বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১২
রানী আমিনা
গভীর নিশুতি রাত। ঘুমিয়ে পড়েছে রেড জোনের সমস্ত অংশ। নিভৃত জঙ্গলের বুকের একাংশে তখনো জেগে আছে এক গুচ্ছ উচ্ছ্বসিত প্রাণ!
লাইফ ট্রির পাশে থাকা ক্রিস্টাল পুল নামক ডোবাটার ওপর রাতের আকাশের তারার প্রতিচ্ছবি জ্বলজ্বল করছে। চাঁদের রুপালি আলো ছড়িয়ে পড়েছে স্বচ্ছ পানির ওপর, তার প্রতিফলনে সমস্ত ডোবাটা বাটিতে রাখা তরল রুপোর মতো দেখাচ্ছে।
পানির ভেতর খিলখিলে হাসি হেসে হুটোপুটি করছে শার্লট লিন্ডা আর ফাতমা। ওদের হাসির শব্দ বাতাসে মিশে গিয়ে ভেঙে দিচ্ছে জঙ্গলের নিগূঢ় নীরবতা।
আঁজলা করে পানি নিয়ে একে অপরের গায়ে ছুড়ে দিয়ে দুষ্টুমি করছে ওরা তিনজনে।
ছেলেগুলো এদিকে নেই, ওরা জঙ্গলের গভীরে গিয়ে হুটোপুটি করছে, এখান থেকেই কানে আসছে ওদের চিল্লাপাল্লার তীক্ষ্ণ আওয়াজ।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সবগুলো এখন নিজেদের অ্যানিম্যাল ফর্মে গিয়ে জঙ্গলের সব ঘুমিয়ে পড়া নিরীহ প্রাণিগুলোকে ভয় দেখিয়ে বেড়াবে। লিও বা কাঞ্জির একটা গর্জনই যথেষ্ট শান্তশিষ্ট প্রাণীগুলোর হার্ট অ্যাটাক দিতে!
বেচারা ব্রায়ান ওদের সাথে এসেই ফেসেছে, জঙ্গলের ভেতর ওকেও টেনে নিয়ে গেছে ওরা।
আনাবিয়া ডোবার কানায় কানায় থাকা পানির এক কোণে গিয়ে ডোবার কিনারায় পিঠ ঠেকিয়ে ভেসে আছে, মাটির ওপর উঠিয়ে দিয়েছে নিজের দুহাতের কনুই, গাছের পাতার ফাঁক গলে চাঁদের আলো পড়ছে ওর রুপোলি জলে সিক্ত চেহারার ওপর, হীরের ন্যায় ঝকমক করছে ও সেখানে।
মন ওর পড়ে আছে মীরের নিকট। এই জঙ্গল, এই ডোবাতে জড়িয়ে আছে ওর আর মীরের কতশত স্মৃতি!
কত রাতেই উথাল পাথাল আদরের পর মীর ওকে কোলে নিয়ে গোসল দিতে এসেছে এখানে। ঘন্টার পর ঘন্টা পানির ভেতর দুজনে মিলে লাফালাফি ঝাপাঝাপি করে, লাল হয়ে যাওয়া চোখ নিয়ে ক্লান্ত হয়ে একসময় আবার ফিরে গেছে প্রাসাদে!
কতদিনে মীর এখানে এসেই আবার ওকে ভাসিয়েছে আদরে, কতদিন গোসলের ভেতরেই আবার টেনে নিয়েছে নিজের বুকের পরে!
স্মৃতিরোমন্থন করে আলতো হাসলো আনাবিয়া, ওর শুভ্র চোয়ালে খেলে গেলো রক্তিম আভা।
ডোবার ভেতর হুটোপুটি করতে থাকা শার্লটের চোখে হঠাৎ পড়লো আনাবিয়ার চেহারাটা, কিছুক্ষণ মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থেকে ও কনুই দিয়ে ওর পাশে কিটকিট করতে থাকা ফাতমাকে গুতা দিয়ে বলল,
“দেখ দেখ, অ্যানা ব্লাশ করে!”
“কতবার বলবো তোকে, অ্যানা নয় শেহজাদী বলবি।”
চাপা ধমকে কথাটা বলে ফাতমা নিজেও তাকালো আনাবিয়ার দিকে, আনাবিয়ার শ্বেতশুভ্র গালদুটোতে লাজরাঙা লালিমায় মাখামাখি হয়ে আছে। ওর এমন মায়া মাখা লাবণ্যে ঘায়েল হয়ে ফাতমা মুখ দিয়ে চাপা উল্লাসের শব্দ করে, চোখ কুচকে দুহাতে মুখ ঢাকলো নিজের।
লিন্ডা এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো, এক ডুব দিয়ে পানির তল দিয়ে ঘুরে এসে ফাতমা আর শার্লটের ঠিক মাঝামাঝি স্থান থেকে ভুস করে মাথা তুললো ও।
আনাবিয়াকে দেখতে ব্যাস্ত থাকা শার্লট আর ফাতমা হঠাৎ নিজেদের মাঝখানে কারো মাথা দেখে ভয়ে চাপা চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে উঠলো। ওদের দুজনকে ভয় পেতে দেখে লিন্ডা হায়েনার মতো নাঁকি শব্দ করে হাসলো। তারপর আনাবিয়ার দিকে তাকিয়ে চাপা সুরে বলে উঠলো
“এমনি এমনি কি আর হিজ ম্যাজেস্টি ঘায়েল হয়েছিলেন! শুধু একবার ভাবো, এই মেয়েটার চোয়ালে হিজ ম্যাজেস্টি একটা শক্ত করে চুমু খেলেন, সাথে সাথে সে স্থান লালে লাল হয়ে গেলো! তাহলে হিজ ম্যাজেস্টির নেক্সট স্টেপ কি হবে……!
