বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১৬
রানী আমিনা
ফ্যালকন দাঁতে দাঁত চেপে দরজার চৌকাঠে এসে দাড়ালো, আনাবিয়া ঢুকতে নিতেই বলে উঠলো,
“ফারিশ জাবিন ভেতরে আছেন শেহজাদী, আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।”
আনাবিয়া মাথা নেড়ে গায়ের পোশাক আশাক ঠিক ঠাক আছে কিনা দেখে নিতে নিতে ভেতরে ঢুকলো, ফ্যালকন চোখ নামিয়ে দরজার নিকট থেকে দূরে সরে গিয়ে পেছন থেকে আবার বলল,
“আপনারা কথা বলুন শেহজাদী। কিছু প্রয়োজন হলে ডাকবেন, আমি বাইরেই আছি।”
কথাটা ফারিশকে শুনিয়ে বলল যেন সে সতর্ক হয়ে যায় এবং কোনো অনধিকার চর্চা না করে বসে। আনাবিয়া ভেতরে ঢুকলে বাইরে চলে এলো ফ্যালকন, রাগে গা জ্বলে যেতে লাগলো ওর৷ বারান্দায় দাঁড়াতেই অশ্বত্থ গাছের ওদিকটা থেকে কোকো লিওকে আসতে দেখলো সে।
ওদেরকে দেখা মাত্রই রাগের মাত্রা আরও বেড়ে গেলো যেন ওর। বড় বড় কদম ফেলে সিড়ি বেয়ে নেমে ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে কিঞ্চিৎ উচ্চস্বরে বলে উঠলো,
“কেন তোমরা ফারিশকে শেহজাদীর সংবাদ দিতে গেলে বলোতো ভাইজান, ওর প্রচন্ড বাড় বেড়েছে!”
“কেন, কি হয়েছে?”
শুধালো কোকো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“তিনি শেহজাদীর সাথে একা কথা বলবেন বলে আমাকে কামরা থেকে বের করে দিয়েছেন। এবং বলেছেন আমি যেন এমন দুরত্বে দাড়াই যেন তাদের কথপোকথন শুনতে না পাই! নইলে তিনি আনকম্ফর্টেবল ফ্যিল করবেন!”
শেষোক্ত কথা গুলো ভেঙচিয়ে ভেঙচিয়ে বলল ফ্যালকন৷ কোকো লিও নিজেদের ভেতর দৃষ্টি বিনিময় করলো একবার, কোকো বলল,
“তাকে কেন জানানো হয়েছে সেটা তো জানিসই, একটু মুখ বুজে সহ্য করে নে৷”
“দেখো কোকো ভাইজান, আমার কিন্তু ব্যাপারটা একদমই পছন্দ হচ্ছে না। আমার মনে হচ্ছে আমরা হিজ ম্যাজেস্টির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছি। ইচ্ছে করে আমরা ফারিশ জাবিনকে শেহজাদীর কাছাকাছি নিয়ে আসার চেষ্টা করছি!”
“তো কি করতাম? আম্মাকে মরতে দেখতাম? মেডিসিন নিচ্ছেন না উনি, খাবার দাবারে সারাক্ষণ অনিয়ম, কখন কি করছেন নিজেও জানেন না। আম্মাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হলে তাঁকে এই জঙ্গল থেকে প্রথমে বের করতে হবে, আর তারপর হিজ ম্যাজেস্টিকে ভুলে থাকার ব্যাবস্থা করতে হবে। নইলে উনি কখনোই সুস্থ হবেন না।”
চুপ হয়ে গেলো ফ্যালকন, কিছু বলতে চেয়েও আবার দমে গেলো। রাগে হতাশায় চোখ সরিয়ে নিলো কোকোর ওপর থেকে। কোকো কিয়ৎক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেললো একটা, তারপর ওর কাধে হাত রেখে বলল,
“আমি জানি তোর খারাপ লাগছে, খারাপ আমারও লাগছে। কিন্তু আমাদের আর কিছুই করার নেই এটা ছাড়া৷ আম্মাকে এই সিচুয়েশন থেকে বের করতে হলে আমাদেরকে এসব চোখ কান বুজে হজম করতে হবে।”
“তাই বলে ফারিশ! ওকে আমার সহ্য হচ্ছেনা ভাইজান, ও শেহজাদীর ওপর অতিরিক্ত অধিকার ফলাতে চাইছে। এসেছে বারো ঘন্টাও হয়নি এর ভেতরেই মনে হচ্ছে ও আমাদের বস!”
