বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩৩+৩৪
রানী আমিনা
প্রায় শেষ বিকেল, মীর আনাবিয়া এখনো সাফওয়ানদের এখানেই আছে এতক্ষণে চলে যেতো কিন্তু সাফওয়ান ছেলেটা খুব করে অনুরোধ করলো ওদেরকে থেকে যাওয়ার জন্য, অন্তত একটা দিন হলেও!
মীর থাকতে চায়নি; একেই এখানের জায়গাটা ওর ভালো লাগেনি তারওপর যে পাইথনটাকে আনাবিয়া সুস্থ করে তুলেছিলো সেটা ওকে খুব বিরক্ত করছে, ওর কাছ থেকে নড়ছেই না!
কখনো ওর দিকে ওক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকছে, কখনোবা লকলকে জিভ বের করে ওর স্মেল নেওয়ার চেষ্টা করছে৷ কখনো বা ওকে পেচিয়ে ধরতে চাইছে শক্ত করে, খেলতে চাইছে ওর সাথে।
আনাবিয়া একবার এসে বলে গেছে ওদের নাকি গায়ের শেডে খুব মিলেছে তাই পাইথনটা ওকে ছাড়তে চাইছে না; মানে কিছু হলেই লোকে ওর গায়ের রঙ নিয়ে পড়ে, বিশেষ করে ওর নিজেরই কোলে পিঠে মানুষ করা বউ!
আর এখন সেই বউয়ের অনুরোধেই ওকে থেকে যেতে হচ্ছে এসব আজগুবি লোকজনের ভেতর।
কোনো ওক অজানা কারণে ও এই পৃথিবীর মানুষ দেরকে দেখতে পারেনা, ইনায়া ভাবীকে যেদিন ডাস্টবিন থেকে উঠিয়েছিলো সেদিনের পর থেকে ওর এই বহির্বিশ্বের ওপর থেকে ভক্তি শ্রদ্ধা সব উঠে গেছে এক প্রকার। মানুষ এত জালেম হয় কিভাবে?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
যদিও ও নিজেও যে খুব ভালো সেটা ও কখনোই বলেনা৷ কিন্তু তাই বলে একটা নবজাতক বাচ্চাকে ওরা ডাস্টিবিনে ঠাই দিবে!
আনাবিয়া খুব খুশি, সাফওয়ানকে ওর খুব ভালো লেগেছে। কোকোর থেকে বয়সে প্রায় বছর পনেরোর ছোট হবে ও, শরীরের বহরেও কিছুটা কোকোর কাছাকাছি, তাই সাফওয়ান ছেলেটাকে খুব আদর আদর লাগছে ওর কাছে। মনে চাচ্ছে কোকোর মতে করে ওর গাল টেনে চুলের ভেতর দলাই মলাই করে দিতে। কিন্তু নিজেকে কন্ট্রোল করে আছে ও।
কোকো আর সাফওয়ানের ভেতর এর ভেতরেই খুব ভাব হয়ে গেছে। দুজনে সেই সকাল থেকেই একসাথে আছে, এমন ভাব হয়েছে যে তার বউয়ের প্রতি খেয়াল দেওয়ারও সময় হচ্ছেনা। আনাবিয়া রুমাইশার খুব খেয়াল রাখছে সকাল থেকে, তাই সে এখন নিশ্চিন্তায় আছে।
বর্তমানে সাফওয়ানদের ছোট্ট বাঁশের তৈরি দু কামরার ঘরটার সামনে আরাম কেদারায় পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে রুমাইশা মেয়েটা, আনাবিয়া পাশেই একটা চারপায়ার ওপর বসে বসে গল্প করছে রুমাইশার সাথে।
সাফওয়ান আর কোকো মিলে রান্নার জোগাড়যন্ত করছে, কোকো জঙ্গলের ভেতর থেকে শুকনো কাঠপাতা নিয়ে এসে জড়ো করছে চুলার পাশে, সাফওয়ান বসে বসে ভাবছে কি কি রান্না করা যায়। জঙ্গলের কুড়েঘরে আজ তার মেহমানে ভরে গেছে, ছোট্ট কুটিরটা আজ গল্পে গল্পে মুখোরিত।
ওদের থেকে কিছুটা দূরে ঘাসের ওপর বসে বসে গভীর মনোযোগের সাথে আমাজনের ম্যাপ টা পরখ করে চলেছে মীর, ওর পাশে ওকে এক প্রকার পেচিয়ে ধরে ওকে কৌতুহলের সাথে দেখে চলেছে র্যাভেন নামক পুরুষ পাইথনটা, মীরের প্রতি তার প্রচন্ড আগ্রহ! মীরকে সে ছাড়ছেই না।
মীর প্রথমে বিরক্ত হলেও এখন ওর বিরক্তির পরিমাণ একটু কমেছে, ও কাজের ফাকে ফাঁকে মাঝে মাঝেই পাইথনটার মাথার ওপর ঘষে আদর করে দিচ্ছে। ওর সে আদরে বিগলিত হয়ে উঠছে পাইথনটা।
রুমাইশা মেয়েটা আনাবিয়ার সাথে নিচু স্বরে গল্প করে চলেছে। নিচু স্বরের একটা গুরুতর কারণ আছে, নিজেদের ব্যাক্তিগত পুরুষদের নিয়ে গল্প করে চলেছে ওরা, আর মাঝে মাঝে কিটকিটিয়ে হাসছে দুজনেই৷
গল্পের এক পর্যায়ে রুমাইশা সাফওয়ান কোকোদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“শিনু দেখো, দুটোর কি ভাব হয়েছে! যে বেডার মুখ দিয়ে কথা বের হতে চায়না তার আজ নাক মুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছে। জমজ ভাই দেখাচ্ছে ওদের দুটোকে৷”
আনাবিয়া ওদেরকে কিছুক্ষণ খেয়াল করে নিয়ে বলল,
“দুটো দেখতেও প্রায় একই রকম, শরীরেও একই রকম, উচ্চতাতেও একই রকম। তবে আমার কোকোটা প্রচুর উগ্র স্বভাবের; কিছু হলেই ও তেড়ে আসে যার তার দিকে। সাফওয়ান সেদিক থেকে অনেকটা শান্ত, গুরুগম্ভীর।”
রুমাইশা মুখ ফিরিয়ে দূরে বসে থাকা মীরের দিকে ইশারা করে বলল,
“মীর ভাইজান কেমন?”
“ও হচ্ছে ঠান্ডা মাথার খুনী। ও পুরো একটা বংশ নির্বংশ করে ফেলবে কিন্তু ওর মুখে তুমি বিন্দুমাত্র আফসোস, রাগ, জেদ কোনোকিছুর আভাস পাবেনা, তেমনি ওর পেছনে টর্নেডো বয়ে গেলেও ওর মুখের ওপর তুমি কখনোই কোনো উদ্বেগ দেখতে পাবেনা, ও দেখতে দেবেনা৷ ও থাকবে শান্ত, স্তব্ধ!”
“কোকো ভাইজান তোমার কি হয় শিনু?”
“ছেলে ও আমার, বড় ছেলে।”
“ছেলে বলতে?”
“ওকে আমি কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি, তাই সেই হিসেবে ছেলে।”
আনাবিয়ার কথা শুনে হেসে দিলো রুমাইশা, আনাবিয়ার অস্বাভাবিক বয়সের ব্যাপারে ওদের এখনো কোনো ধারণা নেই তাই কোকোকে কোলে পিঠে মানুষ করার কথায় ভীষণ মজা পেলো ও। হেসে বলে উঠলো,
“উনি কি তোমার চাচা হন? কিন্তু তোমাদের দুজনকে তো প্রায় সমবয়সী দেখায়।”
“ও সত্যিই আমার ছেলে, আমার থেকে ও বয়সে উনিশ বছরের ছোট।”
রুমাইশার হাসি মুখটা হঠাৎ করেই নিভে গেলো, চোখ জোড়ায় এসে ভর করলো বিস্ময়। অবাক চোখে তাকাতে নিয়েও পরে আবার আনাবিয়ার কথাটাকে হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলে উঠলো,
“এটা কোনো কথা? মজা করছো তুমি আমার সাথে!”
“ওহ আচ্ছা, আমার বয়স কত বলে তোমার মনে হয়?
“টুয়েন্টি/টুয়েন্টি ওয়ান?”
“আমার বয়স সিক্সটি স্যাভেন রানিং।”
রুমাইশা মেয়েটা হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকয়ে রইলো ওর দিকে, তারপর আবার জিজ্ঞেস করলো,
“তোমরা কই থেকে এসেছো যেন?”
“প্যাসিফিক ওশানের মাঝ খানের প্যালেনল্যান্ডো এর শিরো মিদোরি দ্বীপ থেকে।”
রুমাইশা বা সাফওয়ান এতক্ষণ কেউই ওদের এ কথা বিশ্বাস করেনি, ওদের জানামতে প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যিখানে এমন কোনো দ্বীপই নেই, তবে ওরা থাকবে কোথায়?
সাফওয়ান ওদেরকে এই জঙ্গলেরই কোনো অতিপ্রাকৃত সত্ত্বা হিসেবে ধারণা করে নিয়েছিলো, রুমাইশাও তাই। কিন্তু এবার রুমাইশা বিশ্বাস করলো যেন আনাবিয়ার কথা। আগ্রহ নিয়ে শুধালো,
“প্যালেন ল্যান্ডো মানে কি?”
“শিরো মিদোরিয় ভাষায় প্যালেন ল্যান্ডো অর্থ পঞ্চদ্বীপ। পঞ্চদ্বীপে সর্বমোট পাঁচখানা দ্বীপ, তন্মধ্যে শিরো মিদোরি হলো প্রধান দ্বীপ, দেমিয়ান সাম্রাজ্যের ঘাটি সেখানে।”
“তোমাদের ওখানে এখনো রাজতন্ত্র চালু আছে?”
“হ্যাঁ, সম্পুর্ন রাজতন্ত্র। ক্ষমতা সম্পুর্ন বাদশাহর হাতে, তোমাদের এখানের রাজতন্ত্রের মতো প্রধানমন্ত্রীর হাতে নয়।”
“তোমাদের ওখানের বাদশাহ কেমন, নাম কি তাঁর? তিনি দয়াবান নাকি অত্যাচারী?
