বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩২

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩২
রানী আমিনা

“নাম?”
গুলবাহার চমকে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো। এই মুহুর্তে যে স্বয়ং বাদশাহ তার সামনে এসে দাঁড়াবেন, এমনটা সে ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবেনি। ইলহানের কন্ঠে উচ্চাতিত প্রশ্নে হুশ ফিরলো তার, দ্রুত মাথা নামিয়ে নিয়ে কাচুমাচু গলায় অস্ফুটস্বরে উত্তর করলো,
“ব-ব-বাহার..!
ইলহান ভ্রু তুললো, ঠান্ডা চোখে চেয়ে প্রশ্ন করলো,
“শুধুই বাহার?”
বাহারের গলা যেন আটকে আসতে চাইলো, গিলতে গিলতে বলল,
“জ্বি..? ন্‌-না, গ্‌-গুলবাহার..!”
ইলহান আনাবিয়ার কামরার দিকে একবার দৃষ্টি দিলো, জিজ্ঞেস করলো,
“এখানে কি করছো?”

গম্ভীর, শান্ত কণ্ঠস্বর। গুলবাহার ভড়কালো, ইয়াসমিন কালবির থেকে শুনেছে এই দেমিয়ান বংশের মানুষ গুলো ভয়াবহ ঠান্ডা মস্তিষ্কের অধিকারী। নিরাবেগ, শান্ত চিত্তে তাঁরা ঠিক কি কি করতে পারে তার সামান্য ঝলক এই প্রাসাদের অধিবাসিরা একটু হলেও দেখেছে। তাই এঁদের শান্ত চেহারা, ধীর স্থীর মনোভাবের ওপর বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই৷ ভীতসন্ত্রস্ত গলায় সে উত্তর করলো,
“শ্‌-শ্‌-শেহজাদীর ক্‌-কামরা গুছিয়ে দিতে এসেছিলাম…।”
“সোজা হয়ে দাঁড়াও।”
শীতল আদেশ করলো ইলহান।
কখন যে কুঁকড়ে গেছে ভয়ে, বাহার নিজেও জানেনি। বাক্যটা কর্ণকুহরে যেতেই টনক নড়লো তার, সাথে সাথে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। ইলহান নিঃশব্দে ওকে পাশ কাটিয়ে শরীর দুলিয়ে হেটে ঢুকলো আনাবিয়ার কামরায়। বাহার সেখানেই সটান দাঁড়িয়ে রইলো।
মুহূর্ত কয়েক পর ইলহান বেরিয়ে এলো আবার। বাহার কে সম্পুর্ন উপেক্ষা করে পাশ কাটিয়ে হেটে নিজের কামরার দিকে এগোতে এগোতে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“কাজের মান আরও উন্নত হওয়া চাই।”
বাহার জিভ দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে ঢোক গিললো। আজ সকাল থেকে কত কষ্টই না করেছে সে- পর্বা বদলেছে, বিছানার চাদর বদলেছে, মেঝে চকচকে করে তুলেছে, কোনো কিছুতে এতটুকু ময়লা রাখেনি, তবুও তাঁর মনের মতোন হলোনা!
ইলহান চোখের আড়াল হতেই বাহার ঠোঁট উল্টে সামান্য বিদ্রুপ করলো মনে মনে, তারপর মুখ কালো করে দ্রুত পায়ে বারান্দা ছাড়িয়ে বেরিয়ে গেলো রয়্যাল ফ্লোর থেকে।
এক দৌড়ে পাশের কর্মচারীদের ফ্লোরে ঢুকে পড়লো সে। ইয়াসমিনের অ্যাসিস্ট্যান্ট হওয়ার পর থেকে হেরেম ছেড়ে তার কর্মস্থল বর্তমানে এখানে। ইয়াসমিনের কামরার মাত্র দুই কামরা পরেই তার কক্ষ৷ দ্রুত পায়ে এগিয়ে কামরায় ঢুকে পড়লো সে।

ওকে এভাবে ছোটাছুটি করতে দেখে আশেপাশের কর্মচারীরা কিছুটা বিরক্ত হয়ে একে অপরের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করলো। মাঝে মাঝে এই মেয়েটা কোনো কারণ ছাড়াই দুমদাম করে ছুটে বেড়ায়।
কিন্তু বাহারের হাতে এখন সময় নেই তাদের অভিব্যাক্তি লক্ষ্য করার। দরজা আটকে দিয়ে সে টেবিলের সামনের চেয়ার টেনে বসে পড়লো। দ্রুত হাতে নোটবুক তুলে নিয়ে খসখস করে লিখলো কিছু, এক টানে পৃষ্ঠা ছিড়ে সেটাকে মুঠোয় ভরে ছুটে বেরিয়ে এলো আবার। তারপর সোজা ফ্লোরের এক কোণার অবস্থিত লালচে অংশটির সামনে গিয়ে থামলো।
মুহুর্তেই তার সম্মুখে ভেসে উঠলো এক ঘন, কালো ধোঁয়ার মতোন আবছা আবরণ, তারই বা পাশে ধীরে ধীরে ভেসে উঠলো একটি অফ হোয়াটের ক্যি প্যাড। ক্যি প্যাডের নিচে, ডান কোণে ছোট্ট করে ভেসে উঠলো একটি লেখা, ‘গ্রান্ড টেরেস’।

