বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৮

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৮
রানী আমিনা

গায়ের ওপর একটা পাতলা রোব জড়িয়ে রয়্যাল ফ্লোরের বারান্দার এদিক থেকে ওদিক পায়চারী করে চলেছে ইলহান। আধা রাত পার হয়ে গেছে, তবুও ঘুম নেই তার চোখে৷ বিছানায় তার খাস বাদীদের একজন শুয়ে আছে এখনো, সেদিকেও মন টানছে না। কোনো এক অশান্তির সুক্ষ্ম জ্বালাতন ঘুমোতে দিচ্ছেনা তাকে!
রয়্যাল ফ্লোরের প্রবেশদ্বারে এমন সময় শোনা গেলো পদশব্দ। ইলহান তাকালো সেদিকে, কিছু পরেই ধীর পায়ে লাঠিতে ভর দিয়ে হেটে আসতে দেখা গেলো ইয়াসমিনকে। নানা দুঃখে জর্জরিত হয়ে বার্ধক্য যেন একটু দ্রুতই ঘিরে নিয়েছে তাকে।
সময় নিয়ে রয়্যাল ফ্লোরের বিশাল এরিয়া পার করে ইলহামের নিকট এসে নির্দিষ্ট দুরত্ব বজায় রেখে দাড়ালো ও, বলল,

“আমাকে ডেকেছিলেন ইয়োর ম্যাজেস্টি? কোনো অসুবিধা হয়েছে? অরোরা মেয়েটা কি কোনো বেয়াদবি করেছে?”
সমুদ্রের দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে থাকা ইলহান শরীর ঘুরিয়ে দাড়ালো ইয়াসমিনের সামনে, বলল,
“এমন কিছু নয় ইয়াসমিন। তোমাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য ডেকেছি।”
“আদেশ করুন ইয়োর ম্যাজেস্টি।”
ইলহান দম নিলো বড় করে, দম ছেড়ে বলল,
“শেহজাদী আনাবিয়া রেড জোন সম্পুর্ন ঘিরে রেখেছে, কারো সেখানে প্রবেশের অনুমতি নেই, এমনকি আমারও না। সে দেমিয়ান বংশের মেয়ে হয়ে জঙ্গলের ম্যানারলেস পশুদের সাথে দিনাতিপাত করবে ব্যাপারটা আমার খুবই অপছন্দের।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তুমি আগামীকালই যাবে সেখানে। আমাকে প্রবেশ করতে না দিলেও তোমাকে দিবে আশা করি। তুমি গিয়ে তাকে বোঝাবে, এবং তাকে প্রাসাদে ফিরে আসতে বলবে।
যা হবার তা তো হয়েই গেছে, এখন ক্রোধ পুষে রেখে এভাবে প্রাসাদছাড়া হলে ব্যাপারটা কি ভালো দেখায় তুমিই বলো! দেমিয়ান বংশের শেহজাদী হয়ে সে কেন জঙ্গলে থাকবে?
তুমি কাল গিয়ে ওকে বোঝাবে, বলবে আমার আদেশ। যদিও আমার আদেশের তোয়াক্কা সে করবেনা, তবুও বলবে।
সে যদি তোমার কথা শুনে প্রাসাদে ফিরে আসে তবে তোমাকে আমি পুরষ্কৃত করবো ইয়াসমিন। মোটা অংকের পুরষ্কার।”

“অনেক ধন্যবাদ ইয়োর ম্যাজেস্টি, আপনার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ৷ কিন্তু আমি কোনো পুরষ্কার নিতে চাইনা, তিনি যদি আমার কথাতে প্রাসাদে ফিরে আসেন তবে সেটাই হবে আমার জন্য সবচেয়ে বড় পুরষ্কার।
আমি কালই যাবো সেখানে, শেহজাদীকে প্রাসাদে ফিরিয়ে নিয়ে আসার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো আমি, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।”
ইলহান ঠোটের কোণা টেনে হাসলো, মনে মনে তাচ্ছিল্য ভরে বলল,
“ইমোশনে ভরপুর মানুষজনে প্রাসাদ ভর্তি!”
মুখে বলল,
“ঠিক আছে ইয়াসমিন, তুমি তোমার সর্বোচ্চটা দিয়েই চেষ্টা করবে আমি জানি। এখন তুমি যেতে পারো।”
বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে হেটে কামরায় চলে গেলো ইলহান। ইয়াসমিন কিয়ৎক্ষণ রয়্যাল ফ্লোর টিকে চোখ ভরে দেখে নিয়ে এগোলো আবার নিজের কামরার উদ্দ্যেশ্যে।

