বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৫

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৫
রানী আমিনা

রেড জোন জুড়ে ভেসে চলেছে মনোমুগ্ধকর এক সুরের মূর্ছনা। অদ্ভুত মিষ্টি, শ্রুতিমধুর সেই সুরে ডুবে বুদ হয়ে আছে আশে পাশের সকলে৷ লাইফট্রির আশপাশ টা ছেয়ে আছে গ্লিটারের ন্যায় উড়ন্ত এক স্বর্ণালি আলোয়, স্রোতের মতো করে ভেসে বেড়াচ্ছে সেগুলো রেড জোনের প্রকান্ড প্রকান্ড গাছের মাথার ওপর দিয়ে।
কোকোর মাথাটা আনাবিয়ার কোলের ওপর। দুহাতের এক হাত কোকোর বুকের ওপর, অন্য হাত কোকোর মাথার ওপর দিয়ে রেখেছে৷ কোকোর শরীরের ক্ষত গুলো অদ্ভুত স্বর্ণালি আলোর নিচে সেরে উঠছে ক্রমে ক্রমে।
পাসে বসা ব্রায়ান শার্লট আর ফাতমা বসে বসে ঝিমুচ্ছে আনাবিয়ার মুখনিঃসৃত সুরেলা, নেশালো কন্ঠের আবহে। ঘুমের ঢুলুনিতে শার্লটের মাথাটা কাত হয়ে পড়েছে ফাতমার ওপর।

কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর থেমে গেলো আনাবিয়ার কণ্ঠনিঃসৃত সুমধুর সুর। রেড জোনে আবার নেমে এলো নিরবতা। ব্রায়ান শার্লটেরা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসলো। ফাতমা পিট পিট করে এদিক ওদিক তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো ওরা ঠিক কোথায় আছে।
কোকো ঘুমিয়ে আছে, শরীরের ক্ষত গুলো সেরে উঠে, হারানো জেল্লা ফিরে পেয়ে চকচক করছে ওর শ্যাম রঙা দেহ।
আনাবিয়া তাকালো কোকোর মুখ পানে। চোখের পাতা নড়ছে তিরতির করে।
শার্লট ব্রায়ানের গা ঘেঁষে বসে ফিসফিস করে ওকে শুধালো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“এই হাতির মতো ছেলেটা অ্যানার কি হয়, জানো?”
“শেহজাদী বলে সম্বোধন কর গাধী! মরতে চাস নাকি?”
চাপা সুরে ধমকে বলে উঠলো ব্রায়ান, পরক্ষণেই আবার বলল,
“এই ছেলেটাকে আমি আগেও দেখেছি বেশ কয়েকবার, শেহজাদীর কি হয় তা জানিনা।”
ওদেরকে ফিসফিস করে কথা বলতে দেখে ফাতমা হাটুতে ভর দিয়ে এগিয়ে এসে ওদের দুজনের মাঝখানে মুখ বাড়িয়ে দিলো, শার্লট চোখ কুচকে তাকালো ওর দিকে। এদের দুজনকে চুপ হয়ে যেতে ফাতমা ভ্রু উচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“তোরা আমাকে রেখে কি কথা বলছিস?”
“বলছি যে তোকে ওই গন্ডার টার সাথে বিয়ে দেবো।”
বলল ব্রায়ান। ফাতমার উৎসাহী মুখখানা নিমিষেই নিভে এলো, মনে মনে একবার কল্পনা করে নিলো সত্যি সত্যি ওই গন্ডারটার সাথে বিয়ে হলে ওর কি অবস্থা হবে, পরক্ষণেই কল্পনা থেকে ছুটে বেরিয়ে এলো এক প্রকার। মুখ বেকিয়ে ব্রায়ানের পিঠে একটা থাবড়া দিয়ে আবার সরে গেলো ও। ব্রায়ান হেসে উঠলো চাপা সুরে।
আনাবিয়ার কোলে থাকা কোকো নড়ে উঠলো এমন সময়ে, সকলের মনোযোগ গেলো সেদিকে। আনাবিয়া কোকোর চুলের ভাজে বারকয়েক হাত বুলিয়ে দিয়ে চোয়ালে ছোট ছোট করে চাপড় দিতে দিতে স্নিগ্ধ কন্ঠে ডেকে উঠলো,

