বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৭
রানী আমিনা
রাত নেমে গেছে, রেড জোনের বিরাট বিরাট গাছপালা গুলোর সবুজ পাতা আর কাণ্ডে মৃদু মৃদু নীলচে আলো জ্বলছে। বড় বড় জোনাকি গুলো মিটিমিটি করে জ্বলতে জ্বলতে উড়ে চলেছে ধীর বেগে। জঙ্গল জুড়ে বাতাস বইছে মৃদু মন্দ গতিতে।
কোকো, ফ্যালকন আর হাইনা বসে ছিলো ইযানের পাশে। লিও কামরায় গেছে, লিন্ডার জ্বর বেড়েছে বেশ, লিও ব্যাস্ত ওর দেখাশোনা করতে। ফাতমা মাঝে মাঝেই এসে দেখছে জ্বরের মাত্রা।
শার্লট রাতের খাবারের জোগাড়যন্ত্র করছে, রেক্সা আর ব্রায়ান সাহায্য করছে ওকে। মেয়েটি এসেই কেমন সবার সাথে মিলেমিশে গেছে, মনেই হচ্ছে না যে সে অপরিচিত কেউ। যেন কতদিনের চেনা জানা ওদের!
জোভি ওর প্রেমিকাকে নিয়ে ফিরে গেছে বাড়িতে। পরিস্থিতি এখন ঠান্ডা যেহেতু তাই আর এখানে থাকেনি। ওকামি, কাঞ্জি মিলে মহল গার্ড দিচ্ছে, আর আলফাদ গিয়ে ঘুমোচ্ছে। এই কদিন কোকোর পিছে গাঁধার খাটুনি খাটতে গিয়ে ওর ঘুম হয়নি।
ইযানের মুখ শুকিয়ে গেছে, হিজ ম্যাজেস্টি কোথায় কি অবস্থায় আছেন জানেনা ও। তিনি বলেছিলেন কাজ শেষে তাঁর কাছে আবার ফিরে যেতে, কিন্তু এদের জন্য পারেনি ইযান। ভয় হচ্ছে ওর, না জানি ওদিকে হিজ ম্যাজেস্টি ওকে না পেয়ে কতটা রেগে আছেন!
কোকো ইযানের পাশে বসে বসে ফোন গুতাচ্ছিলো, এমন সময় শব্দ করে বেজে উঠলো ওর ফোন। স্ক্রিনে ভেসে উঠলো নাম, ‘দ্যা অ্যাপল অব মা’ আই’।
কোকো দ্রুত কল রিসিভ করে উদ্বিগ্ন গলায় শুধোলো,
“আম্মা, আপনি ঠিক আছেন? কোথায় আছেন এখন? কখন ফিরবেন?”
“একদম আমাকে একবারে এত প্রশ্ন করবিনা কোকো! আগেও অনেকবার বলেছি।”
রাগান্বিত কন্ঠে বলল আনাবিয়া, কোকো শব্দ করে হাসলো তাতে। আনাবিয়া ফোস করে শ্বাস ছেড়ে জিজ্ঞেস করলো,
“তোর আশেপাশে কে কে আছে?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“আমি, হাঁসের বাচ্চা আর হাইনা মিলে ইযানিয়াকে পাহারা দিচ্ছি আম্মা। কাউকে প্রয়োজন আপনার, আম্মা?”
“না, সাইডে গিয়ে কথা বল।”
কোকো ফ্যালকনের দিকে একবার তাকিয়ে উঠে গেলো সিড়ির ওপর থেকে, জঙ্গলের দিকে এগোতে এগোতে বলল,
“বলুন আম্মা।”
“ডার্ক প্যালেস পেরিয়ে একটা ঘন জঙ্গল পড়বে, ওই জঙ্গল পেরোলেই সমুদ্র দেখতে পারবি। সেখানে শেহজাদা ইলহান আছেন, অবস্থা খুব বেশি ভালো নয়। ইযানকে সাথে নিয়ে শেহজাদাকে প্রাসাদে পৌছে দিয়ে আসবি। ওখানে গাড়ি আছে শেহজাদার৷”
কোকো ভ্রু কুচকে শুনলো সব কথা, শেহজাদা সমুদ্র পাড়ে কি করছেন, আর তার অবস্থাই বা খারাপ কেন বুঝে আসলোনা ওর। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করলো না, সেখানে গেলেই বোঝা যাবে ব্যাপারটা কি। শুধোলো,
“আপনি কোথায় আছেন আম্মা? ফিরবেন না?”