বাহার আঙুল রাখলো সেখানে। কালো আবরণ সাড়া দিয়ে পরিণত হল্য উজ্জ্বল সাদা আলোতে, যেন খুলে গেলো একটি উজ্জ্বল প্রবেশপথ। বাহার নিঃশব্দে পা বাড়ালো ভেতরে, ঢুকতেই আলো নিভে এসে ভর করলো এক রহস্যময় ছায়া, পরমুহূর্তেই নিজেকে সে আবিষ্কার করলো প্রাসাদের রুফটপে ওঠার মার্বেল পাথর নির্মিত চওড়া সিঁড়ির সম্মুখে।
সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে উপরে উঠে গেলো বাহার। এই রহস্যময় লিফটের কাজ করার পদ্ধতি ওর জানা নেই। প্রথম প্রথম এর ভেতরে ঢোকাটা ওর কাছে ভয়াবহ মনে হতো। কিন্তু এখন ভয় কেটে গেছে অনেকটাই।
ছাদে পা রাখতেই চোখে পড়লো কয়েক ঝাঁক মেয়ে, তাদের ভেতর একজন হিজ ম্যাজেস্টির খাসবাদী, অরোরা। বেশ দেখতে, আকর্ষণ করার এক দারুণ ক্ষমতা আছে তার ভেতর। বাদশাহ ইলহান এখনো তাকে নিয়মিত কাছে ডাকেন। শোনা যাচ্ছে বাদশাহর সন্তানের জননী সে-ই হবে৷ তাই তাকে নিয়ে দাসীদের আগ্রহের কমতি নেই। তাকে ঘিরে এখনো দাঁড়িয়ে এক ঝাঁক দাসী, খলবলিয়ে গল্প করছে তারা৷
গুলবাহারকে দেখে তারা সামান্য সংযত হলো। ইয়াসমিন কালবির অ্যাসিস্ট্যান্ট সে, কোথাও কোনো অসঙ্গতি দেখলে সোজা গিয়ে জানিয়ে দিবে।

গুলবাহার তাকিয়ে দেখলো চারদিকে। এত মেয়ে এই অসময়ে এখানে কি করছে বুঝে আসলো না ওর। এদের কি কোনো কাজ নেই নাকি? ঝর্রণার পাশে বসে দেদারছে গল্প করেই যাচ্ছে, করেই যাচ্ছে!
বাহার চোখ কুচকে আকাশের দিকে তাকালো একবার, খুঁজলো কিছু। খুঁজে না পেয়ে সামান্য হতাশ ভঙ্গিতে গিয়ে বসলো ঝর্ণার পাশে। দাসী গুলোকে কিভাবে ছাদ থেকে বের করবে সেই পরিকল্পনা করতে থাকলো মাথার ভেতর৷
কিছুক্ষণ গভীর চিন্তাভাবনার পর অবশেষে উঠে অরোরার কাছে গিয়ে বলল,
“হিজ ম্যাজেস্টির মিটিং শেষ হয়েছে, তোমাকে তাঁর প্রয়োজন হতে পারে যে কোনো সময়। এখনি নিচে যাও, নইলে হিজ ম্যাজেস্টি তোমাকে ডেকে না পেলে রেগে যাবেন৷”

অরোরা মেয়েটির চোখে মুখে ভয় ফুটে উঠলো কিঞ্চিৎ, সঙ্গীরাও একে অপরের দিকে উদ্বিগ্ন চোখে দেখলো। অরোরা তাদের সাথে নিয়ে তড়িঘড়ি করে নেমে গেলো নিচে।
ওরা নেমে যেতেই মেঘের নিকট হতে একটি বাজপাখির সুউচ্চ, তীক্ষ্ণ ডাক ভেসে এল। বাহার মাথা তুলে তাকাতেই দেখলো দূর আকাশে একটি বিশাল বাজপাখি মেঘের চতুর্দিকে বৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে ডেকে চলেছে। ডানা দুটো স্থীর, কোনো ঝাপটানি নেই তাতে।

বাহার অস্থির হলো, এখনো ছাদের যেখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে অনেক গুলো মেয়ে। বাহার তাদের দিকে এগিয়ে গেলো, ইয়াসমিনের কড়া নজরের ভয় দেখিয়ে সবাইকে পাঠিয়ে দিলো নানা কাজের ফিরিস্তি দিয়ে। ওর কর্তৃত্বপূর্ণ ধমকাধমকিতে একে একে ছাদ ত্যাগ করলো সকলে।
ছাদ ফাঁকা হতেই বাহার তাকালো আবার আকাশের দিকে। দেখলো বাজপাখিটা শেষবারের মতোন বৃত্তাকারে ঘুরে তীরের ফলার ন্যায় তীব্র বেগে ঘুরে ছুটে আসছে এদিকেই। বাহার ঝর্ণার ধার থেকে উঠিয়ে নিলো একটি ছোট্ট নুড়ি। হাতের মুঠির ভেতর থাকা কাগজের ভেতর নুড়িটি মুড়িয়ে নিয়ে এক নিঃশ্বাসে নিষানা করে ছুড়ে দিলো আকাশের দিকে।
বাজপাখিটি উড়ে যাওয়ার পথে ঠিক সময়মতো এসে নিজের ধারালো নখর দিয়ে খপ করে ধরলো সেটা, মুহূর্তেই ঘুরে গিয়ে তীব্র বেগে উড়ে চলল রেড জোনের দিকে।

