বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৪

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৪
রানী আমিনা

জঙ্গলের ডার্ক প্যালেস এরিয়াতে বাচ্চারা সকলেই মাটিতে বসে আছে চুপচাপ, ন্যাকু এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে। প্যালেসে প্রবেশের দরজার ওপর হতে মাটি সরানো, পাশেই পড়ে আছে কয়েকটি কুড়াল, একটি রোটারি হ্যামার আরেকটি প্লাজমা কাটার।
গত তিন ঘন্টা ধরে হাজার চেষ্টা করেও ধাতব দরজাটির ওপর সামান্য আঁচড় লাগাতে পারেনি ওরা, খোলা দূরের ব্যাপার! দরজাটা আগেও যেমন চকচকে ছিলো এখনো তেমনি আছে।
হাল ছেড়ে দিয়ে তাই সকলেই বসে আছে চুপচাপ, ভেবে চলেছে পরবর্তী পদক্ষেপ কি নেওয়া যায়৷
এমন সময়ে নিরবতা ভেঙে ফ্যালকন নিচের দিকে দৃষ্টি দিয়ে শীতল কন্ঠে বলল,

“আমাদেরকে শেহজাদা জাজীব ইলহানের শরণাপন্নই হতে হবে। তাকে ছাড়া আমরা এই দরজা কোনোভাবেই খুলতে পারবোনা। ভেতরে শেহজাদী কেমন আছেন, কোকো আলফাদ ভাইজান কেমন আছেন আমরা কিছুই জানতে পারছিনা। এভাবে বসে থাকলে যে কোনো সময় যা কিছু হয়ে যেতে পারে।”
“তাই বলে আমরা হিজ ম্যাজেস্টির চির শত্রুর কাছে গিয়ে হাত পাতবো? যে কিনা আমাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালিয়েছে তিন বছর ধরে!”
রুষ্ট গলায় বলল জোভি। ফ্যালকন ওর দিকে একবার তাকিয়ে আবার মাটির দিকে চোখ করে বসে রইলো। হাইনা একটা শ্বাস ছেড়ে বলল,
“এটা আত্মসম্মান বজায় রাখার সময় নয় জোভি, যেখানে আমাদের শেহজাদী বিপদে আছেন সেখানে তাকে বিপদ হতে উদ্ধারে গুরুত্ব না দিয়ে তার শত্রুর কাছে হাত পাতার ব্যাপারে বেশি গুরুত্ব দেওয়াটা চরম বোকামি বৈ কিছু নয়।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“তাছাড়া শেহজাদা ইলহান যত যা-ই করুক, শেহজাদী বিপদে আছেন শুনলে উনি হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন না। এমনিতেই তিনি শেহজাদী, তাছাড়া দেমিয়ানেরা অলওয়েজ নিজেদের ফ্যামিলি মেম্বার দের প্রতি প্রচুর প্রোটেক্টিভ অ্যান্ড কনজার্ভেটিভ। তাই তার কাছে সাহায্যের আবেদন জানাতে কোনো প্রবলেম আছে বলে আমি মনে করিনা।”
বলল লিও। লিন্ডাকে জড়িয়ে নিয়ে বসে আছে সে। লিন্ডার অবস্থা শোচনীয়, শেহজাদীর শোকে কান্নাকাটি করে করে চোখ লাল করে ফেলেছে সে। মাথা ব্যাথায় এখন চোখে কিছু দেখছেনা, তবুও এদের সাথে চলে এসেছে শেহজাদীকে উদ্ধারের জন্য৷ লিও মানা করলেও শোনেনি।

“কিন্তু কে যাবে? শেহজাদা ইলহান তাদের মেয়ের প্রতি প্রটেক্টিভ হতে পারেন, আমাদের প্রতি নয়। তিনি আমাদের চরম ঘৃণা করেন, দুচোখে দেখতে পারেন না। আমরা তার সাথে দেখা করতে চাইলেও তিনি যে দেখা করবেন বা আমাদের কথা শুনতে রাজি হবেন এ ব্যাপারে আমি সন্দিহান।”
ঠান্ডা স্বরে বলল কাঞ্জি, কাঞ্জির কথাতে সকলেই আবার চিন্তায় বুদ হয়ে গেলো। কি করবে, কিভাবে কি বলবে কিছুই মাথায় এলোনা। বিপদের দিনে ওদের মাথা ফাঁকা হয়ে গেছে। শেহজাদী থাকতে যতটা জোর ওদের মনে ছিলো সেটা যেন এখন নেমে এসেছে শূন্যের কোঠায়! কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারছেনা, কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না, সবকিছু গোলমেলে লাগছে। হঠাৎ মাতৃহীনা হয়ে পড়লে বুঝি এমনই হয়!
লিওর বুকের ভাজে ভার হয়ে থাকা মাথা গুজে ছিলো লিন্ডা, এই সিদ্ধান্তহীনতায় দিশেহারা হয়ে কান্না জড়ানো স্বরে নাক টেনে সে বলে উঠলো,