“আমি মীরকে নিয়ে ফারহা হসপিটালের দিকে এগোচ্ছি। আপার আর্মে বুলেট লেগেছে।”
মীরের নাম শোনা মাত্রই প্রচন্ড বিস্মিত হলো কোকো, চাপা উত্তেজিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“হিজ ম্যাজেস্টিকে আপনি পেয়েছেন আম্মা? কোথায় পেয়েছেন? ও-ওনার বুলেট কিভাবে লাগলো? ওনার শরীরের অবস্থা কি এখন? আপনার সাথে আর কেউ আছে? আপনি একা একা পারবেন?”
“একবার বলেছি এত প্রশ্ন একবারে করবিনা। ফিরে এসে বলবো সব। আর এই মুহুর্তে কাউকে মীরের ব্যাপারে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। রাখছি।”
“আম্মা, শেহজাদা কে প্রাসাদে রেখে আমি আসি? আপনার একা একা কষ্ট হয়ে যাবে তো!”
আনাবিয়ার একবার মনে হলো বলে, ফারিশ থাকবে সেখানে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো কোকো যা পারবে ফারিশ তার কিছুই পারবেনা। তাছাড়া ফারিশের সাথে কথা বলতে গেলে এখনো জড়তা এসে ভর করে ওর ওপর, আর একা একা তো একদমই কম্ফোর্টেবল অনুভব করবে না৷
কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“ঠিক, আছে আসিস৷”
বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলো আনাবিয়া। ফোনটা ড্যাশবোর্ডের ওপর রেখে দিয়ে তাকালো পেছনে, রক্ত বন্ধ করার জন্য ন্যাপকিন বেধে দিয়েছিলো মীরের বাহুতে। সেটা ভিজে সম্পুর্ন লাল বর্ণ ধারণ করেছে৷ মীরের জ্ঞান আছে এখনো সামান্য, অবচেতন মনে তাকিয়ে আছে সে, মাঝে মাঝেই অত্যন্ত দুর্বল ভাবে চোখের পাতা নড়ছে তার৷
আনাবিয়া গাড়ির গতি বাড়ালো, এই মুহুর্তে ওয়াটার টানেলের ভেতর আছে সে, আর পনেরো মিনিট বাদেই টানেল শেষ হয়ে কুরো আহমারে পৌছে যাবে৷
ফক্সি আনাবিয়ার পাশের সিটে বসে আছে চুপচাপ, আনাবিয়া সিটবেল্ট লাগিয়ে দিয়েছে, নইলে গাড়ির গতির কারণে বারবার এদিক ওদিক ঝুঁকে পড়ছে ওর ছোট্ট শরীর৷ সিটের এক কোণায় কাচুমাচু হয়ে ভয়ার্ত চোখে তার দুপাশ দিয়ে সাই সাই করে পেছনে চলে যাওয়া টানেলের স্তম্ভ গুলোকে দেখছে সে৷
আনাবিয়া ওকে একবার দেখে নিয়ে মনোযোগ দিলো আবার রাস্তায়। এমন সময় শব্দ করে বেজে উঠলো ওর ফোন। হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিয়ে কানে ধরে বলল,
“বলুন ফারিশ ভাইজান।”
“শেহজাদী, ট্রাফিক ক্লিয়ারেন্স এর অর্ডার দিবো?”
