বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১৩+১৪
রানী আমিনা
“ভাইজান, সম্পর্কের দিক থেকে আমি এখন আপনার চাচা শ্বশুর হয়ে গেছি। আবার ওদিক থেকে আমি আপনার ভাই, এখন আপনি আমাকে কোন দিক থেকে দেখবেন?”
প্রশ্ন করে জায়ান মিটমিটিয়ে হেসে তাকালো কালো রঙা গাড়িতে হাটু ভাজ করে পা ঠেকিয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো মীরের দিকে।
এখনো জঙ্গলের ভেতরকার খোলা প্রান্তরেই অবস্থান করছে ওরা। আনাবিয়া প্রাসাদে ফেরার জন্য অন্দরমহলে শেষ সময়ের টুকটাক প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ মীর ওকে রেডি হতে দিয়ে অপেক্ষা করছে অন্যদের সাথে।
জায়ানের প্রশ্ন শুনে স্মিত হেসে ও উত্তর করলো,
“বউকে জিজ্ঞেস করে বলবো।”
“সাদি ভাইকে চাচাশ্বশুর মানলে আমাকে শ্বশুর মানা তো ফরজ!”
মীরকে উদ্দেশ্য করে গাল ফুলিয়ে বলে উঠলো হামদান। ওর কথা শুনে ওপাশ থেকে নোমান খোচা মেরে বলল,
“এহ্! শখ কতো, উনি নাকি শ্বশুর হবেন! বলি নিজের চেহারাখান আয়নায় দেখেছিস কোনোদিন?”
“হ্যাঁ দেখেছি, তোর থেকে সুন্দর আছে। আমার বউ আমাকে প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ছিলো, যাকে বলে লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট। তোর দিকে তো ওই ঘেউলের মাইয়া গুলানও তাকাবেনা!”
“হু কইছে তোরে।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এ দুটোর ঝগড়া বেগতিক দেখে থামিয়ে দিতে জায়ান ধমকে বলে উঠলো,
“তোরা দুইটা কি আর মানুষ হবিনা? আজকের দিনেও তোরা ঝগড়া করবি?”
“হিজ ম্যাজেস্টি ওরফে ভাইজান তো বলেই দিয়েছেন যে আজ কোনো বাধানিষেধ নাই, যাচ্ছেতাই করা যাবে, তাহলে অসুবিধা কোথায়?”
কোমরে হাত দিয়ে ঝগড়াটে গলায় বলল নোমান। হামদান ওর কথায় সায় জানিয়ে বলল,
“হ ঠিকই তো। বলুননা ভাইজান, আমি আপনার শ্বশুর হইনা?”
মীর ওর দিকে নজর ফিরিয়ে ভারিক্কি কন্ঠে বলল,
“যে ব্যাক্তি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তোমার সুন্নাতে খাৎনা দেখেছে তার শ্বশুর হতে যদি তোমার কোনো অসুবিধা না থাকে তবে আমারও কোনো আপত্তি নেই হামদান।”
মীরের কথায় হামদান লজ্জা পেয়ে চুপসে গেলো। ওর মনে আছে ওদের অনেকের একসাথে সুন্নাতে খাৎনা হয়েছিলো। হিজ ম্যাজেস্টি নিজে দেখতে এসেছিলেন ওদের সবাইকে, আর সেই সময়েই তার সুন্নাতে খাৎনা শুরু হয়েছিলো। কি চিৎকারটাই না সে করেছিলো ভয়ে।
হিজ ম্যজেস্টি ওর ভয়ার্ত চিৎকার শুনে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সেদিন একগাল হেসেছিলেন।
ওদিকে মীরের কথা শুনে নোমান খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠলো। ওর হাসি শুনে গা জ্বলে গেলো হামদানের। পাশ ফিরে সিরিয়াস মুখে ও বলল,
“তুই হাসিস ক্যান? তোর তো ইয়াই নাই, চুপ থাক!”
সাথে সাথে হাসি বন্ধ হয়ে গেলো নোমানের, ভরা মজলিশে ওকে এভাবে থামিয়ে দেওয়ায় অভিমানি দৃষ্টিতে ও তাকালো হামদানের দিকে।
জায়ান, নওয়াস সহ অন্যরা হেসে উঠলো হোহো করে।
কিন্তু মীর হাসলোনা, ওর মনে পড়ে গেলো অনেক গুলো দিন আগে নোমানের ইয়া প্রশ্নে আনাবিয়াকে দেওয়া উত্তরটা। মনে পড়তেই কেশে উঠলো ও।
সর্বনাশ করেছে, ওই মেয়েটা কি মনে রেখেছে এসব?
অতো পূর্বের কথা মনে থাকার কথা না, তবুও নিশ্চিন্ত হতে পারলোনা মীর। যদি দুড়ুম করে কোনোদিন শিনু বলে বসে যে তোমার পোষা কিং সাইজের কিং কোবরাখান কই? তখন ওর অবস্থাটা কি হবে!
ঠোঁট টিপে হাসলো ও। শিনুতো এখন ওর বউ, এসব কিং কোবরা ফোবরা এখন আর কোনো বিষয় না।
ওর ভাবনার মাঝেই অন্দরমহল থেকে শব্দ ভেসে এলো আনাবিয়ার বের হওয়ার।
জায়ান, নওয়াস, হামদান সহ অন্য পুরুষেরা মীরকে বিদায় পূর্ব অভিনন্দন জানিয়ে প্রস্থান করলো দ্রুত পায়ে। নোমান দাঁড়িয়ে রইলো মীরের পাশে, মুখ খানা ওর ভার এখনো।
মীর ওর পিঠে একটা চাপড় দিয়ে বলে উঠলো,
“তোমাকে ধন্যবাদ নোমান।”
পিঠের ওপর মীরের ইস্পাত-দৃঢ় হাতের চাপড়ে নোমানের জান যায় যায় অবস্থা, তবুও মুখে হাসি ফুটিয়ে অবাক কন্ঠে ও জিজ্ঞেস করলো,
“কেন ভাইজান?”
“তোমার বদৌলতে আমার আর আমার শিনুর ভেতর ভবিষ্যতে অনেএএক দুষ্টু মিষ্টি মুহুর্তের সৃষ্টি হতে চলেছে।”
মীরের কথার আগামাথা কিছু না বুঝলেও নোমান খুশি হলো এটা ভেবে যে হিজ ম্যাজেস্টি তাকে ধন্যবাদ দিয়েছে, তাই সে যে কারণেই হোক।
সেই মুহুর্তেই আনাবিয়া বের হয়ে এলো অন্দরমহল থেকে। ওর পেছন পেছন এলো বেলিন্ডা সহ অ্যানিম্যাল টাউনের এক ঝাক মেয়ে।
অফ হোয়াইটের ফ্লাপি গাউনে আনাবিয়াকে চাঁদের আলোয় ঢাকা শুভ্র পরীর ন্যায় ঠেকছে। শ্বেতশুভ্র চুল গুলো দুলিয়ে, হীরা-ঝলমলে চোখ জোড়ায় অদ্ভুত সম্মোহনী চাহনি ফেলে মৃদু পায়ে এগিয়ে এলো ও মীরের দিকে।
মীর বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে অপলক, কবুল বলার সময়ের চাইতেও এখন আরও বেশি সুন্দর লাগছে ওর শিনুকে। আজ যেন স্বর্গের অপ্সরা নেমে এসেছে ওর কাছে। ওর অবচেতন মন প্রশ্ন করে ওঠে, এখন থেকে কি প্রতি মুহুর্তে ওর শিনুর সৌন্দর্য শুধু বেড়েই চলবে?
মীরের ভাবনার মাঝেই ওর একেবারে সামনে এসে ওর চোখে চোখ রেখে দাঁড়ালো আনাবিয়া। মীর ওর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টি রেখেই শব্দ করে খুলে দিলো গাড়ির ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটের দরজা।
আনাবিয়া মিষ্টি হেসে বসলো গিয়ে গাড়ির ভেতর। বেলিন্ডা দ্রুত গতিতে এসে ওর পোশাক ঠিক করে দিতে নিলে মীর বাধা দিয়ে বলে উঠলো,
“প্রয়োজন নেই বেলিন্ডা, আমিই করে নিবো।”
প্রৌঢ়া বেলিন্ডা মাথা নত রেখে সরে দাড়ালো সেখান থেকে। মীর আনাবিয়ার দিকে এক পলক তাকিয়ে ওর ফ্লাপি গাউনের বর্ধিতাংশ যত্ন সহকারে গাড়ির ভেতরে উঠিয়ে দিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। আর তারপর নিজেও উঠে ড্রাইভিং সিটে বসে এগোলো ওদের গন্তব্যের দিকে।
পেছনে ফেলে গেলো এই নবদম্পতির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এতক্ষণ নিজেদের চেপে রাখা মুগ্ধতাপূর্ণ অনুভূতির প্রকাশকারী এক ঝাক মেয়েকে, যাদের কলকলে কথার ফুলঝুরিতে ছেয়ে যেতে লাগলো সমস্ত খোলা প্রান্তর খানা৷
রেড জোন পার হয়েই গাড়ি থামালো মীর, পাশে বসে এতক্ষণ একমনে রাস্তার দিকে দৃষ্টি দেওয়া আনাবিয়া জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো ওর দিকে। মীর এক হাতে ওর কোমর ধরে উঁচু করে নিয়ে এসে ফেললো নিজের কোলের ওপর,
“এখন থেকে আমার সাথে গাড়িতে যাওয়ার সময় তুমি আমার কোলে বসবে, অন্য কোথাও না। বুঝেছো?”
