বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩৬

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩৬
রানী আমিনা

আনাবিয়া হাতে ট্রে নিয়ে গুটিগুটি পায়ে এলো কামরার দরজার নিকট। সন্তর্পণে উঁকি দিলো ভেতরে। কেউ নেই, ওয়াশরুম হতে পানির শব্দ ভেসে আসছে। কালাভুনাটা গোসলে গেছে।
আনাবিয়া সতর্ক পায়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো, কিছুদিন ধরে দরজাটা ক্যাচক্যাচে শব্দ করছে, খুব সাবধানে ঠেললো। নিঃশব্দে ভেতরে গিয়ে টেবিলে খাবার রেখে জগ হাতে নিলো। পানি নেই।
জগ নিয়ে বেরিয়ে এসে পানি ভরে নিয়ে চুপিসারে কামরায় ঢুকলো আবার। ওয়াশরুম থেকে এখনো পানির শব্দ ভেসে আসছে, শালাটা বের হওয়ার আগেই কেটে পড়তে হবে। আনাবিয়া দ্রুত হাতে ট্রে থেকে খাবার নামিয়ে সাজিয়ে দিলো টেবিলে। গ্লাসে পানি ঢালতে যাবে তখনি পেছন থেকে গমগমে স্বরে কেউ শুধোলো,

“আজ আমাকে কি খাওয়ানো হচ্ছে?”
আচমকা কথায় চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে উঠলো আনাবিয়া। হাতের আঘাত লেগে তৎক্ষনাৎ গ্লাসটা ঝনঝন শব্দ তুলে পড়ে গেলো মেঝেতে, জগ থেকে খানিকটা পানি ছলকে পড়ে গেলো টেবিলের ওপর৷ ত্রাসে ঝটিতি পেছনে তাকালো ও।
ঘাড়ের ওপর দিয়ে টাওয়েল ঝুলানো, ভেজা শরীরের ওপর ট্রাউজার পরিহিত মীর তার প্রশস্ত খোলা বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁটে চাপা হাসি, হাসিটা গলা পর্যন্ত উঠে এসেছে, প্রাণপণে আটকে রেখেছে সে।
মেয়েটি ওইটুকু কথায় এতটা ভয় পেয়ে যাবে সে ভাবেনি৷
আনাবিয়া অথর্বের মতো দাঁড়িয়ে রইলো, দৃষ্টি আঁটকে রইলো মীরের চোখপরে। বুকের ভেতর শুরু হলো ক্রমাগত হাতুড়ি পেটা, কাছাকাছি এসে কেউ দাঁড়ালে নিশ্চিতভাবে শুনতে পেয়ে যাবে! সে কি তবে ধরা পড়েই যাবে? এত সহজে?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আনাবিয়ার গলা শুকিয়ে এলো মুহুর্তেই। নিজেকে কোনো রকমে সামলে নিয়ে একটা শুকনো ঢোক গিলে আমতাআমতা করে উত্তর করলো,
“ন্‌-নান রুটি আ-আর চিকেন গ্রিল।”
মীর ভ্রু উঁচিয়ে খাবারের মেন্যুর নিঃশব্দ প্রশংসায় করলো। অস্থির হয়ে হাত কচলাতে শুরু করলো আনাবিয়া, শয়তানটা এরকম কাহিনী করবে আঁচ করতে পারলে ও কখনোই এখানে আসতোনা, ফাতমাকে পাঠাতো।
মীরের স্থির দৃষ্টি ওরই দিকে, যেন পড়ছে ওর আদ্যপান্ত, বইয়ের মতোন, পাতা উলটে উলটে!
আনাবিয়ার গলা কাঁপলো, চোখ নিচে নামিয়ে নিলো দ্রুত! তারপর নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে গলা খাকারি দিয়ে তাকালো আবার মীরের দিকে৷

ভেজা চুল থেকে কপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে এক ফোটা পানি, চিবুকে এসে থামতেই আনাবিয়া মৃদুস্বরে বলে উঠলো,
“চুল থেকে পানি পড়ছে, ভালো করে মুছে নিন। ঠান্ডা লেগে যাবে নয়তো!”
মীর যন্ত্রের মতোন শুনলো ওর কথা, কাঁধের ওপর থেকে টাওয়েল নামিয়ে মাথা মোছা শুরু করও। তৎক্ষনাৎ ওর নোংরা কাপড়ে বাঁধা হাতের দিকে দৃষ্টি গেলো আনাবিয়ার।
অবিলম্বে সব রকমের অস্বস্তি ভুলে আঁতকে উঠলো আনাবিয়া৷ চোখে মুখে তীব্র উদ্বেগ ফুটে উঠলো তার, উত্তেজিত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনার হাতে কি হয়েছে?”

পরমুহূর্তেই দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো সে। চিন্তিত চেহারায় দুহাতে মীরের হাত টেনে নিলো, কপালে ভাজ ফেলে তেজ আর বিরক্তি মিশ্রিত গলায় ধমকে বলল,
“নোংরা কাপড় দিয়ে বেধেছেন কেন? ভালো কাপড় চোখে দেখেননি? এখন যদি ইনফেকশন হয়ে বসে?”
বলেই কাপড়ের টুকরোটা খুলে ছুড়ে ফেলে দিলো কোনো এক দিকে। ক্ষতের পরিমাণ চোখে পড়তেই দ্বিতীয় বারের মতো সন্ত্রস্ত হলো আনাবিয়া৷ মুখে ফুটে উঠলো নিদারুণ ব্যাথিত অভিব্যক্তি! মনে মনে ভয়ানক বকাবকি শুরু করলো সে মীরকে, চাপা ধমকের সুরে বলল,