“দিন, তবে হসপিটাল মুখী কোনো রোডের ট্রাফিক ক্লিয়ারেন্সের প্রয়োজন নেই। হসপিটাল রোড সবারই প্রয়োজন, আমার একার প্রয়োজনে আমি মানুষের ভোগান্তির কারণ হতে চাইনা৷”
“আপনার যেমন আদেশ শেহজাদী।”
আনাবিয়া কল বিচ্ছিন্ন করলো। ফোনটা রেখে দিয়ে বুক ভরে শ্বাস নিলো একটা, এরপর আবারও গাড়ির গতি বাড়িয়ে মনোযোগ দিলো রাস্তায়।
থমকে আছে কুরো আহমার, উপর মহল থেকে অর্ডার এসেছে ট্রাফিক ক্লিয়ারেন্সের। শিরো মিদোরি হতে কুরো আহমারে প্রবেশের পানি পথের সম্মুখের রাস্তা সম্পুর্ন ফাঁকা, রাস্তার ওপর একটা পিপড়া পর্যন্ত নেই!
রাতের জমাট আঁধারের ভেতর, স্ট্রিটলাইটের হলেদেটে আলোর নিচে শহরের উৎসুক জনতা ব্যারিকেড বসানো রাস্তার দুপাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে, অথচ বিরাজ করছে এক নিস্তব্ধ পিনপতন নিরাবতা! চোখে তাদের নিঃশব্দ উত্তেজনা। মুখে চাপা কৌতূহল। কেউ কারও সাথে কথা বলছে না, সকলের দৃষ্টি গিয়ে পড়েছে টানেলের প্রবেশমুখে!
দূরে কোথাও শোনা যাচ্ছে ইঞ্জিনের মৃদু, ক্ষীণ গর্জন! সেই শব্দ নিকটবর্তী হচ্ছে ধীরে ধীরে। এক অভিজাত আতঙ্কে বুকে কাঁপুনি ধরছে তাদের! কেউ কেউ সঙ্গোপনে পকেটে থাকা যান্ত্রিক বস্তুটাকে উঁচিয়ে ধরছে শিরো মিদোরির অতি মূল্যবান কোনো সদস্যের এক ঝলক ফ্রেম বন্দি করার জন্য।
অস্ত্রসজ্জিত নিরাপত্তা কর্মীরা রাস্তার দুধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে, গাড়ির ইঞ্জিনের ক্ষীণ শব্দ কানে আসতেই সতর্ক হয়ে গেলো তারা আরও, ওয়াকিটকি তে একে অপরকে জানিয়ে দিলো রয়্যাল পার্সোনেজের উপস্থিতির সংবাদ। আর তার কয়েক সেকেন্ড পরেই টানলের বডিতে সংযুক্ত রয়্যাল মেম্বার ইন্ডিকেটরে একটি আর্টিফিশিয়াল ফিমেইল ভয়েস বলে উঠলো,
“অ্যাটেনশন সিভিলিয়ান্স অ্যান্ড অল সিকিউরিটি ইউনিটস, দ্যা রয়্যাল কনভয় ইজ অন দ্যা মুভ। মেইনটেইন ডিস্ট্যান্স অ্যান্ড ফল্যো সিকিউরিটি ইনস্ট্রাকশনস। আই রিপিট, মেইনটেইন ডিসট্যান্স অ্যান্ড ফলো সিকিউরিটি ইনস্ট্রাকশনস।”
সমস্ত শহর যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেলো আরও, আর তার কিছু মুহুর্ত পরেই সিংহের ন্যায় গ্রুম গ্রুম গর্জন তুলতে তুলতে টানেল হতে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে এলো মীরের কালো রঙা গাড়িখানা!
ব্যাস্ত শহর, শহরের মানুষ, হলদেটে আলো সকল কিছুকে পেছনে ফেলে তীব্র গতিতে গর্জন শব্দ তুলে নিমিষেই চোখের আড়াল হয়ে গেলো স্বর্ণ বাধানো কালো রঙা চকচকে গাড়িটা!
