বাদশাহ নামা পর্ব ৪৫+৪৬

বাদশাহ নামা পর্ব ৪৫+৪৬
আমিনা

ভোর সকালে সমুদ্রের ওপার থেকে সূর্য উঁকি দিয়ে উঠে লালচে আভা ছড়িয়ে দিলো সমস্ত আকাশ জুড়ে। সে আলোর ঝিলিক সমুদ্রের নীল রঙা পানিতে প্রতিফলিত হয়ে ঢেউ গুলো ক্রমশ লালচে থেকে সোনালি আলোয় ঝিকিমিকি করতে শুরু করলো।

শিরো মিদোরির দেমিয়ান প্রাসাদের সবচেয়ে উঁচু মিনারটার জানালা আর মার্বেল পাথরের দেয়ালে এসে আছড়ে পড়লো ভোরের প্রথম সূর্যকিরণ। ভোরের নিস্তব্ধতায় সমুদ্র থেকে ভেসে আসতে শুরু করলো ঢেউয়ের গর্জন, সেই সাথে জঙ্গলের পাখিদের কলকাকলীতে মুখোরিত হয়ে উঠলো চারপাশ। বাতাসে বয়ে প্রাসাদের সুউচ্চে অবস্থিত কামরা গুলোতে ভেসে আসতে থাকলো সমুদ্রের লবণাক্ততা মিশ্রিত স্নিগ্ধ ভোরের শীতল মায়াবী পরশ। ধীরে ধীরে সমস্ত প্রাসাদ টা ভোরের সোনালী আলোয় মুড়িয়ে ধারণ করলো এক স্বর্গীয় রূপ!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নিজের কামরার সমুদ্রের অতলস্পর্শী ঝিনুকের আকৃতির ন্যায় বিছানায় এলোমেলো ভাবে ঘুমিয়ে আছে অ্যানা৷ ওর শুভ্র কোমল নিরাবরণ শরীর টা একটা মুক্তা রঙা পাতলা চাদরে ঢাকা। অ্যানার পাশের জায়গাটা ফাঁকা। সেখানের বালিশ টায় কারো তৃপ্ত বিশ্রামের চিহ্ন, কিন্তু বিশ্রাম শেষ করে সে অনেক আগেই বিছানা ছেড়েছে।
কিছুক্ষণ পর ঘুম ভাঙলো অ্যানার। কিয়ৎক্ষণ আড়ামোড়া করে গায়ের চাদর টা শরীরে ভালোভাবে জড়িয়ে নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো ও। তারপর কামরার সমুদ্রের দিকের জানালাটার কাছে গিয়ে রেশমি পর্দা টা সরালো, সাথে সাথেই সকালের এক ঝাক মিষ্টি রোদে এসে ঝাপিয়ে পড়লো ওর চোখে মুখে। আলোর তীব্রতায় মিষ্টি হেসে চোখ কুচকে নিলো অ্যানা। তারপর আবার ফিরে গেলো বিছানার দিকে।

মীর নেই কামরাতে। গতকাল কারখানাটাকে ভেতরে থাকা অপরাধীদের শুদ্ধ উড়িয়ে দিয়ে, আঘাতপ্রাপ্ত মীর কে নিয়ে প্রাসাদে ফিরেছিলো ও। রাতেই প্রাসাদে হৈচৈ পড়ে গেছিলো যে শেহজাদী আবার প্রাসাদে ফিরে এসেছেন। কিন্তু এ খবর শুনে মীরের জন্য নির্ধারিত দাসী গুলোর মুখে ভাটা পড়ে গেলো। একেই এই মেয়ে বাদশাহর ধারে কাছে কাউকে ঘেঁষতে দেয় না, যা একটু কয়েক বছরের জন্য একটু নিস্তার পাওয়া গেছিলো, এখন আবার যা তাই!
সন্ধ্যা রাতে প্রাসাদে ফেরার পর মীর ওকে প্রাসাদের কারো সাথেই দেখা করতে দেয়নি। অ্যানার ব্যাক্তিগত দাসী গুলো এতদিন পর শেহজাদীকে প্রাসাদে পেয়ে পরম উচ্ছাসের সাথে ছুটে আসলেও কোনো গার্ড তাদের কে তাদের বাদশাহর অন্দরমহলের চৌকাঠ মাড়াতে দেয়নি৷ অ্যানা তাদের সাথে দেখা করতে চাওয়া সত্বেও দেখা করতে দেয়নি মীর। বলেছে ‘ তুমি ক্লান্ত, সকালে দেখা করো’।

যদিও কালাভুনা ক্লান্তির কথা বলে অন্যদের সাথে ওকে দেখা করতে না দিলেও নিজের পাওনা সুদে আসলে ঠিকই আদায় করে নিয়ে তবেই অ্যানাকে একটু ঘুমাতে দিয়েছে। তা নিয়ে মাঝরাতে অ্যানার অভিমানের শেষ নেই। শেষ মেশ না পেরে অ্যানা ওর সাথে লেপ্টে থাকা মীরকে নিজের থেকে সরিয়ে দিয়ে নিজের গাল ফুলিয়ে বলে উঠেছিলো,
— রাতের একটা বাজে, এখনো তোমার আবদারের শেষ হলো না!
মীর নেশালো চোখে অ্যানার দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে আবারও অ্যানাকে কাছে টেনে নিয়ে ওর শরীরে নিজের স্পর্শ গাঢ় করতে করতে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে একটা শুকনো ঢোক গিলে, ক্লান্ত পরিশ্রান্ত গলায় বলেছিলো,

— আজ যদি আমি মারা যেতাম, তবে এমন আবদার কে করতো তোমার কাছে? কার আবদার মেটাতে রাতের একটা বাজে জেগে থাকতে তুমি, বলোতো শিনু!
মীরের এহেন কথায় মীর কে সর্বশক্তি দিয়ে আকড়ে ধরে কেঁদে বুক ভাসিয়েছিলো অ্যানা। আর মীর অ্যানার কান্না দেখে সশব্দে হেসেছিলো শুধু! ব্লাকমেইল, পিউর ব্লাকমেইল! সব আদর করার ধান্দা!
রাতের স্মৃতি গুলো তাজা করে, ঠোঁট জোড়া তৃপ্ত ভঙ্গিতে প্রসারিত করে অ্যানা ধীর পায়ে হেটে ওর কামরার বাদিকের দেয়ালের সাথে লাগোয়া বিশালাকার ড্রেসিং টেবিলটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। চুল গুলো ওর বেনী করা, অথচ রাতে ঘুমানোর সময় চুল গুলো ওর খোলাই ছিলো। নিশ্চয় হতচ্ছাড়াটা বেধে দিয়েছে৷
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শরীরের ওপর থেকে চাদর টা খুলে ছেড়ে দিলো ও নিচে। সমস্ত শরীর জুড়ে মীরের পাগলামির চিহ্ন গুলো স্পষ্ট হয়ে আছে। সেগুলোকে দেখতে দেখতে অ্যানার মুখমণ্ডল জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো এক লাজুক হাসি।
তখনি ওর কামরার বাহির দ্বারে শোনা গেলো কড়া নাড়ার শব্দ। চমকে দরজার দিকে একবার তাকিয়ে মেঝে থেকে চাদর টা উঠিয়ে সমস্ত শরীর টা ভালো ভাবে ঢেকে নিলো অ্যানা৷ তারপর বলে উঠলো,