“ফারিশ আম্মার ওপর দিওয়ানা ছিলো ফ্যালকন, মরতো ও আম্মার জন্য। আর আজ যদি আম্মার সাথে হিজ ম্যাজেস্টির বিয়ে না হতো, তারা যদি অ্যাজ ইউজ্যুয়াল জীবন যাপন করতেন তবে আম্মার বিয়ে টা ফারিশের সাথেই হতো শিওর। তাই যা হচ্ছে হতে দে। আমি খুব করে চাই এমনটা হোক, আমার আম্মা একটু শান্তিতে কাটাক বাকি জীবন।”
ফ্যালকন বললনা কিছুই, রাগটা দমন করে ঘুরে দাঁড়িয়ে গটগট পায়ে হেটে আবার চলে এলো মহলের বারান্দায়৷
“বলুন ফারিশ ভাইজান, আপনার এখানে আসার উদ্দ্যেশ্য কি?”
ফারিশের সোফার বিপরীতের সোফাতে বসা আনাবিয়া শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো। পরণে ওর ওভার সাইজ টি শার্ট, সাথে একটা ঢোলাঢালা ট্রাউজার। শরীরের অবয়ব তাতে বোঝার কায়দা নেই৷
“আপনি ফিরে এসেছেন জানতে পেরে আপনাকে দেখতে এসেছি শেহজাদী। আপনি যে কখনো ফিরে আসবেন, আপনাকে যে আবার দেখতে পাবো এটা আমি কখনোই ভাবিনি। তাই কৌতুহল দমাতে না পেরে চলে এসেছি। তাছাড়া আপনি প্রাসাদ ছেড়ে রেড জোনে বসবাস করছেন শুনে আপনার খোঁজ খবর নেওয়াকে নিজের দায়িত্ব মনে করে এসেছি।”
ভরাট কন্ঠে বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথেই উত্তর দিলো ফারিশ। চোখের চশমাটা বা হাতের মধ্যমা স্পর্শ করে ঠিক করে নিলে। আনাবিয়া নিবিড় চোখে পর্যবেক্ষণ করলো ওকে, জিজ্ঞেস করলো,
“সংবাদ পেয়েছেন কিভাবে?”
“কুরো আহমারের বর্তমান কন্ট্রোলারের সাথে এক বিশেষ প্রয়োজনে সাক্ষাতের সময়ে তিনি জানিয়েছিলেন, জানা মাত্র আমি সোজা এখানেই চলে এসেছি।”
অকপটে বানানো মিথ্যা টুকু বলে দিলো ফারিশ। গতমাসেই কোকো আর লিওর সাথে কুরো আহমারের মেইন শহরে দেখা হয় ওর। ওরা দুজনে শপ থেকে খুঁজে খুঁজে কিছু জুয়েলরিজ কিনছিলো আনাবিয়ার জন্য। বলা বাহুল্য ফারিশকে দেখিয়ে দেখিয়েই ওরা ঘুরছিলো যেন ফারিশের নজর তাদের দিকে যায়, যেটা ফারিশ ঘূর্ণাক্ষরেও বুঝেনি।
ফারিশ কোকো কে দেখা মাত্রই চিনে ফেলেছিলো, না চিনলেও কোকো তাকে চিনিয়েই ছাড়তো। কোকো লিওকে দেখে কুশলাদি বিনিময় করে ওদরকে নিয়ে একটা ক্যাফেতে ঢুকে সাম্রাজ্যের বর্তমান অবস্থার টুকিটাকি জানতে জানতে হঠাৎই আনাবিয়ার আগমণ সংবাদ শুনে থমকে যায় ফারিশ।
প্রথমে সে বিশ্বাসই করতে চায়নি, লাইফট্রির ভেতর একবার ঢুকে গেলে সেখানে থেকে ফিরে আসা কিভাবে সম্ভব সে জানেনা। কিন্তু কোকো লিও তার সাথে মিথ্যা বলবে কেন সেটাও বুঝতে পারেনা৷
আর তাই আনাবিয়াকে দেখার জন্য সেদিনই শিরো মিদোরিতে আসতে চাইছিলো সে। কিন্তু কোকো সরাসরি মানা করে দেয় তাকে, নইলে আনাবিয়া শেষে কোকো লিওকেই সন্দেহ করে বসবে।
আজ তাই চাতক পাখির ন্যায় দিন গুনে গুনে ঠিক এক মাস পর শিরো মিদোরির রেড জোনে ছুটে এসেছে সে৷
আনাবিয়া ওর উত্তরে সন্তুষ্ট হলো কিনা বোঝা গেলো না, মুখের অভিব্যক্তি অপরিবর্তিত রইলো। কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে সে জিজ্ঞেস করলো,
“নওয়াস চাচাজান তো আর নেই, আপনার পরিবারের বর্তমানে কি অবস্থা, কেমন আছে সবাই?”