দু আঙুলে আনাবিয়ার চোয়াল টেনে বলল মীর। আনাবিয়া প্রতিউত্তরে মাথা নাড়ালো শুধু। মীর আবার স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে কোলে বসে থাকা আনমনা আনাবিয়াকে প্রশ্ন করলো,
“তুমি আজ সারাদিনে কয়টা কথা বলেছো বলোতো! গুনে গুনে পাঁচটা হবে কিনা সন্দেহ। আমি তো বলেছি আমার কোনো দায়িত্ব নেওয়ার প্রয়োজন তোমার নেই।
যখন উপযুক্ত সময় আসবে তখন তুমি নিজেই তোমার সব দায়িত্ব বুঝে নিবে আমি জানি, এত চিন্তার কিছু নেই শিনু! এখন একটু মাথাটা ফ্রেশ করো। তোমার গোসল হয়নি এখনো, প্রাসাদে ফিরেই গোসল দিবে, নইলে তোমার এলোমেলো চিন্তাগুলো স্থীর হবেনা।”
“আমি এখন প্রাসাদে ফিরবোনা।”
এতক্ষণে নিজে থেকে কোনো কথা বলল আনাবিয়া। মীরের সাথে এই মুহুর্তে বাধা পড়ার কোনো প্রস্তুতিই ওর ছিলোনা। ওর মস্তিষ্কটা এই সমস্ত কিছুকে পাহাড়সম চাপ হিসেবে নিচ্ছে। কেমন একটা দম আটকানো অনুভুতি। খোলা জায়গায় যেতে হবে ওর এখন, বুক ভরে বাতাস নিতে হবে!
“কোথায় যেতে চাও বলো, সেখানেই নিবো তোমাকে!”
ওর দিকে আকুল দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধালো মীর। মেয়েটা ওকে চাপ হিসেবে নিচ্ছে, অথচ এই চাপটা কমাতেই ও বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো।
হঠাৎ করে ওর মনে হলো ও কি আনাবিয়ার ওপর সত্যিই চাপ দিয়ে ফেলেছে? ওর শিনুকি খুব স্ট্রেস ফিল করছে ওর জন্য?
“সমুদ্রের পাড়ে যাবো।”
মীরের বুকের ওপর অসহায়ের ন্যায় মাথা ঠেকিয়ে বলল ও, পরক্ষণেই আবার বলে উঠলো,
“তোমার পাঞ্জাবি খুলো, তোমাকে অন্যরকম লাগছে, অচেনা।”
আনাবিয়ার কথা শেষ না হতেই আনাবিয়াকে বুক থেকে কিঞ্চিৎ সরিয়ে এক টানে নিজের গায়ের পাঞ্জাবী খুলে ফেললো মীর, উন্মুক্ত হলো ওর দেহের ভ্রমরকালো, বলিষ্ঠ উর্ধাংশ। আনাবিয়ার মুখপানে চেয়ে ও শুধালো,
“এখন ঠিক আছে?”
“হু, কিন্তু তাই বলে তুমি খালি গায়ে থাকবে?
মীরের দিকে থেকে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে তেজি গলায় বলল আনাবিয়া। শব্দ করে হাসলো মীর, মাথার কাছের ছোট্ট কম্পার্টমেন্টটা খুলে বের করলো একটা পাতলা ফিনফিনা শার্ট। সেটা গায়ে চড়াতে চড়াতে বলে উঠলো,
“কয়েকবছর আগে এই খালি বুকে ঘুমোনোর জন্য বালিশ কাথা নিয়ে আমার কামরায় এসে গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। তখন তো খুব শখে ঘুমোতে!”
“সেতো আমি এখনো ঘুমোতে চাই।”
অন্যদিকে তাকিয়ে সিরিয়াস মুখোভঙ্গি করে বলল আনাবিয়া। মীর ওর কথায় তবদা মেরে বসে রইলো কিছুক্ষণ, তারপর লাজুক ভঙ্গিতে ঠোঁট টিপে হেসে মাথা নিচু করে শার্টের বোতাম আটকাতে নিলো।
তখনি আনাবিয়া ওর দিকে ফিরে বলে উঠলো,
“কি ব্যাপার? লজ্জা পাচ্ছো কেন তুমি? লজ্জা পাওয়ার কথা তো আমার, তুমি লজ্জা পাচ্ছো কেন?”
“মানুষের পার্সোনালিটি সেকেন্ডে কিভাবে বদলে যায়! একটু আগেও যার মুখ থেকে কথা বের হচ্ছিলোনা, স্বামীর আদর সোহাগের মিষ্টি নির্যাতনের শিকার হওয়ার ভয়ে যে চুপসে ছিলো তার এখন মুখে খই ফুটছে! আবার আমাকে জিজ্ঞেস করে আমি কেন লজ্জা পাই!”
“ঠিকই তো, তুমি থাকবা বিন্দাস কারণ তোমার বিয়ে হইছে আজকে, সেটাও একটা কচি মেয়ের সাথে। রাতের বেলা হেব্বি এনিজয় করবা আজ। তোমার তো আনন্দে নাচার কথা! তা নয়, তুমি উলটো লজ্জা পাচ্ছো!”
“এসব কি কথা বার্তা শিনু! কচি মেয়ে, বিন্দাস, হেব্বি! এসব কি? কই থেকে শিখছো এসব?”
মীরের প্রশ্নের উত্তরে আনাবিয়া এক ভ্রু উচু করে জিভের সাহায্যে মুখ থেকে একটা দারুণ শব্দ করে বলল,
“আরও অনেক জিনিস শিখেছি, সময় হলেই জানতে পারবে।”
“যেমন?”
কৌতুক পূর্ণ কন্ঠে, চোখের তারায় ঝিলিক ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করলো মীর। আনাবিয়ার কাজে কথায় ভীষণ মজা পাচ্ছে ও!
“যেমন গুড গার্ল হয়ে থাকার অভিনয়। রাগ নিয়ন্ত্রণের অভিনয়, জেলাসি ফিল না করার অভিনয়, তোমাকে জেলাস ফিল করানোর জন্য অভিনয় ইত্যাদি।”
মীর ঠোঁট কামড়ে হাসলো নিঃশব্দে। আনাবিয়া ওর চোখের গভীরে দৃষ্টি রেখে আবার বলে উঠলো,
“তোমার কি মনে হয়? সেদিন সাফিয়াকে আমি ছেড়ে দিতাম? ন্যো। ইট ওয়াজ অ্যা টেস্ট ফ’ ইয়্যু, তুমি কি করো সেটাই দেখতে চেয়েছিলাম।
রুশি ভাইয়া যে আমার প্রতি দুর্বল সেটা কি আমি জানতাম না ভেবেছো? আমি কি অতোটাও বোকা বলে তোমার মনে হয়? ন্যো।
তুমি কতখানি জেলাস ফিল করো সেটাই দেখতে চেয়েছিলাম, যার জন্য আমি রোজ ওর সাথে কথা বলতাম, অনেক ক্ষণ ধরে। কারণ আমি জানতাম তুমি বোর্ডিংয়ের সিসিক্যামে আমাকে সর্বক্ষণ নজরে নজরে রাখো।
আরও অন্নেক টেস্ট দিয়েছো তুমি, তোমার অজান্তেই! যদিও সফল হয়েছো সব গুলোয়।
আনাবিয়া ফারহা দেমিয়ান তো আর যার তার নিকট নিজের সমস্ত জীবন সঁপে দিতে পারেনা কখনোই।”
মীরের জ্বলজ্বলে হাসি তখনো অব্যাহত, আনাবিয়াকে এক ঝটকায় নিজের বুকে আছড়ে ফেলে ওর ফর্সা গলায় মুখ ডুবিয়ে ও নেশাতুর কন্ঠে বলে উঠলো,
“আমার শিনুকে আমি রন্ধ্রে রন্ধ্রে চিনি, সে কি করে কেন করে সেসব আমার জানা। আজ ওই মেয়েকে শেষ না করে তুমি কেন ছেড়ে দিয়েছো সেটাও আমি জানি। অ্যন্ড আ’ম ড্যাম শিও’ এই টেস্টেও আমি দারুণ মার্ক নিয়ে উত্তীর্ণ হবো।”
“হু, এখন চলো। আমার গাড়ির ভেতরে বসে থাকতে ভাল্লাগছে না। আমি একটু খোলা বাতাসে যাবো। আজকের বিয়েটা আমার জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত ছিলো। আমার ব্রেইন এটাকে প্রসেস করছিলো সারাটা সময় ধরে। এখন প্রসেস হয়ে গেছে, ন্যাও আ’ জাস্ট নিড সাম ফ্রেশ এয়ার!”