আনাবিয়া এখনো ঘুমে। ভোরে একবার উঠেছিলো, কিন্তু বেশিক্ষণ জেগে থাকতে সক্ষম হয়নি, ঘুমের ভারে চোখ ভেঙে আসছিলো। তাই কাজ কর্ম শেষে আবার ঘুমিয়েছে৷ লায়রা ফক্সির ঘুম ভেঙে গেছে, তারা বাইরে বেরিয়ে ছোটাছুটি করার জন্য বারবার দরজার নিকট গিয়ে ঘুরে ফিরে আসছে। ডাকাডাকি করে মালকিন কে জাগাতে মনে সায় দিচ্ছে না, দুজনে তাই চুপচাপ দুঃখবিলাস করতে ব্যাস্ত।
এমন সময়ে সাইড টেবিলের ওপর রাখা যান্ত্রিক বস্তুটা আচমকা চেচিয়ে উঠলো একঘেয়ে কর্কশ শব্দে। বিরক্তিতে ভ্রু কুচকে উঠলো আনাবিয়ার। চোখ জোড়া না মেলেই হাত বাড়িয়ে কোনো রকমে তুললো সেটা। রিসিভ করে ঘুম জড়ানো কন্ঠে হু’ বলতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো কোকোর কিঞ্চিৎ শঙ্কিত কন্ঠস্বর,
“আম্মা…!
শার্লট চিকেন স্ট্যু করেছিলো, হিজ ম্যাজেস্টি এক চামচ মুখে দিয়েই পুরো ট্রেটা ছুড়ে ফেলেছেন বাইরে! এখন কি করবো?”
আনাবিয়া ফোস করে শ্বাস ছাড়লো, এই জীবনে ওর বোধ হয় আর শান্তি পাওয়া হবে না। গলা পরিষ্কার করে শুধোলো,

“এখন কি করছে সে?”
“বারান্দায় ঘুরে ঘুরে দেখছেন, কামরায় কামরায় উঁকি দিচ্ছেন, আপনাকে খুঁজছেন বোধ হয়। তাঁর মন মেজাজ ভালো ঠেকছে না, আমরা তার থেকে দূরে দূরে আছি।”
“দূরেই থাক, ক্ষিদে পেলে ওর মাথায় কাজ করে না, রেগেমেগে এক চটকানা দিয়ে দিলে তখন ঘাড় ঘুরে যাবে৷ ওর দিকে খেয়াল রাখ যেন বারান্দা থেকে নেমে জঙ্গলে না ঢুকে যায়, আমি আসছি।”
বলে ফোন রাখলো। চিৎ হয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। উঠতে ইচ্ছে করছে না একদমই, ঘুম এখনো পুরোপুরি ছাড়েনি ওকে, জাপটে ধরতে চাইছে আরও।
বুক ভরে শ্বাস নিয়ে আবার ছেড়ে দিয়ে এক ঝটকায় উঠে বসলো ও, এখন গড়িমসি করলে ঘুম তার জাদুকরী জাল বিছিয়ে ওকে পরাজিত করে আবার নিয়ে যাবে বিছানায়।
ওকে উঠে বসতে দেখে মেঝেতে মুষড়ে শুয়ে থাকা লায়রা ফক্সি তড়াক করে উঠে দাড়ালো, লেজ নাড়িয়ে জানান দিলো নিজেদের খুশির মাত্রা। আনাবিয়া হাই তুলে বিছানা থেকে নেমে ওদের দুজনের মাথায় আদুরে স্পর্শ বুলিয়ে দিয়ে চলে গেলো ফ্রেশ হতে।

মসভেইলের বারান্দা চত্বরে কাঠের সিঁড়ির মুখের নকশাদার স্তম্ভে হাত ঠেকিয়ে প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মীর।পরণে ট্রাউজার, শরীরের ঊর্ধ্বাংশ উন্মুক্ত। হাত ভাজ করে ঠেস দেওয়ায় বাহুর পেশি বলিষ্ঠ ভঙ্গিতে উদ্ভাসিত হয়ে আছে। কঠোর চোয়াল, এলোমেলো চুল, রোমশ বক্ষ, লম্বা, পেশিবহুল পাতলা পুরুষালি শরীর হতে চোখ ফেরানো দায়! শরীর কমে যাওয়ায় ট্রাউজারটি নেমে গেছে নাভির কিছু নিচে, আরেকটু হলেই বিপদসীমার কাছাকাছি চলে যাবে সেটা।

বিরক্তির প্রথম কারণ ক্ষুধা, দ্বিতীয় কারণ বাজে স্বপ্ন, তৃতীয় কারণ গতদিনের মেয়েটি, চতুর্থ কারণ স্থান পরিবর্তন। ঘুম থেকে উঠেই নিজেকে ভিন্ন পরিবেশে পেয়ে তার মেজাজ বিগড়ে আছে। এমনিতেই মস্তিষ্কের ভেতর সমস্তই এলোমেলো, তার ওপর রোজ ঘুম থেকে উঠে নিজেকে নতুন নতুন স্থানে আবিষ্কার করে ওর ওপর ভর করেছে দুনিয়া বিরোধী অস্থিরতা। পেটের ভেতর ভীষণ ক্ষুধা! সকালে মেয়েটা কি ছাঁই পাশ খেতে দিয়েছে, বিচ্ছিরি!
রোজ স্বপ্নে এক অদ্ভুত প্রাসাদ আর এক চোখ ঝলসানো সুন্দরী মেয়েকে দেখে ঘুম ভাঙছে ওর, স্বপ্ন গুলো এতই বাস্তব যে স্বপ্নালোক আর বাস্তবতার ভেতর পার্থক্য করা ওর জন্য কঠিন হয়ে দাড়িয়েছে। এমন অদ্ভুত স্বপ্ন দেখার কারণ কি সে জানেনা, এর থেকে কি ওর রেহাই নেই? নাকি এসমস্ত স্বপ্ন ওর ভবিতব্য, যা থেকে পালানোর সাধ্য ওর নেই?