ফাতমা লিন্ডার কথা শুনে ওর দিকে কটমট করে চেয়ে ওর সোনালি চুলের গোছায় ছোট করে একটা টান দিয়ে বলল,
“তুই তো ভারী অসভ্য! এইটুকুনই মেয়ের মুখে কিসব কথা!”
শেষোক্ত বাক্যটা শার্লটের দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাসের গলায় বলল ফাতমা। শার্লট ঠোঁট টিপে হাসলো। ফাতমার কথার প্রতিউত্তরে লিন্ডা বলে উঠলো,
“কথার তো কিছুই শোনোনি মিস ফাতমা বেইবি, আমার উনির সাথে আমি যে প্রেমালাম করি সেটা শুনলে তো তুমি অজ্ঞান হয়ে যাবে!”
বলে আবারও হায়েনা স্টাইলে হাসলো লিন্ডা।
“ছিঃ ছিঃ এই অ্যানিম্যাল টাউনের ছেলে মেয়ে গুলা আসলেই অ্যানিম্যালেরই মতো, কোনো লজ্জা শরম নাই! আর তোর যে হাসি, তাতে আমাদের আলট্রা হ্যান্ডসাম লিও যে এখনো তোর সাথে রিলেশনশিপ রেখেছে তাতেই তোর তিনবেলা শুকরিয়া আদায় করা উচিত!”
“শুকরিয়া, শুকরিয়া।”
বলে ঠোঁট টিপে হেসে ফাতমার দিকে তাকিয়ে দুবার ভ্রু নাচালো লিন্ডা। ওর নীল চোখে খেলে গেলো দুষ্টুমির ঝলক। ফাতমা হতাশ হয়ে চোখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকালো।
এমন সময় আনাবিয়া সাঁতরে এগিয়ে এলো ওদের দিকে, বলল,
“একটা ম্যাজিক দেখবি?”
বলা মাত্রই তিনজনে সবেগে ওপর নিচে মাথা নাড়ালো। আনাবিয়া ফিক করে হাসলো ওদের মাথা নাড়ানো দেখে, আর তারপর এক ডুব দিয়ে সাঁতরে সোজা চলে গেলো ক্রিস্টাল পুলের গভীরে৷
কোমল পা জোড়ায় ঢেউ তুলে একেবারেই তলে পৌছে ডোবার তলের কর্দমাক্ত মাটিটা ছুয়ে দিতেই আনাবিয়ার স্পর্শের স্থান থেকে সমস্ত মাটি সোনা রঙা আলোয় আলোকিত হতে হতে একসময় ছড়িয়ে পড়লো সমস্ত ডোবা জুড়ে, চাঁদের আলোয় রুপোলী রঙ ধারণ করা ডোবার পানিটা এবার রঙ নিলো সোনা গলানো পানিতে। লিন্ডা হই হই করে উঠলো। ঝাপিয়ে পড়ে পানির ভেতর হাত মেলে দিয়ে দুহাতে জড়িয়ে নিতে চাইলো যেন!
আনাবিয়া পানিপৃষ্ঠের ওপর উঠে এলো এমন সময়, তারপর ওদের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো। শার্লট আর ফাতমার মুখে কোনো কথা নেই, দুজনে একবার পানির দিকে আর একবার আনাবিয়ার দিকে তাকাতে ব্যাস্ত।
আনাবিয়া এসময় মিষ্টি হেসে আবার বলল,
“আর একটা ম্যাজিক দেখবি?”
লিন্ডা পানি দিয়ে খেলতে ব্যাস্ত ছিলো, আনাবিয়ার কথা শোনা মাত্রই তিড়িং করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মাথা ঝাকালো সবেগে। ওর দেখাদেখি ফাতমা শার্লটও হতভম্ব মুখ করে ওপর নিচে মাথা নাড়ালো।
আনাবিয়া আগের মতোই মিষ্টি করে হাসলো, দৃষ্টিগোচর হলো ওর ঝকঝকে দাঁত। আর তার পরমুহূর্তেই নিজের হাত দিয়ে ডোবার পানির ভেতরে এক অদ্ভুত ঘূর্ণন তৈরি করলো ও, ডোবার পানিটা একটি নির্দিষ্ট অনুরননে কম্পিত হয়ে সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম ঢেউ তুলে গিয়ে বাড়ি খেতে লাগলো কিনারায়, কিছু মুহুর্ত পরেই ডোবার তলের দিকটা থেকে সাতরে উঠে আসলো এক ঝাঁক ছোট বড় মাছ,
পানির ভেতর দিয়ে গোল গোল ঘুরে ওরা এগিয়ে এলো আনাবিয়ার দিকে, ঠোঁট দিয়ে ছুয়ে দিলো পানির ভেতরে ডুবে থাকা আনাবিয়ার শরীর। ওদের স্পর্শে খিলখিল করে হেসে উঠলো আনাবিয়া।
এমন সময়ে দূরের আড়াল থেকে শোনা গেলো কোকোর কন্ঠস্বর,
“আম্মা, আর কত গোসল দিবেন? ঠান্ডা লেগে যাবে তো! ফিরবেন না?”