“কোকো ভাইজান থাকলে আমাদেরকে এভাবে বসে থাকতে হতোনা, ভাইজান কোনো না কোনো উপায় বের করে শেহিজাদীকে ঠিকই খুঁজে নিয়ে আসতো!”
ওর কথা শুনে সকলের বিষন্নতার পরিমাণ বেড়ে গেলো যেন আরও। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো কারো কারো বুক চিরে। শেহজাদীর পরে ওদের একমাত্র ছায়া কোকো ভাইজান, বড় ভাইয়ের মতো সমস্ত বিপদকে বুক পেতে আগলে নিতে শুধু সে-ই পারে। সমস্ত অভিভাবক একত্রে এভাবে ওদেরকে ছেড়ে দিবে সেটা যে ওরা কখনো কল্পনাতেও আনেনি!
“আমাদের চেষ্টা করে দেখতে তো ক্ষতি নেই! শেহজাদা ইলহান আমাদের পছন্দ করেন না সেটা আমরা যেমন জানি, তিনিও তেমন জানেন শেহজাদী বা আমরাও তাকে পছন্দ করিনা। তাই আমরা যদি তার সাথে কথা বলতে চাই তবে শেহজাদা নিশ্চয় বুঝবেন শুধু শুধু আমরা কখনোই তার সাথে কথা বলতে আসবোনা।
নিশ্চয় তিনি আমাদেরকে কথা বলার সুযোগ দিবেন, জানতে চাইবেন কেন আমরা এভাবে সাডেন তার সাথে মিট করতে চাইছি।”

বলল ওকামি। তারপর আবারও নিরবতা, কি করবে ভেবে পেলোনা কেউ। জাজীব ইলহানের কাছে গেলে যদি হিতে বিপরীত হয় তখন আর এক বিপদ ঘাড়ে নামবে। এখন কি করা!
কিছুক্ষণ নিরব থেকে অবশেষে লিও বলল,
“আমরা তবে শেহজাদার কাছেই যাবো, এ ছাড়া আমাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা নাই। এতে আমাদের ক্ষতি হলে হবে, কিন্তু শেহজাদী বা কোকো ভাইজান দের কাউকেই আমরা এভাবে বিপদের মুখে ফেলে রাখতে পারিনা। যারা সারাজীবন আমাদের মাথার ওপর ছায়া হয়ে থেকেছে তাদেরকে অনিশ্চয়তার ভেতর ফেলে রেখে বসে থাকা চরম লেভেলের নিমকহারামি।”

পোড়ানো মাংস থেকে বেশ সুস্বাদু ঘ্রাণ আসছে। অদ্ভুত, লোভনীয়, বুনো গন্ধে ভরে গেছে চারপাশ। মীর আর শেয়ালের বাচ্চাটা অধীর আগ্রহে বসে আছে তা খাওয়ার জন্য। চোখে তাদের লোভাতুর দৃষ্টি, জিভে জল।
মীরের কোমোরে আটকে আছে আনাবিয়ার দৈনন্দিন ব্যাবহার্য একটা টাওয়েল। যেটা বাইরে গেলে সঙ্গে নেয় ও। সেটাকে বেশ শক্ত করে গিট্টু দিয়ে দিয়েছে, নইলে কিছুক্ষণ পর পর কালাভুনা টা এদিক ওদিক কৌতুহলী দৃষ্টিতে হেটে বেড়ানোর সময় তা খুলে পড়ছে৷

আনাবিয়ার মুখে ক্লান্তির রেশ, সকাল থেকে এটা সেটা করতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে ও৷ এরই মধ্যে ওর মনে পড়েছে কোকো আলফাদকে ডার্ক প্যালেসেই থেকে গেছে, নিজেরা বের হতে পারবেনা কখনো, আনাবিয়াকেই যেতে হবে। ওদিকে মহলের বাকি বাচ্চা গুলো কি করছে কে জানে! নিশ্চয় দুশ্চিন্তা করে মরছে সবগুলো!
দ্রুত এদের দুটোকে খাইয়ে ও বেরিয়ে পড়বে। নইলে ঘটনা অন্য দিকে মোড় নিলে বিপদে পড়বে সকলে মিলে। বিশেষ করে মীর।
আনাবিয়া তাকালো একবার মীরের দিকে,ক্ষিধের চোটে বসা থেকে চিৎপাত হয়ে শুয়ে পড়েছে সে বালুর ওপর। চোখ জোড়া বন্ধ, ক্ষুধার্ত মুখ খানা শুকিয়ে আছে। একটু আগে যেটুকু ছোটাছুটি করছিলো এখন সেটাও করছেনা। ক্ষিধেতে সকল দুষ্টুমি উড়ে গেছে তার।

আনাবিয়া ঝলসানো মাংস নামিয়ে খঞ্জর দিয়ে বেশ বড় বড় টুকরো করলো, জঙ্গল হতে কেটে নিয়ে আসা কলাপাতায় মাংসের একটা বড় টুকরো রেখে এগিয়ে দিলো মীরের সামনে৷ মীর সেই মশলা মাখানো ঝলসানো মাংসের সুস্বাদু ঘ্রাণ পেয়ে চোখ মেললো ঝটিতি। পরক্ষণেই হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে তাকালো তার সম্মুখে কলাপাতায় রাখা মাংস টুকরোর দিকে।
লোভাতুর চোখ জোড়া চকচক করে উঠলো, গলা দিয়ে চাপা, সুখময় গর্জন বেরিয়ে এলো ওর,
“গ্রাররররর….”