আনাবিয়া হাত বাড়িয়ে মীরের দিকে ইশারা করে উত্তর দিলো,
“ওইযে পঞ্চদ্বীপের বাদশাহ তার রাজ সিংহাসন ছেড়ে বর্তমানে আমাজনের ঘাসের ওপর বসে আছেন।তিনি অন্যদের কাছে দয়াবান কিনা জানিনা তবে আমার ওপর তিনি খুব অত্যাচার চালান।”
রুমাইশা হতবাক চোখে একবার মীরের দিকে তাকিয়ে আবার আনাবিয়ার দিকে ফিরে অপলক চোখে তাকিয়ে রইলো, কি বলবে বুঝতে পারলোনা ও। আনাবিয়া ওকে এভাবে বিস্ময়ে হা হয়ে যেতে মিষ্টি হেসে বলে উঠলো,
“বিশ্বাস হচ্ছেনা? না হলে বিশ্বাস করতে হবেনা। এখানে আমরা তোমাদের মতোই সাধারণ, নাথিং স্প্যেইশাল।
তুমি বসো এখানে, আমি দেখি ওরা রান্না বান্নার কি করছে।”
বলে বসা থেকে উঠে সাফওয়ান দের দিকে এগোলো আনাবিয়া। রুমাইশা পেছন থেকে ওর দীর্ঘাবয়বের দিকে তাকিয়ে ওর একটু আগে বলা কথা গুলো ভাবতে লাগলো। যার এমন চুল, এমন চোখ, এমন উচ্চতা, এমন শরীর সে যদি বলে সে প্যাসিফিক ওশানের মধ্যিখানে পানির তলা থেকে উঠে এসেছে তবুও বিশ্বাস করা ফরজ।
সাফওয়ান আর কোকো মিলে রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। সাফওয়ান কিছুক্ষণ আগে কোকোর শিকার করে নিয়ে আসা একটা মোটাসোটা হরিণের মাংস টুকরো টুকরো করছিলো, কোকো বসে বসে পেয়াঁজ রসুন কেটে কেটে রাখছে একটা বাটির ভেতরে।
আনাবিয়া গিয়ে বসলো সাফওয়ানের পাশে। সাফওয়ানের মাংস কাটা দেখছে ও। সাফওয়ান ধীর গতিতে কাটছে, আনাবিয়ার সেটা পছন্দ হচ্ছেনা৷
সাফওয়ানের দিকে এক পলক তাকিয়ে ও হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে উঠলো,
“তুই সরে যা, আমার কাছে দে।”
পিচ্চি একটা মেয়ে ওকে কোনো সম্বোধন ছাড়াই তুই তোকারি কছে দেখে সাফওয়ান অবাক হলো, সেই সাথে হলো বিরক্ত। কি মেয়েরা বাবা! ঠিক বয়সে বিয়ে করলে হয়তো এই মেয়ের বয়সী একটা মেয়ে হয়ে যেতো ওর এতদিনে।
সাফওয়ান ভ্রু জোড়া কুচকে তাকালো একবার আনাবিয়ার দিকে। আনাবিয়া ওকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ঝাঝিয়ে বলে উঠলো,
“কি বলেছি আমি?”
সাফওয়ান ওর ধমকে তব্দা মেরে গেলো। পিটপিট করে তাকালো কিছুক্ষণ আনাবিয়ার দিকে, পাশ থেকে কোকো মুখটা সাফওয়ানের কানের কাছে সামান্য এগিয়ে নিয়ে এসে চাপা সুরে বলে উঠলো,
“ক্লিভারটা তোর গলার নলিতে চলে যাওয়ার আগে আম্মার হাতে দে ভাই।”
কোকোর কথা শুনে সাফওয়ান দোনমনা করে ক্লিভারটা তুলে দিলো আনাবিয়ার হাতে৷ তারপর সরে গিয়ে বসলো কোকোর পাশে, ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“এ এতো তেজি ক্যান?”
“উনি যে পরিবেশে বড় হয়েছেন সেই পরিবেশে তোকে ছেড়ে দিলে তুইও তেজি হইতি৷”
“তুই একে আম্মা ডাকিস কেন? আর এতটুকু মেয়েকে উনি উনি করার কি আছে?”
“আম্মা ডাকি কারণ উনি আমার আম্মা, তারওপর উনি আমার সিনিয়র উনিশ বছরের, তার ওপর উনি দেমিয়ান শেহজাদী, তার ওপর দেমিয়ান বাদশাহের একমাত্র বেগম। উনি না বললে ধড়ের ওপর মাথাখান থাকবে না।”
কোকোর কথা শুনে সাফওয়ান ওর দিকে কিছুক্ষণ ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ বলে উঠলো,
“পাগল নাকি তুই? নাকি জঙ্গলের ভেতর গিয়ে উলটো পালটা কোনো ফল খেয়ে নেশা হয়েছে তোর?”
“আমি ফুল্লি কার্নিভোরাস, ফলমূল আমি খাইনা।”
“কার্নিভোরাস আবার কি? কার্নিভোরাস তো পশুদের বলে। তুই কি পশু নাকি? তুই বলবি তুই মিটাটেরিয়ান।”
সাফওয়ানের কথা শেষ হতে না হতেই ওদের কানে এলো ক্লিভারের আঘাতের একের পর এক খচ খচ শব্দ। সাফওয়ান চমকে তাকালো সেদিকে, আর তাকাতেই ওর চোখে পড়লো আনাবিয়ার প্রচন্ড দ্রুত হাতে ধারালো ক্লিভার দিয়ে মাংশের টুকরো করার দৃশ্য, যেন চোখের পলকে সেগুলো এক এক করে হরিণের গা থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে।
সাফওয়ানকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে কোকো পাশ থেকে আবার ওর কানের কাছে মুখ বাড়িয়ে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,
“বলেছিলাম না? গলার নলিতে ছুরি ওঠার আগে……”
আনাবিয়া রান্না করছে এখন, সাফওয়ান কয়েকবার এগিয়ে এসেছিলো এটা ভেবে যে, মেয়েটা কি দিয়ে কি রান্না করবে শেষে খাওয়া যাবেনা। কিন্তু কোকো এগোতে দেয়নি ওকে, বলেছে ওই হাতের রান্না একবার খেলে সারাজীবনে আর ভুলবিনা।
সাফওয়ান কোকোর কথায় আর এগোয়নি, কিন্তু সাবধানতা অবলম্বন করতে কোকোর সাথে সাথে ও নিজেও বসে আছে আনাবিয়ার পাশে। আনাবিয়ার রান্নার প্রসেস দেখছে মনোযোগ দিয়ে।
মীর এদিকে নেই, সে জঙ্গলের ভেতর ঘুরতে গেছে র্যাভেন কে সাথে নিয়ে। পাইথনটা যখন ওকে এতই পছন্দ করেছে তখন এটার সাথেই ঘুরে বেড়ানো যাক, বউ তার এখন নতুন দায়িত্ব পেয়েছে সমাজসেবার।
যা পারে করুক, কিছু বলতে গেলে তখন আবার গাল ফুলিয়ে বসে থাকবে, এই রিস্ক নেওয়া যাবেনা।
লিন্ডা নামক পাইথনটা এখনো ওভাবেই পড়ে আছে। আনাবিয়া ওকে সুস্থ করে তুলতে চাইছিলো কিন্তু সাফওয়ান বলল এক র্যাভেনের জন্যেই মীর কুলোতে পারছেনা, এইবার আর একটাকে জাগালে সে এবার দাঁড়াতে দিবেনা কাউকে, ঘুমিয়ে আছে ঘুমিয়ে থাকুক।
আনাবিয়া রান্না করছে সাফওয়ান হা হয়ে দেখছে, কারণ আনাবিয়া জঙ্গলের ভেতর থেকে মশলা হিসেবে এমন এমন লতাপাতা কুড়িয়ে নিয়েছে যেটা সাফওয়ান জানতোই না যে মশলা হিসেবে ব্যাবহৃত হয়, যার কারণে সন্দেহটা ওর বেশি প্রগাড় হয়েছে। মাংস রান্নার বদলে ঘাসপাতা খাওয়াবে কিনা সেই ভয়ে এখানেই বসে আছে ও সেই থেকে। যদিও রান্না দেখে মনে হচ্ছে খুবই দক্ষ, তবুও সাবধানের মার নেই!
স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার কারণে বিগত ছয়-সাত মাস ধরে সে-ই রান্না করে আসছে, তাই হাত একটু হলেও পেকেছে, অভিজ্ঞতাও হয়েছে। কিন্তু এসব কি?
সাফওয়ান একেবারে ঠান্ডা হয়ে বসে আছে দেখে কোকো হাসলো নিজের মনে। ওর আম্মার সামনে গুরুগম্ভীর ভাব বজায় রাখবে, কঠিন হৃদয়ে থাকবে এমন কোনো পুরুষ হয়তো জন্মায়নি এখনো।
প্রথম পরিচয়ের থমথমে সাফওয়ানের মুখে এখন মিষ্টি হাসি ফুটে আছে, সে ছোট্ট ছেলেটির মতো মনোযোগ দিয়ে বসে বসে পা দুলিয়ে রান্না দেখছে, যেন মা রান্না করছে ওর আর ও বসে আছে কখন রান্না শেষ হবে আর ও পেট পুরে খাবে। কোকোর ভাবনার মাঝেই সাফওয়ান আনাবিয়ার উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো,
“আর একটু লবণ দাও, লবণ হয়নাই।”
আনাবিয়া কাজ বাদ দিয়ে তাকালো সাফওয়ানের দিকে, বলল,
“বেশি বুঝিস তুই?”
সাফওয়ান দমে গেলো। রুমাইশা ছাড়া অন্য কোনো মেয়ের সাথে এত কথা বলা ওর এই-ই প্রথম। কিন্তু এই মেয়েটার ভেতরে কিছু একটা ওছে যেটাকে উপেক্ষা করে থাকা এক প্রকার অসম্ভব। মুহুর্তেই মানুষকে আপন করে নেওয়ার এক অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে হয়তো সে।
প্রথম প্রথম আনাবিয়ার শাসনে সাফওয়ান রাগলেও এখন আর রাগ লাগছেনা, হাসি আসছে ওর৷ মীর নামক ওই ব্লাক শেডের ভাইটার জন্য ওর মায়া হয়, বেচারা এই বউকে কিভাবে সামলে রাখে আল্লাহ মালুম!