“কোকো…”
কোকো চোখ মেললো ধীরে ধীরে, চোখ মেলতেই চোখের ওপর আনাবিয়ার মিষ্টি চেহারাটা ভেসে উঠতেই ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো ও।
তড়িতে আনাবিয়ের দিকে ফিরে হাটুতে ভর দিয়ে বসে বিস্ফোরিত চোখে দেখতে লাগলো আনাবিয়াকে, জিজ্ঞেস করতে চাইলো কিছু— ঠোঁট নড়ে উঠলো, কিন্তু মুখ থেকে কোনো কথাই বের হলোনা।
অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো ও আনাবিয়ার মুখপানে। স্বপ্ন আর বাস্তবের ভেতরে পার্থক্য করতে পারছেনা যেন, এ কি সত্যিই ওর আম্মা? ওর সামনে, এখন, এই মুহুর্তে?

আনাবিয়া ওকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বিরক্ত হয়ে মৃদু জোরে একটা থাপ্পড় দিয়ে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিলো ওর মুখ। থাপ্পড় খেয়ে হুশ এলো কোকোর, থাপ্পড়ের জায়গাটায় কয়েক সেকেন্ডের জন্য হাত চেপে রেখে তড়িতে আবার হতভম্ব চোখে ফিরে তাকালো আনাবিয়ার দিকে, থমকালো ক্ষণিকের জন্য, আর তার পরমুহূর্তেই ‘আম্মা……” বলে ডাক দিয়ে ঝাপিয়ে পড়লো ও আনাবিয়ার কোলের ভেতর!
হকচকিয়ে গেলো আনবিয়া। কোকোর বুক চিরে বেরিয়ে এলো আর্তনাদ, শব্দ করে ছোট্ট শিশুর মতোন কেঁদে উঠলো ও। দুহাতে শক্ত করে আকড়ে ধরলো আনাবিয়ার কোমর।
ওকে এভাবে কাঁদতে দেখে আনাবিয়া কি করবে বুঝতে পারলোনা। ডাকলো একবার,
“কোকো…!”

কোকো ডাক শুনলোনা, কেঁদেই চলল। ব্রায়ান, শার্লট আর ফাতমা ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকিয়ে রইলো ওদের দুজনের দিকে। ভেবে পেলোনা এই এত্ত বড় ছেলেটা আনাবিয়াকে আম্মা কেন ডাকছে। একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে ওরা এই সিদ্ধান্তে উপনিত হলো যে, চাচা টাচা হবে মনে হয়! অল্প বয়সী চাচা।
আনাবিয়া জোর করে কোকোকে তুললো নিজের কোলের ওপর থেকে, মুখটা উঁচু করে ধরে চোখ মুছিয়ে দিয়ে গলা শক্ত করে শুধালো,
“এখানের গার্ড দুটো বলল তোকে নাকি ইলেকট্রিক শক দেওয়া হয়েছে। কে দিয়েছে তোকে ইলেকট্রিক শক? কি চলছে এখানে? কার আদেশে তোকে এখানে এভাবে রেখে গেছে ওরা? বাকিরা কোথায়?”

রাতের এখন প্রায় চারটা, ভোর হবে কিছুক্ষণ পরেই। ধীরে ধীরে জেগে উঠতে শুরু করেছে শিরো মিদোরির পাখি সমাজ। তাদের মিষ্টি কিচিরমিচির আর সুমধুর সুরেলা কন্ঠে ছেয়ে গেছে রেড জোন।
আজ যেন ওরা একটু বেশিই আনন্দিত, উচ্ছসিত। এতদিন পর শিরো মিদোরি তার হারানো রঙ ফিরে পেয়েছে, চারদিকে আবার ছেয়ে গেছে সবুজে। শুকনো গাছের ডালগুলো ফেটে বেরিয়ে এসেছে একরাশ সবুজ কুঁড়ি। নরম, কচি পাতায় ভরে উঠেছে বন।
হাওয়ায় ভাসছে মিষ্টি গন্ধ, কাঁঠালচাঁপার মোহনীয় সুবাস ভেসে আসছে বাতাসে। সমস্ত রেড জোনের আনাচে কানাচে নাম না জানা ফুলেরা সাজিয়েছে নানা রঙের কুড়ির পসরা।