তাকালো সে একবার চারদিকে, জায়গাটা খারাপ নয়, পছন্দসই, বেশ দারুণ। চারদিকে জঙ্গল, ঘন জঙ্গল। কেমন দারুণ গা ছমছমে, ভূতুড়ে, হিংস্র পরিবেশ। যেন হাত বাড়িয়ে ইশারা দিয়ে ওকে আহ্বান করে চলেছে গহীনে হারিয়ে যেতে, কোনো লোমহর্ষক রোমাঞ্চকর ভ্রমণে বেরিয়ে পড়তে। একবার এই অতল সমুদ্রের ন্যায় অশেষ জঙ্গলে ঢুকে পড়তে পারলে বেশ হতো!
জঙ্গলের প্রতি এই হঠাৎ প্রেম কেন উদয় হলো বোধগম্য হলোনা ওর, তাকিয়ে রইলো ভীষণ লম্বা লম্বা রেড উড গাছগুলোর দিকে। এই গাছ গুলোর নাম রেড উড এটা ওর কিভাবে মনে আছে? পাশের গাছটি অশ্বত্থ, এটাও তো ও চিনে! কিভাবে চিনে? সব গাছই যেন ওর চেনা, এই জঙ্গল, এই পরিবেশ, এই খোলা মাঠ চত্বর, এই সব কিছুই যেন ওর জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত- কিন্তু কিভাবে? কেন এসব কিছু এত্ত চেনা?
বিরক্তি সরে গিয়ে মীরের মুখের ওপর এসে ভর করলো বিস্ময়, আর এক রাশ জিজ্ঞাসা।
কেন? কিভাবে? এখানে কি সে পূর্বেও এসেছে? সবকিছু অচেনা হওয়া সত্ত্বেও কোথায় যেন এক চিলতে চেনা চেনা অনুভব! সে নিশ্চয় এখানেরই অধিবাসী। কিন্তু তার আশেপাশের লোকজন গুলোর কি পরিচয়?
একজনকে সে চিনে বটে, অভদ্র দেখতে ছেলেটা, গতকাল যার হাত মুচড়ে দিয়েছিলো বিছানা নষ্ট করে দেওয়ার অপরাধে৷ কিন্তু বাকিরা?

তীক্ষ্ণ নজরে সকলকে সময় নিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে রইলো মীর। ওকে এভাবে এক এক জনের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভড়কালো সকলে। ক্ষেপে গেলো নাকি? হঠাৎ রেগেমেগে কার ওপর যে হামলে পড়বে তার ইয়ত্তা নেই!
মহলের সম্মুখে, কিছুটা দূরে থাকা অশ্বত্থের নিচে দাঁড়িয়ে আছে কোকো, ফ্যালকন আর হাইনা। মীরের নজর ওদেরই দিকে। জোভি ভয়ে এদিকে আসেইনি, কাঞ্জি আর আলফাদ হলরুমের দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে। মীর বারান্দা থেকে প্রস্থান না করা অব্দি লুকিয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুজনে৷ লিও এখনো ঘুমিয়ে, ওর ওপর সকলের ভয়ানক রাগ। লিন্ডা না হয় অসুস্থ, কিন্তু ওই বেয়াদবটা অকারণে ঘুমিয়ে আছে মহাসুখে, আর এরা এখানে হিজ ম্যাজেস্টির খাবারে অরুচির রোষানলে পড়েছে।

ব্রায়ান আর ওকামি ট্রে ছোড়ার কাহিনী হওয়ার পরপরই বেরিয়ে গেছে মীরের খাবার রান্নার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করতে। শার্লট কিচেনের দরজার আড়ালে লুকিয়ে উঁকি দিয়ে বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে মীরের দিকে। মুখটা কিঞ্চিৎ হা হয়ে আছে ওর।
ফাতমা ফুপিয়ে কেঁদে চলেছে, সকালের খাবার মীরকে সে-ই দিতে গেছিলো। এক চামচ মুখে দিয়ে যেই ভয়ঙ্কর চোখে সে ফাতমার দিকে তাকিয়েছে তাতেই ফাতমার আত্মা উড়ে পৃথিবী ছেড়ে মহাকাশের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছে। রেগেমেগে ট্রে ছুড়ে দেওয়া মাত্রই ভয় পেয়ে দৌড়ে পালিয়ে কিচেনে এসে আশ্রয় নিয়েছে সে। সেই থেকে কেঁদেই যাচ্ছে। রেক্সা পাশে বসে পিঠে হাত বুলিয়ে স্বান্তনা দিছে ওকে, আর ফাতমা নাক টানতে টানতে কিছুক্ষণ পর পর চাপা গলায় বিড়বিড় করে বলছে,

“আমি আর যাবোনা, এবার গেলে আমাকে মেরে ফেলবে, আমি আর এখানে থাকবোনা, সেইফ জোনে ফিরে যাবো…! আজ আমার জ্বর আসবে, আজ ভয়ে আমার জ্বর আসবে দেখে নিও তোমরা!”
মীরের শকুনি দৃষ্টি অশ্বত্থের দিক থেকে হঠাৎ এসে আক্রমণ করলো কিচেনের দরজার নিকট থেকে মুখ বের করে থাকা শার্লটের ওপর। ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে গেলো শার্লট, তড়িঘড়ি উঠে পড়ি কি মরি করে পালালো ও দরজার পেছন থেকে, ছুটে গিয়ে ফাতমার গা ঘেঁষে বসে স্তম্ভিত দৃষ্টি তে রেক্সার দিকে তাকিয়ে রোবটের মতোন বলে উঠলো,

“ও বাবা গো….!”
ওকে দেখে ফাতমার কান্নাকাটি বেড়ে গেলো দ্বিগুণ, শার্লটকে বাহুর আঘাতে সরিয়ে দিয়ে নাক টেনে বলল,
“এই তুই আমার কাছে ঘেঁষবি না, তোর জন্য আজ আমার এই অবস্থা! অখাদ্য রান্না করেছিস তুই, আর হিজ ম্যাজেস্টির রক্তচক্ষুতে পড়লাম আমি!”
“আমি অখাদ্য রান্না করি?”