“হ্যাঁ, এইতো হয়ে গেছে।”
উচ্চস্বরে বলে উঠলো আনাবিয়া, তারপর ওদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“চল উঠ, বাকি ম্যাজিক আর একদিন দেখাবো।”
বলে মিষ্টি করে হেসে ডোবা থেকে উঠে পড়লো ও, ভিজে পোশাকে ফুটে উঠলো ওর শরীরের সম্পুর্ন অবকাঠামো। পেছন থেকে লিন্ডা সেটা খেয়াল করে চাপা সুরে বলল,
“আইয়ো, স্যাক্সি লেইডেএএ”
ফাতমা মাথায় একটা চাটি মেরে সাথে সাথে বন্ধ করে দিলো ওর মুখ।
আনাবিয়া পাড়ে উঠে পিঠের ওপর থেকে চুল গুলো একহাতে সামনে নিয়ে এসে পানি ঝেড়ে নিলো। ওর পেছন পেছন বাকিরাও উঠে এলো ডোবা থেকে।
আনাবিয়া পা বাড়ালো মহলে ফেরার জন্য, ঠিক এমন সময়ে হঠাৎই ওর চোখ গেলো আকাশের দিকে।
থমকালো আনাবিয়া কিয়ৎক্ষণের জন্য। ওর দৃষ্টিগোচর হলো এক ঝাঁক সুক্ষ্ম লাল রঙা আলোর কণা, সমস্ত আকাশ জুড়ে বিচরণ করছে সেগুলো। আনাবিয়া ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো সেদিকে, বোঝার চেষ্টা করলো সেগুলো ঠিক কিসের আলো।
ওকে এভাবে থমকে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে লিন্ডাও তাকালো আকাশের দিকে। আকাশ চকচকে ফকফকে, সাদা রঙা মেঘ উড়ে চলেছে উত্তর দিকে, জ্বলজ্বলে চাঁদ; তবে শেহজাদী এত মনোযোগ দিয়ে কি দেখছেন?
আনাবিয়া এতক্ষণ দ্বিধান্বিত চোখে তাকিয়ে ছিলো আলোক রশ্মি গুলোর দিকে, কিয়ৎক্ষণ স্মৃতি হাতড়ানোর পরেই ও বুঝতে পারলো সেগুলো কিসের আলো।
বুঝতে পারা মাত্রই টান টান হয়ে এলো ওর কুঞ্চিত ভ্রু জোড়া, চোয়ালদ্বয় শক্ত হয়ে এলো মুহুর্তেই। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে শার্লট লিন্ডাদের উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো,
“তোরা মহলে ফিরে যা আমি একটু পরেই আসছি।”
আনাবিয়ার সিদ্ধান্তের এমন হঠাৎ পরিবর্তনে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো ওরা, পরক্ষণেই আনুগত্য জানিয়ে দ্রুত পায়ে এগোলো মহলের দিকে।
আনাবিয়া তাকালো আবারও আকশপানে, সুক্ষ্ম লাল রঙা আলোক রশ্মি গুলো ইতোমধ্যে উধাও হয়ে গেছে। পালিয়েছে? হবে হয়তো।
ঠোঁটের কোণ টেনে সামান্য হাসলো আনাবিয়া, একটা শ্বাস ছেড়ে নিয়ে এগোলো লাইফট্রির দিকে।
লাইফট্রির কাছে গিয়ে দাড়াতেই কিছু দূরের আড়াল থেকে ভেসে এলো কোকোর কন্ঠস্বর,
“আম্মা, আপনি মহলে ফিরবেন না?”
“ফিরবো কোকো, কাজ বাকি আছে কিছু। রেড জোনের আকাশপথ টা স্যিল করে ফিরবো।”
“কেন আম্মা, কোনো সমস্যা হয়েছে?”
“একটু আগেই আকশে এক ঝাঁক ড্রোন উড়ছিলো কোকো, ট্র্যান্সপ্যারেন্ট জেলি ড্রোন। ওগুলো যে শেহজাদা ইলহানের পাঠানো ড্রোন সে ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই। প্রাসাদ ছাড়া জেলি ড্রোনের কোনো অস্তিত্ব নেই কোথাও।”
আনাবিয়া বলা মাত্রই কোকো তাকালো আকাশের দিকে। ভ্রু কুচকে চেষ্টা করলো কিছু দেখতে পাওয়ার। কিছুই নেই। এগুলো ওদের চোখে বাধবেও না৷ তবে ও শুনেছে জেলি ড্রোনের কথা, যেগুলো শুধুমাত্র স্পাইং করার জন্য ব্যাবহৃত হয়। স্বচ্ছ জেলি ফিশের মতোন আকাশের ভেতর ভেসে ভেসে ঘুরে বেড়ায় তারা, মিশে যায় আকাশের সাথে। খালি চোখে তাদের দেখা পাওয়া এক প্রকার অসম্ভব ব্যাপার।
আনাবিয়া কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে আনমনে বলে উঠলো,
“আমার ওপর নজরদারি? ড্রোন দিয়ে পঞ্চদ্বীপের বেগমকে পাহারা দিতে চায়! কি ভয়াবহ দুঃসাহস!