“সবাই ভালো আছে শেহজাদী, মেয়েরা আসতে চেয়েছিলো সাথে কিন্তু নিয়ে আসতে পারিনি৷ আপনাকে দেখার খুব শখ তাদের। যদিও তারা জানেনা যে আপনি ফিরে এসেছেন, আবার আপনার কোনো ফটোগ্রাফও নেই কোথাও, তাই ওদের ইচ্ছে অপূর্ণই রয়ে গেছে।”
“আপনার মেয়েরা?”
“জ্বি শেহজাদী, আমার দুইটি মেয়ে, ছেলে তিনজন।”
আনাবিয়ার ঠোঁটে কিঞ্চিৎ হাসি খেলে গেলো, বলল,
“বাহ্, বেশ এগিয়ে গেছেন দেখি।”
হাসলো ফারিশ, মৃদু শব্দ হলো হাসিতে। চোখের চশমা টা আর একবার আঙুলের ছোয়ায় ঠিক করে নিয়ে বলে উঠলো,
“মেয়ে দুটোকে ভালোবাসি অনেক, জানেনই তো ওরা সাধারণ মানুষের মতোই জীবনীশক্তি পায়! বোন দুটোর বয়স হয়ে যাচ্ছে, চামড়া কুচকে গেছে। দেখলে বুকের ভেতর কষ্ট হয়। মনে হয় এ জীবন না পেলেই ভালো হতো।
বাবার কথা মনে পড়ে ভীষণ, তিনি বেঁচে থাকলে হয়তো এতটা খারাপ লাগতো না, মনে হতো কেউ একজন আছে।
পরিবার হওয়ার পর বুঝতে পারছি, দেমিয়ান শেহজাদারা কেন কাউকে বিয়ে করেন না, কেন ভালোবাসেন না…!”
মেঝের দিকে চেয়ে এক নাগাড়ে কথাগুলো বলতে বলতে সিক্ত হয়ে এলো ফারিশের চোখ জোড়া, শেষে গলা ধরে আসতে চাওয়ায় থেমেই গেলো।
আনাবিয়া হাসলো সামান্য, কাছের মানুষের মৃত্যুশোক কি জিনিস সেটা মীরের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে কখনোই জানেনি, বোঝেনি। ওই একটা মানুষের বিয়োগ ওকে কতটা পুড়িয়েছে, এখনো পুড়িয়ে চলেছে সেটা শুধু মাত্র ও আর ওর সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কেউই জানেনা! কাছের মানুষ বলতে ওর ছিলোই বা কে? এক মীরই ওর বাবা মা ভাই বোন আত্মীয় স্বজন সবকিছুর রূপ নিয়ে ছিলো। এক মীরকে হারিয়ে ও গোটা পরিবারই হারিয়ে ফেলেছে।
বুক ভরে দম নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো আনাবিয়া, তারপর বলে উঠলো,
“মানুষের জন্মই হয় মৃত্যুবরণ করার জন্য, মৃত্যুই চরম সত্য। অ্যানিওয়ে, আপনি আমাকে দেখতে এসেছিলেন, খোঁজ খবর নিতে এসেছিলেন, আপনার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। দেখছেনই তো আমি ভালো আছি। আপনি সকালের নাস্তার পর কুরো আহমারের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিবেন। আপনার মেয়েরা অপেক্ষা করছে নিশ্চয়।”
শেষোক্ত বাক্যদ্বয় বলতে বলতে সোফা ছেড়ে উঠে গেলো আনাবিয়া। ফারিশ ব্যতিব্যস্ত হলো, ত্রস্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো,
“আপনাকে আমি একা ছাড়তে চাইনা শেহজাদী, আমাকে এখানে আপনার সাথে দেখা করতে আসার অনুমতি দিন দয়া করে। আপনার নিকট আমার অনুরোধ!”
