বাদশাহ নামা পর্ব ৩৫+৩৬

বাদশাহ নামা পর্ব ৩৫+৩৬
আমিনা

ছুটি কাটিয়ে ঠিক সাত দিনের মাথায়, মাঝরাতের দিকে লিন্ডা কে সাথে নিয়ে কিমালেব থেকে শিরো মিদোরি তে ফিরে এলো অ্যানা আর ফ্যালকন।
সেইফ জোনে ঢুকে, ওয়ার্কিং জোন পার হয়ে ও যখন পানিশমেন্ট এরিয়াতে এলো তখন সেখানে হাত পা বাধা অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখতে পেলো নতুন আসা সেই ছেলে গুলোকে৷ এদের শাস্তি এখনো শেষ হয়নি। কিন্তু সাত দিন তো শেষ, হয়তো কালই শেষ হয়ে যাবে। শরীর গুলো হাড্ডিসার হয়ে গেছে সবার, পাজরের হাড় বেরিয়ে গেছে অনেকের।

অ্যানার পায়ের শব্দ পেয়ে ওদের ভেতরের দু তিন জন দুর্বল ভাবে মাথা তুলে তাকালো সামনে। চোখ গুলো কোটরে চলে গেছে না খাওয়ার দরুন, কিন্তু হিংস্রতা এক ফোটাও কমেনি কারো চোখ থেকে। এখনও সমানে নোংরা দৃষ্টি নিয়ে তাকাচ্ছে ওরা।
অ্যানা এক পলক ওদের দিকে তাকিয়ে ব্যাগ পত্র গুলো হাতে নিয়ে লিন্ডা কে সহ এগিয়ে গেলো মিটিং জোনের দিকে, তারপর মিটিং জোন পার হয়ে হাটতে হাটতে চলে এলো ওর মাঞ্জারে৷
সবাই এখন ঘুমে, আশে পাশে কোনো টু শব্দ টিও নেই। অ্যানা নিজেও ক্লান্ত। ফ্যালকন ওকে সেইফ জোন পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে নিজের বাসায় চলে গেছে ঘুমাতে। অ্যানারও ঘুম আসছে প্রচন্ড। লিন্ডা তো শিরো মিদোরি তে ঢোকার আগেই ঘুমে কাঁদা।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ঘুমন্ত লিন্ডাকে বিছানার এক কোণায় আলতো করে শুইয়ে দিয়ে, ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে এসে বাইরের পোশাক বদলে একটা ঢিলেঢালা ট্রাউজার আর একটা পাতলা টি শার্ট পরে নিলো অ্যানা৷ তারপর সাদা রঙা, নিতম্ব ছাড়ানো লম্বা চুল গুলো বেনী করে, পিঠের ওপর ছেড়ে দিয়ে এক প্রকার দৌড়ে গিয়ে বিছানায় ঝাপিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো অ্যানা। ওর এমন ঝাপাঝাপিতে বিছানার এক কোণায় চিৎপাত হয়ে ঘুমিয়ে থাকা লিন্ডা হুড়মুড় করে জেগে উঠলো। তারপর অ্যানাকে পাশেই উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে ও গিয়ে উঠে বসলো অ্যানার পিঠের ওপর, এরপর আবার আয়েশ করে ঘুরে ফিরে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলো। কিন্তু ওর সে আয়েশ বেশিক্ষণ দীর্ঘস্থায়ী হলো না। তার আগেই অ্যানা পাশ ফিরে সোজা হয়ে বিছানায় পিঠ ঠেকিয়ে দিলো। আর লিন্ডা সরে পড়ে গেলো অন্য পাশে। অ্যানা এমন করায় লিন্ডা একটু বেজার হলো যেন! মুখ ভার করে লেজ গুটিয়ে বিছানার অন্য কোণায় গিয়ে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়লো ও আবার। অ্যানা সেদিকে এক পলক তাকিয়ে মৃদু হেসে আবার নিজের কাজে মন দিলো।
বিছানার সাইড টেবিলের ওপর খুলে রাখা হাতের রিস্ট ওয়াচ টা নিয়ে মেসেজ অপশনে গেলো ও৷ তারপর চিরচেনা আইডি টির ভেতরে গিয়ে টাইপ করলো,

— ইয়্যু ক্যান টেইক মা’ পাওয়ারস ব্যাক অ্যাগেইন, য়্যিফ ইয়্যু ওয়ান্ট।
তারপর কিছুক্ষণ দোনোমনা করে সেন্ড বাটনে ট্যাপ করে মেসেজ টি সেন্ড করে দিলো। আর মেসেজ টি সেন্ড করার পরমুহূর্তেই ফিরতি উত্তর এলো,
— ইয়্যু ক্যান ক্যিপ ‘এম
ব্যাডা কি সবসময় ফোন টা হাতে নিয়ে বসে থাকে নাকি! জীবনে যতগুলো দিন টেক্সট দিয়েছি একেবারে সাথে সাথে রিপ্লাই!’
রিস্ট ওয়াচ টার দিকে তাকিয়ে ভাবলো অ্যানা। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রিস্ট ওয়াচ টা টেবিলের ওপর রেখে দিয়ে আবার পাশ ফিরে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো।

ওর মন বলছিলো হয়তো পাওয়ারস গুলোকে ব্যাক নেয়ার জন্য হলেও মীর একবার আসবে এখানে, ওর সাথে একটি বারের জন্য হলেও দেখা হবে! কতগুলো দিন মীর কে এক নজর দেখা হয়নি! কিন্তু সে আশা বাতিল।
বালিশের ওপর ঠোঁট জোড়া দিয়ে চেপে ধরে, সামনের দেয়ালের দিকে অপলকে তাকিয়ে থেকে বুজের ভেতরে দামামা বাজিয়ে বেড়ানো প্রবল ইচ্ছা টাকে বুকে চাপা দিয়েই এবার চোখ জোড়া বন্ধ করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলো অ্যানা৷

ঠিক তখনই ওর কামরার দরজাটা শব্দ করে খুলে গেলো। চমকে উঠলো অ্যানা। চিরপরিচিত ঘ্রাণ টা পেয়ে বুকের ভেতর রক্ত ছলকে উঠলো ওর। কিন্তু একটুও নড়লো না ও৷ বালিশে মুখ গুজেই ঘাপটি মেরে পড়ে রইলো বিছানায়। এক অদ্ভুত, অপ্রতিরোধ্য আনন্দের প্রবল আক্রমণে ওর ঠোঁট জোড়া প্রশস্ত হয়ে উঠলো। কিন্তু সেটা কোনোভাবেই এই আগন্তুকের নিকট প্রকাশ করতে চাইলো না ও৷
এরপর এক জোড়া পায়ের ভারী শব্দ দরজার নিকট থেকে ক্রমে কাছাকাছি এলো অ্যানার। তারপর অ্যানার বিছানার পাশে এসেই থেমে গেলো। উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা অ্যানা নিজের মুখ টা দরজার উল্টোদিকে ফিরিয়ে রেখেই প্রশ্ন ছুড়ল,

— কেন এসেছো তুমি এখানে?
কথা টা অভিমান ভরে উচ্চারণ করতে চাইলেও সেটার সাথে অভিমানের ছিটে ফোটাও পাওয়া গেলো না। বরং এক রাশ আকুলতা নিয়ে সেটা গিয়ে বাড়ি খেলো মীরের কর্ণকুহরে। মীর ধীর গতিতে বিছানায় বসতে বসতে শান্ত গলায় উত্তর দিলো,
— এদিক থেকে কে জানি আমাকে স্মরণ করছিলো, তাই চলে এলাম!
মীর কে দেখে লিন্ডা বিছানার কোণা থেকে লাফাতে লাফাতে ছুটে এলো। ভাবটা এমন যে ‘দেখো তোমার বউ আমাকে পাত্তাই দিচ্ছে না! তুমি এখন আমাকে একটু কোলে ন্যাও!’
মীর ওর নিকটে ছুটে আসা লিন্ডাকে দুহাত বাড়িয়ে কোলে তুলে নিলো। অ্যানা মুখ টা না ফিরিয়েই আগের মতো করে আবার বলল,