আনাবিয়া ওর এই উপচে পড়া খুশি দেখে মিষ্টি করে হাসলো, তারপর শেয়ালের বাচ্চাটার জন্য মাংসের টুকরো কাটতে উদ্যত হলো। কিন্তু তখনি মীরের কর্মকাণ্ড দেখে তব্দা মেরে গেলো ও।
মীর প্রায় ঝাপিয়ে পড়লো মাংসের ওপর! নিজের খড়খড়ে হাতে পুরো টুকরোটা তুলে একসাথে সব তাড়াহুড়ো করে মুখে ঢোকাতে চাইলো একবারেই। যেন কেউ এক্ষুনি কেউ ছিনিয়ে নেবে ওর খাবার!
ধারালো দাঁতে একের পর এক বিশাল বিশাল কামড় বসিয়ে বিদ্যুৎ বেগে মাংস ছিড়ে ছিড়ে গোগ্রাসে ও গিলতে লাগলো, চিবোনরও সময় পেলোনা! দুহাতের ফাঁক দিয়ে মাংসের তেল চুইয়ে পড়তে লাগলো ওর৷ মুহুর্তেই বিশাল টুকরোটির অর্ধেক সাবাড় করে শব্দ করে গিলে পেটে চালান করে দিলো, পরক্ষণেই আবারও সেই ভয়ানক আক্রমণ!
আনাবিয়া এতক্ষণ বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে ছিলো মীরের দিকে, পরক্ষণেই ওর এহেন খাওয়ার ধরণ দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলো!

মীর এই অত্যন্ত সুস্বাদু খাবার খাওয়ার মাঝে হঠাৎ মিষ্টি, খিলখিলে হাসি শুনে স্থীর হয়ে গেলো সম্পুর্ন, স্বর্ণাভ চোখ জোড়া তুলে তাকালো আনাবিয়ার মুঝপানে। মুখের খাবার ওর মুখেই রয়ে গেলো, চিবোলোনা, গিললোনা, স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো শুধু!
খিলখিলে হাসির মিষ্টি শব্দটা ওর বন্য, উগ্র বক্ষের গভীরে গিয়ে শীতল স্পর্শ টেনে দিলো যেন! হৃৎপিণ্ডের গতি দ্রুততর হলো, এক অজানা সুখানুভূতিতে ছেয়ে গেলো ওর সমস্ত শরীর, যেন কোনো জাদুকরী উপশম হয়ে প্রশমিত করে দিলো ওর অভ্যন্তরীণ সমস্ত ক্ষত!
“কেউ কেড়ে নিবেনা, ধীরে খাও।”
স্মিতহাস্যে মিষ্টি গলায় বলল আনাবিয়া। মীর তখনো মুখ ভর্তি খাবার নিয়ে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে।
আনাবিয়া কিয়ৎক্ষণ ওর দিকে মায়াভরা চোখে তাকিয়ে থেকে অতঃপর হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

“আমার কাছে দাও দেখি!”
কিন্তু মীর সাথে সাথে ঝলসানো মাংসের টুকরো আনাবিয়ার হাতের নাগালের বাইরে লুকিয়ে নিয়ে ভ্রু কুচকে গরগর শব্দ করে বুঝিয়ে দিলো,
“আমার খাবারে একদমই হাত দিবে না।”
ওর খাবার লুকানো দেখে আনাবিয়া গোল গোল চোখ করে বলল,
“বাহ! কথা না জানলেও মালিকানা বেশ ভালো বোঝো দেখি!”
মীর পাত্তা দিলোনা কোনো কিছুতে, ওর সমস্ত মনোযোগ আবার গিয়ে পড়লো ঝলসানো মাংসের ওপর। গোগ্রাসে মাংসের টুকরোতে কামড় বসাতে বসাতে তাকালো সে আনাবিয়ার দিকে।
ঠোঁটের চারপাশে মাংসের তেল মেখে গেছে, নাকের ডগায় একটু খানি লাল মশলা, চোখে দুষ্টু বাচ্চার মতন চাহনি; যেন আনাবিয়াকে দেখিয়ে দেখিয়ে খাওয়ার প্রচেষ্টা!

আনাবিয়া হাসলো মৃদু, মীরের এসমস্ত ক্রিয়া কলাপ ওর কাছে নতুন। এমন দুষ্টুমিতে ভরতি মীরকে ও চিনেনা, যাকে চিনতো সে ছিলো খুবই গুরুগম্ভীর, সর্বদা কাজে ডুবে থাকা, দায়িত্বের ভারে বুদ হয়ে থাকা এক রাজসিক অবয়ব!
এ যেন এক নতুন মীরের আবির্ভাব!
নাকি মীর আগে থেকেই এমনই ছিলো, শুধু ওপরে পড়ে ছিলো এক ইস্পাত দৃঢ় কাঠিন্যতা? কেন? শুধুই জীবনের না পাওয়া গুলোর জন্য? মীরের কি তবে আবার নতুন জন্ম হলো? ঝলসে যেভাবে মলিন স্বর্ণ গলে নতুন, উজ্জ্বল স্বর্ণে রুপান্তর হয় তেমন? নাকি ফিনিক্স পাখির মতোন?

