বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৯

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৯
রানী আমিনা

রাতের এখন প্রায় দুইটা। হাসপাতালের কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্রে সাক্ষর করছে আনাবিয়া। মীরকে নিয়ে একটু পরেই বেরিয়ে যাবে ও হাসপাতাল হতে। ভোর হওয়ার আগেই নিজের রাজমহলে গিয়ে উঠবে৷ সেখানে ইতোমধ্যে সংবাদ পৌছে দেওয়া হয়েছে, ওদিকে হয়তো এতক্ষণে ভীষণ প্রস্তুতি নেওয়ার হিড়িক পড়েছে!
মীরকে সিডেটিভ দেওয়া হয়েছে। ঘুমিয়ে আছে সে এখন। ফক্সি কেবিনের এদিক থেকে ওদিক ছুটে চলেছে একটা বোলতার পেছনে৷ কোকো আধা ঘন্টা হলো হাসপাতালে এসে পৌছেছে, রেক্সাকে আনাবিয়ার পাশে রেখে সে বেরিয়ে গেছে কোথাও, এখনো ফেরেনি৷

মেডিক্যাল টিমের সাথে বিশেষ বৈঠক হয়েছে আনাবিয়ার। সকলকে আজ রাতের ব্যাপারে মুখ তালাবদ্ধ রাখার আদেশ জারি করেছে সে। এই ব্যাপারের কোনো তথ্যাদি যেন কোথাও না থাকে, এবং কোনো ভাবেই যেন বাদশাহর জীবিত থাকার খবর বাইরে না যায় তার জন্য যথাযথ ব্যাবস্থা নেওয়া হয়েছে। যদি কোনোভাবে কোনো নিউজ স্প্রেড হয় তবে মেডিক্যাল টিমের সাথে সাথে হাসপাতালে আজ উপস্থিত প্রতিটি স্টাফ, নার্স, ডক্টরকে পঞ্চদ্বীপ হতে তৎক্ষনাৎ গুম করে দেওয়া হবে।
কামরার এক কোণে সোফায় বসে আছে ফারিশ, ওর পাশে বছর সাতাশের কাছাকাছি চেহারার দুজন পুরুষ৷ এরা জায়ানের প্রথম স্ত্রীর সন্তান।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

জায়ানের স্ত্রী তিনজন। প্রথম স্ত্রী অনেক আগেই গত হয়েছেন, তার থেকে জায়ানের এই দুই ছেলে। এদের সাথে আনাবিয়ার এই প্রথম সাক্ষাৎ হলো। সাক্ষাৎ বলতে শুধু দেখা টুকুই হয়েছে, কথা হয়নি এখনো। কথা বলার মতো সময় হয়ে ওঠেনি আনাবিয়ার।
ওদের পাশে বসা আরেকটি ছোকরা গোছের ছেলে, সে জায়ানের তৃতীয় পক্ষের সন্তান। দ্বিতীয় স্ত্রীর তিন মেয়ে, তিনজনই বিবাহিত, সংসারে পুরোদমে মনোনিবেশ করেছে তারা। দ্বিতীয় স্ত্রী খুব সম্ভবত বার্ধক্য জনিত কারণে মারা গেছেন বছর পাঁচেক হলো।

ভাইদের সাথে বোন গুলোর বিশেষ যোগাযোগ কখনোই ছিলোনা। জায়ান সাদি মারা যাবার পর যোগাযোগ একেবারেই কমে এসেছে। বর্তমানে এরা তিন ভাই ওদের ছোট মায়ের সাথে একই বাড়িতে বসবাস করছে। তিনজনেই কিছুটা জায়ান সাদির মতোন দেখতে। বড় দুই ছেলে বেশি, ছোট টার চেহারা একটু অন্যরকম, হয়তো মায়ের চেহারা পেয়েছে কিছুটা৷ আনাবিয়া ওদের নাম পর্যন্ত শোনেনি এখনো।
কাগজ পত্র গুলো সাক্ষর শেষে ম্যানেজারের কাছে হস্তান্তর করে ঘুরে বসলো আনাবিয়া৷ দৃষ্টি দিলো জায়ানের ছেলেদের দিকে। বড় দুই ছেলে ওর থেকে বয়সে বড়, ফারিশের থেকেও হয়তো কয়েক বছরের সিনিয়র হবে৷ ছোটজন ফ্যালকনের বয়সী।