কাঁদো কাঁদো গলায় শুধোলো শার্লট। রেক্সা ওদের দুজনকে চুপ করিয়ে বলল,
“আস্তে কথা বলুন, হিজ ম্যাজেস্টি শুনতে পেলে যদি এখানে চলে আসে তবে পালানোর আর জায়গা থাকবে না৷”
রেক্সার সাবধান বাণী শুনে সাথে সাথে চুপ করে গেলো দুজনেই। কিছুক্ষণ পর শার্লট নিচু স্বরে স্বগোতক্তি করলো,
“এরকম ভয়ঙ্কর চাহনির লোকের সাথে অ্যানা কি করে থাকতো? আমি হলে তো দুই মিনিটেই অক্কা পেতাম! দুই মিনিটও বেশি হয়ে যায়, ত্রিশ সেকেন্ড, ম্যাক্সিমাম!”
“অ্যাহ্‌, আদার ব্যাপারির জাহাজের চিন্তাভাবনা। ডিঙি নৌকার চিন্তা কর বেয়াদব! আর তোকে কতবার বলেছি অ্যানা নয় শেহজাদী বলবি।”
নাক টেনে খিচিয়ে বলে উঠলো ফাতমা। শার্লট ওর লাল চোখের দিকে একবার তাকিয়ে আবার আগের মতোই রোবট হয়ে বসে রইলো।

মীরের পেটের ভেতর গুরুগুরু শব্দ হতে শুরু করেছে। এখনি কিছু পেটে না পড়লে নিশ্চিত মাথায় খুন চেপে বসবে! দাঁত কিড়মিড় করে তাকালো অশ্বত্থের তলায় থাকা কোকো ফ্যালকন আর হাইনার দিকে। ফ্যালকন সাথে সাথে লুকিয়ে পড়লো কোকোর পেছনে, তার পাতলা শরীর কোকোর শরীরের আড়ালে মিলিয়ে গেলো।
হাইনা আর কোকো ভয়ে ভয়ে চোখাচোখি করলো একবার, শেহজাদীকে সেই কখন সংবাদ দিয়েছে, কিন্তু তিনি এখনো আসলেন না। আজ সবকটার খবর হয়ে যাবে৷
তখনি জঙ্গল হতে মসভেইলে প্রবেশের সরু রাস্তার ওপর দেখা গেলো হুডি আর ট্রাউজারে আবৃত আনাবিয়াকে। হাতে একটা পেপার ব্যাগ। ওকে দেখা মাত্রই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো কোকো। পেছন থেকে ফ্যালকনকে এক টানে সামনে নিয়ে এসে বলল,

“সর হাঁসের বাচ্চা, আম্মা এসে গেছে।”
ফ্যালকন মুখ ভেংচি দিয়ে হাইনার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো, তারপর বারান্দায় তাকাতেই দেখলো মীরের মুখের সমস্ত বিরক্তি, সমস্ত রাগ ভোজবাজির মতোন উবে গেছে। উপরন্তু বেশ আগ্রহের সাথেই সে তাকিয়ে আছে আনাবিয়ার হাতের পেপার ব্যাগের দিকে। ফ্যালকন কোকোকে আঙুলের খোঁচা দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল,
“ওই দেখো ভাইজান। মানুষের কত রকমের রূপ!”
আনাবিয়াকে দেখে মীর হাত নামিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো, আগ্রহী দৃষ্টি তখনো নিবদ্ধ রইলো আনাবিয়ার হাতের প্যাকেটের দিকে। আনাবিয়ার চোখ প্রথমেই পড়লো মীরের কোমরে, আরেকটু নিচে নামলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে৷
দ্রুত সিড়ি বেয়ে উঠে মীরের ট্রাউজারের উপরাংশ ধরে এক টানে পেটের ওপর উঠিয়ে দিয়ে তেজি গলায় বলল,
“খুলে পড়ে যাচ্ছে, চোখে দেখছেন না নাকি?”
মীরের ওসব শোনার সময় নেই, সে আনাবিয়ার হাত থেকে পেপার ব্যাগটা ছো মেরে ছিনিয়ে নিলো। ভেতর থেকে দারুণ রকম সুঘ্রাণ আসছে৷
সময় তেমন ছিলোনা, আনাবিয়া ফ্রিজ দেখে কয়েক টুকরা স্যামন বের করে গ্রিল করে নিয়েছে, সাথে কয়েকটা বাটার টোস্ট। মীর এক টানে প্যাকেট ছিড়ে খাওয়া শুরু করলো অবিলম্বে। আনাবিয়া ওর এই হাঁসের মতোন খাওয়া দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো একটা, বলল,