কোকো পাশ থেকে সাফওয়ানকে টান দিয়ে পেছন দিকে এগিয়ে নিয়ে এসে বলে উঠলো,
“ভাই তুই জ্ঞান দিতে যাইসনা, এদিকে আয়। আম্মা যে রান্না করবে তা তুই চোখ বন্ধ করে খেতে পারবি, রান্নার স্বাদ টেন টেন, এতটুকুও কম হবেনা। তাই তুই জ্ঞান দিস না।”
সাফওয়ান কোকোর কথা শুনে আনাবিয়ার দিক থেকে পিছিয়ে কোকোর কাছে গিয়ে বসলো। রুমাইশা সন্ধ্যা হতে না হতেই ঘুমিয়ে পড়েছে, আনাবিয়া বলে দিয়েছে রান্না হলে ডেকে দিবে ওকে, খেয়ে আবার ঘুমোবে।
সাফওয়ান কোকোর কাছে গিয়ে চাপা গলায় শুধালো,
“তুই ওকে আম্মা বলিস কেন বললি না তো!”
“বলেছিলাম, তুই বিশ্বাস করিসনি আমি কি করতাম? তুই কি জানোস আমিও তোর মতোই হাইব্রিড, কিন্তু অতিমাত্রায় হাইব্রিড। এমন হাইব্রিড যে তোকে তব্দা মেরে দিবে।”
কোকোর কথায় হাসলো সাফওয়ান, কোকোকে একেবারে স্বাভাবিক মানুষের মতোই লাগে, শুধু আকারেই বিশাল। দাঁত গুলো সব এক সাইজের কিন্তু সবগুলো দাঁতের অগ্রভাগ তীক্ষ্ণ, ধারালো।
সাফওয়ান ভেবেছিলো কোকো হয়তো এমনিতেই অমন করে নিয়েছে। এ ছাড়া কোকোর আর কোনো অস্বাভাবিকতা নেই।
ওকে হাসতে দেখে কোকো বলে উঠলো,
“মজা নিচ্ছিস? দেখিয়ে দেই তবে?”
সাফওয়ান কৌতুকপূর্ণ গলায় উৎসাহের সাথে বলে উঠলো,
“অবশ্যই অবশ্যই, শো শুরু করুন।”
কোকোর আঁতে ঘা লাগলো, সেন্টি খাওয়া চোখে ও সাফওয়ানের হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে রইলো, আর তারপর সাফওয়ানের থেকে কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে হুট করেই ও চলে এলো ওর ক্রোকোডাইল ফর্মে।
আর ও ক্রোকোডাইল ফর্মে যাওয়া মাত্রই ওর বিশালাকার দেহ আর ধারালো দাঁতের বহর দেখে ভড়কে গেলো সাফওয়ান, সেই সাথে বিস্ময়ে মুখ খানা হা হয়ে গেলো ওর।
এরকম বিশাল সাইজের কুমির ও আগে কখনো দেখেছে কিনা মনে পড়লো না ওর। মুহুর্তেই ওর বিশ্বাস হয়ে গেলো কোকোর সেই সকাল থেকে বলা সমস্ত আজগুবি কথা বার্তা৷
বিস্ময় নিয়ে ও তাকালো একবার আনাবিয়ার দিকে, এই মেয়েটা সত্যি সত্যিই তবে শেহজাদী, আর ওই ভীষণ উচ্চতার সুদৃঢ় শরীরের অধিকারী ব্যাক্তিটি একজন বাদশাহ! কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব!
কোকো সাফওয়ান কে আরও ভড়কে দেওয়ার জন্য এবার একটু একটু করে এগিয়ে এলো সাফওয়ানের দিকে, হিংস্র ভঙ্গিতে ফোস ফোস করতে করতে।
সাফওয়ান পিছিয়ে গেলো দু কদম, ও খুব ভালোভাবেই জানে সল্ট ওয়াটার ক্রোকোডাইলের দাঁতের শক্তি ঠিক কতটা! এদের দাঁতের একটা সামান্য চাপেই যেকারো শরীর থেকে যেকোনো অঙ্গ মুহুর্তেই আলাদা হয়ে যাবে, চাইলেও ওই করাতের মতো দেখতে ধারালো দাঁতের কামড় থেকে কোনো ভাবেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসা যাবেনা।
কোকো এগোতেই লাগলো, সাফওয়ান ঢোক গিলে আনাবিয়ার দিকে দ্বিধাভরে তাকালো একবার। আনাবিয়া রান্না করতে করতেই বলে উঠলো,
“কোকো দুষ্টামি করিসনা, আমার রান্না প্রায় হয়ে এসেছে। সার্ভ করতে হবে প্লেট রেডি কর।”
কোকো বেজার হলো যেন, সাফওয়ানকে একটু ভয় দেখাতেও দিলোনা ওর আম্মা। মুহুর্তেই আবার নিজের হিউম্যান ফর্মে ফিরে এসে সাফওয়ানের পেটে একটা গুতা মেরে ও চলে গেলো প্লেট বাটি রেডি করতে।
সাফওয়ান বিস্মিত চোখে ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে ইতস্তত করে এসে আবার বসলো আনাবিয়ার পাশে। নরম গলায় শুধালো,
“আপনারা তবে সত্যি সত্যিই প্যাসিফিক ওশানের ভেতর থেকে এসেছেন?”
“আপনি আপনি করতে হবে না, তুমি বলছিলি তুমিই বল। আর আমরা প্যাসিফিকের ভেতর থেকেই এসেছি। অন্নেক ভেতর থেকে।”
বলে মিষ্টি করে হাসলো আনাবিয়া, তারপর শুধালো,
“ক্ষিদে পেয়েছে তোর?”
সাফওয়ান ওপর নিচে মাথা নাড়লো। আনাবিয়া আলতো হেসে পাশে থাকা একটা বাটিতে কিছুটা খাবার বেড়ে দিয়ে সাথে একটা চামচ এগিয়ে দিয়ে বলল,
“খেতে থাক।”
সাফওয়ান চামচে করে সামান্য মুখে দিয়েই চমকে গেলো। অসম্ভব ভালো খেতে হয়েছে। কোকো তবে মিছে বলেনি, এ খাবারের স্বাদ সত্যিই ওর সারাজীবন মনে থাকবে।
সাফওয়ান এবার খাওয়া শুরু করলো গোগ্রাসে। আনাবিয়া ওর খাওয়া দেখে হেসে উঠে জিজ্ঞেস করলো,
“আস্তে খা হতচ্ছাড়া, গলায় বাধবে।
লবণ হয়েছে? ”
লজ্জা পেলো সাফওয়ান, তখন আগ বাড়িয়ে লবণের কথা ও কেন যে বলতে গেলো! যে মেয়ে রান্নায় এত পারদর্শী তাকে ও কি শেখাবে?
তবুও মিষ্টি হেসে ও ওপর নিচে মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিলো লবণ হয়েছে। আনাবিয়া শব্দ করে হেসে সাফওয়ানের চুলের ভেতর হাত দিয়ে একটা নাড়া দিয়ে চলে গেলো কোকো কি করছে দেখতে।
রুমাইশার দুইটা জমজ ছেলে বাচ্চা হয়েছে। বয়স ওদের আজ এক মাস৷ আনাবিয়ারা এখানে আসার এক সপ্তাহ পরেই হঠাৎ ডেলিভারি পেইন ওঠায় আনাবিয়া নিজেই সন্তান প্রসব করিয়েছে ওর৷
মীরকে জোরাজুরি করে সেই থেকে এখানেই থেকে গেছে ওরা কজন। রুমাইশার এই অবস্থা, কোনো হেল্পিং হ্যান্ড নেই, সাফওয়ান ছেলে মানুষ, তার ওপর দুইটা বাচ্চা; কতদিকে সামাল দিবে ও!
সাফওয়ানের কিছু বন্ধু আছে যদিও এখানে, কিন্তু তারা সাফওয়ান দের অবস্থান থেকে অনেক অনেক দূরে থাকে। একা একা দুইটা বাচ্চা সামলানো সাফওয়ানের পক্ষে সম্ভব নয় কখনো।
মীরকে কোনো রকমে ঠেকিয়ে রেখেছে আনাবিয়া, কিন্তু এখন আর সম্ভব বলে মনে হচ্ছেনা। সে ওপরে ওপরে কিছু না বোঝালেও ভেতরে ভেতরে ফুলে আছে। আর এই ফুলে থাকার অন্যতম কারণ হলো এই একটা মাস আনাবিয়া রাতের বেলা মীরকে সঙ্গ দেয়নি একটুও।
মীর অন্যান্য সময় জোরজবরদস্তি করলেও এবার ওকে এত ব্যাস্ত থাকতে দেখে কিছুই বলেনি, চুপচাপ থেকেছে।
বর্তমানে সে সাফওয়ান আর কোকো গেছে জঙ্গলের গভীরে কোনো একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে। কি কাজ সেটা জানেনা আনাবিয়া। কুটিরে ওরা দুজন শুধু, দুজন বললে ভুল হবে সর্বমোট ছয় জন। আনাবিয়া, রুমাইশা, র্যাভেন, লিন্ডা আর সাফওয়ানের দুই ছেলে, সাদমান আর শাহমীর৷
সাদমান শাহমীর এখন ঘুমোচ্ছে। আনাবিয়া ব্যাগ গোছাচ্ছে, কালকেই আমাজন ছেড়ে ওরা বেরিয়ে যাবে৷ আমাজনে পৌছানোর আগে মীর ওকে সারা বিশ্বের সমস্ত উল্লেখযোগ্য স্থান গুলো ঘুরিয়ে দেখিয়েছে, আমাজনই ছিলো ওদের লাস্ট ডেস্টিনেশন। এখন এটাও ঘোরা শেষ।
পুরোটা এক্সপ্লোর করতে পারেনি ঠিকই, কিন্তু যেটুকু করেছে তাতেই হবে। এক্সপ্লোর করতে করতে এই দুইটা মানুষের সাথে এত ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠলো ওদের, এটাই বা কম কি?