— কে স্মরণ করেছে তোমাকে? আমি তো করিনি! লিন্ডা করেছে হয়তো।
নিজের দোষ টা সম্পুর্ন লিন্ডার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ায় লিন্ডা ভ্যাবাচেকা খেয়ে একবার অ্যানার দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি করে আবার মীরের দিকে তাকিয়ে দুপাশে মাথা নাড়িয়ে বোঝালো যে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সম্পুর্ন মিথ্যা, সে তো হাত পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছিলো! এসবের সাথে তার কোনো সম্পর্কই নেই!
মীর লিন্ডার ভ্যাবাচেকা খাওয়া মুখ খানার দিকে তাকিয়ে মৃদু শব্দ করে হেসে উঠলো। তারপর লিন্ডার উদ্দেশ্যে বলল,

— লিন্ডা মামনি! তোমার পাপা আর মাম্মাম এখন একটু একান্তে সময় কাটাবে, তুমি ওদিকে গিয়ে ঘুমাও।
লিন্ডার ভ্যাবাচেকা খাওয়া মুখ খানা পরিবর্তিত হয়ে মুহুর্তেই অন্ধকার হয়ে এলো। মন খারাপ করে মীরের কোল থেকে এক লাফে নেমে কিচেনের দিকে চলে গেলো ও। আর ও কিচেনে ঢুকে যেতেই মীর কিচেনের দরজাটা বাইরে থেকে লক করে দিলো। লিন্ডাকে কিচেনে আটকে রাখায় তড়িঘড়ি করে এদিকে মুখ ফিরিয়ে বিছানায় উঠে বসলো অ্যানা। তারপর ভ্রু জোড়া কুচকে তেজি কন্ঠে বলে উঠলো,

— ওকে ওখানে পাঠিয়ে দিলে কেন? ও তো ভয় পাবে একা একা! সবসময় তুমি এরকম করো! কোকো টাকেও এভাবে তুমি রোজ লেজ ধরে বাইরে ফেলে দিয়ে আসতে! ভবিষ্যতে নিজের বাচ্চাকাচ্চা গুল…….
এতটুকু বলেই থেমে গেলো অ্যানা। ও কি বলে ফেলেছে সেটা বুঝে আসতেই মুখের তেজি ভাবটা মুহুর্তেই উধাও হয়ে গিয়ে সেখানে এসে ভর করলো নিদারুণ যন্ত্রণা। বুকের ভেতর টা জুড়ে এক অদ্ভুত ব্যাথা ঘূর্নিঝড়ের ন্যায় পাকিয়ে উঠতে শুরু করলো যেন! চোখের কোণা গুলো মুহুর্তেই লোনা পানিতে ভরে উঠলো। এই কথা টা ও কিভাবে মুখ ফসকে বলে ফেললো ওর মাথায় আসছে না!

আর অ্যানার এমন চেহারা দেখে মীর আর একমুহূর্ত দেরি না করে প্রায় হাওয়ার গতিতে উঠে পড়লো বিছানায়, এরপর ক্ষিপ্র গতিতে বিছানায় শুয়ে থাকা অ্যানাকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে এক ঝটকায় নিচে থাকা অ্যানাকে নিজের ওপরে নিয়ে মীর নিজে চলে গেলো অ্যানার নিচে। তারপর অ্যানার ছোট্ট, শুভ্র মুখ খানাকে নিজের কালো কুচকুচে হাত জোড়ার বিশাল থাবার ভেতরে নিয়ে অ্যানার চোখের কোণা ভিজিয়ে দেওয়া অশ্রুবিন্দু গুলোকে নিজের উষ্ণ ঠোঁটের ছোয়ায় শুষে নিতে নিতে আকুল কন্ঠে বলে উঠলো,
— শিনজো! শিনু, মা’ বিয়্যুটিফ্যুল অর্কিড! মন খারাপ কোরো না, প্লিজ! আমি তোমাকে জেনে বুঝে কখনো কষ্ট দিতে চায়নি, কখনোই না! তোমার জন্মের পর একদিন আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, তোমার চোখ থেকে এক ফোটা পানিও কখনো এই পৃথিবীর বুকে পতিত হতে দিবো না, কিন্তু আমি ব্যর্থ হয়েছি! আমাকে ক্ষমা করে দিও তুমি! আ’ম স্যো সর‍্যি মা’ বেইবি!
মীরের কথায় অভিমানে অ্যানার নিচের ঠোঁট টা ফুলে উঠলো। আর এরপর মীরের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে মীর কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো ও! মীর নিজেও ওকে দুহাতে জড়িয়ে নিয়ে নিজের বুকের সাথে এক প্রকার পিষে নিয়ে আবার বলে উঠলো,

— বিশ্বাস করো শিনু, তুমি ছাড়া আর অন্য কারো প্রতি আমার বিন্দুমাত্র আকর্ষণ নেই! একটা অনু পরিমাণ ও নয়! আমার যদি একটা সন্তানের প্রয়োজন না হতো তবে আমি কখনো কোনো দাসীকে ছোয়া তো দূর, কারো দিকে তাকিয়েও দেখতাম না, বিশ্বাস করো! আমি না চাইতেও তোমাকে এতটা কষ্ট দিয়ে ফেলবো জানলে কখনোই তোমাকে আমি নিজের সাথে জড়িয়ে নিতাম না! লাইফ ট্রির কথাও আমি শুনতাম না! আমি অনেক চেষ্টা করেছি সব কিছু স্বাভাবিক করতে, কিন্তু আমি পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছি! তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও শিনু, ক্ষমা করে দিও আমাকে!

শেষের কথা গুলো বলতে গিয়ে গলাটা যেন ধরে এলো মীরের। অ্যানার কান্নার বেগ বাড়লো। মিরের শরীরে থাকা পোশাকের বুকের কাছ টা ভিজে উঠতে শুরু করলো। মীর বাধা দিলো না ওকে, কান্না করতে দিলো; যদি এতে অ্যানার যন্ত্রণা দ্বারা পূর্ণ মন টা একটু হলেও হালকা হয়!
রাতের শেষ প্রহরের দিকে কান্নার বেগ কমলে ফোপাঁতে ফোপাঁতে এক সময় মীরের বুকেই ঘুমিয়ে পড়লো অ্যানা! আর মীর বাকি রাত টা অ্যানার স্নিগ্ধ মুখশ্রীর দিকে তাকিয়েই পার করে দিলো! বুকের ভেতর থেকে ওর অ্যানার উদ্দ্যেশ্যে একটি বাক্যই বার বার গলা পাকিয়ে উঠে আসতে চাইলো,
— মা’ বিয়্যুটিফ্যুল অর্কিড, প্লিজ ফ’গিভ ম্যি!

বেলা প্রায় দশটা। পানিশমেন্ট এরিয়ায় শাস্তিপ্রাপ্ত ছেলে গুলোকে সকাল বেলা তে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এক সপ্তাহ ধরে কিছুই পেটে না পড়ায় ওরা এখন ডাইনিং টেবিলে বসে গোগ্রাসে গিলছে। নিজেদের কে পরিষ্কার করার মতো সময় ও ওদের হয়নি। কোনো রকমে হাত মুখ ধুয়েই খেতে বসে গেছে। গা থেকে বিশ্রী, উটকো গন্ধ আসছে ওদের।
আজকে ডাইনিং এরিয়াতে সার্ভিং এর দায়িত্ব শার্লটের। ছেলে গুলোর টেবিলে সার্ভ করতে গিয়ে শার্লটের গা গুলিয়ে আসছে। তবুও নাক মুখ চেপে নিজের দায়িত্ব পালন করে চলেছে ও৷ ব্রায়ান বসে আছে লম্বা ডাইনিং টেবিল টির অন্য প্রান্তে। বসে বসে ছেলে গুলোকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তে পর্যবেক্ষণ করছে ও।

ছেলে গুলো না খেয়ে খেয়ে শুকিয়ে আমসি হয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু চেহারার তেজ কমেনি একটারও। এখনো আশেপাশের মেয়ে গুলোর দিকে বিশ্রী দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে ওরা! এই জন্যই হয়তো বলে, কয়লা ধুইলে ময়লা যায় না!
ব্রায়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছেলে গুলোর থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে উঠে যেতে নিলো কিচেনের পেছন দিকে করা ওর শাক সবজির বাগানের দিকে। তখনি রেসিডেন্স এরিয়ার দিক থেকে হেটে হেটে এদিকে আসতে দেখা গেলো অ্যানাকে।

কালো রঙা হুডির সাথে ছাই রঙা ট্রাউজার পরিহিতা অ্যানা আজ আর মুখে মাস্ক পরেনি। ব্রায়ান সেদিকে তাকিয়েই থমকে গেলো! এই তো সেই মুখ খানা, যেটা দেখে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ও অ্যানা কে চুমু খেয়ে বসেছিলো! আর তারপর থেকেই তো অ্যানা ওর ওপর বেজার হয়ে আছে!
শুকনো একটা ঢোক গিললো ব্রায়ান! অ্যানার ওই শুভ্র মুখশ্রীর টেরাকোটা রঙা ঠোঁটের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে নিতে চাইলেও সরাতে পারলো না ও। হা হয়ে তাকিয়ে রইলো অ্যানার চেহারার দিকে। ব্রায়ানের আশেপাশে কর্মরত নারী, পুরুষ সব ওয়ার্কার্স দেরই কাজ থেমে গেলো এক প্রকার! এর আগে কখনো অ্যানার চেহারা টা ওরা দেখেনি কেউ। আজ অ্যানার শুভ্র মুখ খানা দেখে হা হয়ে গেলো ওরা! একটা মানুষ এত টা সুশ্রী কিভাবে হতে পারে মাথায় এলো না ওদের!