“শেহজাদী তাঁর ব্যাপারে তোকে এখনো কিছুই বলেননি? কীভাবে কি হলো, কিছুই না?”
রেড জোনের খোলা মাঠের ভেতর সগর্বে দাঁড়ানো কাঠ লতাপাতা দিয়ে তৈরি বিরাট মহল টার সম্মুখের অদূরে, খোলা স্থানে থাকা একটা অশ্বত্থ গাছের বিরাট প্রসারিত ডালপালার ছায়ার নিচে ঘাসের ওপর বসা লিও জিজ্ঞেস করলো পাশে বসে থাকা কোকোকে।
“নাহ্‌, জিজ্ঞেস করেছিলাম কয়েকবার, প্রথমে তো উত্তরই করেননি, সম্পুর্ন নিরব থেকেছেন। আর শেষবার যখন জিজ্ঞেস করেছি তখন বিরক্ত হয়ে বলেছেন এই ব্যাপারে তাঁকে কিছুই জিজ্ঞেস না করতে, সময় হলে তিনি নিজেই জানাবেন।”
হাতে একটা পাতা নিয়ে অলসচিত্তে ছিড়তে ছিড়তে উত্তর দিলো কোকো।

“জায়ান সাদি আর নওয়াস জাবিনের কথা জানিয়েছিস?”
“হু, সব জানিয়েছি এ টু জেড। কোথায় কবে কি হয়েছে শেহজাদা ইলহান কবে কার সাথে কি করেছেন কিভাবে করেছেন সব।”
“কি বললেন উনি?”
“কিছুই বললেন না, শুধু শুনে গেছেন।
আম্মাকে আমার কেমন যেন অন্যরকম লাগছে। আমার আগের আম্মা আর এই আম্মার ভেতরে যেন কোথাও একটা অমিল আছে লিও।”
“এ কথা তোকে আমিও বলতে চাইছিলাম।
হিজ ম্যাজেস্টিকে উনি নিজের চাইতেও বেশি ভালোবাসতেন, কিন্তু হিজ ম্যাজেস্টির মৃত্যুসংবাদ শুনেও উনি বেশ স্বাভাবিকই আছেন, কোনো পরিবর্তন নেই।”
“পরিবর্তন আছে লিও, তুই বুঝতে পারছিস না। এই যে প্রায় দশদিন তিনি আমাদের সাথে আছেন, তাঁকে একবারও হাসতে দেখেছিস আগের মতো?
উনি অনেক শান্ত হয়ে গেছেন, আমাদের সাথে থাকলে আগে উনি খিলখিল করে হাসতেন, কত দুষ্টুমি করতেন! এখন তার কিছুই নেই।

দেমিয়ান শেহজাদীরা স্বভাবতই স্বামী অন্তঃপ্রাণ হন, আমাদের শেহজাদীও তার ব্যাতিক্রম নন। বরং উনি একটু বেশিই স্বামী অন্তঃপ্রাণ, তার প্রমাণ আমরা লাইফে বহুবার পেয়েছি।
উনি হয়তো সময় নিচ্ছেন, সম্পুর্ন ব্যাপারটা প্রসেস করার। নিজের একমাত্র পরিবার, একমাত্র অভিভাবক, একমাত্র ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে স্বাভাবিক হওয়া তো আর মুখের কথা নয়!”
কোকো থামলো, তারপর বেশকিছুক্ষণ নিরব রইলো দুজনেই। ভোরের আলো ফুটবে কিছুক্ষণ পরেই, খাবারের ব্যাবস্থা করতে হবে। কোকো শুণ্যে তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাটিতে হাতে ভর দিয়ে উঠে দাড়াতে দাড়াতে বলল,