— এসো!
অ্যানার অনুমতি পাওয়া মাত্রই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো অ্যানার বাল্যবন্ধু ইয়াসমিন। ওর পেছন পেছন কামরায় ঢুকলো অ্যানার ব্যাক্তিগত দাসীদের দুজন।
ইয়াসমিন এসে অপরাধী চেহারায় অ্যানার সামনে দাঁড়িয়ে সামান্য মাথা নুইয়ে আনুগত্য দেখালো। পেছনে থাকা দাসী গুলো উচ্ছাসের সাথে মুখে হাসি ফুটিয়ে সমস্বরে ‘শেহজাদি’ বলে উঠে আনুগত্য দেখিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো৷
অ্যানা পেছনের দুজনকে এক পলক দেখে নিয়ে ইয়াসমিনের দিকে তাকালো। ইয়াসমিনের চোখে মুখে অপরাধবোধ। সেদিন রাতে নিজের বাদশাহের সম্পর্কে নিজেরই শেহজাদীর নিকট এইভাবে বলা টা তার একেবারেই উচিত হয়নি। অ্যানা রাগের মাথায় তাকে আর কখনো তার সামনে আসতে নিষেধ করে দিয়েছিলো। তাসত্বেও ইয়াসমিন আজ এসেছে আবারও। তার প্রাণের শেহজাদী তার ওপর রেগে আছে, এটা সে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেনা!
অ্যানা ইয়াসমিনের দিকে এগিয়ে এসে পেছনের দাসী দুটোকে ইশারায় বাইরে যেতে বলল। সে দাসী দুটো সামান্য মনোক্ষুণ্ণ হলো, কিন্তু অ্যানার আদেশ পালন করে দরজা ঠেলে বাইরে গিয়ে বাইরে থেকে আবার দরজাটা লাগিয়ে দিলো।

দাসী দুটো চলে যেতেই ইয়াসমিন দ্রুতপায়ে এগিয়ে এলো অ্যানার কাছে, তারপর অ্যানার হাত জোড়া ধরে মাথা নত করে ভেজা গলায় বলে উঠলো,
— শেহজাদী, আমি সেদিনের জন্য অনেক অনুতপ্ত! আমি আবারও আপনার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন শেহজাদী! বিশ্বাস করুন, সেদিনের পর থেকে আমি একটা রাতের জন্যেও ভালোভাবে ঘুমাতে পারিনি! অপরাধবোধ প্রতিনিয়ত আমাকে কুরে কুরে খেয়েছে শেহজাদী, আমাকে আপনি ক্ষমা করে দিন! এমন দুঃসাহস আমি আর কখনোই দেখানোর সাহস করবোনা শেহজাদী!
অ্যানা ইয়াসমিন কে থামিয়ে দিয়ে শান্ত গলায় বলল,

— আমি তোমাকে অনেক আগেই ক্ষমা করে দিয়েছি ইয়াসমিন! সেদিন আমারও এতটা রিয়্যাক্ট করা ঠিক হয়নি। সেদিন এমনিতেই আমার মাথা একটু গরম ছিলো, আর তার ওপর তুমি আমার মীরকে নিয়ে ওভাবে বলায় আমি আর নিজেকে সংযত রাখতে পারিনি। জানোইতো ওর ব্যাপারে কেউ কিছু বললে আমি সেটা নিতে পারিনা!
অ্যানার কথায় ইয়াসমিন আস্বস্ত হলো। বুক থেকে একটা পাথর সমান ভার নেমে গেলো যেন ওর। অসহায় মুখটা ওর কৃতজ্ঞতার হাসিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো। হাসি হাসি মুখ করে অ্যানার ডান হাত টা নিজের মুঠিতে নিয়ে চুমু খেয়ে বলল,

— আপনি আমার অশান্ত মনটাকে শান্ত করে দিলেন শেহজাদী! আপনার নিকট আমি চিরকৃতজ্ঞ!
অ্যানা কিছু বলল না। ইয়াসমিনের কথার প্রতিউত্তরে একটা মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে রাখলো ওর ঠোঁটে৷ ইয়াসমিন আবার বলল,
— আপনার খাবার প্রস্তুত আছে শেহজাদী! হিজ ম্যাজেস্টি বের হওয়ার আগে ইয়াসির কে বলে দিয়েছেন আপনার খাবার প্রস্তুত করে রাখতে৷ আপনি রাতে ভালো ভাবে খাননি তাই। আপনি বললেই নিয়ে আসবো।
— কোথায় গেছে ও? ইয়াসির কে কিছু বলেছে?

— না শেহজাদী, তবে উনি অনেক ভোরেই বেরিয়ে গেছেন। কোথায় গেছেন সেটা কাউকে বলেননি। তবে ফ্যালকন এসেছিলো হিজ ম্যাজেস্টির নিকট, ভোর বেলাতে, ইয়াসিরের থেকে শুনেছি।
অ্যানা ভ্রু কুচকালো। ফ্যালকন অতো ভোরে মীরের কাছে কেন এসেছিলো? আর মীরই বা কোথায় গেলো! ভাবলো একবার ফোন দিবে। কিন্তু পরক্ষণেই পেটের ভেতর টা ক্ষিদেয় মুচড়ে উঠলো ওর। মীর তবে ঠিকই আন্দাজ করেছে, ঘুম থেকে উঠেই ও খাই খাই করবে!
অ্যানা হাসলো নিজের মনে। তারপর ইয়াসমিন কে খাবার পরিবেশন করতে বলে ও ঢুকলো শাওয়ারে৷

সকালের খাবারের পর ওয়ারকার্স দের ডাইনিং এরিয়া সাফ করছে শার্লট। কিন্তু কাজে ওর মন নেই একটুও৷ মুখ খানা ভার হয়ে আছে। চোখ জোড়া ছলছলে। ধীর গতিতে হাত চালিয়ে কাজ করে চলেছে ও। ফাতমা ডাইনিং টেবিল থেকে এঁটো বাসন গুলো একটার পর একটা সাজিয়ে রাখছে ভেতরে নিয়ে গিয়ে পরিষ্কার করার জন্য।
শার্লটের অমনোযোগী ভাবটা ওর কয়েকদিন ধরে চোখে পড়ছে। কিন্তু শার্লট কেন এমন মন খারাপ করে আছে সেটার কূলকিনারা করে পারছে না ও৷ এক পর্যায়ে হাতের কাজ রেখে ফাতমা এগিয়ে এলো শার্লটের কাছে। তারপর শার্লটের কাধে হাত রাখলো।
ফাতমা হাত রাখতেই চমকে উঠলো শার্লট। নিজের ভাবনায় ও এতটাই ব্যাস্ত ছিলো যে ফাতমা কে ও লক্ষ্যই করেনি।
শার্লট কে এভাবে চমকাতে দেখে ফাতমা বুঝলো কিছু একটা ঠিক নেই। শার্লট কে নিজের দিকে আলতো হাতে ঘুরিয়ে ও শুধালো,

— কি হয়েছে রে তোর? সারাক্ষণ দেখছি কেমন মনমরা হয়ে থাকছিস! কোনো অসুবিধা? কিছু হলে নির্দ্বিধায় বল আমাকে। আমাদের অ্যানার মতো চুটকিতে সমাধান দিতে না পারলেও সময় নিয়ে হলেও দেওয়ার চেষ্টা করবো!
ফাতমার মুখে অ্যানার কথা শুনে এবার শার্লটের এবার সত্যি সত্যি কান্না পেলো। ঠোঁট উলটে কেঁদে ফেললো ও৷ হঠাৎ ওকে কেঁদে উঠতে দেখতে অপ্রস্তুত হলো ফাতমা। তড়িঘড়ি করে চিন্তিত কন্ঠে বলে উঠলো,
— একি রে! কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে তোকে?