আকাশ মেঘমুক্ত, চাঁদটা হেলে পড়েছে পশ্চিমে। তার ম্লান আলো এসে পড়ছে লাইফট্রির সামনের ফাঁকা স্থানটায়। সেখানে বসে আছে পাঁচ জন মানব মানবী, কারো মুখেই কোনো কথা নেই।
আনাবিয়া হাটুর ভাজের ওপর মাথা রেখে বসে আছে, আনমনা চোখ জোড়া ওর শূন্যে। শুভ্র, দীর্ঘ কেশগুচ্ছ লুটিয়ে আছে মাটিতে। কোকো, ব্রায়ান, শার্লট, ফাতমা সকলে মিলে এতক্ষণ ধরে ওকে গত তিন বছরের অল্পবিস্তর ফিরিস্তি দিয়েছে। আনাবিয়া এখনো যেন বিশ্বাস করতে পারছেনা কিছু, সমস্তই অবিশ্বাস্য ঠেকছে ওর কাছে।
কোকো এখনো চরম সত্যিটা চেপে গেছে আনাবিয়ার থেকে, বুকের ভেতর দুরু দুরু করছে ওর। ও জানে ওর আম্মা অভিমানের তোপে সেই ব্যাক্তিটির কথা জিজ্ঞেস করছেনা। কিন্তু কি হবে যখন ওর আম্মা জানবে তার অভিমান ভাঙাতে দুনিয়ে উলটে ফেলা পুরুষটি আর এই পৃথিবীতেই নেই, মেরে ফেলা হয়েছে তাকে!
দেমিয়ান বংশের বিরাট সমাধিক্ষেত্রে নিজের দাদাজান আর প্রাণপ্রিয় ভাই সালিমের মধ্যিখানে ঘুমিয়ে আছে সে, গভীর ঘুম!

আনাবিয়া মুখ তুললো হাটুর ওপর থেকে, চোখ তুলে তাকালো কোকোর দিকে। বুক কেঁপে উঠলো কোকোর! এই দৃষ্টির অর্থ ওর জানা, এই দৃষ্টি ওকে উদ্দেশ্য করে এক নিরব প্রশ্ন করে চলেছে!
আনাবিয়া মুখ খুললো এবার; ধীর, নরম গলায় প্রশ্ন করলো,
“মীর এখন কোথায় আছে? ইলহান চাচাজান কোথায় রেখেছেন ওকে? এখন সুস্থ আছে ও?”
কিয়ৎক্ষণের জন্য থমকালো কোকো, খুব করে চাইলো নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে, কিন্তু অনিচ্ছাকৃতভাবেই ওর চোখের ওপর নেমে এলো যন্ত্রণার ছায়া। গলার স্বর ভারী হয়ে এলো মুহুর্তেই!
আনাবিয়ার চোখের ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো সঙ্গে সঙ্গেই, বুক ভরে একবার দম নিয়ে চেষ্টা করলো নিজেকে স্থির রাখার।
ওর দিকে তখনো আগ্রহী, উৎকণ্ঠিত চোখে তাকিয়ে আনাবিয়া, অপেক্ষায় উত্তরটি শোনার। অধৈর্য হয়ে দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করলো,

“কেমন আছে ও?”
প্রশ্নটা তীক্ষ্ণ ছুরির ফলার মতো বিধলো কোকোর হৃদয়ে, কি উত্তর দিবে ও? কিভাবে উত্তরটা দিবে, কিভাবে শুরু করবে, কোথা থেকে শুরু করবে?
কোকো চুপ রইলো কিছুক্ষণ, তারপর কাঁপা, নরম গলায় বলে উঠলো,
“উ-উনি এখানে নেই আম্মা।”
আনাবিয়া তাকিয়ে রইলো এক চোখ বিস্ময় নিয়ে, সামান্য এগিয়ে এসে শুধালো,
“এখানে নেই মানে? কোথায় গেছে? ইলহান কোথায় রেখেছেন ওকে?”
কোকো তাকাতে পারলোনা আনাবিয়ার চোখের দিকে, চোখ নামিয়ে নিয়ে মৃদু কম্পিত স্বরে উত্তর করলো,
“অ-অনেক দূরে, যত দূরে গেলে আর কখনোই ফিরে আসা যায় না!”
আনাবিয়ার চোখে বিস্ময়, উদ্বেগ, ভয়! আতঙ্কে ভ্রু তুলে চেয়ে ও শঙ্কিত গলায় বলল,
“হেয়ালি করিস না কোকো, ও কোথায় গেছে সত্যি করে বল! অনেক দূরে মানে কি? কি বলতে চাইছিস তুই? এদিকে তাকা, আমার দিকে তাকা!”
মাথা তুললো কোকো, কন্ঠরোধ হয়ে আসতে চাইলো ওর, তবুও জোর করেই গলা দিয়ে ঠেলে বের করলো কয়েকটি শব্দ,