“ইয়েস ম্যাম।”
বলেই দ্বিতীয়বার গাড়ি স্টার্ট দিলো মীর, আর তারপর ঝড়ের গতিতে গাড়ি হাকালো সমুদ্রের দিকে।
২৬. সমুদ্রের পাড় জুড়ে নিজের অফ হোয়াইটের গাউনটি ফুরফুরে হাওয়ায় উড়িয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে আনাবিয়া। ওর খিলখিলে হাসি কানে বেজে চলেছে মীরের।
ঢেউয়ের স্নিগ্ধ স্পর্শ মৃদুভাবে বয়ে যাচ্ছে ওদের পায়ের নিচ দিয়ে। শেষ বিকেলের সোনালী আভা ঝলমল করছে পশ্চিমে।
মীর হাটছে ধীর গতিতে। ওর বিশাল শরীরের ছায়া সমুদ্র তটে ফুটে আছে অটল পর্বতের ন্যায়, নিরব গাম্ভীর্য নিয়ে একপা একপা করে সেটা এগোচ্ছে সামনে। ওর অদ্ভুত নরম দৃষ্টি স্থীর হয়ে আছে সামনে ছুটে চলা আনাবিয়ার দিকে।
আনাবিয়া ছুটে ঘুরেফিরে চলে আসলো আবার মীরের পাশে। মীরের পেশিবহুল বাহুখানা দুহাতে জড়িয়ে ধরে চোখ তুলে তাকিয়ে দুষ্টু হাসি দিয়ে জানান দিলো যে ওর মাইন্ড এখন বহুত ফ্রেশ।
মীর ঝুকে ওর চুলের ওপর দিয়ে মাথায় একটা চুমু খেলো শব্দ করে। এই মেয়েটা ওর মতো হয়ে উঠছে দিনে দিনে। চঞ্চলতাটা বাদ দিলে আনাবিয়ার পুরোটাই ওর বৈশিষ্ট্য। রাগ, জেদ সবকিছু।
কিন্তু মীর কখনো অভিমান করেনি কারো ওপর, কার উপরই বা করতো! অভিমান করার জন্য অপর পাশের ব্যাক্তির হৃদয়ে একটা শক্তপোক্ত ভিত্তির প্রয়োজন হয় যা মীর পায়নি কখনো কারো কাছে।
কিন্তু এই মেয়েটিকে ও সব দিবে, সব। ওর যত অপূর্ণতা আছে সব এই মেয়েটিকে দিয়ে পূর্ণ করে দিবে। ওর প্রাণপ্রিয় বন্ধুর শেষ অনুরোধ রক্ষা করার প্রাণপণ চেষ্টা করবে ও সারাজীবন!
আনাবিয়া একহাতে মীরের হাত ধরে মীরের হাটার গতির সাথে তাল মিলিয়ে হাটছে। চোখ জোড়া ওর সমুদ্রের বিশাল ঢেউয়ের দিকে নিবদ্ধিত।
হঠাৎ করেই সমুদ্রের একটি বিশাল ঢেউ এসে আছড়ে পড়লো ওর পায়ের ওপর। ঢেউয়ের তীব্রতায় পায়ের নিচে থাকা বালি সরে গিয়ে সিড়সিড়ে অনুভূতি দিলো ওর পায়ের তলায়।
সুড়সুড়ি লেগে উচ্ছসিত হয়ে হেসে উঠলো আনাবিয়া।
“মীরি! ঢেউ নিয়ে গেলো আমাকে….”
মীরের বাহু জড়িয়ে ধরে ঢেউয়ের টানে পা বাড়িয়ে দিয়ে উচ্চস্বরে বলে উঠে আনাবিয়া। পরক্ষণেই চেহারা জুড়ে দুষ্টু হাসি ছড়িয়ে মীরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
“তুমি তো দেখি বউয়ের কেয়ার করোনা! আমাকে ঢেউ নিয়ে যেতোনা আর একটু হলে?”
“নিয়ে গেলেও আবার ফিরিয়ে দিতো। তোমার মতো খচ্চরকে ওরা হজম করতে পারতোনা।”
“আমি খচ্চর?”
চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো আনাবিয়া।
“কথায় কথায় লাফিয়ে ওঠার অভ্যাস কখনোই যাবেনা দেখছি তোমার।”
বলেই হাত বাড়িয়ে আনাবিয়াকে পাজাকোলে তুললো মীর, এক হাতে ওকে ধরে রেখে অন্য হাতে খুলে ছুড়ে দিলো পায়ের হাই হিল। তারপর শান্ত কন্ঠে বলল,
“গোসল দিবে চলো।”
“বেলা বলল আজ নাকি তুমি গোসল দেওয়াবে আমাকে?”
“হুম, ঠিক শুনেছেন।”
“খানিক আগেই না গাড়ির ভেতরে তুমি লজ্জা পাচ্ছিলে তোমার বুকে ঘুমাতে চাই শুনে। এখন গোসল দেওয়ানোর সময়ে আর লজ্জা লাগবে না?”
“উহু, তোমার চোখ বেধে রাখবো।”
“লজ্জা লাগবে তোমার, আর চোখ বাধবো আমি?”
“হু।”
মীরের গলাটা আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মীরের আর একটু কাছাকাছি গিয়ে আগ্রহভরে আনাবিয়া জিজ্ঞেস করলো,
“আজ কি আমাদের বাসর হবে মীরি?”
“প্রাসাদে ফিরে পোশাক খুলে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে একবার দেখো, যদি তোমার মনে হয় তোমার শরীরে বাসর করার মতো জায়গা আছে তবে বাসর করবো।”
সমুদ্রের ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে নির্বিকার কন্ঠে উত্তর করলো মীর৷
“তুমি কি আমাকে অপমান করলে? নোমানের মতো কি এখন আমাকেও দৈনিক শুনতে হবে যে আমার কিছু নাই?”
মীর ঠোঁট কামড়ে হাসলো, তারপর বলল,
“চুপ থাকো। নিজের ঘাড়ে নিজে বিপদ ডেকে আনতে তোমার খুব শখ।”
সমুদ্রের হাটু অব্দি পানির ভেতর আনাবিয়াকে কোলের ভেতর নিয়ে বসে আছে মীর৷ আনাবিয়ার মনোযোগী দৃষ্টি সমুদ্রের পানির ভেতর, আর মীরের দৃষ্টি নিবদ্ধিত ওর
কোমল মুখের ওপর !
আনাবিয়ার পরনের গাউনটা সমুদ্রের পাড়ে থাকা ছোটখাটো নারকেল গাছগুলোর একটিতে ঝোলানো।
ভেতরের অন্তর্বাসের ওপর চড়িয়ে দেওয়া মীরের পাতলা শার্ট খানা।
আনাবিয়া হঠাৎ উচ্ছসিত হয়ে উঠে বলল,
“দেখো, আমি আর একটা ধরেছি!”