উৎসুক জনতা তখনো বিস্মিত নয়নে চেয়ে রইলো এই হঠাৎ এসে নিমিষেই চোখের আড়াল হয়ে যাওয়া গাড়িটির গমন পথের দিকে।
“স্যার, ফারিশ জাবিন ভয়ানক রেগে আছেন। কেবিন এখনো রেডি হয়নি সম্পুর্ন। এত অল্প সময়ে আমরাই বা সবকিছু কিভাবে ম্যানেজ করবো বলুন!”
কাচুমাচু স্বরে বলল একজন নার্স। ম্যানেজার সামান্য ক্রোধের সাথে বলে উঠলো,
“এত গুলো লোক মিলে এখনো একটা কেবিন রেডি করতে পারলে না? যিনি আসছেন তিনি এই হস্পিটালের য়্যোনার, ভুলে যেও না! তোমাদের একটা ভুলের জন্য আমি আমার চাকরি হারাতে পারি, বুঝতে পেরেছো? দ্রুত সবকিছু অ্যারেঞ্জ করো যেভাবে পারো। কিভাবে করবে আমি জানিনা!”
বলেই হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি। অন্য নার্সগুলো সেদিকে কিয়ৎক্ষণ অসহায় চোখে তাকিয়ে থেকে আবার লেগে পড়লো কেবিন রেডি করার কাজে৷
ম্যানেজার ভি আই পি কেবিন থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন নিজের কেবিনে। কিছুদূর যেতেই চোখের সামনে লম্বা চওড়া ফারিশ জাবিনকে দেখে থমকে দাড়ালেন তিনি, মুখে অপ্রস্তুত হাসি ফুটিয়ে এসে বিনীত ভঙ্গিতে বললেন,
“স্যার কেবিন প্রায় তৈরি। শেহজাদীর পেশেন্টের সকল সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা প্রস্তুত আছি। আমাদের সকল ট্যালেন্টেড টিম প্রিপেয়ার্ড হয়ে আছে তাঁকে সকল সেবা দেওয়ার জন্য৷”
“হুম।”
বলে ফারিশ তাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো কেবিন পরিদর্শনে৷ ম্যানেজার ওর যাওয়ার দিকে একবার আশাহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে এগোলেন বাইরের দিকে। শেহজাদীকে কি করে, কোন ভাবে অভ্যর্থনা জানালে তাঁকে খুশি করা যাবে সে চিন্তায় কপালে ঘাম জমতে লাগলো তার।
তখুনি কেউ একজন চিৎকার করে বলল,
“শেহজাদী পৌছেছেন!”
ম্যানেজার তার ভারী শরীর নিয়ে ছুটলো দ্রুত। গাড়ির শব্দ শুনতে পেয়ে, হাসপাতালের সমস্ত স্টাফ আর সিকিউরিটি ইউনিট দ্রুত লেগে পড়লো নিজেদের কাজে৷ সমস্ত হসপিটালে মূহুর্তেই পড়ে গেলো সাড়া। ম্যানেজারের চিৎকার চেচামেচি শোনা গেলো, কাকে যেন চেচিয়ে বললেন,
“নোলান, মেডিক্যাল টিমকে এখুনি কেবিনে গিয়ে উপস্থিত বলো, আর সেভেন ফিট লং স্ট্রেচারের দায়িত্বে কে ছিলো? তাকে দ্রুত উপস্থিত হতে বলো। কোনো ভুল আমি আজ বরদাস্ত করবোনা।”