আনাবিয়া ব্যাকপ্যাক থেকে ন্যাপকিন বের করে নিয়ে এসে মুছে দিলো মীরের তেল লেগে থাকা মুখ।
মীর খাওয়া থামিয়ে দিলো হঠাৎ, কি যেন মনে পড়লো তার। সে যেমন ক্ষুধার্ত, তার সম্মুখে বসা তার রক্ষাকর্ত্রী মেয়েটিও কি ক্ষুধার্ত নয়? তারও নিশ্চয় ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে!
মীরের জান্তব বুকে বেদনা হলো যেন হঠাৎ, সামান্য মোচড় দিয়ে উঠলো বোধ হয়! কিন্তু সে তো কাউকেই খাবারের ভাগ দিতে রাজি নয়, কে খেলো কে না খেয়ে মরলো সেটাও তো তার ভাবনায় কখনোই আসেনা। তবে এই মেয়েই কেন? কি হয় এ ওর?

নিজের এসব নতুন নতুন অনুভূতির সাথে পরিচয় হওয়ার সাথে একটু একটু করে ভেঙে যাচ্ছে তার জান্তব খোলশ! নানা রকম আবেগ, প্রতিক্রিয়া বক্ষমাঝে পারমাণবিক বোমার মতোন বিস্ফোরিত হয়ে রঙ ধনুর সাত রঙ ছড়িয়ে দিচ্ছে তার সাদা কালো অন্তরে! বুকের ভেতরটা নতুন করে সেজে উঠছে যেন তার!
আনাবিয়ার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অতঃপর নিজের খাওয়া মাংসের অবশিষ্টাংশ সে ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে, দ্বিধা ভরে তুলে ধরলো আনাবিয়ার মুখের সম্মুখে।
হঠাৎ তার এমন মন বদলে আনাবিয়া বিস্মিত হলো, চোখে হেসে কপট অভিমান দেখিয়ে বলল,
“তখন নিতে চেয়েছিলাম দাওনি, এখন আমি নিবোনা।”
বলে মুখ ফিরিয়ে শেয়ালের বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে আঙুলের ইশারা করে ডাকলো,
“ফক্সি, এদিকে আসো দেখি!”

বাচ্চাটাকে দেওয়া মাংসের টুকরোটা প্রায় শেষ, সে এখন হাড়খানাকে চিবোনোর প্রাণপণ চেষ্টায় ভীষণ ব্যাস্ত। কিন্তু আনাবিয়া ডাকতেই মাংস ফেলে সে লেজ নাড়াতে নাড়াতে গিয়ে লাফিয়ে দাড়ালো আনাবিয়ার কোলের ভেতর। ঝলসানো মাংস হতে ফক্সিকে আরও খানিক মাংস দিলো। মাংস পেয়ে ফক্সির চোখ চকচক করে উঠলো, চরম হারে লেজ নাড়িয়ে সে তেজিয়ান ভঙ্গিতে মাংস টেনে ছিড়ে ফালাফালা করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো।
আনাবিয়া শব্দ করে হেসে উঠে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো ওর।
মীর দেখলো তা, দেখা মাত্রই মুখ খানা কঠিন হয়ে গেলো ওর। খাওয়া বাদ দিয়ে ফক্সির দিকে কঠিন চোখে চেয়ে রইলো ও। যেন ওর ভাগের আদর এই পিচ্চি দেখতে জানোয়ার টা নিয়ে নিচ্ছে!

এদিকে আদর যিনি দিবেন তিনি অভিমান করেছেন তাকে আগেই কেন মাংস দেওয়া হলোনা। মীরের মুখ খানা চুপসে গেলো, যেন খুব বড় বিপদে পড়ে গেছে, এই বিপদ হতে উদ্ধারের রাস্তা ওর জানা নেই!
মীর একটু থেমে তাকালো আনাবিয়ার চোখে, হাতে এখনো আধা খাওয়া মাংসের টুকরো। এইটুকু আগেই কেন দিলোনা, এই আফসোসে ও বার বার আহত হতে রইলো! একবার হাতের মাংস তো আরেকবার আনাবিয়ার দিকে চেয়ে সে ভাবতে লাগলো কোনটা স্যাক্রিফাইস করবে? এই সুস্বাদু মাংস টুকরো, নাকি সফেদ মেয়েটির আদর!
ভাবনা চিন্তা করে সুস্বাদু মাংসের লোভ অবশেষে পরাজিত হলো আদরের লোভের নিকট! মীর হাত বাড়িয়ে মাংসটুকুকে আনাবিয়ার ঠোঁটে ছোঁয়ালো আবার, স্বর্ণাভ চোখের দৃঢ় চাহনি দিয়ে বুঝিয়ে দিলো,