সমুদ্রের পাড় জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে স্টিংরের এক ঝাক বাচ্চা।
দুজনে মিলে বসে বসে সেগুলোই ধরছে একটা একটা করে। যে বেশি স্টিংরে ধরতে পারবে আগামী এক সপ্তাহ সে যা বলবে অপর জনকে তা-ই মেনে চলতে হবে, সময় আধা ঘণ্টা।
মীর চুপচাপ দেখে চলেছে আনাবিয়ার কান্ডকারখানা। আনাবিয়ার কাছে স্টিংরের সংখ্যা পাঁচটি, আর মীরের কাছে মাত্র একটা।
জিতে যাওয়ার খুশিতে আনাবিয়ার ঠোঁটের ওপর ঝুলছে এক পৈশাচিক আনন্দ। মীর চুপচাপ বসে ওকে দেখছে খেয়াল করে আনাবিয়া কপট রাগ দেখিয়ে বলে উঠলো,
“তুমি বসে আছো কেন? আমার দিকে তাকানোর বহুত সময় পাবে। মাছ ধরো, নইলে কিন্তু আগামী এক সপ্তাহ তোমাকে আমার কথা শুনে চলতে হবে।”
“আমি তোমার কথা শুনতে চাই।”
“হু, নাচতে না জানলে উঠান তো বাকা হবেই।”
“আপনি ভুল ভাবছেন মিসেস। আমি ধরতে শুরু করলে আপনি হেরে যাবেন। নামীর আসওয়াদ দেমিয়ান কে হারানো সহজ নয় আগেই বলেছি। যদি কখনো দেখেন সে হেরে যাচ্ছে তবে বুঝে নিবেন সে ইচ্ছে করেই হেরেছে, অপর পক্ষকে জিতিয়ে দেওয়ার জন্য।”
“ওহ আচ্ছা! তো এখন জিতিয়ে দেখাও তো! আধা ঘণ্টা শেষ হতে আর পাঁচ মিনিট বাকি। এই পাঁচ মিনিটে তোমাকে পাঁচটা স্টিং রে ধরতে হবে। মিনিটে একটা, এইখানে বসে বসে। ধরো দেখি।”
মীর আনাবিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে নিজের ডান হাত খানা দিয়ে হাটু সমান পানির ওপর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পানির ঘূর্ণন তৈরি করে ফেললো একটা, আর তারপরমুহূর্তেই তৈরি হওয়া ঘূর্ণনটিকে পানির তল দিয়ে ধাক্কা দিয়ে একটা বড় সড় ঢেউয়ে পরিণত করে এগিয়ে দিলো ওদের থেকে খানিকটা দূরে হুটোপুটি করতে থাকা স্টিংরের ঝাকের দিকে।
পানির ঢেউটা তল দিয়ে সজোরে গিয়ে নিচ থেকে ধাক্কা দিলো স্টিংরের ঝাকে। পানির ধাক্কায় মাছের ঝাকের একাংশ উপরে উঠে গিয়ে উড়ে এসে আছড়ে পড়লো আনাবিয়ার কোলের ওপর।
আনাবিয়া অবিশ্বাস্য নয়নে তাকিয়ে রইলো ওর কোলের ভেতর লাফালাফি করতে থাকা বাচ্চা গুলোর দিকে। মীর ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে মোহনীয় কন্ঠে বলে উঠলো,
“আগামী এক সপ্তাহ তবে আমার হয়ে গেলো। যা বলবো অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে।”
মীরের নিঃশ্বাসে সুড়সুড়ি লাগায় আনাবিয়া ঘাড় বেকিয়ে সরে গিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠে তড়িতে হাতের কোশে পানি নিয়ে ঝাপটা দিলো মীরের মুখে। মীর চোখ খিচে বন্ধ করে নিয়ে এক ঝটকায় ওকে নিজের দিকে ফিরিয়ে দখল করে নিলো ওর ঠোঁট জোড়া, ঠোঁটের ওপর ঠোঁট রেখে ফিসফিসিয়ে বলে দিলো,
“প্রতিবার দুষ্টুমি করার সাথে সাথে শাস্তি হিসেবে পাবে একটা শক্ত চুমু।”
আনাবিয়া ওর নাকে নাক ঘষে দিয়ে বলে ওঠে,
“তবে তো আমি সারা রাত দুষ্টুমি করবো৷”
আনাবিয়ার কথা শেষ না হতেই ওদের থেকে প্রায় কিলো খানেক দূরে, সমুদ্র তীরের দিকে শোনা গেলো ঝাপাঝাপির ভীষণ শব্দ। দুজনেই চমকে তাকালো সেদিকে।
প্রায় কোমর সমান পানিতে একটা বিশালাকার শার্ক আর কুমিরের ভেতর লড়াই শুরু হয়েছে।
কুমিরটির বিশাল আকৃতি সত্বেও শার্কের ধারালো দাঁতের সাথে সে পেরে দিচ্ছে না৷ বারংবার তীক্ষ্ণ দাঁতের উপর্যুপরি আঘাতে জর্জরিত হয়ে উঠছে কুমিরটি। রক্তে লাল হয়ে উঠতে শুরু করেছে সমুদ্রের সে অংশ।
আনাবিয়া উঠে সেদিকে যেতে চাইলে মীর ওকে থামিয়ে দিয়ে নিজের সাথে চেপে ধরে বলল,
“ প্রকৃতিকে তার মতো করে ছেড়ে দাও শিনু। ওটা ওর খাবার, তোমার বা আমার কোনো অধিকার নেই ওর নিজে হাতে ধরা শিকারকে ছাড়িয়ে নেওয়ার, যদিনা শিকার তোমার কাছের কেউ হয়।”
মীরের কথা শুনে চুপটি করে মীরের বুকের ভেতর মাথা গুজে সেদিকে তাকিয়ে বসে রইলো আনাবিয়া। মীর ওর মুখ খানাকে সেদিক থেকে ফিরিয়ে অন্যদিকে দিয়ে বলল,
“ওদিকে তাকিয়োনা।”
কিন্তু মুখ ফেরানোর আগ মুহুর্তেই কিছু একটা চোখ পড়লো আনাবিয়ার, চমকে ও তাকালো আবার সেদিকে। কুমিরের বাচ্চাদের এক ঝাক কিলবিল করছে রক্ত মেশানো পানির ভেতর। মা কুমিরকে ইতোমধ্যে সমুদ্রের গভীরে টেনে নিয়ে গেছে বড় শার্কটি।
আনাবিয়া উত্তেজিত স্বরে মীরের বুকে আঘাত করে বলে উঠলো,
“ ওখানে কুমিরটির বাচ্চা আছে অনেকগুলো, ওরা খেয়ে ফেলবে সবাইকে! অতোগুলো বাচ্চা মারা গেলে খুব খারাপ হবে মীরি! চলো এক্ষুণি, প্লিজ!
আনাবিয়ার কথাতে অবশেষে উঠলো মীর, তারপর দ্রুত পায়ে আনাবিয়াকে সাথে নিয়ে এগোলো সেদিকে। রক্তে লাল হওয়া পানির ভেতর বাচ্চাগুলোকে খুজে পাওয়া মুশকিল। ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাগুলো এতক্ষণে হয়তো শার্কের পেটেই চলে গেছে।
মীর আনাবিয়াকে সেদিকে আসতে দেখে সেখানে থাকা শার্ক গুলো ছুটে পালালো সমুদ্রের গভীরে। আনাবিয়া দ্রুত পায়ে ছুটলো সেদিকে।
নেই, একটা বাচ্চাও নেই সেখানে। কয়েকটা বাচ্চা শুধু ভেসে আছে উলটো হয়ে, দৃশ্যমান হয়ে আছে ওর পেটের সাদা অংশ, মারা গেছে এগুলো!
হঠাৎ করেই প্রচন্ড খারাপ লাগলো আনাবিয়ার, চোখ ভরে কান্না আসতে চাইলো ওর। একটা বাচ্চাকেও ও বাচাতে পারলোনা!
পেছনফিরে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো ও মীরের দিকে। মীর ভ্রু কুচকে আশেপাশের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করে বলল,
“ওরা খেয়ে ফেলেছে সবগুলোকে আর বাকি গুলোকে খেতে পারেনি বলে মেরে রেখে গেছে। মন খারাপ করোনা শিনু, দ্যাটস দ্যা রুল অব ন্যাচার।”
আনাবিয়াকে নিজের বুকে টেনে নিয়ে মাথার ওপরে একটা শান্ত চুমু খেলো ও। আনাবিয়া সন্ধানী দৃষ্টিতে অসহায়ের ন্যায় চারদিকে চোখ বোলাতে লাগলো একটা বাচ্চা যদি জীবিত থাকে!
সেই মুহুর্তেই ওর চোখ গেলো সমুদ্রের পাড়ের দিকে। পাড়ের স্বল্প পানিতে ভাসছে একটা ছোট্ট বাচ্চা। তার শরীর থেকে চুইয়ে পড়ছে রক্ত।
মীরের আলিঙ্গন ছেড়ে আনাবিয়া ছুটলো তীরের দিকে, মীর এগোলো পেছন পেছন।
তীরে পৌছে বাচ্চাটিকে দ্রুত কোলে তুলে নিলো আনাবিয়া, বেচে আছে বাচ্চাটা, কিন্তু জখম হয়েছে খুব বাজে ভাবে!
জখম হওয়া যায়গাটা ভালোভাবে পরখ করলো ও, তারপর বাচ্চাটিকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে মীরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“একে প্রাসাদে নিয়ে যাই? এর চিকিৎসা করলেই সেরে উঠবে মীরি!”
