,
“আপনারা চারটা মেয়ে একা যাবেন কেন? আমরা কেউ যাই সাথে?”
আনাবিয়া হাসলো, তার বড় ছেলে হয়তো ভুলে গেছে যে সে শিরো মিদোরির শেহজাদী, এই রেড জোনের ভেতরের কোনো প্রাণী কখনো ওর কোনো ক্ষতি করতে আসবে না! তবুও কোকোর মন রক্ষার্থে আনাবিয়া বলে উঠলো,
“ঠিক আছে, আয়।”
কোকো হাসি মুখ করে বারান্দা থেকে লাফিয়ে নামলো নিচে, লিওকেও টেনে নিয়ে এলো। কিন্তু ওরা আসতে না আসতেই কামরা থেকে একে একে বেরিয়ে এলো সকলেই,
তাদেরকে না নিয়ে তাদের শেহজাদী বাকিদের নিয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা ওদের কাছে খুবই দুঃখজনক।
সবার পেছন দাঁড়িয়ে থাকা ফ্যালকন ফাঁকফোকর দিয়ে ঠেলাঠেলি করতে করতে সামনে এগিয়ে এসে বেজার মুখে বলল,

“শেহজাদী, আপনি ওদের নিয়ে যাচ্ছেন, আমরা কি দোষ করেছি? আপনি আজকাল লিও আর কোকোকে চোখে হারান, আমাদের দেখতেই পান না! আর আমাকে তো একদমই না, এসব হাতি দের ভেতরে আমাকে চোখে পড়বে কিভাবে?”
আনাবিয়া কিছুক্ষণ হতাশ চোখে তাকিয়ে রইলো ফ্যালকনের দিকে, তারপর ঠোঁট গোল করে একটা শ্বাস ছেড়ে বলে উঠলো,

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১০

“আচ্ছা, আয় সবাই আয়। আশেপাশে কেউ জেগে থাকলে তাকেও ধরে নিয়ে আয়!”
আনাবিয়ার শেষোক্ত কথাটার দিকে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দিলোনা কেউ, এই সামান্য ডোবায় গোসল করতে যাওয়ার আনন্দে ফেটে পড়লো ওরা, একে অপরকে ঝাকাঝাকি করতে করতে ওরা আনাবিয়ার পেছন পেছন এগোলো লাইফট্রির পাশে থাকা ডোবার দিকে।

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here