“আমি চাইনা আপনি আমাকে দেখতে আসুন ফারিশ ভাইজান, আমাকে দেখাশোনার জন্য আমার ছেলে মেয়েরা আছে। এর বাইরে আমার কাউকে প্রয়োজন হবেনা। যদি হয় তবে আমি নিজেই ডেকে নিবো আপনাকে। এখন আপনি আসতে পারেন৷”
বলে বিছানার দিকে অগ্রসর হলো আনাবিয়া। ফারিশ পেছন থেকে ব্যাকুল, অধৈর্য কন্ঠে বলে উঠলো,
“আমি জানি হিজ ম্যাজেস্টি আমাকে পছন্দ করতেন না, ইভেন আমার করা কাজের জন্য আমি ভীষণই লজ্জিত এবং অনুতপ্ত। কিন্তু বিশ্বাস করুন, অতীতের ফারিশ আর এই ফারিশের ভেতরে অনেক তফাৎ শেহজাদী! আমি তখন আবেগের বশবর্তী হয়ে ভুল করে ফেলেছিলাম একটা, কিন্তু এখন আমি নিজেকে বদলে নিয়েছি, আমি আর আগের মতো নেই!”
আনাবিয়া নিরুত্তর রইলো, ড্রেসিং টেবিলের ওপর থেকে কিছু প্রয়োজনীয় প্রসাধন সামগ্রী হাতে নিয়ে ও এগোতে গেলো ওয়াশরুমের দিকে। ফারিশ আবারও কন্ঠে অসহায়ত্ব ফুটিয়ে বললো,
“আমাকে ফিরিয়ে দিবেন না শেহজাদী! বিশ্বাস করুন, আমি আপনার নিকট অন্যায় কোনো কিছু চাইতে আসিনি! আমি কিছুই দাবি করতে আসিনি এখানে শেহজাদী!
আপনি যা হারিয়েছেন আমি তা পূরণ করতে পারবো না কখনোই। শুধু আপনি যেন একা না থাকেন, আমাকে আপনার পাশে একটু স্থান দেন, এই চাওয়া নিয়েই আমি এসেছি। আমি সেই পুরনো বন্ধুটির মতো করেই আপনার পাশে থাকতে চাই, তার বেশি কিছু নয় কখনোই! ওর চাইতে বেশি কিছু চাওয়ার স্পর্ধা আমার আর কখনোই হবে না শেহজাদী। শেষ বার আমাকে একটা সুযোগ দিন!”
দাঁড়িয়ে গেলো আনাবিয়া, ওয়াশরুমের দরজা থেকে ফারিশের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল,
“ফারিশ ভাইজান, মীর আপনার এসব আবেগকে প্রচন্ড ঘৃণা করতো, আপনার ছায়াও সে দেখতে পারতোনা, আপনার নামটা পর্যন্ত সে শুনতে পারতোনা। সেখানে তার অনুপস্থিতিতে আপনাকে আমি বন্ধু হওয়ার সুযোগটাই বা কিভাবে দিই! এটা তার প্রতি আমার বিশ্বাসঘাতকতা বৈ কিছু হবে না ফারিশ ভাইজান।
সে যা-ই করুক সে আমাকে ভালোবেসেছিলো, সে আমাকে যা দিয়েছে তা এই পৃথিবীর অন্য কারো দেবার সাধ্য নেই, না ভালোবাসা আর না যন্ত্রণা। সে উপস্থিত না-ই থাকতে পারে, কিন্তু তার ভালোবাসার প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধে কখনো কোনো কমতি আমি হতে দিবোনা।”
ফারিশ এবার অধৈর্য হয়ে উঠলো আরও, দুকদম এগিয়ে এসে অসহায় কন্ঠে ও বলে উঠলো,
“আমি জানি আমি ভুল ছিলাম! হিজ ম্যাজেস্টিকে আমিও প্রচন্ড শ্রদ্ধা করি, সমীহ করি। কিন্তু এতসবের পরেও ভুলবসত আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম।
তখন আমি কিভাবে এমন পাগলাটে স্বভাবের হয়ে গেছিলাম আমি নিজেও জানিনা শেহজাদী, কিন্তু এত বছরে আমি পরিবর্তন হয়ে গেছি!