“ শিনু, যার যে জায়গা তাকে সেখানেই রাখতে হয়। বন্যেরা বনে সুন্দর। ওকে এখানেই রেখে যাও, ও সুস্থ হলে হবে নইলে না। প্রাসাদে চিড়য়াখানা বানানোর আমার কোনো শখ নেই।”
“না, আমি একে সঙ্গে নিবো। নইলে প্রাসাদে ফিরবোনা।”
ভ্রু জোড়া কুচকে তেজি কন্ঠে বলে উঠলো আনাবিয়া। মীর ওর দিকে তাকিয়ে ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“ঠিক আছে বাবা! চলো, ওকে নিয়েই চলো।”
মীরের সম্মতি পেয়ে নেচে উঠলো আনাবিয়া, তারপর কুমিরের বাচ্চাটিকে সযত্নে বুকে ধরে নিয়ে দ্রুত পায়ে এগোলো প্রাসাদের দিকে।
বিছানার ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে কনুইয়ে ভর দিয়ে সারা শরীরে পট্টি দেওয়া কুমিরের বাচ্চাটিকে দেখে চলেছে আনাবিয়া।
বাচ্চাটা ঘুমাচ্ছে এখন, মুখ খানা তার খোলা। এখানে পৌঁছানোর পর একগাদা মলা মাছ খেতে দিয়েছে ও বাচ্চাটিকে। খেয়ে দেয়ে বাচ্চাটা এক্কেবারে ফুলে গোল হয়ে গেছে, এখন আনাবিয়ার নরম বিছানার ওমে ঘুম এসে গেছে তার।
মীর কামরায় নেই, রয়্যাল মিটিং রুমে গিয়েছে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে৷ রাতের দশটা বাজতে চলল তবুও তার ফেরার কোনো নাম নেই!
আনাবিয়া ঘড়ি দেখলো আর একবার। ক্ষিদে পেয়েছে ওর, কিন্তু মীর বলে গেছে ও আসলে একসাথে খাবে। ক্ষিদের চোটে হতাশ হয়ে উচু করে রাখা মাথাটা বিছনায় এলিয়ে দিলো আনাবিয়া। সেই মুহুর্তেই ওর কামরায় হুড়মুড়িয়ে ঢুকলো মীর।
ঢুকেই বিছনার মাঝে শুয়ে থাকা আনাবিয়ার পা জোড়ার একটা ধরে হ্যাচকা টানে আনাবিয়াকে নিয়ে এলো নিজের কাছে, তারপর ওকে এক ঝটাকায় উঠিয়ে বুকে জড়িয়ে নিয়ে নিজের কামরার দিকে যেতে যেতে বলল,
“খাবে চলো।”
“এটা কি ধরনের কাজ? ওভাবে টেনে আনলে কেন আমাকে?”
“অভ্যাস করো।”
মীরের কথা শুনে মীরের হৃষ্টপুষ্ট গলাখানা আরও একটু বেশি জড়িয়ে ধরে মীরের দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হাসি দিলো আনাবিয়া। মীর ওর এমন ডেভিল হাসি খেয়াল করে বলে উঠলো,
“তুমি যদি মনে করো তোমার এ হাসির অর্থ আমি বুঝতে পারছিনা তবে তুমি ভুল ভাবছো শিনজো।”
“ওহ আচ্ছা! কেন হাসছি বলোতো দেখি!”
নিজের কামরায় নিয়ে এসে আনাবিয়াকে বুকের ওপর থেকে বিছনায়া ধাম করে ফেলে দিয়ে মীর উত্তর করলো,
“তুমি এখনো বাচ্চা, ওসব কথা মাথাতেও এনোনা। এখন উনিশে আছো, পঁচিশের আগে কোনোভাবেই সম্ভব না।”
“তাহলে কেবল ডেমো দেখালে কেন আমাকে? বললে কেন অভ্যাস করো?
এখন তোমার আদর পাওয়ার জন্য আমাকে ছয় ছয় টা বছর অপেক্ষা করতে হবে?
একদমই না। আ’ কান্ট। ইম্পসিবল!”
মীর ওর দিকে ভ্রু তুলে তাকিয়ে বলল,
“তুমিই না আজ বিয়ের পর আতঙ্কে চুপসে গেছিলে, এখন তবে তোমার এত এনার্জি কই থেকে আসছে?
চুপচাপ খেয়ে ঘুমিয়ে যাবে আমার সাথে, ওসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো।”
“তাহলে আমি তোমার সাথে কেন ঘুমোতে যাবো? আমি ঘুমাবো আমার কামরায়, হুহ।
তোমার সাথে এক বিছানায় থেকেও যদি হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে হয় তবে তোমার সাথে কেন ঘুমাবো শুনি?”
আনাবিয়ার কথায় ওর দিকে ভ্রু কুচকে তাকালো মীর, মনে মনে ভীষণ অপ্রস্তুত হলো ও।
এই মেয়েটা এত দুষ্টু কবে কিভাবে হয়েছে সেটা ও বুঝে উঠতে পারলোনা। ভেতরে ভেতরে লজ্জা পেলেও ওপরে ওপরে নিজেকে গম্ভীর রাখার চেষ্টা করে বলল,
“দুষ্টুমি করার চেষ্টা করবেনা শিনু, যা বলি তাই শুনো। খেয়ে চুপচাপ ঘুমোবে আমার সাথে, আগে যেভাবে ঘুমোতে সেভাবে। ওসব ব্যাপার ভুলেও মাথায় এনোনা। আ’ম সিরিয়াস।”
মীরের কথা শেষ না হতেই বাইরে থেকে দরজায় টোকা পড়লো, এ পাশ থেকে নোমানের গলা ভেসে এলো, খাবার নিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে দরজায়।
মীরের অনুমতি পেতেই ভেতরে ঢুকে খাবারের ট্রেটা রেখে আনুগত্য জানিয়ে বাইরে চলে গেলো নোমান।
ওদিকে তার অনেক কাজ, সারা প্রাসাদ জুড়ে বাদশাহ আর তার শেহজাদীর বিয়ে উপলক্ষে উৎসব চলছে জমিয়ে। রয়্যাল ফ্লোরে প্রাসাদের অন্য কোনো শব্দ এসে পৌছায়না, তাই এ পাশটা নিরব হয়ে আছে বরাবরের মতো।
শুধু থেকে থেকে আনাবিয়ার খিলখিলে হাসি ছাড়া এদিকে আর কোনো শব্দই শোনা যায় না।
নোমান মেঝের সাজানো আসনের ওপর খাবার রেখে দরজা ভেজিয়ে চলে যেতেই বিছানার ওপর বসা আনাবিয়া গলা খাকারি দিয়ে দরাজ গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“একটা সত্যি কথা বলোতো!”
“হু”
গা থেকে বাইরের পোশাক খুলতে খুলতে উত্তর করলো মীর।
“তুমি কি ইমপোটেন্ট?”
শার্টের বোতাম খুলতে নেওয়া মীর ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো আনাবিয়ার দিকে, পরমুহূর্তেই তড়িৎ গতিতে এসে আনাবিয়ার শুভ্র, তুলতুলে গলাখানা নিজের ইস্পাত-দৃঢ় হাতের থাবার ভেতর নিয়ে এক টানে নিজের মুখের নিকট আনাবিয়ার মুখখানা নিয়ে এসে ওর নাকে নাক, ঠোঁটে ঠোঁট স্পর্শ করে চাপা হিসহিসে গলায় বলে উঠলো,
“আমার পুরুষত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলোনা শিনু, বিপদে পড়ে যাবে!”
আনাবিয়ার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো এক চিলতে হাসি, মীরের মতোই চাপা সুরে ও বলে উঠলো,
“বিপদে তো আমি পড়তে চাই।”
“ইয়্যু শিওর’?
মীরের নেশালো কন্ঠের প্রশ্নে শব্দ করে হাসলো আনাবিয়া, তারপর ফিচেল কন্ঠে বলে উঠলো,
“উহু, আ’ ওয়াজ কিডিং মীরি, জাস্ট কিডিং।”
মীরের হাত শিথিল হয়ে এলো, আনাবিয়ার ঠোঁটের ওপর থেকে ঠোঁট সরিয়ে নিয়ে আনাবিয়ার কানের কাছে নিয়ে এলো মীর, অতঃপর ফিসফিসে মোহনীয় কন্ঠে বলে উঠলো,
“আমার ধৈর্যের পরীক্ষা এভাবে নেওয়া বন্ধ করো শিনু! আ’ম বেয়ারলি হোল্ডিং মা’সেল্ফ ব্যাক। ইফ আ’ সামহাউ লুজ কন্ট্রোল এভার, আ’ল ডেস্ট্রয় ইয়্যু রাইট দ্যেন শিনু!”
কথা শেষ করেই ক্ষিপ্র গতিতে আনাবিয়ার কোমর জড়িয়ে ওকে কোলে তুলে নিলো মীর, এসে খাবারের ট্রের পাশে রাখা বসবার স্থানে নিয়ে নামিয়ে দিলো।
অতঃপর নিজেও পাশে বসে নিজেকে সম্পুর্ন স্বাভাবিক করে নিয়ে আনাবিয়ার মুখে খাবার তুলে দিতে দিতে ব্যাস্ত গলায় বলল,
“খেয়েই ঘুমোবে, দুষ্টুমি করবেনা একদম! গুড গার্লের মতো কথা শুনবে আমার, এই উয়্যিকটা কিন্তু আমার মনে রেখো।”
মীরের হাত থেকে খাবার মুখে নিতে নিতে আনবিয়া ভ্রু তুলে বলল,
“তুমি এত ভদ্র সভ্য সুশীল সংযমী হলে কবে থেকে? তোমার বিগত রেকর্ড তো এসব কথা বলেনা!”