“খেতেই হবে, এবং খেয়ে আমাকে আদর দিতে হবে। নইলে আমি ভায়োলেন্ট হয়ে যেতে পারি।”
দুজনের এই নিরব দ্বন্দ্বের মাঝে ফক্সি খাওয়া রেখে লেজ নাড়িয়ে এগিয়ে এলো আনাবিয়ার কাছে, কিন্তু ওকে কাছাকাছি আসতে দেখা মাত্রই মীরের বন্য মনে ক্রোধ জন্মালো ভীষণ, হিংসাত্মক মুখভঙ্গি করে ফক্সিকে এক থাপ্পড়ে সে ছুড়ে ফেলে দিলো কয়েক হাত দূরে!
‘গ্রারররররর’ শব্দ করে বুঝিয়ে দিলো এই মেয়েটি একান্তই তার। এর আদর, স্পর্শ পাওয়ার অধিকার টুকুও শুধুমাত্র তার, এখানে যেন সে ভুলেও ভাগ বসাতে না আসে!
পরক্ষণেই সকস্ত ক্রোধ ফেলে সে আনাবিয়ার দিকে ফিরে তাকালো। আগের মতোই নিষ্পাপ চাহনি নিয়ে আনাবিয়ার ঠোঁটের ওপর ছোয়ালো মাংস টুকরো। আনাবিয়া ঠোঁট গোল করে হতাশ ভঙ্গিতে শ্বাস ছাড়লো একটা, এই ছেলে শোধরাবার নয়৷ তারপর কামড়ে নিলো মাংস থেকে একটুখানি।

খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে আনাবিয়া যখন ডার্ক প্যালেসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলো তখন বেলা দুপুর।
মীর আর ফক্সি দুজন বসে আছে আবার পাশাপাশি, ফক্সি ভয়ে চুপসে আছে, কান নিচের দিকে ঝুলে আছে তার। পাশে বসা এই বিশাল বপু যদি আবার তাকে আছাড় মেরে বসে সেই আশঙ্কায় দুরুদুরু করছে তার বুক।
আনাবিয়া হুডির হুড মাথায় চড়িয়ে দিতে দিতে দুজনের উদ্দ্যেশ্যে বলল,
“আমি বেরোচ্ছি, রাতেই ফিরে আসার চেষ্টা করবো। দুজনের জন্য খাবার আলাদা করে রেখেছি, কেউ কারো খাবারে ভাগ বসাবে না৷
আর মীরি….!”
মীর নিজের সম্বোধন শুনে টান টান হয়ে বসলো। এই অল্প সময়ের ব্যাবধানে নিজের নামখানা সে আয়ত্ত করে ফেলেছে, অল্প স্বল্প বুঝতে শিখেছে যেন আনাবিয়ার বলা ভাষা, স্মৃতিতে ফিরছে অক্ষর-বর্ণের সমাহার। আনাবিয়া বলল,

“ফক্সির দায়িত্ব তোমার ওপর, ওকে যদি আর একটাও আঘাত করেছো তবে তোমাকে আমি এখানেই ফেলে রেখে যাবো, আর ফক্সি কে সাথে নিয়ে যাবো, গট ইট?”
শেষোক্ত কথাটা তর্জনী উঁচিয়ে বলল আনাবিয়া। মীর ঘাড় ঘুরিয়ে ফক্সির দিকে একবার চোখ পাকিয়ে তাকালো, ফক্সি ওর চাহনি দেখে মিইয়ে গেলো আরও। পরক্ষণেই বেজার মুখে ফিরলো আবার আনাবিয়ার দিকে। আনাবিয়া বুঝলো সভ্য হতে সে রাজি হয়েছে।
দুজনকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ও ছুটলো ডার্ক প্যালেসের দিকে। কিন্তু আনাবিয়া চোখের আড়াল হতেই মীর ঝটিতি ফিরে তাকালো পাশে চুপচাপ বসে থাকা ফক্সির দিকে।
ফক্সি ওকে এভাবে তাকাতে দেখে কাচুমাচু ভঙ্গিতে একপা একপা করে সরে যেতে চাইলো, কিন্তু তার আগেই মীরের বিশাল হাতের একটা শক্তিশালী থাপ্পড়ে ছিটকে গিয়ে পড়লো সে দূরের বালুর ভেতর৷

ভর দুপুর, দেমিয়ান প্রাসাদের রয়্যাল ফ্লোরের ক্রিস্টালের তৈরি জানালার ওপর রোদ পড়ে ঝলমল ঝলমল করছে। কামরায় চেয়ারে বসে কিছু কাগজপত্র নাড়াচাড়া করছে ইলহান।
সিংহাসন খানা এখনো কাঁটায় মোড়ানো, সেখানে বসার আর সুযোগ নেই। তাই নিজের জন্য আলাদা চেয়ার তৈরি করে নিয়েছে ও সিংহাসনেরি আদলে৷
টেবিলের ওপর ডানদিকে শূন্যে ঝুলছে একটা হলোস্ক্রিন, সেখানে ভেসে উঠে আছে পঞ্চদ্বীপের সীমান্ত, বর্ডার গার্ডদের প্রতিমুহূর্তে পাঠানো আপডেট এসে জমা হচ্ছে স্ক্রিনের এক কোণায়৷