“এত খানি কিভাবে কেটেছেন? সাবধানে কাজ করতে পারেন না? অত অসাবধান হলে কিভাবে চলবে?”
বলেই ত্রস্ত ব্যাস্ত ভঙ্গিতে কামরার ওয়াল আলমিরার নিকট গেলো ও৷ এখানের একটি কম্পার্টমেন্টে ফার্স্ট এইড কিট ছিলো। ও নিয়ে যায়নি, এখানেই রেখে গেছিলো। ছোট ছোট ক্ষতের ক্ষেত্রে নিজের এনার্জি যেন খরচ করতে না হয় সে জন্য কোকো নিয়ে এসে রেখেছিলো।
আনাবিয়া বের করলো সেটা। মীর এতক্ষণ ঠাই দাঁড়িয়ে দেখে যাচ্ছিলো ওর কর্মকাণ্ড। আনাবিয়া কিট হাতে নিয়ে সোফার দিকে যেতে যেতে কুচকানো ভ্রু সমেত তাকিয়ে তেজস্বী গলায় বলল,
“এখানে আসুন!”

মীর বিনা বাক্যব্যয়ে এগোলো৷ সোফায় বসতেই আনাবিয়া আগের মতো করেই ছিনিয়ে নিলো ওরর হাত, ভ্রু জোড়া ওপরে উঠে গেলো ক্ষতের গভিরতা দেখে। মুখ থেকে অস্ফুট ব্যাথাতুর ধ্বনি বেরিয়ে এলো ওর। চোখের কোণে সামান্য বাষ্প জমলো বোধ হয়! মীর দেখলো সমস্তই, কোনো কিছুই দৃষ্টি এড়ালোনা তার। নিজের হাতখানা আরও একটু বাড়িয়ে আঙুল গুলো গুঁজে দিলো আনাবিয়ার নরম হাতের ভেতর।
হাতের গ্লাভস জোড়া খুললো আনাবিয়া। হ্যিলিং সং এর কোনো উপায় নেই, অথচ ক্ষতটা কত্ত গভীর! ওর হাতের ছোঁয়ায় যদি তবুও হ্যিলিং একটু দ্রুত গতিতে হয়!

আলতো করে মীরের হাতখানা ধরে ক্ষতটা প্রচন্ড যত্নসহকারে পরিষ্কার করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দ্রব্য দিয়ে সময় নিয়ে পট্টি বেধে দিলো। আর ক্ষনে ক্ষনে চাপা গলায় বকাবকি করে গেলো মীরকে।
পুরোটা সময় মীরের নজর আঁটকে রইলো আনাবিয়ার চোখ জোড়ার ওপর৷ ওই নীলচে চোখ, বাকানো ভ্রু জোড়ার সমস্ত বেদনা পীড়িত অভিব্যাক্তি, ক্ষনে ক্ষনে মীরের উদ্দ্যেশ্যে তার শাসন মিশ্রিত বকুনি মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখলো তাকে!
মোলায়েম হাতের স্পর্শে মুহুর্তে মুহুর্তে কেঁপে কেঁপে উঠলো সে, সমস্ত শরীরের আনাচে কানাচে, প্রতিটি লোমকূপে এক শীতল শিহরণ বয়ে গিয়ে জানান দিলো এই স্পর্শ তার চেনা, প্রচন্ড চেনা, শ্বাস প্রশ্বাসের মতোন! স্বস্তি, প্রশান্তি, আরামে ভরপুর!

আনাবিয়ার নীলচে চোখে নিজের গভীর, দৃঢ় দৃষ্টি রেখে নিঃশব্দে তাকে বলল, -তোমাকে বুঝতে রকেট সায়েন্স পড়া লাগবে না মেয়ে, তুমি আমার নিকট খোলা আকাশের মতোন পরিষ্কার, নিভৃত জলের মতোই স্বচ্ছ!
পট্টি বাধা শেষ হতেই আনাবিয়া দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে হাতে তড়িঘড়ি গ্লাভস পরে নিলো, বলল,
“আপনি এখন খেয়ে নিন, আর আমি ফাতমাকে বলে যাবো আপনার মেডিসিনের ব্যাবস্থা করতে, সময় মতো খাবেন। আগামীকাল সকাল বেলা এসে ক্ষতস্থান ড্রেসিং করে দিবো।”
“হাতে ক্ষত নিয়ে আমি খেতে পারবোনা।”
সোজা হয়ে বসে দৃঢ় গলায় বলল মীর। আনাবিয়া গ্লাভস পরতে পরতে থমকালো, অপ্রস্তুত চোখে তাকিয়ে গলা খাকারি দিয়ে বলল,

“চামচ দিয়ে চেষ্টা করুন৷”
“পারছিনা৷”
মীরের ফটাফট উত্তর।
আনাবিয়া ভীষণ ঘাবড়ালো, বুকের ভেতর দ্রিম দ্রিম শুরু হলো ওর। গলা শুকিয়ে এলো মুহুর্তেই, মুখ খানার রঙ উড়ে ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করলো।
মীর এসব ইচ্ছে করে করছে, পরিকল্পনামাফিক! ঠিক পূর্বের মতোন, ওকে ফাঁদে ফেলে! কিন্তু কেন? মীর কি কিছু আঁচ করতে পেরেছে আনাবিয়ার ব্যাপারে? কিছু বুঝে ফেলেছে?
আনাবিয়ার শরীর দিয়ে হিমস্রোত বয়ে গেলো, কাঁপা স্বরে দ্রুত বলে উঠলো

“আম-আমি পারবোনা।”
“পারতে হবে৷”
মীরের সোজাসাপটা, ভণিতা বিহীন উত্তর।
আনাবিয়া প্রাণপণে নিজেকে সামলালো, মীরের সামনে নিজের এই ভীতি যেন প্রকাশ না পায় তার জন্য নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো সর্বোচ্চ! কিন্তু আতঙ্ক থামলোনা, ধরা পড়ে যাবার ভয়ে কাঁপতে শুরু করলো হাত, পা….. বুক!
কামরায়, মীরের সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকার সাহস হলোনা ওর আর, কিছুক্ষণ এখানে থাকলে সত্যিই দম বন্ধ হয়ে আসবে ওর! ইচ্ছে হলো ছুটে বেরিয়ে যেতে!

