বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১৫+১৬

বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১৫+১৬
রানী আমিনা

রাতের এখন প্রায় বারোটা। নিজের বিছানায়
এলোমেলো হয়ে ঘুমিয়ে আছে লেট্যুস কাটের শর্টস আর টপ পরিহিত আনাবিয়া।
ছোট্ট কোকো ঘুমিয়ে আছে ওর বুকের ওপর। সন্ধ্যা বেলাতেই জম্পেস একটা গোসল দেওয়া হয়েছে তাকে। চকচক ঝকঝক করছে তার সমস্ত শরীর। খাবারের ভারে পেটটা ঢোল হয়ে আছে।
আনাবিয়া রাতের খাবার খায়নি। মীর প্রাসাদে ফেরেনি এখনো। মিটিং রুম থেকে নটার দিকে কল করে বলেছে খেয়ে নিতে, কিন্তু আনাবিয়া মীরের সাথে খাবে বলে খায়নি তখন। মীরের জন্য অপেক্ষা করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়েছে।
কিছুক্ষণ বাদেই বাইরে বারান্দায় শোনা গেলো মীরের পদধ্বনি, মৃদু গম্ভীর স্বরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা নোমানকে জিজ্ঞেস করলো,

“আমার শিনু খেয়েছে?”
“ শেহজাদী এখনো খাননি ইয়োর ম্যাজেস্টি, আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এখন ঘুমিয়ে আছেন।”
ভারী ব্যাস্ত পায়ে কামরায় ঢুকলো মীর। গা থেকে বাইরের পোশাক খুলে ছুড়ে দিলো কোথাও। তারপর গায়ের ওপর একটা পাতলা শার্ট চড়িয়ে দিয়ে সোজা আনাবিয়ার কামরায় ঢুকলো।
বিছানার দিকে তাকাতেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো মীরের। কোকোর বাচ্চাটা আনাবিয়ার বুকের ওপর শুয়ে আছে। মীর গিয়ে কোকোর লেজ ধরে উঁচু করে তুললো নিজের সামনে, কাঁচা ঘুম ভেঙে নিজেকে শূন্যে পেয়ে হাত পা ছুড়তে লাগলো কোকো। মীর ওর লেজ ধরে বাইরে নিয়ে যেতে যেতে বলে উঠলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“টাইমস আপ বাডি, ইট’স মাই টার্ন ন্যাও।”
তারপর সোজা নিয়ে গিয়ে বারান্দায় থাকা নোমানের গায়ে ছুড়ে দিয়ে এলো। ওপাশ থেকে নোমানের চমকে ভড়কে যাওয়া চিক্কুর শোনা গেলো সাথে সাথেই।
মীর ফিচেল হেসে বিছানায় উঠে নিজেই শুয়ে পড়লো আনাবিয়ার বুকের ওপর। দুহাতে ওকে জড়িয়ে নিয়ে চুমুর আক্রমণ চালালো আনাবিয়ার সমস্ত মুখমণ্ডল জুড়ে।
একের পর এক চুম্বনের তুমুল বর্ষণে চমকে ঘুম থেকে উঠে গেলো আনাবিয়া। ওকে জাগতে দেখে ওর নাকে নাক ঘষে মীর আদুরে গলায় শুধালো,

“আমার শিনু খাবে না?”
কিন্তু আনাবিয়াকে নিজ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কোনো সুযোগ না দিয়ে পরক্ষণেই আনাবিয়ার ঠোঁট জোড়া দখল করে নিলো প্রগাড় চুম্বনে।
দীর্ঘক্ষণ পড় ছেড়ে দিতেই আনাবিয়া ক্ষিপ্র গতিতে দুহাতে মীরের গলা টিপে ধরে ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলল,
“এই শালা! কিছু করবেনা বলে রেখেছো তো চুমু খাও কেন?”
মীর চোকড হওয়ার অভিনয় করে চেপে যাওয়া গলায় অতি কষ্টে বলে উঠলো,
“একটু চুমু খেলে কিছু হয়না!”
“এই তুমি আর আমাকে টাচ করবানা, যেদিন কিছু করবা সেদিন টাচ করবা। এর আগে যদি করেছো তবে তোমাকেহ….!”

“এত রাগ শরীরের জন্য ভালোনা, খেয়ে নেবে চলো। সময় হলে তোমার এখনকার বাকি থাকা আদর সব এক রাতে পুষিয়ে দেবো।”
আনাবিয়াকে পুরো বাক্যটা শেষ করতে না দিয়ে ওর চোয়াল টিপে দিয়ে বলল মীর।
“খাবোনা আমি।”
মীরের হাত খানা এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে ঝাঝিয়ে উঠে বলল আনাবিয়া। মীর দ্বিগুণ বেগে ওকে নিজের বুকে টেনে নিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে বলল,

“খেতেই হবে। রাতে না খেয়ে ঘুমানো যাবে না একদম।”
“ঠিক আছে! আমি ওই খাবার খাবোনা৷ ক্র‍্যাব খাবো আমি, কিং ক্রাব, সমুদ্রে থেকে ধরেই রান্না করা কিং ক্র‍্যাব।
এর বাইরে আমি আর কিছু খাবোনা। পারলে খাওয়াও, নইলে আমি ঘুমোলাম।”
বলেই আবার ঘুমোনোর প্রস্তুতি নিলো আনাবিয়া।
মীর হাসলো, মেয়েটা ওর হাড় মাংস জ্বালিয়ে খাচ্ছে জন্ম থেকে। আজ পর্যন্ত ওর কখনো বিরক্তি আসেনি, বরং মেয়েটার রাগের চোটে ফুলে ওঠা নাকের পাটা দেখে গলে গেছে ওর হৃদয়।
আনাবিয়ার সন্ধানী চোখ জোড়া এতক্ষণে খুজলো কোকোকে। ওকে কোথাও দেখতে না পেয়ে আনাবিয়া ঘুরে বসে প্রশ্ন করলো,

“আমার কোকো কই?”
“বাইরে নোমানের গায়ে ছুড়ে দিয়ে এসেছি।”
আনাবিয়া রেগেমেগে কিছু বলতে যাবে তার আগমুহুর্তেই আনাবিয়ার কোমর ধরে ওকে হ্যাচকা টানে নিজের বা কাধে উপুড় করে উঠিয়ে নিলো মীর। অতঃপর বিছানা থেকে নামতে নামতে বলল,
“চলো তোমাকে কিং ক্র‍্যাব খাইয়ে নিয়ে আসি৷”
আনাবিয়া ছাড়া পাওয়ার জন্য চিৎকার চেচামেচি করে প্রাসাদ মাথায় তুলে মীরের পিঠে চড় চাপড় দিয়ে উদ্ধার করে ফেললো, কিন্তু ছাড়া পেলোনা!
মীর ওকে কাধে নিয়ে দৃঢ় পায়ে হেটে এগোলো প্রাসাদের এক্সিটের দিকে।

সমুদ্রের ভেজা ভেজা বালির ওপর মীরের গায়ের পাতলা শার্টটা গায়ে চড়িয়ে বসে আছে আনাবিয়া।
মৃদু বাতাসে শার্টের নিচের কোণা গুলো দুলছে থেকে থেকে। ওর শুভ্র রঙা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে বারে বারে এসে পড়ছে মুখের ওপর। বিরক্তি নিয়ে সেগুলো গুজে দিচ্ছে ও কানের পেছনে।
চোখ জোড়া ওর নিবদ্ধিত সুমুদ্রের কোমর সমান পানির ভেতর দাঁড়িয়ে কিং ক্র‍্যাব শিকার করতে থাকা মীরের দীর্ঘাবয়বের দিকে।
আনাবিয়ার ডান দিকে উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে একটা বড়সড় বনফায়ার। সদ্য দেওয়া শুকনো কাঠ গুলো কড় কড় শব্দ করে পুড়ছে। ধোঁয়াগুলো কুন্ডলী পাকিয়ে উড়ে চলেছে আকাশের দিকে।
আকাশে আজ চাঁদ নেই, তবে ঝিকিমিকি তারায় পরিপূর্ণ সমস্ত আকাশ। খোলা আকাশের নিচে বসে বসে মীর কে আদিম পুরুষদের মতো হাতে বর্শা নিয়ে কিং ক্র‍্যাব শিকার করতে দেখতে দেখতে আনাবিয়ার মন ভরে উঠলো ভালো লাগায়।
হঠাৎই মনে হলো এই সমগ্র পৃথিবীতে আজ এই মুহুর্তে জেগে আছে ওরা দুজন, শুধুমাত্র ওরা দুজন। ঘুমিয়ে পড়েছে বাকি সমস্ত কিছু!

এই দুই আদিম সত্তার একজন চেষ্টা করে চলেছে তার সঙ্গিনীর জন্য খাবার জোগাড়ের, অন্যজন মুগ্ধ চোখে দেখে চলেছে তার মন রক্ষার্থে রাতের তৃতীয় প্রহরে সমুদ্রের কোমর সমান নীল পানিতে দাঁড়িয়ে থাকা তার অত্যন্ত ব্যাক্তিগত পুরুষকে।
আনাবিয়ার ভাবনার মাঝেই হঠাৎ সমুদ্রের ভেতর থেকে ভেসে এলো মীরের বিশ্বজয়ীর হাসি, আনাবিয়া চমকে মনোযোগ দিলো মীরের দিকে। হাতে মীরের মস্ত একটা কিং ক্র‍্যাব।
দুহাতে কিং ক্রাবটাকে উলটো করে ধরে সমুদ্রের পাড়ে নিয়ে এলো মীর। আনাবিয়া উচ্ছসিত হয়ে উঠে এগিয়ে গেলো মীরের দিকে।
কিং ক্রাবটির লম্বা ধারালো হাত জোড়া সাড়াশির মতো বার বার ধরতে গেলো মীর কে। মীর সতর্কতার সাথে সেটাকে সরিয়ে ধরলো নিজের থেকে।
আনাবিয়া এসে দাড়ালো মীরের সামনে, চোখে মুখে ওর খুশির ছটা। মীর ওর চকমকে চোখের দিকে দৃষ্টি দিয়ে স্নেহপূর্ণ কন্ঠে বলে উঠলো,

“এবার আমার শিনুর মন আর পেট দুটোই ভরবে৷”
আনাবিয়া শব্দ করে হেসে উঠলো ওর কথায়। কিন্তু তখনি অসাবধানতার কারণে কিং ক্রাবটার হাত পৌছে গেলো মীরের কোমরের নিচের দিকে। সাড়াশির ন্যায় হাতে মীরের কোমরের নিচের অংশ ক্ষিপ্র গতিতে ধরতে নেওয়ার আগেই তড়িতে মীর কোমর সরিয়ে নিলো পেছন দিকে। একহাতে ক্র‍্যাবটিকে নিজের সামনে উঁচু করে ধরে ও বলে উঠলো,