রুমাইশা ব্যাগ গোছাতে সাহায্য করছে আনাবিয়াকে, মুখটা মন খারাপে ছেয়ে আছে তার। আনাবিয়া ওর হাত থেকে একটা একটা করে পাট করা পোশাক নিয়ে স্যুটকেসে রাখছে, নিজের গুলো গুছিয়ে মীরের গুলোও গোছগাছ করতে হবে।
রুমাইশাকে এভাবে মন খারাপ করে থাকতে দেখে আনাবিয়া ওর থুতনি ধরে নাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“মন খারাপ কোরোনা রিমু, কখনো সম্ভব হলে আমরা আবার আসবো তোমাদের সাথে দেখা করতে। এই এক মাসে তোমার বাবু গুলোকে আমি এত ভালোবেসে ফেলেছি যে ওদেরকে ছেড়ে আমারও যেতে ইচ্ছে করছেনা, কিন্তু কি করবো বলো? ফিরতে তো একসময় হবেই!”
রুমাইশা এবার হুট করেই জড়িয়ে ধরলো আনাবিয়াকে, শক্ত করে ওকে জড়িতে ধরে কান্না জড়ানো গলায় বলে উঠলো,
“তোমাকে আমি সারাজীবনেও ভুলবোনা শিনোপা! তুমি আমাকে আর আমার সাফওয়ান কে অথৈ সাগরে পড়া থেকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছো, তুমি না এলে আমার সাফওয়ান আমাকে আর বাচ্চাদের নিয়ে কি করতো ভাবলে আমার কান্না আসে! মুখ ফুটে তো বলতোও না যে ওর কষ্ট হয়ে যাচ্ছে, কি দিয়ে কি করবে বুঝতেছেনা!”
আনাবিয়া মিষ্টি করে হেসে ওর বুকে পড়ে রুমাইশার মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“সৃষ্টিকর্তা এক এক ওছিলায় এক এক জনকে নির্দিষ্ট স্থানে পাঠিয়ে দেয় রিমু, এখানে আমার কোনো ক্রেডিট নেই। এখন কান্না থামাও, বাচ্চারা জেগে যাবে। দ্রুত হাতে হাতে এগুলো গুছিয়ে ফেলি আসো।”
শেষোক্ত কথাটা রুমাইশা কে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলল আনাবিয়া, তারপর আবার লেগে গেলো স্যুটকেস গোছাতে।
কিছুক্ষণ পর ছেলেগুলো সব ফিরে এলো। লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে, খেয়েই ওরা বেরিয়ে যাবে এতদিন ধরে প্যাসিফিকের কোনো এক পোর্টে অনাদরে পড়ে থাকা নিজেদের ইয়টের নিকট।
মীর আনাবিয়া দেরকে পোর্টে ছাড়তে এসেছে সাফওয়ান রিমু। ওদের বাচ্চা দুটো আছে আনাবিয়ার কোলে। হাত পা ছোড়াছুড়ি করছে ওরা দুটো৷
সমুদ্রবন্দরের বুকে এক অনন্ত ব্যস্ততা। নোঙর ফেলা বিশাল বিশাল কার্গো জাহাজ, ছোট-বড় টাগবোটের দৌড়ঝাঁপ, ক্রেনের গম্ভীর গর্জন, আর নাবিকদের কর্মচাঞ্চল্য সব কিছু মিলে মিশে একাকার হয়ে আছে সেখানে।
জেটির ধারে সারি সারি কন্টেইনার সাজানো। সমুদ্রের বুক ছুঁয়ে আসা নোনতা বাতাসে ভেসে আসছে তেল, লোহা আর কাঠের মিশ্রিত গন্ধ। ঢেউয়ের ছন্দে দোল খাচ্ছে জাহাজ গুলো।
এসব দেখতে দেখতে কোকো আর মীর এগোচ্ছে আগে আগে। ওদের ইয়টটা বন্দর থেকে অনেকটা দূরে রাখা। কোকো ওর ক্রোকোডাইল ফর্মে গিয়ে ইয়টটাকে রেখে এসেছিলো দূরে, নোঙর টেনে টেনে। এখন আবার গিয়ে ওকে সেটা তীরে ভেড়াতে হবে৷
কোকো শার্ট প্যান্ট ছেড়ে লাফিয়ে পড়লো সমুদ্রের নীল পানির ভেতরে, আর সমুদ্রের কিছুটে ভেতরে গিয়েই নিজের ক্রোকোডাইল ফর্মে এসে এগিয়ে গেলো ইয়টটার দিকে। ইয়টটাকে জনসাধারণের দৃষ্টি থেকে ইনভিজিবল করে রেখেছিলো মীর। কতদিন এখানে থাকবে জানা নেই, তাই কোনো ক্ষত যেন না হয়ে যায় এর ভেতরে তার জন্য এই ব্যাবস্থা।
কিছুক্ষণ পরেই একটা বিশালার বিলাশবহুল ইয়ট এসে পৌছালো পোর্টের কাছাকাছি। সাফওয়ান রিমু দেখলো সেটা, তাকালো একবার একে অপরের দিকে।
আনাবিয়ার কোলে থাকা বাচ্চা দুটো এই নতুন পরিবেশ, নতুন সবকিছু দেখে খুব লাফালাফি করছে ওর কোলের ভেতর। সাফওয়ান হাত বাড়িয়ে একটাকে নিয়ে নিলো ওর কোলে, রুমাইশা নিয়ে নিলো আর একটাকে।
ইয়টটা কাছে এসে গেলে কোকো আবার বেরিয়ে এলো পানির ভেতর থেকে, তারপর মীর আনাবিয়ার জিনিসপত্র গুলো তুলে দিলো ইয়টের ভেতরে।
মীর দাঁড়িয়ে ছিলো আনাবিয়াদের থেকে কিছুটা সামনে। জিনিসপত্র তোলা হয়ে গেলে সাফওয়ানদের দিকে এগিয়ে এলো ও৷ সাফওয়ানের সামনে দাঁড়িয়ে ও বলে উঠলো,
“আমাদের তবে এবার বিদায় নিতে হচ্ছে সাফওয়ান। তুমি আর তোমার স্ত্রী দুজনেই ভালো থেকো। আর হ্যাঁ, যেকোনো প্রয়োজনে আমার সাথে যোগাযোগ করতে ভুলবেনা। যোগাযোগ করার যে প্রসেস বল্ব দিয়েছি সেটা ফলো করলেই আমাকে নয়তো তোমার শিনোপাকে পেয়ে যাবে, ওকে?”
সাফওয়ান কৃতজ্ঞচিত্তে হেসে মাথা নাড়ালো ওপর নিচে। মীর সাফওয়ান আর রুমাইশার কোলে থাকা বাচ্চা দুটোর গাল আলতো করে নাড়িয়ে দিয়ে আনাবিয়াকে আসতে বলে এগোলো ইয়টের দিকে।
আনাবিয়া সাফওয়ান রিমুর দিকে ফিরে মিষ্টি করে হাসলো আবারও৷ সাফওয়ানের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
“সুযোগ হলে আবারও দেখা হবে ব্রো, তোদের বাচ্চাদের বলে দিস তাদের একটা আদুরে ফুপ্পি আছে। সাত সমুদ্র তেরো নদীর পরে তার বাড়ি, তাকে যেন ভুলে না যায়।”
“তোমাকে কখনো ভোলা সম্ভব নয় শিনোপা। আমি চিরজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো তোমার কাছে। তুমি আমাকে একটা মমতাময়ী বোন দিয়েছো, আমার বাচ্চাদেরকে ওকটা আদুরে ফুপ্পি দিয়েছো, আমার স্ত্রীকে একটা যত্নশীল ননদ দিয়েছো। অনেক কিছুই করে ফেলেছো তুমি এই কয়েকদিনে!”
জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলল সাফওয়ান, প্রচন্ড খারাপ লাগছে ওর। এই কয়েকদিনে ওর কুটিরটা ঝলমল করতো এই মেয়ের রূপের বাহারে, কথার ফুলঝুরিতে মেতে থাকতো ওরা সকলে, হাসি আড্ডায় মাতিয়ে রাখতো ওদের সকলকে।
কুটিরটা এখন আবার আগের মতো নিঃস্তব্ধতায় ছেয়ে যাবে, ওর বাচ্চাদেরকে রোজ রাতে কোলে নিয়ে হেটে হেটে ঘুম পাড়ানোর জন্য এখন আর এই ঝলমলে মেয়েটাকে পাওয়া যাবে না!
আনাবিয়া সাফওয়ানের এমন কথায় হাসলো, ওর মাথার ভেতরে নিজের বা হাতের আঙুল গুলো চালিয়ে দিয়ে বলে উঠলো,
“তোদের কুটিরে ঘুরে গেলাম, এবার কখনো সুযোগ হলে আমাদের কুটিরে নিয়ে যাবো তোদের। চিন্তা করিস না।”
রুমাইশার দিকে ফিরে আনাবিয়া নিজের হাতের অনামিকা থেকে একটা ছোট্ট নকশাদার ডায়মন্ডের আংটি খুলে পরিয়ে দিলো রুমাইশার আঙুলে, রুমাইশা বাধা দিতে চাইলেও শুনলোনা আনাবিয়া। বলল,
“এটা তোকে আমাকে মনে করিয়ে দেবে ক্ষণে ক্ষণে। বাচ্চাদের ভালো ভাবে খেয়াল রাখবি। তোর বাচ্চারা কিন্তু খুব স্পেশাল, বাকিদের থেকে অনেক আলাদা। তাই ওদেরকে বিশেষ ভাবে বড় করবি, নিজেদের বেস্টটা দিবি ওদেরকে, ঠিক আছে?”