পরক্ষণেই একটা বড় দম নিয়ে সত্যিই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে গেলো ও! কিন্তু দরজার কাছে পৌছানো মাত্রই ঝটিতি সামনে এসে দরজা আগলে দাঁড়িয়ে পড়লো মীর। শীতল চোখে তাকিয়ে গমগমে গলায় বলল,
“প্লেটের সব খাবার তোমার হাত দিয়ে আমার পেটে না যাওয়া পর্যন্ত এই কামরা থেকে তুমি বের হচ্ছোনা পুচকে।”
আনাবিয়া পিছিয়ে এলো দুকদম৷ মীর শব্দ করে দরজা আটকে দিলো ভেতর থেকে৷ তারপর সোফার দিকে আঙুলের নিঃশব্দ ইশারায় বসতে বলল আনাবিয়াকে।

আনাবিয়া কাঁপা শরীর নিয়ে গুটিসুটি মেরে গিয়ে বসলো সেখানে। মাথার ভেতর চক্কর দিচ্ছে ওর, মনে হচ্ছে যেন ঘুরে পড়ে যাবে এখানেই। আতঙ্কে, অস্বস্তিতে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে দু কান দিয়ে৷
এতদিন ধরে যে শক্তি, সংযম, আত্ম অহং সে অর্জন করেছিলো তা যেন মুহুর্তেই ধসে পড়লো ওই দরজার নিকট। গলা দিয়ে প্রতিবাদের একটা শব্দ উচ্চারণ করার সাহস পেলোনা, উচ্চারিত হলোনা তারা।
মীর হেলেদুলে এসে ধপ করে বসে পড়লো ওর মুখোমুখি, কাছাকাছি, মেঝেতে। চোখের ইশারায় টেবিলের খাবারের দিকে দেখালো আনাবিয়াকে৷ আনাবিয়া ঢোক গিললো, আনাড়ি পলক ফেললো বার কয়েক। তারপর হাত বাড়িয়ে নিজের দিকে টেনে নিলো প্লেট। ফোর্ক নাইফ হাতে তুলে নিতেই মীর বলে উঠলো,

“আ-হাম, এই মুহুর্তে আমার চামচে খেতে একদমই ইচ্ছে করছেনা মিস….. পুচকে।”
আনাবিয়া কাঁপা হাতে সেগুলো পূর্বের স্থানে রেখে হাত দিয়ে ছিড়তে গেলো রুটি।
“নো গ্লাভস ঈ-দার।”
আনাবিয়ার গ্লাভসের দিকে ইশারা করে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললো মীর৷ আনাবিয়া রুটি রেখে দিয়ে হাত গুটিয়ে কোলের ভেতর নিয়ে বসে রইলো চুপচাপ।
ওকে এভাবে স্থীর হয়ে যেতে দেখে মীর কিঞ্চিৎ কড়া স্বরে বলে উঠলো,
“ক্ষিধে পেয়েছে আমার৷”
আনাবিয়া ওর স্বর্ণাভ চোখের দিকে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে রইলো নিষ্পলক, অতঃপর সন্তর্পণে ছাড়লো একটি দীর্ঘশ্বাস। বা হাতে টেনে খুলে ফেললো গ্লাভস। তারপর হাত বাড়িয়ে তুলে নিলো রুটি।
মীরের ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো আত্মতৃপ্তির মৃদু হাসি। আগ্রহ ভরে তাকিয়ে রইলো আনাবিয়ার চোখপানে, প্রচন্ড ইচ্ছা হলো এই মেয়েটির ঊরু জোড়া জড়িয়ে সেখানে মাথাটাকে বিশ্রাম দিতে, প্রাণপণে তীব্র ইচ্ছাটাকে সংবরণ করলো সে!

আনাবিয়া একটু একটু করে সবগুলো রুটি ছিড়ে গ্রিলের সাথে খাইয়ে দিলো ওকে। পুরোটা সময় মীর ওর তীক্ষ্ণ, শকুনি দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে রইলো আনাবিয়ার চোখের দিকে, যেন খুঁজে চলল সঙ্গোপনে লুকিয়ে থাকা কিছু।
আনাবিয়া মাঝে মাঝেই আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো ওকে। মীরকে ওরই দিকে শীতল, ধারালো চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে আতঙ্কের পরিমাণ বাড়লো ওর।
মীরের ওই ভেতর পড়ে ফেলা, সত্তাভেদী দৃষ্টিকে ও ভয়ানক ভয় পায়! এখন ভয়ের পরিমাণ টা আরও বেশি, ধরা পড়ে যাওয়ার, ধোঁকা দেওয়ার!