পূর্বে অ্যানিম্যাল টাউনের ফ্যালকন, ঈগল আর শকুন দের ওপর দায়িত্ব ছিলো সম্পুর্ন বর্ডার নখদর্পনে রাখার, তাদের কাজে সামান্যতম গাফিলতি হতোনা৷ সর্বদা অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় ওরা সীমান্ত পাহারা দিতো।
কিন্তু এখন ওদেরকে বাদ দিয়ে বেশ ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে। পূর্বে আকাশ পথ নিয়ে কোনো অসুবিধাই ছিলোনা, আকাশ পথের জন্য ওই শিকারী পাখি গুলোই যথেষ্ট ছিলো। তাই কখনো আকাশ পথের জন্য কোনো ডিফেন্সিভ প্রযুক্তিই তৈরি করা হয়নি। এখন নতুন করে তৈরি করাও অনেক সময়সাপেক্ষ। বর্তমানে শুধু মনুষ্য প্রহরী দিয়ে কাজ চালানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে৷
এলোমেলো চুলে থুতনির নিচে এক হাত ঠেকিয়ে কাগজে চোখ রেখে ইলহান তাই ভেবে চলেছে আনাবিয়ার সাথে একটা বিজনেস ডিল করার কথা। কিন্তু ওই বেপরোয়া মেয়েকে রাজি কিভাবে করাবে সেটা কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না।

ওর ভাবনার মাঝেই টেবিলের স্বচ্ছ স্ক্রিনে ভেসে উঠলো ইযানের নাম। ভেতরে আসার অনুমতি চায় সে।
ইলহানের মেজাজ গরম হলো, ছুটির দিনে দুপুরের খাবারের আগ মুহুর্তে ও একা থাকতে পছন্দ করে। ইযানকে বার বার বলে দিয়েছে এই সময়ে যেন কোনো কারণে ওকে বিরক্ত না করা হয়, কিন্তু ওই অসভ্যটার সব প্রয়োজন যেন এই সময়েই হয়!
স্ক্রিনে সোয়াইপ করে ইলহান খুলে দিলো দরজা। ইযান সাথে সাথেই ঢুকলো ভেতরে। ইলহান বিরক্তি নিয়ে তাকাতেই কিছুটা মিইয়ে গিয়ে ইযান বলল,
“ইয়োর ম্যাজেস্টি, শেহজাদীর সাথের ছেলে গুলো আপনার সাথে দেখা করতে চায়, বলছে আর্জেন্ট!”
ইলহানের ভ্রু কুচকালো, আনাবিয়ার ছেলেগুলো ওর সাথে দেখা করতে চায় ভেবে বেশ অবাকই হলো। ভাবলো কিছুক্ষণ, হঠাৎ কি এমন হলো যে অসভ্য গুলো দেখা করতে এসেছে, সেটাও ওর সাথে! কোথাও কোনো বিপদ হলোনা তো!
ওকে চুপচাপ ভাবতে দেখে ইযান ইতস্তত স্বরে বলল,

“ইয়োর ম্যাজেস্টি, আপনি বললে ওদেরকে এখনি চলে যেতে বলবো।”
ইলহান তৎক্ষনাৎ বাধা দিয়ে বলল,
“না, আসতে দাও।”
ইযান কিঞ্চিৎ বিস্মিত হয়ে বেরিয়ে গেলো বাইরে, সে ভাবেওনি এতকিছুর পর হিজ ম্যাজেস্টি ওই ফাউল ছেলে গুলোর সাথে কথা বলতে সম্মতি দিবেন! বারান্দা পেরিয়ে রয়্যাল ফ্লোরের বাইরে বেরিয়ে এসে ওয়্যেটিং রুমের দিকে এগোলো সে। ভেতরে ঢুকে সোফায় বসে থাকা ফ্যালকন, লিও আর হাইনার দিকে তাকিয়ে সে বেজার মুখে বলল,

“এসো আমার সাথে।”
বলেই বেরিয়ে গেলো আবার। ওরা তিনজন দ্রুত পায়ে উঠে এগোলো ইযানের পেছন পেছন।
ইলহান কামরার ভেতর পায়চারি করছে। কি কি হতে পারে, কোন কারণে ছেলে গুলো ওর সাথে দেখা করতে আসতে পারে তার একটা সম্ভাব্য তালিকা করে নিচ্ছে মনে মনে।
বাচ্চারা ইযানের পেছন পেছন রয়্যাল ফ্লোরে ঢুকতেই পুরোনো স্মৃতি এসে যেন জাপ্টে ধরলো ওদের। চারদিকে তাকাতেই অনেক বছর পূর্বের জীবন মনে পড়লো ওদের, যখন ওরা সকলেই এই স্থানে হুটোপুটি করে বেড়াতো!
ওদের রয়্যাল জ্যু নামক সেই স্মৃতিবিজড়িত কামরাতে সময় হলেই লাইন বেধে পড়তে বসা, কোকো ভাইজানের সময়ে অসময়ের অত্যাচার, ফ্যালকনকে কারণে অকারণে খোচানো, শেহাজাদীর মিষ্টি আদর, হিজ ম্যাজেস্টির ধমকানি, ইয়াসমিনের সাথের খুনসুটি, মহসিনের সাথের দুষ্টুমি— সবকিছুই, সমস্ত স্মৃতিই যেন চোখের সামনে এসে লুটিয়ে পড়লো ওদের! কি দিনই না ছিলো সেগুলো, কত সুখময় দিন! আর কি কখনো ওই দিন গুলো ফিরবেনা? কখনোই না?

বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো লিওর, চোখের কোণে সামান্য বাষ্প এসে ভিড় জমালো। একবার যদি অতীতে ফেরা যেতো, তবে ও আর কখনোই এই জ্বালাময়ী বর্তমানে ফেরত আসতে চাইতো না। পরক্ষণে লিন্ডার চেহারাটা মনে পড়তেই মত বদলালো লিওর।
প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মে চলে যে! তার নানা রকম কান্ডের জন্য মানুষের জীবনে কত বিচিত্র ঘটনাই না ঘটে!
ইলহানের অনুমতি নিয়ে অতঃপর কামরার দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো ইযান, ওর পেছন পেছন লিও ফ্যালকন হাইনা৷
ইলহান পূর্বের স্থানে গিয়ে বসেছিলো আবার, ইযান একপাশে সরে গিয়ে দাঁড়ালো। লিও ফ্যালকন হাইনা গিয়ে দাড়ালো টেবিলের সম্মুখে, ইলহানের মুখোমুখি৷ অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাথা নুইয়ে আনুগত্য জানালো। ইলহান ওদের থমথমে হয়ে থাকা চেহারা গুলো জহুরি চোখে পরখ করে নিয়ে বলল,
“বলো, হোয়াটস দ্যা আর্জেন্ট ম্যাটার?”
“শেহজাদীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”

মেঝের দিকে চোখ রেখে বলল লিও, লিওর কথা শোনা মাত্রই ইলহানের নির্বিকার মুখে একই সাথে বিস্ময় আর ভয় এসে ভর করলো। ঝটিতি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বিস্মিত, উদ্বিগ্ন স্বরে অস্থির হয়ে শুধোলো,
“খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মানে কি? কখন থেকে? কোথায় গেছিলো সে? সাথে আর কে আছে? নাকি ও একা একা?”
“গ্‌-গত পরশু সকালে বেরিয়েছিলেন, সাথে কোকো ভাইজান আর আলফাদ ছিলো। তিনজনের কেউই ফেরেনি। ফোনে পাচ্ছিলামনা কাউকে, তাই আমরা সকলে খুঁজতে বেরিয়েছিলাম। জঙ্গলের গভীরে গেলে একটা নেকড়ে জানালো শেহজাদী কোকো ভাইজান আর আলফাদকে সঙ্গে নিয়ে ডার্ক প্যালেসে ঢুকেছেন, আর বের হননি!”
ইলহান শঙ্কিত চেহারায় শুনে যাচ্ছিলো ওদের কথা। ডার্ক প্যালেস শুনেই থমকালো ও।

আনাবিয়া ডার্ক প্যালেসে কেন গেছিলো? ও কি কোনো ভাবে বুঝতে পেরেছে মীর এখনো বেঁচে আছে? ও কি মীরকে খুঁজতে গেছে ডার্ক প্যালেসে? নইলে ওর ডার্ক প্যালেসে যাওয়ার আর কি কারণ থাকতে পারে!
অস্থির হয়ে ভাবতে লাগলো ইলহান, শ্বাস প্রশ্বাসের গতি বেড়ে গেলো হঠাৎ! আনাবিয়া মীরকে খুঁজতে গিয়েছে মানেই ও পুরোপুরি নিশ্চিত মীর এখনো জীবিত! ইলহান দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড়িয়ে বলে উঠলো,
“এই মেয়ে….এই মেয়েই আমাকে শেষ করবে! ওর জন্যই আমার সব শেষ হবে! কেন আমি মীরকে সেদিন মেরে ফেললাম না? কেন ওকে দয়া দেখিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিলাম?”

পরক্ষণেই ইলহান থমকালো। আনাবিয়া এখনো ডার্ক প্যালেস হতে বের হয়নি কেন? গত পরশু সকালে গেলে রাতেই সেখানে পৌছে যাওয়ার কথা, তবে?
ওর ঘ্রাণ শক্তি প্রখর, মীরকে তুড়ি মারার আগেই ও খুঁজে পেতো সেখানে। কিন্তু মীরকে তো আনাবিয়া সেখানে পাবেইনা, তবে এখনো সে বের হয়নি কেন? তবে কি…. তবে কি আনাবিয়া….. আনাবিয়া ওই দরজার কাছে পৌছে যায়নি তো! ও তো জানেনা সেখানে আর কোনো কামরা নেই, দরজা খুললেই সোজা নিচে গিয়ে পড়বে! আর সেখানে…. সেখানে….!
আর ভাবতে পারলোনা ইলহান, দম আটকে আসতে চাইলো ওর। যত যা-ই হোক আনাবিয়া ওরই বংশের মেয়ে, পঞ্চদ্বীপের শেহজাদী! ইলহান ওদের পতন চায়, কিন্তু মৃত্যু নয়, কিছুতেই নয়! চোখ মুখ শক্ত করে কামরা থেকে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে যেতে যেতে চেচিয়ে ইযানকে বলল,
“ইযান, আমার গাড়ি বের করো এখনি!”