“অনধিকারচর্চা কোরোনা ব্রো, পাশে আমার খুনী বউ আছে।”
মীরের কথা শুনে খিলখিল করে হেসে উঠলো আনাবিয়া। মীর স্মিত হেসে ক্র‍্যাবটাকে নামিয়ে দিলো বালির ওপর তারপর কাছে থাকা ধারালো নাইফ দিয়ে আলাদা করতে শুরু করলো ক্রাবের পা গুলো।
আনাবিয়ার মুখে তখনো লেগে আছে মিচকা হাসি। মীর ওর দিকে কাজের ফাকে একবার তাকিয়ে ওকে এমন খচ্চর মার্কা হাসি দিতে দেখে বলে উঠলো,
“যা বলার বলে ফেলুন ম্যাম।”
“আর একটু হলে তোমার কিং কোবরার কল্লা কাটা যাচ্ছিলো।”
ফিক করে হেসে উঠে বলল আনাবিয়া, ওর কথা শুনে গা কাপিয়ে নিঃশব্দে হেসে উঠলো মীর। ক্রাবের একটা পা ওর দিকে ছুড়ে দিয়ে বলে উঠলো,
“অসভ্য হচ্ছ দিনে দিনে।”

মীর এবার উঠে পানি ফুটালো আগুনে, তারপর কেটে রাখা ক্র‍্যাবটাকে দিলো পানির ভেতর সেদ্ধ হতে। বার্বিকিউয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সস গুলো রেডি করে এবার বার্বিকিউ গ্রিলটা গরম করতে দিলো। আনাবিয়া হাত লাগাতে চাইলে ওকে ধরে এক কোণায় চুপচাপ বসিয়ে দিলো মীর। বলল,
“কিছুদিন পর আমার সমস্ত দায়িত্বের সাথে সাথে আমার পেট ভরানোর দায়িত্বটাও তোমার হাতে তুলে দিবো শিনু, তখন আমাকে প্রতিনিয়ত রান্না করে খাওয়ানো লাগবে তোমাকে, তাই আপাতত রেস্ট করো।”
আনাবিয়া মিষ্টি করে হেসে বসে রইলো চুপচাপ, দেখতে লাগলো মীরের কর্মকাণ্ড। শুধালো,

“এত্ত দারুণ বার্বিকিউ করতে তুমি কোথায় শিখেছো বলোতো মীরি!”
“ আমি আর তোমার বাবা যখন বহির্বিশ্বে ছিলাম তখন সেখানের একটা রেইন ফরেস্টের ভেতর আমরা প্রায়ই বার্বিকিউ করতাম।
আমাজন নামে সেখানে একটা বিরাট, বিশাল রেইন ফরেস্ট আছে। তুমি ভাবতেও পারবেনা শিনু জায়গাটা কত্ত সুন্দর! প্রানীজগতের এক অসাধারণ অভয়ারণ্য!

আর সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো আমাজনের অনলি থার্টি পার্সেন্ট এক্সপ্লোর করতে পেরেছে সেখানের সায়েন্টিস্টেরা। বাকি স্যাভেন্টি পার্সেন্ট সকলের এখনো লোকচক্ষুর আড়ালে।
আমেরিকা থাকতে আমরা সেখানে অনেক অনক সময় কাটয়েছি। ওয়ান অব দ্যা বেস্ট প্লেইসেস!”
“তোমরা কতখানি এক্সপ্লোর করেছো?”
“যে এরিয়াটুকু ওখানের সায়েন্টিস্টরা এক্সপ্লোর করেছে আমরা সে এরিয়া গুলো স্কিপ করে আরও ভেতরের দিকে গিয়েছি।

কিন্তু সে জায়গা গুলো বহির্বিশ্বের মানুষের জন্য একদমই সেইফ নয়। জায়গা গুলো ট্রাইব আর হিংস্র প্রাণি তে ভরপুর। বলতে পারো এই ট্রাইব আর হিংস্র প্রাণি গুলো সেখানে একত্রে বসবাস করে, শিকার এবং শিকারী।
মজার ব্যাপার হলো সেখানে এমন অনেক প্রাণি অছে, সায়েন্টিস্টরা যাদের অস্তিত্বও জানেনা, এবং কখনো ধারণাও করেনি যে এগুলো এক্সিস্ট করতে পারে।
“আমাকে নিয়ে যাবে সেখানে?”
চকচকে চোখে আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করলো আনাবিয়া। মীর ওর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে উত্তর করলো,
“তোমাকে নিয়ে গেলে সমস্ত জঙ্গলটা এক্সপ্লোর না করা অব্দি তুমি শান্ত হবেনা আমি জানি, তাই তোমাকে নিয়ে যাওয়া যাবেনা।”

“না! তুমি নিয়ে যাবে আমাকে।”
“ঠিক আছে, নিয়ে যাবো কিন্তু পরে৷ তোমার কলেজ ভার্সিটি সব শেষ করবে হাইয়েস্ট মার্ক নিয়ে, তখন নিয়ে যাবো।”
“তুমি শর্ত দিচ্ছো আমাকে? দিলে তো দিলে, সেটাও আবার হাইয়েস্ট মার্কের! তুমি জানো যে আমার পড়াশোনা করতে ভালো লাগে না, তবুও এরকম আজগুবি শর্ত দাও কেন?”
নাকের পাটা ফুলিয়ে তেজি গলায় বলল আনাবিয়া। মীর গরম করে রাখা গ্রিলের ওপর ক্রাবের দেহের অংশ গুলো রেখে তার ওপর সস ব্রাশ করে দিয়ে হাত ধুয়ে এলো আনাবিয়ার কাছে।

আনাবিয়াকে কোলের ভেতর নিয়ে বসলো ও বালির ওপর। নিজের খোলা বুকে আনাবিয়াকে টেনে নিয়ে মিশিয়ে নিলো, তারপর ওর কাধের ওপর থেকে চুল সরিয়ে গলায় ঠোঁট স্পর্শ করে বলে উঠলো,
“তোমাকে আমি এমনিতেই নিয়ে যাবো, তার জন্য কিছু করতে হবে না। হাইয়েস্ট মার্কের কথাতো আমি এমনি বলেছি, তোমার নাকের পাটা ফোলানোর জন্য। তোমার যে ব্রেইনে ঘাটতি আছে সেটাতো আমি জানিই।”
শেষোক্ত কথাটা বলে ঠোঁট টিপে হাসলো মীর। আনাবিয়া ক্ষেপে গিয়ে তড়িতে ঘুরে দুহাতে টিপে ধরলো মীরের গলা, তারপর দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠলো,

“হ্যাঁ আমার ব্রেইনে ঘাটতি আছে, তোমার কি তাতে?
আমার ব্রেইন দিয়ে কি করবে তুমি? খাবে?
খাওয়ার জন্য আমি আছি দেখতে পাচ্ছোনা? শালার ঘরের শালা!”
মীর চোকড হওয়ার অভিনয় করে চেপে যাওয়া গলায় বলে উঠলো,
“কোথায় খাবো? কি খাবো? খাওয়ার জন্য কিছুই তো দেখিনা কোথাও!”
আনাবিয়া এবার ফুলে উঠলো রাগে। ধাক্কা দিয়ে মীর কে ফেলে দিলো বালির ওপর, তারপর ক্ষিপ্র গতিতে ওর বুকের ওপর উঠে বসে বক্সিং স্টাইলে আঘাত করতে লাগলো মীরের মুখ আর বুক জুড়ে।
আনাবিয়ার কান্ডে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো মীর। ওর ঝরঝরে হাসিতে সচকিত হয়ে উঠলো ঘুমন্ত সমুদ্রপাড় খানা!

ধোঁয়া ওঠা পোড়া পোড়া গরম মাংসের টুকরো গুলো অল্প অল্প করে ছিড়ে নিয়ে ছোট ছোট ফু দিয়ে ঠান্ডা করে আনাবিয়ার গালে তুলে দিচ্ছে মীর৷ আনাবিয়া খেতে খেতে চারপাশটা পর্যবেক্ষণ করছে তৃপ্ত দৃষ্টিতে।
মীর ওর আনমনা দৃষ্টি লক্ষ্য করে শুধালো,
“কি দেখছো এত?”

“কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে এই সবকিছু মীরি, মনে হচ্ছে যেন একটু পরেই চোখ খুলে যাবে আমার। উঠে দেখবো এই সবকিছু আমার স্বপ্ন ছিলো; এই সুন্দর সমুদ্রের পাড়, এই সুন্দর তুমি, এই ধোঁয়া ওঠা গরম মাংস, এই তারা ভরা আকাশ সব কিছু! এগুলো কত্ত সুন্দর, স্বপ্নের মতো সুন্দর!”
মীর স্মিত হেসে আনাবিয়ার গালে আর এক টুকরো মাংস পুরে দিয়ে মনে মনে আওড়াল,
“আমার স্থানে তুমি থাকলে দেখতে পেতে এই সুন্দর সমুদ্রের পাড়, সুন্দর আমি, এই ধোয়া ওঠা গরম মাংস, এই তারা ভরা আকাশ সব কিছুর সৌন্দর্যকে ছাপিয়ে আকাশের ধ্রুব তারাটির মতো উজ্জ্বল হয়ে আছো তুমি!”
আনাবিয়াকে এক হাতে টেনে বুকের কাছে নিয়ে মীর আবদারের সুরে বলল,

“আমার একটা কথা রাখবে শিনু!”
“কি কথা?!”
বিস্মিত কন্ঠে শুধালো আনাবিয়া, মীর ওর কপাল আর চোয়াল জুড়ে নিজের কপাল আর নাক ঠেকিয়ে বলে উঠলো,
“বোর্ডিং ছেড়ে দিয়ে আমার কাছে চলে আসোনা একেবারের জন্য শিনু! তোমাকে বুকে না নিলে ঘুম হবেনা আমার আর, প্লিজ! ”
আনাবিয়ার মুখের কোমল হাসি মিলিয়ে গেলো মুহুর্তেই। চোয়াল শক্ত করে মীরের বুকের ওপর থেকে সরে এলো ও, তারপর শক্ত গলায় বলল,

“এ ব্যাপারে আগেও কথা হয়েছে মীরি! আগেই বলেছি আমি আসবোনা। তুমি নিজেই সেখানে জোর করে পাঠিয়েছিলে আমাকে।
সেদিনের কথা আমি কখনোই ভুলবোনা। বোর্ডিং ছেড়ে আমি সেদিনই আসবো যেদিন আমার কলেজ সম্পুর্ন হবে, এর আগে নয়!”
ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে মীর হাল ছেড়ে দেওয়া গলায় বলল,
“ঠিক আছে আসতে হবে না, এখন আমার কাছে আসো, এটুকু খেয়েনাও৷”
আনাবিয়া আসলোনা, মুখ ফিরিয়ে বসে রইলো অন্যদিকে। মীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাহাতে টেনে নিয়ে এসে ওকে বসালো নিজের কোলের ওপর। আনাবিয়া উঠে সরে যেতে চাইলে মীর ওকে শক্ত করে চেপে ধরলো নিজের সাথে, বলল,