“এখন এগুলো খেয়ে ভালো ছেলেটির মতো চুপচাপ বসে থাকবেন। আমার রান্না এখুনি হয়ে যাবে, তখন পেট ভরে খাবেন, ঠিক আছে?”
মীর মুখের ভেতর সবগুলো টোস্ট একত্রে ঠেসে ভরে দিতে দিতে ওপর নিচে মাথা নাড়ালো। আনাবিয়া হতাস ভঙ্গিতে টোস্ট গুলোর দিকে তাকিয়ে এগোলো কিচেনের দিকে।
ফাতমার কান্না থেমেছে, এখনো ফোঁপাচ্ছে সে। শার্লট বসে বসে ভাবছে দুপুরের রান্নার কি করবে, রেক্সা দুজনকে সমান তালে স্বান্তনা দিয়ে যাচ্ছে৷ দেখে মনে হচ্ছে আজকের দিনের জন্য সে মোটিভেশনাল স্পিকারের পেশা গ্রহণ করেছে।
আনাবিয়াকে ঢুকতে দেখে নড়ে চড়ে বসলো ওরা। আনাবিয়া ঢুকেই শার্লটকে বলল,

“মীরের জন্য আমি রান্না করছি, তুই বাকিদের জন্য খাবারের ব্যাবস্থা কর৷”
শার্লট ঠোঁট ফুলিয়ে উঠে শুধোলো,
“শেহজাদী, আমার রান্না কি এতই খারাপ?”
“মীরের এসব খেতে অভ্যস্ত নয়, প্রাসাদের রয়্যাল শেফ আর আমার হাতের খাবারেই ওর রুচি বাঁধা। মাংস বা সামুদ্রিক খাবারে অরুচি নেই কিন্তু ওর আলাদা মশলা, সবজি প্রিফারেন্স আছে। সব ধরনের মশলা বা সবজি সে খায়না, অপছন্দের কিছু মুখে পড়লেই ধরে ফেলতে পারে। স্বাদ মনমতো না হলে তো একদমই খেতে চায়না।
হয়তো সেই মেমোরি কোর গুলোই ব্রেইনে হিট করছে। এসব নিয়ে একদম মন খারাপ করিস না, তোর রান্না অনেক টেস্টি।”
চুলার ওপর প্যান বসিয়ে গরম করতে করতে মিষ্টি হেসে মোলায়েম স্বরে বলল আনাবিয়া। শার্লট আশ্বস্ত হয়ে আবার বসলো ফাতমার গা ঘেঁষে।

মীরের চুল বেয়ে পানি পড়ছে টপটপিয়ে, মাত্রই টাওয়েল ঘষে শুকোনো শরীর ভিজে যাচ্ছে তাতে। আনাবিয়া দাঁড়িয়ে আছে পাশেই, দেখিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে কিভাবে শরীরের পানি ভালোভাবে মুছে ফেলতে হবে।
মীর আজ নিজে নিজে গোসল দিয়েছে, সেটাও আনাবিয়ার নির্দেশনাতেই। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে শুধু বলে গেছে এটা করুন, ওটা করুন, আর মীর বিনা বাক্যব্যয়ে একের পর এক আদেশ পালন করে গেছে৷
আনাবিয়া চেয়েছিলো কোকো দের কেউ এসে এ কাজ করুক, কিন্তু আনাবিয়ার প্রস্তাব শোনা মাত্রই ভয়ে সবগুলো এদিক ওদিক ছুটে উধাও হয়ে গেছে, কারো টিকি পাত্তা নেই। রান্না শেষ করে তাই বিশ্রামের ফুরসত মেলেনি ওর, মীরকে গোসল দিয়ে তবেই বসবে৷

মাথা মোছা হয়নি দেখে আনাবিয়া কিঞ্চিৎ ধমকের সুরে বলে উঠলো,
“চুল বেয়ে পানি পড়ছে, ভালো করে মুছুন।”
মীর টাওয়েল ঘুরিয়ে নিয়ে এলো একবার মাথা জুড়ে। আনাবিয়া তেজি গলায় বলল,
“হচ্ছে না, আমার কাছে দিন!”
বলে নিজেই মীরের হাত থেকে টাওয়েল ছিনিয়ে নিলো, হাত বাড়িয়ে মাথা মুছে দিতে গিয়ে মনে পড়লো তিনি তো লম্বা!
“মাথা নিচে করুন।”
বলল আনাবিয়া, মীর ঝুঁকে মাথা বাড়িয়ে দিলো আনাবিয়ার দিকে। দলাই মলাই করে ভালো ভাবে মাথা মুছে দিয়ে আনাবিয়া বলল,
“নিজে নিজে পোশাক পরতে পারবেন, নাকি আমাকেই পরিয়ে দিতে হবে?”
মীর হ্যাঙার হতে ট্রাউজার টা হাতে নিতে নিতে মাথা নেড়ে ভ্রু নাচিয়ে বোঝালো, – খুব পারবে৷ আনাবিয়া ওর আত্মবিশ্বাস দেখে মুখ বাকালো, বলল,
“পোশাক পরে বাইরে আসবেন, আমি খাবার দিচ্ছি।”
খাবারের কথা শুনে মীরের শুকনো মুখটা খুশি খুশি হয়ে উঠলো, মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিতেই বেরিয়ে এলো আনাবিয়া।