“মাছ ধরতে যেতে হবে সমুদ্রে, ফ্যালকনকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে আসি। তুই এখানেই থাক, আম্মাকে চোখের আড়াল হতে দিবিনা৷ আম্মা যতই পাওয়ারফুল হন না কেন আমরা পুরুষ, আমাদের দায়িত্ব তাঁকে যে কোনো পরিস্থিতিতে রক্ষা করা।
জানিসই তো হিজ ম্যাজেস্টি আম্মাকে কতটা আগলে আগলে রাখতেন! তাঁর শরীরে কোনোকিছুর আঁচ পর্যন্ত লাগতে দিতেননা। তিনি হয়তো আজ নেই, কিন্তু তার আমানত আমাদের কাছেই আছে৷ উনি উপস্থিত থাকলে এখন যেটা করতেন, যেভাবে করতেন আমাদেরও সেভাবে সেটাই করা উচিত। আম্মাকে নিজেদের সর্বোচ্চ টা দিয়ে সার্ভ করা উচিত, প্রোটেক্ট করা উচিত। তাই চোখ কান খোলা রাখবি সবসময়।”
লিও শূন্যে দৃষ্টি দিয়ে কোকোর কথায় সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ালো ওপর নিচে। কোকো ঘুরে দাঁড়িয়ে এগোলো মহলের দিকে, ফ্যালকনকে ডেকে তুলতে।

সকাল হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ, আনাবিয়া ফাতমা আর শার্লট তিনজনে মিলে তাদের মহলের বিরাট কিচেনে রান্না বসিয়েছে। তিনজনে মিলে আবার সেই পূর্বের মতো করেই হাসি আড্ডায় মেতে রান্না করতে ব্যাস্ত।
কোকো আর ফ্যালকন ভোর হওয়ার আগে সমুদ্রে গিয়ে একটা বিশাল টুনা মাছ ধরে নিয়ে এসেছে, সেটাকেই পাক করে চলেছে তিন রমণী।
আনাবিয়া রান্না করতে চাইলেও ওরা রান্না করতে দেয়নি, নিজেরাই করছে। আনাবিয়া দেখিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে ওদের, মাঝে মাঝে নিজেও হাত লাগাচ্ছে,
কিন্তু এতে ওদের ঘোর আপত্তি দেখে এখন সে কিচেনের দেয়াল ঘেষে একটা তুলতুলে অটোমানের ওপর বসে আছে চুপচাপ।

নেভি ব্লু ব্যাগি ট্রাউজারের সাথে একটা ক্রিম রঙা ওভারসাইজ হুডি পরনে ওর, রংটা দারুণ ভাবে ফুটেছে ওর ওপর। কিচেনের বিশাল জানালা দিয়ে আসা সূর্যের নরম সোনালি আলোর কিছু অংশ পড়ছে ওর মুখের ওপর, ঝিকিমিকি করছে ওর মুখমণ্ডল।
সফেদ চুল গুলো বিরাট খোপা করে বেধে রাখা, কয়েকটি অবাধ্য বাবু চুল সেখান থেকে বেরিয়ে এসে মনের আনন্দে বাতাসে দোল খেয়ে চলেছে।
বাইরে থেকে কাঠের কাজ করার খট খট শব্দ ভেসে আসছে, কাঞ্জি আর ব্রায়ান মিলে আনাবিয়ার এই মহলের করা নামকরণকে কাঠের ওপর খোদাই করতে ব্যাস্ত। বাকিরা বাইরে হৈহল্লা করে চলেছে৷
কোথা থেকে একটা একপাশ ছিড়ে যাওয়া ফুটবল নিয়ে এসে সেটাকে সারাই করে লাথিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে সকলে মিলে।

কিন্তু মৃতপ্রায় ফুটবলের অংশবিশেষ টুকু এবার সত্যি সত্যিই মরতে বসেছে। ছেলেগুলো মরতে দিচ্ছেনা তাকে, তাদের শক্তিশালী লাথির চোটে যতবার ফুটবলটা মনের দুঃখে মরতে গেছে ততবারই সেটাকে আবার জোড়াতালি দিয়ে ঠিক করেছে কোকো। মনে মনে ফুটবল টা নিশ্চই কোকোকে গালাচ্ছে।
লিন্ডা কিছুই করছেনা, সে আনাবিয়ার পাশে থাকা অন্য একটি অটোমানের ওপর বসে আছে চুপচাপ। দেখছে এদের রান্না বান্না। ক্ষিদে পেয়েছে তার, কিন্তু বলতেও পারছেনা৷
কাজে হাত লাগাচ্ছেনা কিন্তু ক্ষিদে পেয়েছে শুনলে এরা ওকে কিচেন থেকে বের করে দেবে নিশ্চিত!
কি করবে ভেবে না পেয়ে পাশে বসা আনাবিয়ার দিকে হেলে পড়ে আনাবিয়ার কোমর জড়িয়ে ধরে কাধে মাথা এলিয়ে দিলো ও। আনাবিয়া মিষ্টি হেসে হাত বুলিয়ে দিলো ওর মাথায়, পরম আবেশে চোখ বুজে নিলো লিন্ডা।
এমন সময়ে প্যালেসের বাইরে এতক্ষণ ধরে ছোটাছুটি করতে থাকা কোকো, ফ্যালকন আর লিও ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে, লম্বা লম্বা পা ফেলে এসে পৌছালো সেখানে, ব্রায়ানও কাজ শেষ করে এলো ওদের পেছন পেছন। ক্ষিদে পেয়ে গেছে সবার!
কোকো এসেই লিন্ডাকে আনাবিয়ার সাথে এমন জড়িয়ে থাকতে দেখে টান দিলো ওর কান ধরে।
কানের ডগায় এমন অতর্কিত হামলায় তড়িঘড়ি করে উঠে বসলো লিন্ডা, কোকো ওর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বলল,