রুমাইশা কৃতজ্ঞতার সাথে তড়িতে মাথা নাড়ালো ওপর নিচে। চোখের কোণে পানির রেশ দেখা গেলো ওর। আনাবিয়া মিষ্টি হেসে সেটুকু মুছে দিয়ে বাচ্চাদুটোর গালে চুমু এঁকে দিয়ে এগোলো ইয়টের দিকে।
কোকো নেমে এসে সাফওয়ানকে শেষ বিদায় জানিয়ে একবার বুকে জড়িয়ে নিয়ে অতঃপর এগোলো আবার ইয়টের দিকে।
কিয়ৎক্ষণ বাদেই ছেড়ে দিলো ও ইয়ট। আনাবিয়া ইয়টের ওপর নিজেদের কেবিনের পাশে দাঁড়িয়ে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানালো আবারও, সাফওয়ান আর রুমাইশা দূর থেকে বিদায় জানালো ওকে।
মুহুর্তেই ইয়টটা চোখের সামনে থেকে এক প্রকার উধাও হয়ে গেলো যেন। পেছনে ফেলে গেলো এক দম্পতির ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস। শিরো মিদোরির ভেতর দিয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে বয়ে চলা ইনভিজিবল রোড গুলোর ওপর দিয়ে সাঁই সাঁই করে তীব্র বেগে ছুটে চলেছে দশ খানা বাইক।
আঁকাবাঁকা রাস্তার সাথে তাল মিলিয়ে তীক্ষ্ণ ঘূর্ণন তৈরি করে তারা এগোচ্ছে বাতাস কেটে।
বাইকের ইঞ্জিনের তীব্র শব্দে কান ঝালাপালা হওয়ার উপক্রম! প্রতিযোগিতায় নেমে প্রতিটা বাইক অন্যটাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়ার অভিপ্রায়ে ছুটে চলেছে ঝড়ের গতিতে।
আনাবিয়া মীরের থেকে বাইক রাইডিং শিখেছে মাস ছয় হচ্ছে, এর ভেতরেই তার পাখনা গজিয়েছে। বাচ্চা দের সাথে রোজ রোজ নতুন নতুন রোডে রেসে নামে সে, আর আজ ওদের সাথে মীরও যোগ দিয়েছে।
মীর যোগ দেওয়ার পেছনে আছে একটা সামান্য গুরুতর কারণ। আনাবিয়া গত রাতে বায়না ধরেছিলো সে বাচ্চাদের নিয়ে আজ রাতের বেলা রেড জোনের ভেতর ক্যাম্প ফায়ার কুকিং করবে, মীরকেও থাকতে হবে সেখানে।
কিন্তু মীরের জরুরি কাজ আছে তাই সে উপস্থিত হতে পারবেনা বলে দিয়েছে। কিন্তু নাছোড়বান্দা আনাবিয়া বলে বসেছে বাইক রেসে ওকে হারাতে পারলে মীর ছাড়া পাবে, কিন্তু যদি আনাবিয়া উইনার হয় তবে মীরকেও ওদের সাথে এই ফরেস্ট পিকনিকে এ যোগ দিতে হবে, কোনো ছাড় নেই।
বর্তমানে ইনভিজিবল রোডের ওপর দিয়ে ছুটে চলা দশ বাইকের সর্বপ্রথমেই আনাবিয়া, বাইকের গতি সর্বোচ্চতে তুলে মীরকে পেছনে ফেলে সে এগিয়ে যাচ্ছে ঝড়ের গতিতে,
ওর ঠিক পেছনেই মীর। আনাবিয়ার বাইকের গতির ওপর গতি উঠাচ্ছে না ও, বউটা ওকে ছাড়া পিকনিক করতে চাইছেনা যখন তখন আজকের দিন টা না হয় জরুরি কাজ গুলো বন্ধই থাকুক!
আনাবিয়া সজোরে এগিয়ে চলেছে, ওর কোনো দিকে তাকানোর সময় নেই। কিন্তু সেই মুহুর্তেই মীরের খেয়াল হলো সামনেই রাস্তার কোনো এক স্থানে স্পিড ব্রেকার দেওয়া।
এই রোডটিতে আনাবিয়া প্রথমবার এলেও মীর এসেছে অনেকবার, এখানের রাস্তার প্রতিটা বাক ওর চেনা। এখনি যদি মেয়েটা বাইকের গতি না কমায় তবে বড়সড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটবে নিশ্চিত!
মীর দ্রুত নিজের পেছনে থাকা বাচ্চাদেরকে হাতের ইশারায় গতি কমাতে বলে নিজেও বাইকের গতি কমিয়ে দিলো কিঞ্চিৎ, তারপর আনাবিয়ার উদ্দ্যেশ্যে পেছন থেকে চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো,
“শিনু, বাইকের স্পিড কমাও!”
কিন্তু আনাবিয়া শুনতে পেলোনা সেটা, শুনলেও গা করলোনা! সবই ওদের সাথে পিকনিকে জয়েন না হওয়ার ধান্দা। উলটো বাইকের আরও গতি বাড়িয়ে দিলো আনাবিয়া।
মীর দেখলো ভারী বিপদ! পুনরায় বাইকের গতি বাড়িয়ে ও ছুটলো আনাবিয়ার পেছনে, বাচ্চারাও কি করবে বুঝতে না পেরে এগোলো মীরের পেছন পেছন।
মীরকে আবার জোর গতিতে এগোতে দেখে আনাবিয়া গতি বাড়ালো আরও, আর সেই মুহুর্তেই ও পৌঁছে গেলো স্পিড ব্রেকারের ঠিক সম্মুখে।
মীরের দম আটকে আসলো যেন!
এই মেয়ে এখানে এই গতিতে আছড়ে পড়লে ওর সেইফটি পোশাক কোনো কাজে দিবেনা, মুহুর্তেই রাস্তায় পড়ে হাত-পা ভাঙবে নইলে রাস্তার পাশের মোটা মোটা গাছের সাথে গিয়ে বাড়ি খাবে।
মীর আর নিজের তোয়াক্কা করলোনা, চলন্ত বাইক থেকে একপ্রকার লাফিয়ে নেমে ঝড়ের গতিতে ও এগোলো আনাবিয়ার দিকে।
আর আনাবিয়া স্পিড ব্রেকারের সাথে ধাক্কা খাওয়ার ঠিক আগ মুহুর্তে বজ্রগতিতে গিয়ে ছো মেরে ওকে বাইকের ওপর থেকে তুলে নিয়ে শূণ্যে উড়াল দিলো মীর!
বাইকটা স্পিড ব্রেকারের সাথে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে উড়ে গিয়ে পড়লো বিশ পঁচিশ হাত দুরে, তারপর কয়েকবার পাল্টি খেয়ে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে পড়ে রইলো রাস্তার এক কোণায়।
মীর শূণ্যে ভেসে থাকা অবস্থাতেই আনাবিয়াকে বুকের সাথে চেপে রেখে বাইকটার দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে যাওয়ার দৃশ্য টা দেখলো চুপচাপ।
আনাবিয়া মীরের বুকের ভেতর মুখ গুজে পড়ে ছিলো, কিয়ৎক্ষণ বাদে বুকের ওপর থেকে মুখ তুলে মীরের দিকে ইনোসেন্ট ফেস নিয়ে তাকালো ও৷ মীর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে চোখে চোখ রেখে সামান্য গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো,
“তোমাকে গতি কমাতে বলার পরও থামোনি কেন? ওই বাইকের সাথে তুমি থাকলে এখন কি হতো তুমি বুঝতে পারছো?”
আনাবিয়া মীরের পিঠখানা দুহাতে জড়িয়ে নিয়ে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে নিঃশব্দে হেসে উত্তর করলো,
“তুমি ছিলে তো পেছনে!”
“হুম, সারাজীবন পেছনে আমি থাকবোনা শিনু। তখন তোমাকে নিজের ভালো নিজেই বুঝতে হবে।”
বলে মীর ওকে নিয়ে নেমে এলো মাটিতে। ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গিয়ে বাচ্চারা সব বাইক থামিয়ে দাঁড়িয়ে গেছিলো রাস্তার দুপাশ জুড়ে। সবার মুখেই আতঙ্ক। আজ যদি হিজ ম্যাজেস্টি এইখানে ওদের সাথে না থাকতেন আর ওরা যদি এদিকে রেস করতে আসতো তবে আজ ওদের সবার কপালে দুঃখ ছিলো!
মীর নেমে আলতো করে মাটিতে পা রাখতেই হঠাৎই মাথাটা ঘুরে উঠলো আনাবিয়ার, আচমকাই শরীরের সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেললো ও। পা জোড়া অকস্মাৎ জোর হারিয়ে নেতিয়ে পড়তে লাগলো যেন। দুহাতে ওকে নিজের সাথে আকড়ে ধরা মীরের পিঠের ওপর থেকে নরম হাতজোড়া নিস্তেজ হয়ে নেমে এলো নিচে, চোখ জোড়া ঘুরিয়ে বন্ধ হয়ে যেতে নিলো হঠাৎই!
মীর সেটা বুঝতে পারা মাত্রই চমকে উঠে জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে থাকা আনাবিয়াকে দ্রুত দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিজের সাথে লাগিয়ে নিলো।
আনাবিয়া মুহুর্তেই নিজেকে পুনরায় ধাতস্থ করে নিয়ে চোখ জোড়া মেলে তাকালো মীরের দিকে।
মীর শঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওরই দিকে, উৎকন্ঠিত স্বরে ও আনাবিয়াকে শুধালো,
“শিনজো, ঠিক আছো তুমি?”
আনাবিয়া এক ঝলক মিষ্টি হাসি ওর দিকে ছুড়ে দিয়ে বুঝালো ও ঠিক আছে। হঠাৎ করেই মাথাটা কেমন জানি ঘুরে উঠলো, এখন ও পুরোপুরি ঠিক আছে।
মীরের চেহারার তবুও ভাবান্তর হলোনা কোনো, আনাবিয়াকে এর আগে কখনো এমন হতে দেখেনি ও, তবে আজ হটাৎ কি হলো? ফোস করে একটা শ্বাস ফেলে আনাবিয়াকে আরও একটু নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। আনাবিয়ার শরীর খারাপ লাগছে দেখে বাচ্চাদের উদ্দ্যেশ্য করে বললো,
“তোরা সবাই প্রাসাদে ফিরে যা এখনি, আজ আর কোনোদিকে যাবিনা। দুপুরবেলা এক্সাক্ট দুইটায় সকলে রেডি হয়ে আমার কামরায় চলে আসবি৷ গট ইট?”