খাবার টেবিলে শুধু মাত্র একটি গ্রিলড চিকেন আর চার পাঁচটি নান রুটি দেখে মীরের মুখে আঁধার নামলো। নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলো আনাবিয়ার দিকে। আনাবিয়া কিচেন থেকে বড়সড় এক পাত্র ভর্তি মাশরুম কারি নিয়ে টেবিলে রাখলো, মীরের অসন্তোষ খেয়াল করে চোখ না তুলেই সে বলল,
“কিচেনে আরও আছে, খাওয়া শুরু করুন।”
মীরের মুখের রঙ ফিরলো, কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে আনাবিয়ার দিকে তাকিয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেললো একটা। পরমুহূর্তেই ঝাপিয়ে পড়লো খাবারের ওপর। আস্ত চিকেনটা দুহাতে উঠিয়ে টেনে ছিড়ে ফেলে বসালো বিশাল কামড়, এক কামড়ে চিকেনের তিন ভাগের এক ভাগ হারিয়ে গেলো ওর মুখগহ্বরে! মুখের দুপাশে, নাকের ডগায় লেগে রইলো চিকেনের গায়ের মশলা। চিবোতেই স্বাদ ছড়িয়ে পড়লো মুখের ভেতর, এক মুহুর্তে মনে হলো এই একই স্বাদের চিকেন গ্রিল সে আগেও খেয়েছে, বহুবার! চিবোতে চিবোতে চিকেনের বাকি অংশটুকু নিজের চোখের সম্মুখে এনে ধরে দেখলো সে কিছুক্ষণ।

বিশাল থাবা বাড়িয়ে নান গুলোর থেকে একটা উঠিয়ে নিতে গেলো, কিন্তু গরম নানে ছ্যাকা দিলো ওর হাতে, দ্রুত হাত সরিয়ে নিয়ে মুখ থেকে চ’ জাতীয় শব্দ করলো ও। কিন্তু ক্ষুধার তাড়নায় পরমুহূর্তেই নানটা উঠিয়ে দুদিকে টান দিয়ে ছিড়ে দু ভাগ করে একাংশ মুখের ভেতর ঠুসে দিলো।
আনাবিয়া গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। পূর্বে মীরকে সে বেশি বেশি খেতে দেখেছে ঠিকই, কিন্তু সে যে এমন রাক্ষুসে খাওয়া খেতে পারে আনাবিয়ার জানা ছিলোনা৷ আর দুটো কামড় দিলেই গ্রিল উধাও হয়ে যাবে, নিশ্চয় আবার চাইবে! ভাগ্যিস আরও দুটো গ্রিল করে রেখেছিলো!
আনাবিয়া কিচেনের দিকে যেতে নিলো, কিন্তু ওকে চলে যেতে দেখেই মীর গলা থেকে শব্দ করে উঠলো। আনাবিয়া ফিরে তাকাতেই মীর ওকে হাতের ইশারায় টেবিলের অপর পাশের চেয়ার দেখিয়ে দিলো।
মানে কি? এখন বসে বসে ওর খাওয়া দেখতে হবে? আনাবিয়া চোখ ঘুরালো, তারপর চেয়ার টেনে বসলো মীরের মুখোমুখি। বসতে না চাইলে আবার কি করে বসবে বলা মুশকিল।
গ্রিল ছেড়ে মীর এবার মাশরুমের পাত্রের দিকে হাত বাড়ালো। আনাবিয়া দ্রুত বলে উঠলো,

“বোলের ভেতর হাত দিবেন না, স্পুন দিয়ে নিবেন৷”
চামচ দিয়ে কিভাবে নিতে হবে দেখিয়ে দিলো আনাবিয়া। মীর কিছুক্ষণ চামচের দিকে তাকিয়ে থেকে অতঃপর আনাবিয়ার নির্দেশনা মতোন সেটা দিয়ে তরকারি নিতে চাইলো, কিন্তু কয়েকবার চেষ্টা করেও যখন মনের মতো তারকারি উঠলো না, পাশ গলিয়ে পড়ে গেলো তখন রেগেমেগে সেটা ছুড়ে দিলো কোথাও। তারপর হাত ঢুকিয়ে দিতে গেলো তরকারির ভেতর।
“থামুন থামুন! আমি দিচ্ছি, আমি দিচ্ছি।”
আনাবিয়া দুহাত তুলে ওকে থামিয়ে দিয়ে আরেকটা চামচ উঠিয়ে নিলো। পাশে থাকা টিস্যু দিয়ে মীরের মুখের দুপাশ মুছে দিয়ে ওর হাত থেকে রুটির অবশিষ্টাংশ নিয়ে তাতে চামচ দিয়ে তরকারি উঠিয়ে রোল করে মীরের মুখের সামনে ধরে বলল,

“দেখি, আ- করুন।”
মীর মুখ আলগা করতেই আনাবিয়া সেটুকু অত্যন্ত যত্নসহকারে পুরে দিলো ওর মুখের ভেতর।
মীরের হঠাৎ ডেজা ভ্যু হলো, এই মুহূর্ত….. ঠিক এমন করেই ওকে কেউ খাইয়ে দিয়েছে পূর্বেও… বহুবার!
চোখের ওপর কিছু অস্পষ্ট স্মৃতি হঠাৎ ভেসে উঠলো মীরের। আনাবিয়ার মুখপানে চেয়ে এক অজানা প্রশ্ন উঁকি দিলো মনে- এই মেয়েটিই কি তার খুব কাছের কেউ? সে কি এই মেয়েটাই?
ভাবনারা দানা বাঁধতে না বাঁধতেই ভারী হয়ে এলো মীরের মস্তিষ্ক, এক রাশ অস্পষ্ট স্মৃতির হঠাৎ আক্রমনে মস্তিষ্কের শিরা উপশিরা জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো এক অদ্ভুত চিনচিনে যন্ত্রণা!