“এই সর! আম্মা এখানে আসার পর থেকে দেখি তুই আম্মার সাথে আঠার মতো লেগে আছিস! উঠ এখান থেকে, এখানে এখন আমি বসবো।”
বলে লিন্ডাকে এক টানে অটোমানের ওপর থেকে উঠিয়ে লিওর বুকের ওপর ছুড়ে দিয়ে সেখানে নিজে বসলো কোকো। তারপর লিন্ডার মতো করেই আনাবিয়াকে জড়িয়ে ধরে আনাবিয়ার কাধের ওপর মাথে রেখে বলে উঠলো,
“ওকে আদর করেছেন এখন আমাকেও করুন, নইলে ভাত খাবোনা।”
কোকোর এমন ছেলে মানুষি আবদারে শব্দ করে হাসলো আনাবিয়া, হাত বুলিয়ে দিলো কোকোর ঝাকড়া চুলে। আনাবিয়াকে হাসতে দেখে চমকে তাকালো ওরা সবাই। কিয়ৎক্ষণ অবাক চোখে দেখে নিয়ে পরক্ষণেই আবার চোখ ফিরিয়ে নিয়ে যে যার কাজে লেগে পড়লো যেন আনাবিয়া সন্দেহ না করে বসে ওদের!
কিন্তু সবার ঠোঁটেই লেগে রইলো মিটিমিটি হাসি, এতগুলো দিন পর ওদের শেহজাদীর ঠোঁটের এই মিষ্টি মধুর ঝংকার শুনে খুশিতে আটখানা হলো ওরা৷

লিন্ডা ওর থেকে এক হাত মম্বা লিওর মুখের দিকে একবার অভিযোগের দৃষ্টিতে তাকিয়ে পরক্ষণেই আবার আনাবিয়ার দিকে মুখ ফিরিয়ে চোখ মুখ কুচকে নাঁকি সুরে কাঁদার ভান ধরে বলল,
“দেখেছেন শেহজাদী, কোকো ভাইয়া সবসময় আমার সাথে এমন করে! আমাকে দুচোখে দেখতেই পারেনা৷”
“হু হু, হইসে, সর এখন সামনে থেকে, ওদিক যা। এই লিও, তোর জিনিস নিয়ে এখান থেকে বাইর হ।”
বলে কোকো আগের মতো করেই পড়ে রইলো আনাবিয়ার কাঁধের ওপর। আনাবিয়া কিছুই বললোনা, মিষ্টি করে হাসলো শুধু। ওর এই বাচ্চা গুলো সারাক্ষণ এর ওর পিছে লেগেই থাকে, এদেরকে আর মানুষ করার অপশন নেই।
লিও লিন্ডাকে কাছে টেনে বাইরে নিয়ে যেতে যেতে চাপা সুরে বলে উঠলো,