“চুপচাপ বসো শিনু, একদম নড়াচড়া করার চেষ্টা করবে না। গুড গার্লের মতো খেয়ে নাও৷ খুব নখড়া করেছো!”
নখড়া শব্দটা বুকে গিয়ে লাগলো আনাবিয়ার। নিচের ঠোঁট টা ফুলে উঠলো মুহুর্তেই। মীরের দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে জড়ানো গলায় বলল,
“আমি নখড়া করি? আমাকে সহ্য না হলে বলে দাও, আমি এখনি চলে যাবো বোর্ডিংয়ে!”
মীর ওর ফুলে ওঠা ঠোঁটখানা ঝড়ের গতিতে দখল করে প্রবল চুম্বনে শুষে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,
“এত রাগ কোথায় থাকে তোমার!”
“যেখানে থাকে সেখানেতো তুমি যেতে চাও না!”
“যেদিন সত্যি সত্যি যাবো সেদিন এই আমার থেকে পালানোর জন্য ছটফট করবা। খেয়ে নাও এখন শিনু! খেয়ে নিয়ে যত ইচ্ছা রাগ কোরো।”

বলে মীর আর একটুকরো মাংস তুলে ধরলো আনাবিয়ার মুখের কাছে। আনাবিয়া সেটুকু মুখে পুরে নিয়ে মীরের দিকে ভ্রু তুলে তাকিয়ে চিবোতে শুরু করলো।
আনাবিয়ার এমন আদুরে ভঙ্গিতে মাংস চিবোনোর দিকে কিছুক্ষণ মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থেকে মীর ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে নেশালো কন্ঠে বলে উঠলো,
“ আ’ লাভ ইয়্যু, আ’ লাভ ইয়্যু মোর দ্যান অ্যানিথিং ইন দিজ হোল ওয়াইড ওয়ার্ল্ড!”
তারপর ছোট্ট করে ঠোঁট ছোয়ালো আনাবিয়ার কানের গোড়ায়।
মুহুর্তেই সমস্ত শরীর জুড়ে বিদ্যুৎ বয়ে গেলো আনাবিয়ার! কান চোয়াল, বুক, তলপেট জুড়ে রক্ত ছলকে উঠলো ওর! থমকে গেলো সমস্তপৃথিবী।

মীরের এইমাত্র বলা শব্দগুচ্ছ গুলো যেন কর্ণকুহর অতিক্রম করে ওর মস্তিষ্কের সাথে সাথে পৌছে গেলো ওর সমস্ত শিরা উপশিরায়, মিশে গেলো শরীরে প্রবাহমান রক্তস্রোতে।
ওর সমস্ত মন মস্তিষ্ক যেন ডুবে গেলো এক অনন্ত মায়াবী অনুভূতির ভেতর!
খাবার চিবোনো থামিয়ে স্তব্ধ দৃষ্টিতে আনাবিয়া তাকিয়ে রইলো মীরের দিকে। মীর মিষ্টি হেসে ওর স্তব্দ দৃষ্টির দিকে নিজের প্রেমপূর্ণ দৃষ্টি রেখে গেয়ে উঠলো,

“I’ma love you every night like it’s the last night,
Like it’s the last night
If the world was ending, I’d wanna be next to you
If the party was over and our time on Earth was through
I’d wanna hold you just for a while
And die with a smile
If the world was ending, I’d wanna be next to you”

মীরের কালো রঙা গাড়ির ভেতর ড্রাইভিং সিটে বসা মীরের কোলের ওপর বসে পা দোলাতে দোলাতে এক মনে ফোনে গেইম খেলছে আনাবিয়া। অন্য সিটে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে কোকো।
মীরের দৃষ্টি রাস্তার ওপর, মনোযোগ আনাবিয়ার দিকে। কুরো আহমারে পৌছানোর পানিপথের টানেল প্রায় শেষের দিকে। মীর রাস্তার দিকে দৃষ্টি রেখে বলে উঠলো,
“ফারিশের সাথে চুপচাপ চলে যাবে। দিনের বেলা গাড়ি নিয়ে সিটিতে গেলে লোকজন ভড়কে যাবে, অনাকাঙ্ক্ষিত জ্যাম লেগে যাবে তখন।”

আনাবিয়া গেইম খেলতে খেলতে মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। মীর আবার বলল,
“কুমিরের বাচ্চাটাকে প্রাসাদে না রেখে নিয়ে যাচ্ছো! সাবধানে রেখো। এগুলো সল্টওয়াটার ক্রোকোডাইল, ভয়ঙ্কর এবং শক্তিশালী। কয়েকদিনের ভেতরেই হৃষ্টপুষ্ট হয়ে যাবে, আর তুমি যে হারে ওকে খাওয়াও তাতে দানব তৈরি হবে ও৷ অন্যদের থেকে সাবধানে রাখবে। কাউকে হাতের মাথায় পেলে কিন্তু ও ছিড়ে খেয়ে ফেলবে, মাইন্ড ইট৷”
“ওর একটা নাম আছে, নাম ধরে ডাকবে। কুমিরের বাচ্চা কুমিরের বাচ্চা করবে না।”
মীর ওর কথা পাত্তা না দিয়ে বলে উঠলো,
“গিয়ে পড়াশোনা করবে, নেচে বেড়াবেনা৷ আর হ্যাঁ, এভলিনের থেকে কোনো বই যেন আর না নেওয়া হয়। যখন উপযুক্ত বয়স হবে তখন যা ইচ্ছা পড়বে আমি মানা করবোনা৷”

“হু।”
ছোট্ট করে উত্তর দিয়ে আনাবিয়া আবার ঢুকে গেলো ফোনে। মীর এবার ভ্রুজোড়া বিরক্তিতে কুচকে আনাবিয়ার হাত থেকে ফোনটা এক ঝটকায় ছিনিয়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিলো জানালা দিয়ে।
হতচকিত হয়ে মীরের দিকে বিস্মিত চোখে তাকালো আনাবিয়া। মীরের কঠিন দৃষ্টি দেখে ভড়কে গেলো ও। মীর ওর দিকে এভাবে কখনোই তাকায়নি এখনো পর্যন্ত। কি এমন করেছে ও! সামান্য গেইমই তো খেলছিলো!
রাগে অভিমানে টইটুম্বুর হয়ে আনাবিয়া পাশের সিটে উঠে যেতে নিলো মীরের কোলের ওপর থেকে। তড়িৎ গতিতে আবার ওকে ধরে নিজের কোলে বসিয়ে দিয়ে শক্ত গলায় মীর বলে উঠলো,

“একদম নড়বেনা। যেখানে আছো সেখানেই বসে থাকবে।”
আনাবিয়া মীরের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে চোখ মুখ শক্ত করে ঠাই বসে রইলো সেখানে, নড়াচড়াও করলোনা।
কুরো আহমারের কিনারে এসে গাড়ি থামালো মীর। টানেল পার হলেই কুরো আহমার সিটি, ফারিশ সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে ওদের জন্য।
মীর ওর কোলের ওপর চোখমুখ শক্ত করে বসে থাকা আনাবিয়াকে ফেরানোর চেষ্টা করলো নিজের দিকে। কিন্তু আনাবিয়া শক্ত হয়ে বসে আছে, মীরের দিকে ও ফিরবে না।
মীর শাসনচ্ছলে কঠিন গলায় বলে উঠলো,
“আমার দিকে ফেরো শিনু!”
কিন্তু আনাবিয়া মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তো নিয়েছেই, ঘাড় শক্ত করে আছে যেন মীর ওকে ফেরাতে না পারে নিজের দিকে।

এবার ধৈর্য হারা হলো মীর! আনাবিয়াকে তুলে এক ঝটকায় নিজের দিকে ফিরিয়ে ইস্পাত-দৃঢ় হাতের শক্ত আঙুল দিয়ে আনাবিয়ার চোয়াল জোড়া টিপে ধরে ধমকে উঠে বলল,
“কি সমস্যা তোমার? রোজ রোজ একই কাজ করো কেন? তোমাকে কোন জিনিসটা কম দিয়েছি আমি? কোথায় কমতি রেখেছি তোমার যে রোজ আমাকে তুমি এভাবে কষ্ট দাও, বলো!
তোমার থেকে আমি কিছু চেয়েছি? কখনো কিছু চেয়েছি? শুধু বলেছি একটু ভালোভাবে থাকো, যা ইচ্ছা হয় করো শুধু ভালোভাবে থাকো, নিজের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করো, শান্তি দাও আমাকে!
এভাবে রাগারাগি করে কি পাও বলোতো! যদি আমার ভালোবাসার থেকেও এই রাগে তুমি বেশি শান্তি পাও তবে এখন থেকে রাগই করবে। আমার কাছে আসবেনা ভুলেও।”

মীরের এমন কথাবার্তায় আনাবিয়ার চোখ জোড়া ভর্তি হয়ে গেলো পানিতে, ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো ও! মীর ওর মুখ খানা তড়িতে নিজের মুখের কাছে টেনে নিয়ে আগের মতো করেই ধমকে বলল,
“এখন কাঁদছো কেন? কেন কাঁদছো বলো! অপর পাশের মানুষের দিকটা কখনো ভাবোনা কেন তুমি? নিজের যেটা মন চায় সেটাই করো, আমার কথা ভাবোনা কেন?
আমার সমস্ত ভালবাসা, মনোযোগ, সময় সবকিছু তোমার জন্য রেখেছি আমি। আর তুমি কি করেছো? এরকম কেন করো শিনু তুমি!
আজ চলে যাচ্ছো বোর্ডিংয়ে, আমার সাথে দুটো কথা বলবে ভালোভাবে সেটাও তুমি বলতে পারছোনা! ফোন নিয়ে পড়ে আছো!”

শেষোক্ত কথাটা হুঙ্কার দিয়ে বলে উঠলো মীর।
আনাবিয়া কেঁপে উঠলো ওর ধমকে, ফোপানো থেমে গেলো ওর সাথে সাথে। ভীতসন্ত্রস্ত চোখে ও তাকিয়ে রইলো রাগের চোটে ঘন নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করার প্রচেষ্টা রত মীরকে।
মীর এবার ছেড়ে দিলো আনাবিয়ার চোয়াল। শুভ্র চোয়াল জোড়ায় আঙুলের রক্তিম ছাপ ফুটে উঠলো মুহুর্তেই। নিস্তব্ধ আনাবিয়ার চোখ বেয়ে দুফোটা উষ্ণ লোনা পানি গড়িয়ে পড়লো ওর কোলের ওপর৷
ফোশ করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করে নিয়ে সে পানিটুকু মুছে দিতে মীর হাত বাড়াতেই ভয়ে, আতঙ্কে দ্রুত পেছন দিকে সরে গেলো আনাবিয়া।
শঙ্কিত দৃষ্টিতে আনাবিয়াকে এক পলক দেখে নিয়ে মীর তড়িতে ওকে দুহাতে নিজের বুকে টেনে নিলো তখনি! বুকের সাথে এক হাতে আনাবিয়াকে চেপে ধরে অন্য হাতে ওর মুখের রক্তিম হয়ে ওঠা জায়গা গুলোতে সযত্নে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে উঠলো,