দ্রুতই ভাবনা ঝেড়ে ফেললো সে, সমস্ত মনোযোগ নিয়ে এলো খাবারের দিকে। মেয়েটির হাতে খাওয়ার মাঝে যেন এক অদ্ভুত মাধুর্য লুকিয়ে আছে, খাবারের স্বাদ দ্বিগুণ হয়ে ধরা দিচ্ছে যেন! মীর এবার নিঃশব্দে খাবারের সব পাত্র ঠেলে দিলো আনাবিয়ার দিকে। চোখের গভীর ইশারায় বোঝালো এগুলো এখন সব তাকেই খাইয়ে দিতে হবে।
আনাবিয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এ-ই হবে, মীরের থেকে দুরত্ব বজায় রাখা ওর পক্ষে এই জীবনে আর সম্ভব হবে না বোধ হয়। এভাবেই বার বার ভাগ্য ওকে টেনে টেনে নিয়ে আসবে মীরের কাছে, আর নয়তো মীর নিজেই ঘুরে ফিরে হাজির হবে ওর সামনে৷
আনাবিয়া সময় নিয়ে অল্প অল্প করে খাইয়ে দিলো মীরকে সমস্তই, শিখিয়ে দিলো নিজে নিজে কিভাবে খেতে হবে, চামচ কিভাবে ব্যাবহার করতে হবে, কিভাবে খেলে মুখে লেগে থাকবে না৷ মীর গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনলো আনাবিয়ার সমস্ত কথা, সমস্ত সুর, কন্ঠের উত্থান পতন। মস্তিষ্ক ওকে বারংবার জানান দিলো এই স্বর তার চিরচেনা, কিন্তু কেন, কিভাবে, তার সুরাহা করে উঠতে পারলোনা।

ট্রি হাউজের ভেতর মিটিমিটি জ্বলছে আলো। আনাবিয়া নরম বিছানায় বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে বসে এক মনে পড়ছে কোনো বই। কোমর পর্যন্ত ঢাকা ছাই রঙা চাদরে।
সফেদ চুল গুলো বেনি করে রাখা, কপালের ওপর কয়েকটি বেবি হেয়ার এসে গড়াগড়ি খেতে ব্যাস্ত৷
লায়রা আর ফক্সির জন্য মেঝেতে বিছানা করে দিয়েছে আনাবিয়া, দুজনে গলাগলি করে ঘুমিয়ে আছে বেঘোরে। মাঝে মাঝে পুরুর পুরুর শব্দ করে নড়াচড়া করে উঠছে দুটো, এঁকেবেঁকে ঘুরে ঘুরে ঘুমোচ্ছে একটু পর পর।
আনাবিয়ার ঘুম চলে আসছে, সারাদিনে বেশ ধকল গেছে ওর। মীরের জন্য রাতের খাবার প্রস্তুত করে দিয়ে সন্ধ্যাতেই ফিরে এসেছিলো। কিন্তু খাবার সময় সে আনাবিয়াকে না পেয়ে ওদিকে ধুন্ধুমার লাগিয়ে দিয়েছিলো, বাচ্চারা ভয়ে যে যেখানে পেরেছে লুকিয়েছে। ফাতমা তো সকাল থেকে আর বাইরে বেরই হয়নি ভয়ে, রাতের ঘটনায় তার এবার সত্যি সত্যিই জ্বর চলে এসেছে।

কোকো ফোনে জানালো দ্রুত ওদিকে গিয়ে তাকে সামলাতে, নইলে আজ কাউকে না কাউকে উপরে যেতে হবে নিশ্চিত। বাধ্য হয়ে আনাবিয়াকে আবার ছুটে যেতে হলো মসভেইলে। পাগলা ষাঁড়ের মতোন ফুঁসতে থাকা মীরকে শান্ত করে, রাতের খাবার খাইয়ে, বিছানায় শুইয়ে দিয়ে তবেই ফিরতে হয়েছে।
আনাবিয়ার চোখের পাতা ভারী হয়ে এলো। কোলের ওপর থাকা বইটা সশব্দে বন্ধ করে রেখে দিলো সাইড টেবিলের ওপর। নড়েচড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে আয়েশ করে চাদর টেনে টুনে নিজেকে মুড়িয়ে নিয়ে হাত বাড়িয়ে টেবিল ল্যাম্প বন্ধ করতে নিতেই বাইরে কোনো কিছুর ধপ শব্দে মাটিতে পড়ার আওয়াজ পেলো আনাবিয়া।
সজাগ হয়ে উঠলো সে। কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করলো বাইরের শব্দ, পায়ের সুক্ষ্ম আওয়াজ কানে এলো ওর।
তখনি দরজায় কড়া নাড়লো কেউ। পরমুহূর্তেই বাইরে থেকে একটি মেয়েলি কন্ঠ ডেকে উঠলো,

“শেহজাদী।”
পরিচিত কন্ঠ শুনে আনাবিয়া উঠে বসলো, বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলে দাঁড়াতেই নজরে পড়লো সদ্য তারুণ্যে পা দেওয়া একটি শ্যাম রঙা মেয়েকে। আনাবিয়াকে দেখা মাত্রই মাথা নামিয়ে আনুগত্যের সাথে সে বলে উঠলো,
“শেহজাদী, আপনার চিঠি এসেছে। দেরির জন্য ক্ষমা করবেন, দুপুরের আগে এসেছিলাম কিন্তু আপনাকে পাইনি, তাই….”

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩১

“কে পাঠিয়েছে?”
মেয়েটির বাড়িয়ে দেওয়া দুহাতের ওপর থেকে চিটিটা তুলে নিতে নিতে শুধোলো আনাবিয়া। মেয়েটি উত্তর করলো,
“বাহার পাঠিয়েছে, শেহজাদী, গুল বাহার৷”

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩৩

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here