বিশ্বাস করুন একবার আমাকে, একটা সুযোগ দিন! এই শেষ, দ্বিতীয় বার ভুল করলে আপনি আমাকে যা শাস্তি দিবেন আমি মাথা পেতে নেবো।”
আনাবিয়া মুখ ফিরিয়ে নিলো, বললোনা কিছুই। ফারিশ কিয়ৎক্ষণ অধীর আগ্রহে আনাবিয়ার উত্তরের অপেক্ষায় তাকিয়ে রইলো, কিন্তু সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও যখন আনাবিয়া কোনো শব্দ উচ্চারণ করলোনা তখন হতাশা গ্রাস করলো ফারিশকে। এতক্ষণের ব্যাকুল কন্ঠে নিমিষেই নেমে এলো নির্জীবতা,
দৃষ্টি নামিয়ে নিষ্প্রাণ কন্ঠে সে বলে উঠলো,
“ঠিক আছে শেহজাদী, আপনি না চাইলে আমি চলে যাবো। কিন্তু আপনি জানবেন আমি ছিলাম সবসময় আপনার পাশে, এখনো থাকতে চাই। যে কোনো প্রয়োজনে যে কোনো সময়ে ডাকবেন আমাকে, আমি সমস্ত ফেলে ছুটে আসবো আপনার কাছে, কোনো দাবি ছাড়াই।
আগামীকাল সকালেই আমি শিরো মিদোরি ছেড়ে যাবো, আপনি আমার চেহারা দেখার আগেই।
আমার ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের জন্য ক্ষমা করবেন শেহজাদী।”
আনাবিয়া ওয়াশরুমের দরজা ঠেলে ভেতরে যেতে যেতে বলে উঠলো,
“ঠিক আছে ফারিশ ভাইজান, দ্বিতীয় বার এখানে আসার সময়ে আপনার মেয়েদেরকে সাথে নিয়ে আসবেন।”
বলেই ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। বাইরে রেখে গেলো ওয়াশরুমের দরজার দিকে চকচকে চোখে, হতভম্ব চেহারায় তাকিয়ে থাকা ফারিশকে।
“লুনা, বাবু সোনা, দুটো কথা শোনোনা!”
সুর করে বলতে বলতে লিও এগোচ্ছে লিন্ডার পেছন পেছন, লিন্ডা রেগে টং হয়ে আছে, পায়ের গতি বেড়ে গেছে কয়েক গুন। দুম দাম পা ফেলে অন্ধকারের ভেতর সে কোনদিকে যাচ্ছে নিজেও জানেনা।
রাগের পেছনে একটা গুরুতর কারণ নিহিত আছে, দুজনে গেছিলো অ্যানিম্যাল টাউনের খোঁজ খবর নিতে। হাইনা সেখানের দায়িত্ব প্রাপ্ত হওয়ায় এরা মাঝে মাঝেই যায় ওর সাথে দেখা করতে। খোজ খবর নেওয়া হয় গেলে, একটু ঘুরঘুর করেও আসা যায়।
কিন্তু আজ সেখানের দুইটা সুন্দরী বাঘিনী লিওকে দূর থেকে হাসি মুখে দেখছিলো এবং নিজেদের ভেতর ফুসুরফাসুর করছিলো। তারা যে লিওকে নিয়েই আলোচনা করছে সেটা লিন্ডা ওদের কথা না শুনলেও টের পেয়েছে।
কিন্তু বড় ব্যাপার সেটা নয়, বড় ব্যাপার হলো লিও অসাবধানতা বসত একবার কি দুবার তাদের দিকে তাকিয়ে ফেলেছে, এই তাকানোই যে তার কাল হবে সেটা জানলে সে আজ চোখই মেলতো না। এখন লিন্ডার ক্রোধের ঝাজ সইতে সইতে তার জীবন তলিয়ে যাওয়ার পথে।
লিও বেশ অনেক ক্ষণ ধরেই ওর রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করে চলেছে কিন্তু ফলাফল শূণ্য৷ লিন্ডার রাগ কমা যেমন তেমন উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। লিও নিজেও গতি বাড়িয়ে আবার সুর করে গেয়ে উঠলো,
“ও লুনা
একটু কথা কহো না
ও লুনা
পেছন ফিরে চাহো না”
লিন্ডা মুখ খুললো এবার, পেছনে না ফিরেই ঝাঝ মেশানো গলায় বলে উঠলো,
“আর একবারও যদি তোমার ওই হেড়ে গলায় আমার প্রিয় গান গুলো গেয়ে গানের ইজ্জতের গুষ্টি কিলিয়েছো তবে তোমার সাথে এই রাতেই ব্রেক আপ করে ফেলবো আমি, এটাই তোমার লাস্ট ওয়ার্নিং!”