বলতে বলতে ছুটলেন তিনি। নোলান নামক লোকটি ছুটলো মেডিক্যাল টিমকে সংবাদ জানাতে। চারদিকে ডাক্তার নার্সদের হাঁকডাক, ছোটাছুটি, স্টাফ দের তড়িঘড়ি কাজকর্ম সব মিলিয়ে এক বিরাট আওয়াজের বন্যা ছড়িয়ে পড়লো চারপাশে। অন্যান্য রোগী আর তাদের আত্মীয় স্বজনেরা হাসপাতালের এই হঠাৎ জাগরণে যারপনাই অবাক হলো! উৎসুক চিত্তে বাইরে বেরিয়ে এলো অনেকে কি হচ্ছে দেখার জন্য।
কিন্তু তাদেরকে বেরিয়ে আসতে দেখে চলতি পথের স্টাফরা ধমক দিয়ে বলল,
“কেউ বাইরে বেরোবেন না, রাস্তা খালি করুন।”
ভয়ে ভয়ে তারা আবার গিয়ে ঢুকলো যে যার কেবিনে। ফারিশ খবর পেয়ে বাইরে এলো দ্রুত। আনাবিয়ার গাড়ি ততক্ষণে গেইটে এসে পৌছেছে, ব্লাক স্যুট পরিহিত স্পেশাল ইউনিটের নিরাপত্তা কর্মীরা এসে দাঁড়িয়েছে গেইটের চতুর্দিকে। রয়্যাল ভেইকল দেখে উৎসুক জনতার ঢল নেমেছে, সকলেই দেখতে চায় কে বের হয় এই কালো রঙা স্বর্ণ বাধানো গাড়ি হতে! নিরাপত্তা কর্মীরা প্রাণপণে ঠেকিয়ে রাখছে তাদের৷
একদল কর্মী ইতোমধ্যে স্ট্রেচার নিয়ে হাজির, ওরা অপেক্ষায় আছে কখন গাড়ির দরজা খুলে সেই অতি রহস্যময়ী ভয়ানক সুন্দরী মেয়েটি বাইরে বের হবে৷
ম্যানেজার সিড়ি বেয়ে নেমে ছুটে এলো গাড়ির কাছে। তাকে দেখা মাত্রই নেমে গেলো ড্রাইভিং সিটের পাশের জানালার গ্লাস। ম্যানেজার থতমত ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে প্রস্তুত হয়ে কিছু বলার আগেই ভেতর হতে একটি শীতল মিষ্টি নারীকন্ঠ এসে বাড়ি খেলো তার কানের পর্দায়,
“সিভিলিয়ান দের যত দ্রুত সম্ভব সরিয়ে ফেলুন, আমি বেরোবো।”
ম্যানেজার হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলেন, ফারিশও নেমে এলো ততক্ষণে। নিরাপত্তা কর্মীদেরকে সহায়তায় দ্রুতই সরিয়ে দিলো উপস্থিত জনতাকে।
বাইরে ফাঁকা হতে শুরু করেছে দেখা মাত্রই দরজা খুলে লাফিয়ে নামলো আনাবিয়া, ওকে নামতে দেখে স্ট্রেচার হাতে ছুটে এলো কয়েকজন স্টাফ। আনাবিয়া গিয়ে পেছনের সিটের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে মীরের অসাড় শররের ঊর্ধ্বাংশ উচু করে ধরলো দ্রুত। ফারিশও ছুটে এলো সেখানে।
পেশেন্টকে নামাতে ভেতরে ঢুকলো সেও। ভেতরে ঢুকে মীরকে দেখা মাত্রই ভূত দেখার মতো চমকালো সে। হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে রইলো মীরের মুখপানে৷
“হাত লাগান ফারিশ ভাইজান। দ্রুত!”