রেক্সা দাঁড়িয়ে ছিলো পাশেই, আনাবিয়ার কাজ শেষ হতেই কাছে এসে সামান্য ঝুঁকে চাপা সুরে জিজ্ঞেস করলো,
“শেহজাদী, আপনি গোসল দিতে চাইলে বলবেন, আমি এক্ষুনি ব্যাবস্থা করে দিবো।”
“প্রয়োজন নেই রেক্সা, রাজমহলে পৌঁছে গোসল দিবো। কোকো কোথায় গেছে?”
কোকোর নাম শুনেই রেক্সার মুখখানা মলিন হয়ে গেলো। মনে পড়লো মহল থেকে বের হওয়ার সময় ওকে বলা কথা৷ কোকোকে যতই অপছন্দ করুক, সস্তা ভাতের হোটেলে মুখ দিবেনা কথাটা ওর জন্য বেশ অপমান জনক!
ছোট করে একটা শ্বাস ছেড়ে কিঞ্চিৎ রোষের সাথে সে উত্তর দিলো,
“ক্ষমা করবেন শেহজাদী, তিনি আমাকে বলে যাননি।”

আনাবিয়া বুঝলো কোথাও কোনো ঝামেলা পাকিয়েছে তার বড় ছেলে। লাই দিয়ে দিয়ে একটা পাঁজিকে তৈরি করেছে যে কিনা শুধু তার আম্মার কাছে পীর, বাকিদের সাথে তার ব্যাবহার জঘন্য!
আনাবিয়া সামনে তাকিয়ে সোজা হয়ে বসলো, ওকে সোজা হয়ে বসতে দেখে ফারিশ সহ বাকিরাও টানটান হয়ে বসলো, ভদ্রোচিত ভাবে। ফারিশ গলা খাকারি দিয়ে জায়ানের ছেলেদেরকে দেখিয়ে বলল,
“লে’মি ইন্ট্রোডিউস, ইনি হলেন আমাদের জাভেদ ভাইজান, জায়ান চাচাজানের বড় ছেলে জাভেদ সাদি।”
পাশে বসা সাদা শার্টের সাথে রিমলেস চশমা পরা ছেলেটাকে দেখিয়ে বলল ফারিশ, ছেলেটি আনুগত্যের সাথে মাথা নাড়ালো। আনাবিয়া দেখলো তাকে, পিউর জেন্টেলম্যান। চশমার কারণে বেশ বিজ্ঞ দেখাচ্ছে তাকে, ব্রিলিয়ান্ট ব্রিলিয়ান্ট একটা ভাইব দিচ্ছে। ক্লাসের স্টাইলিশ ফার্স্ট বয় গুলো এমন লুক দেয়।

“আর ইনি হলেন জেসার ভাইজান, আর ও হলো জুনায়েদ, জুনায়েদ সাদি, জায়ান চাচাজানের ছোট ছেলে।”
পাশাপাশি বসা দু ভাইকে দেখিয়ে বলল ফারিশ৷ আনাবিয়া সৌজন্য সূচক মাথা নাড়ালো। ফারিশ এবার আনাবিয়াকে দেখিয়ে জাভেদ জেসারকে বলল,
“আর ইনি হলেন আমাদের মোস্ট বিউটিফুল, মোস্ট প্রেশাস, মোস্ট ভ্যালুয়েবল, মোস্ট গর্জিয়াস, মোস্ট স্পেইশাল, ওয়ান অ্যান্ড ওনলি শেহজাদী আনাবিয়া ফারহা দেমিয়ান।”
আনাবিয়া থুতনিতে ভাজ ফেলে ফারিশের দিকে বাকা চোখে তাকালো, ফারিশ ওকে এভাবে তাকাতে দেখে নিজের স্থানে সিটিয়ে গিয়ে চুপ হয়ে বসে রইলো। জাভেদ ফারিশকে চুপসে যেতে দেখে আনাবিয়ার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট জোড়া সামান্য প্রসারিত করে বলল,