আনাবিয়ার দিকে তাকিয়ে হাতে বেশি পরিমাণ খাবার নিলো মীর, ওর মুখের ভেতর পুরোটা পুরে ওকে চুপ করিয়ে দিয়ে শাসনের ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
“আর একটাও কথা না, চুপচাপ খাও।”
প্রাসাদের বেইজমেন্টের একটি নির্দিষ্ট কক্ষে হাত বাধা অবস্থায় ঝুলে আছে একটি মেয়ের মৃতদেহ, শরীরটা এখনো গরম। কিছু মুহুর্ত আগেই প্রাণপাখিটা উড়াল দিয়েছে তার।
চেনার বিন্দুমাত্র উপায় নেই।
মুখমণ্ডল ব্যাতিত শরীরের কোথাও সামান্য চামড়া অবশিষ্ট নেই আর। সমস্ত শরীর জুড়ে রক্ত মাখা, উন্মুক্ত হয়ে আছে তার শরীরের সমস্ত রক্তরাঙা মাংস, পেশী, রক্তনালী!
মাংসের ভেতর থেকে কিয়ৎক্ষণ পর পর গলগলিয়ে বের হওয়া রক্তস্রোত চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে পায়ের আঙুল বেয়ে। সেগুলো গিয়ে জমা হচ্ছে পায়ের নিচে রাখা একটি স্টিলের বৌলে।
পেশী গুলো কেঁপে কেঁপে উঠছে এখনো, গরম আভা বের হচ্ছে সমস্ত শরীরটা থেকে! পাশেই রাখা তার সদ্য তুলে ফেলা রক্তাক্ত চামড়াটা।
হামদান দাঁড়িয়ে আছে অন্যপাশে, ঝুলন্ত মেয়েটির থেকে কিছুটা দূরে। বুকের ভেতরটা এখনো ধুকপুক করছে ওর। এতক্ষণ যাবৎ মেয়েটির প্রচন্ড যন্ত্রণায় করা আর্তচিৎকারে হাপিয়ে উঠেছে ওর সমস্ত মন মস্তিষ্ক।
ওপাশ থেকে বেসিনে নিজের রক্তাক্ত হাত জোড়া পরিষ্কার করতে করতে মীর বলে উঠলো,
“চামড়াটা লবণ দিয়ে রাখো হামদান, নইলে নষ্ট হয়ে যাবে।”
“ইয়োর ম্যাজেস্টি, রঙটা কি হবে?”
“মেরুণ, যে ব্লাডটুকু জমা হয়েছে সেটুকু নিয়ে যাও। পারফেক্ট কালার না এলে ওর সাথে এক্সট্রা কালার মিশিয়ে দিবে৷”
“আপনি যা বলবেন ইয়োর ম্যাজেস্টি।”
হাত ধুয়ে মীর এগোলো বেইজমেইন্টের এক্সিটের দিকে। বেইজমেন্ট থেকে বেরিয়ে সোজা চলে গেলো রয়্যাল ফ্লোরে, নিজের কামরায়।
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই ওর চোখে পড়লো বিছানার ওপর উঠে বসা আনাবিয়াকে। ওকে দেখা মাত্রই আনাবিয়া প্রশ্ন ছুড়লো,
“কোথায় গেছিলে তুমি?”
“আমার প্রাণের জন্য একটা গিফট রেডি করতে গেছিলাম।”
আনাবিয়ার কাছে এগিয়ে এসে ওর থুতনি ধরে নাড়িয়ে দিয়ে বলল মীর। পরণের পাতলা সাদা রঙা টি শার্টে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ লেগে আছে ওর।
আনাবিয়া ওর পেটে একটা গুতা মেরে নিজের থেকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“সরোহ, বিশ্রি গন্ধ আছে তোমার গা থেকে। আর কিসের দাগ লাগিয়েছো সারা গায়ে?”
মীর প্রতিউত্তরে কিছুই বলল না, মিষ্টি করে হেসে দুহাতে টি শার্টটা খুলে ফেলে ওয়াশরুমের দিকে এগোতে এগোতে বলে উঠলো,
“গোসলে যাচ্ছি, গোসল দিতে চাইলে চলে এসো।”
মীরের কথায় মুখ বেকিয়ে আবার বিছানায় শোয়ার তোড়জোড় করতে করতে আনাবিয়া বলল,
“কিছু না করে রাত্তির বেলা গোসল দেওয়ার কোনো শখ নেই আমার। তুমি দাও গোসল, হুহ!”
“তাহলে এখন কিছু করি? একটা শক্ত চুমু খেলে হবে?”
ওয়াশরুমের দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে দুষ্টু হেসে বলল মীর।
“চুমু খেলে গোসল দিতে হয় জানতাম নাহ!”
বিড়বিড় করে বলল আনাবিয়া, পরক্ষণেই চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়তে পড়তে বলল,
“তোমার গোসল তুমি করো, আমাকে সকাল বেলা ইম্পেরিয়াল ক্রেস্টে ফিরতে হবে, তোমার সাথে কাহিনী করার মতো সময় আমার নেই।”
আনাবিয়াকে কাল বোর্ডিংয়ে ফিরে যেতে হবে মনে পড়তেই চমকালো মীর, ওর তো মাথাতেই ছিলোনা!
ওয়াশরুমের দরজা থেকে আবার বিছানার নিকট এগিয়ে এসে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা আনাবিয়ার দিকে ঝুকে ও অনুরোধের সুরে বলল,
“কালকেই চলে যাবে? দুদিন পর গেলে হয়না?”
“একমাস পর ফাইনাল এক্সাম, কাল থেকেই ক্লাস শুরু। দুদিন পর গেলে এই দুটোদিন ক্লাস কে করবে? তোমার নানা?”
“আদর না পেয়ে বউয়ের আমার মাথা গরম!”
বলেই বিছানার নিকট থেকে সরে গিয়ে মীর গেলো টেবিলের ওপর রাখা ওর ফোনের কাছে।
ওদিকে চাদরের নিচে মীরের উদ্দ্যেশ্যে মুখ বেকিয়ে ঘুরে শুয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতে লাগলো আনাবিয়া।”
রাতের এখন প্রায় তিনটা, মীর ফোন নিয়ে কল লাগালো নওয়াসের কাছে।
এত রাতে মীরের কল পেয়ে শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকা নওয়াসের ঘুম পালালো রকেটের গতিতে। ধড়মড়িয়ে উঠে কল রিসিভ করে কানে ধরতেই এপাশ থেকে মীর বলে উঠলো,
“গরমের ছুটি দুদিন বাড়িয়ে দাও নওয়াস৷”
বলেই কল কেটে দিলো। ওপাশ থেকে নওয়াস বিছানার ওপর ভ্যাবাচেকা খেয়ে হতভম্ব হয়ে বসে রইলো।
মীর ফোনটা আবার জায়গায় রেখে বিছানার কাছে গিয়ে আনাবিয়ার গায়ের ওপর থেকে এক টানে চাদরখানা উঠিয়ে দুহাতে ওকে এক ঝটকায় নিজের দিকে টেনে এনে ওর বাহুতলে ধরে উঠিয়ে নিলো নিজের বুকের ওপর, এরপর বুকের সাথে ওকে দুহাতে চেপে মিশিয়ে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে এগোতে এগোতে বলল,
“কিছু না করলেও এখন তোমাকে আমার সাথে গোসল দিতে হবে।”
সকাল বেলা ঘুম ভেঙে নিজেকে মীরের শক্ত আলিঙ্গনের ভেতর আবিষ্কার করলো আনাবিয়া। চোখ তুলে মীরের ঘুমন্ত মুখশ্রীর তাকালো একবার।
বিশাল পাহাড়ের ন্যায়— মজবুত, অথচ শান্ত ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে আছে মীর। ওর চওড়া বুকে জানালার সোনালি পর্দার ফাক গলিয়ে এসে পড়ছে সূর্যের সোনালি আলো।
সমস্ত মুখ খানা জুড়ে ফুটে আছে এক স্নিগ্ধ কোমলতা, যেন এই কঠিন দুনিয়ার সমস্ত ভার নামিয়ে আজ নির্ভয়ে ঘুমোচ্ছে ও।
ঘন চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে, কয়েক গোছা এসে পড়েছে কপালের ওপর! ঠোঁটের কোণে ফুটে আছে কিঞ্চিৎ আরামদায়ক হাসি, অদ্ভুত প্রশান্তিতে ছেয়ে আছে ওর সমস্ত মুখখানা!