ধমকে বলে উঠলো আনাবিয়া, ফারিশ তড়িঘড়ি করে এগিয়ে গেলো৷ দুজনে মিলে মীরকে টেনে হিচড়ে বের করে নিয়ে এসে শুইয়ে দিলো স্ট্রেচারে। স্টাফরা তাকে নিয়ে তৎক্ষনাৎ ছুটলো কেবিনের দিকে। মেডিক্যাল টিমের একাংশ তার শরীরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে করতে ছুটলো স্ট্রেচারের পিছে৷
আনাবিয়া ফক্সি কে বের করে গাড়ির দরজা শব্দ করে বন্ধ করে নিজেও এগোলো ভেতরের দিকে, ফক্সি ওকে অনুসরণ করে ছোট ছোট পা ফেলে দৌড়োলো।
ফারিশ নিরাপত্তা কর্মীদের নিকট গাড়ির দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে এসে ছুটলো ভেতরে। মনে তার অনেক প্রশ্ন, কিন্তু এই মুহুর্তে শেহিজাদীকে কিছু জিজ্ঞেস করার মতোন সাহস ওর হয়ে উঠছে না।
ম্যানেজার ছুটে আনাবিয়ার সামনে পৌছে ভেতরের দিকে যেতে যেতে বিনীত ভঙ্গিতে আনুগত্যের সাথে বলল,
“ইটস অ্যান অনার টু রিসিভ ইয়্যু ম্যা’ম, প্লিজ অ্যালাও ম্যি টু এস্কর্ট ইয়্যু ইনসায়্যিড।”
আনাবিয়া উত্তর না দিয়ে পা ফেললো দ্রুত। ফারিশ ছুটতে ছুটতে এসে পৌছালো আনাবিয়ার পেছনে৷ ম্যানেজারের অপ্রস্তুত দৃষ্টি পড়লো ফারিশের দিকে। ফারিশ তাকে চোখ গরম দিয়ে বুঝিয়ে দিলো সামনে থেকে সরতে। ম্যানেজার কাচুমাচু ভঙ্গিতে দ্রুত পলায়ন করলো কোথাও!
“ব্লাড গ্রুপ কি আপনার?”
ফারিশকে শুধোলো আনাবিয়া। ফারিশ অমনোযোগী ছিলো, আনাবিয়ার প্রশ্ন বুঝতে সময় লাগালো কিছুক্ষণ, তারপর বলল,
“ও পজিটিভ শেহজাদী। কোন ব্লাড গ্রুপ লাগবে আমাকে বলুন, আমি ব্যাবস্থা করবো।”
“যার তার থেকে নিলে হবে না ফারিশ ভাইজান, আমাদের ভেতরে কারো ‘এবি’ পজিটিভ ব্লাড পাওয়া যাবে?”
ফারিশ মনে মনে খুঁজলো কিছুক্ষণ, তারপর বলল,
“ক্ষমা করবেন শেহজাদী, ‘এবি’ পজিটিভ আমার জানামতে কাউকে পাচ্ছিনা৷ তবে ‘এ’ পজিটিভ পেয়েছি।”
“এবি’ না পাওয়া গেলে তখন ‘এ’ এর খোজ করবে ফারিশ। খোঁজ নাও, খোঁজ নিয়ে জানাও দ্রুত।”
বলে আনাবিয়া এগোলো সামনে, ওর পেছন পেছন লাফিয়ে চলল ফক্সি৷ ফারিশ ব্যাস্ত হয়ে কল করতে লাগলো চারদিকে৷
বিরাট প্রাসাদের বিশাল বারান্দার শ্বেত পাথরের মেঝের ওপর বিছানো কালো, নকশাদার কার্পেটের ওপর দিয়ে হেটে চলেছে এক অবয়ব। গন্তব্য অজানা। পরণে তার রাজকীয় পোশাক, ভারী পায়ের প্রতি পদক্ষেপে দুলে উঠছে তার পোশাকের পেছনে লাগানো রাজকীয় কেপ এর অগ্রভাগ৷
আনমনে হাটতে হাটতে একসময় সে এসে পৌছোলো কোনো কামরার সামনে, কিয়ৎক্ষণ অপেক্ষা করলো। অতঃপর সামান্য দ্বিধা নিয়ে দৃঢ় হাত জোড়ার একটি রাখলো সে দরজার ওপর। মৃদু ধাক্কা দিতেই দুদিকে সরে গেলো দরজার কপাট। অনিশ্চয়তা নিয়ে ধীর পায়ে ভেতরে ঢুকলো সে।
আভিজাত্যে পরিপূর্ণ একটি ভীষণ গোছালো রাজকীয় কামরা, এক কোণে একটি বিরাট সিংহাসন, কালো পাথরে গড়া। সেদিকে কিছুক্ষণ বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থেকে অতঃপর দৃষ্টি দিলো সে বিছানার ওপর।
মস্ত বিছানার সাদা রঙা, নকশাদার রেশমের চাদরের ওপর একটা ফ্লাপি টেডি নিয়ে খেলছে বছর দুয়েকের একটি ছোট্ট মেয়ে। শ্বেত শুভ্র শরীর, যেন সফেদ তুষারের ছোঁয়া লেগে আছে তার শরীরের প্রতিটি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম স্তরে!