“আ-আ’ম সর‍্যি শিনু। ভয় পেয়োনা আমাকে, এদিকে তাকাও! আমার দিকে তাকাও! সর‍্যি আমি, আর বকা দেবোনা সত্যি। তাকাও এদিকে প্রাণ আমার৷”
আনাবিয়ার গলা শুকিয়ে এসেছে, এই স্বল্প সময়ের কঠিন মীরের কঠিন স্বর, হিংস্র দৃষ্টি ও কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেনা। বুকের ভেয়রটা ধুকপুক করছে ওর, আতঙ্কে মাথার ভেতর টা থমকে গেছে যেন!
মীরের চোখের দিকে তাকানোর সাহস হচ্ছেনা ওর আর। বড় বড় শ্বাস ফেললো ও কয়েকবার। হাতের আঙুল গুলো কাঁপছে অনবরত!
মাথা খারাপ হয়ে গেলো মীরের, আনাবিয়ার আতঙ্কিত বুকের ধুকপুকানির শব্দ স্পষ্ট শুনতে পেলো ও। আনাবিয়াকে শান্ত করতে এক হাত ওর ধুকপুক করতে থাকা বুকের ওপর চেপে রেখে ওর চোয়ালে মুখ ঠেকিয়ে কোমল, দ্রুত গলায় বলল,

“শান্ত হও শিনু, ভয় পেয়োনা আমাকে, এদিকে দেখো, আমাকে দেখো! আ’ম সর‍্যি শিনু, আমার দিকে তাকাও প্লিজ!”
ভয় কমলোনা আনাবিয়ার, ভীত চোখে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে মীরের থেকে দূরে যাওয়ার চেষ্টা করলো ও।
মীর ওকে যেতে দিলোনা, সর্বশক্তি দিয়ে দুহাতে নিজের সাথে চেপে ধরলো, একের পর এক তপ্ত চুম্বনে ভরিয়ে দিলো ওর সমস্ত মুখমণ্ডল!
দম বন্ধ লাগলো আনাবিয়ার। আঁতকে উঠে মীরের আলিঙ্গন থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য হঠাৎ মরিয়া হয়ে উঠলো ও। হাত পা ছুড়ে প্রাণপণে চেষ্টা করতে লাগলো নিজেকে ছাড়ানোর।
মীরও ততই নিজের সাথে জড়িয়ে নিতে থাকলো ওকে, বলে উঠলো,
“শান্ত না হলে ছাড়বোনা তোমাকে আমি! শান্ত হও প্রাণ আমার, ভয় পেয়োনা আমাকে!”
আনাবিয়া হাতাহাতি করলো আরও খানিকক্ষণ, শেষ পর্যন্ত ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে বসে রইলো মীরের কোলে চুপচাপ।
মীর ওর দুহাতের ভেতরে আনাবিয়ার মুখ খানা নিয়ে চুমু খেতে গেলো ওর ঠোঁটে একটা, কিন্তু আনাবিয়া মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সাথে সাথেই। মীর অসহায়ের মতো বলে উঠলো,

“একটা চুমু খাবো, মাত্র একটা, ওনলি ওয়ান!”
কিন্তু আনাবিয়া ফিরলোনা এদিকে, মীর জোর খাটিয়ে ওর মুখটা ফিরিয়ে নিয়ে এলো নিজের দিকে, তারপর মুখ বাড়িয়ে দিতেই আনাবিয়া দাঁতে দাঁত, ঠোঁটে ঠোঁট চেপে চোখ খিচে পড়ে রইলো, কোনোমতেই মীরকে ও চুমু খেতে দেবে না৷
মীর ওর বৃদ্ধাঙ্গুলি আনাবিয়ার দু ঠোঁটের ভাজে চালনা করতে করতে খুজতে লাগলো ঠোঁট জোড়া আলগা করার কোনো জায়গা।

একটুখানি জায়গা পেতেই মীর সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে আনাবিয়ার মুখের ভেতর আঙুল চালিয়ে দিয়ে অতি কষ্টে ওর দাঁতের পাটির ভেতর দিয়ে বৃদ্ধাঙ্গুলিটা ঠেসে দিলো ওর মুখগহ্বরে।
আনাবিয়া সাথে সাথে মীরের আঙুল কামড়ে দিয়ে নিজের থেকে সরানোর চেষ্টা করলো ওকে।
চাপা চিৎকার করে মীর তড়িতে বের করে নিলো আঙুল খানা। কিন্তু আনাবিয়া দ্বিতীয়বার ওর দাঁতকপাটি আটকানোর চেষ্টা করার আগেই মীর ঝড়ের বেগে আক্রমণ করলো ওর ঠোঁটের ওপর।
সেখান থেকে একটা প্রগাঢ় চুম্বন কেড়ে নিয়ে হুমকির সুরে বলে উঠলো,
“শান্ত হও শিনু, আমাকে আদর করতে দাও একটু!

তুমি যদি আমাকে এখন আদর করতে না দাও আমি কিন্তু তোমাকে বোর্ডিংয়ে যেতে দিবোনা, আবার প্রাসাদে ফিরিয়ে নিয়ে যাবো। এক পাও প্রাসাদ থেকে বের হতে দিবোনা, আ’ সয়্যার! বিছানার সাথে লাগিয়ে রাখবো তোমাকে চব্বিশ ঘন্টা! আদর করতে দাও আমাকে!”
আনাবিয়া স্থির হয়ে বসলো এবার সত্যি সত্যি। ছেড়ে দিলো এতক্ষণ শক্ত করে ধরে রাখা শরীরের সমস্ত মাংসপেশি।
মীর আশ্বস্ত হলো, অজস্র চুম্বনের বন্যা বইয়ে দিলো আনাবিয়ার ঠোঁট, চোয়াল, গলা, বুক জুড়ে।
ওকে সম্পুর্ন নিজের দিকে ফিরিয়ে ওর পা দুখানা দুপাশে দিয়ে ওকে টেনে মিশিয়ে নিলো নিজের বুকের সাথে। আনাবিয়ার বুকের ধুকপুকানি গিয়ে ধ্বনিত হতে শুরু করলো মীরের হৃদপিণ্ডের গতির সাথে তাল মিলিয়ে।
দুহাতে আনাবিয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ওর গলায় মুখ গুজে দিয়ে মিষ্টি, খসখসে সুরে মীর বলে উঠলো,
“তুমি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত ছাড়ছিনা তোমাকে!”

অনেক অনেকক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর মীরের বুকে আলগোছে ঘুমিয়ে পড়া ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, আদরে তৃপ্ত আনাবিয়াকে মীর কোলে নিয়ে তুলে দিয়ে এলো টানেলের মুখে অপেক্ষারত ফারিশের গাড়িতে।
এরপর আবার প্রাসাদ অভিমুখে রওনা দিলো ফাকা হয়ে যাওয়া কোল আর বুক নিয়ে!

আনাবিয়ার যখন ঘুম ভাঙলো ততক্ষণে ওরা ইম্পেরিয়াল ক্রেস্টের কাছাকাছি চলে এসেছে। ঘুম ভেঙে উঠে চোখ কচলে ভালোভাবে বসলো ও৷
পাশে ড্রাইভিং সিটে বসা ফারিশ তাকালো একবার ওর দিকে। জানালা দিয়ে বাইরের রাস্তা দেখতে ব্যাস্ত তখন আনাবিয়া।
ফারিশ ওর দিকে আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে রাস্তার দিকে মনোযোগ দিয়ে বলে উঠলো,
“নতুন জীবনের জন্য অভিনন্দন শেহজাদী।”
ফারিশের কথা শুনে জানালা থেকে মুখ ফিরিয়ে ফারিশের দিকে চেয়ে সৌজন্য মূলক হাসি হাসলো আনাবিয়া, ছোট্ট করে বলল,
“ধন্যবাদ রুশি ভাইয়া।”

এতক্ষণে ফারিশের চোখ গেলো আনাবিয়ার চোয়ালের দিকে, মীরের আঙুলের চাপের কারণে হওয়া রক্তিম আভা হ্রাস পেয়ে বর্তমানে গোলাপি বর্ণ ধারণ করে আছে৷ ভ্রু জোড়া সামান্য কুচকে ও জিজ্ঞেস করলো,
“আপনার চোয়ালে কি হয়েছে শেহজাদী?”
আনাবিয়া ওর দিকে না তাকিয়েই মাথা নেড়ে বোঝালো যে ওর কিছু হয়নি।
আনাবিয়ার ভারী মুখ দেখে ফারিশ বুঝলো হিজ ম্যাজেস্টির সাথেই কোনো ঝামেলা লেগেছে ওর।
ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে ও গতি বাড়ালো গাড়ির। মেরুণ রঙা গাড়িটা বাতাস কেটে এগোতে লাগলো রাস্তা দিয়ে।

ইম্পেরিয়াল ক্রেস্টের মেইন গেইটের সামনে গিয়ে গায়ারি থামালো ফারিশ। ক্লাস আওয়ার শেষ হয়ে গেছে খানিকক্ষণ আগেই, স্টুডেন্টরা সবাই বের হচ্ছে একে একে।
মীরের সাথে ঝামেলার কারণে আনাবিয়া ক্লাস মিস করে ফেলেছে!
ফারিশের গাড়ি দেখে স্টুডেন্ট দের হাটার গতি ধীর হয়ে এলো। ফারিশকে দেখার জন্য থেমে গেলো ওরা প্রায়। ফারিশের মেরুণ রঙা গাড়িটা সবার চেনা। সে এখানে একটা কারণেই আসে, আর সেটা হলো নূরিয়া তাজদিন।
এই মেয়েটা আস্ত একটা রহস্য। ওকে ছাদে বন্দি করার পরদিন পাওয়া সাফিয়া জাফরের লাশ এই নূরিয়া নামক মেয়েটিকে করে তুলেছে আরও রহস্যময়ী৷

তার বাকা হাসি, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, কথার দাপট সবকিছুই তাকে করে রেখেছে অন্যদের থেকে আলাদা।
তার ওপর সে ফারিশ ফাবিনের সাথে সম্পর্কিত, এর অর্থ দেমিয়ান বংশের সাথেও তার কোনো না কোনো যোগসূত্র আছে। এ কারণেই হোক বা অন্য কোনো কারণে মেয়েটির সামনে তারা কেউ ভুলেও পড়তে চায় না!
গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভিং সিটের দরজা খুলে নামলো ফারিশ। পুরুষালি সুদৃঢ় শরীরের অধিকারী ফারিশকে দেখতে দাঁড়িয়ে গেলো সেখানের মেয়েগুলো।
ফারিশের লুক্স, ড্রেসআপ নিয়ে ফিসফিসে আলোচনা শুরু হলো তাদের ভেতর। তাদের মুগ্ধ দৃষ্টি ফারিশের চওড়া বুকের ওপর।

ফারিশ বের হয়ে ঘুরে এসে খুলে দিলো আনাবিয়ার পাশের দরজা।
কালো রঙা হুডি আর গ্রে কালারের ওভার সাইজ প্যান্টস পরিহিত আনাবিয়া বের হয়ে এলো সেখান থেকে, চোখে পরে নিলো সানগ্লাস।
পোনিটেল করে বাধা লম্বা চুলগুলো কোমর ছাড়িয়ে নিচে গিয়ে পড়েছে। পিঠে ব্যাগ নিয়ে এক হাতে কোকো অন্য হাতে ওয়াটার পট নিয়ে ফারিশকে বিদায় জানিয়ে ইম্পেরিয়াল ক্রেস্টের বিরাট ক্যাম্পাসের ভেতর পা রাখলো ও। অন্যান্য গ্রেডের স্টুডেন্ট গুলো হা হয়ে দেখতে লেগে গেলো ওকে!

