বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩১
রানী আমিনা
তড়িতে মীরের মুঠি হতে হাত ঝেড়ে ছাড়িয়ে নিলো আনাবিয়া৷ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে কোকোকে ইশারায় বলল বাইরে চলে যেতে। কোকো নিজের কাঁধ চেপে ধরে দ্রুত পায়ে ছুটে বেরিয়ে গেলো, এখানে থাকলেই ওর ওপর কখন কোন দিক থেকে দুম দাম থাবড় নেমে আসবে তার ইয়ত্তা নেই৷
কোকোর যাওয়ার পানে মীর তাকিয়ে রইলো প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে। আনাবিয়া ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করে শক্ত গলায় শুধোলো,
“ওকে ওভাবে কেন ধরেছিলেন?”
মীর আনাবিয়ার দিকে কিয়ৎক্ষণ শীতল চোখে তাকিয়ে অতঃপর অভিযোগের ভঙ্গিতে তর্জনীর ইশারায় নিজের বিছানা দেখালো। আনাবিয়া তাকিয়ে দেখলো বিছানায় স্ফটিকের গ্লাসটি হেলে পড়ে আছে, ভিজে গেছে বিছানার কিছু অংশ।
ফোস করে একটা শ্বাস ছেড়ে ও বলল,
“তাই বলে ওকে এভাবে ব্যাথা দিতে হবে?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মীর দু হাত দুদিকে উঁচিয়ে ঘাড় নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিলো এর চেয়ে ভালো উপায় ওর জানা ছিলোনা৷ তারপর আনাবিয়াকে উপেক্ষা করে আনাবিয়ার পেছনে সোফার ওপর রাখা খাবারের ট্রে এর দিকে এগোলো।
বিরাট আকৃতির ট্রের ওপর বেশ বড়সড় চওড়া থালায় উঁচু উঁচু করে পোলাও সাজানো, অন্য বাটিতে খান সাতেক রোস্ট। মীর ব্যাস্ত ভঙ্গিতে সোফার ওপর গিয়ে হাটু ভাজ করে বসলো, চোখ জোড়া চকচক করে উঠলো তার, খাবারের লোভনীয় সুগন্ধে জিভে জল চলে এলো, ঢোক গিলে নিলো সে।
খামচা মেরে এক মুঠো ভাত তুলতে যাবে তার আগেই আনাবিয়া ধমকে বলে উঠলো,
“কি করছেন? দু দিন ধরে হাত মুখ ধোয়া নেই, দাঁত ব্রাশ করা নেই, গোসল নেই! এভাবে খাওয়া যাবেনা, ফ্রেশ হয়ে এসে খেতে হবে৷”
মীর কপালে ভাজ ফেলে তাকালো ওর দিকে, যেন প্রশ্ন করলো – তোমার থেকে পারমিশন নিয়ে খেতে হবে নাকি আমাকে?
পরমুহূর্তেই এক খামচা ভাত তুলে মুখের ভেতর ঢুকিয়ে চিবোতে চিবোতে আনাবিয়ার দিকে এক ভ্রু উঁচিয়ে বুঝিয়ে দিলো- তোমার ধমককে আমি থোড়াই কেয়ার করি।
আনাবিয়া ফোস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিড়বিড়িয়ে বলল,
“ইয়া রাব! আমাকে ধৈর্য দিন!”
তারপর দরজার নিকট গিয়ে একটা দাসীকে বলল বড় জগে পানি ভরে এখানে পৌছে দিতে, এবং আরও একটা খানদানি প্লেট ভরে পোলাও রোস্ট প্রস্তুত রাখতে। এরপর আবার এসে বসলো বিছানার ওপর, স্বামী তার সোফা দখল করে রেখেছে৷
মীর মূহুর্তের ভেতরেই বড় বড় গ্রাস তুলে রোস্ট সমেত প্লেট সাফ করে ফেললো। প্লেট ফাঁকা হতেই কিছুক্ষণ শূন্য থালার দিকে তাকিয়ে থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো আনাবিয়াকে। স্বর্ণাভ চোখে তখনো লেগে রইলো ক্ষুধা।
আনাবিয়া ঠোঁট টিপে হাসলো, পেটে খাবার পড়ে দৃষ্টি একটু নরম হয়েছে তার৷ মোলায়েম স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“আরও চাই?”