হঠাৎ চারপাশ টা অত্যাধিক নিরব অনুভব করে ডাইনিং টেবিলে কর্মরত শার্লটও ফিরে তাকালো সেদিকে। আর তাকিয়েই চোখ কপালে উঠে গেলো ওর! পুতুলের মতো চেহারার একটি মেয়ে ধীর গতিতে হেটে আসছে ওরই দিকে! মুখ খানাতে যেন তার আভিজাত্য ফুটে ফুটে উঠেছে! শার্লট অবাক হলো! এটা ওদের অ্যানা! এমন সুন্দরী! এই মাত্রাতিরিক্ত সুন্দরী টা তাদের সাথে কি করছে! কি অপরাধ করেছে ও যার জন্য আজ ও এইখানে! এমন হীরের মতো চমকানো একটা মেয়েকে ওরা কিভাবে শাস্তি দিতে পারলো! ওর স্থান তো হওয়া উচিত ছিলো শিরো মিদোরির প্রাসাদে! ওর হওয়া উচিত ছিলো বাদশাহর খাস দাসী! শিরো মিদোরির বেগম! ও এখানে কেন!
ব্রায়ান কে পাশ কাটিয়ে ধীর পায়ে শার্লটের কাছাকাছি এগিয়ে এলো অ্যানা। অ্যানা কে এগিয়ে আসতে দেখে হতভম্ব মুখ নিয়ে শার্লট ও এগিয়ে গেলো সেদিকে। অ্যানা ওর দিকে তাকিয়ে ওর চিরাচরিত গাম্ভীর্যতা বজায় রেখে বলে উঠলো,

— মুখ বন্ধ কর, মাছি ঢুকবে।
শার্লট সাথে সাথেই নিজের হা হয়ে থাকা মুখ টা বন্ধ করে নিলো। তারপর আরও কিছুক্ষণ অ্যানার স্নিগ্ধ মুখের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থেকে বলে উঠলো,
— তুই কত সুন্দর রে অ্যানা! তোকে দেখে তো আমার এখন হিংসা হচ্ছে!
শার্লটের কথায় অ্যানা লজ্জা পেলো যেন, মৃদু হাসলো ও৷ শার্লট ওর শুভ্র, নরম হাত টা ধরে নিজের মুঠির ভেতর পুরে আবার জিজ্ঞেস করলো,
— কখন এসেছিস তুই? এই কদিনে তোকে কত মিস করেছি! কোথায় গেছিলি বলতো?
— কোথায় গেছিলাম সেটা বলতে পারবো না৷ তবে আশেপাশেই ছিলাম! কাল রাতে এসে পৌঁছেছি, তোরা ঘুমিয়ে গেছিলি ততক্ষনে।
মৃদুস্বরে উত্তর করলো অ্যানা। শার্লট ওর দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎ উচ্ছসিত হয়ে বলে উঠলো,

— অ্যাই, তুই তো ছিলি না! আমাদের ওয়ার্কার্স দের ভেতরে তো বিয়ে লেগেছে রে!
— কি বলিস! সিরিয়্যাসল্যি! কারা বিয়ে বসছে?
— লিলি, আর পিটার! ওদের নাকি এক সাথে কাজ করতে করতে প্রেম হয়ে গেছে! এখন শাস্তি কবে শেষ হবে তার তো কোনো ইয়ত্তা নেই! তাই ওরা এখানেই বিয়ে টা সেরে নিতে চায়।
— প্রাসাদ থেকে পারমিশন দিয়েছে?
— হ্যাঁ! ভাইয়া প্রাসাদে গিয়ে ওখানের কর্মচারী দের সাথে কথা বলেছিলো গতকাল। ওরা বলেছে বিয়ের অনুষ্ঠান করা যাবে, অসুবিধা নেই। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে বিয়ে উপলক্ষে আমাদের কে এই মাসের বেতনের সাথে ফিফটি পার্সেন্ট বোনাসও দেওয়া হচ্ছে, শপিং এর জন্য! এর আগে কখনো এমন হয়নি নাকি, তাই! আমার তো খুশিতে নাচতে ইচ্ছা করছে রে অ্যানা!
শার্লটের এমন খুশি দেখে ওর ফোলা ফোলা গাল দুটো দুহাতে চেপে দিলো অ্যানা। তারপর বলল,

— কালকেই বেতন তুলে শপিং করিস।
— হ্যাঁ, ভাইয়া গতকাল প্রাসাদে গিয়ে ওখানের বোচকা ওয়ালা বুড়ি কে বলে এসেছে আগামী কাল ভালো ভালো পোশাক নিয়ে আসতে। আমাদের মেয়েরা কিনবে। আমি তো ভাইয়া কে বলে দিয়েছি বোচকা ওয়ালা বুড়ি আসলে আমি আগে যাবো তার কাছে, গিয়ে আমাদের বেগমের থেকে কোনো পোশাক এসেছে কিনা দেখবো! তুই জানিস না! কয়েক বছর আগে লিলি একটা পোশাক পেয়েছিলো বেগমের, বোচকা ওয়ালা বুড়ির কাছে। এত্ত দারুণ, এত্ত দারুণ যে কি বলবো! পার্লের মতো রঙ, এত্ত ফ্লাপি, আর এত্ত স্মুদ! শুধু হাত দিয়ে ছুয়ে দিতে ইচ্ছা করছিলো পোশাক টাতে! কিন্তু লিলি শয়তান আমাকে বকেছিলো হাত দিয়েছিলাম তাই! হতচ্ছাড়া বেডি! লিলি বোধ হয় বিয়েতে ওটাই পরবে।
অ্যানা ঠোঁট টিপে হেসে জিজ্ঞেস করলো,

— বেগমের পোশাক পরার খুব শখ?
— অন্নেএএএএএক!
— ঠিক আছে, আমি ব্যাবস্থা করে দিবো। প্রাসাদের এক লোকের সাথে আমার কানেকশন আছে, জোগাড় হয়ে যাবে। ফ্রি তে।
— ফ্রি তে! কিন্তু কিভাবে সম্ভব? বোচকা ওয়ালা বুড়ি তো বলে অনেক দাম দিয়ে নিয়ে আসে নাকি!
— ও বুড়ি মিথ্যা বলে। যে পোশাক গুলো প্রাসাদ থেকে আসে সেগুলো প্রাসাদের মেয়ে রা ওকে এমনিতেই দিয়ে দেয় বাইরের স্বল্পাবস্থা সম্পন্ন মেয়েদেরকে দান করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু বোচকা বুড়ি সেটা না করে পোশাক গুলো এইখানে এনে দাম দিয়ে বিক্রি করে বিজনেস করে!