আনাবিয়া আলতো করে মীরের আলিঙ্গন থেকে ছাড়িয়ে নিতে লাগলো নিজেকে, কিন্তু মীরের শক্ত বাহুবন্ধনী থেকে নিজেকে ছাড়াতে বেশ বেগ পেতে হলো ওর। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে সন্তর্পণে বিছানা ছেড়ে উঠে চলে গেলো ও ওয়াশরুমে।
কিয়ৎক্ষণ বাদে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে সামান্য তৈরি করে নিলো ও। মীর ঘুমোচ্ছে এখনো।
বিছানায় উঠে এসে মীরের পাশ ঘেঁষে বসলো আনাবিয়া, অতঃপর মীরের কপালপরে এসে পড়া চুলগুলো আলতো স্পর্শে সরিয়ে দিয়ে মীরের মাথাটা জুড়ে পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিলো কিছুক্ষণ।
ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে এবার হাত সরিয়ে বিছানা থেকে নামতে গেলো আনাবিয়া, কিন্তু তার আগ মুহুর্তেই মীর খপ করে ধরে ফেললো ওর হাতখানা। তারপর আবার হাতখানা নিজের মাথার ওপর টেনে এনে রেখে ঘুমজড়ানো কন্ঠে বলে উঠলো,
“ আরও!”
মীরের এই ছোট্ট আবদারে শব্দ করে স্নিগ্ধ হাসলো আনাবিয়া, মীরের পাশে শুয়ে পড়ে মীরের মাথাটা নিজের বুকের সাথে লাগিয়ে শব্দ করে একটা চুমু খেলো, তারপর মীরের রেসমসম চুলের ভেতর আঙুল চালনা করতে করতে নরম গলায় বলল,
“আজ এখনো ঘুমিয়ে আছো যে! তুমি তো সূর্য ওঠার আগে হারিয়ে যাও, তোমার ভাষায় যাকে তুমি বলো ‘নিরুদ্দেশ হতে চলেছি’!”
“বউ কে ছেড়ে যেতে ইচ্ছা করছে না!”
আনাবিয়ার বুকের মাঝে মুখ ঘষে বলে উঠলো মীর, দুহাতে আবার জড়িয়ে ওকে মিশিয়ে নিলো নিজের সাথে। আনাবিয়া ওর গলা জড়িয়ে ধরে দুষ্টু গলায় বলল,
“যেহেতু আমার সাথে তোমার কিছু হচ্ছেনা তাই আমি তোমার সেমি বউ। সেমি বউকে ছেড়ে যেতে কোনো অসুবিধা হওয়ার তো কথা না। ফাইনাল বউ হলে হয়তো একটু কষ্ট হতো।”
“তুমি এতটা ফাজিল কিভাবে হয়েছো বলোতো শিনু! কাদের সাথে মেশো তুমি?”
“এসব কথা বলার জন্য কারো সাথে মেশা জরুরি নয় মীরি। এসব এমনিতেই শেখা যায়। ইম্পেরিয়াল ক্রেস্টের অপজিটে একটা বিশায়ায়াল লাইব্রেরী আছে দেখেছো?”
“হু!”
“ওইটার রোম্যান্স সেকশনের যত আলট্রা প্রো ম্যাক্স ইরোটিক ডার্ক রোম্যান্স আছে সব পড়ে মুখস্ত করে ফেলেছি। ভেবেছিলাম তোমার সাথে এক মাথা দিয়ে সব রিমেক করবো, কিন্তু তুমি দেখি ব্রহ্মচারীদের মতো আচরণ করা শুরু করেছো!”
মীর চমকে মুখ তুলল আনাবিয়ার বুকের ওপর থেকে, অতঃপর অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে আনাবিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“এসব বই তোমাকে কে পড়তে দিয়েছে? ওখানে তো টুয়েন্টি-টু মিনিমাম এজ লিমিট দেওয়া আছে! তুমি কিভাবে পড়েছো? কে পড়তে দিয়েছে তোমাকে?”
“আমার একজন রুমমেট ছিলো এভলিন নামে, সে এখন ভার্সিটিতে। ওকে দিয়ে আমার এজ লিমিটের বাইরের বইগুলো কব্জা করেছি আমি। বুঝেছেন মিস্টার নামীর আসওয়াদ দেমিয়ান?”
মীর ভ্রুজোড়া কিঞ্চিৎ কুচকে ভর্ৎসনার কন্ঠে বলল,
“ওসব বই কেন পড়েছো তুমি? আজকের পর থেকে ওসব বইয়ে হাত দেওয়া তোমার জন্য সম্পুর্ন নিষিদ্ধ! ওই এভলিন মেয়েটার সাথে তবে তোমার এত সখ্যতা এই কারণে, বই পাচার করো!”
“তুমি যে এত নাক সিটকাচ্ছো, তুমি এই প্রায় দেড়শ খানা বছর ধরে কি কি করেছো তার সবটুকু না জানলেও বেশিরভাগই আমার জানা!
আমি সামান্য কখানা বই পড়েছি! আর তুমি?
তোমার দাসী ছিলো শয়ে শয়ে, তাদের সাথে রোজ রাতে বেড শেয়ার করতে তুমি!
কাউকে দ্বিতীয় বার কখনো স্পর্শ করতে না, কাউকে কাউকে তো মেরেই ফেলতে! জানিনা ভেবেছো?”
শেষোক্ত কথা গুলো বলতে গিয়ে ফুলে উঠলো আনাবিয়ার নাকের পাটা, ক্রোধে রক্তিম হয়ে এলো চোয়াল জোড়া। মীরের আলিঙ্গন থেকে নিজেকে এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে বসলো ও।
মীরের শান্ত চোখজোড়া হঠাৎ করেই কঠিন হয়ে এলো, চোয়ালদ্বয় শক্ত করে ও শুধালো,
“কে বলেছে তোমাকে এসব? আর কি কি শুনেছো তুমি? কার থেকে শুনেছো?”
“তুমি যা করেছো অতীতে করেছো, তোমার অতীতের কোনো কাজই আমি মনে রাখবোনা বা রাখিনি।
আমি তোমার স্ত্রী হবো জানার পর থেকে তুমিযে অন্য কোনো মেয়েকে স্পর্শ করোনি এতেই আমি খুশি।
তবে হ্যাঁ, কখনো যদি করো, ভুল করেও যদি করো তবে এই প্রাসাদে আমি রক্তের বন্যা বইয়ে দেবো, মনে রেখো!
হয় সেই মেয়ে দুনিয়া ছাড়বে নয়তো আমি।”
মীর উঠে বসে ক্রোধে পরিপূর্ণ আনাবিয়াকে টেনে নিলো নিজের কোলের ভেতর, অতঃপর আনাবিয়ার কাঁধের ওপর থেকে পোশাক সরিয়ে উন্মুক্ত করে সেখানে নিজের ঠোঁট স্পর্শ করে বলল,
“ওসব অতীত শিনু। আমি যদি এখন কিছু করতাম তবে তোমার রাগ করার অধিকার ছিলো অবশ্যই। কিন্তু আমি তো এখন কিছুই করিনি, করবোও না!
তবুও তোমার যদি কোনো সন্দেহ থেকে থাকে তবে তুমি প্রাসাদের সমস্ত দাসীকে আজ এই মুহুর্তেই শেষ করে দিতে পারো, আমি তোমাকে কিছুই বলবোনা, কখনোই!”
“হু হয়েছে, আর নকশা করতে হবেনা সরো। ওপাশে আমার কোকো কি করছে কে জানে?”
“কোকোটা আবার কে?”
“আমার কুমিরের বাচ্চা, ওর নাম রেখেছি কোকো। ক্রোকোডাইল এর শর্ট ফর্ম।”
“যেভাবে সম্বোধন করলে, ‘আমার কোকো’! আমাকে তো আজ পর্যন্ত কখনো এভাবে আদর করে ডাকোনি!”
“অবশ্যই ডেকেছি, মনের কান দিয়ে শুনো শুনতে পাবে।”
বলে বিছানা ছেড়ে উঠে নিজের কামরায় যেতে নিলো আনাবিয়া। পেছন থেকে মীর আবার শুধালো,
“ওসব কথা কে বলেছে তোমাকে? বলে যাও।”
“হু বলি, আর তুমি তাদের গিয়ে কুপিয়ে আসো!”
“কিচ্ছু করবোনা, প্রমিজ।”
“তোমার ও প্রমিজ তুমি রাখতে পারবেনা আমি জানি৷ তাই চুপ থাকো।”
এক পেট ভরপুর ছোটমাছ খেয়ে কোকো এখন হাপাচ্ছে। তার পেটে আর বিন্দুমাত্র জায়গা নেই তবুও সে আরও খাবে।
আনাবিয়া মাছের ছোট্ট ট্রে টা ওর সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে চোখ পাকিয়ে বলে উঠলো,
“আর না কোকো, তুমি ফুলে টমেটো হয়ে গেছো। বেশি খেলে তখন তুমি ফেটে যাবে৷”
আনাবিয়ার কথা কিঞ্চিৎ বুঝলো কোকো, ট্রে টা সরিয়ে নেওয়ায় বেশি দুঃখ পেলো। মুখ নামিয়ে সরে গিয়ে চুপটি করে বসে রইলো বিছানার এক কোণে।
“ওরে বাপরে! পুচকুর দেখি আবার অভিমানও আছে!”