মীরের আদেশ পাওয়া মাত্রই বাচ্চারা সকলে একযোগে ‘ইয়েস ইয়োর ম্যাজেস্টি’ বলে তখনি বাইক ঘুরিয়ে ফিরে গেলো প্রাসাদের দিকে।
মীর আনাবিয়াকে নিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে এগোলো প্রাসাদের দিকে। হঠাৎ ওর এমন অসুস্থতা ভাবিয়ে তুলছে মীরকে, প্রাসাদে গিয়েই একবার হেকিমকে দেখিয়ে নিতে হবে৷
ভাঙাচোরা বাইক দুখানা সেখানেই পড়ে রইলো। রাত হলেই রেড জোনের বিশেষ বাসিন্দারা ইনভিজিবল রোড গুলো ক্লিন করার সময়ে এগুলো নিয়ে যথাস্থানে রেখে আসবে৷
দুইটা বাজতে চলেছে।
প্রাসাদের রয়্যাল ফ্লোরের ‘দ্যা রয়্যাল জ্যু’ নামক কামরায় রেডি হচ্ছে বাচ্চারা সবাই। ফর্মাল ড্রেস আপ করছে ওরা সকলে, হিজ ম্যাজেস্টি সেরকমই আদেশ দিয়েছেন।
আজ ওদের সাথে কি হতে চলেছে জানেনা ওরা, তবে সকাল বেলা শেহজাদী ওদের বলছিলেন ওদের নাকি এখন দায়িত্ব পালনের সময় এসেছে।
তবে কি হিজ ম্যাজেস্টি ওদেরকে চাকরি দিচ্ছেন?
কোকো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসবই ভাবছিলো, তখন ফ্যালকন এলো ওর কাছে। নিষ্পাপ মুখ করে ভ্রু তুলে বলে উঠলো,
“কোকো ভাইয়া, টাই বেধে দাও!”
কোকো ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে ফ্যালকনের টাই টা দুহাতে ধরে ওকে হ্যাচকা টানে নিজের দিকে টেনে নিয়ে টাই বেধে দিতে দিতে কটমট করে বলে উঠলো,
“দামড়া হয়েছিস, এখনো টাই বাধতে শিখিসনি হাঁসের বাচ্চা!”
ফ্যালকন প্রতিউত্তরে কিছুই বললনা, নিজের এই ডাকনামটা ও মেনে নিয়েছে। এখন শেহজাদী ছাড়া সবাই ওকে হাঁসের বাচ্চা বলেই ডাকে, এমনকি হিজ ম্যাজেস্টিও!
এখন হতাশ হয়ে আর লাভ নেই। হাঁসের বাচ্চা বললেও টাই টা যে কোকো ভাই বেধে দিচ্ছে এটাই অনেক!
টাই বাঁধা শেষ করে কোকো ওর মাথায় একটা চাটি মেরে বলে উঠলো,
“চুলগুলো ভালো করে সেট কর গাধা। হাঁস আছিস ভালো আছিস, এখন আবার বুনো হাঁস হতে যাস না।”
ফ্যালকন শান্ত ছেলের মতো গিয়ে চুলটা ভালো করে আঁচড়ে নিলো। শেহজাদী জেগে থাকলে এসব ওর করা লাগতো না, শেহজাদী নিজেই সবাইকে সাজিয়ে গুছিয়ে দিতেন।
কিন্তু শেহজাদী ফিরে এসেই ঘুমিয়ে পড়েছেন।
হিজ ম্যাজেস্টি হেকিমকে দেখাতে চাইছিলেন কিন্তু শেহজাদী ঘুমিয়ে পড়ায় রাতে দেখাবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
কিন্তু রাতে আবার ওদের আউটডোর কুকিং! শেহজাদীকে এই অসুস্থ অবস্থায় এসব করতে মানা করলেও তিনি শুনবেননা, পিকনিক করবেনই।
এমন জেদির জেদি! যা বলবেন তা করেই ছাড়বেন। মাঝে পড়ে ওরা কজন হিজ ম্যাজেস্টির চোখ রাঙানি দেখবে। বউকে তো তিনি কিছু বলতে পারেননা, রাগ গুলো সব ঝাড়েন এই অসহায়, অবলা জানোয়ার গুলোর ওপর।
ফ্যালকন চুলগুলো সেট করতে করতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো একটা।
রেডি হয়ে সকলে মিলে দুইটা বাজার ঠিক আগ মুহুর্তে গিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে গেলো মীরের কামরার সামনে। প্রৌঢ় আরমান আগে থেকেই দাঁড়িয়ে ছিলো সেখানে।
সবগুলোর ড্রেস আপ চেক করে ঠিকঠাক করে দিলো ও, আর এরপর দুইটা বাজতেই আরমান খুলে দিলো মীরের কামরার দরজা, বাচ্চারা সটান দাঁড়িয়ে গিয়ে সারিবদ্ধভাবে হেটে হেটে ঢুকলো ভেতরে।
মীর গায়ের ওপর একটা ছাই রঙা রোব জড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো ওর কামরার বইয়ের ছোট খাটো আলমিরার নিকট, হাতে ওর একটা খোলা বই, যেটা বাচ্চারা আসতেই বন্ধ করে আবার আলমিরার তাকে রেখে দিলো ও।
বাচ্চারা সকলে মীরের রাজকীয় টেবিলের সামনে এসে সারিবদ্ধভাবে দাড়িয়ে গেলো। ফ্যালকন আড়চোখে দেখতে লেগে গেলো মীরের কামরাটা।
সাদা আর সোনা রঙে সজ্জিত এই আভিজাত্যপূর্ণ কামরাটার ভেতরে হাতে গোণা কয়েকবার এসেছে ও, আর প্রত্যেকবারই চরম কৌতুহল নিয়ে দেখেছে এই কামরার প্রতিটা কোণা।
তবুও ওর কৌতুহল মেটেনি, যতবার আসে ততবারই ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক দেখতে লেগে যায় ও৷
কোকো পাশেই দাঁড়ানো ছিলো, ওকে এমন নড়াচড়া করতে দেখে চাটি মেরে থামিয়ে দিয়ে সোজা করে দাঁড়িয়ে দিলো।
মীর এগিয়ে এলো টেবিলের নিকট, তারপর আয়েসি ভঙ্গিতে বসলো চেয়ারে। টেবিলের ওপর রাখা স্ফটিকের পেপার ওয়েটটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে ছেলেগুলোর দিকে এক নজর দেখে নিলো ও৷
সকলের মাথা নিচের দিকে, স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেঝের দিকে তাকিয়ে; মীরের আদেশের অপেক্ষায়।
মীর কিয়ৎক্ষণ ওদের দিকে তাকিয়ে থেকে এবার গমগমে গলায় বলে উঠলো,
“তোমাদের সবার যথেষ্ট বয়স হয়েছে, ম্যাচিউর হয়েছো। এখন কাজে হাত লাগাতে হবে, দায়িত্ব নিতে হবে। আজ তোমাদের সকলকে নির্দিষ্ট কাজের সাথে যুক্ত করে দিবো, এবং কাল থেকেই ময়দানে নেমে যেতে হবে। বসে বসে খাওয়ার সময় আর নেই।
ড্যু আ’ মেইক মাইসেল্ফ ক্লিয়ার?”
বাচ্চারা স্ট্যাচুর মতো শক্ত হতে দাঁড়িয়ে সমস্বরে বলে উঠলো,
“ইয়েস, ইয়োর ম্যাজেস্টি।”
“গ্যুড!”
বলে নামীর কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে সোজা হয়ে বসলো, অতঃপর হটাৎ করেই গুরুগম্ভীর, কর্তৃত্বপূর্ণ স্বরে বলে উঠলো,
“কোকো এবং ফ্যালকন, আজ থেকে তোমরা দুজন শিরো মিদোরির গ্রান্ড প্রটেক্টর।
কোকো, তুমি হবে আমার রাজ্যের সীমান্তরক্ষীদের প্রধান, হাই মার্শাল অব দ্যা ফ্রন্টিয়ার। রাজ্যের সীমান্তের প্রতিটি শ্বাস, প্রতিটি ছায়া, প্রতিটি অস্ত্র তোমার নজরে থাকবে। আমার অনুমতি ছাড়া আমার সাম্রাজ্যের কোথাও এক বিন্দু রক্ত ঝরবে না। যদি ঝরে— তবে তার হিসেব তোমাকেই দিতে হবে।”
একটু থেমে মীর আবার বলে উঠলো,
“ফ্যালকন! তোমাকে শিনজো টেকনোলজিতে মাহির করেছে, এখন সেটার সদ্ব্যবহার করার সময় এসেছে। তুমি কোকোর অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করবে, এই মুহূর্ত থেকে তুমি সাম্রাজ্যের ম্যাস্টার অব আর্কেন সিস্টেম। রাজ্যের প্রতিটি সংকেত, প্রতিটি কণ্ঠস্বর তোমার নজরে থাকবে। কেউ যেন তোমার থেকে লুকাতে না পারে, প্লাস পালাতে না পারে।
আমি যা দেখতে চাই, তোমরা আমাকে তা দেখাবে। যা জানতে চাই, তোমরা তা জানাবে। তোমরা দুজনে মিলে আমার সাম্রাজ্যকে সম্পুর্ন নখদর্পনে রাখবে। একটা পিঁপড়াও আমার অনুমতি ছাড়া এই দ্বীপের ভেতরে প্রবেশ করবেনা, কেউ কোনো অরাজকতা সৃষ্টি করতে পারবেনা। বোঝা গেছে?”
কোকো ফ্যালকন সমস্বরে বলে উঠলো,
“ইয়েস ইয়োর ম্যাজেস্টি।”
মীর এবার হাইনার দিকে তাকিয়ে আগের মতো করেই ডেকে উঠলো,
“হাইনা!”
হাইনা স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে একটা শুকনো ঢোক গিলে উত্তর দিলো,
“ইয়েস ইয়োর ম্যাজেস্টি।”
“অ্যানিম্যাল টাউন আজ থেকে তোমার অধীনে। এখানে কী কী হবে, কে থাকবে, কে যাবে— এ সমস্ত সিদ্ধান্ত তোমার। এই এরিয়াটা ছোট্ট, কিন্তু এর গুরুত্ব বিশাল।
স্যো ফ্রম ন্যাও অন, এটাকে যথাযথ ভাবে পরিচালনা করা তোমার দায়িত্ব। এই দায়িত্বে সামান্যতম অবহেলাও আমি বরদাস্ত করবোনা৷ এখানে এক বিন্দু বিশৃঙ্খলা হলে তার জবাবদিহি তোমাকেই করতে হবে। গট দ্যাট?”