ভয়ানক তেজি আর কঠোর নূরিয়া তাজদিনের হাতে এমন গোলগাল কুমিরের বাচ্চা দেখে ভড়কালো ওরা।
আনাবিয়া ওদের ভীতসন্ত্রস্ত দৃষ্টি কে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে এগোলো বোর্ডিং এর দিকে।
ক্লাস আওয়ার শেষ, এখন আর এদিক ওদিক গিয়ে কোনো লাভ নেই। বিকেল বেলা ডোমিনিয়ন অ্যাসোসিয়েশনের সাথে গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে বসতে হবে ওকে। ফোনটাও নেই ওর কাছে যে যোগাযোগ করবে কারো সাথে।
বড়বড় পা ফেলে সিড়ি বেয়ে ও উঠে গেলো বোর্ডিং এর চতুর্থ তলায়। ফোর ফোর্টিন নম্বর রুমের সামনে গিয়ে দরজার নব ঘুরিয়ে ঢুকলো ভেতরে।

ওকে দেখা মাত্রই হৈহৈ করে বিছানা ছেড়ে উঠে এলো ওর রুমমেট নওমি, এসেই দুহাতে জড়িয়ে ধরলো ওকে। আনাবিয়া ধমকের সুরে বলে উঠলো,
“কি শুরু করেছিস? হাতের জিনিসপত্র গুলো রেখে ফ্রেশ হতে দে, তারপর যত ইচ্ছা জড়িয়ে ধরিস৷”
আনাবিয়ার কথায় হাসি হাসি মুখে নওমি ছেড়ে দিলো ওকে, কিন্তু পরিক্ষণেই ওর চোখ গেলো আনাবিয়ার হাতে থাকা কোকোর দিকে। ভয়ে চিৎকার করে ছুটে বিছানার ওপর উঠে গেলো ও, আতঙ্কিত কন্ঠে বলে উঠলো,
“তুই কুমিরের বাচ্চা নিয়ে ঘুরছিস কেন নূর? ওটাকে কোন ডোবা থেকে তুলে এনেছিস? আর এখানেই বা কেন নিয়ে এসেছিস!”

“ও এখন থেকে আমার সাথেই থাকবে।”
কোকোকে বিছানায় নামিয়ে পিঠের ব্যাগ টা খুলতে খুলতে বলল আনাবিয়া৷ পরক্ষণেই আবার বলল,
“ও কিছু করবেনা তোকে, নিশ্চিন্তে নিচে নামতে পারিস৷”
বলেই ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো আনাবিয়া৷
নওমি সতর্কিত চোখে কোকোর দিকে তাকিয়ে সন্তর্পণে ধীর পায়ে নামলো বিছানা থেকে।
কোকোর স্থীর দৃষ্টি তখনও নওমির ওপর, নওমি যেদিকে যাচ্ছে ওর চোখের দৃষ্টিও সেদিকে ঘুরে চলেছে।
ভড়কালো নওমি। ওয়াশরুমে থাকা আনাবিয়ার উদ্দ্যেশ্যে উচ্চস্বরে বলে উঠলো,
“নূর, তোর কুমিরের বাচ্চা আমাকে খাবার ভাবছে মনে হয়!”

নওমির কথা শুনে ওয়াশরুমের দরজা খুলে বাইরে মুখ বাড়িয়ে দিয়ে আনাবিয়া শক্ত গলায় বলে উঠলো,
“ওর একটা নাম আছে, কোকো। কুমিরের বাচ্চা কুমিরের বাচ্চা করবিনা৷”
অতঃপর কোকোর দিকে তাকিয়ে আদেশের সুরে বলে উঠলো,
“একদম দুষ্টুমি করবেনা কোকো, ওদিকে ফেরো।”
আনাবিয়ার কথা শোনার সাথে সাথেই কোকো হতাশ হয়ে পেছন ঘুরিয়ে নওমির বিপরীত দিকে ফিরে বসে রইলো। নওমি চমকালো সাথে সাথে! কোকো কি দারুন কথা শুনলো, এক্কেবারে ইন্সট্যান্ট!
আনাবিয়া আবার ঢুকে গেলো ওয়াশরুমে। নওমি অবাক চোখে ওয়াশরুমের দরজার দিকে তাকিয়ে থেকে মনে মনে আওড়ালো,
“আমিতো ভেবেছিলাম এ শুধু মানুষের ওপরেই ছড়ি ঘোরাতে পারে, কিন্তু এখনতো দেখি এ কুমিরের ওপরও ছড়ি ঘোরাতে ওস্তাদ!”

শেষ বিকেলের দিকে নিজেকে হুডি আর ট্রাউজারে আবৃত করে আনাবিয়া বের হলো বোর্ডিং থেকে। উদ্দ্যেশ্য ওর কলেজের পশ্চিম কোণে থাকা বিরাট কনফারেন্স রুমের ভেতর থাকা হেড কোয়ার্টারে। ডোমিনিয়ন অ্যাসোসিয়েশনের মিটিং গুলো সেখানেই হোল্ড করা হয় বরাবর।
অ্যাসোসিয়েশনের ক্যাপ্টেন এখন ও নিজেই। গরমের ছুটির পর একটা ইভেন্টের আয়োজন করার কথা ছিলো ওদের, সেটা নিয়েই মিটিং।
কিন্তু ফোনটা কাছে নেই, মীরের বাচ্চা ছুড়ে ফেলেছে। নওমির ফোন থেকে কোনোরকমে সবার সাথে যোগাযোগ করে এসেছে ও।

পিঠের ওপর ব্যাগে ভরে কিছু বই আর খাতাপত্র নিয়ে ও এগোচ্ছে কনফারেন্স রুমের দিকে৷
মডেলদের ন্যায় পা ফেলার ভঙ্গিতে নজর কেড়ে চলেছে সবার, কলেজ ক্যাম্পাসে থাকা ছেলে মেয়েরা অবাক চোখে দেখে চলেছে ওকে। ফিসফিসে কথা ভেসে আসছে তাদের থেকে।
সাফিয়ার অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর পর থেকে সকলেই এক নামে চেনে ওকে, নূর!
সাফিয়ার রহস্যজনক মৃত্যু, সেটাও আবার কলেজ থেকে অত্ত দূরে, ঠিক নূরিয়া তাজদিনকে শাস্তি দেওয়ার পরদিনই, এই সবকিছুই চর্চায় রাখে ওকে সারাক্ষণ।

সকলেরই ধারণা সাফিয়ার মৃত্যুর পেছনে পরোক্ষভাবে হলেও নূরের হাত আছে৷ তাই নূরকে দেখা মাত্রই রাস্তা ছেড়ে সরে দাঁড়ায় ওরা ছোট বড় সকলেই, অজানা আতঙ্কে থাকে ওরা যেন!
এই মেয়েটি ঠিক কে, এর পিতা মাতা বা পরিবারের পরিচয় কি কোনো তথ্যই কেউ জানেনা। এমনকি কলেজ কর্তৃপক্ষও না। সমস্ত ইনফরমেশনই অদ্ভুত কারণে গোপন রাখা হয়েছে সবার থেকে।
শুধুমাত্র নাম নূরিয়া তাজদিন, এসেছে ওয়ারদিচা থেকে, ফারিশের আত্মীয় এই তথ্য টুকুই তাদের জ্ঞানের ভেতর৷
আশেপাশের ছেলেমেয়েদের দৃষ্টি কে পুরোপুরি উপেক্ষা করে আনাবিয়া জোর কদমে হেটে গেলো কনফারেন্স রুমে।
রুমে ঢুকতেই দেখতে পেলো অ্যাসোসিয়েশনের অন্যান্য সদস্যেরা ওর জন্য অপেক্ষা করছে হেড কোয়ার্টার এর বাইরে।

ওকে আসতে দেখেই এতক্ষণের গল্পগুজব থেমে গেলো ওদের, কথা বন্ধ করে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো সবাই।
আনাবিয়া ওদের কাছাকাছি এসেই আদেশের সুরে বলে উঠলো,
“ভেতরে গিয়ে বসো।”
সকলে মিলে সুড়সুড় করে হেড কোয়ার্টারের ভেতরে গিয়ে বসলো মিটিং টেবিলের চারপাশে রাখা চেয়ারে।
ওরা গিয়ে বসার পর কামরায় ঢুকলো আনাবিয়া, ভারী পায়ে দৃড়তা মিশিয়ে ও এসে দাড়ালো টেবিলের সামনের দিকে। তারপর স্নিগ্ধ কন্ঠে বলে উঠলো,
“শুরু করা যাক।”
তারপরেই নিজের পেছনের দেয়ালে থাকা ব্লাকবোর্ডে বড় বড় করে লিখলো, ‘ডোমিনেন্স: দ্যা ইন্টেলিজেন্স ওয়ারফেয়ার’
তারপর বলল,

” গত মিটিংয়ে আমরা ইভেন্ট নিয়ে কথা বলেছিলাম। সামান্য ধারণাও নেওয়া হয়েছিলো সবার থেকে। ছুটির ভেতরে তোমাদের সবার ইভেন্ট বিষয়ক মেইল আমি পড়েছি। সবার মতামত এবং আমার নিজস্ব বিবেচনায় আমি ইভেন্টটাকে ইন্টেলিজেন্স কম্পিটিশন হিসেবে রাখতে চাইছি।
এই ওয়ারফেয়ারটি হবে এমন একটি ইন্টেলেকচুয়াল স্ট্র্যাটেজি গেম, যেখানে স্টুডেন্টরা ছোট ছোট দল তৈরি করে কলেজ কর্তৃপক্ষের দেওয়া বিভিন্ন চ্যালেঞ্জে অংশ নিবে৷ প্রতিটি চ্যালেঞ্জ পরীক্ষা করবে তাদের বুদ্ধিমত্তা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, টিমওয়ার্ক, এবং নেতৃত্বের দক্ষতা।

আমরা শুধু ইম্পেরিয়াল ক্রেস্টই নয়, আশেপাশের স্কুল প্লাস কলেজ গুলোকেও ইনভাইট করব। আমাদের ফোকাস হবে তরুণদের নেতৃত্ব এবং সৃজনশীল চিন্তাভাবনা।
কিন্তু আমাদের বাজেট সীমিত। তাই স্পন্সরশিপের ব্যাপারে সবার আইডিয়া দরকার। ইন্টেলিজেন্স গেইম টাকে কিভাবে সাজানো যায় সেটাও একটা চিন্তার বিষয়।”
কথা শেষ করে আনাবিয়া বাকিদের দিকে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আনাবিয়ার দৃষ্টিতে নড়েচড়ে বসলো ওরা সবাই।
অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র মেম্বার আরিশ নামের টুয়েলভথ গ্রেডের ছেলেটি গলা খাকারি দিয়ে বলে উঠলো,

“পুরো ইভেন্টটাই আমরা গেমিং স্টাইলের করতে পারি। একেকটি রাউন্ডে ভিন্ন ভিন্ন চ্যালেঞ্জ থাকবে। যেমন— মাইন্ড ম্যাজ, পাজল ব্রেক, অর রিয়েল-টাইম স্ট্র্যাটেজি।”
আরিশের কথা শুনে নিজেদের ভেতর ছেলে মেয়ে গুলো চাপা আলোচনা করে নিলো কিছুক্ষণ। ওপাশ থেকে অন্য একজন মেয়ে বলল,
“মাইন্ড ম্যাজটা ভালো আইডিয়া। এখানে তাদের সামনে কিছু জটিল সমস্যা দেওয়া হবে, এবং সময় বেধে দেওয়া হবে, এই যেমন একঘণ্টা বা আধাঘন্টার ভেতর প্রবলেম সলভ করতে হবে। কিন্তু রিয়েল-টাইম স্ট্র্যাটেজি চ্যালেঞ্জটা কীভাবে সাজানো যায়?”