— কিইইইই! বুড়ি তো খুব শয়তান দেখি! কাল আসুক বুড়ি, হবে ওর!
নাকের পাটা ফুলিয়ে তেজ দেখিয়ে বলল শার্লট। অ্যানা ওর তেজ দেখে হাসলো সামান্য। তারপর বলল,
— আমাকে কাজে যেতে হবে। আসি এখন।
অ্যানা চলে যেতে নিতেই শার্লট ফট করে চাপা গলায় বলে উঠলো,
— এই বিয়ে টা শেষ হওয়ার পর খুব শিঘ্রই আমরা আর এক জোড়ার বিয়ে দেখবো হয়তো। আশা করি আমাদের সুন্দরী পাত্রী অমত করবে না! আমাদের পাত্র টা তো খারাপ না! ওরকম ছেলে একশতে একটা মিলে।
অ্যানা চলে যেতে নিয়েও আবার দাঁড়িয়ে গেলো। মুখ খানা সামান্য ঘুরিয়ে পেছনে থাকা শার্লটের উদ্দ্যেশ্যে চোখে হেসে বলে উঠলো,

— পাত্র টা খারাপ না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমি বিবাহিতা! নইলে ভেবে দেখতাম।
— বিবাহিতা মানে? সত্যি তুই বিবাহিতা?
ভ্যাবাচেকা খেয়ে হতভম্ব মুখ করে প্রশ্ন টা করলো শার্লট। অ্যানা ঠোঁট টিপে হেসে বলল,
— হ্যাঁ, এই তো আগামী মাসের দশ তারিখে আমাদের ফিফ্‌টি এইটথ্‌ অ্যানিভার্সারি।
শার্লট হা হয়ে কিছুক্ষণ অ্যানার বলা কথাটা মাথার ভেতরে নাড়াচাড়া করলো, আর তারপরই নিজের ডান হাত খানা বাতাসে নাড়িয়ে অ্যানার কথা টাকে সম্পুর্ন উড়িয়ে দিয়ে হাসি মুখে বলল,
— যাহ্‌, দুষ্টু মেয়ে! শুধু মিথ্যা কথা বলে!

তারপর আবার ফিরে গেলো ডাইনিং টেবিলের দিকে। ছেলে গুলোর খাওয়া প্রায় শেষের দিকে। অ্যানা ওর যাওয়ার দিকে এক পলক তাকিয়ে গোফের তলে হেসে সেখান থেকে প্রস্থান করলো। সত্যি কথার আসলেই ভাত নেই!
৬০. রাতের প্রায় দুইটা। মীরের চোখ জোড়া সামান্য লেগে এসেছিলো। এত রাত হওয়ার পরও নিজের কামরার স্বর্ণ আর রৌপ্যের নকশা করা মাঝারি আকৃতির চন্দন কাঠের তৈরি টেবিলটায় বসে বসে রাজ্যের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ঘাটাঘাটি করছিলো ও৷ কখন চোখ টা লেগে এসেছে টেরই পায়নি। কাজের চাপে ও দম ফেলার ফুরসতটুকুও পাচ্ছে না।

জোরে শ্বাস ফেলে চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলো মীর৷ তারপর ওয়াশরুমে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে এসে আবার চেয়ারে বসার প্রস্তুতি নিলো৷ তখনি ওর বুকের ভেতর টা কেঁপে উঠলো সামান্য।
মৃদু হাসলো মীর। ওর আদরের শিনু তবে ওর কাছাকাছিই আছে! চেয়ারে বসার সিদ্ধান্ত টা বাদ দিয়ে কামরার ডান দিকে থাকা সাদা রঙা সরু দরজা টা খুলে চলে গেলো ও অ্যানার কামরায়।
কিছুক্ষণ বাদেই অ্যানার কামরার জানালা টার গ্লাসের পাশে থাকা সরু, চিকন জায়গাটা দিয়ে কামরার ভেতরে চলে এলো একটি ছোট্ট সরু ডাল। তারপর ধীরগতিতে, নিঃশব্দে সেটা খুলে ফেললো জানালার গ্লাস টা৷ আর তার পরমুহূর্তেই কামরার ভেতরে প্রবেশ করলো অ্যানা৷ ভেতরে ঢুকে জানালার গ্লাস টা আবার আটকে দিয়ে চাপা গলায় বলে উঠলো,

— লাইটস অন।
ওর কমান্ডের সাথে সাথেই জ্বলে উঠলো কামরার সিলিঙের সাথে লাগোয়া, এক তোড়া বুনো ফুলের ন্যায় নকশার সোনা রঙা স্ফটিকের ঝাড়বাতি। মুহুর্তেই স্বর্ণালি আলোয় আলোকিত হয়ে উঠলো অ্যানার কামরাটা। অ্যানা কামরার মাঝখান টায় দাঁড়িয়ে কামরার চারপাশ টায় এক বার নজর বুলালো।
অনেক অনেক গুলো দিন পর আজ নিজের কামরায় এলো অ্যানা। এই কামরা টায় কতই না স্মৃতি লুকিয়ে আছে ওর আর মীরের! মীরের সাথে ঘুমাবে বলে কত কাহিনীই না করতো ও! কিন্তু ওর তখনও বয়স হয়নি বলে মীর ওকে কাছেই নিতে চাইতো না! সমস্ত রাত গাল ফুলিয়ে ও বসে থাকতো বিছানায়, ঘুমাতো না। শেষ মেশ মীর এসে ওকে নিয়ে যেতো ওর কামরায়।

সমুদ্রের ঝিনুকের আকৃতির ন্যায় বিছানা টার দিকে তাকালো ও একবার। এই বিছানা টায় মীরের সাথে কতই না আদর সোহাগ হয়েছে ওর! হঠাৎ হঠাৎ মাঝরাতে এসে উপস্থিত হয়ে ওর ফিটফাট বিছানাটাকে কত্ত অগোছালো করে দিয়েই না মীর ভোর বেলা বীরদর্পে বেরিয়ে যেতো! বেরিয়ে যাওয়ার আগে ওর কাঁচা ঘুম টা ভেঙে দিয়ে ওকে জ্বালাতন করতে ভুলতো না!

সবকিছু যেন এখনো চোখের সামনে ভাসছে অ্যানার। মৃদু হেসে বিছানার দিক থেকে চোখ সরিয়ে ও এগোলো ওর ক্লজেটের দিকে। ক্লজেট বললে ভুল হবে, বলা যেতে পারে আস্ত একটা শপিং মল! ওর জুতা থেকে জুয়েলারি, সবকিছুর যে কত শত কালেকশন এখানে আছে তা ও নিজেও জানে না! একটা জিনিসও কখনো ওর নিজ হাতে কেনা নয়। পোশাক গুলো সব ওর মীর নিজে থেকে প্রাসাদের দক্ষ ফ্যাশন ডিজাইনার্স আর টেইলর্স দিয়ে বানিয়ে দিয়েছে। জুয়েলারি গুলোও প্রাসাদের দক্ষ জুয়েলার্স দের দিয়েই বানানো। বাইরে থেকে খুব কম জিনিসই কেনা ওর।
ক্লজেটের দরজাটা আস্তে করে ঠেলে ভেতরে ঢুকলো অ্যানা। ভেতরে ঢোকা মাত্রই ওর নাকে এসে বাড়ি খেলো মীরের শরীরের ঘ্রাণ। কিছুক্ষণের জন্য থমকালো অ্যানা। তারপর ভাবলো মীর তো পাশের রুমেই থাকে। ওর শরীরের ঘ্রাণ এখানে আসা অস্বাভাবিক কিছু না! তারপর চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো ওর পোশাক কালেকশনের দিকে, নিঃশব্দে হেটে গেলো যেন কোনো রকম কোনো শব্দে মীরের ঘুম টা না ভেঙে যায়!
শার্লটের জন্য একটা সুন্দর পোশাক নেওয়া দরকার। লিলির জন্যও নেওয়া প্রয়োজন। মেয়েটা নাকি নিজের বিয়েতে পুরোনো পোশাক পরবে! বিয়ে জিনিস টা জীবনে একবারই আসে। এদিনে সবকিছু সুন্দর, নতুন হওয়া চাই। আর মেয়েটা কিনা একটা পুরোনো পোশাক পরবে! ব্যাপার টা মেনে নেওয়া কষ্টকর!