লিও হো হো করে হাসলো, টিটকারি মেরে বলল,
“ঝাঁসির রানী লিন্ডা বাঈ।”
লিন্ডা সেটা শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে লাফিয়ে উঠলো, রাগের চোটে এবার ছুটে লিওর থেকে পালাতে নিলো যেন ও। কিন্তু লিও পেছন থেকে দ্রুত পায়ে হেটে লিন্ডার কাছাকাছি পৌছে হাত বাড়িয়ে খপ করে লিন্ডার হাত ধরে হ্যাচকা টানে নিজের বুকে আছড়ে ফেললো, তারপর কৌতুক পূর্ণ কন্ঠে বলে উঠলো,
“এত রাগ কোথায় থাকে তোমার দেখি!”
বলে লিন্ডার টি শার্টের বুকের নিকট দু আঙুল বাড়াতেই লিন্ডা একটা থাবড়া দিয়ে ওর হাত সরিয়ে দিয়ে ক্রোধান্বিত স্বরে বলল,
“অসভ্য, বেয়াদব! একদম আমাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করবে না!”
লিন্ডার কোমর জড়িয়ে ওকে বুকের সাথে জাপ্টে ধরে থাকা লিও ফিচেল হেসে বলে উঠলো,
“এখন কোথায় আছো শুনি?”
নিজের অবস্থান সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া মাত্রই লিন্ডার রাগ আরও বেড়ে গেলো যেন, রাগে চেচিয়ে উঠে সে হাতপা ছুড়ে নিজেকে ছাড়াতে চাইলো লিওর বাহুবন্ধনী হতে। কিন্তু তখনি লিওর হাস্যোজ্জ্বল চেহারার হাসিটুকু মুছে গিয়ে হঠাৎ এসে ভর করলো সতর্কতা। রাগে চেচাতে থাকা লিন্ডার মুখের ওপর হাত চাপা দিয়ে সে চাপা সুরে বলে উঠলো,
“হুশশশ, চুপ করো লুনা….।
লিন্ডা চুপ হয়ে গেলো সাথে সাথে, ক্রোধ মিলিয়ে গেলো ওর চেহারার, সতর্ক চোখে কান খাড়া করে লিওর গায়ের ওপর ভর ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো ও।
“শুনতে পাচ্ছো?”