কোনো ভাবে যদি মীর বুঝে যাও ওর চোখের লেন্স জোড়া ফেইক? মীরের চোখের সামনে বসে থেকে কিভাবে নিজের সত্তাকে গোপন রাখবে? কিভাবে ওই স্বর্ণাভ, তীব্র দৃষ্টির সম্মুখে নিজেকে আগলে রাখবে?
আনাবিয়া আতঙ্কিত হলো আরও, যতটা সম্ভব দৃষ্টি নত করে খাইয়ে গেলো মীরকে। কিন্তু মীরের দৃষ্টি হতে আড়াল করতে সক্ষম হলোনা, মীর ঝুঁকে নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো ওর চোখের দিকে।
খাবারের মাঝপথে হঠাৎ থেমে গেলো মীর, স্থবির হয়ে বসে রইলো কিয়ৎক্ষণ। শরীরের রহস্যময় যন্ত্রণাটা আবার ফিরে এসেছে; ভয়ানক, অজানা, নিরব বিষের মতো ছড়িয়ে পড়ছে স্নায়ুর গভীরে!
গত এক সপ্তাহ ধরে ভয়ানক এই অভিশাপে পুড়ছে সে! শরীরের ভেতর হঠাৎ হঠাৎ যেন কেউ আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে, ভেতরটা চিরে চিরে পুড়ছে প্রতিবার! সেই অসহনীয় জ্বালা কমাতে ঘন্টার পর ঘন্টা শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে থাকে সে। ঠান্ডা পানির ধারায় ভিজে জবজবে হয়ে গেলেও যন্ত্রণা যেন আরও গাঢ় হয়ে জমে থাকে মজ্জার ভেতর!
মীর স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো যন্ত্রণা স্তিমিত হওয়ার আশায়, কিন্তু কমলোনা, উত্তরোত্তর বেড়েই চলল, গ্রাস করে ফেলতে চাইলো ওর অস্তিত্ব! ওর শক্ত হয়ে যাওয়া চোখ মুখের ওপর নিদারুণ যন্ত্রণার ছাপ দেখা মাত্রই বিস্মিত হলো আনাবিয়া। ব্যতিব্যস্ত, চিন্তিত গলায় শুধোলো,

“কি হয়েছে আপনার? ক্ষতস্থানে যন্ত্রণা হচ্ছে?”
মীর কথা বলার মতো শক্তি পেলোনা, যন্ত্রণা যেন ওকে ভেতর থেকে অসাড় করে দিলো। দাঁতে দাঁত চেপে, চোখ ভর্তি বিধ্বংসী যন্ত্রণা নিয়ে সে তাকালো আনাবিয়ার মুখপানে। ওর সে চাহনি প্রচন্ডরকম অসহায় ঠেকলো আনাবিয়ার নিকট। মীরের দিকে ঝুঁকে এসে ভ্রু তুলে শঙ্কিত, উদ্বিগ্ন গলায় ও শুধোলো,
“কি হচ্ছে বলুন আমাকে? কোথায় যন্ত্রণা হচ্ছে?”
আনাবিয়ার প্রশ্ন শেষ হতে না হতেই মীর ঝটিতি উঠে ছুটে গেলো ওয়াশরুমে, দরজাটা সজোরে বন্ধ করলো, শব্দে কেঁপে উঠলো কামরা!

শাওয়ার ছেড়ে দিলো তৎক্ষনাৎ। গায়ে ঠান্ডা পানির প্রবাহ পড়তেই লম্বা দম ছাড়লো সে!
আনাবিয়া ব্যাস্ত পায়ে ওয়াশরুমের সামনে এসে দরজায় করাঘাত করে উৎকন্ঠিত, অস্থির কন্ঠে শুধোলো,
“ঠিক আছেন আপনি? কি হচ্ছে আপনার? মীর…!”
আনাবিয়ার কন্ঠে নিজের নাম শুনে থমকালো মীর, জোরে শ্বাস ছেড়ে কোনো রকমে উত্তর করলো,
“ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা…!”
আনাবিয়া শঙ্কিত চিত্তে দরজায় কান পেতে চুপ হয়ে রইলো, স্থীর হয়ে ভাবলো কিছুক্ষণ, তারপর তড়িঘড়ি স্বরে বলল,

“শাওয়ার বন্ধ করুন, দ্রুতই! স্থীর হয়ে দাঁড়ান কিছুক্ষণ প্লিজ।”
মীর তবুও শাওয়ার বন্ধ করছে না দেখে আনাবিয়া তাগাদা দিলো আবারও। মীর দাঁতে দাঁত চেপে বন্ধ করলো শাওয়ার। পানির শব্দ বন্ধ হতেই আনাবিয়া বলল,
“আমার কথা শুনুন, স্থীর হয়ে দাঁড়ান। চোখ বন্ধ করুন….. করেছেন?”
ভেতর থেকে উত্তর আসলো, – হু..!
“জোরে শ্বাস টেনে নিন, তারপর ধীরে ধীরে ছাড়ুন! ধীরে ধীরে…!”
মীর দেয়াল দু হাতের থাবা ঠেকিয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো৷ আনাবিয়ার কথা মতোই ধীরে ধীরে শ্বাস ছাড়লো সে, কয়েকবার। পরক্ষণেই আবার ভেসে এলো আনাবিয়ার স্বস্তিদায়ক কন্ঠ,
“পেট থেকে শ্বাস ছাড়ুন, শরীর ছেড়ে দিন, সমস্ত পেশি শিথিল করুন, ধীইইরে ধীইইরে….!”
মীর তাই করলো, শরীর ছেড়ে দিলো, ছেড়ে দিলো পেশি। মুহুর্তেই সমস্ত যন্ত্রণা কমে গিয়ে এক অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করলো নিজের সারা শরীর জুড়ে৷ বাইরে থেকে আনাবিয়া শুধোলো,

“ভালো লাগছে এখন?”
“হু…… অনেক!”
আনাবিয়া বাইরে থেকে চাপা স্বরে ফিচেল হাসলো, তারপর বলল,
“এবার আয়নাতে দেখুন।”
মীর চোখ খুলে আয়নাতে তাকাতেই আঁতকে উঠলো! তড়িতে সরে গেলো দুকদম পেছন দিকে। এক কোণায় রাখা ফ্লাওয়ায় ভ্যাজ টা ওর হাত লেগে পড়ে গিয়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো।
আনাবিয়া ওর আতঙ্ক বুঝতে পারা মাত্রই হেসে উঠলো খিলখিলিয়ে। মীর ওর হাসি শুনলো, ভালো লাগলো ভীষণ। নিজেও ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে তাকিয়ে রইলো আয়নার দিকে।