মীর তড়িতে মাথা নাড়ালো ওপর নিচে। আনাবিয়া মিষ্টি হেসে আরও এক প্লেট বোঝাই করে খাবার এনে দিলো ওকে।
বিশাল থাবার বড় বড় লোকমা তুলে পর পর আরও দুই প্লেট পোলাও রোস্ট সাবাড় করে টানটান হয়ে গেলো মীর। জগ উঁচিয়ে পানি খেলো ঢকঢক করে, অতঃপর তৃপ্তির ঢেকুর তুলে চোখ জোড়া বন্ধ করে গা এলিয়ে দিলো সোফায়। আনাবিয়ে পুরোটা সময় বসে বসে দেখলো ওর খাওয়া৷
কি ক্ষিদেটাই না পেয়েছিলো…!
সন্ধ্যা নেমেছে কিছুক্ষণ হলো। আনাবিয়া দলবল নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে ফেরার। জাভেদ, জেসার, জুনায়েদ তিন ভাই দুপুরে খেয়েই কিমালেবের উদ্দ্যেশ্যে বেরিয়ে পড়েছে। ফারিশ ওর বাসায় ফিরে গেছে বিকেল পড়ার আগেই।
কোকো আর রেক্সা মিলে শেষ মুহুর্তের গোছগাছ সম্পন্ন করছে, একটু পরেই বেরিয়ে যাবে ওরা। মীর কে স্লিপিং পিল দেওয়া হয়েছে একটু আগেই, এতক্ষণে সে ঘুমিয়েও পড়েছে বোধ হয়। ঘুমন্ত অবস্থাতেই তাকে শিরো মিদোরিতে নেওয়া হবে, নইলে রাস্তায় দুরন্তপনা শুরু করলে আনাবিয়ার পক্ষে সামলানো কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে৷
আনাবিয়ার প্রস্তুত হওয়া শেষ, ড্রেসিং রুমে নিজের প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে সে৷ একটা সাদা রঙা ক্রপ টপ আর গ্রে শেডের ওভারসাইজড কার্গো প্যান্ট পরনে ওর। ক্রপ টপের ওপর একটা ওপেন জ্যাকেট চড়ানো। পায়ে সাদা রঙা হাই-টপ স্নিকার্স, লম্বা সফেদ চুলগুলো উঁচু পোনিটেল করে বাধা৷
এটা সেটা দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা শেলফ খুলতেই ভেতরে একটা ফটোগ্রাফ দেখতে পেলো আনাবিয়া। হাতে নিয়ে মুখের সম্মুখে ধরলো, ওর আর মীরের ফটোগ্রাফ।
একটা সি গ্রীনের ফ্রক পরনে ওর, নিরাভরণ পদযুগলে কচি ঘাসের ওপর দাঁড়িয়ে সে, হাতে একটা ব্লাক মাম্বা ধরে রাখা, মুখে বিশ্বজয়ীর হাসি, উচ্ছসিত চোখ জোড়া ক্যামেরার দিকে। ওর ঠিক পেছনেই ট্রাউজার পরিহিত, উন্মুক্ত শরীরে দাঁড়ানো মীর। তার শকুনি চোখ জোড়া আনাবিয়ার হাতে ধরা কালো রঙা বিষধর সরীসৃপটির দিকে, যেন চোখ দিয়েই অবলা প্রাণীটাকে বোঝাতে চাইছে- দাঁতের যদি এতটুকু আঁচড় লেগেছে তবে তোর মুণ্ডু ছিড়ে হাতে ধরিয়ে দিবো।
এই ডাস্কমায়ার জঙ্গলের ভেতরেই শ্যুট করা, ওদের পনেরো তম অ্যানিভার্সারিতে তোলা। ক্যামেরার পেছনে নিশ্চয় কোকো ছিলো! কোকো ছাড়া মীর আর কারো সামনেই এভাবে আসবে না, এমন খোলা শরীরে।
মনে পড়লো আনাবিয়ার, সাপটিকে ধরবে বলে কত অনুনয় বিনয়ই না করতে হয়েছিলো সেদিন মীরের কাছে! তার এক কথা, বিষধর কোনো কিছুর ধারে কাছেও যাওয়া যাবে না।
শেষ মেশ নাকের পানি চোখের পানি এক করে এই সাপটা ও ধরে ছেড়েছিলো। একটা সাপ ধরার জন্য আনাবিয়ার এত কান্নাকাটি দেখে পরবর্তীতে মীর ওকে কত যে পঁচিয়েছে!