“ইয়েস ইয়োর ম্যাজেস্টি।”
বলে আবারও ঢোক গিললো হাইনা। এর আগে ওরা কেউ কখনো প্রফেশনালি কোনো কাজ করেনি। মীর দায়িত্ব দিয়েছে তবে সামান্য সময়ের জন্য। সেটাকে ওরা যথাযথ ভাবে পালনও করেছে। কিন্তু এখন তো ওদেরকে ধরে ধরে দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া হচ্ছে স্থায়ী ভাবে, এখন ওরা এই গুরুদায়িত্ব কিভাবে সামাল দিবে?
মীর এবার লিওর দিকে ফিরে বলে উঠলো,
“লিও, তুমি এখন থেকে আমার ব্যাক্তিগত রক্ষী। আরমানের বয়স হয়েছে ওকে এখন দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেওয়ার সময় এসেছে।
আজ থেকে তুমি হবে আমার ছায়া। আমি যেখানে যাবো তোমাকে সেখানে যেতে হবে, আমি যেখানে পা রাখবো তোমাকে সেখানে অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় পাহারা বসাতে হবে, আমার বুকে কারো আঘাত এসে পড়ার পূর্বে তোমাকে সেটার মুখোমুখি হতে হবে। নিজেকে সেভাবেই প্রস্তুত করে নাও।”
“ইয়েস ইয়োর ম্যাজেস্টি।”
বলে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো লিও। মীর ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে এবার কাঞ্জি আর আলফাদের দিকে ফিরলো।
“আলফাদ এবং কাঞ্জি, এখন হতে তোমরা দুজন হবে আমার চোখ, আমার কান, আমার নিরব ছায়া। কোথায় কে কী বলছে, কী লুকোচ্ছে সব থাকবে তোমাদের জানা। তোমরা দুজন হবে ইনভিজিবল; আলোয় নয়, ছায়ায় মিশে থাকবে। তোমাদের থেকে পঞ্চদ্বীপের প্রতিটি কোণার খবর নিবো আমি।
তোমাদের অস্তিত্ব কেউ টের পাবে না, কিন্তু তোমাদের ছায়া শত্রুর ঘাড়ে শ্বাস ফেলবে। শত্রুর চিন্তার আগে তোমরা জানবে, আমি বলার আগেই তোমরা বুঝবে।
আর ব্যর্থতা? এই নামে তোমাদের কোনো অপশন নেই। ইজ দ্যাট আন্ডারস্টুড?”
কর্তৃত্বপূর্ণ স্বরে বলে উঠলো মীর। আলফাদ কাঞ্জি ভড়কালো, ওদেরকে তবে গুপ্তচর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে? তবে তো ওরা আর শিরো মিদোরি তে থাকতে পারবেনা, ওদেরকে ছুটে বেড়াতে হবে সমস্ত পঞ্চদ্বীপ জুড়ে। দুজনে চাপা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অন্যদের মতো সমস্বরে বলে উঠলো,
“ইয়েস ইয়োর ম্যাজেস্টি।”
“ওকামি এবং জোভি, তোমাদের দুজনের কাজ এই প্রাসাদেই। ওকামি আজ থেকে রয়্যাল ট্রেজারার। সাম্রাজ্যের যত মুদ্রা, রত্ন, হীরে জহরত এভরিথিং তোমার দায়িত্বে থাকবে। তোমাকে আমি দায়িত্বশীল, হিসেবি, সৎ হিসেবেই জানি, তাই কোনো ধরনের অব্যবস্থাপনা সহ্য করা হবেনা।তুমি ভুল করলে সেটা তুমি জানার আগে রাজ্য জেনে যাবে, কথাটা মাথায় রাখবে।
জোভি, তুমি আজ হতে রয়্যাল আর্মরির দায়িত্বপ্রাপ্ত হচ্ছো। প্রাসাদের অস্ত্রাগারের প্রতিটি অস্ত্র তোমার দায়িত্বে থাকবে। তোমাকে সন্তানের মতো করে অস্ত্রের যত্ন নিতে হবে, নিয়মিত পরীক্ষা করতে হবে যতক্ষণ না সেগুলো সাম্রাজ্যের প্রতিরক্ষা ক্ষমতার প্রতীক হয়ে উঠে।
তোমরা সবাই তোমাদের দায়িত্ব পূঙ্খানুপুঙ্খ রূপে পালন করবে, আর তোমাদের দায়িত্ব পালনে সামান্যতম অবহেলাও যদি পাওয়া যায় তবে তার ভয়ানক খেসারত তোমাদেরকেই দিতে হবে। আ’ য়োন্ট রিপিট মা’সেল্ফ, নোট দ্যাট।”
মীরের কথা শেষ হতেই বাচ্চারা আবার সমস্বরে ‘ইয়েস ইয়োর ম্যাজেস্টি’ বলে উঠলো।
মীর আবার গা এলিয়ে দিলো চেয়ারে। এতক্ষণের প্রফেশনালিজম ছেড়ে এবার সম্পুর্ন স্বাভাবিক হয়ে ও শুধালো,
“তোদের রাতের ক্যাম্প ফায়ার কুকিং এর কি খবর?”
“ইয়োর ম্যাজেস্টি, শেহজাদী ঘুম থেকে উঠলে জানতে পারবো।”
বলল কোকো। মীর টেবিলের ওপর থেকে একটা কলম নিয়ে আঙুলের মাথায় ঘোরাতে ঘোরাতে গুরুগম্ভীর গলায় বলে উঠলো,
“শিনজো ঘুম থেকে জেগে উঠে পিকনিক করতে চাইলে তোরা সবাই সাফ সাফ মানা করে দিবি, বলবি আজ নয় অন্য দিন, আজ তোদের সবার কাজ পড়ে গেছে।
ও অসুস্থ এটা মাথায় রাখবি। ও পিকনিক করবে বললেই তোরা নাচবি না, যদি নাচতে দেখি তবে সব গুলোকে উল্টো করে ঝুলিয়ে পেছনে রডের বাড়ির আদর দেবো, মাইন্ড ইট!”
ছেলেরা কিছু উত্তর দিবে তার আগেই পাশের কামরা থেকে দরজা খুলে মুখ বাড়িয়ে দিয়ে ভ্রুকুটি করে আনাবিয়া বলে উঠলো,
“তুমি তো খুব খারাপ, হ্যাঁ! বাচ্চাগুলোকে হুমকি দিচ্ছো? আমার শান্তি তোমার সহ্য হয়না তাইনা?”
আনাবিয়ার কথা শুনে হকচকিয়ে গেলো মীর, এই মেয়ে জাগলো কখন? জেগে আবার সব শুনেও ফেলেছে। আনাবিয়ার ভ্রুকুটি করা দৃষ্টি থেকে তাড়াতাড়ি দৃষ্টি সরিয়ে অন্যদিকে তাকালো ও।
আনাবিয়া ওর ফিরিয়ে নেওয়া মুখের দিকে কিছুক্ষণ তীর্যক চোখে তাকিয়ে থেকে বাচ্চাদের উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো,
“অ্যাই, সবগুলো জিনিসপত্র গুছিয়ে রেড জোনের দিকে এগো, আমি আজ দুঘন্টা বেশি কাটাবো ওখানে। হুহ!”
বলে আবার কামরায় ঢুকে গেলো আনাবিয়া। মীর সেন্টি খাওয়া চোখে তাকিয়ে রইলো আনাবিয়ার কামরার দরজার দিকে।
আর বাচ্চারা সব ঠোঁট টিপে হাসি আটকানোর প্রাণপণ চেষ্টা করতে করতে মীরের অগ্নীদৃষ্টি থেকে পালাতে সুড়সুড় করে বেরিয়ে গেলো কামরা থেকে।
সন্ধ্যা পেরিয়েছে ঘন্টা দুই হলো, আনাবিয়ার রান্না প্রায় শেষের দিকে। বাচ্চারা সব প্লেট বাটি ধুয়ে পরিষ্কার করতে ব্যাস্ত। মীর আনাবিয়াকে হেল্প করছে রান্নায়।
বউ এখন তার থেকেও বড় রাধুনি, বউয়ের হাতের রান্না খাওয়ার পর এখন আর প্রাসাদের রয়্যাল কুকের রান্নাও তার ভালো লাগেনা। নিজের হাতের রান্না তো আরও ভালো লাগেনা। শুধু এই চাঁদের টুকরোর হাতের রান্না খেতে মন চায়।
রান্না শেষ হলে চুলা থেকে নামিয়ে ফেললো মীর। আনাবিয়া মীরের ওপর সমস্ত দায়িত্ব দিয়ে এগোলো লাইফট্রির পাশে থাকা ডোবাটার দিকে, এখন কিছুক্ষণ সময় নিয়ে গোসল না দিলে ও আর স্থীর হতে পারবেনা।
বাচ্চারা সকলে মাটিতে ঘাসের ওপর বড়সড় ম্যাট বিছিয়ে, প্লেটগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে দিলো। দুপুর থেকে কাজ করতে করতে ওদের অবস্থা কাহীল, এখন দুটো খেয়ে কামরায় গিয়ে সবাই জম্পেশ ঘুম দিবে৷
কাল থেকে আবার হিজ ম্যাজেস্টির দেওয়া গুরুদায়িত্ব পালনে লেগে পড়তে হবে, শান্তির দিন শেষ। আজ রাতটা একটু মনের মতো ঘুমিয়ে নিবে ওরা।
আনাবিয়া লাইফট্রির পাশের চিকচিকে পানি বিশিষ্ট ডোবাটায় কিছুক্ষণ ইচ্ছেমতো ডুবিয়ে পোশাক বদলে ভিজে চুল নিয়ে এলো আবার ওদের ক্যাম্প ফায়ারের স্থানে। গোসল দেওয়ার পর এখন একটু ভালো লাগছে ওর, এতক্ষণ গায়ের ভেতর কি যেন একটা হয়ে যাচ্ছিলো।
কোকো ফ্যালকনেরা ততক্ষণে খাবার বেড়ে নিয়ে অপেক্ষা করছে ওর জন্য, আনাবিয়া এসে বসলো মীরের পাশের শূন্য স্থানে। মীর এক হাতে ওকে নিজের দিকে আরও টেনে নিয়ে বলল,
“অনেক করে ফেলেছো, আর কষ্ট করতে হবেনা তোমার। এখন আমার হাতে খাও।”
আনাবিয়া চোয়াল ফুলিয়ে হেসে মাথা ঠেকালো মীরের বাহুতে। সত্যিই আজ কষ্ট হয়ে গেছে ওর, এরকম ক্লান্ত ওর কখনোই লাগেনা, আজ ক্লান্তিতে শরীর একেবারে ভেঙে যাচ্ছে যেন!