ঠোঁট টিপে হেসে বিছানায় শুয়ে কোকোর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো আনাবিয়া৷
মীর বেরিয়ে গেলো কিছুক্ষণ আগে। যাওয়ার আগে চাপাচাপি করে ওকে চুমু খেয়ে গেলো কয়েকটা, বিউটিবোনের কাছে বানিয়ে দিয়ে গেলো একটা মেরুণ রঙা দাগ। ওদিকে নেই ব্যাডা এদিকে আছে!
কোকো পিঠে আদর পেয়ে ভুলে গেলো অভিমান। খুশি মনে গুটি গুটি পায়ে এসে শুয়ে পড়লো আনাবিয়ার বাহুর নিকট। শুয়েই ঘুম, হা করে ঘুম!
মীর নোমানকে দিয়ে কোকোর জন্য আলাদা থাকার জায়গার ব্যাবস্থা করিয়েছে রাতেই, কিন্তু আনাবিয়া ওকে সেখানে রাখতে নারাজ, কোকো তার বিছানাতেই থাকবে। মীর এতবার করে বলল যে বাচ্চাটা বিছানা নষ্ট করে ফেলবে কিন্তু আনাবিয়া শুনলে তো!
এমন সময় আনাবিয়ার কামরার বাহিরের দরজাটায় শব্দ হলো কিঞ্চিৎ। আনাবিয়া মাথা উঁচু করে তাকালো সেদিকে। কারো সাড়া শব্দ না পেয়ে আবারও মাথা গুজলো বালিশে, রাতে ওর ঘুম হয়নি তেমন, মীরের জন্য ওকে শেষ রাতে আবার গোসল করতে হয়েছে অকারণে। এখন ঘুমে ওর চোখ ঢুলুঢুলু।
ইম্পেরিয়াল ক্রেস্ট থেকে মেসেজ দিয়েছে গরমের ছুটি আরও দুদিন বাড়ানো হয়েছে, এই মীর অসভ্যটার জন্য ক্লাস দুদিন কম পাবে এবার সকলে।
এমন সময়ে দরজার কাছে শব্দ হলো আবারও। আনাবিয়া উঠলো এবার, বিছানা থেকে নেমে গিয়ে দরজা খুলে সামনে কাউকেই দেখতে পেলোনা।
কিন্তু পরক্ষণেই ওর চোখ গেলো নিচের দিকে। বাচ্চা একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওর পায়ের কাছে। মাথা উঁচিয়ে অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে সে ভীষণ উচ্চতার আনাবিয়ার দিকে, এতটা উঁচু করেছে যে আর একটু হলে দড়াম দিয়ে পেছনে পড়ে যাবে৷
ওকে দেখে আনাবিয়া মিষ্টি হেসে হাটু মুড়ে বসলো সেখানে। মেয়েটার বিস্মিত দৃষ্টিও সেইসাথে নামলো ওর মুখপানে চেয়ে। বিস্ময়াভিভূত হয়ে ছোট্ট মেয়েটা বলে উঠলো,
“তুমি কত্ত সুন্দর!”
আনাবিয়া স্নিগ্ধ হেসে রিনরিনে গলায় বলল,
“তাই? আমাকে ছুয়ে দেখবে?”
আনাবিয়া বলতেই মেয়েটা এগিয়ে এলো ওর একেবারে কাছে এসেই নিজের ছোট্ট ছোট্ট হাতজোড়া দিয়ে আগলে নিলো আনাবিয়ার মুখ খানা, খুশিতে ঝকমক করে উঠলো মেয়েটার নীলাভ চোখ জোড়া। আনন্দে আত্মহারা হয়ে সে বলে উঠলো,
“তুমি কত্ত নরম!!”
খিলখিল করে হেসে উঠলো আনাবিয়া। মীর ওকে দিনে দশবার এই মেয়েটার মতো করেই প্রশংসা করে, ঠিক এমন মুগ্ধ চোখে চেয়ে, এভাবে ওর মুখ খানা হাতের ভেতর নিয়ে।
“এখানে কিভাবে এসেছো তুমি? কে আছে তোমার সাথে?”
আনাবিয়ার প্রশ্নে মেয়েটি চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি ফেলে ফিসফিসিয়ে উত্তর দিলো,
“কাউকে বলবেনা যেন, আমি না পালিয়ে এসেছি!”
“তাই? কোথা থেকে পালিয়েছো তুমি?”
“আমার বাসার সবাই মারা গেছে বলে ওরা আমাকে এখানে নিয়ে চলে এসেছে, আরও অনেকে আছে সেখানে আমার মতো। কিন্তু সেখানে কয়টা বড় বড় দজ্জাল মহিলা আছে এরা খুব বকে আমাকে, তাই আমি পালিয়ে এসেছি।”
মেয়েটির কথা শুনে আনাবিয়ার হাসি মুখে আধার নেমে এলো, এই মেয়েটির কেউ নেই!
ওরও কেউ নেই, তবুও ওর মীরি আছে। ওর মীরি একাই একশ জন, ওর কখনো কারো অভাব মনে হয়নি এখনো পর্যন্ত!
সর্বক্ষণ মীরিকে সবরকম পরিস্থিতিতে নিজের পাশে ছায়ার মতো পেয়েছো ও, পরিবার বলতে ও শুধু মীরিকেই বোঝে। আর জায়ান চাচাজান, নওয়াস চাচাজান, হামদান, বেলিন্ডা, নোমান, ফারিশ এরা ওর খুব কাছের মানুষ, কিন্তু মীরির উর্দ্ধে ওর কেউ না!
“কি নাম তোমার? আর তোমার পরিবারের সবাই মারা গেলেন কিভাবে?”
“আমার নাম ক্যাথরিন, বাবা আমাকে ক্যাথি বলে ডাকতেন। কিন্তু বাবা আর নেই, কেউ নেই আর! সবাই মরে গেছে!”
বলতে বলতে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো ক্যাথরিন। আনাবিয়া তড়িতে ওকে নিজের বুকে টেনে নিয়ে বলে উঠলো,
“আরে আরে, কাঁদেনা বাচ্চা আমার!
যারা চলে গেছে তারা কি আর ফিরে আসবে বলো? তুমি তাদের জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করবে সবসময়, ঠিক আছে?”
“আমি জেইসাস এর কাছে সবসময় প্রার্থনা করি যেন আমার বাবা মাকে, সব্বাইকে হ্যাভেনে নেয়।”
দুহাতে চোখ মুছে বলল মেয়েটি। আনাবিয়া ওকে বুক থেকে সরিয়ে নিজের সামনে নিয়ে এসে বলল,
“এইতো, খুব ভালো! খেয়েছো তুমি সকালে?”
মেয়েটা মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো, আনাবিয়া বেলিন্ডাকে ডাকলো সাথে সাথেই। বেলিন্ডা এদিকে এসে ক্যাথরিন কে দেখে কিঞ্চিৎ অবাক হলো, আনাবিয়া ওকে সব বলতেই ও বলল,
“শেহজাদী, এদেরকে গতপরশুই প্রাসাদে নিয়ে আসা হয়েছে। ওয়ারদিচায় ওদের দুই খ্রিস্টান পরিবারের ভেতর কোনো কারণে ঝামেলা হয়েছে, দুই পরিবার দুরকম বিশ্বাসে বিশ্বাসী সেটা নিয়েই ঝামেলা বেধেছে, পরে সেটা দুই পরিবার থেকে ছড়িয়ে পড়েছে দুই গ্রুপে।
সেখানেই এই মেয়েটার পুরো ফ্যামিলি প্রাণ হারিয়েছে। পনেরো জনের ভেতর থেকে ও একাই বেচে আছে।
আনাবিয়া মেয়েটির মুখের দিকে তাকালো একবার, শুকনো মুখে ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে সে আনাবিয়ার দিকে, চোখ জোড়া মায়ায় ভরপুর।
বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১১+১২
“ওর জন্য খাবার নিয়ে এসো বেলা।”
আনাবিয়ার আদেশ পেতেই বেলিন্ডা আনুগত্য জানিয়ে দ্রুত পায়ে এগোলো ক্যাথরিনের জন্য খাবার নিয়ে আসতে। আনাবিয়া মেয়েটিকে আবার নিজের কাছে টেনে নিয়ে স্নেহপূর্ণ কন্ঠে বলল,
“এখন থেকে তুমি আমার কাছে থাকবে, বেলিন্ডার সাথে। তোমার নাম আজ থেকে আর ক্যাথরিন নয়, ইয়াসমিন। মনে থাকবে?”
মেয়েটি মাথা নাড়ালো দ্রুত গতিতে, মুখে ফুটে উঠলো বিশ্বজয়ের হাসি, এই পরীর মতো সুন্দর মেয়েটার কাছে থাকতে পারবে ভেবেই খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠলো ওর চোখজোড়া।