প্রায় ফিসফিসে কন্ঠে শুধোলো লিও, লিন্ডা ওর দিকে একবার চোখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে মাথা নাড়লো ওপর নিচে, মুখটা এখনো লিওর হাতের নিচে চাপা পড়ে আছে৷
একটা চাপা মেয়েলি গোঙানির শব্দ ভেসে আসছে আশেপাশের কোনো স্থান থেকে, খেয়াল করে না শুনলে টের পাওয়ার উপায় নেই।
লিন্ডা লিওর চোখাচোখি হলো, লিন্ডার মুখ ছেড়ে দিয়ে লিও এগোলো সতর্ক পায়ে, লিন্ডা ওর শার্টের হাতা মুঠির ভেতর ধরে এগোলো পেছন পেছন। শুকনো পাতার ওপর পা পড়ে শব্দ যেন না হয় তার জন্য পা ফেললো সন্তর্পণে।
শব্দের উৎসের দিকে এগোতে এগোতে লিন্ডার বুকের ভেতর ধুক ধুক শুরু হলো, এই রাতে চাপা গোঙানির শব্দটা ভৌতিক ঠেকছে, যেন কোনো অশরীরী কোনো রুগ্ন নারীর রূপ নিয়ে ছলচাতুরী করে ওদের দুজনকে ফাসাতে চাইছে নিজের জালে।
নির্ভীকচিত্তে লিও এগিয়ে গেলেও ভয় পেলো লিন্ডা, ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে লিওর পিঠের সাথে সেঁটে গেলো ও৷ লিও এক হাতে ওকে পিঠের সাথেই আগলে নিলো। পা বাড়ানোর সাথে সাথে গোঙানির শব্দটা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে লাগল।
কিছুদূর যাওয়ার পরই হঠাৎ থমকে দাড়ালো লিও, হাটার মাঝে বাধা পেয়ে লিন্ডা ধাক্কা খেলো লিওর পিঠের সাথে। কি হয়েছে দেখার জন্য লিওর প্রশস্ত পিঠের এপাশ থেকে মুখ বাড়িয়ে সামনে দেখলো, দেখেই ভয়ে মুখ থেকে ওর বেরিয়ে এলো চাপা চিৎকার।
Yuhi Baras Baras Kaali Ghata Barse
Hum Yaar Bheeg Jaaye
Is Chaahat Ki Baarish Mein
Teri Khuyli Khuli Lato Ko Suljhaaun
Main Apni Ungliyon Se
MainTo Hoon Isi Khwaayish Mein
Sardi Ki Raaton Mein
Hum Soye Rahe Ek Chaadar Mein
Hum Dono Tanha Ho Na
Koi Bhi Rahe Is Ghar Mein
Zara Zara Behekta Hain Mehekta Hain Aaj To Mera
Tan Badan Main Pyaasi Hoon
MujheBhar Le Apni Baahon Mein
Zara Zara Behekta Hain Mehekta Hain Aaj To Mera
Tan Badan Main Pyaasi Hoon
MujheBhar Le Apni Baahon mein………
মধ্যরাতে গুণগুনিয়ে ওদের শেষ বাসরের দিনে মীরের গাওয়া গানটি গাইতে গাইতে নিজের সফেদ চুলে চিরুনী বুলোচ্ছিলো আনাবিয়া। ওর গুণগুণানির কারণে আশপাশের গাছপালা গুলো আলোকিত হয়ে উঠেছিলো, গান থামাতেই একটু একটু করে নিভে গেলো আলোগুলো। অন্যদিনে এমন সময়ে ও বিছানায় ঘুমে কাঁদা থাকে, কিন্তু আজ ঘুম আসছে না। তাই আয়নার সম্মুখে বসে বসে চুলগুলোকে আঁচড়ে নিচ্ছে সে।
বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১৫
চুলগুলো মীরের ভীষণ প্রিয় ছিলো, কাছে এলেই আঙুলে এক গুচ্ছ চুল পেচিয়ে না নিলে ওর শান্তি হতোনা। পেচিয়ে পেচিয়ে আবার ছেড়ে দিয়ে, আবার পেচিয়ে আনাবিয়ার চোখে চোখ রেখে গল্প করতে মীর ভীষণ ভালোবাসতো!
কত যত্ন নিতো মীর ওর চুলের, নিয়ম করে শ্যাম্পু দেওয়া, তেল দেওয়া, বেণী করা সবকিছুই মীর করে দিতো। যেদিন না পারতো ইয়াসমিনকে ভালোভাবে বার বার করে বলে দিয়ে যেত যেন ওর অনুপস্থিতিতে ওর কাজটা একদম পূঙ্খানুপুঙ্খরূপে হয়। ইয়াসমিন করতোও তাই, নইলে যে মীরের রাগের শেষ থাকতো না!
হাসলো আনাবিয়া। তখনি বাইরে শোনা গেলো দ্রুত গতির ধুপ ধাপ পা ফেলার শব্দ, সাথেই কোকোর আতঙ্কিত স্বরে ‘আম্মা, আম্মা’ চিৎকার ধ্বনি……