শার্লট দুদিকে মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো, কান্নার দমকে কথা বের হলো না ওর মুখ থেকে। ব্রায়ান নিজের মাঞ্জার থেকে বেরিয়ে, হাতে একটা শাবল নিয়ে শক্ত মুখে আগাচ্ছিলো কিচেনের পেছন দিকে থাকা ওর করা শাকসবজীর বাগান টার দিকে। শার্লটের কান্নার শব্দ কানে আসতেই ও ফিরলো এদিকে। তারপর হাতের শাবল টা মিটিং জোনের ওদিকটায় রেখে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো ওদের দিকে। ফাতমা ব্রায়ান কে দেখে হাঁফ ছাড়া ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
— দেখুন না মিস্টার উইলসন! শার্লট তখন থেকে কেঁদেই যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করেছি কিন্তু কিছু বলছেও না কেন কাঁদছে!
ব্রায়ান ত্রস্ত ভঙ্গিতে শার্লটের কাছে এসে ওকে দুহাতে আগলে নিয়ে ফাতমার উদ্দ্যেশ্যে বলল,

— আমি দেখছি ফাতমা। তুমি বাসন গুলো ভেতরে নিয়ে যাও।
ফাতমা বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে শার্লটের দিকে এক পলক তাকিয়ে বাসন গুলো নিয়ে চলে গেলো কিচেনের দিকে৷ ফাতমা যেতেই ব্রায়ান ডাইনিং টেবিলের পাশে থাকা একটা চেয়ার টেনে সেখানে বসালো ফুপিয়ে কেঁদে চলা শার্লটকে। তারপর নিজেও একটা চেয়ার টেনে বসলো ওর মুখোমুখি।
ভুল করে ফেলেছে ব্রায়ান। অ্যানা যাওয়ার আগে ওকে বলে গেছিলো শার্লটকে যেন ওই ব্যাপারে কিছুই না জানায়, কিন্তু ব্রায়ান অ্যানার কথা রাখতে পারেনি। শার্লটের বারংবার জেরার মুখে মুখ ফসকে বলে দিয়েছে। আর তারপর থেকেই কেঁদে বুক ভাসিয়ে চলেছে শার্লট।
ব্রায়ান ক্রন্দনরতা শার্লটের চোখের লোনা পানিটা আঙুল দিয়ে মুছে দিয়ে নরম গলায় বলে উঠলো,

— অ্যানা আমাকে বলেছিলো তোকে যেন কিছুই না বলি। কিন্তু আমি ওকে দেওয়া ওয়াদা ভঙ্গ করে তোকে সব বলে দিয়েছি। এই ব্যাপারে পুরো ওয়ার্কিং জোনে শুধু মাত্র আমরা তিনজন ছাড়া আর কেউ জানে না৷ এখন তুই যদি এরকম করিস তবে সবাই অ্যানার ব্যাপার টা জেনে ফেলবে শার্লট! সারাক্ষণ এরকম মন খারাপ করে থাকিস না! আর বারবার অ্যানার কামরার দিকে গিয়ে বসে থাকিস না।
আমি আর থিয়োডর সবাইকে বলেছি যে অ্যানাকে কর্তৃপক্ষ বিশেষ ছুটি দিয়েছে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজের জন্য, কবে আসবে সেটা কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে জানায়নি। এখন তুই যদি বার বার অ্যানার মাঞ্জারের সামনে গিয়ে এভাবে বসে থাকিস তবে সবাই ব্যাপার টা সন্দেহের চোখে দেখবে!

— আমি কি করবো ভাইয়া! অ্যানা চলে যাওয়ার আগে আমার সাথে একটাবার দেখা করে গেলো না! ও কোথায় আছে, কি করছে, কি খাচ্ছে, বেচে আছে নাকি ওরা ওকে মেরে ফেলেছে সেটাও জানিনা! ওর জন্য আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে ভাইয়া, আমি রাতে ঘুমাতে পারছিনা এক ফোটাও!
ফুপিয়ে কেঁদে কেঁদে ব্রায়ানের হাত ধরে কথা গুলো বলল শার্লট৷ ব্রায়ানের চোখ জোড়া ছলছল করে উঠলো! ওরও তো মন চাইছে শার্লটের মতো করে নির্দ্বিধায় একটু কাউকে জড়িয়ে ধরে এইভাবে কাঁদতে! বুকের ভেতর টা যে জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে ওর, কিন্তু কাকে বোঝাবে ও!
শার্লটটা নিজেই ভেঙে পড়েছে, সেখানে ওও যদি এখন ভেঙে পড়ে তবে কে সামলাবে ওদেরকে!
শার্লটকে সব সমস্যা থেকে আগলে নেওয়া সে অ্যানাই তো আর নেই! কে এখন শার্লটকে বোঝাবে, কে থামাবে ওর কান্না!

ব্রায়ান একটা ঢোক গিলে ঝুকে এসে শার্লটের মাথাটা নিজের বুকে টেনে নিলো। শার্লট ভাইয়ের বুকে স্থান পেয়ে আরও জোরে কেঁদে উঠলো। ব্রায়ানের চোখ থেকেও দুফোটা লোনা পানি নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়লো শার্লটের চুলের ওপর, কিন্তু সেগুলোকে ও সন্তর্পণে লুকিয়ে নিলো, যেন নিজের মস্তিষ্ক কেও বুঝতে দিলো না যে ওরও কষ্ট হচ্ছে।
যারা দেখলো তারা এটাকে নিছক দু ভাইবোনের মনোমালিন্য পরবর্তী সখ্যতা হিসেবে ধরে নিলো, কিন্তু কেউ জানতেও পারলোনা একটা মায়া ভরা বুকের অধিকারী রমণীর জন্য দুজনেরই হৃদয় পুড়ছে।

বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলো, তবুও মীরের কোনো খবর নেই। অ্যানা হাতে ফোন টা ধরে চিন্তিত মুখে কামরার এ মাথা থেকে ও মাথা পায়চারি করে বেড়াচ্ছে। সকাল থেকে এখনো পর্যন্ত কতবার যে মীরের ফোনে কল লাগিয়েছে তার হিসাব নেই, কিন্তু কালাভুনা টার কোনো হদিস নেই। না তুলছে ফোন, না দিচ্ছে টেক্সট। চিন্তায় চিন্তায় মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে অ্যানার৷
ফ্যালকনের কাছেও কয়েকবার ফোন দিয়েছে, কিন্তু মীরের মতো সেও লাপাত্তা। কারো কোনো খোজ নেই! ক্রমে ক্রমে অস্থির হয়ে উঠছে অ্যানা। কয়েকবার ইয়াসির নামক ক্যাস্ট্রেটেড গার্ড টার কাছে খোঁজ নিয়েছে, কিন্তু সেও কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি৷

শেষ মেশ অ্যানা পায়চারী বাদ দিয়ে স্থীর হয়ে বসলো বিছানায়। মাথার ভেতরের দুঃশ্চিন্তা টা এবার রাগে রূপ নিতে শুরু করেছে ওর। কালাভুনা টার এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজ কর্মের জবাব চাইবে আজ ও৷
কি এমন জরুরি কাজ পড়েছে তার যে ফোন টা তোলা যাবে না, টেক্সট এর রিপ্লাই দেওয়া যাবে না! যত্তসব!
ওই ফ্যালকন টাকেও দেখে নেবে অ্যানা। ফাজিল ছেলে! একটাবার কল রিসিভ করে তো বলে দেওয়া যায় যে আমরা এই কাজে বিজি আছি এখন কথা বলার সময় নেই! সেটুকুও করতে পারছে না!
সময় গড়ালো আরও খানিক। অ্যানা নিজের বিছানা ছেড়ে উঠে চলে গেলো কামরার ব্যালকনিতে। ব্যালকনিটা জঙ্গলের দিকে মুখ করা। একটা কেদারা টেনে সেখানে বসে জঙ্গলের দিকে ফিরে মুখ ভার করে বসে রইলো অ্যানা। একজন দাসী এসে ওকে এক কাপ কফি দিয়ে গেলো। সেটাতে ছোট্ট ছোট্ট করে চুমুক দিতে দিতে জঙ্গলটাকে দেখতে শুরু করলো ও।

জঙ্গল জুড়ে অন্ধকার নেমে এসেছে, কিন্তু জেগে উঠতে শুরু করেছে হরেক রকমের আজগুবি জীবজন্তু। যেখানে সেখানে একটু একটু করে আলোকরশ্মি জ্বলে উঠছে বারে বারে। গাছপালা গুলো জুড়ে হুটোপুটি করে বেড়াচ্ছে ছোট্ট ছোট্ট কিছু ফ্লাপি কাঠবেড়ালি। গায়ের পশমগুলো ওদের জ্বলজ্বল করছে।
শিরো মিদোরির জঙ্গলের গাছপালা সহ সমস্ত জীবজন্তুরই এটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য। রাত হলেই জঙ্গল জুড়ে আলোকরশ্মিগুচ্ছ খেলা করে বেড়ায় তাদের শরীর জুড়ে। পৃথিবীর অন্য সকল স্থানের জীবজগৎ থেকে সম্পুর্ন ভিন্ন এই জীবজগৎ কখন, কিভাবে বেড়ে উঠেছে সে সম্পর্কে কারোরই জানা নেই!
অ্যানা সেদিকে তাকিয়ে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে গাছপালাগুলো জুড়ে ছুটে বেড়ানো ছোট্ট ছোট্ট কিউট কিউট পিচ্চি গুলোকে দেখছিলো। এমন সময়ে ইয়াসমিন সেখানে এসে উপস্থিত হয়ে ব্যালকনিতে ঢোকার দরজায় দাঁড়িয়ে ডেকে উঠলো,