নিজের একেবারে নতুন পোশাক গুলোর ভেতর থেকে শার্লটের জন্য একটা মেরুণ রঙা, ফ্লাপি, অফ শোল্ডার টি লেঙ্গথ এর গাউন নিলো অ্যানা। এরপর লিলির জন্য সাদার ভেতরে কোনো গাউন আছে কিনা খুজতে শুরু করলো। নতুনের ভেতরে কোনো সাদা গাউন পেলো না। তাই এবার গেলো একটু স্বল্প পুরোনোর দিকে।
কিছুক্ষণ খুজতেই পেয়ে গেলো একটা সাদা রঙা, স্টোনের কাজ করা বল গাউন। কুরো আহমারে কোনো এক অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য মীর এটা তৈরি করে দিয়েছিলো ওকে। ওই একবারই পরা হয়েছে এটা ওর৷ হাত বাড়িয়ে সে পোশাক টা নামালো ও। তারপর পোশাকের কোথাও কোনো খুত আছে কিনা দেখতে লেগে গেলো।
ঠিক তখনি পেছন এক জোড়া কালো কুচকুচে, পেশিবহুল ইস্পাত-দৃঢ় হাত এসে জড়িয়ে নিলো ওকে। সাথে সাথেই চমকে উঠলো অ্যানা। হাত জোড়ার মালিক নিজের প্রশস্ত বুকের সাথে অ্যানার শুভ্র মোলায়েম পিঠ খানা ঠেকিয়ে নিয়ে অ্যানার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে মোলায়েম কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

— তোমার জন্য কোনটা নিবে? আমি চ্যুজ করে দিবো?
অ্যানা দুই হাতে দুইটা পোশাক ধরা অবস্থাতেই স্থির হয়ে রইলো৷ অতঃপর একটা ঢোক গিলে উত্তর দিলো,
— প্রয়োজন নেই। বিয়েতে আমি যাচ্ছিনা!
— কেন যাচ্ছোনা? যেও! একটু আনন্দ ফুর্তি করো তোমার না হওয়া ননদের সাথে। সারাক্ষণ এইভাবে মন খারাপ করে থাকতে হয় না! হাসি খুশি থাকবে সবসময়, আগে যেমন থাকতে! তুমি এইভাবে মন খারাপ করে থাকলে আমার ভালো লাগে না একটুও!
অ্যানার ফর্সা কাধের ওপর থেকে হুডির কিছু অংশ সরিয়ে সেখানে ঠোঁট ছুইয়ে বলল মীর৷ অ্যানা স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে থেকেই ঝাঝাল কন্ঠে উত্তর দিলো,
— খারাপ লাগতেও তো দেখছিনা! আর আমি এমন কেন থাকি সেটা তুমি ভালো করেই জানো। তাই এসব নাটক আমার সামনে করবে না!

— ঠিক আছে করবো না নাটক, সিনেমা করবো। তুমি চাইলে সিরিজও করবো।
বলে আরও একটু অ্যানার সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করলো মীর। মীরের মতলব বুঝতে পারা মাত্রই ঝড়ের গতিতে মীর কে নিজের থেকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়ে, ভ্রু জোড়া কুচকে অ্যানা ঝাঝিয়ে বলে উঠলো,
— ওই! হতচ্ছাড়া কালাভুনা! আমার একাকিত্বের সুযোগ নিতে চাও তুমি!
ধাক্কা খেয়ে অ্যানার থেকে কিছুটা দূরে সরে যাওয়া মীর অ্যানার এমন চেহারা দেখে সশব্দে হেসে উঠলো, তারপর হাসি থামিয়ে বলল,
— এই তো! পুরোনো ফর্মে ফিরে আসছো৷ আরও একটু আসো!
মীর কে ঘর কাপিয়ে হাসতে দেখে মেজাজ তুঙ্গে উঠে গেলো অ্যানার। পোশাক দুটোকে ধাম করে হ্যাঙারে ঝুলিয়ে রেখে আবার দুকদম মীরের দিকে এগিয়ে এসে ওর বুক বরাবর নিজের দুহাত দিয়ে আরও একবার ধাক্কা দিয়ে তেজি গলায় বলে উঠলো,

— অ্যাই, কি ভেবেছো তুমি? আমার সাথে এমন তুলা তুলা খেললে আমি তোমার সামনে আমার লেইগ স্প্রেইড করে দেবো? কখনোই না, মিস্টার নামীর আসওয়াদ দেমিয়ান!
মীর মুখ কুচকে বলল,
— ছিহঃ! কি সমস্ত কথা বার্তা বলো!
তারপর মুখে হাত রেখে গলা খাকারি দিয়ে বলে উঠলো,
— প্লিজ, কন্টিন্যিউ!

অ্যানা কিছুক্ষণ শক্ত দৃষ্টিতে মীরের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর পেছন ফিরে হ্যাঙার থেকে গাউন দুটো নামিয়ে, চোখ মুখ শক্ত করে সেখান থেকে চলে যেতে উদ্যত হলো। কিন্তু মীর কে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার আগেই নিজের শক্ত হাত জোড়া দিয়ে অ্যানা কে ধরে ফেললো মীর। তারপর ওকে আষ্টেপৃষ্টে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে ওর হাত থেকে পোশাক দুটো এক প্রকার ছিনিয়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিলো ক্লজেটের মেঝেতে। আর এরপর অ্যানা কিছু বুঝে ওঠার আগেই মীর ওর ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো অ্যানার ঠোঁট জোড়ায়! তারপর ওকে নিজের সাথে জড়িয়ে রেখেই ক্লজেটের ভেতর থেকে বের হয়ে চলে এলো অ্যানার কামরায়। তারপর অ্যানা কে নিয়েই ঝাপিয়ে পড়লো অ্যানার বিছানার ওপর৷

এতক্ষণ মীরের বাহুডোর থেকে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য হাত পা ছোড়াছুড়ি করতে থাকা অ্যানা হাপিয়ে উঠে এক ঝটকায় নিজের মুখ খানা সরিয়ে নিলো মীরের মুখ থেকে। তারপর হাঁফাতে হাঁফাতে তেজি গলায় বলল,
— শুনো মীর! ছেড়ে দাও আমাকে, মোটেও আমার সাথে ইয়ে করার চেষ্টা করবে না!
— কিয়ে?

এক হাতে অ্যানা কে চেপে ধরে অন্য হাতে ওকে অনাবৃত করতে করতে মোহনীয় কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো মীর। অ্যানা প্রতিবাদ করে মীর কে কিছু বলতে নেওয়ার আগেই আবার নিজের ঠোঁট জোড়া দিয়ে অ্যানার সমস্ত কথা থামিয়ে দিলো মীর। এরপর ধীরে ধীরে পরিণত হতে শুরু করলো একটা ক্ষ্যাপাটে পাগলা ষাঁড়ে, সেই সাথে ক্ষেপিয়ে তুলতে থাকলো অ্যানাকেও। অ্যানার ভেতরে থাকা প্রতিবাদ গুলো মীরের উত্তরোত্তর বাড়ন্ত আদরের তোপে নিভে এলো যেন!
ঘনিষ্ঠ হওয়ার চরম মুহুর্তে অ্যানার কানের কাছে মুখ নিয়ে মীর ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,
— কে যেন বলছিলো…..
অ্যানা শেষ করতে দিলো না ওর কথা টা! নিজের হাত টা মীরের মুখে চাপা দিয়ে ওর মুখ বন্ধ করে দিলো!

পরদিন সকাল বেলা অ্যানা ওর হাতে দুইটা বড়সড় প্যাকেট নিয়ে ওর মাঞ্জার থেকে বের হয়ে এলো মিটিং জোনে। দিনের আলো ফুটলো কেবল। ওয়ার্কিং জোন এখন জেগে উঠতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে। কিচেনের ওদিক টা থেকে থেকে ধোয়া উড়ছে। মাঝে মাঝে সেখান থেকে রান্নার সুঘ্রাণ ভেসে আসছে মৃদুমন্দ বাতাসের সাথে সাথে৷ ওয়ার্কার্স রা যে যার কাজে লেগে পড়েছে ইতোমধ্যে।
শার্লট ডাইনিং এরিয়া পরিষ্কার করছিলো। খানিক বাদেই খেতে বসবে সবাই। এমন সময় অ্যানা কে দুইটা প্যাকেট হাতে ওর দিকে এগিয়ে আসতে দেখে শার্লট কাজ থামিয়ে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো প্যাকেট গুলোর দিকে। অ্যানা কাছাকাছি এলে প্যাকেট দুটোর দিকে নির্দেশ করে বলল,

— কি আছে রে এতে অ্যানা?
অ্যানা প্যাকেট দুটোর ভেতর থেকে একটা শার্লটের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
— নিজেই দেখে নে।
শার্লট দ্বিধাভরা দৃষ্টিতে একবার অ্যানার দিকে তাকিয়ে অ্যানার হাত থেকে প্যাকেট টা হাতে নিয়ে প্যাকেট টির মুখ খুললো। খুলেই অবাক হয়ে গেলো ও। বিস্মিত দৃষ্টিতে অ্যানার দিকে একবার তাকিয়ে উচ্ছসিত হয়ে আবার প্যাকেটের দিকে দৃষ্টি দিয়ে তাড়াহুড়ো করে পোশাক টি বের করলো প্যাকেটের ভেতর থেকে। বের করতেই মেরুণ রঙা টি লেঙ্গথ এর অফ শোল্ডার গাউন টা এক দমকে ফুলে ফেপে ফ্লাপি হয়ে ঝুলে রইলো শার্লটের হাতে।
গাউন টি দেখে শার্লটের খুশি আর ধরে না! উচ্ছসিত হয়ে মুখ থেকে কয়েকটা আনন্দ সূচক ধ্বনি বের করে ও বলে উঠলো,