“মন খারাপ করেনা আমার নীলনয়না! আদর দিবো তোমাকে, চলো।”
লিন্ডা তবুও কটমট করে তাকিয়ে রইলো কোকোর দিকে, লিও শেষপর্যন্ত দুহাতে ওর কোমর ধরে উঁচু করে তুলে নিয়ে চলে গেলো বাইরে।
লিও লিন্ডা চলে গেলে পেছন থেকে ব্রায়ান এগিয়ে এসে দাড়ালো ফাতমা আর শার্লটের মাঝখানে, বোনের মাথায় চাটি দিয়ে আনাবিয়াকে এড়িয়ে চাপা সুরে বলল,
“কি রান্না করিস, কোনো ঘ্রাণ নেই কেন?”
“খুন্তি টা তোর নাকের ফুটোয় ঢুকিয়ে দিই আয়, ঠিকই ঘ্রাণ পাবি।”
পাতিলের ভেতর থেকে খুন্তিটা উঠিয়ে দেখিয়ে চাপা হিসহিসে গলায় বলল শার্লট। হেসে উঠলো ব্রায়ান।
কিচেনের দেয়ালের উপরিভাগে থাকা শেল্ফের ভেতর থেকে এলাচের কৌটা বের করে তার থেকে একটা এলাচ নিয়ে মুখে পুরে দিয়ে শার্লট হতে নিরাপদ দুরত্বে সরে গিয়ে বলে উঠলো,

“দেখিস, দুই গুণবতী রাধুনি রান্না করতে গিয়ে যেন বাড়ি সুদ্ধ রান্না করে ফেলিসনা, সবই কিন্তু কাঠের।”
“তুই এখান থেকে সর নইলে কিন্তু পাতিলের ভেতর মাছের সাথে তোকেও রান্না করে ফেলবো!”
রাগী স্বরে বলল শার্লট, ব্রায়ান শব্দ করে হেসে উঠে এলাচটা চিবোতে চিবোতে বেরিয়ে গেলো বাইরে৷
এমন সময় হঠাৎ বাইরে শোনা গেলো এক অদ্ভুত ক্ষীণ মেটালিক সাউন্ড। এত কোলাহলের ভেতর সেটা অন্য কারো কানে না গেলেও আনাবিয়া শুনতে পেলো ঠিকই।।

তড়িতে কোকোর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাড়ালো ও, তারপর বেরিয়ে এলো কিচেন থেকে।
কিচেন থেকে বেরোলেই সম্মুখে মহলের বিরাট বারান্দা, সেখানে দাড়ালে মহলের সামনের অংশটা সম্পুর্ন দেখা যায়। মহলের কাঠের মেঝের বারান্দায় রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে সম্মুখের দিকটায় নজর বুলালো আনাবিয়া, তখনি ওর চোখ গেলো কাঠের সিঁড়ির ওপর দন্ডায়মান এক স্বচ্ছ রোবোটিক গার্ডের দিকে, যাকে চোখে মেলানো ভার!
সূর্যের সুক্ষ্ম আলোকরশ্মি পড়ছে তার ধাতব বর্মের ওপর, চকচক করে উঠে, সাতরঙা সরু তীক্ষ্ণ আলো টিকরে পড়ছে স্বচ্ছ আর্মরের ওপর থেকে। আনাবিয়াকে দেখা মাত্রই এগিয়ে এলো স্বচ্ছ অবয়বটা, নিজের আর্টিফিশিয়াল রোবোটিক ভয়েসে বলে উঠলো,

“শুভ সকাল শেহজাদী, হেরেমের কালবী ইয়াসমিন আপনার সাথে দেখা করতে চায়।”
বাচ্চারা বেশ কয়েকজন বাইরেই ছিলো, ফুটবল ছেড়ে ওরা গা এলিয়ে দিয়ে বসে ছিলো নরম ঘাসের ওপর। আনাবিয়াকে হঠাৎ এভাবে এসে মহলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে যেতে দেখে অবাকই হয়েছিলো ওরা, কিন্তু হঠাৎ এমন উদ্ভট কন্ঠস্বর শুনে চমকালো সবগুলো। তড়িতে তাকিয়ে দেখলো আশেপাশে কিন্তু কাউকেই নজরে বাধলোনা। দ্বিধান্বিত হয়ে ওরা তাকিয়ে রইলো আনাবিয়ার দিকে।
এমন সময় আনাবিয়া গার্ডটির উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো,

“আসতে দাও৷”
স্বচ্ছ গার্ডটি মুহুর্তেই প্রস্থান করলো, হাওয়ার বেগে আবার ফিরে গেলো নিজের স্থানে। আর তার বেশ কিছুক্ষণ পরেই রেড জোনের ঘন জঙ্গল পেরিয়ে খোলা মাঠের ভেতরে পা রাখলো ইয়াসমিন।
আনাবিয়া পায়ের ওপর পা তুলে বসে ছিলো বারান্দায় রাখা সোফাতে। চোখ মুখে ওর কাঠিন্যতা এসে ভর করেছে হঠাৎই!