আনমনে হাসলো আনাবিয়া, ফটোগ্রাফটা সাথে নিবে সিদ্ধান্ত নিয়েও আবার কি ভেবে সেটা সেখানেই রেখে বেরিয়ে এলো ও।
সব গোছগাছ শেষে ঘুমন্ত মীরকে গাড়িতে তুলে ওরা যখন রওনা করলো তখন রাতের আটটা। কোকো রেক্সাকে নিয়ে বাইকে চেপে আগে আগে বেরোলো। ফক্সিকে আবারও পাশের সিটে সিটবেল্ট বেধে বসিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো আনাবিয়া, তারপর এগোলো শিরো মিদোরির উদ্দ্যেশ্যে।
মধ্যরাত। কুরো আহমার হতে শিরো মিদোরি তে প্রবেশের ওয়াটার টানেল দিয়ে সবেগে ছুটে চলেছে মীরের কালো রঙা গাড়িখানা। বাইকে আগে আগে ওদেরকে একপ্রকার এসকর্ট করে চলেছে কোকো।
শুনশান নিরবতার মাঝে গাড়ির ইঞ্জিনের গ্রুম গ্রুম আওয়াজ ঝন ঝন করে বাড়ি খাচ্ছে টানেলের স্বচ্ছ কাঁচে৷ ফক্সি ঘুমিয়ে গেছে, এঁকেবেঁকে চিৎ হয়ে লেপ্টে আছে সে সিটের সাথে। পেছনে মীর গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, তার ভারী নিঃশ্বাস কানে আসছে আনাবিয়ার।
ফাঁকা রাস্তা দিয়ে সবেগে চলতে চলতে হঠাৎই সজোরে ব্রেক কষলো কোকো। রেক্সা হুমড়ি খেয়ে পড়লো ওর পিঠের ওপর। ঢুলুনি এসে গেছিলো ওর, ধাক্কা খেয়ে ঘুম উড়ে গেলো মুহুর্তেই, চাপা সুরে ধমকে সে বলল,
“এই ভাবে কেউ ব্রেক করে?”
কিন্তু কোকো কোনো কথা বললনা, ওর দৃষ্টি নিবদ্ধ রইলো সম্মুখের রাস্তার ওপর৷ ওর দেখাদেখি রেক্সা নিজেও তাকালো সামনে। তাকাতেই দেখতে পেলো রাস্তা আটকে আড়াআড়ি একটি ধূসর রঙা গাড়ি দাড় করিয়ে তাতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একজন দীর্ঘকায় ব্যাক্তি। গৌরবর্ণের পুরুষটির শরীরে জড়ানো অভিজাত পোশাক, চোখ জোড়া জ্বলজ্বলে- পার্পল রঙা। চোখ জোড়া দেখা মাত্রই তাকে চিনতে বেগ পেতে হলোনা ওর।
উৎকন্ঠিত হলো সে, ভয়ও পেলো সামান্য, একটু নড়েচড়ে গা ঘেঁষে বসলো কোকোর। না জানি কি হয়!