মেয়েটির প্রশ্নে টেবিলে হাত ভর দিয়ে ঝুকে আনাবিয়া বলে উঠলো,
“আমরা “ডিসিশন অ্যান্ড ডমিনেন্স” নামের একটা সেগমেন্ট করতে পারি। এখানে দলগুলোকে যেকোনো একটা প্রেশার ক্রিয়েটকারি সিচুয়েশন দেওয়া হবে— যেমন, একটা যুদ্ধক্ষেত্রের সিমুলেশন।
তাদেরকে বিভিন্ন রিসোর্স দেওয়া হবে, সেগুলো ব্যবহার করে নিজেদের গ্রুপকে প্রতিপক্ষের অ্যাটাক থেকে সেইফ করতে হবে।
যে দল সবচেয়ে কম রিসোর্সে সবচেয়ে বেশি সময় টিকে থাকবে, তারাই জিতবে।”
আনাবিয়ার কথায় আরিশ ছেলেটা আবার বলল,

“ভালো বলেছো নূর, তবে চ্যালেঞ্জগুলো যেন কোনোভাবেই একঘেয়েমি না হয়ে ওঠে সেদিকটাও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, স্টুডেন্টরা যেন প্রতিটা গেইমেই প্রচন্ড এক্সাইটেড ফ্যিল করে।
আর পাজল ব্রেক সেগমেন্টে আমরা সম্পুর্ন কলেজ ক্যাম্পাসটাকেই এরিয়া ধরে দিতে পারি। স্টুডেন্টরা সমস্ত কলেজ জুড়ে আমাদের ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা ক্লু খুঁজে পাজলগুলো সমাধান করবে।”
আনাবিয়া প্রশ্ন করলো ওদের কে, পাজল ব্রেক গেইম টার নাম কি দেওয়া যায়। ও পাশ থেকে একটা জুনিয়র ছেলে আমতাআমতা করে বলে উঠলো,

“এর নাম আমরা ‘ব্রেইনলক এস্কেপ’ দিতে পারি। আর আমার মনে হয় এই ইভেন্ট টাকে রাতের বেলা দিলে ভালো হয়। এতে ক্যাম্পাসকে আমরা রহস্যঘেরা স্থানে পরিণত করতে পারবো; এই যেমন লাইটিং, সাউন্ড এফেক্ট, আর ভিজ্যুয়াল দিয়ে আরও থ্রিলিং এনভিরনমেন্ট তৈরি করতে পারবো, স্টুডেন্টরা এতে বেশি মজা পাবে।”
ছেলেটির কথা শুনে ওর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিলো আনাবিয়া। সবাই বুঝলো ছেলেটির আইডিয়া আনাবিয়ার পছন্দ হয়েছে।

এদিকে আনাবিয়া ছেলেটির কথায় হাসি দেওয়ায় খুশিতে গদগদ হয়ে গর্বে ফুলে উঠলো সে। ওপর পাশের জনকে গুতা মেরে নিজের কৃতিত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিলো আর একবার।
আরিশ সবার দিকে একবার তাকিয়ে বলে উঠলো,
“স্পনসরশিপের ব্যাপারটা নিয়ে কি করবো আমরা? ইবেন্টের জন্য প্রচুর খরচা হবে, এত খরচা কলেজ ফান্ড থেকে আমাদেরকে কখনোই দিবা না! আমাদের এমন কাউকে স্পনসর করতে হবে যেন আমাদের সমস্ত খরচ তারা একাই বহন করতে পারে, কারণ একটা ইভেন্টের জন্য তো আমরা স্পন্সরের জন্য এদিক ওদিক ছুটেতে পারিনা।
আরিশের পাশে বসা অন্য একটি ছেলে আমতাআমতা করে বলে উঠলো,

“আমি একটা কথা বলবো! তোমরা কেউ আমাকে বকা দেবে না!”
ওর কথা শুনে সকলে ওকে আস্বস্ত করলো যে কেউ ওকে বকা দিবে না। শিওর হয়ে নিয়ে ছেলেটা বলে উঠলো,
“কেননা আমরা স্বয়ং হিজ ম্যাজেস্টির কাছেই আমাদের ইভেন্টের খরচার জন্য আবেদন করি! সাথে হিজ ম্যাজেস্টিকে ইনিভাইট করি আমাদের ইভেন্টে প্রধান অতিথি হয়ে আসার জন্য!
হিজ ম্যাজেস্টি ব্যাস্ত ঠিকই, কিন্তু আমাদের ইনভাইটেশন তো তিনি অবশ্যই গ্রহণ করবেন, তাইনা?
তিনি নিজে উপস্থিত না হলেও তার পরিবর্তে কাউকে পাঠাবেন, ইভেন্টের বাকি কস্টও হিজ ম্যাজেস্টি দিবেন আশা করি!”
আরিশ সহ অন্যরা উচ্ছসিত হয়ে উঠে বলে উঠলো,

“দারুন আইডিয়া! হিজ ম্যাজেস্টির নিকট আবেদন করলেই আমাদের আর অন্য কোথাও যাওয়া লাগবে না। উনি একাই একশ।
মীরের কথা মনে পড়তেই আনাবিয়া মুখ বেকিয়ে টেবিলের ওপর থেকে নিজের ভার সরিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো,
“ঠিক আছে তবে প্লানটা এভাবেই থাকবে, এই ব্যাপারে আমরা আগামীকাল আর একবার বিস্তারিত আলোচনায় বসবো।
আর আমরা শেষ রাউন্ডে একটা বড়সড় চমক রাখতে পারি। এইটার সাথে প্রথম তিন রাউন্ডের কোনো মিল থাকবে না।

শেষ মুহূর্তে স্টুডেন্টদের দল গুলোকে ভাগ করে দিয়ে সবাইকে একটা সম্পুর্ন নতুন দল তৈরি করতে বলা যেতে পারে। এতে নতুন পরিস্থিতিতে নিজেদের মানিয়ে নেওয়ার একটা টেস্ট নেওয়া হয়ে যাবে৷
এখানে এবার সব দল একে অপরের বিরুদ্ধে খেলবে। এই রাউন্ডটার নাম আমরা ‘দ্য লাস্ট স্ট্যান্ড’ রাখতে পারি।”
আনাবিয়ার কথায় সায় জানালো ওরা সকলে। আরও কিছু টুকটাক আলোচনা করে আনাবিয়া সবার উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো,
“ঠিক আছে, আজকের মিটিং এই পর্যন্তই। আজ সবাই গরমের ছুটি শেষে ক্যাম্পাসে ফিরেছি, সবাই ক্লান্ত। আজকের দিনে বেশি কথা না বাড়ানোই ভালো হবে। সবাই যে যার স্থানে চলে যেতে পারো। মিটিং ডিসমিসড।”
কথা শেষ করে সবাইকে বিদায় জানিয়ে আনাবিয়া বের হলো হেড কোয়ার্টার থেকে। ওর পেছন পেছন বের হয়ে গেলো অন্যরাও।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে, আশেপাশে আঁধার ঘনিয়ে এসেছে। অন্ধকারের পর্দা নামার আগেই রাস্তার ধারের ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলো জ্বলে উঠতে শুরু করেছে, ছড়িয়ে দিচ্ছে স্নিগ্ধ উষ্ণতা।
আনাবিয়া কনফারেন্স রুম থেকে বেরিয়ে বোর্ডিং এর রাস্তা ধরলো। চোখ জোড়া ওর ঘুরে বেড়াতে লাগলো ক্যাম্পাসের অলিগলিতে।

দিনের চঞ্চলতা ম্লান হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। আকাশের বুকে কমলা-নীল-লালের আঁচড় ধরে, সূর্যের শেষ ম্লান আলো পা ছুঁইয়ে যাচ্ছে ক্যাম্পাসের কোণায় কোণায়।
ছেলেমেয়েরা সব ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে নিজেদের আড্ডায় মেতে আছে, কেউ ক্যাফেটেরিয়ায় বসে গরম চায়ের কাপে ভর করে গল্পের পাহাড় জমাচ্ছে, কেউবা মাঠের বেঞ্চিতে বসে সুরের ঝড় তুলেছে গিটারের ছোঁয়ায়। ফাঁকা করিডোরগুলোতে কদাচিৎ জুতোর শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
নতুন প্রেমিক-প্রেমিকা গুলো এখনো চুপিসারে, লাজরাঙা মুখে হাতে হাত রেখে আড্ডা দিতে ব্যাস্ত।
মিষ্টি দৃশ্য গুলো দেখতে দেখতে ঠোঁটে স্নিগ্ধ হাসি ফুটিয়ে এগোতে লাগলো আনাবিয়া। এমন সময় পেছন থেকে ভেসে এলো আরিশের কন্ঠ,

উচ্চস্বরে ‘নূর’ বলে ডেকে উঠলো সে দূর থেকে।
আনাবিয়া পেছন ফিরে তাকাতেই দেখতে পেলো ওর দিকে উর্ধ্বাশ্বাসে ছুটে আসতে থাকা আরিশকে।
আরিশ ছুটে এসে ওর পাশে দাঁড়িয়ে জোরে শ্বাস ফেলতে ফেলতে আনাবিয়ার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“তোমাকে আজ সকালে মেসেজ করেছিলাম অনেকগুলো, কিন্তু কোনো রিপ্লাই পাইনি, তুমি সিনও করোনি!”
“সর‍্যি ভাইয়া, আসলে আমার ফোনটা সকাল বেলা নষ্ট হয়ে গেছে। আমার কাছেও নেই সেটা, বাসাতেই ফেলে রেখে এসেছি ভুল করে। কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথা হলে বলুন, আমি শুনছি।”
শান্ত, ভদ্রোচিত কন্ঠে বলল আনাবিয়া। আরিশ কি বলবে বুঝতে না পেরে নার্ভাস হয়ে পড়লো, মুহুর্তেই ভাবনা চিন্তা করে একটা ঢোক গিলে বলে উঠলো,

“তুমি কি ফ্রি আছো সন্ধ্যার পর?”
“না ভাইয়া, সন্ধার পর আমাদের কজনের গ্রুপ স্টাডি থাকে বোর্ডিং এর লাইব্রেরিতে। গ্রুপ স্টাডি শেষ করে আমাকে ব্রিউ ব্লিস কফি শপে যেতে হবে।”
“ওখানে কেন যাবে অতো রাতে?”
কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো আরিশ। আনাবিয়া হাটা শুরু করে ফারিশকেও ওর সাথে সাথে এগোতে বলে উত্তর দিলো,
“সেখানে আমার এক ফ্রেন্ড পার্ট টাইম জব করে, কাল ওর এক্সাম। এক্সামের কোনো প্রিপারেশন নেয়নি ও, নোটসও নেই ওর কাছে। কাজ ফেলে নোটস নিতে আসতেও পারছেনা, কাজে ফাকি দিলে শপের য়্যোনার ওকে কাজ থেকে বের করে দেবে।
তাই আমি নিজেই গিয়ে দিয়ে আসবো আর নোটস গুলো একটু বুঝিয়ে দিয়ে আসবো।”

“একাই যাবে?”
“জ্বি।”
“আমারও ওদিকে কাজ আছে, তুমি চাইলে আমি তোমার সাথে যেতে পারি।”
“কি কাজ আপনার ওদিকে?”
আনাবিয়ার প্রশ্নে বিপাকে পড়লো আরিশ। কি কাজ সেটা এত দ্রুত ভেবে ও কিভাবে বলবে? তবুও মাথা খাটিয়ে দ্রুত বলে উঠলো,
“ব্যাক্তিগত, ব্যাক্তিগত কাজ আর কি!”