মীর হাতে করে খাবার তুলে ওর বাহুতে মাথা ঠেকানো আনাবিয়ার মুখে তুলে দিলো, আনাবিয়া ওভাবে বসেই খেতে শুরু করলো, মাথা তুলতে ইচ্ছা করছেনা ওর।
কিন্তু খাবারটা চিবিয়ে গিলে ফেলা মাত্রই পেটের ভেতর পাকিয়ে উঠলো ওর, গা গুলিয়ে উঠলো মুহুর্তেই।
আসন্ন ঘটনার ব্যাপারে দ্রুত সতর্ক হয়ে উঠে মীরের বাহুর ওপর থেকে চকিতে মাথা তুললো ও, তারপর বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে চলে গেলো পেছন দিকে আর গিয়েই হড়হড় করে বমি করে দিলো ও।
মীরের বুক কেপে উঠলো তৎক্ষনাৎ! হাতের প্লেটটা ফেলে রেখে উঠে দাঁড়িয়ে ও ছুটে গেলো আনাবিয়ার দিকে।
আনাবিয়া বমি করতে ব্যাস্ত, পেটের ভেতর থেকে যেন সবকিছু ঘূর্ণি পাকিয়ে উঠে আসতে চাইছে, নাড়িভুড়ি শুদ্ধ সব বেরিয়ে আসতে চাইছে যেন!
মীর দুহাতে ওকে পেছন থেকে অবলম্বন দিলো, বমির দমকে যেন পড়ে না যায় আবার! পেছন ফিরে কোকোর উদ্দ্যেশ্যে চিন্তিত কন্ঠে উচ্চস্বরে বলে উঠলো,
“কোকো, হেকিমকে ইনফর্ম কর এখনি। জলদি আসতে বল!”
কোকো দেরি না করে ওদের থেকে কিছুটা দূরে সরে গিয়ে কল লাগালো প্রাসাদে। আধা মিনিট বাদে আবার দ্রুত পায়ে এদিকে এগিয়ে এসে মীরের উদ্দ্যেশ্যে বলল,
“হেকিম রওনা দিয়েছেন ইয়োর ম্যাজেস্টি।”
আনাবিয়া স্থীর হয়ে বসলো এতক্ষণে, হাপাচ্ছে ও, প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছ। মীর ওকে টেনে নিয়ে এসে ঠেকালো নিজের বুকের সাথে— অস্থীর, শঙ্কিত কন্ঠে শুধালো,
“কেমন লাগছে এখন শিনু? শরীর খুব খারাপ লাগছে তোমার?”
আনাবিয়া উত্তর দেওয়ার মতো শক্তিটুকু পেলোনা, নিঃশ্বাস পড়তে লাগলো ওর ঘন ঘন। আর তার পরমুহূর্তেই আবার মীরের গা ভাসিয়ে বমি করে দিলো ও! পেটের ভেতর কিছুই নেই, শুধু পানি বের হচ্ছে মুখ দিয়ে৷
মীর আর দেরি করলো না এক মুহুর্তও! আনাবিয়াকে বুকের ওপর চেপে রেখে বাচ্চাদেরকে পেছনে ফেলে রেখে পায়ে ভর দিয়ে নিমিষেই ও উঠে গেলো শূন্যে, আর তারপর ঝড়ের ন্যায় তীব্র বেগে এগোলো প্রাসাদের দিকে।
প্রাসাদের একটা বিরাট এরিয়া জুড়ে মেডিক্যাল জোন। হাইটেক মেডিক্যাল ল্যাব গুলো সব এখানে অবস্থিত, তার পাশেই আছে রিসার্চ ল্যাব। মীরের সমস্ত গোপন রিসার্চ, সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ গুলো এখানে হয়।
মেডিক্যাল ল্যাবের ঠিক পাশেই রয়্যাল মেডিক্যাল জোন। সেখানের একটা সুসজ্জিত কামরার নরম বিছানায় স্থীর হয়ে শুয়ে আছে আনাবিয়া৷
বমির দমক ওর কমেছে এখন। রাজপরিবারের জন্য নির্ধারিত হেকিম দেখছে ওকে খুটিয়ে খুটিয়ে, সমস্যা টা আসলে কি সেটা বের করার চেষ্টা করছে।
চিন্তিত মীর মুখে হাত ঠেকিয়ে বসে আছে বিছানার পাশের সোফায়। মুখ খানা দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত, ভ্রু জোড়া বাকানো উদ্বিগ্নতার চাপে। আশঙ্কিত দৃষ্টি ওর আনাবিয়ার মুখের ওপর।
মেয়েটা এই অল্প সময়ের ভেতরেই কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, মুখ খানা পাণ্ডুর বর্ণ ধারণ করেছে। পিটপিট করে তাকাচ্ছে সে, একবার হেকিমের দিকে তো আর একবার মীরের দিকে।
মীর এখনো পোশাক ছাড়েনি, নোংরা হয়ে যাওয়া পোশাকেই এখনো বসে আছে ও। কোকো দাড়িয়ে আছে ওর পেছনে, বাকি বাচ্চারা সব মেডিক্যাল জোনের বাইরের খোলা স্থানে দাঁড়িয়ে আছে।
আনাবিয়া মীরের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে ক্লান্ত গলায় বলে উঠলো,
“তুমি এখনো ও পোশাকে আছো কেন? কামরায় গিয়ে পোশাক বদলে ফ্রেশ হয়ে এসো। কোকো আছে তো আমার কাছে!”
মীর যেতে চাইলোনা, তবুও জোরাজোরি করে ওকে পাঠিয়ে দিলো আনাবিয়া। কোকো বসে রইলো আনাবিয়ার পাশে, হেকিম কিভাবে কি করে সেগুলো সব মনোযোগী দৃষ্টিতে দেখতে থাকলো।
কিয়ৎক্ষণ বাদে মীর ফিরলো আবার। কোনো রকমে গোসল দিয়ে গায়ের ওপর একটা রোব জড়িয়ে চলে এসেছে ও। তারপর আবার বসে গেছে আনবিয়ার পাশে।
রয়্যাল কেবিন গুলোতে ওদের আসা হয়না, অল্প স্বল্প অসুস্থ হলে রয়্যাল হেকিম গুলোই রয়্যাল ফ্লোরে গিয়ে চেক আপ করে আসে।
আজ হঠাৎ ওরা এসে উপস্থিত হওয়ায় বাইরের মেডিক্যাল জোনের অন্যান্য অংশের কাজ থেমে গেছে, সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে এদিকে। মীর আনাবিয়ার দিকে ওদের সবার চরম কৌতুহল!
প্রাসাদে থাকলেও রয়্যাল ফ্লোর সম্পুর্ন প্রাসাদ থেকে এক প্রকার বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে ওরা কখনোই মীর আনাবিয়াকে দেখার সুযোগ পায়না।
শুধুমাত্র নির্দিষ্ট ব্যাক্তিবর্গ ব্যাতিত রয়্যাল ফ্লোরে পা রাখারও অনুমতি নেই কারো, তাই ওদেরও কখনো রয়্যাল ফ্লোরটা দেখার মতো সৌভাগ্য হয়না।
কচিৎ কখনো রয়্যাল ফ্লোর থেকে রয়্যাল মেমবার রা বেরিয়ে এলে তাই ওদের কৌতুহলের সীমা থাকেনা।
মীর ফিরেই ওদেরকে এভাবে উকি ঝুকি মারতে দেখে মীর কোকোর দিকে ইশারা করলো, কোকো সাথে সাথেই কামরার সুসজ্জিত গ্লাসের দেয়াল গুলোর অনাবৃত দেয়ালটা পর্দা দিয়ে আবৃত করে দিলো।
মীর এসে এসে বসলো আবার সোফায়, তারপর আনাবিয়াকে পরীক্ষা করতে থাকা হেকিমের দিকে তাকিয়ে বলল,
“হেকিম বাসির, বলো।”
“ইয়োর ম্যাজেস্টি, শেহজাদীর ফুড পয়জনিং হয়েছে।”
“কিন্তু সেটা কিভাবে হলো? সারাজীবন ও প্রাসাদের রয়্যাল কুকের তৈরি খাবার খেয়েছে, এখনো খাচ্ছে। ফুড পয়জনিং হওয়ার তো কোনো সম্ভাবনাই নেই!”
ভ্রুকুটি করে শুধোলো মীর। বাসির হেকিম বিপদে পড়লো, ইতস্তত করে বলল,
“ই-ইয়োর ম্যাজেস্টি, কখনো হয়তো ভুলবসত, কোনোভাবে শেহজাদীর শরীরে জীবাণু ঢুকে গেছে, সেটা হয়তো কেউ বুঝতে পারেনি। সেটা এখন এসে ফুড পয়জনিংয়ে রূপ নিয়েছে।”
হেকিমের উত্তরে সন্তুষ্ট হলোনা মীর, ভ্রু কুচকে কিছুক্ষণ বসির হেকিমের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে উঠলো,
“এখন কি করতে বলো? ওর যদি আবার বমি হয়?”
“শেহজাদীকে আমি ওষুধ খাইয়ে দিয়েছি ইয়োর ম্যাজেস্টি, আপাতত আর বমি হবেনা। তবে শেহজাদীর খাওয়া দাওয়ার দিকে এখন থেকে বিশেষ নজর দিতে হবে। শেহজাদীর শরীরে ব্লাডের মাত্রা কিছুটা কম মনে হচ্ছে। রক্ত বাড়ে এমন খাবার খাওয়াতে হবে শেহজাদীকে নিয়মিত।
এখন উনি চাইলে কামরায় ফিরে বিশ্রাম নিতে পারেন।”
বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩১+৩২
মীর ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বসা থেকে উঠে আনাবিয়াকে রোগীর বিছানা থেকে উঠিয়ে কোলে নিয়ে এগোলো নিজেদের কামরার দিকে।
ছেলেগুলো মীরের আদেশ পেয়ে আবার ফিরে গেলো রেড জোনের ভেতরে, সেখানে ফেলে রেখে আসা খাবার গুলো খেয়ে সব কিছু ক্লিন অ্যান্ড ক্লিয়ার করে রেখে আসতে৷