“অ্যান্ড মোস্ট টেরিবলি ফ্রাইটেনিং অ্যান্ড মোস্ট পাওয়ারফুল য়ুম্যান অব অল টাইম।”
আনাবিয়া ওর বলার ধরণে হাসলো মৃদু, বলল,
“রাত অনেক হয়েছে, আজ আমার রাজমহলে আপনারা আমন্ত্রিত। আমন্ত্রণ রক্ষা করলে খুশি হবো।”
“আপনার খুশিতে ব্যাঘাত ঘটাবো এ সাধ্য বা স্পর্ধা কি আমাদের আছে, শেহজাদী।”
মৃদু হেসে বেশ গমগমে পুরুষালি কন্ঠে বলল জাভেদ৷ আনাবিয়া মনে মনে ভ্রু তুলে প্রশংসা করলো জাভেদের কথার। বেশ তো কথা, মেয়ে পটাতে খুব কাজে দিবে। জায়ান চাচাজানের হুলিয়া পেয়েছে দেখি সম্পুর্ন।

ওদের কথার মাঝেই হন্তদন্ত হয়ে সেখানে ঢুকলো কোকো। ওকে দেখে সকলেই একটু চমকালো। বিশাল শক্তপোক্ত শরীর, আন্ডারগ্রাউন্ড মাফিয়া ডনদের মতোন ভয়ানক, হিংস্র অথচ শান্ত চেহারা; যেন কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে দেখতে পেলেই পেছন থেকে একটা ম্যাশেটি বের করে গলায় ধরে বলবে, তাকালি কেন? ফাইন দে।
গায়ে একটা ওভার সাইজ টি শার্ট, ওভার সাইজ হওয়া সত্বেও টি শার্টের বাহুর অংশ আটসাট হয়ে আছে ওর ফুলানো মাসলসে। বিশাল হাতের মুঠিতে ধরা একটা সবুজ রঙা পলিব্যাগে খাবারের বক্স।
জাভেদরা একটু অপ্রস্তুত হলো ওকে দেখে। একটু ভয় ও পেলো যেন! কোকো ঢুকেই কারো দিকে দৃষ্টি না দিয়ে সোজা আনাবিয়ার কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলল,

“আম্মা, খাবেন আসুন।”
কথা বলতেই দৃষ্টি গোচর হলো ওর করাত সদৃশ ধারালো দাঁত, জুনায়েদ সেটা দেখতে পেয়ে ভড়কে গিয়ে নড়েচড়ে ফারিশের গা ঘেঁষে এসে বসলো।
কোকো পাশ হতে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বেশ আরামের সহিত বসে পড়লো আনাবিয়ার পাশে৷ আনাবিয়া ওর দিকে একবার তাকিয়ে নিজের চেয়ারে পিঠ এলিয়ে বসে বাচ্চাদের মতো করে বলল,
“উউ, এখন আমার ভাল্লাগছে না।”

ওর ব্যাক্তিত্বের এমন হঠাৎ পরিবর্তন দেখে জাভেদ আর জেসার ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো। জুনায়েদ মিষ্টি করে হাসলো, যেন আনাবিয়ার এমন আচরণ খুব মনে ধরেছে তার। ফারিশের ভেতর কোনো ভাবান্তর হলোনা, সে আনাবিয়ার এমন আচরণে ছোট বেলা হতেই অভ্যস্ত।
“আম্মা, অনেক খুঁজে খুজে এই খাবার এনেছি আমি, আপনি না খেলে হবেই না!”
খাবারের বক্সের ঢাকনা খুলতে খুলতে বলল কোকো। আনাবিয়া নাক কুচকে চরম বিরোধিতা করে বলল,
“আমি একদম খাবোনা এখন!”
“খেতেই হবে।”
“উহু।”

“সন্ধ্যায় সাগর থেকে ধরে নিয়ে আসা জ্যান্ত স্যামনের গ্রিল, চিকেন ফ্রাই, গ্রিন স্যালাড, ফ্রেশলি বেকড ব্রেড, আর আপনার ফেভরিট চকোলেট ডেজার্ট। খাবেন কিনা বলুন, নইলে আমি খেয়ে ফেললাম, এমনিতেই আমি কিছু খাইনি সন্ধ্যা থেকে।”
বলে নিজের পেটের ওপর হাত চাপলো কোকো। আনাবিয়া খাবারের বক্সের দিকে লোভাতুর চোখে তাকিয়ে ঢোক গিললো একটা। কোকো নিজের মনে হাসলো একবার। গ্রিলড ফিশের কিছু অংশ হাতে উঠিয়ে আনাবিয়ার মুখের সামনে ধরে বলল,
“নিন আ করুন।”
আনাবিয়া ফারিশের দিকে তাকালো, ফারিশ ওর ইশারা বুঝে চেয়ার ছেড়ে ব্যাস্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে জাভেদ জেসারদের বলল,