তখুনি সেখানে এসে উপস্থিত হলো আনাবিয়া। কোকোর বাইকের পাশেই গাড়ি থামালো সে। বের হলোনা গাড়ি থেকে কাঁচের এপাশ হতেই নিজের সূচালো দৃষ্টি রাখলো পার্পল রঙা দৃষ্টির মালিকের দিকে।
কোকো কিঞ্চিৎ ভীত, দ্বিধান্বিত দৃষ্টিতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো আনাবিয়ার দিকে। তখুনি পা বাড়ালো পুরুষটি। আনাবিয়ার দিকে দৃষ্টি রেখে কোকোর উদ্দেশ্যে সে বলল,
“আমি শেহজাদীর সাথে একা কথা বলতে চাই।”
কোকো শঙ্কিত চোখে তাকালো আবার আনাবিয়ার দিকে, আনাবিয়া ইশারায় ওকে এগোতে বলল মসভেইলের দিকে। ইলহানের দিকে একবার তাকিয়ে কোকো বাইক স্টার্ট দিলো, তারপর আড়াল হয়ে গেলো আনাবিয়ার দৃষ্টি হতে।
পেছনের সিটে ঘুমিয়ে থাকা মীরের দিকে একবার দৃষ্টি দিয়ে গাড়ির দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলো আনাবিয়া। পায়ের স্নিকার্সে খট খট শব্দ তুলে সে এসে দাড়ালো ইলহানের মুখোমুখি। বলল,
“বলুন, চাচাজি। এত রাতে আপনি এখানে? ব্যাপারটা কি?”
“কোথা হতে আসা হচ্ছে?”
“কৈফিয়ত দিতে আমি বাধ্য নাকি?”
বুকে হাত বেধে গাড়ির সম্মুখে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে পালটা প্রশ্ন করলো আনাবিয়া৷ ওর পেছনে, গাড়ির দিকে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে ইলহান আবারও চোখ রাখলো আনাবিয়ার মুখের ওপর, শুধোলো,
“আমার দু মিনিটের ছোট ভাই কেমন আছে এখন?”
“ভণিতা ছেড়ে সোজা কথায় আসুন।”
ভ্রু উঁচিয়ে বলল আনাবিয়া। ইলহান হাসলো সামান্য, দু কদম এগিয়ে এসে শুধোলো,
“কি চাও তুমি?”
“অনেক কিছুই! সাম্রাজ্য, ক্ষমতা, সিংহাসন ইত্যাদি৷”
“নিজের জন্য তো নয়!”
“জ্বি, ঠিক ধরেছেন, নিজের জন্য নয়, মীরের জন্য। আমার জন্যই তার এ সব কিছু হাতছাড়া হয়েছিলো যে! আমার মতো ম্যানারলেস, জেদি মেয়ের জন্য!
আপনিই তো বলেছিলেন, মীর তার সাম্রাজ্য, ক্ষমতা, সিংহাসন সব হারিয়েছে আমার কর্মকাণ্ডের কারণে। নইলে আপনার ক্ষমতা ছিলোনা তার থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার!”
ভ্রু তুলে তাকিয়ে বলল আনাবিয়া৷ ইলহান হাসলো সামান্য, তারপর আনাবিয়ার চোখে সরাসরি দৃষ্টি রেখে, হাসি মুখ কঠিন করে বলল,
“এখনো সময় আছে, নিজের ভালো বুঝতে শিখো মেয়ে।”
“আপনিও, চাচাজি৷”
“তোমাকে আমি আগেই সাবধান করেছি, আমার রাস্তায় আসবে না। নইলে যেটা ঘটবে সেটা কারো জন্যই ভালো হবে না।”
“আমি কি করবো কি করবোনা সেটা নিতান্তই আমার ব্যাক্তিগত ব্যাপার, আপনার নাক এখানে গলুক আমি চাইনা। এখন রাস্তা ছাড়ুন।”
“যা বললাম স্মরণে রেখো, আর তোমার এবং আমার দু মিনিটের ছোট ভাইয়ের ভালো চাইলে আমার সাম্রাজ্য থেকে দূরত্ব বজায় রেখো।”
“আপনাকে কে বলল আমি আপনার এই সস্তা হুমকিকে ভয় পাই?”