— শেহজাদী!
অ্যানা জঙ্গলের দিকে দৃষ্টি রেখেই অমনোযোগী কন্ঠে উত্তর করলো,
— বলো ইয়াসমিন।
ইয়াসমিনের পেছন থেকে দুজন দাসী র‍্যাপিং পেপারে মুড়িয়ে রিবন দিয়ে বাধা একটা বড়সড় বক্স এনে রাখলো অ্যানার সামনে, তারপর নিজেদের পেছন দিকে হেটে আবার বেরিয়ে গেলো বাইরে। অ্যানা বক্স টার দিকে একবার তাকিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো ইয়াসমিনের দিকে। ইয়াসমিন মুখে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে বলে উঠলো,
— হিজ ম্যাজেস্টি পাঠিয়েছেন আপনার জন্য!
অ্যানা একবার গিফট বক্স আর একবার ইয়াসমিনের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বিস্ময়াভিভূত হয়ে লাফিয়ে চেয়ার থেকে নেমে দাঁড়ালো। কালাভুনার বাচ্চা টা সারাদিন নকশা মেরে এখন গিফট বক্স পাঠিয়েছে! আসুক আজকে প্রাসাদে, ওর গিফট ওকে ভর্তা করে খাওয়ানো হবে৷
অ্যানা কপট রাগ দেখিয়ে বক্সটার রিবন ফিতা টা খুলতে নিলো। তখনি দেখলো রিবন ফিতাটির নিচে অসাধারণ সুন্দর নকশা করা একটি ছোট্ট চিরকুট। অ্যানা কপাল কুচকে চিরকুট টা হাতে নিয়ে মেলে ধরলো সামনে। সেখানে মীরের হ্যান্ডরাইটিংএ গোটা গোটা করে লেখা,
“ হ্যাপি ফিফটি এইটথ অ্যানিভার্সারি, মা’ বিয়্যুটিফ্যুল অর্কিড”

ছোট্ট চিরকুট টা পড়ে অ্যানার চোখে মুখে খুশির ঝিলিক দিয়ে উঠলো। এতসব ঝামেলার চক্করে অ্যানা তো ভুলেই গেছিলো আজ ওদের অ্যানিভার্সারি। কালাভুনা টা তবে এইসব করতে সারাদিন এর সামনে আসেনি!
গত দুবছরে মীর চাইলেও অ্যানা ওদের অ্যানিভার্সারি পালন করতে দেয়নি৷ শুধু কি অ্যানিভার্সারি, কিছুই পালন করেনি ও। বিশেষ দিনগুলোতে ও দিনের বেলাটা সমুদ্রের পাড়ে আর রাতের বেলাটা লাইফট্রির আশেপাশে ঘুর ঘুর করে কাটিয়ে দিতো। মীরের হাজার অনুরোধেও কোনো কাজ হতো না! কিন্তু এবার মীরের ওপর থাকা অভিমানের পাল্লাটা হালকা হয়ে গিয়েছে অনেক! আর কতগুলো দিন মানুষ টিকে বঞ্চিত করবে ও!
অ্যানা তাড়াহুড়ো করে বক্সের মুখ টা খুলে মেলে ধরলো সামনে। ভেতরে তাকাতেই দেখতে পেলো আর একটা চিরকুট। সেটা হাতে নিয়ে মেলে ধরে পড়লো,

“রাতের ন’টার ভেতর রেডি হয়ে বসে থাকবে, নটার ওপাশে যতগুলো সেকেন্ড লেইট করবে তত গুলো চুমু আমার পাওনা।”
লেখাটা পড়ে অ্যানার ঠোঁট জোড়া প্রসারিত হলো। কি ভেবে ও এবার চিরকুটের পেছন দিকটা মেলে ধরলো সামনে। সেখানে মীরের হাতে লেখা,
“ তুমি চাইলে দু ঘন্টা লেইট করতে পারো, আমি কিছু মনে করবো না”
অ্যানা ফিক করে হেসে দিলো। তারপর চিরকুট টা পাশে রেখে বক্সের ভেতর গিফট টাকে ঢেকে রাখা লালা রঙা রেশমি কাপড় টা সরালো অ্যানা৷ সরাতেই ওর চোখ জোড়া খুশিতে পরিপূর্ণ হয়ে গেলো। বিয়ের দিনের স্মৃতি গুলো মুহুর্তেই তরতাজা হয়ে উঠলো ওর। না চাইতেও চোখ থেকে দুফোটা নোনা জল গড়িয়ে পড়লো ওর কোলের পরে৷
৬৫. প্রাসাদের অন্দরমহলের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে চারজন বলিষ্ঠ শরীরের সুপুরুষ। সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজেদের ভেতর হাসি তামাসা করছে তারা এসে থেকে৷ এ ওরে খোঁচাচ্ছে, ও এরে খোচাচ্ছে! সকলেরই পরণে সাদা রঙা শার্ট আর তার সাথে চারকোল রঙা প্যান্ট। শার্টের হাতা গুলো গোটানো, বুকের কাছটা আঁটসাঁট ভাবে লেগে আছে দেহের সাথে৷ তাদের কথার ফুলঝুরিতে প্রাসাদের অন্দরমহলে থাকা দাসী গুলো মাঝে মাঝেই উঁকি মেরে দেখে চলেছে এই সুদর্শন চার যুবককে৷
এমন সময় সেখানে এসে উপস্থিত হলো প্রাসাদের অন্দরমহলের গার্ড ইয়াসির। তাকে দেখা মাত্রই চারজন যুবকের ভেতরের সবচেয়ে বড়সড়, লম্বা ছেলেটা শুধালো,

— আম্মার রেডি হওয়া কতদূর ইয়াসির?
— শেহজাদী নামছেন। অন্দরমহল পেরিয়েই চলে আসবেন এক্ষুনি। আপনারা আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন৷
কোকোর দিকে এক পলক তাকিয়ে উত্তর করলো ইয়াসির। তারপর আবার অন্দরমহলের দিকে হাটা দিলো।
বাদশাহ এবং তার একমাত্র বেগমের আটান্নতম অ্যানিভার্সারি উপলক্ষে প্রাসাদ জুড়ে উৎসব চলছে৷ দাসীরা নিজেদের ভেতর খলবলিয়ে কথা বলে চলেছে৷ তাদের কথার প্রধান টপিক হলো শেহজাদী। শেহজাদী তাদের অন্দরমহলে আসেননা বললেই চলে! তাই এখানের বেশিরভাগ দাসীই শেহজাদীকে কখনো চোখের দেখা দেখেনি। শুধুমাত্র শুনেছে শেহজাদীর রূপের গল্প আর বাদশাহকে তার চোখ ধাধানো রূপের মোহে আটকে রাখার গল্প।

প্রাসাদের প্রৌঢ়বয়সী দাসী গুলোর অনেকেই শেহজাদীকে পছন্দ করেন না। তাদের অন্দরমহলে শেহজাদী ‘হোয়াইট উইচ’ নামে পরিচিত। আজ যদি শেহজাদী না থাকতো তবে প্রাসাদে তাদেরই রাজত্ব চলত। তাদের গর্ভেধারনকৃত সন্তানের ন্যায় দীর্ঘ জীবন তারা না পেলেও যতগুলো দিন বাঁচতো নিজেকে শেহজাদার মা হিসেবে পরিচয় দিয়ে অন্তত গর্ববোধ করতে পারতো! সেই কটা দিন অন্তত রানীর হালে থাকতো!
কিন্তু এই শেহজাদীর জন্য তাদের জীবনটাই বরবাদ হলো। যৌবন গুলো নষ্ট হলো অকারণে!
দাসীদের গল্পের মাঝেই ইয়াসির সহ আরও বেশ কয়েকজন গার্ড মেয়েদের অন্দরমহলের মাঝে তড়িঘড়ি করে এসে পৌছে তাড়াহুড়ো করে বলতে শুরু করলো,