“আপনার বাবা, আর আপনার বাবার দাদাজানের মাঝে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়ে আছেন তিনি৷”
নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেলো সমস্তটা, আনাবিয়া বিশ্বাস করতে চাইলোনা, অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কোকোর দিকে, এক ফালি দ্বিধার হাসি ফুটলো ওর ঠোঁটে, পরক্ষণেই আবার নিভে গেলো তা!
“মজা করছিস তুই আমার সাথে?”
প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে তাকিয়ে রইলো আনাবিয়া, ঢোক গিললো একটা। যেন ভেতর থেকে দলা পাকিয়ে উঠে আসতে চাওয়া হাহাকারকে দাবিয়ে রেখে দিতে চাইলো ভেতরেই! ওর মন, মস্তিষ্ক বিশ্বাস করতে চাইলোনা কোকোর বলা একটি শব্দও।

কিন্তু যখন দেখলো ওর সামনে হাটুতে ভর দিয়ে বসে থাকা কোকোর চোখ জোড়া লাল হয়ে উঠেছে হঠাৎই, ঢোক গিলে কান্না চেপে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে চলেছে— তখনই কাঁপতে শুরু করলো আনাবিয়ার শরীর! থরথর কম্পনে শরীরটা যেন মিশে যেতে চাইলো মাটিতে!
হৃদস্পন্দন তীব্র হয়ে গেলো আচমকাই, শ্বাস প্রশ্বাস হয়ে এলো অস্বাভাবিক! টলে উঠলো আনাবিয়া, বল হারিয়ে ধপ করে বসে পড়লো একপাশে, ফাঁকা চোখ জোড়া এক মুহুর্তের জন্য চেয়ে রইলো শূন্যে।

কোকো হাটুর ভর ছেড়ে এবার বসে পড়লো মাটিতে, নজর উঠালোনা এতটুকুর জন্যও! অপরাধবোধে ছেয়ে গেলো ওর হৃদয়। ওর আম্মা যদি এখন প্রশ্ন করে কেন ওরা সেই মানুষটিকে রক্ষা করেনি, কেন ওরা তাকে না বাঁচিয়ে নির্লজ্জের মতো এখনো নিজেরা বেঁচে আছে এই পৃথিবীতে, তবে কি উত্তর দেবে ও? কি দিয়ে স্বান্তনা দিবে?
চারপাশটা যেন শূন্য হয়ে গেল হঠাৎ করেই, নিস্তব্ধ হয়ে গেলো সমস্তটা! হাওয়ার মৃদু স্রোত, পাখির ডানা ঝাপটানো, দূরের কোনো অস্পষ্ট কোলাহল—সব যেন মুহুর্তেই হারিয়ে গেলো কোনো এক গভীর শুনশান নীরবতার মাঝে।
আনাবিয়া বোবা হয়ে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ, দৃষ্টি ফাঁকা, শ্বাস টেনে নিতে পারছে না যেন। চোখের ভেতর একরাশ বিস্ময়, অস্বীকার, আর অজানা এক ত্রাস!
ঠোঁট কাঁপছে তিরতির করে, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ নামছে না। যেন শরীরের সমস্ত শক্তি ওর এক মুহূর্তে নিঃশেষ হয়ে গেছে!