শরীরের এই শ্যামলা থেকে হঠাৎ মেটালিক ব্লাক কালারে বদল দেখে কিঞ্চিৎ বিস্মিত হলো। হাত বুলিয়ে নিলো কালোর ওপর উজ্জ্বল সোনালী রঙের রেখা গুলোতে। হাতের দিকেই নজর যেতেই চোখে পড়লো হিংস্র মাংসাশী প্রাণীদের ন্যায় ভয়াল, চওড়া থাবা! আর তার শেষ প্রান্তে ধারালো নখর!
আয়নার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো মীর, দেখলো রয়্যাল ব্লাকে মোড়ানো এক অচেনা, রাজকীয় চেহারা। কিছু একটা চিন্তা করে ভ্রু কুচকে মুখ আলগা করলো সে৷ চোখে পড়লো এক জোড়া হিংস্র, ধারালো, ঝকঝকে ক্যানাইন দাঁত।
ধীরে ধীরে বৃদ্ধাঙ্গুলি তুলে ছুয়ে দেখলো দাঁতের তীক্ষ্ণতা, একটু জোর চাপ পড়লেই ছেদ পড়বে চামড়ায়! আয়নার প্রতিফলনে চোখ রেখে ঠোঁটের কোণে টেনে আনলো এক রহস্যময় হাসি, মৃদুস্বরে স্বগতোক্তি করলো,

“নট দ্যাট ব্যাড…!”
পরক্ষণে আনাবিয়ার কথা মনে পড়তেই ভেজা ট্রাউজার টা একটানে খুলে তড়িতে কোমরে জড়িয়ে নিলো ধুসর টাওয়েল খানা। ওয়াশরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো সে।
আনাবিয়া তখনো দাঁড়িয়ে, ঠোঁটে চাপা হাসি। মীরের বর্তমান অবস্থা কল্পনা করে দাঁত মেলে নিঃশব্দে হাসছিলো সে। মীরকে বেরোতে দেখা মাত্রই হুশ ফিরলো ওর, দ্রুত পায়ে ঘুরে ছুটে বেরিয়ে যেতে নিলো কামরা থেকে। কিন্তু দরজা পর্যন্ত যাওয়া মাত্রই মীর ঝড়ের গতিতে এসে পথ আটকে দাঁড়িয়ে পড়লো দরজার সামনে, গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করলো তৎক্ষনাৎ,

“কিভাবে করলে এটা? এসব তুমি কিভাবে জানো?”
আনাবিয়া কি উত্তর দিবে ভেবে পেলোনা৷ আনত নয়নে দাঁড়িয়ে আঙুল কচলাতে শুরু করলো। জবাব খুঁজে না অএয়ে শ্বাস আটকে আসতে চাইলো।
সময় গড়িয়ে চলল, আনাবিয়ার চুপচাপ অনড় ভঙ্গিটাই মীরের ক্রোধের আগুনে ঘী ঢেলে দিলো!
ধৈর্যহারা হয়ে আনাবিয়াকে এক ঝটকায় টেনে নিয়ে চেপে ধরলো দরজার ওপর, কঠিন স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“আ’ ওয়ান্ট আনসার, সময়ের দাম আছে আমার৷ কিভাবে জানো তুমি আমার সম্পর্কে এত কিছু? হাউ ড্যু ইয়্যু নো মি লাইক দিস?”
“আমি-আমি কিছু জানিনা!”
চোখ খিচে বন্ধ করে উত্তর করলো আনাবিয়া৷ মীর দাঁতে দাঁত চাপলো, চিবিয়ে চিবিয়ে বলল৷
“ইয়্যু নো এভ্রিথিং অ্যাবাউ’ট মি। হু আর ইয়্যু এক্স্যাক্টলি? জবাব দাও…. এখনি!”
“আমি আপনার কেউ না৷”

আতঙ্ক ছেড়ে হঠাৎ ঠান্ডা, নিস্তরঙ্গ জলের মতো উত্তর করলো আনাবিয়া। কিন্তু এ নিস্তরঙ্গতা যেন আরও পাগল করে তুললো মীরকে, দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিসিয়ে সে বলে উঠলো,
“আ’ ডোন্ট বিলিভ দিজ টাইপ অব বুলশিটস। কি হও তুমি আমার? কি সম্পর্ক তোমার আমার সাথে? হু দ্যা হেল আর ইয়্যু টু মি?”
আনাবিয়া এবার সোজা তাকালো মীরের চোখের দিকে, ধীরে ধীরে ঠোঁট নেড়ে বলল,
“বললাম তো আমি আপনার কেউ না! আপনার সাথে আমার কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই।”
“মিথ্যা বলছো তুমি!”
গর্জে উঠলো মীর। পরক্ষণেই নিজেকে শান্ত করে ফেললো, ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি আমার কি হও?”
“কেউ না।”

মীরের মুখের দিক থেকে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বাধোবাধো, ফিসফিসে গলায় উত্তর করলো আনাবিয়া। মীর তৎক্ষনাৎ ওর মুখখানা নিজের সাড়াশির ন্যায় আঙুল দিয়ে ধরে নিজের দিকে ফেরালো,
“সত্যিই তুমি আমার কিছু হও না?”
আনাবিয়ার গলা কাঁপলো, এক দলা পাকানো যন্ত্রণা মিশ্রিত কন্ঠে ভেসে এলো ওর বুকের তলানি হতে,
“সত্যি বলছি আমি৷”
“তোমার পরিবার কোথায় থাকেন? কে কে আছে তোমার পরিবারে? তুমি কেন এখানে থাকো?”
এক নাগাড়ে প্রশ্ন গুলো করলো মীর, পরমুহূর্তেই আবার জিজ্ঞেস করলো,
“ওই ছেলে মেয়েগুলোর সাথে তোমার কি সম্পর্ক? ওরা এনিম্যাল টাউনের বাসিন্দা। কিন্তু তুমি? তুমি তো অ্যানিম্যাল টাউনের কেউ নও, তবে তুমি কে?”
অত্যন্ত নমনীয় কন্ঠে প্রশ্ন গুলো করলো মীর। ওর স্বর্ণাভ চোখ জোড়া তীক্ষ্ণ, নিবিড় দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে রইলো আনাবিয়ার নীলচে চোখ জোড়া।