“ওহ, ঠিক আছে। আমার গ্রুপ স্টাডি চলবে সাড়ে নটা পর্যন্ত। তারপর কফি শপের উদ্দেশ্যে বের হবো। আপনার ব্যাক্তিগত কাজ আগে থাকলে আপনি সেরে আসতে পারেন, আমি একাই যেতে পারবো।”
“আরে নাহ! আমার ব্যাক্তিগত কাজ যেকোনো সময় হলেই হবে।
তাহলে কিন্তু আমি সাড়ে নটার দিকে তোমার বোর্ডিং এর সামনে এসে অপেক্ষা করবো তোমার জন্য।”
ঘাড় চুলকে, মুখে অপ্রস্তুত হাসি ফুটিয়ে বলল আরিশ।
“অতো রাতে গার্লস বোর্ডিং এর সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে পাবলিক আপনাকে কেলাবে। আপনি কলেজ গেইটে দাঁড়াবেন, আমি গ্রুপ স্টাডি শেষ করেই চলে আসবো।”
বলে আনাবিয়া দ্রুত পা চালিয়ে চলে এলো বোর্ডিং এর বিল্ডিংয়ে। পেছনে ওর যাওয়ার দিকে ব্যাকুল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বুকের ওপর হাত রাখলো আরিশ।

অবশেষে এই মিষ্টি গুরুগম্ভীর তেজি মেয়েটার সাথে কিছুক্ষণ একাকী সময় কাটাতে পারবে ও!
৩৪. বোর্ডিংয়ের চতুর্থ তলায় নিজের কামরায় ব্যাগের ভেতর নোটস গুলো ঢুকিয়ে চেইন টেনে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিলো আনাবিয়া। পাশের বিছানা থেকে নওমি শুধালো,
“এগারোটার ভেতরে ফিরে আসতে পারবি তো?”
“পারবো, এখন সবে নটা বেজে চল্লিশ। সাইকেলে যেতে লাগবে পনেরো মিনিট, গিয়ে ওকে আধা ঘন্টা পড়া বুঝিয়ে দিয়ে আবার পনেরো মিনিটে চলে আসবো। এগারোটার আগেই চলে আসবো। চিন্তা করিস না। আর কোকোকে সময় মতো খেতে দিস। ফ্রিজের ভেতর ছোট মাছ রাখা আছে ভাজি করে। দশটার পর খেতে দিবি।”
“তোর কুমিরের বাচ্চাকে আমি খেতে দিতে পারবোনা। দ্যাখ কেমন করে তাকিয়ে আছে! মনে হচ্ছে তুই ওকে মাছ না আমাকে খেতে বলছিস।”

আনাবিয়া ট্রাউজারের নিচের অংশ গুটিয়ে জুতার ফিতা লাগাতে লাগাতে বলল,
“ওর একটা নাম আছে আগেই বলেছি। আর একবারও যদি ওকে কুমিরের বাচ্চা বলিস তবে মাছের জায়গায় সত্যি সত্যিই তোকে খাইয়ে দেবো ওকে, মনে থাকে যেন।”
নওমি চুপসে গিয়ে ছোট্ট করে উত্তর দিলো,
“আচ্ছা।”
আনাবিয়া কোকোর পিঠের ওপর আর একবার হাত বুলিয়ে আদর করে দিয়ে বের হয়ে এলো কামরা থেকে। তারপর সিড়ি বেয়ে নেমে এলো নিচতলায়। বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে গ্যারাজ থেকে সাইকেলটা নিয়ে এগোলো কলেজ গেইটের দিকে৷
আকাশে আজ মেঘের আড়ালে চাঁদের কিরণ ঝিলমিল করছে মৃদু। ল্যাম্পপোস্টের নরম আলো রাস্তার ওপর ছড়িয়ে পড়ে হলুদাভ আভা ছড়িয়ে দিয়েছে।

ক্যাফেটেরিয়ার দিক থেকে শব্দ ভেসে আসছে সামান্য। দূর থেকে ভেসে আসছে ছেলেমেয়েদের সমস্বরে হাসির শব্দ।
আনাবিয়া সরব নিরবের ভেতর দিয়েই পৌছালো গেইটের নিকট। পৌছাতেও দেখলো আরিশ দাঁড়িয়ে আছে আগে থেকেই। পাশে ওর সাইকেল রাখা। আনাবিয়ার অপেক্ষায় রাস্তার এপাশ থেকে ওপাশে পায়চারী করে চলেছে সে।
আনাবিয়া নামলোনা সাইকেল থেকে। আরিশকে ইশারায় আসতে বলল ওর পেছন পেছন।
আরিশ দ্রুত ওর সাইকেলে উঠে দ্রুত গতিয়ে প্যাডেল চালিয়ে আনাবিয়ার পাশাপাশি এসে উঠলো।
আনাবিয়ার নির্বিকার মুখ খানার দিকে একপলক তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলে উঠলো,
“আমাদের কিন্তু সকাল সকাল ফিরতে হবে। জায়গাটা তেমন ভালো নয়। রাতের জন্য তো একদমই সেইফ নয়!”
“আপনি আবার আমার সাথেই ফিরবেন?”

রাস্তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো আনাবিয়া। আরিশ থতমত খেলো, নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে বলল,
“হ্যাঁ আমার কাজ শেষ হয়ে যাবে তোমার সাথে সাথে, তাই তোমার সাথেই ফিরবো।”
“আমি তো আপনাকে বলিনি আমি সেখানে কতক্ষণ থাকবো!”
আরিশ ঢোক গিললো, আমতাআমতা করে বলল,
“ইয়ে…..মানে, এহেম….. মানে, হয়ে যাবে…… ততক্ষণে আমার কাজ। আমি অপেক্ষা করবো তোমার জন্য।”
আনাবিয়া নির্বিকার চোখে তাকালো একবার আরিশের দিকে, তারপর আবার চোখ ফিরিয়ে নিয়ে মনোযোগ দিলো রাস্তায়। এদিকে নার্ভাসনেসে আরিশের ঘাম ছুটতে লাগলো কপাল বেয়ে!

আনাবিয়ার বান্ধবীটার নাম আইলিন। বাবা নেই, সংসারে শুধু মা আর ছোট একটা ভাই। কফি শপে পার্টটাইম জব করে সংসারের যাবতীয় খরচ চালায় ও।
ব্রিউ ব্লিস কফি শপটার পরিবেশ খুব একটা সুবিধার নয়। গলির একেবারে শেষ প্রান্তে, যেখানে রাস্তাগুলো অন্ধকার, নির্জন আর দিকভ্রান্ত। কিন্তু এখানে স্যালারিটা একটু বেশি পাওয়া যায় বলে আইলিন এখনো এখানেই পড়ে আছে।
আনাবিয়া আর আরিশ কফি শপের বাইরে নিজেদের সাইকেল দুটো পার্ক করে রেখে গ্লাস ঠেলে ঢুকলো কফি শপের ভেতর।

শপের ভেতরে আলো কম, ময়লা সিলিং থেকে ঝুলে থাকা পুরনো লাইট গুলোর কোনো কোনোটার হলুদ আলো বিলীন হয়ে যেতে যেতেও আবারও এক অদ্ভুত ঝলক দিয়ে উঠে মিলিয়ে যাচ্ছে গাঢ় অন্ধকারে, পরক্ষণেই জ্বলে উঠছে আবারও।
টেবিলসেট গুলোতে বসে আছে কিছু অদ্ভুত দর্শন পুরুষ মানুষ। এদের কাউকে দেখে আনাবিয়ার জনসাধারণ মনে হলোনা।

অদ্ভুত পোশাক, দেহশালী, সমস্ত শরীরে ট্যাটু আকা এক এক জনের। সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে দিয়ে তারা ডুবে আছে তাদের ভাবনায়, গ্লাসে মদ ঢেলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে অন্যদের চাপা আলোচনা শুনছে কেউ কেউ।
আনাবিয়া আর আরিশ থমকে দাঁড়িয়ে রইলো কফি শপের ভেতরে, দরজার কাছে। ওদেরকে এইখানে এই অসময়ে দেখে সেখানের লোকগুলো ভ্রু কুচকে তাকালো ওদের দিকে।
ওদের তাকানো দেখে আরিশ আনাবিয়ার পেছন থেকে চাপা গলায় বলে উঠলো,
“তুমি শিওর তোমার বান্ধবী এখানে কাজ করে?”
আনাবিয়া চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে বলে উঠলো,
“হ্যাঁ, এখানেই।”

আনাবিয়া খেয়াল করলো লোক গুলোকে, তাকিয়ে আছে ওরা প্রায় সবাই আনাবিয়ার দিকে। বিস্ময়ে কারো কারো চোখ বড় বড় হয়ে আছে, হতবাক হয়ে হা হয়ে গেছে কেউ কেউ। এমন রাতে এমন সুন্দরী মেয়ে এই তল্লাটে কি করছে সেটা বুঝে উঠতে না পেরে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তারা তাকিয়ে রইলো আনাবিয়া আর আরিশের দিকে।
আনাবিয়া ওদের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে মনোযোগ দিলো ওর বান্ধবীকে খোজায়, এগিয়ে গেলো ভেতরে কয়েকপা।

আরিশ ভয়ে ভয়ে চারদিকে তাকিয়ে এগিয়ে গেলো আনাবিয়ার পেছন পেছম।
আনাবিয়া এখানে উপস্থিত হওয়ায় শপের পরিবেশ যেন কোনো গাঢ়, অস্বাভাবিক মোড়ের মধ্যে চলে গেছে, কৌতুহলী হয়ে সবাই ওকেই দেখছে।
আরিশের ব্যাপারটা ভালো লাগছে না। লোকগুলো সুবিধার নয় মোটেই। আইলিন মেয়েটা এখানে কি খেয়ে কাজ করতে আসে মাথায় এলোনা ওর।

আনাবিয়া একটু এগোতেই সামনে আইলিনকে দেখতে পেলো ট্রেতে করে কফি নিয়ে ভেতর থেকে বের হয়ে আসতে।
আনাবিয়াকে দেখেই থমকালো ও। চারদিকে একবার সতর্ক দৃষ্টি দিয়ে কফি গুলো নির্দিষ্ট স্থানে সার্ভ করে ও দ্রুত পায়ে এলো আনাবিয়ার কাছে, চাপা গলায় বলে উঠলো,
“তুই এখানে কি করছিস নূর? এখানে আসা তোর একদমই উচিত হয়নি! কেন এসেছিস তুই এই সময়ে?”
আনাবিয়া ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে চারপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে নাক মুখ কুচকে বলে উঠলো,
“তুই এইখানে কাজ করিস? জায়গাটা এক্কেবারে ইয়াক! কোনো ঢকপদ নেই, হাইজিন নেই! এরকম পরিবেশে তো আমার কোকোও থাকতে চাইবেনারে লিনা!