— এইটা আমার জন্য?
অ্যানা মৃদু গতিতে ওপর নিচে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝালো। সেটা দেখে শার্লট খুশিতে আত্মহারা হয়ে পোশাক টা নিজের গায়ে ধরে লাফিয়ে নেচে নিলো খানিক, তারপর পোশাক টার উপরিভাগে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মুগ্ধ কন্ঠে বলে উঠলো,
— ড্রেস টা কত্ত সুন্দর! কি দারুণ কালার! মনে হচ্ছে খেয়ে ফেলি! এটা সত্যিই বেগমের?
শেষের কথা টা অ্যানার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল শার্লট। অ্যানা আবারও আগের মতো মাথা নাড়ালো। অ্যানার থেকে কনফার্ম হয়ে শার্লট আরও বেশি খুশি হলো যেন! হাতে ধরা পোশাক টা নাকের কাছে ধরে বুক ভরে সেটার ঘ্রাণ নিয়ে আবার বলল,

— ইশ, কি দারুন পারফিউমের ঘ্রাণ এতে! ব্রায়ান ভাইয়া বলছিলো পুরো প্রাসাদ জুড়ে নাকি এত্ত সুন্দর, এত্ত দারুণ স্মেল পাওয়া যায়, যে মনে হয় সারাক্ষণ নাক লাগিয়ে রাখি!
শার্লটের কথায় মজা পেয়ে হেসে উঠলো অ্যানা। তারপর বলল,
— পছন্দ হয়েছে তোর?
— হবে না মানে! আলবাত হয়েছে! এটা তো এক্কেবারেই নতুন দেখা যায়। কিন্তু তুই এটা কিভাবে জোগাড় করলি বলতো? কে আছে তোর প্রাসাদে?
পোশাক টা নিজের গায়ে ধরে দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করলো শার্লট। অ্যানা চোখে হেসে বলে উঠলো,
— বলেছিলাম না আমি বিবাহিতা! আমার ভা….. মানে আমার বর ওখানের কর্মচারী। সে-ই এসব এনে দেয়।
— কাল থেকে তোর কি হয়েছে বলতো! কথায় কথায় বিবাহিতা বিবাহিতা করছিস! সমস্যা কি তোর? মোটেও মজা করবিনা আমার সাথে বলে দিলাম! তোকে আমি আমার ভাবি বানাবো, তাই এসব অলুক্ষুণে কথা বলবি না আমার সামনে।

কিছুটা রেগে ভ্রু কুচকে বলে উঠলো শার্লট। অ্যানা ওর রাগি মুখ খানার দিকে তাকিয়ে হেসে দিলো। তারপর বলল,
— সত্যি কথাই বললাম, বিশ্বাস করা না করা তোর ব্যাপার।
— চুপ থাক তুই, কথা কবি না।
বলে শার্লট আবার পোশাক টা দেখতে লেগে গেলো। মেরুণ রঙা ফ্লাপি গাউন টার সমস্ত শরীর জুড়ে বসানো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মেরুণ রঙা স্টোন গুলো রোদে চকমক করছে, সেগুলোই বার বার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে শার্লট। আর অ্যানা দেখছে শার্লটের এই বাচ্চামি কান্ডকারখানা। কিছুক্ষণ পর শার্লট আনমনে বলে উঠলো,
— ইশ, আমি যদি বাদশাহর বেগম হতে পারতাম! বেগম না হোক, অন্তত দাসী হতাম! তবে এমন সুন্দর সুন্দর পোশাক পেতাম রোজ রোজ।
শার্লটের কথা শুনে অ্যানা বিড়বিড় করে বলে উঠলো,
— পুরান পাগল ভাত পায় না, আবার নতুন পাগলের আমদানি!

বর্তমানে লিলির মাঞ্জারের কামরায় বসে আছে শার্লট আর অ্যানা৷ লিলি উচ্ছসিত মুখে ওর কামরার আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে অ্যানার দেওয়া পোশাক টা নিজের গায়ে ধরে বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে। চোখে মুখে আনন্দ ঝিলিক দিয়ে উঠছে ওর। তা দেখে শার্লট আর অ্যানা মাঝে মাঝেই একে অপরের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। লিলি আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে দেখতে দেখতেই উচ্ছসিত কন্ঠে বলে উঠলো,
— গাউন টা কত্ত সুন্দর! বিয়ে উপলক্ষে তোমার থেকে এত্ত সুন্দর একটা উপহার পাবো তা আমি কখনোই ভাবিনি অ্যানা! এটা কোথায় পেয়েছো তুমি?
অ্যানা কিছু বলার আগেই শার্লট পাশ থেকে বলে উঠলো,

— প্রাসাদে অ্যানার এক কাল্পনিক জামাই থাকে, সে-ই দিয়েছে। জামাই ইন হার ডেলুলু।
অ্যানা শার্লট কে পেছন থেকে একটা চাটি মেরে থামিয়ে দিলো। তারপর লিলি কে বলল,
— প্রাসাদে আমার একজন ক্লোজ রিলেটিভ আছে, তার মাধ্যমেই আনিয়েছি।
— অনেক ধন্যবাদ তোমাকে অ্যানা! তুমি যে আমাকে কতটা খুশি করে দিয়েছো তা তুমি নিজেও জানো না! আমার বিয়ে টা কে বলতে গেলে তুমি পরিপূর্ণতা দিয়েছো, তোমাকে ধন্যবাদ!
অ্যানা লজ্জা পেলো, সামনের পরে কেউ এভাবে বললে ওর লজ্জা লাগে প্রচন্ড। রক্তিম গাল নিয়ে নাকটা কিঞ্চিৎ কুচকে ও বলে উঠলো,

— আরে নাহ! ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই। কেউ কাউকে কোনো উপহার দিলে তাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করতে হয় না। আর তাছাড়া এটা তোমার বিয়ে, বিয়েতে তো সবকিছুই পারফেক্ট হওয়া চাই! আর তাছাড়া এটা তো একেবারেই নতুন পোশাক নয়, ব্যাবহৃত পোশাক। এ আর এমন কি!
— এটাই আমার কাছে হাজার খানা নতুন পোশাকের থেকেও বেশি দামী অ্যানা! আমি যে কত্তটা খুশি তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না!
অ্যানার দিকে কৃতজ্ঞতা সূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল লিলি।

লিলির সাথে আরও কিছুক্ষণ বিয়ে নিয়ে আলাপ করে ওরা দুজন বের হয়ে আসলো সেখান থেকে। তারপর মাঞ্জারের ভেতর কার সরু রাস্তা দিয়ে হাটতে হাটতে এগোলো মিটিং জোনের দিকে। শার্লট অ্যানার সাথে বকবক করে যাচ্ছে, আর অ্যানা মাঝে মাঝে হু হা করে তার উত্তর দিচ্ছে। এমন সময় শার্লটের চোখ গেলো অ্যানার হুডির গলার কাছ টাতে। অ্যানা মাস্ক পরেনি আজও, কিন্তু মাথায় হুডির হুড তুলে দিয়েছে। আর তার ফাক দিয়েই শার্লটের চোখ গেছে অ্যানার গলায়।
ফর্সা, মোলায়েম গলাটার ওপর থেকে গোটা করে একটা মেরুণ রঙা ছোপের সামান্য অংশ স্পষ্ট ভাবে উকি দিচ্ছে। শার্লট সেদিকে দৃষ্টি রেখে কিছুটা আতঙ্কিত গলায় বলে উঠলো,

— অ্যানা! তোর গলায় কি হয়েছে?
অ্যানা প্রথমে ভেবে পেলো না, বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে শার্লটের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে নিজের গলা টা দেখার চেষ্টা করলো একবার, যে কি হয়েছে। আর হুডির ভেতর দিয়ে গলা আর বুকের দিকে উকি দিয়ে ছোপ ছোপ দাগ গুলো দেখা মাত্রই ওর মনে পড়ে গেলো কাল রাতের কথা। মীর ফাজিল টা এই কাজ করেছে কাল। অসভ্য টার হুস থাকে না কোনোদিন! মীর কে মনে মনে কয়েকটা সভ্য গালি দিয়ে গলা থেকে চোখ সরিয়ে শার্লটের জিজ্ঞাসু দৃষ্টির দিকে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে তাকালো অ্যানা। তারপর বলল,