আনাবিয়া উত্তর করলো না কোনো, হিংস্র বাঘের থাবার তলে ধরা পড়ে যাওয়া হরিণ শাবকটির ন্যায় কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলো ও! মীর ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভ্রু কুচকে নিলো হঠাৎ, প্রচন্ড মনোযোগ দিয়ে ওই চোখের গভীরে খুঁজে চলল কিছু। পরক্ষণেই ওর হাত এগোলো আনাবিয়ার মাস্কের উদ্দ্যেশ্যে।
ভড়কালো আনাবিয়া, একটা শুকনো ঢোক গিলে চোখ খিচে বন্ধ করে তড়িত স্বরে বলে উঠলো,
“আপনার টাওয়েল খুলে গেছে।”
মীর হতচকিত হয়ে দ্রুত জাপটে ধরলো নিজের টাওয়েলের উপরিভাগ। আনাবিয়া ছাড়া পাওয়া মাত্রই দরজা খুলে ছুটে বেরিয়ে গেলো দমকা হাওয়ার মতো, পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেলো করিডোরে। শুধু রইলো ওর শরীরের মিষ্টি ঘ্রাণ, আর রেখে গেলো মীরের শরীরে বয়ে চলা অগ্নিস্রোত!
মীর ওর পলায়নের পথে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ, তারপর নাকের পাটা ফুলিয়ে বলল,
“আজ ধোঁকা দিয়ে পালিয়ে যেতে পেরেছো বলে ভেবোনা দ্বিতীয় বার আমার হাত ফসকে পালাতে পারবে…. পুচকে কোথাকার!”

সন্ধ্যা রাত।
জোভির বাসার ডাইনিং রুমে আড্ডা জমেছে বাচ্চাদের৷ কাঞ্জি জোভির ছেলেকে কাঁধে উপর উঠিয়ে রেখেছে। কুচকুচে কালো রঙা বাচ্চাটা তার ছোট্ট ছোট্ট নখর দিয়ে আকড়ে ধরে আছে কাঞ্জির চুল।
ব্রায়ান আর হাইনা দুজনে মিলে চা খেতে খেতে গল্প করছে। হাইনাকে অ্যানিম্যাল টাউন হতে ধরে নিয়ে এসেছে ওরা। শার্লট আর ফাতমা কামরায়, ঘুমোচ্ছে দুজন। সারাদিন বাইরে বাইরে ঘুরে ক্লান্তু ভীষণ। জোভি ওর বউয়ের সাথে কিচেনে। রাতের খাবার সবাই এখানেই খাবে৷
কাঞ্জি পিচ্চিকে কাধ থেকে বার বার ফেলে দিচ্ছে বিছানায়, পিচ্চিটা মজা পেয়ে কুইকুই করে উঠে আবার লাফিয়ে উঠছে ওর কাঁধের ওপর। কাঞ্জি আবার মহাসমারোহে বিছানায় ঠেসে ফেলছে ওকে।
এমন সময় ব্রায়ানের পাশে রাখা কাঞ্জির ফোনটা বেজে উঠলো, কাঞ্জি কাঁধের পিচ্চিটাকে বিছানায় ফেলে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলো,

“কে কল করেছে?”
ব্রায়ান ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকালো, ‘শেহজাদী’ নামটা দেখামাত্রই বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো ওর। গলা খাকারি দিয়ে বলল,
“শেহজাদী কল করেছেন।”
কাঞ্জি ইশারায় বলল রিসিভ করতে৷ ব্রায়ান কাঁপা হাতে ফোন তুলে দিয়ে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো আনাবিয়ার মিষ্টি রিনরিনে কন্ঠ,
“কাঞ্জি, আমি আজ মহলে ঢুকবোনা, শার্লট বা ফাতমা কাউকে বলিস আজকের রাতের মতোন মীরের খাবারটা ম্যানেজ করে নিতে।”
ব্রায়ান কি বলবে ভেবে পেলোনা, আনাবিয়ার গলা শুনে জমে গেলো ও। আনাবিয়া সাড়াশব্দ না পেয়ে ভ্রু কুচকে ডাকলো,

“কাঞ্জি?”
ব্রায়ান তড়িতে ফোনটা কাঞ্জির দিকে ছুড়ে দিলো। ক্ষীণ ভঙ্গিতে হাত পা কাঁপতে শুরু করলো ওর৷ কাঞ্জি ওর অদ্ভুত আচরণে কপালে ভাজ ফেলে তাকালো, তারপর ফোন কানে ধরে বলল,
“জ্বি শেহজাদী, বলুন।”
“শার্লট ফাতমা কোথায়?”
“ওরা দুজনেই ঘুমোচ্ছে, শেহজাদী। আমরা জোভিদের বাসায় বেড়াতে এসেছি। কোনো প্রয়োজন হলে আমাকে বলুন, আমি এখুনি চলে আসছি।”
“না…. কিছুনা। এনজয় কর তোরা৷”
বলে কল কেটে দিলো আনাবিয়া। কাঞ্জি ফোনটা পাশে রেখে দিয়ে গম্ভীরমুখে তাকালো ব্রায়ানের দিকে। ব্রায়ান ঢোক গিলে তাকিয়ে রইলো মেঝের দিকে।
আনাবিয়া ফোন রেখে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো একটা। ওকেই আবার পড়তে হবে মীরের সামনে।