“চলুন ভাইজান, বাকি প্রসিজিউর শেষ করে আমরা ফেরার প্রস্তুনি নিই।”
জাভেদেরা উঠে পড়লো ফারিশের দেখাদেখি, বুঝলো হয়তো ওদের সামনে খেতে শেহজাদীর অস্বস্তি হবে৷ ফারিশের সাথে ওরা চলে গেলো সব ব্যাবস্থা করতে। ওরা যেতেই আনাবিয়া লুফে নিলো কোকোর হাতে ধরা মাছের টুকরোটি। কোকোর আঙুল ঘেঁষে গেলো আনাবিয়ার দাঁতের অগ্রভাগ৷ কোকো ব্যস্ত স্বরে বলে উঠলো,
“শুধু মাছ খান আম্মা, আমার হাতটাকে রক্ষা দিন!”
আনাবিয়া ভ্রু কুচকে নিয়ে ওর বাহুতে একটা থাবড়া বসালো। খাবার টুকু চিবিয়ে গিলে নিয়ে বলল,
“তুই কি জানিস তুই একটা অতিমাত্রায় হাজবেন্ড ম্যাটারিয়াল?”
আনাবিয়ার কথা শুনে কোকো হোহো করে হাসলো, বলল,
“আপনার মেয়েকে আমার সাথে বিয়ে দিলে আমি শুধু হাজবেন্ড ম্যাটারিয়াল নয় হাজবেন্ড ম্যাটারিয়াল টু দ্যা পাওয়ার হান্ড্রেড হতাম আম্মা! এত্ত যত্ন করতাম, এত্ত যত্ন করতাম যে আপনি আমাকে কোলে তুলে আবার মাছ ভাজা খাওয়াতে চাইতেন।”

আনাবিয়া খিলখিল করে হাসলো ওর কথা শুনে। তারপর বলল,
“তুই মানুষের সামনে ভুলেও হাসবিনা কোকো, তোর দাঁতের দিকে তাকালে মানুষ ভড়কে যায়৷ তুই এসেই যখন কথা বললি তখন জুনায়েদ ছেলেটা ভয় পেয়ে ফারিশের কাছাকাছি গিয়ে বসেছিলো।”
কোকো দাঁত বের করে হাসলো, চিকেনের এক টুকরো আনাবিয়ার মুখে তুলে দিয়ে বলল,
“আচ্ছা আম্মা, এই রয়্যাল ব্লাডলাইনের সবগুলো এত হ্যান্ডসাম হয় কিভাবে? আপনার বংশের সাথে সম্পর্কিত যে কোনো ছেলেকে দেখি এক্কেরে নায়কের মতোন চেহারা! আমাদের হিজ ম্যাজেস্টির কথাই ধরুন, গায়ের রঙ কালো কিন্তু তার চেহারার অমন ম্যাজেস্টিক গড়ন দেখলে আমারই বুক কেঁপে উঠে। আপনাকে দেখুন, আপনাকে দেখলে মানুষের মাথা হ্যাং হয়ে যায় পাঁচ মিনিটের জন্য।
অথচ আমাকে দেখুন, দেখে মনে হবে আমি একটা জেল পালানো সিরিয়াল কিলার, সকলে ভয়ে সুড়সুড়িয়ে পালিয়ে যায় আমার হুলিয়া দেখে৷

আনাবিয়া শব্দ করে হাসলো ওর কথায়, বলল,
“রয়্যাল লাইনের ছেলেদের জন্য বেছে বেছে সবসময় সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটাকে নেওয়া হয়। ওদের গর্ভে জন্মানো ছেলে মেয়েগুলোও তাই জিনগত ভাবে সম্পুর্ন পারফেক্ট শেইপের হয়। আর এটা চলতেই থাকে চলতেই থাকে, এবং ক্রমে ক্রমে আরও হ্যান্ডসাম হতে থাকে।
চাচাজির একটা বাচ্চা হোকনা, তখন দেখবি গোষ্টির সবগুলোকে ছাড়িয়ে যাবে৷”
পরক্ষণেই আনাবিয়ার চোখ গেলো ওদের থেকে কিছু দূরে বসা রেক্সার দিকে৷ আনাবিয়া ওকে বলল,
“এই, তুমি ওদিকে বসেছো কেন? এখানে এসো, আমার পাশে বসো।”
রেক্সা আনাবিয়ার এই প্রস্তাবে অপ্রস্তুত হলো, ইতস্তত ভঙ্গিতে চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে বসলো আনাবিয়ার পাশের চেয়ারে৷