— মেয়েরা, সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে যাও। কেউ এক ফোটাও নড়বে না। মাথা নিচু করে থাকবে। শেহজাদী আসছেন! যাও, যাও!
ইয়াসিরের কথায় অন্দরমহলে হৈচৈ পড়ে গেলো। দাসী গুলো যে যার জায়গা থেকে দ্রুত উঠে অন্দরমহলের মাঝের চলার রাস্তা টার দুপাশে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে গেলো সারিবদ্ধ ভাবে। শেহজাদী কে প্রথমবার চোখে দেখার উত্তেজনায় অনেকের হাত পা কাঁপতে শুরু করলো। নিজেদেরকে সামলে নিয়ে ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো তারা।
ইয়াসির এবং অন্যান্য অন্দরমহলের গার্ড গুলোও দাসীদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো। তার কিছুক্ষণ পরেই প্রাসাদের অন্দরমহলের অভ্যন্তরীণ প্রবেশদ্বারের রয়্যাল মেমবার ইন্ডিকেটরে একটা ফিমেইল ভয়েস বলে উঠলো,
— অ্যাটেনশান! আওয়ার অনারেবল বেগাম অ্যান্ড শেহজাদী আনাবিয়া ফারহা দেমিয়ান।

অ্যানার পুরো নাম টা শোনা মাত্রই সমস্ত অন্দরমহলের হলরুম টা জুড়ে নেমে এলো পিনপতন নিরবতা। আর তার কিছুক্ষণ পরেই প্রাসাদের সাদা রঙা মার্বেল পাথরে মৃদু মিষ্টি সুর তুলে হলরুমে প্রবেশ করলো অ্যানা। আর অ্যানা প্রবেশ করতেই সেখানের সবার দৃষ্টি যেন থমকে গেলো ওকে দেখে।
পরণের অফ হোয়াইটের ফুল স্লিভ বল গাউন টা যেন এক টুকরো চাঁদনীর মতো জড়িয়ে আছে ওকে। সমস্ত গাউন টা জুড়ে ছোট্ট ছোট্ট মুক্তা আর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হীরককণার অপূর্ব নকশা, আলোর ঝলকে ঠিকরে উঠে সেগুলো চারপাশ টাকে আরও উজ্জ্বল করে তুলছে!

নিজের প্রতিটা পদক্ষেপে রাজকীয় স্নিগ্ধতা মিশিয়ে, ধীর গতিতে এক অনন্য মাধুর্য আর দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের সাথে হেটে সামনে এগোতে লাগলো অ্যানা। গাউনের পেছনের ভারী কাপড় মেঝেতে আলতো ভাবে ছুয়ে টেনে চলতে লাগলো ওর সাথে। প্রতি পদক্ষেপের সাথে সাথে ওর পায়ের নুপুরের মৃদু ঝংকার তৈরি করতে লাগলো সুরের মূর্ছনা।
মাখনের মতো মসৃণ, কোমল গাল দুটোতে ব্লাশের মৃদু ছোয়া, যেন সেখানে স্পর্শ করা মাত্রই গলে যাবে। টেরাকোটা রঙা ঠোঁট জোড়াতে সুক্ষ্ম, দুর্বোধ্য হাসি। কুচকুচে ঘন কালো রঙা চোখের পাপড়ির নিচে হীরকখণ্ডের ন্যায় চোখ জোড়াতে স্নিগ্ধতা, প্রজ্ঞা আর মায়ার মিশেল।

গাউনের পেছন টা ব্যাকলেস। চুল গুলো মাথার ওপরে দারুন করে বেধে রাখা, পেছন থেকে কয়েক গুচ্ছ বেবি হেয়ার কার্ল হয়ে ছড়িয়ে আছে শুভ্র মোলায়েল খোলা পিঠখানার ওপর, যা ওর সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তুলেছে কয়েক গুন! চুলগুলোর ওপরে হীরক খচিত ছোট্ট একটি টায়রা। কানে ছোট্ট ছোট্ট হীরার দুল। সেগুলোতে আলো পড়ে চারদিকটা ঝলমলিয়ে উঠছে বারে বারে।

অ্যানার এমন চোখ ধাধানো চেহারা দেখে দাসীরা মাথা নিচু রাখতে ভুলে গেলো যেন! এক ধ্যানে ওরা দেখে চলল তাদের সামনে দিয়ে কোমরে ঢেউ তুলে হেটে যাওয়া এই অসম্ভব রূপবতী মেয়েটিকে। সময় টা যেন থমকে গেলো একেবারে। অ্যানা এগোনোর সাথে সাথে ওর শরীর থেকে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো অসাধারণ এক ম্যাজেস্টিক মিষ্টি ঘ্রাণ, দাসীদের যেন ঘোর লেগে গেলো তাতে! মুগ্ধ চোখে ওরা তাকিয়ে রইলো অ্যানার দিকে।

হাটতে হাটতে নিজের বা দিকে সামান্য ঘাড় ঘুরিয়ে অ্যানা তাকালো কয়েকটা দাসীর দিকে। ওর সে গভীরতা পূর্ণ মায়াবী চাহনি দেখা মাত্রই ওরা কয়েকজন স্থীর হয়ে গেলো। অ্যানা ওদের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিজের মনে একটু হেসে নিয়ে ধীর গতিতে এগোলো সামনে। ওর এই নজর থেকে বাঁচার সাধ্য আছে কার! যেখানে দেমিয়ান বংশের ওই শক্তিশালী পুরুষটি পর্যন্ত ওর এই মোহনীয় দৃষ্টিকে উপেক্ষা করতে পারে না, সেখানে এরা কিভাবে পারবে!
অ্যানা হলরুম পেরিয়ে বাইরে বেরিয়ে যাওয়া মাত্রই দাসীরা যেন এবার দম নিলো বুক ভরে। ওই অত্যান্ত সুন্দরী মেয়েটা যেন এতক্ষণ ওদের দম আটকে রেখেছিলো! মুহুর্তেই উচ্ছসিত হয়ে উঠে নিজেদের ভেতর আবারও আলোচনায় বসে গেলো ওরা। কেউ পড়লো অ্যানার চেহারা নিয়ে, কেউ পড়লো ওর চোখ নিয়ে, কেউ পড়লো ওর পোশাক নিয়ে, কেউ বা পড়লো ওর হাটার ভঙ্গি নিয়ে। তাদের কল্পনাকে ছাপিয়ে যাওয়া এই দম আটকানো অপ্সরা কে নিয়ে চলতে থাকলো তাদের আলাপচারিতার গুঞ্জন।

ফ্যালকন, কোকো, হাইনা আর জোভি দাঁড়িয়ে ছিলো কিছুটা সামনেই। অ্যানার জন্য অপেক্ষা করতে করতে এরই মাঝে ফ্যালকনের সাথে এক দফা মারামারি ঝাকাঝাকি হয়ে গেছে কোকোর। অ্যানা অন্দরমহল থেকে থেকে বেরিয়ে ওদের দিকে যেতে নিলেই কোকো ফ্যালকন দের চোখ গেলো সেদিকে। মারামারি ভুলে ফ্যালকন কোকো দুজনেই দাঁড়িয়ে গেলো অ্যানার দিকে চেয়ে।
ফ্যালকন অ্যানার দিকে অপলকে তাকিয়ে থেকে কোকোর হৃষ্টপুষ্ট পেট টাতে কনুই দিয়ে গুতা দিয়ে চাপা, উত্তেজিত গলায় বলে উঠলো,