অন্ধকারের ভেতর দিয়ে লুকিয়ে চুরিয়ে মহলে প্রবেশ করলো আনাবিয়া। চারদিক সুনসান, বাচ্চারা আজ আর হয়তো ফিরবে না৷
মীরের কামরার দিকে নজর গেলো ওর, কামরাতে আলো নেই। সে কি নেই মহলে? আনাবিয়া পা টিপে টিপে এগোলো সেদিকে। মীরের দরজার সম্মুখে এসে দেখলো দরজা বাইরে থেকে বন্ধ।
তবুও চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি দিলো আনাবিয়া, বলা যায়না কি ফন্দিফিকির করে বসে আছেন তিনি। কখন কোন দিক থেকে আক্রমণ করে বসবেন তার ইয়ত্তা নেই!
কিন্তু কিছুক্ষণ এদিক ওদিক দেখেও কারো উপস্থিতি টের না পেয়ে আনাবিয়া বুঝলো সে সত্যিই মহল ছেড়েছে। তখনি চোখে পড়লো কিচেনে বাতি জ্বলছে৷
গুটি গুটি পায়ে কিচেনের দরজার পাশে এসে দাড়ালো সে, উঁকি মেরে দেখলো ভেতরে। কোথাও কেউ নেই, চারদিক নিঃস্তব্ধ। তবুও সন্দেহ দূর হলোনা আনাবিয়ার। কিচেনে বাতি জ্বালিয়ে রেখে যাওয়ার কি কারণ থাকতে পারে মীরের?

ধীর, সতর্ক পায়ে ঢুকলো ও কিচেনে। সাবধানি দৃষ্টি ফেললো চারদিকে। মীর নেই আশেপাশে কোথাও। তবে এখানে বাতি কেন?
আরও কয়েক পা ভেতরে এগোতেই কিচেনে থাকা সোফার ওপর চোখ পড়লো আনাবিয়ার, সেখানে র‍্যাপিং পেপারে মোড়া একটা ছোট্ট বক্সের মতো কিছু। ওপরে একটি ভাজ করে রাখা চিরকুট৷
আনাবিয়া এগিয়ে গেলো সেদিকে, সোফার সামনে দাঁড়িয়ে তুলে নিলো কাগজখানা। সেখানে মীরের হস্তাক্ষরে লেখা,
“ফ’ দ্যা গ্রেটেস্ট কুক অব অল টাইম”
তারই ঠিক নিচে লেখা,
“আমার ক্ষতের যত্ন নেওয়ার জন্য পুচকেকে ধন্যবাদ
~ আসওয়াদ
পুনশ্চঃ পালিয়ে গিয়ে ভালো করোনি পুচকে, সি ইয়্যু সুন।”

শেষোক্ত বাক্য দ্বয় পড়ে হাসলো আনাবিয়া। র‍্যাপিং পেপারে মোড়া বক্স সদৃশ বস্তুটা হাতে নিলো। র‍্যাপিং খুলতেই ভেতরে একটি মেরুণ রঙা মখমলি বক্স চোখে পড়লো ওর। সেটা মেলতেই দেখলো একটি ফিঙ্গার রিং। তার কেন্দ্রে ফুটে আছে এক বিশাল, কোমল গোলাপ রঙা ফুল। পাঁপড়িগুলো তার এতটাই সূক্ষ্মভাবে গড়া যেন মৃদু বাসন্তী হাওয়ায় দুলে চলেছে। ফুলটির চতুর্দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আরও কয়েক গাছি ছোট্ট ছোট্ট ফুল, পাপড়ি গুলোতে খোদাই করা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ডায়মন্ড গুলো ঝিকিমিকি করছে। পাতাগুলোতে খোদাই করা এমারাল্ড পাথর গুলো যেন সবুজ রঙা আলো ছড়িয়ে চলেছে। পুরো আংটিটা যেন একটি বৃক্ষ, তার রূপোর ডাল-পালা বেয়ে উঠে এসেছে এক ঝাঁক ফুল!

আনাবিয়া এক দৃষ্টিতে দেখে গেলো আংটিটি। এটা মীর কোথা থেকে জোগাড় করেছে ভেবে পেলোনা ও। ওর বিয়ের আংটিটা বেশ ক বছর আগে প্রাসাদ থেকে পালিয়ে রেড জোনে চলে আসার পথে খুলে ফেলে দিয়েছিলো। সেটা হয়তো আজ মাটির গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো আনাবিয়া, তারপর আংটি টা তুলে সযত্নে নিজের বা হাতের অনামিকাতে পরালো।

বেশ কদিন আর মীরের দেখা পাওয়া গেলোনা। সে পুরোপুরি লাপাত্তা। আনাবিয়া সকাল বিকাল খোঁজ নিলো কাঞ্জির কাছে, কিন্তু প্রতিবারই না বোধক সংবাদ এলো। কোথায় গেছে সে কেউই জানেনা, কেউ তাকে যেতে দেখেনি, আর না দেখেছে ফিরতে!
আনাবিয়া লায়রা আর ফক্সিকে নিয়ে এসেছিলো বাইরে ঘুরতে। গতবার দুজনে মাতবারি করে বেরিয়ে কার না কার সাথে মারামারি করে মুখে আঁচড় কেটে এসেছে। ফক্সি তো এক কোণে লুকিয়ে ছিলো, মারামারি যা করার করেছে লায়রা। শেষ মেশ কাঞ্জি হঠাৎ দেখতে পেয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছে। লায়রার নাম সে দিয়েছে ‘মাফিয়া লেডি’, নাচতে নাচতে এক ফুল গ্রোণ ব্লাক প্যান্থারের সাথে পাঙ্গা নিতে গেছিলো। খেয়েছেও এক থাবড়া! থাবড়া খেয়েও দমে যায়নি উলটে তাকে পালটা আক্রমণ করতে গেছে।