“হুমকিকে হুমকি পর্যন্তই রাখবো যদি তুমি নিজেকে সংযত করো, নইলে হুমকিকে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে আমার বেশি সময় লাগবে না আনাবিয়া।”
“আপনার জ্ঞাতার্থে জানাই, এই মুহুর্তে পঞ্চদ্বীপের একমাত্র এবং একচ্ছত্র অধিপতি আমার গাড়ির ব্যাকসিটে ঘুমিয়ে আছে। এবং পঞ্চদ্বীপের বাদশাহর একমাত্র বিবাহিতা স্ত্রী এবং একমাত্র দেমিয়ান শেহজাদী আপনার সামনে দাঁড়িয়ে। সুতরাং যা-ই বলবেন ভেবে বলবেন, শেহজাদা। নইলে পরবর্তীতে আফসোস করেও কোনো কূল কিনারা পাবেন না৷ এখন বলুন, রাস্তা ছাড়বেন? নাকি আপনার ওপর দিয়ে চালিয়ে দিবো?”
“রাস্তা আমি অবশ্যই ছাড়বো, কিন্তু—
এরপর আমার নেওয়া পদক্ষেপ তোমার পছন্দ না হলে আমার কিন্তু কিছুই করার নেই আনাবিয়া৷ অ্যান্ড ইটস অ্যা ওয়ার্নিং ফ’ ইয়্যু।”
বলে ইলহান আবার উঠলো নিজের গাড়িতে। তারপর ঝড়ো গতিতে এগোলো প্রাসাদের দিকে৷ আনাবিয়া নিজেও ড্রাইভিং সিটে এসে বসলো। পেছনের সিটে ঘুমিয়ে থাকা মীরকে আরেকবার দেখে নিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে সজোরে এগোলো রেড জোনের দিকে।
মহলে ততক্ষণে আনাবিয়ার ফিরে আসার সংবাদে নানা রকমের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। কোকো এসে মীরের ফেরার সংবাদ দিতেই একাংশ আনন্দে লাফিয়েছে, অন্যদল খুশিতে এক দফা কান্নাকাটি করেছে।
আনাবিয়ার কামরাটি মীরের জন্য নতুন করে গোছগাছ করা হয়েছে। বেসমেন্ট থেকে তার জিনিসপত্র, পোশাক আশাক, বইয়ের একাংশ দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয়েছে কামরা। আনাবিয়ার জিনিসপত্র গুলো এখনো ট্রি হাউজে চালান করতে ব্যাস্ত বাচ্চারা। ফাতমা আর শার্লট এখনো সেখানেই আছে, ট্রি হাউজকে আনাবিয়ার যোগ্য করে তোলার জন্য।
কোকো চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে ছিলো মহলে ফেরার রাস্তার সম্মুখে। ইঞ্জিনের গ্রুম গ্রুম শব্দ পেতেই চঞ্চল হয়ে উঠলো ও। মহলের দিকে এগিয়ে গিয়ে নিশ্চিত হলো সব গোছগাছ হয়েছে কিনা।
আনাবিয়া এসে গাড়ি থামালে কোকো আর লিও মিলে গাড়ির ব্যাকসিট হতে আধো ঘুমে থাকা মীরকে ধরাধরি করে নিয়ে এগোলো কামরার দিকে। ওদের কাঁধে ভর দিয়ে কামরায় ঢুকলো সে এলোমেলো পায়ে। বিছানায় শুইয়ে দিতেই চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী ঘুরে ফিরে উপুড় হয়ে ঘুমোলো সে।
আনাবিয়া বেসমেন্টে গাড়ি রেখেই ফক্সি আর লায়রাকে নিয়ে চলে এলো ট্রি হাউজে৷ শার্লট ফাতমা তখনো ট্রি হাউজের ডেকোরেশনে ব্যাস্ত। এগোতে এগোতে ট্রি হাউজের গোলাকার জানালা দিয়ে হলুদ রঙা আলো বিচ্ছুরিত হতে দেখলো আনাবিয়া। মৃদু হাওয়া ঢেউ খেলিয়ে চলেছে সাদা রেশমের পর্দায়, তারই ফাঁক দিয়ে টিকরে বেরোচ্ছে অল্প স্বল্প আলো৷