— ভাইরে ভাইইইই! আমাদের শেহজাদী কে আজ হুরপরী লাগছে রেএএএএ!
ফ্যালকনের কথা শুনে সকলে তাকালো অ্যানার দিকে। কোকো নিজের বুকের বা পাশ টা ডান হাতে দিয়ে চেপে ধরে ফ্যালকনের মতো করে উত্তর দিলো,
— আজকে আমার আব্বাজান শ্যাষ রে ফ্যালকন! এই সাদা পরীটাকে দেখে আব্বাজান সামলাতে না পেরে হার্টঅ্যাটাক না করলেই হলো!
ফ্যালকন আর কোকোকে এইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অ্যানা হেসে দিলো এবার৷
— কিরে, তোরা এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? মনে হচ্ছে আজ নতুন দেখছিস আমাকে!
চোখ ঘুরিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলল অ্যানা৷ অ্যানার কথা শেষ হতে না হতেই ফ্যালকন ওপাশ থেকে নালিশের সুরে বলে উঠলো,

— শেহজাদী, কোকো হিজ ম্যাজেস্টি কে আব……
ফ্যালকন কথা শেষ করার আগেই কোকো ওর মোটাসোটা হাত খানা দিয়ে ফ্যালকনের মুখ চেপে ধরে ওকে থামিয়ে দিয়ে ওর দিকে কটমটে চোখে তাকালো। অ্যানা ওদের দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে কপট রাগ দেখিয়ে বলে উঠলো,
— আজকের দিনেও তোরা মারামারি করবি?
অ্যানার ধমকে কোকো ফ্যালকন দুজনেই থেমে গেলো, তারপর কোকো ফ্যালকন কে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গলা খাকারি দিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,
— চলুন শেহজাদী, হিজ ম্যাজেস্টি আপনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন।
কোকোর ভঙ্গি দেখে অ্যানা ফিক করে হাসলো, তারপর ওদের সামনে এগোতে এগোতে শুধোলো,
— কোথায় যাচ্ছি আমরা?
পেছন থেকে ফ্যালকন বলে উঠলো,
— লোকেশন বললে চাকরি থাকবে না। গলাও উধাও হয়ে যেতে পারে!

মীরের ব্যাক্তিগত কালো রঙা রয়্যাল কারে অজানার উদ্দ্যেশ্যে পাড়ি দিয়েছে অ্যানা। ওকে বলা হয়নি ঠিক কোথায় যাচ্ছে ওরা। অটো ড্রাইভ এর গাড়িটা মৃদু মন্দ গতিতে এগিয়ে চলেছে গন্তব্যের দিকে। পেছনের সিটে গাড়ির উইন্ডোতে দুই হাত ঠেকিয়ে সেখানে থুতনি ঠেকিয়ে বসে আছে অ্যানা, চোখ জোড়া ওর বাইরে। রেড জোনের রাতের সৌন্দর্যটা একমনে উপভোগ করছে ও৷
কোকো ফ্যালকনেরা অন্য গাড়িতে। মীরের গাড়িতে ওঠার অধিকার অ্যানা ছাড়া আর কারো নেই। বেশিরভাগ সময়ে মীর নিজেই গাড়ি চালায়, নয়তো অটো ড্রাইভিং মোড অন করে রাখে।

অ্যানা জানালার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে গাড়িটার ভেতরে তাকালো। এই গাড়িটার কোণায় কোণায় ওদের ভালোবাসার স্মৃতি। কত্তগুলো পাগলাটে, ভালোবাসাময় রাত ওরা এই গাড়িতেই কাটিয়েছে সে হিসাব করতে গেলে ওর বছর লেগে যাবে! কত রাত মীর ওকে নিয়ে হুট করেই বেরিয়ে পড়েছে ঘুরতে। ঘুম ঘুম চোখে থাকা অ্যানার ঘুম উড়িয়ে দিয়েছে নিজের শরীরের গাঢ় স্পর্শ দিয়ে। কত মান অভিমানের পালা চলেছে ওদের এই গাড়ির ভেতরে!
আনমনে হাসলো অ্যানা। আটান্ন টা বছর! এত্ত গুলো বছর কিভাবে ওই কালাভুনাটার সাথে কেটে গেলো ওর! এখনো মনে পড়লে মনে হয় এইতো সেদিনের কথা, মীর ওকে দুম করেই বিয়ে করে নিয়েছিলো, অথচ অ্যানা তখনও পরিপক্ক হয়ে উঠেনি। সেই অ্যানাকে নিজের বুকে রেখেও আদর করতে না পেরে তড়পাতে থাকা মীরের মুখ খানা তখন দেখার মতো হতো!

অ্যানা শব্দ করে হাসলো এবার। পাশে থাকা ফোন টাতে তখনই টুংটাং শব্দ তুলে বার্তা এলো। অ্যানা মৃদু হেসে ফোন টা হাতে তুলে নিয়ে মেসেজে ঢুকলো। ওপরে কালাভুনা’ নাম টা ফুটে আছে।
“এত মিষ্টি করে হেসো না, হৃৎপিণ্ডটা বেরিয়ে আসবে আমার”
মেসেজটি পড়ে অ্যানার ঠোঁট জোড়া মিষ্টি হাসিতে প্রসারিত হলো। নিঃশব্দে হেসে নিজের বা কাঁধের ওপর হাত বোলালো ও। কতশত দিন পূর্বে ওর শরীরে ট্র‍্যাকার সেট করে দিয়েছিলো মীর। সেবার অ্যানা ভার্সিটি থেকে ক্যিডন্যাপ হওয়ার পর মীরের ভেতরে ভয় ঢুকে গেছিলো যে, আবার না ওর শিনজো ওর থেকে হারিয়ে যায়৷ সেদিনের পর থেকে একটা মূহুর্তের জন্যেও মীরের নজরের বাইরে যেতে পারেনি ও৷ কোনো না কোনোভাবে অ্যানার প্রতিটা পদক্ষেপ ওর নখদর্পনে, তাই সে যেভাবেই হোক!

আনমনে স্মৃতিচারণ করতে করতেই গাড়িটা হঠাৎ করে থেমে গেলো। অ্যানা চমকালো, পৌঁছে গেছে! গাড়ির ভেতর থেকে সামনে তাকালো ও। সমুদ্রের পাড়ে এসে দাঁড়িয়েছে গাড়িটা। সামনে বিশাল সমুদ্রের জলরাশি। সেদিক থেকে বারে বারে ধেয়ে আসছে লবণাক্ত শীতল বাতাস।
অ্যানার গাড়ির সামনেই দৃঢ় চিত্তে দাঁড়িয়ে আছে লাল, সাদা আর গোলাপি রঙা গোলাপ দিয়ে সাজানো একটি বিশালাকার আর্ক। গাড়িটা যেখানে থেমেছে সেখান থেকে শুরু করে আর্কের ভেতর দিয়ে সোজা সামনে চলে গেছে একটি লালরঙা মখমলি গালিচা। গালিচার দুপাশে বাচ্চাদের জন্য দুচার টা টেবিল রাখা৷ গালিচা টা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে ফুল দিয়ে তৈরি একটি ছোট্ট সিলিং লেস প্যান্ডেল। লিও কাঞ্জিরা দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। কোকোরাও পাশের গাড়ি থেকে নেমে গেছে৷ কিন্তু মীর কই?

কোকো ফ্যালকনেরা গাড়ি থেকে নেমেই ছুটলো প্যান্ডেল টির দিকে। প্যান্ডেলের বেদীর ওপর উঠেই হুড়োহুড়ি শুরু করলো ওরা সকলে। অ্যানা ওদের দিকে থেকে চোখ সরিয়ে গাড়ির উইন্ডো দিয়ে তাকিয়ে আশে পাশে তাকিয়ে মীরকে খুজতে ব্যাস্ত হলো। তখনি ওর গাড়ির দরজাটা সশব্দে খুললো কেউ। চমকে সেদিকে তাকালো অ্যানা। তাকাতেই ওর চোখে পড়লো স্বর্ণালি আভা ছড়ানো শিকারী চোখের অধিকারী মীরের চেহারাটা।
কালো জমীনের ওপর সোনলি রঙা বর্ডার দেওয়া ঢিলাডালা রোব আর সাদা রঙা ঢোলা প্যান্ট পরণে ওর৷ ঘাড় বাবরি ঝাকড়া চুলগুলো বাতাসে মৃদু মন্দ উড়ছে। ঠোঁট জুড়ে ওর মুগ্ধ করা হাসি। রোবের বুকের কাছ টা উন্মুক্ত, পেশিবহুল বলিষ্ঠ বুকটা প্যান্ডেলের দিক থেকে ভেসে আসা আলোতে চকচক করছে। সেদিকে তাকিয়ে অ্যানার চোখ জোড়া আটকে গেলো। এই লোকটা সারাক্ষণ বুক খুলে রাখে কেন? অ্যানাকে সিডিউস করার ধান্ধা!