— আরে ও কিছু না! কাল রাতে কামরায় এক বড়সড় অসভ্য মশা ঢুকেছিলো। সেইটাই মনে হয়ে কামড়ে কামড়ে এই অবস্থা করেছে। আমি ঘুমিয়ে ছিলাম, টের পায়নি কিছু।
— আচ্ছা দেখি, ভাইয়াকে বলে তোর জন্য একটা মশার স্প্রে আনিয়ে দিবো, তাহলে আর তোকে মশা কামড়াবে না।
বলতে বলতে সামনে হাটতে লাগলো শার্লট। অ্যানা মনে মনে বলল,
— এ মশা যদি স্প্রে মারলে চলে যেত রে, তাহলে তো আমি নিজেই শ খানেক সাথে নিয়ে ঘুরতাম!
৫২. কেটে গেলো প্রায় এক সপ্তাহ। লিলি আর পিটারের বিয়ে আজ। সকাল থেকেই তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। অ্যানা ওর মাঞ্জারে যথারীতি নিজের হুডি আর ট্রাউজার পরে রেডি হচ্ছিলো আর মনে মনে কাবাবের রেসিপিটা মনে করছিলো। কাবাব রান্নার ভার টা আজ ওর ওপর।

এমন সময় ওর দরজায় এসে কড়া নাড়লো শার্লট। অ্যানা তো পুরোপুরি অপ্রস্তুত! ওর চোখে এখনো লেন্স লাগানো হয়নি। দ্রুত গতিতে ধবধবে সাদা রঙা চুল গুলোকে এক ঝটকা দিয়ে কুচকুচে কালো তে পরিণত করলো ও, তারপর ছুটে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখা লেন্স জোড়া পরে নিলো চোখে। তারপর ধীরে সুস্থে এসে দরজা খুললো। অ্যানা দরজা খুলেতেই শার্লট হুড়মুড়িয়ে ঢুকে গেলো কামরায়৷ তারপর লাফাতে লাফাতে খাটের ওপর বসে পড়ে বলল,

— তুই আজ কি ড্রেস পরবি দেখালি না তো!
অ্যানা দরজা টা আবার লাগিয়ে দিতে দিতে শার্লট কে বলল
— বিয়ে হচ্ছে লিলির, কিন্তু তুই যেভাবে লাফালাফি করছিস, মনে হচ্ছে বিয়েটা তোরই হচ্ছে! ব্রায়ান কে বলে ব্যাবস্থা করবো নাকি?
— আমার ব্যাবস্থা পরে কইরো, আগে তোমরা তোমাদের ব্যাবস্থা করো, তোমাদের বিয়ে না দেখে আমি কোথাও যাচ্ছিনা।
অ্যানা এবার শক্ত হলো। হাসি হাসি মুখটা কঠোর করে নিয়ে শক্ত গলায় বলল,
— এবার কিন্তু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে শার্লট। একই মজা বার বার করলে কিন্তু ব্যাপার টা মোটেই ভালো দেখায় না৷ এরকম কথা দ্বিতীয় বার বললে কিন্তু আমি তোদের দুজনের সাথেই সব ধরণের যোগাযোগ একেবারেই কমিয়ে দেবো।

অ্যানার ধমকে চুপসে গেলো শার্লট। মন টা বিষাদে ছেয়ে গেলো ওর। অ্যানা মাঝে মাঝে কত ভালো ব্যাবহার করে ওর সাথে, একেবারে অমায়িক ব্যাবহার! আবার মাঝে মাঝে প্রচন্ড কঠোর হয়ে যায়। এরকম টা অ্যানা ঠিক কেন করে ও বুঝে উঠতে পারিনা। মন খারাপ করে শার্লট বলল,
— ঠিক আছে, আর বলবো না!
তারপর কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে আবার জিজ্ঞেস করলো,
— তুই কোনটা পরবি বললি না তো!
— বিয়েতে যাচ্ছি না আমি, আর তাছাড়া রান্না বান্না করতে হবে বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময় পাবো না। তোরা যা, এনজয় কর।
— আচ্ছা, দিনের অনুষ্ঠানে না যাস, রাতের অনুষ্ঠানে তো যাবি! রাতে প্রচুর ধুমধাড়াক্কা নাচাগানা হবে, তুই সেখানে চল অন্তত, নাকি সেখানেও যাবি না?
— এসব এখন আর ভালো লাগে না আমার, তবুও চেষ্টা করবো যাওয়ার। তুই গিয়ে বিয়ের জন্য রেডি হ। আমি বেরোবো এখন, নইলে দেরি হয়ে যাবে আমার।
অ্যানার কথা শুনে একটা ছোটো খাটো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানা ছেড়ে উঠে বাইরে চলে এলো শার্লট। ওর পিছু পিছু অ্যানাও বের হলো, তারপর শার্লট গেলো ওর মাঞ্জারের দিকে আর অ্যানা এগোলো কিচেনের দিকে। অনেক অনেক কাজ আজকে।

দুপুরের আগে আগে ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেলো লিলি আর পিটারের। লিলি কে সাদা রঙা বল গাউন টায় অপরূপা দেখাচ্ছে। স্টোন গুলো রোদ পড়ে ঝিলিক দিয়ে উঠে গাউন টার সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে কয়েক গুণ৷ লিলির মুখ খানা মিষ্টি হাসিতে টইটুম্বুর হয়ে আছে। ভালোবাসার মানুষ কে নিজের করে পাওয়ার আনন্দ চোখে মুখে ফুটে উঠেছে ওর। স্যুটেড ব্যুটেড পিটার কেও আজ প্রচ্চুর হ্যান্ডসাম লাগছে। সর্বক্ষণ চুপচাপ থেকে কাজ করে যাওয়া পিটার যে কবে কিভাবে লিলির প্রেমে পড়ে গেছে এটা একটা রহস্য! মানুষ প্রেমে পড়লে তো তার হাব ভাব দেখে একটু হলেও বোঝা যায়, কিন্তু ছুপা রুস্তম পিটার কোনোদিন কাউকে এসব বুঝতেই দেয়নি। লিলিও না। হুট করে এসেই বলে বিয়ে করতে চায়! অথচ বোঝা যেত বেচারা ভাজা মাছ টা উলটে খেতে জানে না!

শার্লট ওর মেরুণ রঙা গাউন টা পরে আছে। খুশি ওর চোখে মুখে আর ধরছে না। বরাবরই আবেগপ্রবণ শার্লট লিলির খুশিতে নিজেও বাচ্চাদের মতো লাফাচ্ছে। ব্রায়ান তাকিয়ে দেখছে শার্লট কে। বোনের বেড়ে ওঠাটা আজ চোখে পড়ছে ওর। শার্লট কে এতদিন সেই ছোট্ট বোনটি ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি ওর, কিন্তু আজ মনে হচ্ছে বোনটা ওর বড় হয়ে গেছে অনেক। অপরূপা শার্লটের দিকে থেকে আজ চোখ সরানোই দায়।
অ্যানা এখনো কাজ করছে কিচেনে। ওর সাথে কাজ করতে থাকা অন্যদেরকে বিয়ের অনুষ্ঠানে ঠেলে ঠুলে পাঠিয়ে দিয়ে ও নিজেই সব কাজ একা হাতে করছে। রান্না বান্না সব শেষ, ইতোমধ্যে ওদিকে ভুরিভোজ ও শুরু হয়ে গেছে হয়তো। এখন শুধু কিচেন টা পরিষ্কার করা বাকি। এগুলো কোনো ব্যাপারই না। বলতে গেলে এক চুটকি তে হয়ে যাবে। শুধু শুধু ছেলে মেয়ে গুলোকে খাটানোর কোনো মানে হয় না৷

কিচেনের দরজা টা বন্ধ করে দিয়ে কাজ করছিলো অ্যানা। ওর কাজের ভেতরেই কে যেন এসে কড়া নাড়লো দরজায়। কাজ ফেলে, ঘর্মাক্ত চেহারা নিয়ে এসে দরজা খুললো ও। খুলতেই দেখতে পেলো থিয়োডর কে। থিয়োডর হা হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
কিমালেব থেকে ফিরে আসার পর এই প্রথম ওর থিয়োডরের সাথে দেখা হলো। থিয়োডর আজকাল নিজের মাঞ্জারে বেশি থাকে না। সেদিনের সেই দুর্ঘটনার কারণে এখন আউটসাইডার্স দের রেসিডেন্স এরিয়াতেই বেশি থাকা পড়ে ওর। যার জন্য অ্যানার চেহারাটা দেখার সৌভাগ্য ওর এখনো হয়ে উঠেনি। তাই আজ, এই মুহুর্তে অ্যানার শুভ্র, কিঞ্চিৎ রক্তিম অসাধারণ সৌন্দর্যমণ্ডিত চেহারাটা দেখে কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলো থিয়োডর। একটা মানুষ এতটা সুন্দর কিভাবে হয়!