ছোট্ট সিড়ি বেয়ে উঠে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই পায়ের নিচে সাদা রঙা উলের কার্পেট ঠেকলো ওর। চোখ ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখলো ট্রি হাউজের আমূল পরিবর্তন করে ফেলেছে দুটোয় মিলে।
ঘরের মাঝখানে রাখা একখানা গভীর নীলাভ মখমলের সোফা, পাশেই একটা ছোট্ট চন্দ্রাকৃতি টেবিল, তার ওপর স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ ল্যাম্পে জ্বলছে হালকা নীল আলো।
দেয়ালের গায়ে খোদাই করা বইয়ের তাকে ওর মহলের কামরার বই গুলো সাজানো। অন্য কোণায় ডায়েরি গুলোও চোখে পড়লো, সেগুলো হঠাৎ দেখতে না পেয়ে আনাবিয়ার বুক কেঁপে উঠেছিলো।
কামরার ডান পাশের কোণার বেড স্পেসে নতুন সাটিনের চাদর, সিল্কের চকচকা বালিশ৷ মাথার ওপরে কাঠের সিলিং এ খোদাই করা লতা পাতার নকশা অনুসরণ করে ছোট্ট ছোট্ট হলুদ বাতি জ্বলছে।
ওকে সেদিকে তাকাতে দেখে শার্লট চোখে হেসে বলল,
“ওগুলো ফ্যালকন ভাইয়ার কাজ, আপনি এখানে থাকবেন শুনে তার সে কি তেজ! পরে কাঞ্জি ভাইজানকে সাথে নিয়ে তখুনি কুরো আহমারে গিয়ে এসব কিনে এনেছেন তিনি।”
আনাবিয়া উঁকি মেরে কিচেনের দিকে দেখলো একবার। ফাতমা বলল,
“ওখানেও সব নতুন, কুরো আহমারে যাবার আগে সব খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে লিস্ট করে নিয়ে গেছে দুজন। আপনার ওয়াশরুমের চেহারাও বদলে গিয়েছে, দেখুন চমক দিচ্ছে সব কিছু!”
আনাবিয়া সন্তুষ্টির হাসি হাসলো। গায়ের পোশাক খুলতে খুলতে বলল,
“শার্লট, আমি গোসলে যাবো। এসেই ঘুমোবো, ক্লান্ত লাগছে অনেক।”
শার্লট সম্মতিসূচক মাথা নাড়িয়ে হাতের কাজ ফেলে ছুটলো ওয়াশরুমে, গোসলের ব্যাবস্থা করতে। লায়রা আর ফক্সি মিলে নতুন কামরা পেয়ে লাফালাফি শুরু করেছে, লাফিয়ে একবার এদিক আরেকবার ওদিকে ছুটছে। ফাতমা ফক্সি কে দেখিয়ে বলল,
“শেহজাদী, এই পিচ্চিকে কোথায় পেয়েছেন?”
“পেয়েছিলাম জঙ্গলের ভেতর, পিছু ছাড়ছিলোনা তাই সাথে নিয়ে এসেছি। ফক্সি নাম ওর৷”
ফাতমা মিষ্টি করে হেসে শ্বাস ছাড়লো একটা। যেখানে যাকেই পাবে তাকেই ধরে নিয়ে আসা লাগবে ওদের শেহজাদীর। এখন এই দুটো যে লাফিয়ে বিছানা নোংরা করছে!
লায়রা এই কদিনে ওদের চিনে ফেলেছে, তাই সে দুষ্টুমি কম করছে, কিন্তু ফক্সি! সে দুষ্টুমিতে পিএইচডি করে এসেছে বোধ হয়! ছুটে গিয়ে আগে উঠেছে বিছানায়, তারপর এক লাফে সোফার ওপর!