আমি নিরীহ প্রাণীটির মতোন জঙ্গলে বসে আছি তাতেও তার আতঙ্ক কমছে না, আমার ওপর ড্রোন দিয়ে নজরদারি চালাচ্ছে! যাকে ভয় পায় তাকে ড্রোন দিয়ে আটকে রাখার চেষ্টা; হাস্যকর! আমি যদি কিছু করতেই চাই তবে আপনার হাজারটা ড্রোনের চোখও আমার এতটুকু নাগাল পাবেনা শেহজাদা ইলহান।”
কোকো এতক্ষণ ড্রোন খুজতেই ব্যাস্ত ছিলো। আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে বলে উঠলো,
“আমি এখানেই আছি আম্মা। কাজ শেষ হলে আওয়াজ দিবেন, আপনাকে নিয়েই ফিরবো।”
আনাবিয়া প্রতিউত্তরে বললনা কিছুই, লাইফট্রির আরও কাছাকাছি গিয়ে হাত রাখলো ও লাইফট্রির গায়ে। মুহুর্তেই হাত রাখা স্থানটিতে ফুটে উঠলো স্বর্নালী আলো, নড়েচড়ে জেগে উঠলো লাইফট্রি। নিজের ছোট্ট লতানো ডালপালা গুলো একিয়ে বেকিয়ে লিখলো একটা বার্তা,
“হোয়াট ডু ইয়্যু ওয়ান্ট, মা’ সুয়্যিট লিটল বেইবি গার্ল?”
লাইফট্রির এমন মিষ্টি সম্বোধনে আলতো হাসলো আনাবিয়া, বলল,
“স্যিল দ্যা স্কাই দ্যাট ক্রাউনস মা’ রেড জোন, দ্যা স্কাই বিলংস সোললি টু মি, অনলি মি।”
নড়ে উঠলো লাইফট্রি, নিজের ডালপালা গুলো মেলে ধরলো আকাশের দিকে, ছোট ছোট লতানো ডালপালা গুলো দিয়ে আবারও লিখলো একটি বার্তা,
“ব্লেস ম্যি উইদ ইয়োর সুয়্যিট ডিভায়্যিন ভয়েস।”
আনাবিয়া গিয়ে বসলো লাইফট্রির পাদদেশে, পিঠে ঠেকিয়ে দিলো গাছের বিশাল গুড়ির ওপর। লাইফট্রি তার নিম্নদেশে থাকা ডালপালা গুলো দিয়ে আদরে জড়িয়ে নিলো আনাবিয়াকে নিজের সাথে, পরম আবেশে আনাবিয়া মাথা ঠেকালো গাছের গায়ে, চোখ জোড়া বুজে নিলো। দুহাতের তালু মাটিতে ঠেকিয়ে গলা ছেড়ে গেয়ে উঠলো,
“জন্ম মৃত্যুর আবর্তনে পুনর্জন্ম হবে
তোমার আবার দেখা পাবো কখন কে জানে!
দূরে যাও…… সরে যাও…..
রেখে যাও….. কিছু স্মৃতি তোমার আমার
জানি আবার একটি জন্ম আমার কভু হবে না
জানি আবার এমন করে তোমার দেখা পাবো না….
জানি আবার একটি জন্ম আমার কভু হবে না
জানি আবার এমন করে তোমার দেখা পাবো না…..