আনাবিয়া কোকোর দিকে চেয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো রেক্সা খেয়েছে কিনা৷ কোকো ঠোঁট উল্টিয়ে জানেনা ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়ালো। আনাবিয়া চোখ গরম দিলো ওকে।
কোকো ফোস করে একটা শ্বাস ছেড়ে পাশে রাখা পলিব্যাগের ভেতর থেকে অন্য একটি বক্স বের করে ছুড়ে দিলো রেক্সার কোলের ওপর। রেক্সা লাফিয়ে উঠে খপ করে ধরলো সেটা, কোকোর দিকে একবার কটমট করে তাকিয়ে মুখ ফেরালো অন্যদিকে।
আনাবিয়া কোকোর এহেন আচরণে ওর বাহুতে আরেকটা চাপড় দিলো। রেক্সা কে বলল,

“খেয়ে নাও রেক্সা, খেয়েই বের হতে হবে আমাদের৷”
রেক্সা খেতোনা, কিন্তু শেহজাদীর কথা ফেলার মতো সাহস ওর নেই। তাই বক্স টা খুলে দেখলো। ভেতরে দুটো সেদ্ধ আলু, দুটো রুটি আর সবজি। ক্ষিধেও লেগেছে বেশ, সেদ্ধ আলু নিয়ে তাই ও খাওয়া শুরু করলো ব্যাস্ত ভঙ্গিতে।
আনাবিয়া রেক্সার দিকে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে থেকে অতঃপর কোকোর দিকে ফিরে দুষ্টু হেসে ভ্রু নাচালো দুবার। কোকো সজোরে দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিলো অসম্ভব! এমন কিছু হচ্ছে না কোনোমতেই! তারপর চিকেনের খানিকটা আনাবিয়ার মুখে ঠেসে দিয়ে বসে রইলো।
আনাবিয়া রেক্সার দিকে তাকিয়ে থেকে মুখের খাবার টুকু গিলে বলে উঠলো,
“তুমি তো বেশ মিষ্টি দেখতে!”

রেক্সা লজ্জা পেলো, আনাবিয়ার দিকে লাজুক চোখে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো আবার, মোলায়েম সুরে বলল,
“আপনার মিষ্টত্বের কাছে আমি কিছুই নই শেহজাদী! আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দরতমা মিষ্টি নারীটি আপনি!”
আনাবিয়া ওর এমন প্রশংসা শুনে হাসলো মিষ্টি করে, পরক্ষণেই ওর মুখের অভিব্যক্তি খেয়াল করে শুধোলো,
“তোমার মুখখানা এত শুকনো লাগছে কেন?”
“ক-কিছুই না শেহজাদী, এমনিতেই অমন লাগছে।”
কিন্তু সন্দেহ হলো আনাবিয়ার। ভ্রু কিঞ্চিৎ কুচকে, কোকোকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“ও কিছু বলেছে নাকি তোমাকে?”

রেক্সা ভড়কালো সামান্য, কোকোর দিকে একবার তাকিয়ে দেখলো। কোকো সাথে সাথে দৃষ্টি দিয়ে বুঝিয়ে দিলো যে তখনের ব্যাপারে শেহজাদী কিছু জানতে পারলে একদমই ভালো হবে না।
চোখ নামিয়ে নিলো রেক্সা৷ সে কিছু বলছে না দেখে আনাবিয়া এবার কোকোর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলো,
“এই, তুই কিছু বলেছিস ওকে?
কোকো সঙ্গে সঙ্গে ভালো ছেলেটি সেজে বিরোধিতা করে বলল,
“উহু, আমি কিছুই বলিনি! কি বলবো আমি?”
“সত্যি কথা বল।”
“সত্যি!”
“এই ও কি বলেছে তোমাকে?”