অ্যানাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মীর ওর হাত টা বাড়িয়ে দিলো গাড়িতে বসা অ্যানার দিকে। অ্যানা মীরের বুকের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে তাকালো মীরের বাড়িয়ে দেওয়া ইস্পাত-দৃঢ় হাতটির পানে৷ তারপর নিজের হীরকখন্ডের ন্যায় দৃষ্টি টা মীরের চোখ জোড়ার ওপর নিবদ্ধিত রেখে মীরের হাত টা ধরে গাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো ও৷ আর অ্যানার মুখের ওপর প্যান্ডেলের ঝলমলে আলো পড়তেই এক মুহুর্তের জন্য থমকে গেলো মীর৷ সমস্ত বুক টা জুড়ে বাটারফ্লাই খেলে গেলো ওর। অপলক দৃষ্টিতে অ্যানার শুভ্র, স্নিগ্ধ মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে রইলো ও।
দূরে কোথাও ডেকে উঠলো এক ঝাক রাতের পাখি। সমুদ্র বাতাসের সাথে ষড়যন্ত্র করে তুলতে লাগলো একের পর এক বিশাল ঢেউয়ের গর্জন। এই অতীব সুন্দরী মেয়েটির রূপ দেখতে বাধা দিতে একের পর এক বাতাসের শক্তিশালী ঝাপটা এসে আছড়ে পড়তে লাগলো মীরের চোখে মুখে। কিন্তু তাদের কোনো ষড়যন্ত্রই সফল হলো না। মুগ্ধ দৃষ্টি টাকে এক মুহুর্তের জন্যও টলাতে সক্ষম হলোনা তারা কেউ!

প্যান্ডেলের বেদীর ওপর দাঁড়ানো কোকো ফ্যালকন কে গুতা মেরে বলে উঠলো,
— বলেছিলাম না! এখন প্রমাণ দেখ সামনাসামনি।
ফ্যালকন ওর কথায় মীর অ্যানার দিকে তাকিয়ে হাসলো মৃদু। দুজনকে একসাথে এভাবে দেখে চোখ জোড়া জুড়িয়ে এলো ওদের সবার।
মীর অ্যানাকে নিজের কাছে টেনে দুহাতে জড়িয়ে নিয়ে ওর কপালে নিজের উষ্ণ ঠোঁট জোড়া ছুইয়ে দিয়ে কপালে ঠোঁট ঠেকিয়ে রেখেই মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো,
— মা’ আই স্যুদিং বিয়্যুটিফ্যুল অর্কিড, মা’ লাইফ, মা’ হ্যাপিনেস, মা’ প্যিস, মা’ এভরিথিং!
অ্যানা চোখ বুজে নিলো। মীরের মুখনিঃসৃত কথা গুলো ওর হৃদয় ছুয়ে দিলো যেন৷ শান্ত হয়ে এলো ও পুরোপুরি। কিছুক্ষণ পর মীর ওর কপাল থেকে ঠোঁট সরিয়ে, ওকে নিজের আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করে ওর হাতটা নিজের মুঠির ভেতরে ধরে নিয়ে এগোলো বেদীর দিকে

কেক কাটা শেষে, খাওয়া দাওয়া করে প্রচন্ডরকম হুটোপুটি করে সমুদ্র পাড় টাকে সচকিত করে তুললো বাচ্চারা। বেদীর ওপরে মীরের খোলা বুকে পিঠ ঠেকিয়ে বসে অ্যানা দেখে চলেছে সেসব। আর মীর দেখে চলেছে ওকে। ওর কানের কাছের কোকড়ানো চুল, চোখের ঘন কালো পাপড়ির বার বার ওঠানামা, দ্যুতি ছড়ানো মণী জোড়ার বার বার স্থান পরিবর্তন, টেরাকোটা রঙা ঠোঁট জোড়াতে হাসির উত্থান পতন, বিউটি বোনের চকচকে খাজটা, তার থেকে কিছুটা নিচে মীর কে চুম্বকের মতো টানতে থাকা ক্লিভেজ!
অ্যানার কোমল শরীর টা নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসতে ওর আর তর সইছে না।
অ্যানার কানের কাছে মুখ ঠেকিয়ে ও নেশালো গলায় বলে উঠলো,

— দেরি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু!
বাচ্চাদের হুটোপুটি উপভোগ করতে থাকা অ্যানা চমকে তাকালো মীরের দিকে, তারপর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে প্রশ্ন করলো,
— কিসের?
— সুনামির ন্যায় একটি রোম্যান্সের।
মুখ ভার করে উত্তর করলো মীর। অ্যানা ভ্রুকুটি করে মীরের চোয়ালটা দুহাতের ভেতরে নিয়ে শাসনের ছলে চেপে দিয়ে বলে উঠলো,
— মাথায় শুধু ওসবই ঘোরে তোমার সারাক্ষণ! বাচ্চারা আছে দেখছো না?
অ্যানার কথা শোনা মাত্রই মীর অ্যানার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ওদের থেকে বেশ খানিকটা দূরে কাহিনি করতে থাকা বাচ্চা গুলোর উদ্দ্যেশে উচ্চ স্বরে বলে উঠলো,
— বাচ্চা রা!

মীরের গলার আওয়াজ পাওয়া মাত্রই সকলে যে যার কাজ ফেলে সোজা হয়ে তাকালো মীরের দিকে। আর তার পরমুহূর্তেই কেস টা কি বুঝতে পেরে কোকো ফ্যালকন জোভি হাইনা সকলে ওদের দিকে থেকে চোখ সরিয়ে তাড়াহুড়ো করে চলে গেলো ওদের গাড়ির কাছে৷ লিও লিন্ডাকে নিজের কাঁধে তুলে ছুটলো ওদের পেছন পেছন। আর এরপর সকলে মিলে চাপাচাপি করে গাড়িতে বসে সেখান থেকে দুমদাম করে প্রস্থান করলো। ব্যাপার টা এত দ্রুত ঘটলো যে অ্যানা হা হয়ে দেখলো শুধু, কিছু বলার মতো সুযোগ পেলোনা কাউকে!
ওরা চলে যেতেই চোখ গরম করে মীরের দিকে তাকালো অ্যানা। মীর ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে অ্যানার দিকে ভ্রু তুলে তাকিয়ে রইলো।

— অ্যাই, তুমি ওদের কে এভাবে পাঠিয়ে দিলে! কি ভাববে ওরা?
— আমি তো একবারও ওদের কে চলে যেতে বলিনি!
আগের মতো করেই বলল মীর। অ্যানা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকলো ওর দিকে কিছুক্ষণ, তারপর হঠাৎ করেই মীরের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে ওর গলা চেপে ধরলো। মীর শব্দ করে হেসে উঠলো সাথে সাথে। আর তারপর ওর গলায় থাকা অ্যানার হাত জোড়া দুহাতে ধরে সেদুটোকে একসাথে করে নিজের এক হাতের মুঠির ভেতর ধরলো মীর। এরপর হুট করেই কোলে তুলে নিলো অ্যানকে। তারপর প্রেমময় কন্ঠে বলে উঠলো,
— চলো!
— কোথায়?
ভ্রু তুলে শুধোলো অ্যানা। মীর উত্তরে শুধু একটা মিষ্টি হাসি ফিরিয়ে দিলো ওকে।