মুহুর্তেই লাইফট্রির শরীর বয়ে আলোকতরঙ্গ খেলে গেলো নিচের দিকে, মাটির নিচে থাকা শেকড় বেয়ে সমস্ত রেড জোনের ভূপৃষ্ঠ ছুয়ে চতুর্দিকে ছুটে বয়ে গেলো আলোক তরঙ্গগুলো। ছুটে ছুটে ঠিক রেড জোনের সীমানা প্রান্তে গিয়ে মাটির তল থেকে হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে এলো তা, অতঃপর এক স্বচ্ছ আলোর দেয়ালের ন্যায় উঠে গেলো আকাশের দিকে। বিশাল বিশাল দীর্ঘ রেড উড ট্রি গুলোকে ছাড়িয়ে প্রায় মেঘের ভেতর গিয়ে পৌছোলো তা। আর তার পরেই সেগুলো ছুটে চললো রেড জোনের আকাশের কেন্দ্রের দিকে।
ঘুমন্ত রেড জোনে যে গুটিকয়েক মানুষ তখনো জেগে তারা অবাক নয়নে দেখে গেলো এই অভূতপূর্ব দৃশ্য, রাতের অন্ধকারকে ভেদ করে স্বর্ণাভ দ্যুতি ছড়িয়ে ছুটে চলা আলোকরশ্মি গুলোর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গেলো তারা।
মসভেইলে থাকা বাচ্চা গুলোও বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলো আকাশের দিকে, বুঝতে চাইলো ঠিক কি হচ্ছে তাদের আকাশে। ওদেরকে ছাড়িয়ে সোনা রঙা আলোকতন্তু গুলো একত্রিত হয়ে কেন্দ্রের দিকে এগোতে এগোতে একে একে ঢেকে নিতে থাকলো সমস্ত এরিয়া। ছুটতে ছুটতে লাইফট্রির ঠিক ওপরে থাকা আকাশে এসে একসময় মিলিত হলো সবগুলো আলোকতন্তু, একত্রিত হওয়ার পরপরই ক্রমে ক্রমে বাড়লো তাদের উজ্জ্বলতা। আর এরপর হঠাৎই ভীষণ উজ্জ্বল হয়ে চোখ ধাধিয়ে দিয়ে দপ করে জ্বলে উঠে সেটা আচমকাই নিভে গেলো পুরোপুরি। রেড জোন আবারও নিমজ্জিত হলো পূর্বের ন্যায় স্নিগ্ধ আঁধারে।
সমস্ত রেড জোনকে এক অদৃশ্য জালে আবদ্ধ করে ফেললো লাইফট্রি, করে ফেললো সিলগালা। আনাবিয়া গান থামালো এমন সময়ে, চোখ মেলে তাকালো সম্মুখে। ঝকমক করে উঠলো ওর হীরকখন্ডের ন্যায় চোখ জোড়া। স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশিই উজ্জ্বলতা ছড়াতে লাগলো ওর শুভ্র শরীর৷
লাইফট্রি ধীরে ধীরে আবারও চলে এলো নিজের পূর্বের অবস্থায়। আনাবিয়া ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে উঠে দাড়ালো, লাইফট্রির ডালের ওপর ঝুলিয়ে রাখা পোশাক গুলো থেকে তোয়ালে টা নিয়ে গায়ে জড়ালো, পোশাক গুলো নিয়ে নিলো হাতে, একেবারে মহলে ফিরে বদলে নিবে৷
পা বাড়ালো আনাবিয়া, কোকোকে ডাকতে নিলো ফিরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সেই মুহুর্তেই রেড জোনের দূর সীমানা প্রান্ত থেকে ভেসে এলো কোনো হিংস্র প্রাণীর হাড়হীম করা ভয়ানক ক্ষুধার্ত গর্জন!
চমকে সেদিকে তাকালো আনাবিয়া, সমস্ত শরীরে শিহরণ বয়ে গেলো ওর, শরীরের পশম গুলো খাড়া হয়ে গেলো, বুক কেঁপে উঠলো কোনো অজানা শঙ্কায়৷ ভ্রুদ্বয় কিঞ্চিৎ কুচকে বোঝার চেষ্টা করলো ঠিক কোন প্রানী এমন ভয়ানক গর্জন তুললো। এমন ক্ষুধার্ত চিৎকার ঠিক কোন প্রাণী দিতে পারে! এমন আওয়াজ এর আগে কেন শোনেনি কখনো?
“আম্মা ফিরবেন না? আপনার ঠান্ডা লেগে যাবে তো!”
কোকো দূর আড়াল থেকে বলে উঠলো আবারও। কোকোর কথায় সম্বিত ফিরে পেলো আনাবিয়া, দৃষ্টি ফিরয়ে নিয়ে মহলের দিকে পা বাড়িয়ে আনমনে বলে উঠলো,
“হ্যাঁ…. ফিরবো….. চল যাই।”
কোকো আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে এগোলো আনাবিয়ার পেছন পেছন। চলতে চলতে আনাবিয়া জিজ্ঞেস করলো,
“হ্যা রে কোকো, একটু আগে ওটা কিসের আওয়াজ ছিলো?”
“হবে কোনো বাঘ সিংহের, ব্লাক বেয়ারও হতে পারে। ওরা তো ওদিকেই থাকে বেশিরভাগ। তুলনামূলক বৃদ্ধ জন্তু গুলো শিকার না পেলে ক্ষিদেয় ওভাবে চিৎকার করে, অনেকে যন্ত্রণায়ও চিৎকার করে। হয়তো বেদম মারামারি লাগিয়েছিলো কারো সাথে, এখন কুপোকাত হয়ে পড়ে আছে জঙ্গলে, ওদের আর কি?”
বললো কোকো। আনাবিয়া আনমনা হয়ে রইলো তেমনি, বলল না কিছুই। কোকো জিজ্ঞেস করলো,
“একটু আগে আপনি কি করলেন আম্মা? ওই আলো গুলো কিসের ছিলো?”