আর তারপর…
তারপর অনাহূতভাবে হঠাৎ এক বিকট, হৃদয়বিদারক আর্তনাদ বেরিয়ে এল আনাবিয়ার বুক চিরে— কান্না নয়, এক ছিন্নভিন্ন করে ফেলা চিৎকার!
বুকের গহীন থেকে উঠে আসা সে আর্তচিৎকার এমন তীব্র, এমন সুচালো, এমন তীক্ষ্ণ বাজলো যেন বক্ষপাজর ভেদ করে বেরিয়ে আসতে চাইছে ওর যন্ত্রণা!
নিজের এই অপ্রত্যাশিত যন্ত্রণা, অপ্রত্যাশিত চিৎকারে নিজেই যেন হতবিহ্বল হয়ে গেলো আনাবিয়া, কম্পিত হাত দুটো মাথার পাশে তুলে চেপে ধরতে চাইলো মুখ, যেন নিজেকে নিজেই থামাতে চাইছে, কিন্তু পারলো না!
ওর গগনবিদারী হাহাকারে কেঁপে উঠলো সমস্ত রেড জোন! মুহুর্তেই ভীষণ ভয়াল মেঘ জমলো আকাশে, শুরু হলো বিদ্যুতের ভয়ানক ঝলকানি! ঝড়ো বাতাসে দুমড়ে মুচড়ে যেতে শুরু করলো রেড জোনের গাছ পালা গুলো!
দম ফুরিয়ে এলো আনাবিয়ার। আর্তনাদ থামিয়ে, গভীর পানিতে ডুবে যেতে থাকা শিশুর হঠাৎ পানিপৃষ্ঠ পেয়ে বুক ভরে দম নেওয়ার মতো করে শ্বাস টেনে নিলো আনাবিয়া। প্রকম্পিত দুই হাত মাথা থেকে নামিয়ে মাটিতে ঠেকালো, যেন মাটি আঁকড়ে ধরে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে চাইছে ও এই পৃথিবী পৃষ্ঠে!

“না… না… এটা সত্যি না… এ-এটা কোনো ভাবেই সত্যি না…!”
ঠোঁট নাড়িয়ে অস্পষ্টভাবে কথাগুলো বলে নিজেকে নিজেই স্বান্তনা দিলো যেন আনাবিয়া। পরমুহূর্তেই আবার ওর গলা চিরে উঠে এলো একটি আর্তচিৎকার!
কণ্ঠস্বর ফেটে যেতে চাইলো, গলা শুকিয়ে এলো মুহুর্তেই, কিন্তু কান্না থামলো না। শুভ্র চোয়াল বেয়ে নোনা জল ঝরে পড়লো মাটির ওপর, সেই অত্যান্ত উর্বর পানির ফোটায় মুহুর্তে সেখানে ফুটে উঠলো কয়েকটি নতুন জংলি ফুলের কুড়ি!

কাঁধ কাঁপলো আনাবিয়ার, বুকটা ধড়ফড় করতে লাগলো ঝড়ের কবলে পড়া পাখির অসহায় ডানাঝাপটানোর ন্যায়!
চোখের সামনে মুহূর্তেই ঝাপসা হয়ে এল সবকিছু—সেই চিরচেনা মুখটা, সেই স্মিত হাসি, সেই হাজার হাজার স্মৃতি, সেই পাগলাটে ভালোবাসা, সেই ঝড় তোলা আদর… সব… সব যেন আনাবিয়ার থেকে পালিয়ে যাচ্ছে, ছুটে চলে যাচ্ছে এক ভয়ানক দূরত্বে; এমন এক স্থানে যেখান থেকে আর কোনোদিন কেউ ফিরবে না!
“তুমি কেন গেলে… আমায় এখানে একা ফেলে রেখে কেন গেলে…! তুমি কি জানতেনা তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই…?”

মর্মভেদী এক গোঙানী দিয়ে চিৎকার করে শুধোলো আনাবিয়া, কিন্তু যাকে শুধোলো সে শুনলোনা এ প্রশ্ন! উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনটুকুও তার এখন আর নেই!
প্রশ্ন গুলো করেই মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে ফেলল আনাবিয়া, নিজের বাহুজোড়া দিয়ে মুখটা আগলে নিয়ে ভেঙে পড়ল কান্নায়! কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলো সমস্ত শরীরটা, যেন ওর মর্মের সমস্ত ব্যথা ছড়িয়ে পড়ছে শরীরের প্রতিটি কোষে!
সম্মুখে বসা থাকা কোকো নিরুপায়, অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আনাবিয়ার দিকে। চোখ ছাপিয়ে ক্ষারজল নেমেছে সরু গতিতে!