থিয়োডর অপলক চোখে তাকিয়ে আছে অ্যানার টেরাকোটা রঙা ঠোঁট জোড়ার দিকে। মোলায়েম ঠোঁট জোড়া যেন একটু খানি টোকা দিলেই গলে পড়ে যাবে মাটিতে! সরু নাকের ওপর বিন্দু বিন্দু ঘাম হীরককণার ন্যায় চমক দিচ্ছে। কালো রঙা হরিণী চোখ জোড়াতে এক রাশ জিজ্ঞাসা।
থিয়োডর কে এমন কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের ন্যায় তাকিয়ে থাকতে দেখে বিরক্ত হয়ে গলা খাকারি দিলো অ্যানা। সাথে সাথেই ধ্যান ভাঙলো থিয়োডরের। অ্যানার দিকে এইভাবে তাকিয়ে থাকার কারণে লজ্জা পেলো ও। মাথাটা সামান্য নিচু করে নিয়ে গলা খাকারি দিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে মৃদু কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

— তুমি এখনো এখানে কাজ করছো কেন অ্যানা? ওদিকে এত আয়োজন করা হয়েছে, সেখানে অ্যাটেন্ড না করে তুমি এখনো কাজ করে চলেছো! গরমের ভেতরে এভাবে কিচেনের দরজা জানালা বন্ধ করে কেউ কাজ করে? লাল হয়ে গেছো দেখো! বের হয়ে আসো, অন্য কেউ করে দেবে ও কাজ। তোমাকে করতে হবে না৷
শেষোক্ত বাক্য গুলো কিছুটা হুকুমের ন্যায় শোনালো অ্যানার কাছে। বিরক্ত হলো ও প্রচন্ড। থিয়োডর কি ওর ওপর অধিকার ফলাতে চাইছে?
থিয়োডরের কথার জবাবে নিজের কন্ঠস্বরটা যথাসম্ভব নরম রাখার চেষ্টা করে অ্যানা বলল,

— কাউকে না কাউকে তো কাজ গুলো করতেই হতো, তো আমি করলে অসুবিধা কোথায়? আর তাছাড়া বিয়ের ফাংশনও শেষের দিকে। এখন অ্যাটেন্ড করেই বা কি, আর না করেই বা কি! আপনি গিয়ে ওদিক টা দেখুন থিয়োডর। আমি এদিক টা আমার মতো করে সামলে নিচ্ছি।
বলে এক প্রকার থিয়োডরের মুখের ওপরেই ধাম করে দরজা টা বন্ধ করে দিলো অ্যানা। অ্যানার এমন আচরণে থিয়োডর অবাক হওয়ার থেকে বেশি কষ্ট পেলো। মন খারাপ করে ফিরে এলো ও মিটিং জোনের দিকে।
৫৪. বিয়ের কালচারাল প্রোগ্রামটা শুরু হয়েছে ঘন্টা তিনেক আগে। মাঝখানে রাতের খাবারের জন্য কিছুটা বিরতি ছিলো। এরপর আবার সবাই নতুন উদ্যমে দ্বিতীয় দফা নাচাগানা শুরু করে দিয়েছে।

অ্যানা বসে আছে ওর কামরায়। ও শুধু রাতের খাবারটা খাওয়ার জন্যই যা একটু বাইরে বেরিয়েছিলো। এছাড়া আর বের হয়নি। রাতের ইভেন্টেও ও যায়নি। শার্লট এসে অনেকবার পিড়াপিড়ি করেছে, তবুও ওকে নড়াতে পারেনি। শেষ মেশ হাল ছেড়ে দিয়ে শার্লট একা একাই চলে গেছে সেখানে।
সন্ধ্যার পর ইভেন্ট টা কালচারাল থাকলেও এখন আর কালচারাল নেই। বাইরে, মিটিং জোনে ব্রায়ানের জোড়াতালি দেওয়া অসহায় সাউন্ডবক্সটায় বিকট শব্দে রক মিউজিক বাজছে। সেই মিউজিকের তালে তালে অন্ধকারের ভেতর আবছা পার্টি লাইটে পার্টি ড্যান্স দিচ্ছে সকলে। মিউজিকের সাউন্ড ছাড়া আর অন্য কিছুই শোনা যাচ্ছে না।
অ্যানা ওর কামরায় বসে বসে উচ্চস্বরে বেজে চলা মিউজিক থেকে নিজের মন অন্যদিকে নিতে একটা বই পড়ার চেষ্টা করছিলো। কয়েক পৃষ্ঠা পড়ার পরই হঠাৎ দূরের কোনো এক জায়গা থেকে ওর কানে এসে বাড়ি খেলো শার্লটের কন্ঠস্বর!

সচকিত হয়ে উঠলো অ্যানা। মিউজিকের সাউন্ড টাকে পাশ কাটিয়ে ও শোনার চেষ্টা করলো আসলেই শব্দটা সত্যি ছিলো, নাকি ওর মনের ভুল! কিছুক্ষণ কান পেতে থাকার পরই ওর কানে আবারও এসে ঠেকলো শার্লটের চাপা আর্তনাদ। মুহুর্তেই শব্দের উৎসের দিক টা পরিষ্কার হয়ে এলো অ্যানার কাছে। মাঞ্জারের একেবারে শেষের দিকে, ব্লু জোন যেখানে শুরু হয়েছে শব্দ টা সেদিক থেকেই আসছে।
এমন সময় নিজের কামরার দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পেলো অ্যানা। সেই সাথে ভেসে এলো ফ্যালকনের আতঙ্কিত কন্ঠস্বর,

— শেহজাদী!
অ্যানা দ্রুতগতিতে চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে দরজা খুলে দিলো। অ্যানাকে দেখা মাত্রই দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ফ্যালকন আতঙ্কিত গলায় বলল,
— শেহজাদী! আপনার সাথে যে মেয়েটা সর্বক্ষণ থাকে, শার্লট না কে, ওই মেয়ে টা আর ওর ভাই ব্রায়ান কে কারা জানি মাঞ্জারের পেছন দিকটাতে টানা হ্যাচড়া করতে করতে নিয়ে গেছে! আমি ওদের কে সাহায্য করতে গিয়েও করিনি। আমাকে ওরা কখনো এর আগে এদিক টাতে দেখেনি। এখন দেখলে সন্দেহ করতে পারে ভেবে আমি আর সেখানে যাইনি। সোজা আপনার কাছে চলে এসেছি!
কথা গুলো এক দমে বলে দম ফেললো ফ্যালকন। চোখ মুখ ওর উদ্ভ্রান্ত। বোঝাই যাচ্ছে খুব দ্রুত গতিতে এসেছে। জোরে জোরে দম ফেলছে ও।

বাদশাহ নামা পর্ব ৩৩+৩৪

ফ্যালকনের থেকে এমন কথা শোনা মাত্রই অ্যানার চোয়াল জোড়া শক্ত হয়ে এলো। এই কাজ কারা করতে পারে সেটা বুঝতে বেগ পেতে হলো না ওর। আর তার পরমুহূর্তেই দ্রুত পায়ে হেটে কামরার ভেতর ঢুকে গিয়ে নিজের বিছানার তলা থেকে বের করে নিয়ে এলো একটা ধারালো, চকচকা রাম দা। আর এরপর চোখে মুখে ভয়াবহ হিংস্রতা নিয়ে নিজের মাঞ্জার থেকে বের হয়ে ক্ষীপ্র গতিতে এগিয়ে চলল ব্লু জোনের সীমানার দিকে।

বাদশাহ নামা পর্ব ৩৭+৩৮

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here