শুভ্র চুলগুলো যেন তুষার মিশ্রিত জলধারা, যেখানে কোনো বাক নেই, রেশমের মতোন কোমল চুলের বাহার হতে যেন ঠিকরে পড়ছে ঝিকিমিকি আলোর কণা!
ঠিক যেন এক আদূরে জোছনার পুট্টুলি! বিছানা যেন এক টুকরো আকাশ, তার ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছে সে নিজের ছোট্ট ছোট্ট পা জোড়ায় টুপটাপ শব্দ তুলে! খেলতে খেলতে হাসছে, খিলখিলে, স্বর্গসদৃশ হাসি!
শেষ বিকেলের আধো আঁধারে পরিপূর্ণ কামরার ভেতর ঠিক কোহিনূরের মতোন ঝলমল করছে যেন সে!
এগিয়ে গেলো আগন্তুক, মনে হলো এই তুষার শুভ্র মেয়েটি তার জনম জনমের চেনা! আগন্তুকের এগোনোর শব্দে চোখ তুলে তাকালো মেয়েটি। মুহুর্তেই নিজের স্থানে জমে গেলো আগন্তুক!
মেয়েটির চোখের মণি….. ঠিক যেন এক ঝাঁক স্বচ্ছ স্ফটিক! তার হীরকখণ্ডের ন্যায় ঝলমলে চোখের চাহনি যেন তীরের ফলার মতোন তীব্র বেগে ছুটে এসে ভেদ করলো আগন্তুকের হৃদপিণ্ড! হঠাৎ মনে হলো এই চোখে তাকিয়ে সে যেন শত শত বছর পেরিয়ে এসেছে!
ডাকলো সে,
“শিনজো!”
এই মেয়েটির নাম সে কিভাবে জানে? কিভাবে স্মরণে আছে একে? কি হয় এই মেয়েটি ওর? ভাবলো আগন্তুক।
কিন্তু যাকে ডাকা হলো সে আগন্তুকের এই হতভম্ব চেহারাকে পাত্তাই দিলোনা। উপরন্তু তাকে দেখে প্রচন্ড খুশিতে আত্মহারা হয়ে, সমস্ত খেলা ফেলে খিলখিলে হাসি হেসে, সফেদ চুলে ঝিকিমিকি ঢেউ তুলে, রেশমের বিছানার ওপর দিয়ে দৌড়ে এসে তার কাছে যাবার জন্য লাফিয়ে নামার চেষ্টা করলো নিচে৷
বুক কাঁপলো আগন্তকের, ঝড়ের বেগে ছুটে গেলো সে! বিছানা থেকে লাফিয়ে মেঝেতে পড়ার আগেই দুহাতে জাপটে নিজের বুকের ভেতর পুরে নিলো তার শিনজোকে। শক্ত করে ধরে কপট শাসনচ্ছলে, গলায় জোর দিয়ে বলল,
বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৬
“এভাবে নামতে আসছে শিনজো? কবে আমাকে হার্ট অ্যাটাক দিবে তুমি!”
কিন্তু যাকে বকাটা দেওয়া হলো তার কোনো ভাবান্তর হলো না, সে লাফিয়ে ঝাপিয়ে আগন্তুকের গলা সজোরে জড়িয়ে ধরে, তাকে সমস্ত দিন না পাওয়ার অভাব পূরণ করতে চোখ বুজে মুখ ডুবিয়ে পড়ে রইলো তার বুকে। আধো আধো বুলি ফুটিয়ে বলল,
“মীলি পঁতা….”