লাঠিতে ভর দিয়ে ধীর গতিতে একটু একটু করে এগিয়ে মহলের নিকট এলো ইয়াসমিন। খোলা প্রান্তর পর্যন্ত গার্ডগুলোই পৌছে দিয়ে গেছে ওকে। কিন্তু সে স্থান হতে এই পর্যন্ত আসতে গিয়েই দম বেরিয়ে যাচ্ছে ওর।
ইয়াসমিন দাড়ালো একটু, দম নিলো বেশ কয়েকবার। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখলো মহলটাকে। গাছের পুরু কাণ্ড, লতাপাতায় বাধিয়ে তৈরি করা বিশালাকার মহলটির ওপরে কাঠ দিয়ে খোদাই করে বড় বড় অক্ষরে লেখা, ‘মসভেইল প্যালেস’।
চোখ নামিয়ে নিলো ইয়াসমিন, তারপর মহলে প্রবেশের চওড়া সিড়ি বেয়ে একটু একটু করে উঠলো ওপরে। বারান্দা থেকে সেটা সহজেই দৃষ্টি গোচর হলো আনাবিয়ার, হাঁক ছাড়লো ও,

“শার্লট, এক গ্লাস পানি নিয়ে আয়।”
শার্লট কিচেন থেকে গ্লাসভর্তি পানি নিয়ে আসতে আসতে ইয়াসমিন উঠে এলো মহলের বারান্দায়। আনাবিয়া পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো ওর দিকে, বলল,
“এসো ইয়াসমিন, বসো।”
ইয়াসমিন ধীর পায়ে হেটে এসে বসলো আনাবিয়ার বিপরীতে। আনাবিয়া ঝুকে এসে টেবিলে রেখে দেওয়া পানির গ্লাসটা এক হাতে ঠেলে এগিয়ে দিলো ওর দিকে। ইয়াসমিন পানি খেলো ঢক ঢক করে।
গ্লাসটা আবার নির্দিষ্ট স্থানে রেখে দিয়ে দম নিলো ইয়াসমিন, গুছিয়ে কিছু বলতে নিবে তার আগেই আনাবিয়া বলে উঠলো,

“সকালে খাওনি নিশ্চয়, অপেক্ষা করো খাবার তৈরি হয়ে এসেছে প্রায়।”
ইয়াসমিন দ্বিতীয় কথা বললোনা, চুপচাপ বসে রইলো আনাবিয়ার সম্মুখে। আসলেই ক্ষিদে পেয়েছে তার, সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই ছুটেছে এদিকে, খাবার গ্রহণের সময় পায়নি।
বুকের ভেতর দুরু দুরু করছে ওর, কিভাবে হিজ ম্যাজেস্টির বলা কথাটা শেহজাদীকে বলবে সেটারই ছক কষে চলেছে মনে মনে। এখন ভালোয় ভালোয় কথাটা বলতে পারলেই হয়!

খাবার তৈরি হয়ে গেলে আনাবিয়া আর ইয়াসমিনকে বাইরে বারান্দায় খাবার দিয়ে গেলো শার্লট আর ফাতমা। বাচ্চারা সকলে গিয়ে বসলো ওদের হলরুমের ভেতরে থাকা বিশাল ডাইনিং টেবিলে।
আনাবিয়া ওদের সাথে আজ খেতে বসবেনা দেখে কোকো মুখ ফুলালো খানিক, পরে তাকে আবার সাধাসাধি করে খেতে বসাতে হলো।
বারান্দায় চুপচাপ খেয়ে চলেছে ইয়াসমিন, খেতে খেতে মাঝে মাঝেই চোখ উঁচিয়ে দেখছে আনাবিয়াকে। বোঝার চেষ্টা করছে আনাবিয়ার চেহারার ভাষা৷
ওকে বার বার এভাবে তাকাতে দেখে আনাবিয়া নির্বিকার, দৃঢ় গলায় বলে উঠলো,

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৭

“ইয়াসমিন, শেহজাদা জাজিব ইলহান কে বলে দিও আমার স্বামীর হত্যাকারীর সাথে একই প্রাসাদে আমি সজ্ঞানে কখনোই থাকবোনা। জাজীব ইলহানের ছায়াতলে দেমিয়ান প্যালেসে থাকার চেয়ে আমি ডার্ক প্যালেসের নোংরা কুঠুরি গুলোকে বেশি প্রেফার করবো।”

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৯

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here