“ওগুলো ট্রান্সপ্যারেন্ট ওয়ালের আলো। রেড জোনের আকাশসীমা স্যিল করে দিয়েছি, কোনো ফরেন ইলেকট্রনিক ডিভাইস এই এরিয়ার ভেতরে আর ঢুকতে পারবে না৷”
হাটতে হাটতে আনমনেই উত্তর করলো আনাবিয়া, মন ওর তখনো পড়ে রইলো ওই অজানা হিংস্র প্রাণীটার ক্ষুধার্ত আর্তচিৎকারের দিকে।
ইয়াসমিন হেরেমে ছিলো, নতুন আসা দাসী গুলোর ভেতর থেকে ইলহানের জন্য সবচেয়ে সুন্দরী, নিটোল দাসীগুলোকে বাছাই করছিলো সে। এদেরকে নিয়ে গিয়ে এবার ভালোভাবে সমস্ত নিয়ম কানুন শিখিয়ে আগামীকাল রাতে কোনো একজনকে ইলহানের নিকট পেশ করা হবে।
এমন সময়ে হেরেমের হলরুমের মেঝেতে ধুপধাপ পা ফেলে ছুটে এলো বাহার, বর্তমানে ইয়াসমিনের সহযোগী পদে অধিষ্ঠিত হয়েছে সে।
ছুটে এসেই হাফাতে হাফাতে বলে উঠলো,
“কালবী, হিজ ম্যাজেস্টির খাস দাসী গুলোর ভেতর ঝামেলা বেধেছে, আপনি তাড়াতাড়ি চলুন নইলে রক্তারক্তি হয়ে যাবে এবার!”
ইয়াসমিন চকিতে তাকালো বাহারের দিকে, অবিশ্বাসের গলায় একবার অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো,
“কি বলো! হিজ ম্যাজেস্টি কোথায় আছেন এখন?”
“উনি প্রাসাদে নেই, বাইরে বেরিয়েছেন, কোথায় গেছেন জানিনা।”
ইয়াসমিন সব কাজ ফেলে দ্রুতপায়ে প্রস্থান করলো হেরেম থেকে। বাহার ছুটলো ওর পেছন পেছন।
রয়্যাল ফ্লোরে মুহসিন একা ঠেকিয়ে পারছেনা, তার সাথে আরও কিছু ক্যাস্ট্রেটেড গার্ড মিলে সামলানোর চেষ্টা করছে ইলহানের দুজন খাস দাসীকে। অন্য জন কামরার এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ, তামাসা দেখছে সে।
মুহসিন যাকে ধরে আছে সে অপরজনের উদ্দ্যেশ্যে তেজী গলায় চিৎকার করে বলে উঠলো,
“নিজেকে আজকাল বেগম ভাবতে শুরু করেছো তাই না? নিজের চেহারা আয়নায় দেখেছো কোনোদিন?”
“হ্যাঁ আমি বেগম নই, কিন্তু তোমার চেয়ে কোনো অংশে কমও নই! হিজ ম্যাজেস্টির প্রথম খাসদাসী আমি, এত দাসীদের ভিড়ে তিনি আমাকে রেখে দিয়েছেন প্রথমেই। তাই আমার সাথে সাবধানে কথা বলবে! নইলে তার ফলাফল একদমই ভালো হবে না!”
ঝাঝিয়ে বলে উঠলো অন্যজন, গার্ডগুলো ধরে রাখতে পারছেনা তাকে, পারলে সামনের জনের মাথা ফাটিয়ে দেয় সে!
প্রথম জন আবারও বলে উঠলো,
“উনি তোমার চেয়ে আমাকে বেশি পছন্দ করেন! তোমার পর বহু দাসী তাঁর খাসকামরায় গেছে আর এসেছে, আর এতজনের ভীড়ে তিনি শুধুমাত্র আমাকে রেখে দিয়েছেন!
যদি তোমাকে দিয়েই তার হয়ে যেতো তবে তিনি আমাকে রাখতেন না, ইসাবেল কেও রাখতেন না! তুমি তাঁর মনোরঞ্জনে ব্যর্থ, স্বীকার করো।”
দ্বিতীয় জন এবার ধৈর্য হারালো, গার্ডের হাত থেকে নিজেকে এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিয়ে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে এক মোক্ষম আঘাত হানলো দ্বিতীয়জনের মুখে, মুহুর্তেই ঠোঁট ফেটে রক্ত বেরিয়ে এলো তার, নাকের কোণা বেয়ে সরু ধারায় রক্ত এসে চুইয়ে পড়লো থুতনি বেয়ে।
সেই মুহুর্তেই শব্দ করে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো ইয়াসমিন, পেছন পেছন বাহার এলো তার। ইয়াসমিন ঢুকেই ঝাঝালো গলায় বলে উঠলো,
“কি শুরু করেছো তোমরা? তোমাদেরকে আমি এসব করতে শিখিয়েছি? হিজ ম্যাজেস্টি ফিরে এসে তোমাদের ভেতর থেকে কাউকে ডেকে পাঠালে কিভাবে তাঁর সামনে যাবে তোমরা?”
ইয়াসমিন এগিয়ে গেলো প্রথম দাসীটির কাছে, ঠোঁটের কোণটা তার আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে খয়েরী রঙ ধারণ করেছে।, রক্ত থামছেনা নাক থেকে। ইয়াসমিন ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে আঘাতকারীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“আজ যদি কোনো ভাবে হিজ ম্যাজেস্টি অরোরা কে বিছানায় ডাকে, আর ওর এমন অবস্থা দেখে যদি প্রশ্ন করে তবে তোমাকে আমি বাঁচাতে পারবোনা এমি!”