এই মুহুর্তে অ্যানা দাঁড়িয়ে আছে শিরো মিদোরি থেকে অনেক অনেক দূরে, সমুদ্রের ভেতরে থাকা একটি ছোট্ট দ্বিপে, কয়েকটি গাছপালা আর একটি ছোট্ট কুঠিবাড়ি ছাড়া সেখানে আর কিছুই নেই। তারই কিনারে, জলরাশির ধারে রাখা একটি চওড়া, সাদা রঙা বিছানা। লাল রঙা গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো সে বিছানার চারপাশে মৃদু নীলরঙের আলোচ্ছটা। বিছানার পাশে হেলান দিয়ে রাখা একটি গিটার।
স্ট্যান্ডের চারপাশটা পাতলা পর্দা দ্বারা আবৃত, সমুদ্র থেকে বয়ে আসা বাতাসের ঝাপটা বারে বারে উড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে সে পর্দা গুলো। বিছানার সিলিং টা স্বচ্ছ পর্দা দ্বারা ঢাকা, নক্ষত্রখচিত আকাশটা সেখান থেকে স্পষ্টতা অস্পষ্টতা মিলিয়ে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে৷
মীর তাকিয়ে ছিলো অ্যানার বিস্মিত, লাজরাঙা মুখ খানার দিকে। কিছুক্ষণ ওভাবে তাকিয়ে থেকে এরপর অ্যানার একেবারে নিকটে এসে ও বলে উঠলো,

— পোশাক টা ভারী লাগলে খুলে দিই?
অ্যানা তাকালো ওর দিকে। তারপর মৃদুভাবে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। মীর সম্মতি পেয়ে গেলো ওদের পেছন দিকে থাকা কুটিবাড়িটার ভেতরে, তারপর সেখান থেকে হাতে একটা প্যাকেট নিয়ে এলো অ্যানার কাছে।
প্যাকেটটা থেকে একটা লেট্যুস কাটিং এর নাইট টপ আর একটা শর্টস বের করলো ও। তারপর অ্যানার শরীর থেকে ভারী গাউন টা খুলে দিয়ে টপ আর শর্টস টা পরিয়ে দিলো। শরীর থেকে বাকি এক্সেসরিজ গুলোও খুলে দিলো একে একে, শুধু কোমরে থাকা হীরকখণ্ড বসানো কোমর বন্ধনী আর পায়ের রুমঝুম শব্দ তোলা পায়েল জোড়া রেখে দিলো। তারপর সেখান থেকে আবারও অ্যানাকে কোলে তুলে নিয়ে মীর হেটে গেলো বিছানার দিকে।
অ্যানাকে মাটিতে পা ঝুলিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে মীর নিজে হাটু গেড়ে বসে পড়লো অ্যানার সামনে, মাটিতে। তারপর ঝুকে অ্যানার উন্মুক্ত উরুতে সশব্দে একটা চুমু খেয়ে অ্যানার সরু কোমর টা দুহাতে জড়িয়ে নিয়ে অ্যানার মুখের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে গাঢ় কন্ঠে বলে উঠলো,

— হ্যাপি অ্যানিভার্সারি মা’ কুয়্যিন!
তারপর কিছুক্ষণ অপলকে অ্যানার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার বলে উঠলো,
— তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ উপহার শিনু! আমার জীবনের গল্পের সবচেয়ে সুন্দর অধ্যায় তুমি, যাকে পড়লেই আমার বুকের ভেতর টা শীতলতায় ছেয়ে যায়, যাকে দেখা মাত্রই আমার হাজার চিন্তায় ভারী হয়ে থাকা মস্তিষ্ক টা সমস্ত চিন্তা মুক্ত হয়ে হালকা হয়ে যায়!
তোমাকে নিজের সাথে বেধে নেওয়ার পর থেকে যত সময় বয়েছে, ততই আমি তোমার প্রেমের গভীরতায় একটু একটু করে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি! জীবনের বাকি দিনগুলোতেও আমি তোমার ভেতরেই হারিয়ে যেতে চাই বার বার! তোমাকে হাজার বার হাজার ভাবে ভালোবাসতে চাই।

আমার জীবনে তোমার মূল্য যে কতখানি সেটা তুমি কখোনোই জানবে না শিনু! আমার এই সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপনে তুমি যে কতখানি অবদান রেখেছো সেটা আমি আর আমার সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কেউ জানে না! আমি আমার জীবনের শেষ মুহুর্ত টা পর্যন্ত তোমার সাথে থাকতে চাই, ঠিক এভাবে।
আমি কখনোই কোনো ঝড়ঝাপটাকে আমাদের একে অপরের থেকে আলাদা করে দিতে দেবো না শিনু! তুমি যতবারই ভুল বুঝে, অভিমান করে আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে ততবারই আমি তোমার কাছে গিয়ে দাড়াবো! তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবো নিজের কাছে।

শুধু একটাই অনুরোধ তোমার কাছে, নিজেকে কখনো এমন কঠিন করে নিও না যেন আমার এই এক আকাশ পরিমাণ ভালোবাসাও তোমার সে অভিমান গলিয়ে দিতে না পারে!
এমন টা যদি কখনো হয় তবে আমি একেবারে মরে যাবো শিনু। তুমি আমার কাছে নেই এটা আমি কখনোই মেনে নিতে পারবো না! কোনোদিনও না এবং কোনো অবস্থাতেই না!
তুমি যখন, যেখানে, যে অবস্থাতেই থাকো না কেন আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তুমি আমার হয়েই থাকবে, শুধুমাত্র আমার! তোমাকে আমি নিজের থেকে দূরে যেতে কখনোই দেখতে পারবো না শিনু!
শেষোক্ত কথা গুলো বলতে গিয়ে গলা ধরে এলো মীরের। অ্যানা ওকে থামিয়ে দিয়ে নিজের কাছে টেনে নিয়ে স্নিগ্ধ প্রেমময়ী কন্ঠে বলল,

— চুপ করো! এসব কথা বলে মন খারাপ করো না! এদিকে আসো, বিছানায় উঠে আসো। তুমি গিটার এনেছো যে! গান শোনাবে না আমাকে?
নিজের চোখের কোণা জোড়া আলতো হাতে মুছে নিলো মীর। তারপর মাটি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে অ্যানার দিকে এক পলক তাকিয়ে গিটার খানা হাতে তুলে নিলো ও। এরপর বিছানায় বসে অ্যানাকে নিজের কোলের ওপর টেনে নিয়ে, গিটার টা অ্যানার কোলে রেখে সেটাতে মৃদু শব্দ তুললো মীর৷ তারপর ওর বুকে মাথা ঠেকিয়ে রাখা অ্যানার কপালে একবার ঠোঁট ছুইয়ে নেশালো কন্ঠে গেয়ে উঠলো,

Yuhi Baras Baras Kaali Ghata Barse
Hum Yaar Bheeg Jaaye
Is Chaahat Ki Baarish Mein
Teri Khuyli Khuli Lato Ko Suljhaaun
Main Apni Ungliyon Se
MainTo Hoon Isi Khwaayish Mein
Sardi Ki Raaton Mein
Hum Soye Rahe Ek Chaadar Mein
Hum Dono Tanha Ho Na
Koi Bhi Rahe Is Ghar Mein
Zara Zara Behekta Hain Mehekta Hain Aaj To Mera
Tan Badan Main Pyaasi Hoon
MujheBhar Le Apni Baahon Mein
Zara Zara Behekta Hain Mehekta Hain Aaj To Mera
Tan Badan Main Pyaasi Hoon
MujheBhar Le Apni Baahon Mein

বাদশাহ নামা পর্ব ৪৩+৪৪

নিজেদের ঘনিষ্ঠ সময়ে অ্যানার কানের কাছে মুখ নিয়ে মীর আজ আবারও বলল,
— যা-ই হয়ে যাক না কেন, তুমি জেনো আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি, শুধুমাত্র তোমাকে ভালোবাসি, আর কাউকে না!
কিন্তু সে কথার মর্মার্থ উদ্ধার করতে পারলো না অ্যানা৷ মীরের বাহুবন্ধনীতে নিজেকে সপে দিলো পুরোপুরি।

বাদশাহ নামা পর্ব ৪৭+৪৮

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here