প্রশ্নটা আনাবিয়া রেক্সার দিকে ফিরে করলো। কোকোর গলা শুকিয়ে এলো, এবার একটা সর্বনাশ হবে ওর৷ রেক্সা কোকোর দিকে আড়চোখে একবার তাকালো, কোকো দৃষ্টি দিয়ে রীতিমতো হুমকি দিয়ে যাচ্ছে তাকে। রেক্সা এবার কোকোর হুমকির তোয়াক্কা করলোনা, অত্যন্ত নরম সুরে বলল,
“উনি বলেছেন আমার মতো সস্তা ভাতের হোটেলে তিনি মুখ দেন না।”
কোকো এ কথা শোনা মাত্রই খাবারের বক্স টা কোনোরকমে রেখে আনাবিয়ার চোখে চোখ পড়ার আগেই দ্রুত উঠে ছুটে বেরিয়ে গেলো কামরা ছেড়ে! এই মুখ আর ওর আম্মাকে দেখানোর মতো অবস্থা নেই ওই সস্তা ভাতের হোটেলের জন্য।
আনাবিয়া তাজ্জব বনে গেলো রেক্সার কথা শুনে, পাশ ফিরে কোকোর দিকে তাকাতে নিতেই দেখলো সে ইতোমধ্যে জায়গা ছেড়ে পালিয়েছে!

শেষ রাতের নিগুঢ় নিঃস্তব্ধতা ভেদ করে, কুরো আহমারের ডাস্কমায়ার জঙ্গলের মধ্যিখানে অবস্থিত রাজমহলের ভেতর হতে হঠাৎ কর্ণগোচর হলো এক অপার্থিব, অতলান্ত মিষ্টি মেয়েলি সুর! জাদুকরী সুরের মূর্ছনায় রাতের গাঢ় কালো আকাশে ফুটে উঠল এক স্বর্ণাভ আলোকস্রোত। জলরাশির মতোন ঢেউ খেলে ভেসে বেড়াতে শুরু করলো তা বাতাসে বয়ে!
নিমিষেই মৃদু প্রশান্তিকর বাতাস বয়ে গেলো চারদিকে,
ঝিকিমিকি আলোক কণিকা নেমে এলো রাতের গহীনে, ছড়িয়ে পড়লো ডাস্কমায়ার জঙ্গলের সমগ্র গাছপালার ডাল হতে পাতায় পাতায়!
মোহনীয় সুরের নেশালো প্রভাবে গভীর ঘুমের কোমল স্বপ্নে তলিয়ে যেতে লাগল সকল প্রাণ! চাঁদের আলো ধীরে ধীরে ভরে উঠলো সোনালী ঢেউয়ে। হঠাৎই যেন কুরো আহমারের সমগ্র ডাস্কমায়ার পরিণত হলো এক টুকরো শিরো মিদোরিতে!

স্ফটিকের ঝাড় বাতির আলোতে ঝিকিমিকি করছে কামরার প্রতিটি কোণ। কামরার ঠিক মধ্যিখানে অবস্থিত একটি বিরাট বিছানা। তার চারপাশে ঝুলছে অতিসূক্ষ্ম নকশার ক্রিম রঙের পাতলা মসৃণ পর্দা।
শিমারের মতোন চিকচিকে সাদা স্যাটিনের চাদর বিছানো সেখানে, তার ওপর সোনালী সুতার সুক্ষ্ম সূচিকর্ম। কয়েকটি তুলতুলে সাদা রঙা তাকিয়া ছড়ানো বিছানার ওপর। পাশেই একটি সাদা রঙা শক্ত কুশন বালিশ, তার ওপর মাথা রেখে উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে আছে মীর। পরণে একটা কালো রঙা ট্রাউজার, শরীরের ঊর্ধ্বাংশ উন্মুক্ত।
আনাবিয়া ওর হিল্যিং সং শেষ করে বিছানায় বসে বসে তাকিয়ে আছে মীরের দিকে। নরম বালিশে ঘুমোনোর অভ্যাস নেই মীরের, ঘাড়ে ব্যাথা হয়। দাসী গুলো সব নরম বালিশ দিয়েছিলো। আনাবিয়া বলাতে একটা শক্ত তাকিয়ার ব্যাবস্থা করে দিয়ে গেছে তারা।

বিছানার বিপরীতে রাখা বিরাট আয়নাটার দিকে তাকিয়ে আনাবিয়ার মনে পড়লো ফারিশের বিয়ের দিনের কথা, গাল জোড়া লাল হয়ে এলো ওর, সেদিন রাতে কি পাগলামিটাই না করেছিলো কালাভুনার বাচ্চা! ক্রোধ দমনের জন্য কেউ যে কারো ওপর এত মিষ্টি, অসহ্য অত্যাচার করতে পারে সেটা আনাবিয়ার জানা ছিলোনা৷
পুরোনো স্মৃতি মনে করলে বিস্তর হাসলো আনাবিয়া।
বাইরেটা নিরব। সকলে ঘুমিয়ে পড়েছে এতক্ষণে। রেক্সা দাসীদের সাথে গিয়ে ঘুমিয়েছে। কোকো একা এক কামরায়। জাভেদরা চার ভাই মিলে একই কামরায় ঘুমিয়েছে। দেখা সাক্ষাৎ হয়না তেমন তাই এক কামরায় ঢুকেছিলো আড্ডা দেওয়ার সুবিধার্থে।