এরপর ঘুরে এমির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“বাদশাহর খাস দাসীদের শরীরে আঘাত করার অর্থ মৃত্যুদন্ড, এটা তোমার জানা ছিলো নিশ্চয়?
আমি হিজ ম্যাজেস্টিকে নিজে থেকে কিছুই জানাবোনা। উনি যদি অরোরা কে এর ভেতর কামরায় না ডাকেন তবে তুমি বেঁচে গেলে, আর যদি ডেকে পাঠান তবে ওইদিনই হবে তোমার শেষ দিন। কথাটা মনে রেখো!”
বলে অরোরা কে নিয়ে বাইরে চলে যেতে নিচ্ছিলো ইয়াসমিন, তখনি পেছন থেকে এমি বলে উঠলো,
“ওকে তো আমি কিছুই করিনি কালবী, সামান্য আঘাত করেছি মাত্র! এই সামান্য আঘাতের জন্য আমার মৃত্যুদণ্ড কেন হবে?”
“কারণ বাদশাহ আমাকে বেশি পছন্দ করেন, আমার এ অবস্থা করেছো দেখলে তোমার চামড়া তুলে নিবেন তিনি!”
মুখের ক্ষতস্থানটি এক হাতে চেপে ধরে হিংস্র বাঘিনীর ন্যায় বলল অরোরা নামক দাসীটি।
এমি কোমর বেধে আবারও কিছু বলতে নিবে তার আগেই ইয়াসমিন ধমকে বলে উঠলো,
“চুপ করো তোমরা! যে-ই বাদশাহর খাসদাসীদের গায়ে আঘাত করবে তাকেই শাস্তি পেতে হবে, কারো কোনো ছাড় নেই৷ দ্বিতীয় বার যদি এমন বেয়াদবি করতে দেখেছি তবে তোমাদের দুজনকেই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে এখান থেকে বের করে দিবো, জীবনে আর কখনো হিজ ম্যাজেস্টির ছায়াটিও দেখতে পাবে না!”
ইয়াসমিন অরোরা কে নিয়ে চলেই যাচ্ছিলো কিন্তু তখনি ওর পা জোড়া থেমে গেলো এমির কথাতে,
“আমাদের শেহজাদী তো প্রয়াত বাদশাহর কত দাসীকেই খুন করেছিলেন, কই তাঁকে তো কিছুই বলা হয়নি!
এমনকি বাদশাহর অনাগত সন্তানকে পর্যন্ত তিনি হত্যা করেছিলেন, তার তো মৃত্যুদণ্ড হয়নি!
তবে আমার কেন? আমি কি এমন করেছি? আমি যদি ওর বড়সড় কোনো ক্ষতি করতাম তখন না হয় আমি আমার শাস্তি মাথা পেতে নিতাম! আমি তো কিছুই করিনি! আমি যা করেছি সেটুকু ওর প্রাপ্য ছিলো।”
“মুখ সামলে কথা বলো মেয়ে! কার সাথে নিজের তুলনা করছো তুমি? তিনি একজন শেহজাদী, দেমিয়ান কন্যা! শেহজাদা নামীর আসওয়াদ দেমিয়ানের প্রাণের থেকেও প্রিয় ছিলেন তিনি ভুলে যেও না!
নিজের থেকেও শেহজাদীকে বেশি ভালোবাসতেন তিনি। শেহজাদী এই প্রাসাদের সমস্ত দাসীকে খুন করে ফেললেও তিনি একটা শব্দও উচ্চারণ করতেন না।
আর তুমি সামান্য একজন দাসী, যার সিকিমাত্র মুল্য নেই হিজ ম্যাজেস্টির কাছে, তুমি কিভাবে তাঁর মতো সম্মানীয়া কারো সাথে নিজের তুলনা করো?
দ্বিতীয়বার এধরণের কথা মুখ দিয়ে বের করলে তোমার জিভ টেনে ছিড়ে ফেলবো আমি, মনে রেখো!