আর এখানের কাস্টমার গুলোর একটাকেও তো কাস্টমার লাগছেনা, ড্রাগডিলার লাগছে দেখতে সবগুলারে!”
আইলিন আর একটু এগিয়ে এসে চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি দিয়ে চাপা গলায় বলল,
“এরা ড্রাগ ডিলারই! তুই কেন এসেছিস? আমি বলেছিলাম তো নোটস লাগবে না! তবুও কেন দিতে এসেছিস?
আজ এখানে একটা বড়সড় ডিল হবে, এইখানে আসা আজ তোর একদমই উচিত হয়নি নূর। তুই এক্ষুণি ফিরে যা।
আর তোকে একটা ভালো কথা বলি, এই রূপ নিয়ে যেখানে সেখানে চলে যাবিনা! বিপদে পড়বি কবে, কূল কিনারা খুজে পাবিনা।”

পেছন থেকে আরিশও বলে উঠলো,
“আইলিন ঠিক বলেছে নূর, ওকে নোটস গুলো দিয়েই চলো এখান থেকে। কেমন নেগেটিভ নেগেটিভ ফ্যিল আসছে এখান থেকে।”
আনাবিয়া ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে ব্যাগ থেকে নোটস গুলো বের করে আইলিন কে দিতে দিতে বলল,
“কালকের এক্সাম অবশ্যই দিবি, নইলে কিন্তু এবারও ইলেভেন্থ গ্রেডের এক্সাম দিতে পারবিনা। ব্যি সিরিয়াস লিনা। তোর একটা আস্ত ফ্যামিলি আছে তাদের টেক কেয়ার তোকেই করতে হবে। আর হ্যাঁ, এসব জায়গা ছেড়ে কোনো ভালো জায়গায় কাজ নেওয়ার চেষ্টা কর। ওকে?”

আইলিন নোটস গুলো হাতে নিয়ে মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো, তারপর তাড়া দিয়ে বলল,
“দ্রুত বের হ এখান থেকে। আজ তোরা এলি অথচ আমি তোদের জন্য কিছুই করতে পারলামনা, সামান্য আপ্যায়নও করতে পারলাম না তোদেরকে।”
“অন্য একদিন করিস, আজ আসি। সাবধানে থাকিস তুই এখানে। আর এই মাস শেষ হলেই তোকে যেন এইখানে আর কাজে আসতে না দেখি, মনে থাকবে?”
আদেশের সুরে বলল আনাবিয়া, আইলিন হেসে ফেললো ওর শাসন করার ভঙ্গিতে। মাথা নেড়ে বলল,
“হ্যাঁ বাবা, মনে থাকবে। তুই যা এখন।”

আনাবিয়ারা বিদায় নেওয়ার প্রস্তুতি নিতে নিতেই বাইরে শোনা গেলো গাড়ির শব্দ। আঁতকে উঠলো আইলিন। আনাবিয়া আর আরিশকে দ্রুত তাড়া দিলো চলে যাওয়ার জন্য। সেই মুহুর্তেই কফি শপের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো কালো রঙা স্যুট ব্যুটে সজ্জিত একটা সুদর্শন ছেলে। তার পেছন পেছন ঢুকলো তার এক ঝাক সঙ্গী সাথি।
ভেতরে ঢুকেই হই হুল্লোড়ে কফি শপটাকে মাতিয়ে ফেললো তারা সকলে মিলে। আনাবিয়া আর আরিশ বের হতে নিলো সেখান থেকে, কিন্তু ওরা দরজার কাছে পৌছানোর আগেই স্যুট ব্যুট পরা ছেলেটা চেয়ারে বসতে বসতে আনাবিয়াকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে উঠলো,

“এই যে মিস…… হোয়াইট বিউটি! কোথায় চলেছেন? কফি চাই আমাদের।”
আইলিন অপ্রস্তুত হয়ে তাড়াতাড়ি সেদিকে ছুটে গিয়ে বলে উঠলো,
“ আপনি কোন কফি অর্ডার দিতে চান, স্যার?”
“তুমি নয়, ওকে পাঠাও।”
আনাবিয়ার দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে আঙুলের ইশারা করে উত্তর দিলো ছেলেটি। আইলিন আবারও অপ্রস্তুত কন্ঠে বলে উঠলো,
“উনি ওয়্যেটার নন স্যার! কাস্টমার।”

বলেই আনাবিয়াকে চোখের ইশারায় বেরিয়ে যেতে বলল দ্রুত। আনাবিয়া আর আরিশ দরজা খুলে বের হতে নিলো, কিন্তু তার আগেই ছেলেটার সাথে আসা ছেলেগুলোর ভেতরের একজন সজোরে দরজাটা আনাবিয়ার থেকে কেড়ে নিয়ে ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়ে আনাবিয়ার উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো,
“স্যার আপনাকে কফি সার্ভ করতে বলেছেন, কফি সার্ভ না করে আপনি কোথাও যেতে পারবেন না।”
প্রমাদ গুণলো আইলিন! আমতাআমতা করে স্যুট পরিহিত ছেলেটার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

“স্যার, উ-উনি কা-কাস্টমার…..!”
আইলিনকে পুরো বাক্যটা শেষ করতে দিলোনা ছেলেটা, হাত উঁচু করে থামিয়ে দিয়ে আনাবিয়ার দিকে দৃষ্টি রেখেই বলে উঠলো,
“যে-ই হোক না কেন আমি ওর হাতেই কফি খাবো।”
তারপর আনাবিয়াকে বলল,
“যান, মিস হোয়াইট বিউটি, আমার জন্য কড়া করে একটা ব্লাক কফি নিয়ে আসুন। আ’ম ওয়্যেটিং হেয়ার এগারলি ফ’ ইয়োর সার্ভিস!”

দরজার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকা আনাবিয়া এবার পুরোপুরি ঘুরে দাড়ালো ছেলেটির দিকে তারপর নির্বিকার কন্ঠে বলে উঠলো,
“ আ’ কান্ট, আ’ম নট অ্যা ওয়্যেটার।”
“তুমি ওয়্যেটার হও বা না হও আমার জন্য কফি তোমাকেই আনতে হবে। স্যো, হারি আপ!”
আনাবিয়া নড়লোনা, ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। আইলিন গুটি গুটি পায়ে হেটে এসে দাড়ালো ওর পাশে, চাপা অনুরোধের সুরে বলে উঠলো,
“এক কাফ কফ্যিই তো, দিয়ে আয় একটু। দিয়ে চলে যাস! প্লিজ, ঝামেলা করিসনা। এরা মানুষ ভালোনা।”
আনাবিয়া ছোট্ট করে বলে উঠলো,
“ইম্পসিবল!”

আইলিন আতঙ্কিত হলো! আনাবিয়াকে ও ভালো করেই চেনে, কফ্যি কেন ওর অনিচ্ছায় ওর পশম নাড়ানোর সাধ্যও কারো নেই! কি করবে এখন ও!
স্যুট পরা ছেলেটা শহরের নাম করা আন্ডারগ্রাউন্ড মাফিয়া ড্যানিয়েল ইভানের ছেলে ম্যাসন ইভান। ওর সাথে লাগতে যাওয়া মানে জান খোয়ানো, নয়তো ইজ্জত খোয়ানো!
মাথা খারাপ গয়ে গেলো আইলিনের! কি করবে বুঝতে পারলোনা ও!
ম্যাসন ইভান আবারও তাড়া দিয়ে বলে উঠলো,
“কি হলো মিস হোয়াইট বিউটি? হয়্যার ইজ মা’ কফ্যি?”
আনাবিয়া এক ভ্রু উঁচু করে নির্বিকার কন্ঠে বলে উঠলো,
“টোল্ড ইয়্যু, আ’ম নট অ্যা ওয়্যেটার!”

বলেই দরজা খুলে বাইরে যেতে নিলো ও, কিন্তু আগের ছেলেটাই আবার দরজা চেপে ধরে বন্ধ করে দিলো। ওদিক থেকে ম্যাসন মৃদু হাসিতে ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে বলে উঠলো,
“আমাকে কফ্যি সার্ভ না করে তুমি এখান থেকে এক পাও আগাতে পারবেনা মিস হোয়াইট বিউটি! তবে তুমি যদি কফ্যি সার্ভ করতে না চাও তবে অন্য কিছু সার্ভ করতে পারো, আ’ ওন্ট মাইন্ড!”
আনাবিয়াকে আপাদমস্তক লোলুপ দৃষ্টিতে পরখ করে বলে উঠলো ম্যাসন। আনাবিয়া পাল্টা হেসে মিষ্টি গলায় বলে উঠলো,

“পীপিলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে!”
ম্যাসনের মুখে খেলে চলা হাসিটা চলে গেলো হঠাৎ, ক্রমে শক্ত হয়ে এলো ওর চোয়াল। চেয়ার ছেড়ে উঠে ধীর পায়ে ও এগিয়ে এসে আনাবিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে নেশালো কন্ঠে বলে উঠলো,
“শেষ বারের মতো বলছি, সার্ভ মি অ্যা কাপ অভ কফ্যি উইদ ইয়্যোর বিউটিফুল হ্যান্ডস! অর আ’ উইল টেস্ট এভরি সিঙ্গেল পার্ট অব ইয়্যোর স্নো হোয়াইট বডি!”

বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১৩+১৪

কথাটা বলে হঠাৎ করেই ম্যাসন এগিয়ে এলো আনাবিয়ার একেবারেই কাছে, পরমুহূর্তেই মুখ এগিয়ে নিয়ে এলো আনাবিয়ার মুখের কাছে।
আঁতকে উঠে তড়িতে পেছন দিকে সরে গেলো আনাবিয়া, আর তার পরমুহূর্তেই ঝড়ের গতিতে ঠাস করে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো ম্যাসনের গালে!

বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১৭+১৮

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here