মীরের বাহুর ক্ষতস্থান সম্পুর্ন সেরেছে কিনা দেখে নিয়ে আনাবিয়া নেমে পড়লো বিছানা থেকে। গুটিগুটি পায়ে নিঃশব্দে এগোলো ড্রেসিং রুমের দিকে।
ড্রেসিং রুমটি বিশাল, উচ্চচূড়া সিলিং। সিল্কের ভারী পর্দা ঝুলছে চারপাশে। সাজিয়ে রাখা পোশাক আর অন্যান্য প্রসাধন সামগ্রীর বহর পেরিয়ে সামনের দিকে এগোলো আনাবিয়া৷ সেখানে সাদা পাথরের তৈরি সুবিশাল বাথ টাব থেকে এখনো ধোয়া উড়ছে সামান্য। দাসী গুলো ঘুমোতে যাওয়ার পূর্বে সব প্রস্তুত করে রেখে গেছে।
ফেনা তোলা পানির ওপর ভাসছে সাদা আর বেবি পিঙ্ক মিশেলের গোলাপের পাঁপড়ি। কস্তুরী আর জাফরানের সুগন্ধিতে ম’ম’ করছে চারপাশ।
পরণের পোশাক খুলে আনাবিয়া নামলো বাথটাবে, অতঃপর গা ডোবালো উষ্ণ পানিতে। এই কদিনের সমস্ত ক্লান্তি যেন এক নিমিষেই দূরীভূত হলো এই উষ্ণ পানির সংস্পর্শে!

স্নান শেষে আনাবিয়া এসে বসলো ড্রেসিং রুমের সেন্টারে রাখা নকশাদার ফুল ভিউ মিররের সম্মুখে। পরণে একটি স্যাফায়ার ব্লু লেয়ার্ড ব্যালগাউন। প্রতিটি লেয়ারের বাইরের দিকে নীল মখমলি সুতায় খচিত ছোট্ট ছোট্ট ক্রিস্টাল কণা, ড্রেসিং রুমের স্বর্ণাভ আলোতে ঝিকিমিকি করছে তা। গাউনের নিচের দিকের প্রলম্বিত অংশ ছড়িয়ে মেলে আছে পেছনে।
বহু দিন পর নিজের শরীরে নিজের কোনো রাজকীয়, অভিজাত পোশাক চড়ালো আনাবিয়া, এতদিনে একটি পোশাকও ছুয়ে দেখেনি ও। নিজের টি শার্ট, ট্রাউজার আর মীরের সাদা শার্টেই কেটে গেছে দিন। আজ ভারী ইচ্ছে হলো নিজেকে পুরোনো রূপে ফিরে পাওয়ার!
মুখে সামান্য প্রসাধনী ছুইয়ে গলায় একটি সাদা মুক্তো আর স্যাফায়ার স্টোনের ফ্লোরাল প্যাটার্নের নেকলেস চড়িয়ে দিলো। সাথে ম্যাচিং ইয়ারিংস।

সজ্জিত খোলা, সফেদ চুলে, ললাটের উপরিভাগে চড়িয়ে দিলো শৃঙ্গাকার নকশার একটি স্যাফায়ার, হীরে আর ঝোলানো মুক্তোয় সজ্জিত চওড়া হেডপিস।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ভালোভাবে দেখলো একবার। মীর দেখলে নিশ্চয় বলতো, ঘরে আজ তার নীল পরী নেমে এসেছে! আনমনে হাসলো আনাবিয়া।

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৮

ঘুম আসছে ওর এবার। এত সাজগোজ করে কিভাবে ঘুমোতে যাবে তাই ভাবতে লাগলো ও বসে বসে। আবার খুলতেও ইচ্ছা করছে না এই মুহুর্তে, ভালো লাগছে পরে থাকতে এসব!
এমন সময় কামরা থেকে হঠাৎই কিছু একটা পড়ে ভেঙে যাওয়ার শব্দ পেলো আনাবিয়া৷

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here