খুব বাড় বেড়েছে তোমার, আজই তোমাকে এই প্রাসাদ থেকে বের করার ব্যাবস্থা করবো আমি।”
শেষোক্ত কথাগুলো চিবিয়ে চিবিয়ে বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে অরোরাকে নিয়ে প্রস্থান করলো ইয়াসমিন। যতদ্রুত সম্ভব এই আঘাতের চিহ্ন গুলো মুছে ফেলার চেষ্টা করতে হবে, নইলে হিজ ম্যাজেস্টি অরোরাকে আর ছুয়েও দেখবেন না! এমিটারও কল্লা কাটা যাবে।
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে সবে। পূর্ব দিগন্ত থেকে সূর্য ধীরে ধীরে জেগে উঠছে, তটরেখা রাঙিয়ে দিচ্ছে কোমল আলোয়। শিরো মিদোরির কোল ঘেঁষা সমুদ্র হয়ে আছে শান্ত, ঢেউগুলো নিঃশব্দে কূল ছুঁয়ে ফিরে যাচ্ছে, যেন ঘুম কাটেনি তাদের এখনো।
সমুদ্রের ধার ঘেঁষে খালি পায়ে ধীর কদমে হেটে চলেছে আনাবিয়া। পায়ের নিচে ঠান্ডা, ভেজা বালু সিড়সিড় করছে। বালুর ওপর যেখানে সেখানে ছড়িয়ে আছে ঝিনুক, কোথাও কোথাও উঁকি দিয়ে আছে গুচ্ছ গুচ্ছ সামুদ্রিক ঘাস।
একটা ছোট পাখি ডাকতে ডাকতে হঠাৎ উড়ে এসে বসলো আনাবিয়ার কাঁধের ওপর, এতক্ষণ উড়ে কষ্ট হয়ে গেছে তার৷ আনাবিয়ার কাধে আরামসে বসে বিশ্রাম নিতে নিতে ঝিমুতে লাগলো সে।
ঘাড় ঘুরিয়ে পাখিটাকে একবার দেখলো আনাবিয়া, চোখ জোড়া বন্ধ, তিরতির করে কাঁপছে। আনাবিয়ার শুভ্র চুলের গোছার ভেতরে সে ঠেলে দিলো তার মুখ। পাখিটির এমন কান্ডে মিষ্টি হাসি ফুটে উঠলো আনাবিয়ার মুখে।
মসভেইলে ওদের কেটে গেছে আজ প্রায় দুবছর।অনেকগুলো দিন পর আজ রেড জোন ছেড়ে বেরিয়েছে ও। খুব মন টানছিলো সমুদ্রটা, তাই সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই এখানে চলে এসেছে।
বাচ্চারা ঘুম থেকে ওঠেনি তখনো, ওদেরকে না বলেই চলে এসেছে। ফোনটাও ফেলে রেখে এসেছে কামরায়। ঘুম থেকে উঠে হয়তো এতক্ষণে ওর খোঁজ করে চলেছে সবগুলো।
চারকোল রঙা ড্রেইপ প্যান্টের সাথে মীরের একটা সাদা রঙা পাতলা শার্ট গায়ে আনাবিয়া সমুদ্রের কিনারের জমে থাকা একটা পাথরের ওপর এসে বসলো। সমুদ্রের বিশাল বিশাল ঢেউয়ের দিকে দৃষ্টি রাখলো আনমনে৷
নিতম্বদেশ ছাড়ানো খোলা সফেদ চুলগুলো উড়তে লাগলো ভীষণ বাতাসে। প্যান্টের নিচের অংশ ভাজ করে উপরে তুলে পা জোড়া চুবিয়ে দিলো লোনা পানির ভেতর, ঢেউ এসে আছড়ে পড়লো ওর পায়ের ওপর।
আজ মীরকে মনে পড়ছে ভীষণ! কোনো ভাবেই তার স্মৃতি গুলোকে মাথা থেকে সরাতে পারছেনা আনাবিয়া। এক ভয়ঙ্কর অস্বস্তি আর যন্ত্রণায় রীতিমতো ঘায়েল হয়ে চলেছে ও প্রতিনিয়ত! স্মৃতি গুলো সব দুমুখো ছুরির ফলার ন্যায় আঘাত করে চলেছে ওকে, একদিকে বিশ্বাসঘাতকতার আঘাত, অন্যদিকে স্বয়ং বিশ্বাসঘাতকের অনুপস্থিতির যন্ত্রণা।
বিশ্বাসঘাতক বর্তমান থাকলে না হয় আজ তাকে মারা যেতো, কাটা যেতো, রাগ করা যেতো, অভিমানভরে দূরে থাকা যেতো, নিজের সমস্ত ক্রোধ, সমস্ত যন্ত্রণা মিটিয়ে নেওয়া যেতো। কিন্তু এখন ওর কি করার আছে? একইসাথে দু যন্ত্রণা কিভাবে সহ্য করা যায়?
এই সমুদ্রতীরে ওদের কতশত স্মৃতিই না জুড়ে আছে! যেদিকেই চোখ যায় সেদিকেই শুধু ওর আর মীরের উদ্দাম ছুটে চলার দৃশ্য ফুটে ওঠে চোখে। শিরো মিদোরির প্রতিটা কোণ চোখে আঙুল দিয়ে ওকে মনে করিয়ে দেয় প্রতিটা মুহুর্ত, প্রতিটা ক্ষণ, প্রতিটা পূঙ্খানুপুঙ্খ স্মৃতি!
চোখ জোড়া হঠাৎ বন্ধ করে নিলো আনাবিয়া। বুক ভরে দম নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, সময় নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো কিছুক্ষণ।
বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১১
সেই মুহুর্তেই নিজের আশেপাশে ও টের পেলো কারো উপস্থিতি, চমকে তাকিয়ে নিজের আশপাশটা দেখলো ও, আর তখনি দূরের রাস্তা থেকে হাত উচিয়ে উচ্চস্বরে একটি গমগমে পুরুষালি কন্ঠস্বর বলে উঠলো,
“এই যে, আমি এখানে।”