আনাবিয়া তাই দুটোকে গ্রাউন্ডেড করে রেখেছিলো। আজ তাদের শাস্তি শেষ হয়েছে। আনাবিয়া বলে দিয়েছে তার অনুমতি ছাড়া যেন কোনোভাবে একটাও বাইরে না বের হয়৷
কাঞ্জি ব্রায়ানরা আশেপাশেই আছে। জঙ্গলের ভেতর হাউকাউ করে বেড়াচ্ছে সবগুলো। ব্রায়ান ছেলেটা যা একটু সভ্য শান্ত ছিলো এদের সাথে থেকে থেকে ওটাও বদের হাড্ডিতে পরিণত হয়েছে। শার্লট আগে থেকেই বাদর ছিলো, ওটার বেশ জুৎ হয়েছে এদের সাথে মিশে। কিন্তু ফাতমাকে কেউ বদলাতে পারেনি। সে পূর্বের মতোই শান্ত, মীরের থালা ছোড়ার ঘটনার পর থেকে আরও শান্ত হয়ে গেছে।
আনাবিয়া ফক্সি লায়রা কে খেলতে ছেড়ে গিয়ে বসলো লাইফ ট্রির পাদদেশে। পিঠ ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলো। লাইফ ট্রি তার ডালপালা দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো ওকে।
এমন সময় শব্দ করে বেজে উঠলো হুডির পকেটে থাকা যান্ত্রিক বস্তুটি। আনাবিয়া চোখ মেললো। কল রিসিভ করে কানে ধরতেই ও পাশ থেকে ভেসে এলো কোকোর অভিমানী গলা,

“আম্মা, আমার আর ভালো লাগছে না, আমি বাড়ি আসবো, আপনার কাছে।”
আনাবিয়া মিষ্টি করে হাসলো, ওর বড় ছেলেটা মাঝে মাঝে নিজের বয়স ভুলে বাচ্চাদের মতোন আবদার করে বসে। রিনরিনে কন্ঠে ও বলল,
“ঠিক আছে আয়, ওরা কজন আছে যেহেতু কিছুদিন ওরাই বর্ডারের দায়িত্ব পালন করুক। তুই ফ্যালকন আর আলফাদকে নিয়ে চলে আয়।”
“আলফাদ আসবে না বলল, ওর এখানে ভালোই লাগছে। আমি আর ফ্যালকন চলে আসছি।”
“ঠিক আছে, তবে রেক্সাকেও সাথে নিয়ে আসিস। ওর সমুদ্রের ধারে কাছে থাকার অভ্যাস নেই, হঠাৎ বেশিদিন কাটালে শরীর খারাপ করবে৷”
“আবার ভা… মানে রেক্সাকে কেন…. আচ্ছা ঠিক আছে আম্মা। আমরা কালকেই রওনা করছি তবে।”
আনাবিয়া আরও কিছু কথা বলে কল রাখলো। বেশ খুশি খুশি দেখালো ওকে, কোকো কাছাকাছি থাকলে ওর আর একা একা বোধ হয় না। ছেলেটা তার সব রকম পরিস্থিতিতে বুক চিতিয়ে হাজির হয়ে পড়ে।

কোকোরা ফিরেছে কয়েকদিন হলো, মীরের দেখা নেই। আনাবিয়া অস্থির হয়ে উঠছে ক্রমে ক্রমে। লোকটা গেলো আর ফিরলোনা, কোথায় আছে কি করছে জানারও কোনো পথ নেই।
কোকোকে পাঠিয়েছিলো আশেপাশে খোঁজ নিতে, কিন্তু কোকো কোনো সংবাদ পায়নি। মীর যে বাচ্চাদের মহল থেকে বের করে দিয়েছে এই সংবাদই কেবল ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে সে আনাবিয়ার নিকট৷

আনাবিয়ার শঙ্কা বাড়ছে ক্রমশ। স্থীর হয়ে থাকতে পারছে না এতটুকু সময়। এক ভয়াল অশান্তি গ্রাস করেছে যেন ওকে। গতকাল সারারাত ঘুমোতে পারেনি দুঃশ্চিন্তায়। বিকেল পড়তেই তাই রাজ্যের ঘুম নেমে এলো ওর চোখে।
এই মুহুর্তে লায়রা কে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে আনাবিয়া। বেচারি লায়রা জেগে জেগে অপেক্ষা করছে কখন শেহজাদীর ঘুম ভাঙবে আর সে ফক্সির সাথে বাইরে খেলতে যাবে। ফক্সি বসে আছে মেঝেতে, অধীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে আনাবিয়ার মুখপানে, চোখের পাপড়ির দিকে মনোযোগী দৃষ্টি তার, একটু নড়লেই যেন সে স্বস্তি পায়!
এমন সময় ভ্রুম ভ্রুম শব্দে কেঁপে উঠলো সাইড টেবিলের উপরাংশ। আনাবিয়া কপাল কুচকে হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিয়ে কানে ধরলো। ও পাশ থেকে ভেসে এলো কোকোর ভীতসন্ত্রস্ত কন্ঠ,

“আম্মা, হিজ ম্যাজেস্টি ফিরেছেন।”
আনাবিয়ার ঘুম উড়ে গেলো, বিছানায় উঠে বসলো তৎক্ষনাৎ। ঢোক গিলে শুধোলো,
“ও-ও ঠিক আছে ? ওর কোনো অসুবিধা হয়নি তো? সুস্থ আছে ও?”
“জ্বি, উনি ঠিক আছেন। আপনাকে খুঁজছেন।”
মীর ঠিক আছে শুনে প্রচন্ড আস্বস্ত হলো আনাবিয়া, স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো একটা। পরক্ষণে মীর ওকে খুঁজছে মনে পড়তেই বলে উঠলো,

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩৫

“বলে দে আমি আসবোনা, আমার শরীর খারাপ।”
কোকো কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দিলো,
“ব্রায়ানকে আঁটকে রেখেছেন, আপনি না এলে…. ছেড়ে দিবেন না৷”

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩৭

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here