কোকো আর আলফাদের কামরায় এই মুহুর্তে মুখোমুখি বসে আছে কোকো আর রেক্সা, মেয়েটির নাম যে রেক্সা সেটা কোকো দু মিনিট হলো জানতে পেরেছে।
দুজনে মুখোমুখি বসে আছে ঠিকই কিন্তু কেউ কারোর দিকে তাকিয়ে নেই। রেক্সা তাকিয়ে আছে নিজের বা দিকের জানালার দিকে, কোকো তাকিয়ে আছে তার বা দিকের জানালার দিকে। আর আলফাদ থমথমে মুখে বসে আছে এদের দুজনের পাশে।

কোকোকে সে বলেছে ও যদি রেক্সা কে সর‍্যি না বলে তবে রেক্সা আর খাবার বাড়িয়ে দিবে না। সুতরাং খাবারের মায়ায় হোক বা আলফাদের জোরাজোরিতে, কোকো সর‍্যি বলতে শেষমেশ রাজি হয়েছে।
রাজি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু রেক্সাকে অনেক অনুনয় বিনয় করে হাজির করার পর কোকো এখন মেয়েটির দিকে তাকিয়ে পর্যন্ত দেখছেনা, সর‍্যি বলা দূরের কথা!
আলফাদ উভয়সংকটে পড়ে কোকোর দিকে হতাশ চোখে তাকিয়ে আছে, এই কুমির নামক গন্ডারটাকে নিয়ে সে কি করবে সেটাই ভেবে চলেছে যেন৷

“কারো কিছু বলার না থাকলে আমি চললাম, আমার কাজ আছে।”
বলে রেক্সা বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লো হঠাৎ, আলফাদ হায় হায় করে উঠে বলল,
“আরে না না, আপনি কোথায় চললেন? ও বলবে, বলবে। কোনোদিন কাউকে বলেনি তো তাই একটু নার্ভাস হয়ে আছে। আপনি যাবেন না প্লিজ!”
বলে কটমট করে কোকোর দিকে তাকিয়ে একটা গুতা দিয়ে তাগাদা দিলো সর‍্যি বলার জন্য। কোকো বা দিক থেকে মুখ সরিয়ে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলল,

“সর‍্যি।”
“আপনি কি ট্যারা? নাকি সিলিং এ আমার আলাদা ভার্সন দেখতে পাচ্ছেন? আমি নিচে বসে আছি, ওপরে নয়।”
কোকো আলফাদের দিকে ধ্বংসাত্মক চোখে তাকালো, আলফাদ দুহাত জোর করে করুণ চোখে তাকিয়ে বোঝালো,
“এই প্রথম এই শেষ, আর তোকে কিছু করতে হবে না। এবারের মতোন আমার কথা খানা শোন!”
কোকো এবার তীর্যক চোখে সরাসরি তাকালো মেয়েটির চোখের দিকে। ওর এমন চাহনি দেখে মেয়েটি হঠাৎ হকচকিয়ে গেলো। কোকো গমগমে গলায় বলল,

“সর‍্যি।”
বলেই চোখ মুখ শক্ত করে মেয়েটির সামনে থেকে উঠে হনহনিয়ে চলে গেলো বাইরে। ও চলে যেতেই রেক্সা আলফাদের দিকে ফিরে বিরক্তি পূর্ণ কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
“এমন কেন ও?”
“ছোট বেলা থেকে আদরে আদরে ওকে বাদর করে ফেলেছে আমাদের প্রাণপ্রিয় শেহজাদী, মাটিতে তাই পা পড়েনা ওর। আপনি ওর জীবনে দ্বিতীয় ব্যাক্তি যাকে ও কোনো ভুলের জন্য সর‍্যি বলেছে। হিস্ট্রি হয়ে গেছে হিস্ট্রি!”
বলে আলফাদ নিজেও বেরিয়ে গেলো কোকো কই গেলো খুঁজতে।

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৩

কোকোর এই বদ্ধ পরিবেশে এমনিতেও মেজাজ গরম হচ্ছিলো, তারপর এই আলফাদের কারণে মেয়েটির কাছে সর‍্যি বলে পরাজিত হওয়ার কারণে ওর মেজাজ তুঙ্গে উঠে গেছে। রয়্যাল গ্রেড থেকে তাই ও বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে এলো বাইরে। একবার হেটে ডার্ক প্যালেসের প্রবেশ দ্বার পর্যন্ত গিয়ে দেখে আসবে দরজা খোলা যায় কিনা।
কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পরই সুস্থ সবল আনাবিয়াকে দ্রুত পায়ে এদিকেই আসতে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেলো ও।

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here