ওর আম্মার এমন অবস্থা ও কিভাবে সইবে? কি করলে একটু শান্ত হবে ওর আম্মা, একটু শান্তি পাবে?
সে কি হাত বাড়িয়ে তাকে থামাবে? তাকে একবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরবে? না কি স্বান্তনা দিবে?
কী বললে, কি করলে কমবে ওর আম্মার এই বুক ফেটে যাওয়া যন্ত্রণা?
কিছুই না। এই মুহূর্তে হয়তো ওর সমস্ত ভাষা, সমস্ত কর্ম ওই ভীষণ যন্ত্রণার কাছে পোড়া ছাইয়ের ন্যায় মূল্যহীন!
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করলো তখন শিরো মিদোরির সমুদ্রের কোল ছুঁয়ে, ঢেউ গুলো সশব্দে আছড়ে পড়তে থাকলো তীরে, স্তব্ধ হয়ে রইলো রেড জোন।
শুধুমাত্র আনাবিয়ার গগনবিদারী আর্তনাদটাই ভেসে বেড়াতে লাগলো বাতাসে… ভেসে বেড়াতে লাগলো একটা হৃদয়ভাঙা, নিঃশেষ হয়ে যাওয়া আত্মার আকুতি, যা শূন্য ভোরের বুকে প্রতিধ্বনি তুলে কাঁপিয়ে দিতে চাইলো পুরো পৃথিবী……!

দেমিয়ান প্রাসাদের কোল ঘেঁষে থাকা কিঞ্চিৎ অন্ধকার গলি পেরিয়ে নিঃশব্দে অবস্থান করছে একটি কবরস্থান। ভোরের শীতল বাতাস আর মাটির সেঁদো গন্ধে ভরা পরিবেশটা নিস্তব্ধ। সেখানের শিলাবদ্ধ সমাধিস্থল গুলোর একটি এখনো যেন নতুন। গতরাতের বৃষ্টিতে ভিজে পরিষ্কার হয়ে গেছে সেখানের সমস্ত ধুলোবালি, স্বল্প পুরোনো কবরটির মাথার ওপরের খোদাইকৃত শিলাটি ঝকঝক করছে।
কবরের চারপাশে জন্মেছে এক ঝাঁক বুনো ফুলের গাছ, সেগুলোর নরম কান্ড, শাখা প্রশাখা গুলো নত হয়ে ঝুঁকে পড়েছে কবরের ওপর।

কবরের চারপাশটা ঘেরাও করে রাখা ছোট্ট প্রাচীরের উপরিভাগে হাতস্পর্শ করে দাঁড়িয়ে আছে আনাবিয়া। কবরটির অগ্রভাগে থাকা শিলাখন্ডের উপরিভাগে খোদাই করে লেখা তার শ্রদ্ধেয় পুরুষ, তার জীবনসঙ্গীর নামটা ম্লান হয়ে এসেছে সামান্য, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে ওর মানুষটির এটুকু চিহ্নও!
আনাবিয়ার মুখ জুড়ে ছেপে আছে বিষণ্ণতা। চোখ জোড়ায় ফুটে আছে গভীর শূন্যতা, ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাওয়া এক অনুভূতি। চোখের কোণে অশ্রুর আভাস স্পষ্ট, কিন্তু তা ঝরে পড়ছে না।
কাঁচের মতো স্বচ্ছ, নিস্তব্ধ চোখ জোড়া দিয়ে এক গভীর, অতল দৃষ্টি নিয়ে কবরটির দিকে তাকিয়ে আছে সে। ভেতরে ভেতরে এক তীব্র শূন্যতা গ্রাস করে চলেছে তাকে!
ভোরের গা ছমছমে শীতল বাতাস সারা শরীরে মৃদু শিহরণ এনে দিলো আনাবিয়ার, শিউরে উঠলো ও। প্রতিটি নিঃশ্বাস ভারী হয়ে ঝড়ে পড়লো বুক চিরে। দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইলো, তবু এতটুকু শব্দ করেলোনা। নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলো কবরের দিকে।