ফাতমা ওদের কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করে ভ্রু কুচকালো, রাগী গলায় বলল,
“এই যে দুই গুনধরী, নোংরা পা নিয়ে এখানে লাফালাফি করা হচ্ছে! ফ্যালকন ভাইজান দেখলে লেজ ধরে জঙ্গলে ফেরত দিয়ে আসবে আবার!”
আনাবিয়া ওয়াশরুমের দিকে এগোতে এগোতে বলল,
“ওদেরকে বকাবকি কোরোনা ফাতমা, বাচ্চারা দুষ্টুমি করবেনা তো কে করবে? কারো গায়েই নোংরা নেই, আমি ফক্সিকে ডলে ডলে গোসল দিয়েছি, ও একদম পবিত্র। আর লায়রা তো ভদ্রমহিলা, সে মাটিতে পা-ই দিতে চায়না।”
“হ্যাঁ, এমন পাক পবিত্র মহাশয়ার জন্য এখন আমাকে জুতার ব্যাবস্থা করতে হবে বোধ হয়!”
বলে হাসলো ফাতমা। শার্লট সব প্রস্তুত করে বেরিয়ে এলো গোসল খানা হতে। আনাবিয়া ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
“তোমরা এখন মহলে ফিরে যাও, আমি গোসল দিয়ে বের হবো। ঘুমোবোনা এখন।”
“কেন শেহজাদী?”
শুধোলো শার্লট। আনাবিয়া দরজা বন্ধ করতে করতে বলল,
“আমার গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আছে, লাইফ ট্রির সাথে।”
বেলা হয়েছে বেশ, দেমিয়ান প্রাসাদের রয়্যাল ফ্লোরে বারান্দায় দাসদাসীদের আনাগোনা, হাতে তাদের রাজকীয় খাবারের পশরা। বাদশাহর খাস কামরায় আজ চলছে কোনো গুরুত্বপূর্ণ মিটিং, গুটিকয়েক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিবর্গের সাথে বাদশাহ গভীর আলোচনায় ব্যাস্ত।
ঘন্টা দুই পরে জম্পেশ খাওয়া দাওয়া শেষে একে একে বেরিয়ে এলেন অতিথিরা। বারান্দায় বসে কিছুক্ষণ খোশগল্প করে অবশেষে বিদায় নিলেন।
গুলবাহার ছিলো আনাবিয়ার কামরায়। রোজ শেহজাদীর কামরা পরিষ্কার ঝকঝকা রাখা তার কাজ। আগে অন্য একটি দাসী করতো, কিন্তু এক অজানা কারণে ইলহান নির্দিষ্ট কয়েকজন ব্যাতিত অন্য সবার জন্য শেহজাদীর কামরায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। আনাবিয়ার কামরা ছিমছাম রাখার দায়িত্ব তাই ইয়াসমিন বর্তমানে বাহারের ওপর দিয়েছে।
বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩০
রোজকার মতোন সমস্ত গোছগাছ শেষে বাহার বেরিয়ে যাচ্ছিলো কামরা থেকে। কিন্তু রাজ অতিথিদের বারান্দায় আগমনে আবার ঢুকে গেছিলো কামরায়। এতক্ষণ সেখানেই চুপচাপ বসে থেকে, শেহজাদীর কামরার কর্ণার র্যাকে রাখা শোপিস গুলো আরও একবার নেড়েচেড়ে দেখছিলো কোথাও ময়লা রয়ে গেলো কি।
বাইরেটা নিরব হতেই উঠে দাঁড়ালো সে। নিঃশব্দে দরজা খুলে বের হলো। দ্রুত পায়ে সরু বারান্দা পেরিয়ে সানন্দে প্রধান বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই নিজের একেবারেই সামনে একটি দীর্ঘাবয়াব দেখা মাত্র তড়িতে থমকে দাঁড়িয়ে গেলো সে।