বুকের ভেতর থাকা চিরকালীন যন্ত্রণাটা ক্রমশ বেড়ে চলে ওর। সমস্তই আঁধারে আচ্ছাদিত, যেন এক গহিন অন্ধকারের দিকে হেটে চলেছে সে, যেখানে নেই কোনো আলো!
হীরকখন্ডের ন্যায় চোখ জোড়াতে উঁকি দিয়ে রইলো এক গভীর, অমীমাংসিত যন্ত্রণা— জানিয়ে দিয়ে গেলো আজ সে শোকার্ত, একদম একা!
বুক ভরে দম নিয়ে আবার বাতাসে ছেড়ে দিয়ে কবরস্থান থেকে ধীর পায়ে বেরিয়ে আসলো আনাবিয়া। প্রবেশ পথে দাঁড়িয়ে আছে ওরা চারজন৷ সেদিকে এক পলক তাকিয়ে চোখের কোণাটা মুছে নিলো ও। মুহুর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে ফিরে আসলো নিজের চিরাচরিত স্বভাবে।
প্রবেশ পথ অতিক্রম করে বাইরে বেরিয়ে এসেই কোকোকে জিজ্ঞেস করলো,
“ফ্যালকনকে কোথায় ঝুলিয়েছে?”

ধুলোয় ঢাকা ফার্ম হাউজের কনস্ট্রাকশন সাইট। চারপাশে ইট-বালুর স্তূপ, কাঠের তৈরি মাচা আর ব্যস্ত শ্রমিকদের কোলাহল। তার ভেতরেই নিঃশব্দে কাজ করে চলেছে বাচ্চারা।
ফার্ম হাউজের কাজ একদিনেই বেশ খানিকটা এগিয়েছে। লিডার গার্ডটি হাতে চাবুক নিয়ে দাড়িয়ে আছে, কাজে সামান্য দেরি হলেই জাহেলিয়াত যুগের মতোন শপাং শপাং চাবুকের বাড়ি পড়ছে বাচ্চাদের পিঠের ওপর।
ফ্যালকন এখনো পাশে থাকা বিশাল গাছটির ডালে ঝোলানো, সারারাত এখানেই বৃষ্টির পানিতে ভিজতে হয়েছে ওকে। এখন রোদের উত্তাপে আবার শুকিয়েও গেছে। জ্ঞান নেই, হাত জোড়া অভিকর্ষজ টানে ঝুলে আছে নিচের দিকে।

বৃষ্টির জন্য কাজে বিরতি দেওয়া হলেও ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই আবার কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে ওদের। লিডার গার্ড নিজে দাঁড়িয়ে কাজের তদারকি করছে৷ এদিক ওদিক হলেই আজ সবগুলোকে বুঝিয়ে দেবে ভালোমতো, আদেশ অমান্য করার সাধ মিটিয়ে দিবে।
এমন সময় পেছন থেকে একজন গার্ড এসে বলে উঠলো,
“লিডার, আপনার ব্রেকফাস্ট তৈরি।”

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৪

লিডার গার্ডটি একবার ইটের বোঝা বইতে থাকা লিও আর কাঞ্জির দিকে তাকিয়ে উঠে দাড়ালো চেয়ার ছেড়ে। তারপর এগোলো কনস্ট্রাকশন সাইটের অদূরেই তার জন্য নির্ধারিত তাবুতে।
দুজন গার্ডকে দাড়া করিয়ে রেখে গেলো যেন অসভ্য গুলো ভুলেও কাজে ফাকি দিতে না পারে৷ গার্ড দুটো তাদের জাদরেল লিডারের খপ্পর থেকে কিছু সময়ের বিরতি পেয়ে জমিয়ে শুরু করলো গল্প।
সেই মুহুর্তেই রোদের আলোয়, ঝলমলে ধোঁয়াটে বাতাসে, গার্ডদের নজর এড়িয়ে লুকিয়ে চুরিয়ে কনস্ট্রাকশন সাইটের দিকে দ্রুত, সতর্ক পায়ে ছুটে আসলো একটি কিশোরী মেয়ে……

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here